মাধবীকঙ্কণ/আটাশ

উইকিসংকলন থেকে
আটাশ

 বীরনগরের জমিদারের প্রকাণ্ড অট্টালিকার পার্শ্বে সুন্দর ও প্রশস্ত উপবন দিয়া নদীতীরে আসা যাইত। সেই উপবনে বাল্যকালে নরেন্দ্রনাথ ও হেমলতা দৌড়াদৌড়ি করিত, সেই নদীতীরে বালক বালিকার সঙ্গে খেলা করিত, হাসিত কাঁদিত আবার উচ্চহাস্যে উপবন আমোদিত করিত। আজি সেদিন পরিবর্তিত হইয়াছে, নরেন্দ্রনাথ শান্তিশূন্য-হৃদয়ে দেশে দেশে বেড়াইতেছেন, শ্রীশচন্দ্র শ্বশুরের সম্প্রতি মৃত্যু হওয়ায় জমিদার হইয়াছেন, হেমলতা আজি বালিকা নহেন, নব জমিদারের গৃহিণী।

 সায়ংকালে সেই উপবন দিয়া দুইটি রমণী ঘাটে যাইতেছিলেন। একজন হেমলতা অপরজন শ্রীশচন্দ্রের বিধবী ভগিনী।  হেমলতার বয়ঃক্রম এক্ষণে পঞ্চদশ বর্ষ হইবে, অবয়ব ক্ষীণ, কোমল ও উজ্জ্বল রূপরাশিতে পরিপূর্ণ, নয়ন দুইটি জ্যোতির্ময়, যুগল সুচিক্কণ ও সূক্ষ্ম, গণ্ডস্থল রক্তিমচ্ছটায় আরক্ত, মুখমণ্ডল উজ্জ্বল ও লাবণ্যময়। তথাপি যৌবনপ্রারম্ভে প্রফুল্লতা সে অবয়বে লক্ষিত হয় না, যৌবনের উন্মত্ততা মুখমণ্ডলে দৃষ্ট হয় না। বোধ হয়, যেন সেই সুন্দর ললাটে সেই স্থির চক্ষুদ্বয়ে সে সুচিক্কণ ওষ্ঠে অল্পকালেই চিন্তার অঙ্ক অঙ্কিত হইয়াছে। নয়নের উজ্জ্বল জ্যোতি ঈষৎ স্তিমিত হইয়াছে, মুখমণ্ডলের প্রফুল্প আলোকের উপর জীবনের সন্ধ্যার ছায়া বিক্ষিপ্ত হইয়াছে। যৌবনের সৌন্দর্য ও লাবণ্য দেখিতে পাইতেছি, কিন্তু যৌবনের প্রফুল্লতা কৈ? প্রফুল্লতা থাকিলে কি হেম এরূপ নম্রভাবে ধীরে ধীরে যাইত? ঐ ক্ষুদ্র নতশির পুষ্পটিকে তুলিয়া কি উহার দিকে ঐরূপ স্থরভাবে চাহিত? যে কৃষ্ণবর্ণ সুচিক্কণ কেশপাশে তাহার বদনমণ্ডল ও নয়নদ্বয় ঈষৎ আবৃত হইয়াছে, ধীরে ধীরে সযত্নে সরাইয়া দেখ, নয়নদ্বয়ে জল নাই তথাপি নয়নদ্বয় স্থির, শান্ত, যৌবনোচিত চপলতাশূন্য। নিকটে যাইয়া দেখ হেমলতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছে না, তথাপি যেন ভারাক্রান্ত হৃদয় হইতে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস বহির্গত হইতেছে। অর্ধ-প্রস্ফুটিত কোরকে দুঃখকীট প্রবেশ করে নাই, তথাপি কোরক জীবনাভাবে যেন ঈষৎ শুষ্ক ও নতশির। জীবনের অরুণোদয় যেন মেঘচ্ছায়ায় বিমিশ্রিত।

 শৈবলিনীর বয়ঃক্রম পঞ্চবিংশবর্ষ হইবে। শৈবলিনীর বিধবা অবয়বে যৌবনের রূপ নাই, অনির্বচনীয় পবিত্র গৌরব আছে। মস্তক হইতে নিবিড় কৃষ্ণ কেশপাশ পৃষ্ঠদেশে স্থিত রহিয়াছে, ললাট সুন্দর, চক্ষু বিশাল ও শান্তুপ্রভ, মুখমণ্ডল গভীর অথচ কোমল অবয়ব উন্নত ও বিধবার শুভ্রবসনে আবৃত। শৈবলিনী হেমলতাকে কনিষ্ঠার ন্যায় ভালবাসিত, সস্নেহ-বচনে তাহার সহিত কথা কহিতে কহিতে ঘাটে যাইতেছিল। শৈবলিনীর জীবন যেন মেঘশূন্য, বায়ুশূন্য সায়ংকাল, গভীর নিস্তব্ধ, শান্ত।

 বাল্যকালে হেমলতা নরেন্দ্রনাথের মুখ দেখিলে ভাল থাকিত। যৌবন প্রারম্ভে নরেন্দ্রনাথ হেমলতার হৃদয়ে স্থান পাইয়াছিল, হেমলতা বুঝিতে পারে নাই কিন্তু তাহার হৃদয় নরেন্দ্রনাথপূর্ণ হইয়াছিল। যখন সেই নরেন্দ্রের সহিত চিরবিচ্ছেদ হইল যখন হেম আর একজনের সহধর্মিণী হইয়া প্রতিমাকে হৃদয় হইতে বিসর্জন দিতে বাধ্য হইল, তখন প্রেম কি পদার্থ, হেম বুঝিতে পারিল তখন মর্মভেদী দুঃখ আসিয়া হেমের হৃদয় বিদীর্ণ করিতে লাগিল। বালিকা সরলা নবোঢ়া বধূ, সে কথা কাহার কাছে বলিবে? সে দুঃখ কাহার কাছে জানাইবে?

 শৈবলিনী পঞ্চবর্ষের সময়েই বিধবা হইয়াছিল, শ্বশুরালয়েই থাকিত, কখন কখন ভ্রাতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিত। শৈবলিনী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী, দুই তিনবার বীরগ্রামে আসিয়াই হেমলতার অন্তরের ভাব কিছু কিছু বুঝিতে পারিল মনে মনে সঙ্কল্প করিল “যদি বালিকাকে আমি যত্ন না করি, বোধ হয় ভ্রাতার সংসার ছারখার হইয়া যাইবে।” শৈবলিনী সেই অবধি বীরগ্রামে রহিল।

 শৈবলিনীর সস্নেহ ব্যবহারে ও প্রবোধবাক্যে হেমলতার দুঃখভাব কিঞ্চিৎ হ্রাস পাইল। শৈবলিনী মানবচরিত্র বিশেষ বুঝিত, একবারও হেমকে তিরস্কার করিত না, কনিষ্ঠা ভগিনীকে যেন প্রবোধ-বাক্যে সান্ত্বনা করিত। তাহার সারগর্ভ স্নেহপরিপূর্ণ কথায় কোন্ দুঃখীর দুঃখ না বিদূরিত হয়। শৈবলিনী গল্প করিতে অতিশয় পটু, সর্বদাই হেমলতাকে পুরাণের গল্প বলিত। সে পবিত্র মুখে পবিত্র গল্প শুনিতে শুনিতে হেমলতার রজনীতে নিদ্রা বিস্মরণ হইত। গভীর রজনী, গভীর বন, চারিদিকে বৃক্ষের অন্ধকার দেখা যাইতেছে, বায়ুর শব্দ ও হিংস্র জন্তুর নাদ শুনা যাইতেছে। রাজকন্যা দয়মন্তী অদ্য স্বামীর প্রেমকে একমাত্র অবলম্বন করিয়া ধন মান রাজ্য তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া, সুখে জলাঞ্জলি দিয়া, ভিখারিণীর বেশে বিচরণ করিতেছে। স্বামী তৃষ্ণার্ত হইলে গণ্ডুষ করিয়া জল দিতেছে, স্বামী বস্ত্রহীন হইলে আপন বস্ত্র দিতেছে স্বামী পরিশ্রান্ত হইলে আপন অঙ্কে তাঁহার মস্তক স্থাপন করিয়া স্বয়ং অনিদ্র হইয়া উপবেশন করিয়া আছে। সেই স্বামী যখন মায়া বিচ্ছিন্ন করিয়া অভাগিনীকে ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইল তখনও অভাগিনীর স্বামী-চিন্তা ভিন্ন এ জগতে আর চিন্তা নাই, স্বামীর পুনর্মিলন ভিন্ন এ জগতে আর আশা নাই।

 অথবা সেই মহর্ষি বাল্মীকির কুটীরে চিরদুঃখিনী বৈদেহী হস্তে গণ্ডস্থাপন করিয়া এখনও হৃদয়েশ্বরকে চিন্তা করিতেছে। সম্মুখে পুত্র দুইটি খেলা করিতেছে তাহাদিগের মুখ অবলোকন করিতেছে, আবার শ্রীরামের চিন্তা করিতেছে। যিনি নিরাশ্রয়া, নিষ্কলঙ্কা, অন্তঃস্বত্ত্বা রাজকন্যা, রাজরানী চিরনির্বাসিত করিয়াছেন, সেই নিষ্ঠুর পতিকেও অদ্যাবধি হৃদয়ে স্থান দিয়া অভাগিনী চিন্তা করিতেছে সেই পতিই সীতার জীবনের জীবন, হৃদয়ের সর্বস্ব ধন। পতিব্রতার কী মাহাত্ম্য?

 রজনী তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত হেমলতা তাহার ধর্মপরায়ণা ননদিনীর নিকট এই সকল পুণ্যকথা শুনিত। দুঃখকথা শুনিয়া হেমলতার হৃদয় আলোড়িত হইত, ননদিনীর হৃদয়ে বদন ঢাকিয়া দরবিগলিত ধারায় রোদন করিত; আবার মুখ তুলিয়া সেই পবিত্র কথা শুনিত, আবার শোকাকুলা হইয়া অবারিত অশ্রুজল ত্যাগ করিত। হেমলতা ভাবিত সংসারে সকলেই দুঃখিনী, পুণ্যাত্মা সীতা দুঃখিনী, ধর্মপরায়ণা সাবিত্রী দুঃখিনী, আমি কি অভাগিনী যে নিজ দুঃখবিহ্বলা হইয়া রহিয়াছি। তাঁহারা সাধ্বী ছিলেন, পতিব্রতা ছিলেন, অভাগিনী হেমলতা আজও নরেন্দ্রের চিন্তা করে, দেবতুল্য স্বামীকে বিস্মৃত হইয়াছে। আমি অবলা, আমার বল নাই। ভগবান সহায় হও, পাপচিন্তা হৃদয় হইতে উৎপাটিত কর, অবলার যতদূর সাধ্য চেষ্টা করিবে।

 শৈবলিনীর অপরূপ স্নেহ ও প্রবোধবাক্যে হেমলতা ক্রমশ শান্তিলাভ করিল, হৃদয়ের প্রথম প্রেমস্বরূপ ভীষণ শেল উৎপাটিত হইল কিন্তু অনেক দিনে, অনেক চেষ্টায়, অনেক পরিশ্রমে সে ফললাভ হইল। সেই পরিশ্রম ও চেষ্টায় যৌবনের প্রফুল্লতা শুরু হইয়া অবয়বে চিন্তার রেখা অঙ্কিত হইল হেমলতা আজি আর দুঃখিনী নহে, কিন্তু স্বভাবত ধীর নম্র ও নতশির।

 এক্ষণে হেমলতা ও শৈবলিনী সর্বদাই নরেন্দ্রের কথা কহিত, বাল্যকাল হইতে শৈবলিনী নরেন্দ্রকে ভ্রাতা বলিত এখন যেমন তাহাকে ভ্রাতার স্বরূপ জ্ঞান করিত। ভ্রাতার বিপদে বা অবর্তমানে ভগিনীর চিন্তা হয়, হেমও নরেন্দ্রের জন্য ভাবিত, কিন্তু তাহার হৃদয় আর পূর্ববৎ বিচলিত হইত না; কিম্বা যদি কখন কখন সায়ংকালে এই উপবনে একাকিনী বিচরণ করিতে করিতে হেমের বাল্যকালের কথা মনে পড়িত, ভাগীরথীর কলকল শব্দ শুনিয়া নীল গগনমণ্ডলে উজ্জ্বল পূর্ণচন্দ্র দর্শন করিয়া, শীতল হরি কুঞ্জবনে উপবেশন করিয়া বাল্যকালে সঙ্গীত-কথা মনে পডিত, যদি সে কথা মনে পড়িয়া হেমের চক্ষে একবিন্দু জল লক্ষিত হইত,—পাঠক, তাহার ভ্রাতৃস্নেহের নিদর্শন স্বরূপ বলিয়া মার্জনা করিও। অন্য ভাব তিরোহিত করিবার জন্য হেম অনেক চেষ্টা করিয়াছে, অনেক সহ্য করিয়াছে, অভাগিনী অনেক কাঁদিয়াছে, সে ভাব তিরোহিত হইয়াছে, যদি হৃদয়ের কন্দরে অজ্ঞাতরূপে সে ভাবের একবিন্দুও লুক্কায়িত থাকে, পাঠক, সেটুকু অভাগিনী হেমকে ক্ষমা করিও।