মাধবীকঙ্কণ/আঠার

উইকিসংকলন থেকে
আঠার

 যশোবন্তসিংহের অবশিষ্ট অল্পসংখ্যক সেনা রাজপুতানা অভিমুখে আসিতে লাগিল। নরেন্দ্র তাঁহার পরম বন্ধু গজপতির মরণে অতিশয় দুঃখিত ও ক্লিষ্ট হইলেন, কিন্তু প্রত্যহ নূতন নূতন দেশ দেখিতে দেখিতে সে দুঃখ কিঞ্চিৎ পরিমাণে বিস্মৃত হইলেন। কয়েকদিন আসিতে আসিতে সৈন্যেরা অবশেষে রাজপুতানার অভ্যন্তরে আসিয়া পড়িল। যশোবন্তসিংহ মাড়ওয়ার দেশের রাজা, সে দেশে আসিতে হইলে মেওয়ার দেশের অভ্যন্তর দিয়া আসিতে হয়।

 মেওয়ার দেশের অসংখ্য দুর্গ দেখিয়া নরেন্দ্র বিস্মিত হইলেন। দুর্গগুলি প্রায়ই পর্বতচূড়ায় নির্মিত, সহসা হস্তগত করা শত্রুর দুঃসাধ্য। পর্বতগুলি উন্নত শিরে মুকুটস্বরূপ দুর্গ ধারণ করিয়া অপুর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। সে সমস্ত দুর্গে উঠিবার পথ নাই, কেবল একদিকে সোপানের ন্যায় পথ আছে, তাহার উপর দিয়া লোক গমনাগমন করে। যুদ্ধকালে দুর্গের ভিতর খাদ্যসামগ্রী সঞ্চিত হয়, সেই একটিমাত্র দ্বার রুদ্ধ হয়, পরে শত্রুগণ যাহাই করুক না, দুর্গবাসিগণ নিশ্চিন্তে থাকিতে পারে।

 শত্রুরা দুর্গে উঠিবার উপক্রম করিলে উপর হইতে প্রস্তররাশি নিক্ষিপ্ত হয়, ঐ প্রস্তরাঘাতে একেবারে বহুসংখ্যক শত্রু বিনষ্ট হয়।  এইরূপ দুর্গ দেখিতে দেখিতে সৈন্যের শেষে একদিন সন্ধ্যার সম্ম চিতোরের দুর্গের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। সৈন্যরা আহারাদি সমাপ্ত করিয়া আপন আপন শিবিরে বিশ্রাম করিতে গেল কিন্তু নরেন্দ্র কতিপয় রাজপুতের সহিত চিতোর পর্বতে উঠিয়া তাহার উপরিস্থ দুর্গে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। নরেন্দ্র বিস্মিত নয়নে কুম্ভ রাজার সুন্দর স্তম্ভ দেখিলেন, পদ্মিনী রাজ্ঞীর প্রাসাদে ও সরোবর দেখিলেন, যে সিংহদ্বারে রাজপুত যোদ্ধগণ বার বার অসিহস্তে জীবনদান করিয়াছেন, তাহা দেখিলেন, যে চিতায় রাজপুত- রমণীগণ চিতারোহণ কুল মান রক্ষা করিয়াছেন, সেই চিতার গহ্বর দেখিলেন।

 সহসা তাঁহাদের সম্মুখে একজন বৃদ্ধ মনুষ্য আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজপুতদিগের মধ্যে কেহ কেহ তাহাকে চিনিতে পারিলেন, তিনি চিতোরের পুরাতন ‘চারণ'। চারণগণ। পূর্বকালে রাজপুতানার রাজাদিগের গৌরবগীত গাহিয়া রাজপুরুষ ও নগরবাসীদের মনোরঞ্জন করিতেন; রাজপুতানায় এখন পর্যন্ত সন্ধ্যার সময়ে লোকে সমবেত হইয়া চারণের গীত শুনিতে ভালবাসে, পূর্ব-গৌরবগান শুনিতে শুনিতে তাহাদিগের নয়ন বীরশ্রুতে আপ্লুত হয়।

 নরেন্দ্র ও তাঁহার সঙ্গী রাজপুতগণ চারণকে একটি শিলার উপর বসাইলেন ও আপনারা চারিদিকে বলিয়া প্রতাপসিংহের গান শুনিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। চারণ সেই গান আরম্ভ করিলেন।

 “রাজপুতগণ। এটি আমার গীত নহে, অম্বর গর্জন-প্রতিঘাতী পর্বতশৃঙ্গের গীত, বজ্রনাদ জলপ্রপাতের গীত, তোমরা শ্রবণ কর। যে পর্বতকন্দরে একজন রাজপুতসেনার অস্থি পড়িয়া রহিয়াছে, সেই গহ্বর হইতে এই গীত বহির্গত হইতেছে। যে পূর্বতরঙ্গ বাহিনীর জল রাজপুতের একবিন্দু শোণিতেও আরক্ত হইয়াছে, সেই তটিনীর কুলে এই ধ্বনিত হইতেছে। প্রতাপসিংহ। এটি তোমার গীত।

 ঐ দেখ, আকবরের ভীষণ প্রতাপে সমগ্র ভারতবর্ষ কম্পিত হইতেছে, কিন্তু প্রতাপের হৃদয় কম্পিত হইল না। চিতের নগর আর তাহার নাই, তাঁহার পিতার রাজত্বকালে নিষ্ঠুর আকবর চিতোর কাড়িয়া লইয়াছেন। দুর্গক্ষোর্থ জয়মল্ল জীবন দিয়াছিল, পড়ে মাতা ও বনিতা স্বহস্তে যুদ্ধ করিয়া জীবাদান করিয়াছিল, তথাপি রাজপুতের বক্ষস্থল বিদীর্ণ করিয়া আকবর চিতোর কাড়িয়া লইলেন। প্রতাপ যখন রাজা হইলেন, তখন চিতোর নাই, সৈন্য নাই, অর্থ নাই, কিন্তু তাহার বীরান্তঃকরণ ছিল, বীরের দুঃসাধ্য কি আছে? প্রবলতাপাদ্বিত রাজপুতরাজগণ দিল্লীর দাসত্ব স্বীকার করিলেন, প্রতাপ করিলেন না। অম্বরের ভগবানদাস ও মাড়ওয়ারের মল্লদেব নিজ নিজ দুহিতাকে দিল্লীর সম্রাটহস্তে অৰ্পণ করিলেন, মহানুভব প্রতাপ ম্লেচ্ছের কুটুম্ব হইতে অস্বীকার করিলেন। কেন

স্বীকার করিবেন? মেওয়াৱাধিপতিরা সূর্যবংশাবতংস, সে উন্নত বংশ কে কলুষিত করিবেন?

 সাগরতরঙ্গের ন্যায় দিল্লীর সেনা মেওয়ার প্লাবিত করিল, তাহার সঙ্গে— হা জগদীশ এ লজ্জার কলঙ্ক কেন রাজস্থানের ললাটে অঙ্কিত করিলে?—তাহার সঙ্গে রাজপুতরাজগৎ যোগ দিলেন। মাড়ওয়ার, অম্বর, বিকানী, বুলী প্রভৃতি নানা দেশের রাজারা আপনা দিগের দাসত্বের কলঙ্ক অপনীত করিবার জন্য প্রতাপকেও দিল্লীর দাস করিবার জনা আকবরের সহিত যোগ দিলেন। অম্বরের মানসিংহ প্রতাপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন, মহানুভর প্রতাপ ম্লেচ্ছের কুটুম্বের সহিত ভোজন করিতে অস্বীকার করিলেন। সবোষে মানসিংহ দিল্লী যাইয়া অসংখ্য সেনা তরঙ্গে মেওয়ার দেশ প্লাবিত করিলেন। মানসিংহ। তুমি কাবুল হইতে বঙ্গদেশ পর্যন্ত সমস্ত ভারতবর্ষে বিজয়-পতাকা উড্ডীন করিয়া শত্রুদমন করিয়াছিলে,—কাহার জন্যে? হায়। ম্লেচ্ছের অধীন হইয়া রাজপুত নাম ডুবাইলে? ম্লেচ্ছের পদরজঃ রাজপুতের ললাটে কী সুন্দর শোভা পাইতেছে।

 অন্ধকারে ঐ জলপ্রপাতের ভীষণ তেজ দেখিতে পাইতেছ? না, তোমরা পাইবে না, কিন্তু আমি অন্ধকারে থাকি, আমি দেখিতেছি। উহার মধ্যস্থলে উন্নত শিলাখণ্ড সগর্বে দণ্ডায়মান রহিয়াছে, জলপ্রপাতেও কম্পত হইতেছে না। জলপ্রপাত অপেক্ষা অধিক তেজে সাগরগর্জনে মোগল-সৈন্য আসিয়া মেওয়ার দেশ প্লাবিত করিল, শিলাখণ্ডের ন্যায় সগর্বে প্রতাপ দণ্ডায়মান ছিলেন। হল্দিঘাটে মহাযুদ্ধ হইল, সেনাদিগের রব পর্বতকন্দর হইতে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। আকাশে উর্থিত হইয়া যেত হইতে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। কিন্তু সাহসে কি হইবে? মোগলেরা অসংখ্য সেনা! দ্বাবিংশ সহস্র রাজপুতের মধ্যে কেবল অষ্ট সহস্র লইয়া প্রতাপ পলায়ন করিলেন, অবশিষ্ট হল্দিঘাটের ভীষণ উপত্যকায় চিরনিদ্রায় নিদ্রিত রহিলেন।

 এই কি একবার? বৎসর বৎসর এইরূপ সংগ্রাম হইল, বৎসর বৎসর প্রচুর সেনা, ন রাজ্য হ্রাস পাইতে লাগিল; বৎসর বৎসর তাহার জীবনাকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হইতে লাগিল; কিন্তু তাহার বীরত্ব হ্রাস পাইল না। তিনি দিল্লীর দাস হইলেন না।

 রাজপুত! তোমাদের চক্ষুতে যদি জল থাকে, বিসর্জন কর, হৃদয়ে যদি শোণিত কে বিসর্জন কর। ঐ দেখ, প্রতাপের রাজধানী পর্বতকরে শয়ন করিয়া রহিয়াছেন। আকাশ মেঘাচ্ছন, মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছে, রাজধানী পর্বতন্দরে শয়ন করিয়া আছেন, প্রতাপ খড়গহস্তে জাগরিত হইয়া আছেন। ঐ দেখ, বৃক্ষ হইতে রজ্জু লম্বিত হইতেছে। কাষ্ঠাসনে কি দুলিতেছে জগদীশ। রাজার শিশু-পুত্রের ঝুলিতেছ, নীচে রাখিলে হিংস্র জন্তু লইয়া যাইবে। ঐ দেখ, প্রতাপের পুত্রবধু শুস্ক পত্র জালাইয়া খাদ্য প্রস্তুত করিতেছেন, রুটি প্রস্তুত হইল, সকল খাইও না, অর্ধেক খাও, অর্ধেক রাখিয়া দাও, আবার ক্ষুধা পাইলে কোথায় পাইবে? ঐ শুন, ক্রন্দনধ্বনি শ্রুত হইল। একটি বালিকার হস্ত হইতে বন্য বিড়াল রুটি কাড়িয়া লইয়া গেল, রাজকন্যা ক্ষুধায় চীৎকার করিয়া ক্রন্দন করিতেছে!

 রাজপুত। প্রতাপের জয়গীত গাও, তিনি পঞ্চবিংশ বৎসর মোঘলদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন, পর্বতশিখরে বাস করিয়াছেন। পর্বত উপত্যকায় যুদ্ধ করিয়াছেন, পর্বতকন্দরে পরিবারকে পালন করিয়াছেন; তথাপি ইহজন্মে আকবরের অধীনতা স্বীকার করেন নাই। পর্বতে পর্বতে এই গীত প্রতিধ্বনিত হইতে থাকুক, সমগ্র রাজস্থানে এই গীত শব্দিত হইতে থাকুক, হিমালয় হইতে প্রতিহত হইয়া সাগরবারি পর্যন্ত সঞ্চরণ করুক, হিমালয় অতিক্রম করিয়া সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হউক, আর যদি স্বর্গে সাহস ও স্বদেশানুরাগের গৌরব থাকে, এই গীত আকাশপথে উত্থিত হইয়া স্বর্গের দ্বারে আঘাত করিয়া মানবের যশঃকীর্তি বিস্তার করুক!”

 চারণের ভীষণ গর্জন শুনিয়া সকলেই স্তম্ভিত হইয়া রহিল। ক্ষণপরে সকলেই চাহিয়া দেখিল, চারণ নাই। তাঁহার চিহ্নমাত্রও নাই, কেবল আকাশে মেঘরাশি ভীষণ গর্জন করিয়া যেন তাঁহার ভয়াবহ গীত বার বার ধ্বনিত করিতে লাগিল।

 রাজপুতেরা স্বদেশের পূর্বগৌরব স্মরণ করিতে করিতে উৎসাহে হুঙ্কার করিয়া উঠিল, যোদ্ধাদিগের চক্ষু বীরাশ্রুতে ছল ছল করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পর তাহারা উঠিয়া আপন শিবিরে প্রস্থান করিল। নরেন্দ্র তাহাদের সহিত প্রস্থান করিলেন না, তিনি হস্তে গণ্ডস্থল স্থাপন করিয়া সেই মেঘাচ্ছন্ন রজনীতে ভীষণ চিতোর দুর্গের তলে বসিয়া কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। মেঘ ক্রমে গাঢ়তর হইয়া আসিতেছে, নরেন্দ্র প্রস্থান করিলেন না। আকাশের প্রান্ত হইতে প্রান্ত পর্যন্ত উজ্জ্বল বিদ্যুল্লতা জগৎ ও গগনমার্গ চমকিত করিতে লাগিল, রহিয়া রহিয়া মেঘ ভীষণ গর্জনে পৃথিবী কম্পিত করিতে লাগিল, রহিয়া রহিয়া নৈশ বায়ু ভীষণ উচ্ছ্বাসে বহিতে লাগিল, নরেন্দ্র প্রস্থান করিলেন না।

 নরেন্দ্র ভাবিতে লাগিলেন, স্বদেশেও মহাবল-পরাক্রান্ত রাজারা আছেন, তবে সুদূর বঙ্গদেশের এ দুর্দশা কেন? যুদ্ধই রাজপুতদের ব্যবসা; বালক, বৃদ্ধ সকলেই যুদ্ধশিক্ষা করে, তাহারা ধন দিয়াছে, ঐশ্বর্য দিয়াছে, প্রাণ দিয়াছে, তথাপি স্বাধীনতা বিসর্জন দেয় নাই। তাহাদের গ্রাম দগ্ধ হইয়াছে, নগর লুণ্ঠিত হইয়াছে, দুর্গ শত্রুহস্তে পতিত হইয়াছে, তথাপি তাহারা গৌরব বিসর্জন দেয় নাই। সে গৌরবগীত আজিও আরাবল্লীর কন্দরে ও উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। আর বঙ্গদেশ। বেগপ্রবাহিনী গঙ্গানদী তাহার গৌরবগীত গায় না, ব্রহ্মপুত্র স্বাধীনতার গীত গায় না, রাজা-প্রজা সকলেই বড় সুখে নিদ্রা যাইতেছে। জগতে তাহাদের নাম নাই, বীরমণ্ডলীর মধ্যে তাহাদের স্থান নাই।”