মাধবীকঙ্কণ/চার

উইকিসংকলন থেকে
॥ চার॥

 পূর্বোপ্লিখিত ঘটনাবলীর পর চারি বৎসরকাল অতিবাহিত হইল। চারি বৎসরে কিরূপ পরিবর্তন হয়, পাঠক মহাশয় তাহা অনুভব করিতে পারেন।

 শ্রীশচন্দ্র এক্ষণে সপ্তদশ বৎসর বয়ঃক্রমের যুবক, ধীর শান্ত, বিচক্ষণ, ধর্মপরায়ণ। তাহার প্রশস্ত উদার মুখমণ্ডল ও উন্নত অবয়ব দেথিলেন গম্ভীর প্রকৃতি ও স্থিরবুদ্ধি জানিতে পারা যায়।

 নরেন্দ্র পঞ্চদশ বর্ষের উগ্র যুবা, শ্রীশ অপেক্ষাও উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, উন্নতকায় ও তেজস্বী কিন্তু অতিশয় উগ্র, ক্রোধপরবশ ও অসহিষ্ণু। নবকুমারের ঘৃণা সে সহ্য করিতে পারিত না, শ্রীশচন্দ্রের যথার্থ গুণের কথাও সে সহ্য করিতে পারি না, সর্বদা তাহার মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করিত। এখনও পর্যন্ত যে নরেন্দ্র এ সমস্ত সম্ভ করিয়াছিল, সে কেবল হেমলতার জন্য। মরুভূমিতে একমাত্র প্রস্রবণের ন্যায় হেমলতার অমৃতমাখা মুখখানি নরেন্দ্রের উত্তপ্ত হৃদয় শান্ত ও শীতল করিত, হেমলতার জন্য নরেন্দ্র নবকুমারের তিরস্কারও সহ্য করিত, আপন বিজাতীয় ক্রোধ সংবরণ করিত।

 হেমলতা ক্রয়োদশবর্ষের বালিকা। আকাশে প্রথম উষাচিহ্নের ন্যায় প্রথম যৌবনচিহ্ন হেমলতার শরীরে প্রকাশ পাইতেছে। নিবিড় কৃষ্ণ কেশরাশি লম্বমান হইয়া বক্ষস্থল ও গণ্ডস্থল আবরণ করিতেছে, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ যৌবনাবন্তে অধিকতর উজ্জ্বল আভায় প্রকাশ পাইতেছে, সুন্দর আয়ত নয়ন দুইটি বাল্যকাল-সুলভ চাঞ্চল্য পরিত্যাগ করিয়া এক্ষণে ধীর ও শান্ত ভাব ধারণ করিয়াছে; সমস্ত অবয়বও ক্রমে পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতেছে।

 সেই সুগঠিত, কুসুম-বিনিন্দিত শরীরে কি নব নব ভাব প্রকাশ করিয়াছে, তাহা বর্ণনায় আমরা অক্ষম; তবে হেমলতার আচরণে যাহা লক্ষিত হয়, তাহাই বলিতে পারি। হেম এখনও নরেন্দ্রের সহিত কথাবার্তা কহিতে বড় ভালবাসে, কিন্তু বালিকা অধোবদনে ধীরে ধীরে কথা কহে, ধীরে ধীরে নরেন্দ্রের মুখের দিকে নয়ন উঠাইয়া আবার মস্তক অবনত করে। আহা, সে আয়ত প্রশান্ত নয়ন দুইটি নরেন্দ্রের মুখের উপর চাহিতে বড় ভালবাসে। সেই বালিকার ক্ষুদ্র হৃদয় নরেন্ত্রের কথা ভাবিতে বড় ভালবাসে। যখন সায়ংকালে নরেন্দ্র নৌকায় আরোহণ করিয়া গঙ্গার প্রশান্ত বক্ষে ইতস্তত বিচরণ করে, বালিকা গবাক্ষপার্শ্বে বসিয়া স্থির নয়নে তাহাই দেখে, যখন নৌকা অনেক দূর ভাসিয়া যায়, সন্ধ্যার অপরিস্ফুট আলোক যতদূর দেখা যায়, বালিকা সেই গঙ্গার অনন্ত বোত নিরীক্ষণ করে। সন্ধ্যার পর বাটা আসিয়া যখন নরেন্দ্র ‘হেম’ বলিয়া কথা কহিতে আইসে, তখন সেই আনন্দদায়িনী কথায় হেমের হৃদয় ঈষৎ নৃত্য করিয়া উঠে। যখন দুই-একদিনের জন্যও নরেন্দ্র ভিন্ন গ্রামে গমন করে, তখন প্রাতে, মধ্যাহ্নে, সায়ংকালে হেম অন্যমনা হইয়া থাকে।

 তথাপি হেমের মনের কথা কেউ জানে না। কপোতী যেরূপ আপন শাবকটিকে অতি যত্নে কুলায় লুকাইয়া রাখে, বালিকা এই নূতন ভাবনাটিকে অতি সঙ্গোপনে হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকাইয়া রাখিত। বালিকা নিজেও সে ভাবটি ঠিক বুঝিতে পারিত না, না বুঝিয়াও সে প্রিয় ভাবটি সযত্নে জগতের নিকট হইতে সঙ্গোপন করিত।

 বৃদ্ধ নবকুমার হেমকে এখনও বালিকা মনে করিতেন, সেই বালিকার উদার সরল মুখখানি দেখিলে কেনই বা মনে না করিবেন? বিবাহ দিলে একমাত্র কন্যা পরের হইবে, এই ভয়ে যতদিন পারিলেন, বিবাহ না দিয়া রাখিলেন। শ্রীশচন্দ্রও হেমের হৃদয়ের পরিচয় পাইল না, কিরূপেই বা পাইবে? হেম তাহার সহিত সর্বদাই সরল-হৃদয়ে নিঃসংকোচে কথা কহিত। শ্রীশচন্দ্রের নিকট প্রত্যহ কিছু কিছু পড়িতে শিখিত, পাঠ বলিয়া যাইত, পড়া হইলে পড়া দিত, যত্নের সহিত শ্রীশচন্দ্রের উপদেশবাক্য গ্রহণ করিত। নরেন্দ্র পড়াইতে আসিলে বালিকা মনঃস্থির করিতে পারিত না, নরেন্দ্র পড়া লইতে আসিলে বালিকা ভাল করিয়া বলিতে পারিত না, সমস্ত ভুল যাইত। সংসার-কার্যের তাবৎ ঘটনাই যেন শ্রীশচন্দ্রের নিকট বলিত, শ্রীশের উপদেশ ভিন্ন কোন কার্য করিত না। নরেন্দ্র উপদেশদাতা নহেন, নরেন্দ্র আসিলে অন্য কথা হইত অথবা অনেক সময় কথা হইত না; সুতরাং শ্রীশ মনে করিত যে, বালিকার হৃদয়ে যেটুকু প্রণয় বা স্নেহ আছে তাহা শ্রীশকেই অবলম্বন করিয়াছে।