মাধবীকঙ্কণ/বত্রিশ

উইকিসংকলন থেকে
বত্রিশ

 “নরেন্দ্র! ভালবাসিয়াছি। যে হিন্দুরমণী তোমার প্রণয়ের পাত্রী, তাহাকেও আমি দেখিয়াছি। কিন্তু তুমি কখনও ভালবাসার জন্য দেওয়ানা হও নাই। আমার তাতারদেশে জন্ম, তথাকার সকলেই উগ্রস্বভাব, আমিও বাল্যকাল হইতেই অতিশয় উগ্রস্বভাব ছিলাম। আমি ক্রুদ্ধ হইলে বালকগণও ক্রীড়া পরিত্যাগ করিয়া বালিকার নিকট হইতে দূরে সরিয়া যাইত। একটি যুদ্ধে আমার পিতা হত হয়েন, আমি রুদ্ধ হইয়া বাঁদী অবস্থায় দিল্লীর সম্রাটের নিকট বিক্রীত হইলাম। স্বাধীনতা গেল, কিন্তু উগ্রস্বভাব গেল না। বোধ হয়, ভারতবর্ষের উষ্ণতর সূর্যতাপে আমার শোণিত ক্রমশ উষ্ণতর হইল। প্রাসাদে তাতার-রমণীদিগের কি কাজ, বোধ হয় তুমি জান না। আমরা বেগমদিগের মহল রক্ষা করি, খড়্গ ও ছুরিকা ব্যবহারে আমরা অপটু নহি, বেগমদিগের আদেশে কত শত ভয়ঙ্কর কার্য সম্পাদন করি, তাহা জগৎসাধারণ কি জানিবে? আমি এ সমস্ত ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া সকলের অসাধ্য কার্যও সাধন করিতাম। আমার এই গুণের জন্যই সাহেব বেগম আমার এরূপ ক্রোধ সহ্য করিতেন।

 যখন দিল্লী পরিত্যাগ করিয়া আমি তোমার সহিত আসিলাম, আমার স্বভাব কিছুমাত্র কিছুমাত্র অন্যথা হইল না, দেওয়ানা হইয়া তোমার সহিত আসিলাম।

 উদয়পুরের হ্রদে নৌকা করিয়া সন্ধ্যার সময় চন্দ্রলোকে বেড়াইতে যাইতে স্মরণ হয়? তোমাকে সর্বদাই চিন্তিত দেখিতাম, কিন্তু তুমি কি ভাবিতে, স্থির করিতে পারিতাম না। একদিন আমি নৌকায় বসিয়াছিলাম, তুমি আমার স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া শুইয়াছিলে ও চন্দ্রের দিকে দেখিতেছিলে, স্মরণ হয়? আমি সমস্ত সময় তোমার চন্দ্রকরোজ্জ্বল মুখের দিকে চাহিয়াছিলাম, তোমার কেশবিন্যাস করিয়া দিয়াছিলাম, তোমার অঙ্গুলি লইয়া খেলা করিতেছিলাম। সহসা তুমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলে, হেম। আর কি তোমাকে এ জীবনে দেখিতে পাইব? আমি বঙ্গভাষা ভাল জানি না, কিন্তু এ কথা বুঝিলাম। আমার মনে সন্দেহ জাগ্রত হইল।  স্ত্রীলোকের মনে একবার সন্দেহ উদয় হইলে তাহা শীঘ্র তিরোহিত হয় না। দিবারাত্র তোমার হেমের কথা জানিতে উৎসুক থাকিতাম, তোমার কাগজপত্র চুরি করিয়া পড়াইয়া লইতাম, কথায় কথায় তোমার নিকট হইতে বীরনগরের সমস্ত কথা বাহির করিয়া লইতাম। তখন তোমার হেমকে তোমার মন হইতে দূর করিয়া সেই স্থান অধিকার জন্য আমার হৃদয় জ্বলিতে লাগিল।

 তোমার হিন্দু ধর্মে আস্থা দেখিয়া আমি একলিঙ্গ-মন্দিরের গোস্বামীদিগের নিকট আপনার ইষ্টলাভের জন্য যাইতাম। প্রথমে যাঁহার নিকট যাইলাম, তিনি পরম তেজস্বী ও ধার্মিক, আমার সমস্ত প্রস্তাব শুনিয়া আমাকে পদাঘাত করিয়া তাড়াইয়া দিলেন। এইরূপে তিন চারিজনের নিকট অপমানিত হইয়া অবশেষে সেই শৈলেশ্বরের নিকট যাইলাম। তিনি অনেক অর্থলোভে সম্মত হইলেন। আমি তৎক্ষণাৎ তিন শত মুদ্রার একটি হীরক-বলয় তাঁহার হাতে দিলাম আর সহস্র মুদ্রার একটি মুক্তামাল্য তাঁহার সম্মুখে দোলাইয়া বলিলাম, “যদি ছলে বলে কৌশলে নরেন্দ্রকে হেমলতার চিন্তা ত্যাগ করাইতে পার, মুসলমান ধর্ম অবলম্বন করাইতে পার, আমাকে গ্রহণ করাইতে পার, তবে এই মুক্তাহার তোমার গলায় স্বহস্তে পাইয়া দিব।”

 এত অর্থ কোথায় পাইলাম, জিজ্ঞাসা করিবে? জেহান-আরার দাসদাসীরও অর্থের অভাব ছিল না। দেশের বড় বড় লোক সম্রাটের নিকট কোন আবেদন করিতে আসিলে বেগম-সাহেবাকে উপঢৌকন না দিলে কোন কার্যই সম্পাদিত হইত না। কেহ একটি উচ্চকর্মের প্রার্থী, কেহ একটি বিষয়ের প্রার্থী, কেহ প্রজার উপর অত্যাচার করিয়াছেন, তাহার ক্ষমা চাহেন, কেহ পরের জায়গীর কাড়িয়া লইয়াছেন, তাহার একটি সনন্দপত্র চাহেন, কোন যোদ্ধা যুদ্ধে পরাস্ত হইয়াছেন, তাহার ক্ষমাপ্রার্থী, কাহারও উপর সম্রাটের অন্যায় ক্রোধ হইয়াছে, সে ক্রোধ হইতে নিস্তার পাওয়া আবশ্যক; সকলেই রাশি রাশি হীরা মুক্তা ও অর্থ বেগম-সাহেবার নিকট পাঠাইয়া দিয়া আপন আপন আবেদন জানাইতেন। বেগম-সাহেবার দাসীরাও অর্থে বঞ্চিত হইত না।

 তাহার পর শৈলেশ্বর যে যে উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি জান। সে উপায় বিফল হইল, আমার আশা বিফল হইল। দুই দিন পর্বতগহ্বরে নিজে নারীবেশে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম, তুমি সুরায় উন্মত্ত ছিলে, দেখিয়াছিলে কি না জানি না। প্রথম দিনে তোমার পদতলে পড়িয়া রোদন করিয়াছিলাম, দ্বিতীয় দিবস তোমার প্রাণসংহারে উদ্যত হইয়াছিলাম। হস্ত হইতে খড়্গ পড়িয়া গেল, তাতারের হস্ত হইতে খড়্গ পড়িয়া যায়, কখনও জানিতাম না, আমি এরূপ ক্ষীণ, তাহা জানিতাম না।  পরে তোমার সহিত পুনরায় আগ্রায় আসিলাম, অনুসন্ধানে জানিলাম, বঙ্গদেশ হইতে একজন ধনাঢ্য জমিদার আসিয়াছে,—তোমর হেমকে দেখিলাম। পাপিষ্ঠা! পরস্ত্রী তোমার হেম। উঃ, আর যাতনা সহ্য করিতে পারি না। তিন দিন পর মথুরার গোলোকনাথের মন্দিরে এক-প্রহর রাত্রির সময় যাইও, পরস্ত্রীকে আবার দেখিও। তুমি আমাকে হতভাগিনী করিয়াছ, তোমাকেও হতভাগা করিব, সেইজন্য এই সমাচার দিলাম। সেইজন্য আগ্রার দুর্গে লইয়া যাইয়া হেমকে দেখাইয়াছিলাম।

 আমার মৃত্যু সন্নিকট, জিঘাংসা তাতারের ধর্ম, আমি অধর্ম ভুলি নাই, আমার শোণিত শীতল হয় নাই।

 উঃ! আমার মস্তক ঘুরিতেছে। যদি এ তৃষ্ণাকে স্নেহবারি দান করিতে, তবে মুসলমানী অকৃতজ্ঞ হইত না, যতদিন জীবিত থাকিত—কিন্তু সে কথায় আর কাজ কি নরেন্দ্র! এ জীবনের জন্য বিদায় দাও, যদি মৃত্যুর পর আর একবার দেখা হয়, নিষ্ঠুর নরেন্দ্র! এই হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া অন্তরের ভাব তোমাকে দেখাইব। নরেন্দ্র। যখন তুমি আমাকে ভালবাসিবে—নতুবা এই ছুরিকা দ্বারা তোমার পাষাণ হৃদয় চূর্ণ করিব!
—উন্মাদিনী জেলেখা

 পত্র পাঠ সমাপ্ত হইল। নরেন্দ্রের নয়ন হইতে দুই-একবিন্দু অশ্রুবারি পড়িল। তিনি নিস্তব্ধে চিন্তা করিতে করিতে গৃহ হইতে বাহির হইলেন। রজনী প্রায় শেষ হইয়াছে, সমস্ত নগর নিস্তব্ধ। নরেন্দ্র পদচারণা করিতে করিতে অনেক দূর যাইয়া পড়িলেন, দেখিলেন সম্মুখে যমুনা।

 একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া নরেন্দ্র প্রত্যাগমন করিতে ছিলেন, এরূপ সময়ে দেখিলেন, যমুনাতীরে একস্থানে কতকগুলি লোক সমবেত হইয়া একটি মৃতদেহ ভূমিতে সন্নিবেশিত করিতেছে। জিজ্ঞাসা করায় সেই লোকের মধ্যে একজন উত্তর দিল, “মৃত ব্যক্তি পুর্বে বেগম মহলের দাসী ছিল। একজন কাফের সৈনিকের সহিত ব্যাভিচারিণী হইয়া বাহির হইয়া যায়। বোধ হয়, সে সৈনিক উহাকে এক্ষণে হত্যা করিয়াছে, দাসীর বক্ষস্থলে এই তীক্ষ ছুরিকাঘাত বসান দেখিলাম। হতভাগিনীর নাম জেলেখা।”