মানিনী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।


 রজনীকান্ত যে আফিসে কর্ম্ম করিতেন, তিনি সেই আফিসের একজন নিতান্ত সামান্য কর্ম্মচারী হইলেও আফিসের সাহেব তাঁহাকে ভাল বাসিতেন। কারণ, সাহেবের বিশ্বাস ছিল যে, রজনীকান্তের বেতন নিতান্ত অল্প হইলেও তিনি অবিশ্বাসী কর্ম্মচারী নহেন।

 বিপিনের কলেজ পরিত্যাগ করিবার কিছু দিবস পরেই রজনীকান্তের আফিসে ৬০ টাকা বেতনের একটী চাকরী খালি হইল। রজনীকান্ত সময় বুঝিয়া এক দিবস তাঁহার সাহেবকে আপন ভ্রাতা বিপিনের নিমিত্ত বলিলেন। উক্ত চাকরীর নিমিত্ত অনেক লোক উপস্থিত হইলেও, কি জানি, কি ভাবিয়া রজনীকান্তের মনিব সেই কর্ম্মে বিপিনকে নিযুক্ত করিলেন।

 চাকরী হইবার পরও বিপিন আপনার ভ্রাতা রজনীকান্তের সহিত পূর্ব্বের মত একত্র বাস করিতে লাগিলেন। রজনীকান্ত মনে করিলেন যে, এখন দুই ভ্রাতার উপার্জ্জিত অর্থ হইতে সাংসারিক খরচ পত্র বাদে যাহা কিছু বাঁচাইতে পারিবেন, তাহার দ্বারা পূর্ব্ব ঋণ সকল প্রথমে পরিষ্কার করিয়া পরিশেষে বিপিনের বিবাহের বন্দোবস্ত করিবেন। রজনীকান্ত মনে যাহা ভাবিয়াছিলেন, কার্য্যে কিন্তু তাহা ঘটিল না। বিপিন আপনার বেতন হইতে একটিমাত্র পয়সা দিয়াও সংসারের সাহায্য করিলেন না। এইরূপে দুই মাস গত হইয়া গেলে, এক দিবস রজনীকান্ত খরচের নিমিত্ত বিপিনকে কহিলেন। উত্তরে বিপিন কহিলেন, “আমি যে সামান্য বেতন পাই, তাহাতে আমি নিজের খরচই কুলাইয়া উঠাইতে পারি না—সংসারের সাহায্য করিব কি প্রকারে?”

 বিপিনের কথা শুনিয়া রজনীকান্ত মর্ম্মাহত হইলেন, তথাপি তাঁহাকে আর কিছু না বলিয়া নিজের সাধ্যানুযায়ী সংসার খরচের সংস্থান করিতে লাগিলেন। কিন্তু ঋণের ভাগ ক্রমেই বর্দ্ধিত হইতে লাগিল।

 রজনীকান্ত মনে করিলেন যে, এই সময় বিপিনের বিবাহ দেওয়ার নিতান্ত অবশ্যক; নতুবা যে তাহার স্বোপার্জ্জিত অর্থ সকল এইরূপেই নষ্ট করিয়া ফেলিবে। এই ভাবিয়া রজনীকান্ত একটা বয়স্থা পাত্রীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

 বিপিনও জানিতে পারিলেন যে, রজনীকান্ত তাঁহার বিবাহের চেষ্টা করিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু লজ্জার খাতিরে সম্মুখে তিনি কোন কথা না বলিয়া, একখানি পত্রে তাঁহার মনের ভাব ব্যক্ত করিয়া আপন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট পাঠাইয়া দিলেন। রজনীকান্ত ঐ পত্র পাঠ করিয়া যে কিরূপ মর্ম্মাহত হইলেন, তাহা বলা যায় না। ক্রমে রাজকিশোরীও এই পত্রের কথা অবগত হইয়া দুঃখ করিতে লাগিলেন। বিপিন রজনীকান্তকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার মর্ম্ম এইরূপ;—

 “দাদা! আমি অনেক দিবস হইতে আমার মনের কথা আপনাকে বলিব বলিয়া মনে করিতেছি, এবং এই সকল কথা আপনার নিকট প্রকাশ না করিলে কোনরূপেই চলিতে পারে না, তাহা আমি অবগত আছি। কিন্তু দারুণ লজ্জার নিমিত্ত এত দিবস তাহা আপনাকে বলিতে পারি নাই। যাহা হউক, এখন দেখিতেছি যে, আমার মনের কথা আপনার নিকট গোপন রাখিলে আর চলে না। মনে করিয়াছিলাম যে, সংসারের খরচ আমি আমার বেতনের টাকা হইতে কেন দিই না ও ঐ টাকা কিসে খরচ করিয়া থাকি, এই কথা যে দিবস আপনি আমাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিবেন, সেই দিবস আমি আমার মনের কথা আপনাকে বলিব; কিন্তু আপনি এক দিবস ভিন্ন দ্বিতীয় দিন আর সে কথা স্পষ্ট করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন না। সুতরাং এ পর্য্যন্ত আমিও কোনমতে আমার মনের কথা প্রকাশ করিবার সুযোগ পাইলাম না।

 “এখন দেখিতেছি, আপনি আমার বিবাহের নিমিত্ত সবিশেষ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। সুতরাং আর আমি আমার অন্তরের কথা গোপন রাখিতে পারি না। আপনি আমার বিবাহের চেষ্টা আর করিবেন না। কারণ, বিবাহ হইতে আমার বাকী নাই; প্রায় এক বৎসরের অধিক হইল, আমার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। বিবাহের পর যে পর্য্যন্ত আমি তাঁহাকে সাহায্য করিতে সমর্থ না হইয়াছিলাম, সেই পর্য্যন্ত আমার স্ত্রী আমার জনৈক বন্ধুর দ্বারা প্রতিপালিত হন। কিন্তু যে পর্য্যন্ত আমার চাকরী হইয়াছে, সেই পর্য্যন্ত আমি আমার বেতন হইতে তাহার খরচপত্র নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছি, এবং যাহাতে তিনি আরও একটু লেখা-পড়া ভাল করিয়া শিখিতে পারেন, তাহার নিমিত্ত এখন আমি তাঁহাকে একটী স্কুলে রাখিয়া দিয়াছি। সেইস্থানে তিনি রাত্রি দিবস অবস্থিতি করিয়া লেখা-পড়া শিক্ষা করিতেছেন। এখন যেরূপ আপনার বিবেচনা হয়, সেইরূপ আপনি করিতে পারেন। যদি আপনি তাঁহাকে আনিয়া বাড়ীতে রাখেন, তাহাতে আমার কোন আপত্তি নাই। তিনি এখন লেখাপড়া শিখিয়াছেন, নিজের ভালমন্দ তিনি এখন নিজে বেশ বুঝিয়াছেন। সুতরাং আমার বিবেচনা হয়, বাড়ীতে আসিয়া বাস করিতে তাঁহার কোন আপত্তি হইবে না। এরূপ অবস্থায় আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করিবেন, তাহাই হইবে। একত্র বাস করিলে খরচ-পত্রের অনেক সুবিধা হইবার সম্ভাবনা। এরূপ অবস্থায় আমার বোধ হয়, সকলে মিলিয়া একত্র বাস করা কর্ত্তব্য। বিশেষতঃ যাহাকে বিবাহ করিয়াছি, তাঁহাকে অন্য স্থানে রাখিয়া আমার অন্য স্থানে থাকা কোনরূপেই কর্ত্তব্য নহে। আপনার আদেশ পাইলেই স্কুল হইতে আমি আমার স্ত্রীকে বাড়ীতে আনয়ন করিব। ইতি:—”  বিপিনের পত্র পাঠ করিয়া রজনীকান্ত যে কিরূপ মনস্তাপ পাইলেন, তাহা ভ্রাতামাত্রেই সহজে অনুভব করিতে পারিবেন। অশিক্ষিতা রাজকিশোরীর চক্ষু দিয়াও জলধারা বহিল। কিন্তু উভয়ে পরামর্শ করিয়া পরিশেষে বিপিনের মতে মত দিলেন, এবং বিপিনের স্ত্রীকে বাড়ী আনাই স্থির করিলেন।

 রজনীকান্ত বিপিনের সেই পত্রের উত্তর প্রদান করিলেন না; কিন্তু সময়ক্রমে রাজকিশোরী এক দিবস উহার ও স্বামীর মনের ভাব বিপিনের নিকট প্রকাশ করিলেন। বিপিন তাঁহাদিগের কথা শুনিয়া বিশেষরূপে সন্তুষ্ট হইলেন, এবং বর্তমান মাসের অবশিষ্ট কয়েক দিবস গত হইলেই, তিনি তাঁহার পত্নীকে আপন গৃহে আনয়ন করিবেন স্থির করিলেন।

 ক্রমে মাসের অবশিষ্ট কয়েক দিবস গত হইয়া গেল। এক দিবস সন্ধ্যার সময় বিপিন তাঁহার পত্নীর সহিত আপন বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 বিপিনের স্ত্রী বাড়ীতে পদার্পণ করিবামাত্রই তাঁহাকে দেখিয়া রজনীকান্ত ও রাজকিশোরী একেবারে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা ভাবিয়াছিলেন যে, বিপিনের স্ত্রী মানিনী নিতান্ত বালিকা হইবেন; নতুবা স্কুলে থাকিয়া এখনও পর্য্যন্ত লেখাপড়া শিখিতেছে কি প্রকারে? আরও ভাবিয়াছিলেন যে, কোন বন্ধুর অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া, তাঁহাদিগের অজ্ঞাতে বিপিন এই বিবাহ করিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু যখন বিপিন তাঁহার স্ত্রীকে গাড়ী হইতে নামাইলেন, তখনই তাঁহাদিগের মস্তকে বজ্রাঘাত হইল। বিপিনের স্ত্রীকে ঘরে উঠাইবেন কি—মস্তকে হাত দিয়া তাঁহারা সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন।

 রজনীকান্ত দেখিলেন যে, মানিনী বালিকা নহেন—যুবতী। বিপিন অপেক্ষা তাহার বয়স অধিক না হইলেও নিতান্ত কম হইবে না। তাহার পরিধানে একখানি শাটী থাকিলেও কেমন একরূপ করিয়া পরিধান করা। তাহার নিম্নে গলা হইতে লম্ববান্‌ একটী সাদা ঘাঘ্‌রা বা সেমিজ। পায়ে ফুল মোজা, তাহার উপর বুট জুতা। মাথার উপর একটী লেজ বাহির করা পাগ্‌ড়ী।

 এইরূপ অবস্থায় মানিনী গাড়ী হইতে নামিয়াই সম্মুখে রজনীকান্ত ও রাজকিশোরীকে দেখিতে পাইলেন। উহাদিগকে দেখিয়াই বিপিনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহাঁরা দুইজন কে?”

 উত্তরে বিপিন কহিলেন, “ইনি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, আর ইনিই উহাঁর বনিতা।”

 বিপিনের কথা শুনিবামাত্র, মানিনী আপন দক্ষিণ হস্ত প্রসারণ করিয়া উহাঁদিগকে শেকহ্যাণ্ড করিবার মানসে প্রথমে রজনীকান্তের দিকে অগ্রসর হইলেন। রজনীকান্ত এই অশ্রুতপূর্ব্ব ব্যাপার দেখিয়া লজ্জায় অধোবদন হইয়া দ্রুতপদে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন।

 অশিক্ষিতা রাজকিশোরী এরূপ হস্ত প্রসারণের উদ্দেশ্য কি, জানিতে না পারিয়া মানিনীর হাত ধরিয়া গৃহের ভিতর লইয়া গেলেন। সেই স্থানে একখানি চেয়ার পূর্ব্ব হইতে রক্ষিত ছিল। কাহাকেও কিছু না বলিয়া মানিনী তাহাতেই উপবেশন করিলেন।

 মানিনীর অবস্থা দেখিয়া রজনীকান্ত ভাবিলেন যে, বিপিনের মতে মত দিয়া তিনি কি সর্ব্বনাশই করিয়াছেন! এখন সমাজের লোক তাহাকে কি বলিবে?