বিষয়বস্তুতে চলুন

মার্কাস্‌ অরিলিয়সের আত্মচিন্তা/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

মার্কাস্‌ অরিলিয়সের আত্মচিন্তা।
প্রথম পরিচ্ছেদ।

 ১। প্রতিদিন প্রভাতে স্মরণ করিও, রাত্রি আসিবার পূর্ব্বেই, কোন-না-কোন অনধিকার চর্চ্চাকারী ব্যক্তি, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি, কটুভাষী ব্যক্তি,—কোন-না-কোন শঠ ঈৰ্ষাপরায়ণ অসামাজিক বর্ব্বর ইতর ব্যক্তির সহিত তোমার সাক্ষাৎ ঘটিতে পারে। ভাল মন্দের অজ্ঞতা হইতেই তাহাদের এই সমস্ত কুটিলতা ও বুদ্ধিবিপর্য্যয় উৎপন্ন হয়। সৌভাগ্যবশতঃ আমি ভাল কাজের স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য ও মন্দ কাজের কদর্য্যতা বুঝিতে পারি; আমার ধ্রুব বিশ্বাস, যে ব্যক্তি আমাকে বিরক্ত করিতেছে সে আমার আত্মীয়; এক রক্তমাংসের না হইলেও আমাদের উভয়ের মন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ; কেন না, উভয়ই এক ঈশ্বর হইতে প্রসূত। ইহাও আমার ধ্রুব বিশ্বাস, কেহই আমার বাস্তবিক ক্ষতি করিতে পারে না, কেন না কেহই আমাকে বলপূর্ব্বক অন্যায়াচরণে প্রবৃত্ত করিতে পারে না। আমার ন্যায় যাহার একই প্রকৃতি, যে একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, কোন্‌ প্রাণে আমি তাহাকে ঘৃণা করিব—তাহার কথায় রাগ করিব? দুই হাত, দুই পা, দুই চোখের পাতা, উপরের ও নীচেকার দন্তপাঁতি যেরূপ পরস্পরকে সাহায্য করে, আমরাও সেইরূপ পরস্পরকে সাহায্য করিবার জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছি। অতএব পরস্পরের সহিত বিরোধ করা নিতান্তই অস্বাভাবিক। ক্রোধ ও বিদ্বেষের মধ্যে এইরূপ একটা অমিত্রোচিত ভাব প্রকাশ পায়।

 ২। এই কয়েকটি জিনিসে আমার জীবন গঠিত;—রক্তমাংস, নিশ্বাস ও মনের একটি নিয়ামক অংশ। মনকে বিক্ষুব্ধ হইতে দিও না। ইহা নিষিদ্ধ। আর শরীরের কথা যদি বল,—শরীরকে এমনি ভাবে দেখিবে যেন এখনি তোমার মৃত্যু হইতেছে। কেন না, শরীর জিনিসটা কি?—একটু রক্ত, আর কতকগুলা অস্থি বইত আর কিছুই নয়; স্নায়ু, শিরা, নাড়ী প্রভৃতির দ্বারা একখানি জাল বোনা হইয়াছে। তাহার পর, নিশ্বাস জিনিসটা কি?—একটু বাতাস, তাও আবার স্থায়ী নহে—ফুস্‌ফুস্‌ যন্ত্র ঐ বাতাসকে একবার বাহির করিয়া দিতেছে, আবার ভিতরে শোষণ করিয়া লইতেছে। তোমার জীবনের তৃতীয় অংশটি—নিয়ামক অংশ। বিবেচনা করিয়া দেখ তুমি বৃদ্ধ হইয়াছ; এই উৎকৃষ্ট অংশটিকে আর দাসত্ব করিতে দিও না। যেন উহা স্বার্থপর বৃত্তিসমূহের দ্বারা চালিত না হয়; উহা যেন ভবিতব্যতার সহিত বিরোধ না করে, বর্ত্তমানে বিচলিত ও ভবিষ্যতের জন্য ভীত না হয়।

 ৩। দেবতাদের কাজের মধ্যে বিধাতার হাত সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়। এমন কি, আকস্মিক ঘটনাও প্রকৃতির উপর নির্ভর করে; কেন না, যে কারণশৃঙ্খলা বিধাতৃবিধানের অধীন, উহা সেই কারণশৃঙ্খলা প্রসূত একটি কার্য্যমাত্র। বস্তুতঃ পদার্থমাত্রই ঐ একই উৎস হইতে বিনিঃসৃত। তা ছাড়া, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের একটা প্রয়োজন—একটা স্বার্থ আছে; তুমি সেই ব্রহ্মাণ্ডেরই একটি অংশমাত্র। অতএব বিশ্বপ্রকৃতিকে যাহা ধারণ করিয়া আছে, তাহা বিশ্ব প্রকৃতির প্রত্যেক অংশেরও পক্ষে প্রয়োজনীয় ও হিতজনক; কিন্তু জগৎ পরিবর্ত্তনের উপর স্থিতি করিতেছে, মৌলিক ও মিশ্র ভূতের বিকার ও পরিণামের দ্বারাই জগৎ সংরক্ষিত হইতেছে। একদিকে ক্ষতি হইলে, আর এক দিকে তাহ পূরণ হইয়া থাকে। এই সমস্ত চিন্তা করিয়া তুমি সন্তুষ্ট হও, এবং ইহাকেই তোমার জীবনের বীজমন্ত্র করিয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ কর। তাহা হইলে, মৃত্যুকালে আর আক্ষেপ করিতে হইবে না;—যাহা পাইয়াছ তজ্জন্য দেবতাদিগকে সর্ব্বাস্তঃকরণে ধন্যবাদ দিয়া, হাসিতে হাসিতে এখান হইতে প্রস্থান করিতে পরিবে।

 ৪। স্মরণ করিও, তোমার যাহা ইষ্টজনক তাহার প্রতি মনোযোগী না হইয়া, কতবার “আজ কাল” করিয়া তাহা স্থগিত রাখিয়াছ, এবং দেবতারা তোমাকে যে সব অবসর দিয়াছেন তুমি তাহা হেলায় হারাইয়াছ। আর কালহরণ করিও না; এখন ভাবিয়া দেখ, কি প্রকার জগতের তুমি একটি অংশ, এবং কি প্রকার নিয়ন্তা পুরুষ হইতে তুমি উৎপন্ন হইয়াছ; একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তোমার কাজ করিতে হইবে; যদি তুমি এই সময়ের মধ্যে নিজের উন্নতিসাধন না কর, আত্মাকে উজ্জ্বল না কর, মনকে শান্ত না কর, তাহা হইলে, কাল তোমাকে শীঘ্র হরণ করিয়া লইয়া যাইবে, আর উদ্ধারের উপায় থাকিবে না।

 ৫। এই কথা সর্ব্বদাই মনে রাখিবে যে, তুমি মনুষ্য ও তুমি একজন রোমক; সম্পূর্ণ ও অকৃত্রিম গাম্ভীর্য্য, মনুষ্যত্ব, স্বাধীনতা ও ন্যায়পরতাসহকারে প্রত্যেক কার্য্য সাধন করিবে। এবং এমন কোন কল্পনা ও খেয়াল মনে স্থান দিবে না যাহা ঐ সকল গুণকে বাধা দিতে পারে। প্রত্যেক কার্য্য তোমার জীবনের যেন শেষ কার্য্য—এই রূপ মনে করিয়া যদি কাজ কর, যদি তোমার প্রবৃত্তি ও তৃষ্ণাদি তোমার প্রজ্ঞার বিরোধী না হয়, হঠকারিতা হইতে যদি দুরে থাক, কপটতা ও স্বার্থপরতা তোমাকে যদি স্পর্শ না করে, নিজ অদৃষ্টের জন্য তুমি যদি আক্ষেপ না কর, তবেই তাহা করা সম্ভব হইবে। দেখ, কত অল্প বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া চলিলেই, মানুষ দেবতার মত জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারে; কেন না, এই অল্প কতকগুলি কাজ করিলেই, দেবতারা মানুষের নিকট হইতে যাহা চাহেন তৎসমস্তই তাহার করা হয়।

 ৬। অন্তরাত্মা! এখনও কি তুই আপনাকে অবমাননা করিবি! দেখ্‌, আপনাকে সম্মান করিবারও আর বড় সময় থাকিবে না। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন এর-মধ্যেই প্রায় ফুরাইয়া আসিয়াছে; তথাপি আপনার প্রতি নির্ভর করিয়া তুই অন্যের হৃদয়ের উপর, তোর সুখকে স্থাপন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিস্!

 ৭। আকস্মিক ঘটনা কিংবা বহির্বিষয়ে যেন তোমার মন একেবারে নিমগ্ন হইয়া না থাকে। যাহাতে ভাল বিষয় শিক্ষা করিবার অবসর পাও এইজন্য মনকে শান্ত রাখিবে, বিনির্ম্মুক্ত রাখিবে,—বিষয় হইতে বিষয়ান্তরে মনকে ভ্রমণ করিতে দিবে না। ইহা ছাড়া, আর এক প্রকার চাঞ্চল্য বর্জ্জন করিতে হইবে; কেন না, কেহ কেহ ভারী ব্যস্ত, অথচ কিছুই করে না; তাহারা আপনাকে ক্লান্ত করিয়া ফেলে, অথচ তাহাদের কোন গন্তব্য স্থান নাই, তাহাদের কোন লক্ষ্য নাই—কার্য্যের কোন উদ্দেশ্য নাই।

 ৮। অপরের মনের কথা না জানিতে পারায় কোন লোক প্রায় অসুখী হয় না, কিন্তু যে আপনার মনের ভাবগতি না জানে সে নিশ্চয়ই অসুখী হয়।

 ৯। এই কথাগুলি সর্ব্বদাই হাতের কাছে থাকা আবশ্যকঃ—

 বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি, আমার নিজের প্রকৃতি,—এহ উভয়ের মধ্যে কি সম্বন্ধ, কি প্রকার সমষ্টির ইহা কি প্রকার অংশ, আমি যে মহাসত্তার অংশ সেই সত্তার অনুযায়ী কাজ করিতে,—কথা কহিতে কোন মর্ত্ত্য মানব আমাকে বাধা দিতে পারে না;—এই সমস্ত বিষয় ভাল করিয়া বিবেচনা করিতে হইবে।

 ১০। থিওফ্রেটস্ মানব-কৃত অপরাধের তারতম্য তুলনা করিয়া প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানীর মত কথা বলিয়াছেন। তিনি বলেনঃ—ক্রোধ-প্রসূত অপকর্ম্ম অপেক্ষা বাসনা-প্রসূত অপকর্ম্ম আরও গুরুতর। কারণ, যে ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়, সে অনিচ্ছাপূর্ব্বক কষ্টের সহিত বিবেকের আদেশ লঙ্ঘন করে, এবং তাহার চৈতন্য হইবার পূর্ব্বেই সে সংযমের বাহিরে চলিয়া যায়। কিন্তু যে ব্যক্তি সুখের লালসায় অভিভূত হইয়া, যথেচ্ছাচার করে, সে আত্ম-কর্ত্তৃত্ব হইতে ও মনুয্যোচিত সংযম হইতে ভ্রষ্ট হয়। অতএব তিনি তত্ত্বজ্ঞানীর মতোই এই কথা বলিয়াছেন যে,—যে ব্যক্তি দুঃখের সহিত পাপাচরণ করে, তাহা অপেক্ষা যে ব্যক্তি সুখের সহিত পাপাচরণ করে সেই অধিক অপরাধী। কারণ, প্রথম ব্যক্তি কতকটা অপরের আঘাতে ব্যথিত, এবং সেই ব্যথাই তাহার ক্রোধকে উত্তেজিত করে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তি হইতে কার্য্য আরম্ভ করে, এবং কেবল বাসনার বশেই অপকর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়।

 ১১। তোমার সমস্ত কর্ম্ম, বাক্য ও চিন্তাকে এই অনুসারে নিয়মিত করিবে; কেন না এই মুহূর্ত্তেই তোমার মৃত্যু হইতে পারে! আর এই মৃত্যুটা এতই-কি গুরুতর ব্যাপার? যদি দেবতারা সত্যই থাকেন, তবে তোমার কোন কষ্ট নাই, কারণ, তাঁহারা তোমার কোন অনিষ্ট করিবেন না। যদি তাঁহারা না থাকেন, অথবা আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ না করেন—তবে আর কিসের চিন্তা? দেবতাহীন কিংবা বিধাতৃহীন জগতে থাকিয়া কি লাভ?—ওরূপ জগতে না থাকাই ভাল। কিন্তু বাস্তবপক্ষে, দেবতারা আছেন এবং মানুষের ব্যাপারে তাঁহাদের সংস্রব ও মমতা আছে, ইহাতে সংশয় নাই। যাহা প্রকৃত দুঃখ তাহাতে মানুষ যাহাতে পতিত না হয়, তাঁহারা তাহাকে এরূপ শক্তি দিয়াছেন। যদি অন্য দুঃখ কষ্ট বাস্তবিকই অমঙ্গল হইত, তাহা হইলে উহা বর্জ্জন করিবার শক্তিও তাহাকে দিতেন। কিন্তু যাহা মানুষকে হীন না করে, তাহা তাহার জীবনকে হীন করিবে কি করিয়া? আমি এ কথা কখনই বিশ্বাস করিতে পারি না যে, বিশ্বপ্রকৃতি কেবল জ্ঞানের অভাবে, এই সকল বিষয়ে উপেক্ষা করিয়াছেন, অথবা জানিয়া-বুঝিয়াও শুধু শক্তির অভাবে এই ক্রটি নিবারণ কিংবা সংশোধন করিতে পারেন নাই; অথবা শক্তি কিংবা দক্ষতার অভাবে, সৎ ও অসৎ ব্যক্তির জীবনে ভাল মন্দ নির্ব্বিশেষভাবে ঘটতে দিয়াছেন। ফলতঃ, জীবন মৃত্যু, মান অপমান, সুখ দুঃখ, ঐশ্বর্য্য দারিদ্র্য—এই সকল জিনিস—কি পুণ্যবান্‌, কি পাপী,—সকলেরই ভাগ্যে সমানরূপে নির্দিষ্ট। কেন না, এই সকল জিনিসে কোন প্রকৃত হীনতা বা মহত্ত্ব নাই; এবং সেই জন্যই আসলে উহা ভালও নহে, মন্দও নহে।

 ১২। বিবেচনা করিয়া দেখ, পদার্থ সকল কত শীঘ্র বিশ্লিষ্ট ও বিলীন হইয়া যায়;—পদার্থসকল জগৎসত্তার মধ্যে এবং তাহাদের স্মৃতিগুলি কাল ও মহাকালের মধ্যে বিলীন হইয়া যায়। আরও বিবেচনা করিয়া দেখ, ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলা কিরূপ,—বিশেষতঃ সেই সকল ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলা যাহা আমাদিগকে সুখ দিয়া মুগ্ধ করে, কষ্ট দিয়া ভয় দেখায়, কিংবা ফাঁকা সুখ্যাতির জন্য আমাদের প্রীতি আকর্ষণ করে। একটু চিন্তা করিলেই জানিতে পারিবে, এই সমস্ত জিনিস কি অপদার্থ, কি জঘন্য, কি ক্ষুদ্র, কত শীঘ্র উহা শুষ্ক হইয়া যায়—মরিয়া যায়। জানিতে পারিবে, সেই সকল লোকগুলাই বা কিরূপ—যাহাদের খেয়ালের উপর, যাহাদের প্রশংসার উপর, এই সুখ্যাতি নির্ভর করে। মৃত্যুর প্রকৃতি কি তাহাও জানিতে পারিবে। মৃত্যু হইতে যদি মৃত্যুর আড়ম্বর ও বিভীষিকাকে অপনীত কর, তাহা হইলে দেখিবে, উহা একটা প্রাকৃতিক কার্য্য ভিন্ন আর কিছুই নহে। প্রকৃতির কার্য্যকে যে ভয় করে, সে নিতান্তই শিশু; মৃত্যু শুধু প্রকৃতির কার্য্য নহে, উহা প্রকৃতির হিতজনক কার্য্য। সর্ব্বশেষে আমাদের বিবেচনা করিতে হইবে, ঈশ্বরের সহিত আমাদের কিরূপ সম্বন্ধ,—আমাদের সত্তার কোন্‌ অংশের সহিত এবং সেই অংশের কোন বিশেষ অবস্থার সহিত ঈশ্বরের যোগ।

 ১৩। যে ব্যক্তির কৌতুহল কেবল বহির্বিষয়েই বিচরণ করে তাহার মত দুর্ভাগ্য আর কেহ নাই। অনেকে অন্যের মনের ভিতর প্রবেশ করিবার জন্য খুবই ব্যস্ত, কিন্তু তাহারা বিবেচনা করেন—আপনার অন্তরে যে দেবতা রহিয়াছেন সেই অন্তর্দেবতার পূজা অর্চ্চনা ও সেবা করিলেই যথেষ্ট হয়। সমস্ত উগ্র প্রবৃত্তি, সকল প্রকার মন্দভাব, হঠকারিতা ও মিথ্যাভিমান, দেবতা ও মনুষ্যের প্রতি অসস্তোষ—এই সমস্ত হইতে চিত্তকে বিমুক্ত ও পরিশুদ্ধ রাখা—ইহাই অন্তর্দেবতার পূজানুষ্ঠান। দেবতারা জগতের কার্য্য উত্তমরূপে নির্ব্বাহ করেন—এই জন্য দেবতাদিগের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি অর্পণ করা কর্ত্তব্য, এবং মনুষ্যগণের সহিত আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সম্বন্ধ আছে বলিয়াই মানুষের কাজকেও আমাদের ভালভাবে দেখা উচিত। তাছাড়া ভাল মন্দর জ্ঞান না থাকা প্রযুক্ত অনেক সময়ে মানুষের প্রতি কৃপাদৃষ্টিও করিতে হয়। অন্ধব্যক্তি যেরূপ সাদা কালোর প্রভেদ বুঝিতে পারে না, সেইরূপ নৈতিক গুণ সমূহের প্রভেদ বিচার করিতে না পারাও একটা স্বভাবের ন্যুনতা।

 ১৪। যদি তুমি তিন হাজার কিংবা ত্রিশ হাজার বৎসরও বাঁচিয়া থাক, তবু স্মরণ রাখিও, যে জীবন এখন তুমি যাপন করিতেছ সেই জীবন ছাড়া আর কোন জীবন তুমি হারাইবেনা; অথবা যে জীবন তুমি হারাইবে সে জীবন ছাড়া তোমার আর কোন জীবন নাই। সুতরাং সর্ব্বাপেক্ষা দীর্ঘ জীবন ও সর্ব্বাপেক্ষা স্বল্পস্থায়ী জীবন গণনায় একই। সর্ব্বস্থলেই, বর্ত্তমানের স্থায়িত্ব সমান। অতএব প্রত্যেকেরই নাশের পরিমাণ একই রূপ—ইহা কালের একটি বিন্দুমাত্র; কেহই অতীত ও ভবিষ্যৎকে হারাইতে পারে না। কেননা যাহার যে জিনিস নাই সে তাহা হইতে বঞ্চিত হইবে কি করিয়া? এই সমস্ত কারণে দুইটি তত্ত্ব শুধু আমাদের মনে রাখিতে হইবে। একটি এই—প্রকৃতি চক্রগতিতে ভ্রমণ করে—সমস্ত অনন্ত কালে, তাহার একই মুখ প্রকাশ পায়। সুতরাং কোন মানুষ একশত বৎসর, দুইশত বৎসর, কিংবা আরও অনেক বৎসর বাঁচিল—তাহাতে, কি যায় আসে? ইহাতে তাহার এইমাত্র লাভ হয়, সে একই দৃশ্য অনেকবার দেখে। আর একটি কথা এই, যখন দীর্ঘজীবী ও অল্পজীবী ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তখন তাহাদের ক্ষতি একই রূপ। যে বর্তমান তাহাদের আছে সেই বর্তমানকেই তাহার হারায়, কেন না, যাহার যে জিনিস নাই তাহাকে হারান বলা যায় না।

 ১৫। “সিনিক্‌” সম্প্রদায়ের তত্ত্বজ্ঞানী মনিমস্ (Monimus) বলিতেন, পদার্থ মাত্রই মনের ভাব। এই উক্তিটিতে যে টুকু সত্য আছে, শুধু যদি সেই টুকুই গ্রহণ করা যায়, তবেই উহার দ্বারা কিছু উপকার দর্শিতে পারে।

 ১৬। কোন মনুষ্যের আত্মা নানা প্রকারে আপনাকে পীড়া দিতে পারে। প্রথমতঃ যখন কাহারও আত্মা বিস্ফোটকের ভাব ধারণ করে—জগতের পৃষ্ঠে একটা অধিমাংস হইয়া অবস্থিতি করে—সেই এক প্রকার পীড়া। কোন প্রাকৃতিক ঘটনায় উত্ত্যক্ত হইলে, সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি হইতে আপনাকে বিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয়তঃ, যদি কেহ ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিশোধ লইবার জন্য কাহাকে বিদ্বেষ করে, কিংবা কাহারও অনিষ্ট কামনা করে, তাহা হইলেও তাহার আত্মার ঐ একই দুর্দ্দশা উপস্থিত হয়। তৃতীয়তঃ, সুখ কিংবা দুঃখে অভিভূত হইলে, চতুর্থতঃ, কর্ম্মে ও বাক্যে ছলনা, প্রবঞ্চনা, মিথ্যাচরণ করিলে, পঞ্চমতঃ, কি কাজ করিতেছে না জানিয়া উদ্দেশ্যহীন হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইলেও আত্মার অনিষ্ট করা হয়। অতি ক্ষুদ্র কাজ হইলেও তাহার একটা উদ্দেশ্য থাকা চাই। বুদ্ধি বিবেচনা ও বিধিব্যবস্থা অনুসারে চলাই জ্ঞানবুদ্ধিবিশিষ্ট জীবের কর্ত্তব্য।

 ১৭। মনুষ্যজীবনের পরিমাণ একটি বিন্দুমাত্র; এই জীবনের বস্তু ক্রমাগত ভাসিয়া চলিয়াছে, ইহার জ্ঞানদৃষ্টি অতীব ক্ষীণ ও অস্পষ্ট এবং ইহার সমস্ত উপাদান গলিত হইবার দিকে উন্মুখ। মন একটা আবর্ত্ত বিশেষ। ভাগ্যের কথা কিছুই অনুমান করা যায় না। এবং যশের কোন ভাল মন্দ বিচার নাই। এক কথায়, আমাদের শরীর,—নদীর প্রবাহবৎ; আমাদের মন—স্বপ্ন ও জলবিম্ববৎ। মানব-জীবন শুধু এক প্রকার সংগ্রাম ও দেশভ্রমণ, এবং যশের শেষ পরিণাম—বিস্মৃতি। মনুয্যের মধ্যে টিকিয়া থাকে তবে কোন্‌ জিনিস্‌?—তত্ত্বজ্ঞান ভিন্ন আর কিছুই না। এখন তত্ত্বজ্ঞানের কাজটা কি? তত্ত্বজ্ঞানের কাজ,—আমাদের অন্তর্দেবতাকে অনিষ্ট ও অপমান হইতে রক্ষা করা—সুখ দুঃখ হইতে উচ্চতর ভূমিতে তাঁহাকে স্থাপন করা, অব্যবস্থিতরূপে, ছদ্মভাবে ও ছলনাপূর্ব্বক কোন কাজ না করা এবং অন্যের মনোভাবের নিরপেক্ষ হইয়া অবস্থিতি করা। তা’ছাড়া, তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা দেয়, বস্তু সকল যে ভাবে আসিবে মন যেন তাহাই গ্রহণ করে; যাহার ভাগ্যে যে জিনিস পড়িবে তাহাই যেন সে মানিয়া লয়—কোন আপত্তি না করে; কেন না, মন যে কারণ হইতে উৎপন্ন—এই জিনিস্‌গুলিও সেই একই কারণ হইতে উৎপন্ন। সর্ব্বোপরি, মৃত্যুকে সহজভাবে দেখিবে; ইহা আর কিছুই নহে—প্রত্যেক বস্তু যে পঞ্চভূতে গঠিত, উহা বিশ্লিষ্ট হইয়া সেই পঞ্চভূতেই আবার মিশিয়া যায় এই মাত্র। দেখ, স্বয়ং পঞ্চভূত যদি পরম্পরের সহিত মিশিয়া গিয়া ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তবে যদি তাহাদের গঠিত সমস্ত বস্তুই পরিবর্ত্তিত ও বিলীন হইয়া যায় তাহাতে কি হানি? কেন তবে মানুষ উহাদের পরিণামে এত চিন্তিত হয়? ইহা প্রকৃতির কার্য্যপ্রণালী ছাড়া ত আর কিছুই নহে; আর প্রকৃতি কখনই কাহার অনিষ্ট করে না।