মিবাররাজ/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

মিবাররাজ।

ঐতিহাসিক উপন্যাস।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 আরাবলী পর্ব্বতের পাদদেশে মিবার রাজ্যের তোরণস্বরূপ কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শৈলশ্রেণী বিরাজিত; “ইদর” সেই শৈলময়-ভূমির একটি বন প্রদেশ।

 আন্দাজ প্রায় চতুর্দ্দশ শত বৎসর পূর্ব্বে একদিন প্রভাত মা হইতে হইতে কতিপয় ধনুর্দ্ধারী ভীল শিকারী উক্ত অরণ্য প্রদেশের একটি গ্রাম পথ অতিক্রম করিয়া একটি বৃক্ষতলে আসিয়া দাঁড়াইল, যেন কাহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল।

 ধীরে ধীরে পূর্ব্বাকাশে উচপাহাড় শৃঙ্গের গাত্রে উষার স্বচ্ছ শুভ্র মূর্ত্তি বিভাসিত হইল, সে মূর্ত্তি দেখিয়া স্তরবিন্যস্ত পাহাড় শ্রেণীর ছাত্র হইতে, জটাজুটধারী অরণ্যের মস্তক হইতে জমাট অন্ধকার রাশি বায়ুতাড়িত-কুঝঝ‍্টিকার ন্যায় সভয়ে দ্রুতবেগে পলায়ন করিতে লাগিল, সে মূর্ত্তি দেখিয়া অরণ্যের শত পাখী আনন্দে আগমনগীত গাহিয়া উঠিল; শিকারীরা সৌৎসুক দৃষ্টিতে একবার পুর্ব্বাকাশের দিকে একবার পথের দিকে চাহিতে লাগিল। ক্রমে উষার শতবর্ণ-রঞ্জিত-আকাশে সূর্য্য উদিত হই তাহার কনক-কিরণ হাসিতে পাহাড়ের সর্বাঙ্গ—নদী নির্ঝর গাছ পালা বন গ্রাম আনন্দে বিকশিত হইয়া উঠিল। কৃষকেরা বলদ লইয়া একঘেয়ে সুরে গান গাহিতে গাহিতে ক্ষেত্রের দিকে গমন করিতে লাগিল, গরু ঘোড়া মহিষ ভেড়ারা পাহাড়ে চরিতে লাগিল, দু একটা বন্য ছাগশিশু পাহাড়ের দুরারোহ্য শৃঙ্গে ছুটাছুটি করিতে লাগিল। একদল খরগোস গাছ পালার ভিতর হইতে রাঙ্গা রাঙ্গা চোখ বাহির করিয়া শিকারীদের দেখিয়া আবার বনের মধ্যে লুকাইয়া পড়িল— শিকারীরা ব্যস্ত হইয়া উঠিল, বারবার তাহারা নিকটের একটা উঁচু ঢিবিতে উঠিয়া চারিদিক দেখিতে লাগিল, একজন নিতান্ত অধীর হইয়া ধনুকটা কাঁধ হইতে হাতে লইয়া সজোরে তাহার প্রান্তভাগ মাটির উপর রাখিল— সেখানকার মাটিটা খুঁড়িয়া গেল—সে রাগের স্বরে বলিল—“মুই আর দাঁড়াইতে পারিবু না, ঝটপট চলিতে হয় ত চল, ‘তানা’ না এল ত বড্ডা বয়ে গেল।” দলপতি বৃদ্ধ-ভীল পুত্রের এই কথায় যেন ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন—কাচুমাচু করিয়া বলিলেন—“বাপ্পুরে সার টুকুনখানি সবুর কর, ‘তানা’ মুদের লায়েক লাকীন শিকারী, তানারে ছাড়তে আছে”—বৃদ্ধের অনুকরণ করিয়া সকলেই বলিয়া উঠিল— “আরে নানা নানা,—‘তানা’ মুদের লায়েক লাকীন শিকারী তানারে ছাড়া হইবু না”—ভীলরাজপুত্র (সংক্ষেপের জন্য ভীলপুত্র বলিয়াই আমরা সম্বোধন করিব) রাগিয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিল—এমন সময় হঠাৎ হৈ হৈ শব্দ পড়িয়া গেল, যাহাৱা উঁচু ঢিবিতে উঠিয়া দেখিতেছিল—তাহা বলিয়া উঠিল—“ঐ যে ঐ ‘তানা’ আসিছে রে”— সকলের আহ্লাদের চীৎকার ধ্বনির মধ্যে একজন ধনুর্দ্ধারী যুবক দ্রুতপদে আসিয়া দাঁড়াইল।