মিবার-গৌরব-কথা/চণ্ড ও মুকুলজী
মহাবীর হামিরের পৌত্র রাণা লক্ষসিংহ সর্ব্বতোভাবে পিতৃপুরুষের গৌরব অক্ষুন্ন রাখিয়া সুদীর্ঘকাল চিতোরে রাজত্ব করেন। মিবারের শ্রেষ্ঠতম নৃপতিগণের মধ্যে রাণা লক্ষ অন্যতম। তাঁহার বীরত্ব, প্রতাপ, কীর্ত্তিকথায় একদা মিবারভুমি প্রতিধ্বনিত হইত। নিম্নলিখিত ঘটনাসূত্রে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র চণ্ডকে বঞ্চিত করিয়া তাহার সর্ব্বকনিষ্ঠ পুত্র মুকুলজী পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন।
একদিন রাণা লক্ষ মন্ত্রী পারিষদে পরিবৃত হইয়া রাজসভায় আসীন আছেন এমন সময় মাড়বার-রাজ রণমল্লের নিকট হইতে নারিকেল ফল লইয়া একজন দূত তথায় উপস্থিত হইল। রাণা তাহার যথাযোগ্য অভ্যর্থনা করিয়া আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন যে, মাড়বার রাজ চণ্ডের সহিত আপনার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব করিয়া পাঠাইয়াছেন। রাণা শুনিয়া হাসিয়া বলিলেন,—“তাই ভাল! আমি ভাবিতেছিলাম এই বৃদ্ধ বয়সে কে আবার আমার বিবাহের প্রস্তাব করিয়া পাঠাইল।” চণ্ড সে সময় রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন না। তিনি আসিয়া পিতার পরিহাসের কথা শুনিয়া বলিলেন “পিতা যখন পরিহাস করিয়াও সে কন্যার সহিত নিজের বিবাহের কথা ভাবিয়াছেন, তখন আমি আর তাহাকে বিবাহ করিতে পারিনা।” সুতরাং তিনি কোন প্রকারেই সে কন্যাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন না। রাণা লক্ষ পুত্রকে কত বুঝাইলেন, কত তিরঙ্কার করিলেন, কত অনুরোধ করিলেন কিছুতেই তাঁহাকে সম্মত করাইতে পারিলেন না। তখন অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “কি, আমি পিতা হইয়া এত অনুনয় বিনয় করিলাম, কিছুতেই তোমার গ্রাহ্য হইলনা? আমি, মাড়বার-রাজকে অপমানিত করিতে পারিনা, আমি তাঁর কন্যাকে বিবাহ করিতেছি, কিন্তু তুমি আজ আমার নিকট প্রতিজ্ঞা কর যে, চিরদিনের মত মিবার সিংহাসনের আশা পরিত্যাগ করিলে। এই বিবাহে যদি আমার পুত্র জন্মে, সেই মিবারের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হইবে।” চণ্ড পিতার নিকট বিধিপূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা করিলেন। কালে নূতন মহিষীর একটি পুত্র জন্মিল। তাহার নাম মুকুলজী। মুকুলজীর বয়স যখন পাঁচ বৎসর, তখন রাণা লক্ষ মুসলমানদিগের অত্যাচার হইতে গয়াতীর্থ রক্ষা করিবার জন্য গমন করেন। যাত্রার পূর্ব্বে রাজ্যের সন্ত্রান্ত লোকদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “আমিত চলিলাম, আর যে ফিরিব এরূপ আশা নাই। এখন আমি কোন্ ভূসম্পতি মুকুলকে দান করিয়া যাই।” কুমার চণ্ড অমনি দৃঢ়স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কেন মিবারের রাজসিংহাসন।” এই বলিয়াই চণ্ড নিরস্ত হইলেন না, কিন্তু পিতার গমনের পূর্ব্বে বিশেষ উদ্যোগী হইয়া মুকুলের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করিলেন; এবং স্বয়ং তাহার মন্ত্রী হইয়া রাজ্য শাসন করিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন। রাণা লক্ষ মুকুলের রাজ্যাভিষেক দর্শন করিয়া তীর্থে গমন করিলেন। কুমার চণ্ড বিশ্বম্ভ অনুগত ভৃত্যের ন্যায় ভ্রাতার রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন। ক্ষুদ্র বালক মুকুল সিংহাসনে উপবিষ্ট, আর চণ্ড দীনদাসের ন্যায় নিম্ন আসনে আসীন, এদৃশ্য দেখিয়া সভাস্থ সকলের মনে এক অপূর্ব্ব ভাবের উদয় হইত। সকলে চণ্ডকে দেবতার ন্যায় শ্রদ্ধা ভক্তি করিত। কিন্তু হায়! মিবার রাজ্যে কেবল একজন ছিলেন, তিনি চণ্ডের কোন কর্ম্মই প্রসন্ন চক্ষে দেখিতেন না। তাঁহার সকল কার্য্যেই একটা না একটা দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেন। তিনি চণ্ডের বিমাতা ও মুকুলের জননী। তিনি গোপনে চণ্ডের নামে অনেক নিন্দা প্রচার করিতে লাগিলেন। চণ্ড প্রথমে বিমাতার এরূপ ব্যবহারে কিঞ্চিন্মাত্র বিচলিত হইতেন না; কিন্তু শেষে দেখিলেন তাহার সকল কার্যেই বিমাতার সন্দেহ, তখন তিনি আর সহ্য করিতে পারিলেন। মুকুলের জননী কেবলই বলিতেন, চণ্ডই প্রকৃত রাজা, আমার পুত্র কেবল সাক্ষী-গােপাল! বিমাতার কথাতে অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া একদিন চণ্ড তাহাকে বলিলেন, “মাতঃ, আপনি নাকি বলেন যে, মুকুলকে বঞ্চিত করিয়া আমি স্বয়ং রাজা হইবার জন্য সচেষ্ট? একবার চিন্তা করিয়া দেখিবেন, আমার যদি রাজা হইবার বাসনা থাকিত তাহা হইলে আজ আর আপনাকে রাজমাতা হইতে হইত না। যাহা হউক আপনার মনে যখন এমন বিরুদ্ধ ভাব, তখন আমার এ রাজ্য ত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ। আমি আপনার পুত্রের রাজ্য ত্যাগ করিয়া চলিলাম। আপনি পুত্রের কল্যাণ চিন্তা করুন কিন্তু সাবধান আমার পিতার রাজ্যের যেন সর্বনাশ না হয়, আর আপনার পুত্রের কোন বিপদ না হয়।” এই বলিয়া চণ্ড বিমাতার পদধূলি লইয়া ভ্রাতাকে আশীর্ব্বাদ করিয়া মিবার রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া চিরদিনের মত চলিয়া গেলেন। বিমাতা একটি কথাও বলিলেন না। মুকুলের জননী অচিরে আপনার পিতা, ভ্রাতা ও আত্মীয়স্বজনকে চিতােরে আহ্বান করিলেন। তাঁহারা রাজকার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। মাড়বাররাজ প্রথমে দৌহিত্রকে ক্রোড়ে লইয়া সিংহাসনে উপবিষ্ট হইতেন, পরে একাই সিংহাসনে উপবেশন করিলেন। ক্রমে তাঁহারা পিতাপুত্রে সকলই গ্রাস করিয়া ফেলিলেন। এমন কি মুকুলকে হত্যা করিবার জন্য যড়যন্ত্রও চলিতে লাগিল। তথাপি মুকুলের জননীর চেতনা নাই। অবশেষে একদিন মুকুলের বৃদ্ধা ধাত্রী রাণীকে বিশেষ তিরস্কার করিয়া কহিল—“আপনি কি একেবারে অন্ধ হইয়াছেন? পুত্রের রাজ্য ও জীবন সকলই যায়, তথাপি কোন্ সুখে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছেন?” ধাত্রীর তিরস্কারে রাণীর চক্ষু ফুটিল। তাই ত কি সর্ব্বনাশ! পিতা ও ভ্রাতার হস্ত হইতে রক্ষা পাই কিরূপে?” ভাবিয়া দেখিলেন তিনি নিরুপায় ও অসহায়। তখন অন্য কোন গতি না দেখিয়া চণ্ডকে বলিয়া পাঠাইলেন, “চণ্ড তুমি ভিন্ন এ বিপদে আর রক্ষাকর্ত্তা নাই। তুমি শীঘ্র আসিয়া তােমার পিতার রাজ্য ও ভ্রাতার প্রাণ রক্ষা কর।” চণ্ড সংবাদ পাইবামাত্র উপস্থিত হইলেন। সকলে সাদরে তাঁহাকে গ্রহণ করিল। চণ্ড বিশ্বাসঘাতক মাড়বাররাজকে হত্যা করিয়া তাঁহার পুত্রকে সদলে রাজ্য হইতে দূরীকৃত করিয়া দিলেন। শত্রুকে দমন করিয়া, রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া ভ্রাতার রাজ্যকে সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক করিয়া মহামনা চণ্ড আবার বিদায় লইলেন। এবার বিমাতা বলিলেন, “বৎস, তুমি আর দূরে যাইওনা; এইখানেই অবস্থান কর।”—চণ্ডের হৃদয় বিমাতার পুর্ব্বাচরণে এতই ব্যথিত হইয়াছিল যে, তিনি কোন ক্রমেই আর চিতােরে থাকিতে সম্মত হইলেন না। বলিলেন, “জননি! বিপদে পড়িলেই আমাকে ডাকিবেন, আমি চিরদিন আপনার পুত্রের রাজ্য রক্ষা করিবার জন্য প্রাণপাত করিব। কিন্তু আমি আর এখানে থাকিতে পারি না, কি জানি আপনার মনে আবার যদি কোন সন্দেহ উপস্থিত হয়। শত্রুর অস্ত্রাঘাত বক্ষ পাতিয়া লইতে পারি, কিন্তু আত্মীয়ের অবিশ্বাস সহ্য হয় না”—এই বলিয়া চণ্ড জন্মের মত পিতৃরাজ্য পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। প্রজাগণ হায়! হায়! করিতে লাগিল।