মিবার-গৌরব-কথা/ধাত্রী পান্না

উইকিসংকলন থেকে

ধাত্রী পান্না।

 সংগ্রামসিংহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র রত্ন ও বিক্রমজিৎ যথাক্রমে চিতোরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাণা বিক্রমজিৎ পিতার অতি অনুপযুক্ত পুত্র ছিলেন। তাঁহার বীরত্ব এবং তেজস্বিতার যে অভাব ছিল তাহা নয়। তিনি এমন উদ্ধত ও অত্যাচারী ছিলেন যে, তাঁহার শাসনাধীনে সর্দ্দারগণ ও প্রজাগণ কেহই সুখী ছিল না। আভ্যন্তরীণ অশান্তির বিষয়, জানিয়া গুর্জ্জরের মুসলমান অধিপতি বাহাদুর মিবার রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। এই যুদ্ধে বাহাদুরের পক্ষে একজন ইউরোপীয় গোলন্দাজ ছিল। বহুদিন হইল রাজপুতগণ এমন ভীষণ যুদ্ধ করে নাই। চারিদিক্‌ হইতে দলে দলে রাজপুত বীরগণ আসিয়া এই যুদ্ধে যোগদান করিল, বিক্রমজিৎও বীরের ন্যায় মিবারের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু মিবারের সর্দ্দারগণ রাণার দুর্ব্ব্যহারে অন্তরে এরূপ জর্জ্জরিত ছিলেন যে, তাহারা সমগ্র মনপ্রাণের সহিত যুদ্ধে যোগদান করেন নাই। যুদ্ধের অবসান না হইতেই—সংগ্রামের শিশুপুত্র উদয়সিংহ এবং চিতোর নগরী রক্ষা করিবার জন্য অনেকে চিতােরে প্রত্যাবর্ত্তন করিল। বিক্রমজিৎ অতুল সাহসের সহিত যুদ্ধ করিতে থাকিলেন। তাঁহার পত্নী বীর নারী জহর বাই বর্ম্মে দেহ আবৃত করিয়া সসৈন্য শক্রর সহিত সমরে অবতীর্ণ হইয়া অতুল সাহস দেখাইয়া রণভূমে প্রাণত্যাগ করিলেন— তথাপি চিতাের রক্ষা করা অসম্ভব হইল। তখন চিতােরের বীরগণ রাজ বলির উদ্যোগ করিল।— চিতােরের রাজলক্ষ্মীর সন্তোষের জন্য রাজমুকুটধারী রাণাকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করিতে হইবে; নতুবা চিতােরের আর রক্ষা নাই। রাণা বিক্রমজিৎ রণভূমিতে এক্ষণে সংগ্রামসিংহের ভ্রাতা সূর্য্যমল্লের বীর পুত্র বাঘজী জীবনাহুতি দিতে সম্মত হইলেন। তাঁহার মস্তকে রাজমুকুট ও রাজছত্র শােভিত হইল। তিনি অতুল বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ বিসর্জ্জন করিলেন। তথাপি চিতাের রক্ষা অসম্ভব হইল, তখন রাজপুতবাসিনীগণ জহর ব্রতের[১] অনুষ্ঠান করিল।—ত্রয়ােদশ সহস্র রাজপুত রমণী চিতানলে দেহ ভস্মীভূত করিল। বাহাদুর চিতোর জয় করিয়া সসৈন্যে সেই পবিত্র নগরীতে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু এক পক্ষ গত না হইতে হইতে সংবাদ আসিল হুমায়ুন গুর্জ্জর আক্রমণ করিতে যাইতেছেন। বাহাদুরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ত্বরায় করিতে হইল—হুমায়ুনের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া তিনি রাজ্য হইতে তাড়িত হইলেন। কথিত আছে, মিবারের রাণী কর্ণবতী হুমায়ুনকে “রাখি ভাই” বলিয়া সম্বোধন করিয়া চিতোর উদ্ধার করিবার জন্য আহ্বান করিয়াছিলেন। হুমায়ুন চিতোর রক্ষার জন্যই আসিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহার আগমনের পূর্ব্বেই দুরাত্মা বাহাদুর চিতোরের সর্ব্বনাশ সাধন করে। তখন হুমায়ুন বাহাদুরের রাজ্য আক্রমণ করিয়া তাহার দুষ্কৃতির উপযুক্ত শাস্তি বিধান করিলেন।

 হুমায়ুনের সহায়তায় বিক্রমজিৎ আবার চিতোরের সিংহাসনে আরোহণ করিলেন বটে, কিন্তু অভিজ্ঞতায় তাঁহার কোন শিক্ষাই হইল না। সম্ভ্রান্ত সর্দ্দারগণ তাঁহার অত্যাচারে জর্জ্জরিত হইয়া তাঁহার পিতৃব্যপুত্র বনবীরকে চিতোরের রাজপদে অভিষিক্ত করিলেন। বিক্রমজিৎ পদচ্যুত হইয়া ভগ্নহৃদয়ে বাস করিতে লাগিলেন। সংগ্রামসিংহের শিশু পুত্র উদয়সিংহ তখন ছয় বৎসরের বালক। বালকের অপ্রাপ্ত বয়সকালে বনবীর রাজ্য-রক্ষক হইয়া রাজকার্য্য সমাধা করিবেন এইরূপ স্থিরীকৃত হইল। কিন্তু রাজশক্তির আস্বাদনে বনবীরের স্বভাব বিকৃত হইয়া উঠিল—নিষ্কণ্টকে বংশ পরম্পরায় রাজপদে প্রতিষ্ঠিত থাকিবার বাসনা তাঁহার হৃদয়ে প্রবল হইল। তখন বিক্রমজিৎ এবং বালক উদয়কে হত্যা করিবার জন্য বনবীর কৃতসংকল্প হইলেন। তাঁহার এ গুপ্ত অভিসন্ধির কথা কেহই জানিল না।

 একদিন দিবসের কার্য্য সমাপনান্তে সকলে আপন আপন কক্ষে সমাগত হইয়াছে। রাজপ্রাসাদে দীপমালা প্রজ্বলিত হইয়াছে। ক্রীড়াশীল বালক উদয় দিবাশেষে ধাত্রী মাতার গৃহে সমাগত। ধাত্রী পান্না পরম আদরে বালককে ক্রোড়ে লইয়া যথানিয়মে পান ভোজন করাইয়া তাহাকে শয্যায় শয়ন করাইয়া পার্শ্বে বসিয়া পরিচর্য্যা করতে লাগিল। এমন সময়ে সহসা অন্তঃপুরে ঘোর কোলাহল উপস্থিত হইল। প্রাসাদের অদূরে ক্রন্দনের রোল উত্থিত হইল। পান্না চকিত বিস্মিত হইয়া দণ্ডায়মান হল। সেই মুহূর্ত্তে এক ভৃত্য দৌড়িয়া আসিয়া সংবাদ দিল যে, বনবীর বিক্রমজিৎকে হত্যা করিয়াছে। বুদ্ধিমতী পান্না নিমেষে হৃদয়ঙ্গম করিল বনবীর বিক্রমজিৎকে হত্যা করিয়াই নিবৃত্ত হইবে না, অচিরে আসিয়া শিশু উদয়কে হত্যা করিবে। চক্ষের নিমেষে পান্নার কর্ত্তব্য নির্ণয় হইয়া গেল।—সর্ব্বস্ব পণ করিয়াও সংগ্রামসিংহের বংশধরকে রক্ষা করিতেই হইবে। নিদ্রিত উদয়সিংহকে ক্রোড়ে লইয়া ত্বরায় তাহাকে এক পুষ্পকরন্তিকায় রাখিয়া তাহাপত্রপুষ্পে আচ্ছাদন করিয়া ভৃত্যকে আদেশ করিল, “ত্বরায় ইহা লইয়া দৃষ্টির বাহিরে গমন করিয়া কোন নিরাপদ স্থানে রক্ষা কর। আমি ত্বরায় যাইতেছি।” উদয়কে প্রেরণ করিয়া পান্না বিবেচনা করিল, শূন্য শয্যা দেখিলে বনবীর সকলই জানিতে পারিবে। তখন আপনার নিদ্রিত শিশুপুত্রকে আনিয়া প্রতাপের শয্যায় শয়ন করাইল। স্বচক্ষে পুত্রের নিধন দেখিতে পারিবে না মনে করিয়া পান্না ত্বরিতে গৃহত্যাগ করিবার উদ্যোগ করিতেছে। এমন সময় বনবীর দ্রুতবেগে রক্তাক্ত উন্মুক্ত অসি হস্তে লইয়া সেই গৃহে উপস্থিত হইয়াই—বিকট স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “ধাত্রী রাজকুমার উদয়সিং কই—” ধাত্রী নীরব, মুখে বাক্যস্ফূর্ত্তি হইল না। বনবীর গর্জ্জন করিয়া বলিয়া উঠিল, “দেখিতেছ না আমার হস্তে উন্মুক্ত অসি? শীঘ্র বল কোথায় উদয়।” ধাত্রী অঙ্গুলিসঙ্কেতে প্রতাপের শয্যা দেখাইয়া চক্ষুঃ না ফিরাইতেই পামর বনবীর শিশুর বক্ষঃস্থলে তরবারি বিদ্ধ করিয়া দিল। পান্নার প্রাণের ভীষণ অবস্থা শোকের অতীত। আজ তাহার চক্ষে অশ্রু নাই, বদনে এক ভৈরব ভাবের আবির্ভাব হইল। উন্মত্তের ন্যায় ত্বরিত-পাদবিক্ষেপে গৃহ হইতে নির্গত হইয়া উর্দ্ধশ্বাসে উদয়সিংহের পশ্চাতে ধাবমান হইল। পান্নার চক্ষে চিতোরপুরী আজ এক ভীষণ নরকের মর্ত্তি ধারণ করিয়াছে। হায় ভগবন্, এই কি শিশোদীয় কুলের পবিত্র পীট চিতোর?—পাষণ্ড বনবীর যে আজ নারকীয় দৃশ্যের অভিনয় করিতেছে? কোথায় পলায়ন করি? এই পামরের হস্ত হইতে সংগ্রামসিংহের বংশধরকে রক্ষা করি কিরূপে?—জোড়হস্তে উর্দ্ধানেত্রে পান্না ক্রমাগত বলিতেছে, “ভগবন্, রক্ষা কর! জননী হইয়া নিদ্রিত অসহায় শিশুকে বলি দেওয়া অপেক্ষা অভাগিণী পান্না আর কি করিতে পারে?— হায় আমার অভাগা শিশু, শৈশবে তুমি যে রাজকুমারের জন্য মাতৃদুগ্ধে বঞ্চিত হইয়াছিলে। আজ তাহার জন্য তোমার সুকুমার জীবন ধ্বংস হইল! ওঃ! আমি দৃশ্যই দেখিলাম! হায় আমি কি কুক্ষণেই রাজপুরীতে পদার্পণ করিয়াছিলাম! সাধ্বী মহিষি, আজ তুমি স্বর্গ হইতে দেখ অভাগিণী পান্না হৃদ্‌পিণ্ড ছেদন করিয়া তোমার নিকট শপথ পালন করিল।” নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপনীত হইয়া পান্না দেখে শিশু উদয়সিংহ তখনও নিদ্রিত। পান্না ভাবিল বালককে বক্ষে ধরিয়া হৃদয় শীতল করিবে। কিন্তু এ জীবনে সে ভীষণ অগ্নি আর নির্ব্বাপিত হইবার নহে। পান্না শিশুকে লইয়া সমুদায় বিশ্বস্ত সর্দ্দারের আশ্রয় ভিক্ষা করিল। বনবীরের ভয়ে কেহই শিশুকে আশ্রয় দিতে সম্মত হইল না। ধাত্রী পান্না নিজ সন্তানের জীবনের বিনিময়ে যাহার জীবন রক্ষা করিল; আজ তাহার পিতার প্রসাদভোগী সর্দ্দারগণ দুর্দ্দিনে সেই শিশুকে আশ্রয় দিল না। ক্ষোভে দুঃখে ঘৃণায় পান্নার হৃদয় জ্বলিতে লাগিল! অবশেষে আশাশা নামে একজন জৈন সর্দ্দারের গৃহে উপনীত হইয়া শিশুর জন্য আশ্রয় ভিক্ষা করিল। আশাশা অপরাপর সর্দ্দারদিগের ন্যায় প্রথমে অসম্মত হইলেন বটে কিন্তু তাঁহার বৃদ্ধা জননী পুত্রকে শত ধিক্কার দিয়া বলিলেন, “বৎস একটী শিশুকে আশ্রয় দিতে তোমার এত ভয়! সংগ্রামসিংহের নিকট তুমি কি ঋণী নহ? নিশ্চয় জানিও তুমি এই শিশুকে আশ্রয় দিলে সেই পুণ্যফলে বিধাতা তোমার চিরকল্যাণ করিবেন।”

 জননীর অনুরােধে আশাশা উদয়সিংহকে ভাগিনেয় বলিয়া পরিচয় দিয়া গ্রহণ করিলেন। ধাত্রী পান্নার হৃদ্‌পিণ্ডচ্ছেদন বৃথা হয় নাই। উদয় সিংহ কালে চিতাের সিংহাসনে উপবেশন করিয়াছিলেন এবং বীরশ্রেষ্ঠ প্রতাপসিংহ ইহাঁরই পুত্র।

 মিবারের ইতিহাসে পান্নার অপূর্ব্ব আত্মত্যাগ এবং অদ্ভুত কর্ত্তব্যনিষ্ঠার কথা স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত আছে। রাজপুত জাতির সকল কাহিনী অত্যাশ্চর্য্য! কোথায় কে শ্রবণ করিয়াছে ধাত্রীমাতা প্রভুর সন্তানকে রক্ষা করিবার জন্য আপন সন্তানকে ঘাতেকর হস্তে সমৰ্পণ করিয়াছে? ধন্য বীরনারী পান্না! ধন্য তােমার মহীয়সী কীর্ত্তি। তুমি সমুদায় নারীকুলের নমস্যা।


  1. জহর ব্রত রাজপুত রমণীর এক ভীষণ ব্রত। শত্রু হস্তে পতিত হবার সম্ভাবনা দেখিলে সমুদায় রাজপুত রমণী সমবেত হইয়া শিশু সন্তানদিগকে ক্রোড়ে করিয়া ভীষণ অগ্নিকুণ্ডে লম্ফ দিয়া প্রাণত্যাগ করিতেন।