মিবার-গৌরব-কথা/রাণা সঙ্গ বা সংগ্রামসিংহ
মিবারের রাণা মুকুলজীর পুত্র রাণা কুম্ভ মিবারের ইতিহাসে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। তিনি যেমন বীর, তেমনই বিবিধ রাজগুণে বিভূষিত ছিলেন। তাঁহার কীর্ত্তিকথা মিবারের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া আছে। রাণা কুম্ভ সম্বন্ধে একটি অতি আশ্চর্য্য গল্প আছে। তিনি একদা কোন বিশেষ যুদ্ধে জয়ী হইয়া পরদিন হইতে প্রত্যহ কোন আসনে উপবেশন করিবার পূর্ব্বে আপনার তরবারি মস্তকোপরি তিনবার প্রদক্ষিণ করিতেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র রায়মল্ল প্রতিদিনই পিতার এই কার্য্যটী দেখিয়া মনে মনে অতি বিস্মিত হইতেন। একদিন কৌতুহলী হইয়া পুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “পিতঃ! প্রতিদিনই যে আপনি আসন পরিগ্রহ করিবার পূর্ব্বে মস্তকের চারিদিকে তিনবার তরবারি প্রদক্ষিণ করেন তাহার অর্থ কি?”
এই প্রশ্ন শুনিয়াই রাণা অগ্নিবর্ণ হইয়া উঠিলেন এবং পুত্রকে তৎক্ষণাৎ মিবার রাজ্য হইতে নির্ব্বাসিত করিয়া দিলেন। বীরবর রাণা কুম্ভ অন্যতম পাষণ্ড পুত্রের হস্তে জীবলীলা সম্বরণ করেন। কুম্ভের মৃত্যুর পর রায়মল্ল আসিয়া পিতৃসিংহাসন অধিকার করিলেন। রায়মল্লের অদৃষ্টে পারিবারিক সুখ বিধাতা লেখেন নাই। তাঁহার তিনটী পুত্র ছিলেন; তাঁহারা ভ্রাতৃপ্রেম বিস্মৃত হইয়া পরস্পরের সহিত বিবাদ বিসম্বাদে কালযাপন করিতেন। জ্যেষ্ঠ সঙ্গ, মধ্যম পৃথ্বীরাজ এবং কনিষ্ঠ জয়মল্ল। পিতার জীবদ্দশাতেই চিতােরের সিংহাসন কে অধিকার করিবে এই প্রশ্ন লইয়া তাঁহারা সর্ব্বদাই তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতেন। পুত্রত্রয়ই পৈতৃক সিংহাসন লাভের জন্য ব্যাকুল এবং পরস্পরের শত্রুতা সাধনে বদ্ধপরিকর। একদিন তাঁহারা তিনজনেই পিতৃব্য সূর্য্য মল্লের সম্মুখে এই বিষয় লইয়া ঘোর তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। কিছুতেই এ প্রশ্নের মীমাংসা হয় না। তখন সঙ্গ বলিলেন, “নাহরা মুগরার[১] চারণী দেবীর পরিচারিকা সন্ন্যাসিনী যাঁহাকে নির্ব্বাচিত করিবেন তিনিই মিবার রাজ্যের উত্তরাধিকারী হইবেন।” এই প্রস্তাবে সকলেই সম্মত হইয়া স্ব স্ব ভাগ্য পরীক্ষার জন্য সন্ন্যাসিনীর আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। পৃথ্বীরাজ এবং জয়মল্ল অগ্রেই গৃহে প্রবেশ করিয়া একখানি আসনে উপবেশন করিলেন। তাঁহাদের পশ্চাতেই সঙ্গ এবং সূর্য্যমল্ল প্রবেশ করিয়া অপর একখানি ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপর উপবেশন করিলেন। সকলেই নীরব—কাহার মুখে বাক্য নাই। কিয়ৎক্ষণ পরে পৃথ্বীরাজ তাঁহাদিগের আগমনের কারণ সন্ন্যাসিনীকে জ্ঞাপন করিলেন। সন্ন্যাসিনী কোন বাক্যই উচ্চারণ না করিয়া অঙ্গুলি সঙ্কেত দ্বারা ব্যাঘ্রচর্ম্ম দেখাইয়া দিলেন। জ্যেষ্ঠ সহােদরের সৌভাগ্যের কথা জানিয়া পৃথ্বীরাজ ক্রোধে অন্ধ হইলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য ধাবিত হইলেন। সূর্য্যমল্ল সঙ্গকে রক্ষা করিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। দেবীমন্দিরে তুমুল যুদ্ধের অভিনয় হইল। সকলেই অত্যধিক পরিমাণে আহত হইলেন। সঙ্গের একটী চক্ষু নষ্ট হইয়া গেল। ভ্রাতৃগণের রক্তে পবিত্র মন্দির কলুষিত হইল। সন্ন্যাসিনী এই দৃশ্য দেখিয়া উৰ্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিলেন। পৃথ্বীরাজও গুরুতররূপে আহত হইয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার প্রচণ্ড ক্রোধ কিছুতেই প্রশমিত হইবার নহে। দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া সঙ্গের সর্ব্বনাশ সাধন করিবার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন। সঙ্গ দেখিলেন, পৃথ্বীরাজের সহিত পিতৃগৃহে বাস করা অসম্ভব। তিনি ছদ্মবেশে নিরুদ্দেশ হইয়া দেশে দেশে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাহাতেও পৃথ্বীরাজের জিঘাংসা প্রশমিত হইল না। তিনি ভ্রাতার নিধনের জন্য দেশে দেশে গুপ্তচর নিযুক্ত করিলেন। সঙ্গ মিবারের রাজকুমার হইয়াও এই সময় যে নিদারুণ দুঃখ সহ্য করিয়াছিলেন তাহার বর্ণনা হয় না। একদা তিনি ছাগরক্ষকের গৃহে অতিথি হইয়া কিছুদিন তথায় বাস করেন। তাহারা তাঁহাকে ছাগরক্ষণ কার্য্যে এবং অন্যান্য শ্রমসাধ্য কার্য্যে নিযুক্ত করিয়া দিনান্তে অতি অপকৃষ্ট খাদ্য আহার করিতে দিত। সঙ্গ রাজকুমার—তিনি ছাগরক্ষণ কার্য্য উত্তমরূপে করিতে পারিতেন না। তাহারা তাঁহাকে সে জন্য অনেক দুৰ্বাক্য বলিত। সঙ্গ নীরবে সকল সহ্য করিতেন। আমরা ইংলণ্ডের ইতিহাসে “এলফ্রেড দি গ্রেটের” গল্প শুনিতে পাই। রাণা সঙ্গও মিবারের “এলফ্রেড দি গ্রেট ছিলেন। নির্ব্বাসিত হইয়াও এক দিনের জন্য তিনি মিবারের সিংহাসন লাভের জন্য নিশ্চেষ্ট হন নাই। এদিকে পিতা রায়মল্ল জ্যেষ্ঠপুত্রের অদর্শনে নিতান্ত ম্রিয়মাণ হইলেন, এবং পৃথ্বীরাজই সকল অনর্থের মূল বিবেচনা করিয়া তাঁহাকেও মিবার রাজ্য হইতে নির্ব্বাসিত করিলেন; এতদিন সঙ্গের যে দশা ছিল পৃথ্বীরাজের ভাগ্যেও তাহাই হইল। কিন্তু রাজপুতের হস্তে তরবারি থাকিলে তাঁহার আর ভাবনা কি? নির্ব্বাসিত হইয়াও পৃথ্বিরাজের বীরত্বের গৌরব ম্লান হইল না। ওদিকে সঙ্গ কাশ্মীর রাজ্যে উপনীত হইয়া দস্যুপতি করিমচাঁদের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। করিমচাঁদ সঙ্গের বীরত্ব, সাহস, তেজস্বিতা ও উদ্যম দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া তাঁহার হস্তে কন্যা সম্প্রদান করিলেন।
রায়মল্লের জীবদ্দশাতেই ভগিনীপতিপ্রদত্ত বিষ ভক্ষণে পৃথ্বীরাজের মৃত্যু হইল। বৃদ্ধ রায়মল্ল পুত্রশোকে জর্জ্জরিত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। পুত্রদিগের পরস্পরের বৈরীভাব তাঁহার জীবনকে বিষময় করিয়া তুলিয়াছিল। রায়মল্লের মৃত্যুর সময় সঙ্গ কাশ্মীরে অবস্থান করিতেছিলেন। তিনি পিতার মৃত্যুসংবাদ শ্রবণ করিয়া চিতোরে আগমনপূর্ব্বক রাজ্যভার গ্রহণ করিলেন। তাঁহার সুশাসনগুণে অতি অল্পদিনের মধ্যে প্রজাগণ তাঁহার একান্ত অনুরক্ত হইয়া পড়িল। রাণা সঙ্গ ইতিহাসে সংগ্রামসিংহ নামে পরিচিত। তাহার ন্যায় বীর এবং উপযুক্ত ব্যক্তি সে সময়ে রাজপুতানায় আর ছিল না। তাঁহার বীরত্ব, প্রতাপ ও রণকৌশল দর্শনে কেহ আর মিবারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিত না। দিল্লী ও মালবের নৃপতিগণ অষ্টাদশবার সংগ্রামসিংহের সহিত সংগ্রামে পরাজিত হইয়া হতমান হইয়া ছিলেন। তখনকার দিনে সংগ্রাম সিংহের নাম শ্রবণ করিলে শক্রদিগের হৃদ্কম্প উপস্থিত হইত। দিল্লীর সাম্রাজ্যের তখন পতনদশা, দিল্লীর সম্রাট সংগ্রাম সিংহের নিকট হতমান হইয়া একেবারে নিষ্প্রভ হইয়া পড়িয়া ছিলেন। খোরসানের অধিপতি বীরবর বাবর সুযোগ বুঝিয়া ভারত সাম্রাজ্যে পদার্পন করিয়া পাণিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করিয়া দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করিলেন। দৃঢ় অধ্যবসায়, কঠোর সহিষ্ণুতা এবং অসাধারণ উদ্যমশীলতার অসাধ্য কি আছে? বাবর যে বিজয়ী হইলেন তাহাতে আর বিচিত্র কি?
বাবর দিল্লীর সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত সংগ্রাম সিংহের দর্প চূর্ণ করিবার জন্য চিতোরের অভিমুখে ধাবিত হইলেন। সংগ্রাম সিংহও নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তিনিও বাবরের সম্মুখীন হইবার জন্য বিধিমতে প্রস্তুত হইলেন। বিয়ানার নিকটবর্ত্তী কনুয়ানামক স্থানে উভয়ের সৈন্যদলের সাক্ষাৎ হইল। অচিরে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। প্রথম যুদ্ধে যবন সেনা বিধ্বস্ত বিক্ষিপ্ত হইয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করিল।— বাবর শাহ অপর এক বাহিনী লইয়া নিকটেই ছিলেন। তিনি ভগ্নদূত মুখে সমুদায় বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া আবার সমুদায় ছত্রভঙ্গ সৈন্যদিগকে একত্রিত করিয়া যুদ্ধে আহ্বান করিলেন। যবন সৈন্যগণ সংগ্রাম সিংহের সম্মুখীন হইতে কিছুতেই প্রস্তুত হইল না। বাবরশাহ কত উৎসাহিত করিলেন, কত প্রলোভন দেখাইলেন, কত মিষ্ট বাক্য বলিলেন তাঁহার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইবার উপক্রম হইল। বাবর বড় সুরাপ্রিয় ছিলেন প্রতিজ্ঞা করিলেন এ জীবনে আর সুরা স্পর্শ করিবেন না। যেখানে যত সুরাপাত্র ছিল সকলই চূর্ণ বিচুর্ণ করিলেন। অনন্যোপায় হইয়া লজ্জা ঘৃণায় ম্রিয়মান হইয়া পড়িলেন। এমন সময়, সহসা তাঁহার সৈন্যগণ উৎসাহিত হইয়া রণপ্রদানে সম্মত হইল! তখন তিনি পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ করিয়া মহোৎসাহে পূর্ণ হইয়া কোরাণ আনিয়া প্রত্যেক সৈন্যকে তাহা স্পর্শ করাইয়া প্রতিজ্ঞা করাইলেন “হয় বিজয়ী বেশে রণক্ষেত্র হইতে আসিবে, না হয় বীরের ন্যায় তথায় নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করিবে” সকলেই কোরাণ স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইল। শপথ করিয়া ঘোর নিনাদে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল! আবার হিন্দু মুসলমানে ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হইল। বাবর আত্মরক্ষার জন্য পরিখা মধ্যে অবস্থিতি করিতে গাগিলেন। চতুর্দ্দিকে কামান শ্রেণী সজ্জিত করিয়া রজ্জু দ্বারা দৃঢ় বন্ধন করিলেন। পরিখা মধ্যে কিছুদিন অবস্থিতি করিয়া বাবরের সৈন্যগণের কষ্টের এক শেষ হইল। তিনি সংগ্রাম সিংহের সহিত সন্ধি করিবার জন্য ব্যাকুল হইলেন। কিন্তু সন্ধির প্রস্তাব উপস্থিত হইয়াও কার্য্যে পরিণত হইল না। রাজপুতসেনা বিজয়মদোন্মত্ত হইয়া যুদ্ধের জন্য অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল। আজীবন যুদ্ধে জয় হইয়া সংগ্রামসিংহ নিতান্ত আত্মপ্রত্যয়শীল হইয়া উঠিয়া ছিলেন। রাজপুতগণ নিতান্ত অনভিজ্ঞের ন্যায় বাবরের ব্যুহ আক্রমণ করিল! যুদ্ধের মধ্যস্থলে সংগ্রামসিংহে দলস্থ একজন সর্দ্দার সসৈন্যে বাবরের সহিত যোগদান করিল। হায়। এতদিন পরে সংগ্রামসিংহের প্রতি বিজয়লক্ষ্মী বিমুখ হইলেন! দ্বিতীয় যুদ্ধে সংগ্রামসিংহ পরাস্ত হইলেন। তিনি ভগ্ন হৃদয়ে মিবারের অভিমুখে যাত্রা করিলেন বটে, কিন্তু চিতোরে আর প্রবেশ করিলেন না। পর্ব্বতে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। সংগ্রামসিংহ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, হয় বিজয়ী বেশে চিতোরে প্রবেশ করিবেন নচেৎ আর পিতৃপুরুষের পবিত্র রাজধানীতে প্রবেশ করিবেন না। চিতোরবাসী সংগ্রামসিংহকে চিরদিন বিজয়ী দেখিয়া আসিয়াছে। আজ হতমান হইয়া চিতোরবাসীকে আর মুখ দেখাইলেন না। রাজপুত বীর কি কখন যুদ্ধক্ষেত্র হইতে প্রাণ লইয়া ফিরিয়া আইসে? সংগ্রামসিংহ আর চিতোরে পদার্পণ করিলেন না। কিন্তু যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, চিতোর উদ্ধারের আশা এবং চেষ্টা পরিত্যাগ করেন নাই। কিন্তু তাঁহার আশা ফলবতী হইবার পূর্ব্বেই মৃত্যু আসিয়া তাঁহাকে গ্রাস করিল। গুণগ্রাহী বাবর সংগ্রামসিংহের বীরত্ব দর্শনে শতমুখে তাঁহার সাধুবাদ করিয়া গিয়াছেন। বাবর এবং সংগ্রামসিংহ উভয়েই যৌবনে অশেষবিধ দুঃখ বিপদ্ সংগ্রামের ভিতর চরিত্রের বল সঞ্চয় করিয়াছিলেন। পরস্পর শত্রু হইলেও তাঁহাদের চরিত্র একই উপাদানে গঠিত হইয়াছিল। বীরত্ব, তেজস্বিতা, অসাধারণ ধৈর্য্য ও প্রগাঢ় অধ্যবসায় উভয়ের চরিত্রের প্রধান গুণ ছিল।—যেমন বাবর শাহ তেমনি সংগ্রামসিংহ—উভয় উভয়ের সমকক্ষ!
- ↑ উদয়পুরের পাঁচ ক্রোশ দূরে অবস্থিত।