বিষয়বস্তুতে চলুন

মিবার-গৌরব-কথা/হামিরের চিতোর উদ্ধার

উইকিসংকলন থেকে

হামিরের চিতোর উদ্ধার।

  দিল্লীর সমাট আলাউদ্দীন দুইবার চিতোর আক্রমণ করিয়াছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন আক্রমণ করেন তখন রাণা অজয়সিংহ পিতার একান্ত অনুরোধে জীবন রক্ষা করিতে বাধ্য হন। আলাউদ্দীন চিতোর জয় করিয়া চিতোরের শাসনভার মালদেবের হস্তে ন্যস্ত করেন। মালদেব দিল্লীশ্বরের আশ্রিত হইয়া পরম সুখে চিতোর রাজ্য ভোগ করিতে থাকেন। ওদিকে অজয়সিংহ নির্ব্বাসিতের ন্যায় পর্ব্বতে পর্ব্বতে জঙ্গলে জঙ্গলে লুকাইত থাকিয়া পিতৃরাজ্য উদ্ধারের চেষ্টায় নিযুক্ত রহিলেন, কিন্তু তিনি সফলকাম হইতে পারেন নাই। তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র হামির তাঁহার প্রাণের এই চিরপোষিত আকাঙ্ক্ষা কার্য্যে পরিণত করেন।

 মালদেব গোপনে এবং ছলনাপূর্ব্বক হামিরের সহিত নিজের বিধবা কন্যার বিবাহ দিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহাতে হামির শত্রুর নিকট এরূপ অপমানিত হইয়া প্রতিশোধ লইতে বিস্মৃত হন নাই। মালদেব জামাতা বলিয়া যাঁহাকে সাদরে গ্রহণ করিয়াছিলেন তাঁহার হস্তেই পররাজ্য অপহরণের উপযুক্ত শান্তি পাইয়াছিলেন। বিবাহের পর মালদেব যখন হামিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমার নিকট কিরূপ যৌতুক চাও”? তখন তিনি পত্নীকে একথা উল্লেখ করিলে মালদেব দুহিতা বলিলেন “তুমি আর কিছুই গ্রহণ করিও না, কেবল পিতার উপযুক্ত কর্ম্মচারী জালকে প্রার্থনা করিও, তাঁহার সহায়তায় তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে।” হামির তাহাই করিলেন।

 মালদেবদুহিতার গর্ভে হামিরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ক্ষেত্র সিংহ জন্মগ্রহণ করিলেন। চিতোরের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা ক্ষেত্রপালের নামানুসারে কুমারের নাম ক্ষেত্র সিংহ রাখা হইল। রাজকুমার যখন শিশু, তখন দৈবজ্ঞেরা গণনা করিয়া বলিলেন যে বালকের উপর ক্ষেত্রপালের রোষদৃষ্টি পড়িয়াছে, দেবতার কোপের শান্তি না হইলে শিশুর আর কল্যাণ নাই। এই বিষম কথা শুনিয়া পিতামাতা অপার চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। হামিরের পত্নী শেষে স্বীয় পিতাকে বলিয়া পাঠাইলেন, যে চিতোরে ক্ষেত্রপালের বিধি পূর্ব্বক পূজা অর্চ্চনা না করিলে পুত্রের আর মঙ্গল নাই। মালদেব এই কথা শুনিয়া কন্যা এবং দৌহিত্রকে লইয়া যাইবার জন্য একদল অশ্বারোহী সৈন্য পাঠাইলেন। হামিরের-পত্নী পুত্রকে লইয়া বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী জালের সহিত চিতোরে যাত্রা করিলেন। যাইবার সময় হামিরকে ডাকিয়া বলিলেন “আমি জালের সহায়তায় চিতোরের প্রধান প্রধান সর্দ্দারদিগকে হস্তগত করিবার চেষ্টা করিব, তুমি সসৈন্যে চিতোর আক্রমণ করিবে, তাহা হইলে তোমার পক্ষে চিতোর জয় নিতান্ত দুঃসাধ্য হইবে না।”

 হামির বলিলেন “সমুখ সমরে আমার হস্তে তোমার পিতার নিধন হইলে তুমি আমাকে মার্জ্জনা করিবে কি? আমার পরম শত্রু হইলেও তিনি ত তোমার পিতা।” হামির পত্নী বলিলেন “তোমার হস্তে আমার পিতার নিধন আমি ইচ্ছা করি না; তুমি আমার পিতার জীবন অব্যাহতি দিও। তবে আমি তোমাকে চিতোরের সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখিতে চাই। তুমি চিতোরের রাণা হইবে ইহা অপেক্ষা আমার অধিক সুখের বিষয় আর কি হইতে পারে?”

 হামিরের পত্নী চিতোরে উপস্থিত হইয়া দেখেন পিতা কোথায় সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছেন। বড়ই সুযোগ উপস্থিত; পিতার সহিত পতিকে সম্মুখ সমরে প্রবৃত্ত হইতে হইবে না। এই ভাবিয়া অচিরে স্বামীকে এই সুসংবাদ পাঠাইলেন। হামির সসৈন্যে চিতোর আক্রমণ করিলেন। একি! সহসা কোথায় রণবাদ্য বাজিয়া উঠিল? মালদেবের অনুপস্থিতি কালে কোন্ শত্রু চিতোর আক্রমণ করিল? চিতোরবাসিগণ যখন শ্রবণ করিল, আক্রমণকারী চিতোরের রাজবংশধর হামির, তখন সকল উৎকণ্ঠা,সকল ভীতি, আনন্দে পরিণত হইল। চিতোরবাসিগণ হামিরকে চিরপরিচিত আত্মীয়ের ন্যায় সাদরে গ্রহণ করিল। মালদেবের অনুগত সৈন্যগণ হামিরের গতিরোধ করিতে চেষ্টা করিল; কিন্তু হামিরের প্রচণ্ড বলের নিকট কেহই অগ্রসর হইতে পারিল না। চিতোরবাসিগণ গগন বিদারী হঙ্কারে চিতোরের উদ্ধার কর্ত্তা হামিরের জয় জয়কার ঘোষণা করিল। হামিরের চিরজীবনের সাধ পূর্ণ হইল। পিতৃপুরুষের গৌরবান্বিত সিংহাসনে উপবিষ্ট হইয়া তিনি আপনাকে ধন্য ও কৃতার্থ মনে করিলেন। মালদেব দিলীশ্বরের সহায়তা লাভ করিয়াও আর চিতোরের সিংহাসন ফিরিয়া পাইলেন না।