মিবার-গৌরব-কথা/হামিরের জননী কৃষকবালা
হামিরের জননী কৃষকবালা।
পাঠক পাঠিকাগণ, ইতিপূর্ব্বেই রাণা লক্ষণ সিংহ এবং তাঁহার একাদশটী পুত্র চিতোরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর প্রীতির জন্য কিরূপে মুসলমানদিগের সহিত যুদ্ধে প্রাণ দিয়াছিলেন তাহার বিবরণ পাঠ করিয়াছ। লক্ষ্মণ সিংহের দ্বিতীয় পুত্র অজয় সিংহ কেবল পিতার অনুরোধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দান করিতে পারেন নাই। অজয় সিংহ চিতোর উদ্ধার করিতে অনেক চেষ্টা করিয়াও বিফল হন। কিন্তু অবশেষে তাঁহার ভ্রাতৃ-তনয় অরিসিংহের পুত্র হামির শত্রু হস্ত হইতে চিতোর উদ্ধার করেন। হামিরের জন্মবৃত্তান্ত অতি চমৎকার। একদিন অরিসিংহ কতিপয় বন্ধুর সহিত অন্দাবারণ্যে মৃগয়া করিতে গিয়াছিলেন। শীকার করি বার সময় একটী বন্য বরাহের পশ্চাতে ছুটিতে ছুটিতে এক বিশাল জনার ক্ষেত্রের ভিতর আসিয়া পড়িলেন। সেই ক্ষেত্রের মধ্যে এক মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া এক কৃষকবালা পশুপক্ষিদিগকে তাড়াইয়া দিতেছিল। রাণা উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া আসিয়া কৃষকবালাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমার, তোমার এই ক্ষেত্রের ভিতর একটি বন্য বরাহকে ছুটিয়া আসিতে দেখিয়াছ কি? সেটা কোন দিকে গিয়াছে বলিতে পার?” কৃষকবালা বলিল-“মহাশয়, আর ওদিকে যাইবেন না, বরাহ কোন দিকে গিয়াছে আমি দেখিয়াছি,— আপনারা অপেক্ষা করুন, আমি বরাহ ধরিয়া দিতেছি।” রাণা এবং তাঁহার বন্ধুগণ অবাক হইয়া কৃষকবালার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বালিকা তৎক্ষণাৎ ক্ষেত্র হইতে একটি জনারগাছ তুলিয়া অস্ত্র দিয়া তাহার অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ করিয়া লইল এবং মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া বরাহকে লক্ষ্য করিয়া সেইটি ছুঁড়িল। অমনি বরাহ বিদ্ধ হইয়া মাটীতে পড়িল। সকলে আসিয়া আশ্চর্য্য হইয়া জনার আহত মৃত বরাহকে দেখিতে লাগিল। রাণা কৃষকবালার অব্যর্থ লক্ষ্য দেখিয়া মনে মনে শত সাধুবাদ করিতে লাগিলেন। মৃগয়া শেষ করিয়া রাণা ও তাঁহার বন্ধুগণ নদীতটে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। রাণা বারম্বার কৃষকবালার কথা বলিতে লাগিলেন। এমন সময় হঠাৎ একটি মৃত্তিকা পিণ্ড আসিয়া অরিসিংহের অশ্বের পায়ে সজোরে লাগিল। অশ্বটি তৎক্ষণাৎ পড়িয়া গেল। সকলে কারণ অনুসন্ধান করিতে গিয়া দেখেন, মাচার উপর দাঁড়াইয়া কৃষকবালা পশুদিগকে প্রস্তর খণ্ড দ্বারা তাড়াইতেছে। তাঁহারই হস্ত নিক্ষিপ্ত একটি মুৎপিণ্ড আসিয়া অরিসিংহের প্রকাণ্ড অশ্বটিকেও ধরাশায়ী করিয়াছে কুমারী আপনার অপকার্য্য বুঝিতে পারিয়া, ব্যস্ত সমস্ত হইয়া মাচা হইতে নামিয়া, রাণার নিকট যােড় হস্তে বারম্বার বলিতে লাগিল, “মহাশয়, আমি না জানিয়া আপনার ঘােড়াটিকে মারিয়াছি, বােধ করি আপনার ঘােড়া আর চলিতে পারিবে না। আপনি দয়া করিয়া আমায় ক্ষমা করুন।” রাণা মিষ্টকথায় কৃষকবালাকে আশ্বস্ত করিয়া বিদায় দিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহারা গৃহে ফিরিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন, এবং কিছুদূর। যাইতে না যাইতেই পথে দেখিলেন, আবার সেই কৃষক- বালা! এবার তাহার মস্তকে দুগ্ধের কলস। কুমারী দুই হস্তে দুটিী মহিষশাবক তাড়াইয়া লইয়া চলিয়াছে, রাণা ও তাঁহার বন্ধুগণ এই দৃশ্য দেখিয়া হাসিতে লাগিলেন। রাণার বন্ধুগণ পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন “ওহে, রাণা এই কৃষকবালার অব্যর্থ লক্ষ্য ও বাহুবল দেখিয়া একেবারে মােহিত হইয়াছেন। জানিনা, তাঁহার মুগ্ধ হইবার আরও কোন কারণ আছে কিনা! দেখা যাক কৃষকবালার বল কত!” এই বলিয়া একজন হঠাৎ বেগে অশ্ব লইয়া কুমারীর উপর আসিয়া পড়িল, বালিকা চক্ষের একপলকে অশ্বারােহীর দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিল এবং তৎক্ষণাৎ মহিষশাবকদিগের গলরঞ্জু ঘােড়ার পায়ের সহিত এমন কৌশল করিয়া জড়াইয়া দিল যে, অশ্ব ও সওয়ার একত্রে ধরাশায়ী হইল। রাণা ও তাঁহার বন্ধুগণ হাসিয়া উঠিলেন। রাণা বলিলেন, “কিহে রাজপুতবীর। একথা কতদিন মনে থাকিবে?” সেই বীরের ধূলিধসরিত মুখখানি লজ্জায় রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। রাণা গৃহে ফিরিলেন, কিন্তু সেই কৃষকবালাকে কিছুতেই ভুলিতে পারিলেন না। তৎপরদিন রাণা সেই কৃষকবালাকে দর্শন করিবার জন্য বনে গমন করিলেন এবং তাহার পিতার নিকট তাহাকে বিবাহ করিবার ইচ্ছা জানাইলেন। নির্ব্বোধ কৃষক কিছুতেই সম্মত হইল না। অগত্যা রাণা বিষণ্ণ মুখে গৃহে ফিরিলেন। কৃষক বাড়ীতে ফিরিয়া পত্নীকে সমুদায় কথা বলিল। সে স্বামীর নির্ব্বুদ্ধিতার কথা শুনিয়া শতবার ধিকার দিয়া বলিল, “হায়, হায়, কি করিলে। চিতোরের রাণা তোমার জামাতা হইবে, এ সৌভাগ্য সহ্য হইল না। যাও তাঁহার চরণ ধরিয়া কন্যাকে তাঁহার গৃহে দিয়া আইস।” অগত্যা কৃষক কন্যাকে লইয়া রাণার সহিত বিবাহ দিয়া আসিল। এই বীরবালাই হামিরের জননী।