মৃণালিনী/চতুর্থ খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দশম পরিচ্ছেদ।


প্রেম—নানা প্রকার।

 আনন্দাশ্রু-প্লাবিত-বদনা মৃণালিনীকে হেমচন্দ্র হস্ত ধরিয়া উপবন গৃহাভিমুখে লইয়া চলিলেন। হেমচন্দ্র মৃণালিনীকে একবার অপমানিতা, তিরস্কৃতা, ব্যথিতা, করিয়া ত্যাগ করিয়া গিয়াছিলেন আবার আপনিই আসিয়া তাঁহাকে হৃদয়ে গ্রহণ করিলেন,—ইহা দেখিয়া গিরিজায়া বিস্মিত হইল; কিন্তু মৃণালিনী একটি কথাও জিজ্ঞাসা করিলেন না—একটি কথাও কহিলেন না। আনন্দ-পরিপ্লববিবশা হইয়া বসনে অশ্রুস্রুতি আবরিত করিয়া চলিলেন। গিরিজায়াকে ডাকিতে হইল না—সে স্বয়ং অন্তরে থাকিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

 উপবনবাটিকায় মৃণালিনী আসিলে তখন উভয়ে বহুদিনের হৃদয়ের কথা সকল ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তখন হেমচন্দ্র, যে যে ঘটনায় মৃণালিনীর প্রতি তাঁহার চিত্তের বিরাগ হইয়াছিল, আর যে যে কারণে সেই বিরাগের ধ্বংস হইয়াছে তাহা বলিলেন। তখন মৃণালিনী যে প্রকারে হৃষীকেশের গৃহ ত্যাগ করিয়া ছিলেন, যে প্রকারে নবদ্বীপে আসিয়াছিলেন সেই সকল তখন উভয়েই পূর্ব্বোদিত কত হৃদয়ের ভাব পরস্পরের নিকট ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তখন উভয়েই কত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কল্পনা করিতে লাগিলেন। তখন কতই নূতন নূতন প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ হইতে লাগিলেন। তখন উভয়ে নিতান্ত নিষ্প্রয়োজনীয় কত কথাই অতি আবশ্যকীয় কথার ন্যায় আগ্রহ সহকারে ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তখন কতবার
১৭২
মৃণালিনী।
উভয়ে মোক্ষোন্মুখ অশ্রুজল কষ্টে নিবারিত করিলেন; তখন কতবার উভয়ের মুখপ্রতি চাহিয়া অনর্থক মধুর হাসি হাসিলেন—সে হাসির অর্থ “আমি এখন কত সুখী।” পরে যখন প্রভাতোদয়সূচক পক্ষিগণ রব করিয়া উঠিল, তখন কতবার উভয়েই বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন যে “আজি এখনই রাত্রি পোহাইল কেন?”—আর সেই নগরমধ্যে যবনবিপ্লবের যে কোলাহল উচ্ছ্বসিতসমুদ্রের বীচিরববৎ উঠিতেছিল—আজি হৃদয় সাগরের তরঙ্গরবে সে রব ডুবিয়া গেল।

 উপবনগৃহে আর এক স্থানে আর একটা কাণ্ড হইতেছিল। দিগ্বিজয় প্রভুর আজ্ঞামত রাত্রি জাগরণ করিয়া গৃহ রক্ষা করিতেছিল, মৃণালিনীকে লইয়া যখন হেমচন্দ্র আইসেন, তখন সে দেখিয়া চিনিল। মৃণালিনী তাহার নিকট অপরিচিতা ছিলেন না—যে কারণে পরিচিত ছিলেন, তাহা ক্রমে প্রকাশ পাইতেছে। মৃণালিনীকে দেখিয়া দিগ্বিজয় কিছু বিস্মিত হইল কিন্তু জিজ্ঞাসার সম্ভাবনা নাই; কি করে? ক্ষণেক পরে গিরিজায়াও আসিল দেখিয়া দিগ্বিজয় মনে ভাবিল “বুঝিয়াছি—ইহারা দুই জন গৌড় হইতে আমাদিগের দুই জনকে দেখিতে আসিয়াছে। ঠাকুরাণী যুবরাজকে দেখিতে আসিয়াছেন—আর এ ছুঁড়ি আমাকে দেখিতে আসিয়াছে সন্দেহ নাই।” এই ভাবিয়া দিগ্বিজয় একবার আপনার গোঁপ দাড়ি চুমরিয়া ইল, এবং ভাবিল, “না হবে কেন?” আবার ভাবিল, “এ ছুঁড়ি কিন্তু বড় নষ্ট—এক দিনের তরে কই আমাকে যে ভাল কথা বলে নাই—কেবল আমাকে গালিই দেয়—তবে ও আমাকে দেখিতে আসিবে তাহার সম্ভাবনা কি? যাহা হউক একটা পরীক্ষাই করিয়া দেখা যাউক। রাত্রি ত শেষ হইল—প্রভুও ফিরিয়া আসিয়াছেন এখন আমি পাশ কাটিয়া একটুকু শুই। দেখি মাগী আমাকে খুঁজিয়া লয় কি না?” ইহা ভাবিয়া দিগ্বিজয় এক নিভৃত স্থানে গিয়া শয়ন করিল। গিরিজায়া তাহা দেখিল।

 দুর্ভাগ্যক্রমে দিগ্বিজয় রাত্রিজাগরণে ক্লান্ত ছিল শয়ন মাত্র নিদ্রাভিভূত হইয়া সকল বিস্মৃত হইল। গিরিজায়া তখন মনে মনে বলিতে লাগিল, “আমি ত মৃণালিনীর দাসী—মৃণালিনী এ গৃহের কর্ত্রী হইলেন অথবা হইবেন—তবে ত বাড়ীর গৃহকর্ম্ম করিবার অধিকার আমারই। এইরূপ মনকে প্রবোধ দিয়া গিরিজায়া একগাছা ঝাঁটা সংগ্রহ করিল এবং যে ঘরে দিগ্বিজয় শয়ন করিয়া আছে সেই ঘরে প্রবেশ করিল। দিগ্বিজয় চক্ষু বুজিয়া আছে, পদধ্বনিতে বুঝিল যে গিরিজায়া আসিল—মনে বড় আনন্দ হইল—তবেত গিরিজায়া তাঁহাকে ভাল বাসে? দেখি গিরিজায়া কি বলে? এই ভাবিয়া দিগ্বিজয় চক্ষু বুজিয়াই রহিল। অকস্মাৎ তাহার পৃষ্ঠে দুম্ দাম্ করিয়া ঝাঁটার ঘা পড়িতে লাগিল। “আঃ মলো ঘর গুলায় ময়লা জমিয়া রহিয়াছে দেখ—এ কি? এক মিন্সে চোর নাকি? মলো মিন্সে! রাজার ঘরে চুরি!” এই বলিয়া আবার সম্মার্জ্জনীর আঘাত। দিগ্বিজয়ের পিট ফাটিয়া গেল।

 “ও গিরিজায়া—আমি! আমি!” “আমি! আমি! আরে তুই বলিয়াই ত খাঙ্গরা দিয়া বিছাইয়া দিতেছি।” এই বলিবার পর আবার বিরাশী সিল্কা ওজনে ঝাঁটা পড়িতে লাগিল।

 “দোহাই! দোহাই! গিরিজায়া! অমি দিগ্বিজয়।” (আবার চুরি করিতে এসে আমি দিগ্বিজয়! দিগ্বিজয় কেরে মিন্সে।” ঝাঁটার বেগ আর থামে না।

 দিগ্বিজয় এবার সকাতরে কহিল, “গিরিজায়া আমাকে একেবারে ভুলিয়া গেলে?”  গিরিজায়া বলিল “তোর সঙ্গে আমার সঙ্গে কোন্ পুরুষে আলাপ রে মিন্সে!”

 দিগ্বিজয় দেখিল নিস্তার নাই—রণে ভঙ্গ দেওয়াই পরামর্শ। দিগ্বিজয় তখন অনুপায় দেখিয়া, উর্দ্ধশ্বাসে গৃহ হইতে পলায়ন করিল। গিরিজায়া সম্মার্জ্জনী হস্তে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইল।