মৃণালিনী/চতুর্থ খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।


জাল ছিঁড়িল।

 বঙ্গেশ্বরপুরে অধিষ্ঠিত হইয়াই বখ্‌তিয়ার খিলিজি ধর্ম্মাধিকারের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। ধর্ম্মাধিকারের সহিত সাক্ষাতের অভিলাষ জানাইলেন। তাঁহার সহিত যবনের সন্ধি নিবন্ধন হইয়াছিল, তাহার ফলোৎপাদনের সময় উপস্থিত!

 পশুপতি ইষ্টদেবীকে প্রণাম করিয়া, কুপিতা মনোরমার নিকট বিদায় লইয়া, কদাচিৎ উল্লাসিত, কদাচিৎ সশঙ্কিত চিত্তে যবন সমীপে উপস্থিত হইলেন। বখ্‌তিয়ার খিলিজি গাত্রোত্থান করিয়া সাদরে তাঁহার অভিবাদন করিলেন এবং কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। পশুপতি রাজভৃত্যবর্গের রক্তনদীতে চরণ প্রক্ষালিত করিয়া আসিয়াছেন, সহর্ষে কোন উত্তর দিতে পারিলেন না। বখ্‌তিয়ার খিলিজি তাঁহার চিত্তের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন,

 “পণ্ডিতবর! রাজসিংহাসনারোহণের পথ কুসুমাবৃত নহে। এ পথে চলিতে গেলে, বন্ধু বর্গের অস্থিমুণ্ড সর্ব্বদা পদে বিদ্ধ হয়।”

 পশুপতি কহিলেন, “সত্য। কিন্তু যাহারা বিরোধী তাহাদিগের বধ আবশ্যক। ইহারা নির্ব্বিরোধী।”

 বখ্‌তিয়ার কহিলেন, “আপনি কি শোণিত প্রবাহ দেখিয়া নিজ অঙ্গীকার স্মরণে অসুখী হইতেছেন।”

 পশুপতি কহিলেন, “যাহা স্বীকার করিয়াছি, তাহা অবশ্য করিব। মহাশয়ও যে তদ্রুপ করিবেন তাহাতে আমার কোন সংশয় নাই।”

 বখ্। “কিছুমাত্র সংশয় নাই। কেবল মাত্র আমাদিগের এক যাজ্ঞা আছে।”

 প। “আজ্ঞা করুন।”

 ব। “কুতবউদ্দীন বঙ্গশাসনভার আপনার প্রতি অর্পিত করিলেন। অদ্য হইতে আপনি বঙ্গে রাজ প্রতিনিধি হইলেন। কিন্তু যবন সম্রাটের সঙ্কল্প এই যে যবন ধর্ম্মাবলম্বী ব্যতীত কেহ তাহার রাজকার্য্যে সংলিপ্ত হইতে পারিবে না। আপনাকে যবনধর্ম্ম অবলম্বন করিতে হইবে?”

 পশুপতির মুখ শুকাইল। তিনি কহিলেন “সন্ধির সময়ে এরূপ কোন কথা হয় নাই।”

 ব। “যদি না হইয়া থাকে, তবে সেটা ভ্রান্তি মাত্র। আর এ কথা উত্থাপিত না হইলেও; আপনার ন্যায় বুদ্ধিমান্ ব্যক্তির দ্বারায় অনায়াসেই অনুমিত হইয়া থাকিবে। কেন না এমন কখন সম্ভবে না যে নবজিত হিন্দুরাজ্য যবন কর্ত্তৃক হিন্দুহস্তে প্রত্যর্পিত হইবে।”

 প। “আমি বুদ্ধিমান্ বলিয়া আপনার নিকট প্রতীয়মান হইতে পারিলাম না। ইহা আমা কর্ত্তৃক অনুমিত হয় নাই।”

 ব। “যদিও পূর্ব্বে না হইয়া থাকে, তবে এক্ষণে হইল। আপনি যবনধর্ম্ম অবলম্বনে স্থিরসঙ্কল্প হউন।”

 প। (সদর্পে) “আমি স্থিরসঙ্কল্প হইয়াছি যে যবন সম্রাটের সাম্রাজ্যের জন্যেও সনাতন ধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া নরকগামী হইব না।”

 ব। “ইহা আপনার ভ্রম। যাহাকে সনাতন ধর্ম্ম বলিতেছেন, সে ভূতের পূজা মাত্র। কোরাণ উক্ত ধর্ম্মই সত্য ধর্ম্ম। তদবলম্বী হইয়া ইহকাল পরকালের মঙ্গল সাধন করুন।”

 পশুপতি যবনের শঠতা বুঝিলেন। বুঝিলেন যে তাহার অভিপ্রায় এই মাত্র, যে কার্য্য সিদ্ধ করিয়া নিবদ্ধ সন্ধি ছলক্রমে ভঙ্গ করিবে। আরও বুঝিলেন, ছলক্রমে না পারিলে বলক্রমে করিবে। অতএব কপটের সহিত কাপট্য অবলম্বন না করিয়া দর্প করিয়া ভাল করেন নাই। তিনি ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “যে আজ্ঞা আমি আজ্ঞানুবর্ত্তী হইব।”

 বখ্‌তিয়ার ও তাঁহার মনের ভাব বুঝিলেন। বখ্‌তিয়ার যদি পশুপতির অপেক্ষা চতুর না হইতেন তবে এত সহজে বঙ্গ জয় করিতে পারিতেন না। বঙ্গভূমির অদৃষ্টলিপি এই যে এ ভূমি যুদ্ধে জিত হইবে না; চাতুর্য্যেই ইহার জয়। চতুর ক্লাইব সাহেব ইহার দ্বিতীয় পরিচয় স্থান।

 বখ্‌তিয়ার কহিলেন, “ভাল, ভাল। অদ্য আমাদিগের শুভ দিন। এরূপ কার্য্যে বিলম্বের প্রয়োজন নাই। আমাদিগের পুরোহিত উপস্থিত; এখনই আপনাকে ইস্‌লামের ধর্ম্মে দীক্ষিত করিবেন।”

 পশুপতি দেখিলেন, সর্ব্বনাশ। বলিলেন, “একবার মাত্র অবকাশ দিউন, পরিবারগণকে লইয়া আসি, সপরিবারে একেবারে দীক্ষিত হইব।”

 বখ্‌তিয়ার কহিলেন, “আমি তাঁহাদিগকে আনিতে লোক পাঠাইতেছি। আপনি এই প্রহরীর সঙ্গে গিয়া বিশ্রাম করুন্।”

 প্রহরী আসিয়া পশুপতিকে ধরিল। পশুপতি ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “সে কি? আমি কি বন্দী হইলাম?”

 বখ্‌তিয়ার কহিলেন, “আপাততঃ তাহাই বটে।”

 পশুপতি রাজপুরী মধ্যে নিরুদ্ধ হইলেন। ঊর্ণনাভে র জাল ছিঁড়িল—সে জালে কেবল সে স্বয়ং জড়িত হইল।  আমরা পাঠক মহাশয়ের নিকট পশুপতিকে বুদ্ধিমান্ বলিয়া পরিচিত করিয়াছি। পাঠক মহাশয় বলিবেন, যে ব্যক্তি শত্রুকে এতদূর বিশ্বাস করিল, সহায়হীন হইয়া তাহাদিগের অধিকৃত পুরীমধ্যে প্রবেশ করিল তাহার চতুরতা কোথায়? কিন্তু বিশ্বাস করিয়া কি করেন। এ বিশ্বাস না করিলে যুদ্ধ করিতে হয়। ঊর্ণনাভ জাল পাতে, যুদ্ধ করে না।

 সেই দিন রাত্রিকালে মহাবন হইতে বিংশতি সহস্র যবন আসিয়া নবদ্বীপ প্লাবিত করিল। বঙ্গজয় সম্পন্ন হইল। যে সূর্য্য সেই দিন অস্তে গিয়াছে, আর তাহার উদয় হইল না। আর কি উদয় হইবে না? উদয় অস্ত উভয়ই ত স্বাভাবিক নিয়ম। আকাশের সামান্য নক্ষত্রটাও অস্ত গেলে পুনরুদিত হয়।