মৃণালিনী/প্রথম খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।


পিঞ্জরের বিহঙ্গিনী।

 বাষ্পীয় রথের গতি অতি বিচিত্র। দিল্লীহইতে কলিকাতা আসিতে দুই দিন লাগে না। কিন্তু ইতিহাসলেখকের লেখনীর গতি আরও বিচিত্র। পাঠক মহাশয় এই মাত্র দিল্লীতে; তৎপরেই প্রয়াগে; এক্ষণে আবার প্রাচীন নগরী লক্ষ্মণাবতীতে আসিয়া তাঁহাকে হৃষীকেশ ব্রাহ্মণের গৃহাভ্যন্তরে নেত্রপাত করিতে হইল।

 হৃষীকেশ সম্পন্ন বা দরিদ্র ব্রাহ্মণ নহেন। তাঁহার বাসগৃহের বিলক্ষণ সৌষ্ঠব ছিল। তদীয় অন্তঃপুর মধ্যে যথায় দুইটী তরুণী কক্ষ প্রাচীরে আলেখ্য লিখিতেছিলেন, তথায় পাঠকমহাশয়কে দাঁড়াইতে হইবে। উভয় রমণী আত্মকর্ম্মে সবিশেষ মনোভিনিবেশ করিয়াছিলেন, কিন্তু তন্নিবন্ধন পরস্পরের সহিত কথোপকথনের কোন বিঘ্ন জন্মিতেছিল না। সেই কথোপকথনের মধ্য ভাগ হইতে পাঠক মহাশয়কে শুনাইতে আরম্ভ করিব।

 এক যুবতী অপরকে কহিলেন, “কেন, মৃণালিনি, কথার উত্তর দিস্ না কেন? আমি সেই রাজ পুত্রটীর কথা শুনিতে ভাল বাসি।”

 “সই মণিমালিনি! তোমার সুখের কথা বল, আমি আনন্দে শুনিব।”

 মণিমালিনী কহিল, “আমার সুখের কথা শুনিতে শুনিতে আমিই জ্বালাতন হইয়াছি, তোমাকে কি শুনাইব?”

 মৃ। “তুমি শোন কার কাছে—তোমার স্বামীর কাছে?”

 মণি। “নহিলে আর কারও কাছে বড় শুনিতে পাই না। এই পদ্মটী কেমন আঁকিলাম দেখ দেখি?”

 মৃ। “ভাল হইয়াও হয় নাই। জল হইতে পদ্ম অনেক উর্দ্ধে আছে, কিন্তু সরোবরে সেরূপ থাকে না; পদ্মের বোঁটা জলে লাগিয়া থাকে, চিত্রেও সেইরূপ হইবে। আর কয়েকটী পদ্মপত্র আঁক; নহিলে পদ্মের শোভা স্পষ্ট হয় না। আরও, পার যদি উহার নিকট একটী হংস আঁকিয়া দাও।”

 মণি। “হংস এখানে কি করিবে?”

 মৃ। “তোমার স্বামীর ন্যায় পদ্মের কাছে সুখের কথা কহিবে।”

 মণি। (হাঁসিয়া) “দুই জনেই সুকণ্ঠ বটে। কিন্তু আমি লিখিব না। আমি সুখের কথা শুনিয়া শুনিয়া জ্বালাতন হইয়াছি।”

 মৃ। “তবে একটী খঞ্জন আঁক।”

 ম। “খঞ্জন আঁকিব না। খঞ্জন পাখা বাহির করিয়া উড়িয়া যাইবে। এত মৃণালিনী নহে, যে স্নেহ-শিকলে বাঁধিয়া রাখিব।”

 মৃ। “খঞ্জন যদি এমনই দুশ্চরিত্র হয়, তবে মৃণালিনীকে যেমন পিঞ্জরে পূরিয়াছ খঞ্জনকেও সেইরূপ করিও।”

 ম। “আমরা মৃণালিনীকে পিঞ্জরে পূরি নাই—সে আপনি আসিয়া পিঞ্জরে প্রবেশ করিয়াছে।”

 মৃ। “সে মাধবাচার্য্যের গুণ।”

 ম। “সখি, তুমি কত বার বলিয়াছ যে মাধবাচার্য্যের সেই নিষ্ঠুর কাজের কথা সবিশেষ বলিবে। কিন্তু কই, আজিও কেন তুমি মাধবাচার্য্যের কথায় পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া আসিলে।”

 মৃ। মাধবাচার্য্যের কথায় আসি নাই। মাধবাচার্য্যকে আমি চিনিতাম না। আমি ইচ্ছা পূর্ব্বকও এখানে আসি নাই। একদিন সন্ধ্যার পর আমার দাসী আমাকে এই অঙ্গুরীয় দিল। এবং বলিল যে যিনি এই অঙ্গুরীয় দিয়াছেন তিনি উদ্যানে অপেক্ষা করিতেছেন। আমি দেখিলাম যে, উহা হেমচন্দ্রের সঙ্কেতাঙ্গুরীয়। তাঁহার সাক্ষাতের অভিলাষ থাকিলে তিনি এই অঙ্গুরীয় দ্বারা সঙ্কেত করিতেন। আমাদিগের বাটীর পশ্চাতেই উপবন ছিল। যমুনা হইতে শীতল বায়ু সেই উদ্যানকে স্নিগ্ধ কুরিত। তথায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইত।”

 মণিমালিনী কহিলেন, “ঐ কথাটী মনে পড়িলেও আমার বড় অসুখ হয়। তুমি কুমারী হইয়া কি প্রকারে পুরুষের সহিত গোপনে প্রণয় করিতে?”

 মৃ। “অসুখ কেন সখি—তিনিই আমার স্বামী। তিনি ভিন্ন অন্য কেহ কখন আমার স্বামী হইবে না।”

 ম। “কিন্তু এ পর্য্যন্ত ত তিনি স্বামী হয়েন নাই। সুতরাং সাধ্বীর তাহা অকর্ত্তব্য। রাগ করিও না সখি! তোমাকে ভগিনীর ন্যায় ভাল বাসি; এই জন্য বলিতেছি। তোমার চরিত্রে এমন কলঙ্ক—ইহা যখনই মনে পড়ে তখনই আমার শরীরে জ্বর আইসে।”

 মৃণালিনী অধোবদনে রহিলেন। ক্ষণেক পরে, চক্ষের জল মুছিলেন। কহিলেন, “মণিমালিনি! এ বিদেশে আমার আত্মীয় কেহ নাই। আমাকে ভালকথা বলে এমত কেহ নাই। যাহারা আমাকে ভালবাসিত তাহাদিগের সহিত যে আর কখন সাক্ষাৎ হইবে সে ভরসাও করি না। কেবলমাত্র তুমি আমার সখী—তুমি আমাকে ভাল না বাসিলে কে আর ভাল বাসিবে?”

 ম। “আমি তোমাকে ভাল বাসিব, ও বাসিয়াও থাকি, কিন্তু যখন ঐ কথাটী মনে পড়ে, তখন মনে করি তোমার সঙ্গে আমার দেখা না হওয়াই ভাল ছিল।”

 মৃণালিনী পুনশ্চ নীরবে রোদন করিলেন। কহিলেন, “সখি, তোমার মুখে এ কথা আমার সহ্য হয় না। যদি তুমি আমার নিকট শপথ কর, যে যাহা বলিব তাহা এ সংসারে কাহারও নিকটে ব্যক্ত করিবে না, তবে তোমার নিকট সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারি। তাহা হইলে তুমি আমাকে ভাল বাসিবে।”

 ম। “আমি শপথ করিতেছি।”

 মৃ। “তোমার চুলে দেবতার প্রসাদিত ফুল আছে। তাই স্পর্শ করিয়া শপথ কর।”  মণিমালিনী তদ্রূপ করিলেন।

 তখন মৃণালিনী মণিমালিনীর কাণে যাহা কহিলেন, তাহার এক্ষণে বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই। শ্রবণে মণিমালিনী পরম প্রীতি প্রকাশ করিলেন। গোপন কথা সমাপ্ত হইল।

 মণিমালিনী কহিলেন, “তাহার পর, মাধবাচার্য্যের সঙ্গে তুমি কি প্রকারে আসিলে? সে বৃত্তান্ত বলিতেছিলে, বল।”

 মৃণালিনী কহিলেন যে “আমি পূর্ব্বরীত্যনুসারে হেমচন্দ্রের অঙ্গুরীয় দেখিয়া সাক্ষাৎ প্রত্যাশায় ঐ উদ্যান মধ্যে প্রবেশ করিলে দূতী কহিল যে রাজপুত্র পুলিনলগ্ন নৌকায় অধিষ্ঠান করিতেছেন। আমি অনেক দিন রাজপুত্রকে দেখি নাই। ব্যগ্রতাবশতঃ বিবেচনাশূন্য হইলাম। পুলিনে আসিয়া দেখিলাম যে যথার্থই একখানি তরণী সৈকতে লগ্ন হইয়া রহিয়াছে। তাহার বহির্ভাগে এক জন পুরুষ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, মনে করিলাম যে রাজপুত্রই দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমি তরণীর নিকট আসিলাম। নৌকার উপর যিনি দাড়াইয়াছিলেন তিনি আমার হস্তে ধরিয়া নৌকায় উঠাইলেন। অমনি নাবিকেরা নৌকা খুলিয়া দিল। কিন্তু আমি করস্পর্শেই বুঝিয়াছিলাম যে এ ব্যক্তি হেমচন্দ্র নহে।”

 মণি। “আর অমনি তুমি চীৎকার করিলে?”

 মৃ। “চীৎকার করি নাই। একবার ইচ্ছা হইয়াছিল বটে কিন্তু চীৎকার আসিল না।”

 মণি। “আমি হইলে জলে ঝাঁপ দিতাম।”

 মৃ। “হেমচন্দ্রকে না দেখিয়া কেন মরিব?”

 মণি। “তার পর কি হইল?”

 মৃ। “প্রথমেই নৌকারোহী আমাকে মাতৃসম্বোধন করিয়া আমার প্রধান ভয় দূর করিলেন; কহিলেন, “মাতঃ আমি আপ নাকে মাতৃসম্বোধন করিতেছি—আমি আপনার পুত্র, কোন আশঙ্কা করিবেন না। আমার নাম মাধবাচার্য্য, আমি হেমচন্দ্রের গুরু। কেবল হেমচন্দ্রের গুরু এমত নহি; ভারতবর্ষের রাজগণের মধ্যে অনেকের সহিত আমার সেই সম্বন্ধ। আমি এক্ষণে কোন দৈবকার্য্যে নিযুক্ত আছি তাহাতে হেমচন্দ্র আমার প্রধান সহায়; তুমি তাহার প্রধান বিঘ্ন।” আমি বলিলাম, ‘আমি বিঘ্ন?’ মাধবাচার্য্য কহিলেন, ‘তুমিই বিঘ্ন। যবনদিগের বিজিত করা, হিন্দু রাজ্যের পুনরুদ্ধার করা, সুসাধ্য কর্ম্ম নহে; হেমচন্দ্র ব্যতীত কাহারও সাধ্য নহে; হেমচন্দ্রও অনন্যমনা। না হইলে তৎকর্ত্তৃকও সিদ্ধ হইবে না। যত দিন আপনার সাক্ষাৎ লাভ সুলভ থাকিবে, তত দিন হেমচন্দ্রের আপনি ভিন্ন অন্য ব্রত নাই—সুতরাং যবনধ্বংস কে করে?’ আমি কহিলাম, “বুঝিলাম প্রথমে আমার ধ্বংস ব্যতীত যবনধ্বংস নাই। আপনার শিষ্য কি আপনার দ্বারা অঙ্গুরীয় প্রেরণ করিয়া আমাকে প্রাণত্যাগে অনুরোধ করিয়াছেন?”

 মণি। “এত কথা বৃদ্ধকে বলিলে কি প্রকারে?”

 মৃ। “বিপদ কালে লজ্জা কি? মাধবাচার্য্য আমাকে মুখরা মনে করিলেন, মৃদু হাসিলেন, কহিলেন ‘আমি যে তোমাকে এইরূপ হস্তগত করিব তাহা হেমচন্দ্র জানেন না।”

 “আমি মনে মনে কহিলাম তবে, যাঁহার জন্য এ জীবন রাখিয়াছি, তাঁহার অনুমতি ব্যতীত সে জীবন ত্যাগ করিব না।” মাধবাচার্য্য বলিতে লাগিলেন, “তোমাকে প্রাণত্যাগ করিতে হইবে না—কেবল আপাততঃ হেমচন্দ্রকে ত্যাগ করিতে হইবে। ইহাতে তাঁহার পরম মঙ্গল। যাহাতে তিনি রাজ্যেশ্বর হইয়া তোমাকে রাজমহিষী করিতে পারেন, তাহা কি তোমার কর্ত্তব্য নহে, তোমার প্রণয়মন্ত্রে তিনি কাপুরুষ হইয়া রহিয়াছেন, তাঁহার সে ভাব দূর করা কি উচিত নহে?’ আমি কহিলাম? ‘যাহা উচিত তাহা তাঁহার নিজমুখে আমি শুনিতে পাইয়া থাকি। আমার সহিত সাক্ষাৎ যদি তাঁহার সঙ্গে অনুচিত হয়, তবে তিনি কদাচ আমার সহিত আর সাক্ষাৎ করিবেন না। তজ্জন্য আমার প্রতি মহাশয়ের পীড়ন অনাবশ্যক।’ মাধবাচার্য্য বলিলেন, ‘বালকে ভাবিয়া থাকে, বালক ও বৃদ্ধ উভয়ের বিবেচনাশক্তি তুল্য; কিন্তু তাহা নহে। এ বয়সে বঞ্চবিংশতিবর্ষীয় বালকের অপেক্ষা আমাদিগের পরিণামদর্শিতা যে অধিক তাহাতে সন্দেহ করিও না। আর তুমি সম্মতা হও বা না হও, যাহা সঙ্কল্প করিয়াছি তাহা সিদ্ধ করিব। আমি তোমাকে দেশাস্তরে লইয়া যাইব। গৌড় দেশে অতি শান্তস্বভাব এক ব্রাহ্মণের বাটীতে তোমাকে রাখিয়া আসিব। তিনি তোমাকে আপন কন্যার ন্যায় যত্ন করিবেন। এক বৎসর পরে আমি তোমার পিতার নিকট তোমাকে আনিয়া দিব। আর সে সময়ে হেমচন্দ্রে যে অবস্থায় থাকুন, তোমার সহিত তাঁহার বিবাহ দেওয়াইব, ইহা সত্য করিলাম। এই প্রলোভন-বাক্যেই হউক, আর অগত্যাই হউক, আমি নিস্তব্ধ হইলাম। তাহার পর এই খানে আসিয়াছি।”