মেজদিদি/আঁধারে আলো/পাঁচ
॥পাঁচ॥
সকালবেলা স্নান করিয়া সত্য ধীরে ধীরে বাসায় ফিরিয়াছিল। তাহার দৃষ্টি ক্লান্ত, সজল। চোখের পাতা তখনও আর্দ্র। আজ চারদিন গত হইয়াছে সেই অপরিচিতা প্রিয়তমাকে সে দেখিতে পায় নাই-আর তিনি গঙ্গাস্নানে আসেন না।
আকাশ-পাতাল কত কি যে এই কয়দিন সে ভাবিয়াছে, তাহার সীমা নাই। মাঝে মাঝে এ দুশ্চিন্তাও মনে উঠিয়াছে, হয়ত তিনি বঁচিয়াই নাই, হয়ত বা মৃত্যুশয্যায়! কে জানে!
সে গলিটা জানে বটে, কিন্তু আর কিছু চেনে না। কাহার বাড়ি কোথায় বাড়ি, কিছুই জানে না। মনে করিলে অনুশোচনায় আত্মাগ্নানিতে হৃদয় দগ্ধ হইয়া যায়। কেন সে সেদিন যায় নাই, কেন সেই সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করিয়াছিল?
সে যথার্থই ভালবাসিয়াছিল। চোখের নেশা নহে, হৃদয়ের গভীর তৃষ্ণা। ইহাতে ছলনা কাপট্যের ছায়ামাত্র ছিল না, যাহা ছিল তাহা সত্যই নিঃস্বার্থ, পবিত্র, বুকজোড়া স্নেহ।
বাবু।
সত্য চমকিয়া চাহিয়া দেখিল, তাহার সেই দাসী যে সঙ্গে আসিত, পথের ধারে দাঁড়াইয়া আছে।
সত্য ব্যস্ত হইয়া কাছে আসিয়া ভারী গলায় কহিল, কি হয়েচে তাঁর? বলিয়াই তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িল-সামলাইতে পারিল না।
দাসী মুখ নীচু করিয়া হাসি গোপন করিল, বোধ হয় হাসিয়া ফেলিবার ভয়েই মুখ নীচু করিয়া বলিল, দিদিমণির বড় অসুখ, আপনাকে দেখতে চাইচেন।
চল, বলিয়া সত্য তৎক্ষণাৎ সন্মতি দিয়া চোখ মুছিয়া সঙ্গে চলিল। চলিতে চলিতে প্রশ্ন করিল, কি অসুখ? খুব শক্ত দাঁড়িয়েচে কি?
দাসী কহিল, না, তা, হয়নি, কিন্তু খুব জ্বর।
সত্য মনে মনে হাতজোড় করিয়া কপালে ঠেকাইল, আর প্রশ্ন করিল না। বাড়ির সুমুখে আসিয়া দেখিল খুব বড় বাড়ি, দ্বারের কাছে বসিয়া একজন হিন্দুস্থানী দরোয়ান ঝিমাইতেছে। দাসীকে জিজ্ঞাসা করিল, আমি গেলে তোমার দিদিমণির বাবা রাগ করবেন না ত? তিনি ত আমাকে চেনেন না।
দাসী কহিল, দিদিমণির বাপ নেই, শুধু মা আছেন। দিদিমণির মত তিনিও আপনাকে খুব ভালবাসেন।
সত্য আর কিছু না বলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।
সিঁড়ি বাহিয়া তেতলার বারান্দায় আসিয়া দেখিল, পাশাপাশি তিনটি ঘর, বাহির হইতে যতটুকু দেখা যায়, মনে হইল সেগুলি চমৎকার সাজান। কোণের ঘর হইতে উচ্চহাসির সঙ্গে তবলা ও ঘুঙুরের শব্দ আসিতেছিল। দাসী হাত দিয়া দেখাইয়া বলিল, ঐ ঘর-চলুন। দ্বারের সুমুখে আসিয়া সে হাত দিয়া পর্দ। সরাইয়া দিয়া সু-উচ্চকণ্ঠে বলিল, দিদিমণি, এই নাও তোমার নাগর।
তীব্র হাসি ও কোলাহল উঠিল। ভিতরে যাহা দেখিল, তাহাতে সত্যের সমস্ত মস্তিষ্ক ওলট-পালট হইয়া গেল; তাহার মনে হইল, হঠাৎ সে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িতেছে, কোনমতে দোর ধরিয়া সে সেইখানেই চোখ বুজিয়া চৌকাঠের উপর বসিয়া পড়িল।
ঘরের ভিতরে মোঝেয় মোটা গদি-পাতা বিছানার উপর দু-তিনজন ভদ্রবেশী পুরুষ। একজন হরমোনিয়াম, একজন বাঁয়া-তবলা লইয়া বসিয়া আছে,—আর একজন একমনে মদ খাইতেছে। আর তিনি? তিনি বোধ করি, এই মাত্র নৃত্য করিতেছিলেন, দুই পায়ে একরাশ ঘুঙুর বাঁধা, নানা অলঙ্কারে সর্বাঙ্গ ভূষিত—সুরারঞ্জিত চোখ-দুটি ঢুল-ঢুল করিতেছে; ত্বরিতপদে কাছে সরিয়া আসিয়া, সত্যর একটা হাত ধরিয়া খিল্খিল্ কবি যা হাসিয়া বলিল, বঁধুর মিরগি, ব্যামো আছে নাকি? নে ভাই, ইয়ারকি করিস নে, ওঠ্-ও সবে আমার ভারী ভর করে।
প্রবল তড়িৎ-স্পর্শে হতচেতন মানুষ যেমন করিয়া কাঁপিয়া নড়িয়া উঠে, উহার করস্পর্শে সত্যর আপাদমস্তক তেমনি করিয়া কাঁপিয়া নড়িয়া উঠিল।
রমণী কহিল, আমার নাম শ্রীমতি বিজ্লী-তোমার নামটা কি ভাই? হাবু? গাবু
সমস্ত লোকগুলি হো হো শব্দে অট্টহাসি জুড়িয়া দিল, দিদিমণির দাসীটি হাসির চোটে একেবারে মেঝের উপর গড়াইয়া শুইয়া পড়িল, —কি রঙ্গই জান দিদিমণি!
বিজ্লী কৃত্রিম বোষের স্বরে তাহাকে একটা ধমক দিয়া বলিল, থাম, বাড়াবাড়ি করিস্ নে-আসুন, উঠে আসুন, বলিয়া জোর করিয়া সত্যকে টানিয়া আনিয়া একটা চৌকির উপর বসাইয়া দিয়া পায়ের কাছে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া হাত জোর করিয়া শুরু করিয়া দিল—
আজু রজনী হাম, ভাগে পোহায়নু
পেখনু পিয়া মুখ-চন্দা
জীবন যৌবন হাম, সফল করি মাননু
দশ-দিশ ভেল নিরদন্দা।
আজু মণ্টু গেহ, গেহ করি মাননু
আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।
আজু বিহি মোহে, অনুকূল হোয়ল
টুটল সবহু সন্দেহা।
পাঁচবাণ অব লাখবাণ হউ
মলয় পবন বহু মন্দা।
অব সো ন যুবহু মরি পরিহোয়ত—
তব মানব নিজ দেহা—
যে লোকটা মদ খাইতেছিল, উঠিয়া আসিয়া পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল। তাহার নেশা হইয়াছিল, কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, ঠাকুরমশাই, বড় পাতকী আমি—একটু পদরেণু—
অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় আজ সত্য স্নান করিয়া একখানা গরদের কাপড় পরিয়াছিল।
যে লোকটা হারমোনিয়াম বাজাইতেছিল, তাহার কতকটা কাণ্ডজ্ঞান ছিল, সে সহানুভূতির স্বরে কহিল, কেন বেচারাকে মিছামিছি সঙ্ সাজাচ্চ?
বিজ্লী হাসিতে হাসিতে বলিল, বাঃ, মিছামিছি কিসে? ও সত্যকারের সঙ বলেই ত এমন আমোদর দিনে ঘরে এনে তোমাদের তামাসা দেখাচ্চি। আচ্ছা, মাথা খাস গাবু, সত্য বল্ ত ভাই, কি আমাকে তুই ভেবেছিলি? নিত্য গঙ্গাস্নানে যাই, কাজেই ব্রাহ্মও নই, মোচলমান খ্রীষ্টানও নই। হিঁদুর ঘরের এতবড় ধাড়ী মেয়ে, হয় সধবা, নয় বিধবা-কি মতলবে চুটিয়ে পীরিত কর্ছিলি বল্ ত? বিয়ে করবি বলে, না ভুলিয়ে নিয়ে লম্বা দিবি বলে?
ভারি একটা হাসি উঠিল। তার পর সকলে মিলিয়া কত কথাই বলিতে লাগিল।
সত্য একটিবার মুখও তুলিল না, একটা কথার জবাব দিল না। সে মনে কি ভাবিতেছিল, তাহা বলিবই বা কি করিয়া, আর বলিলে বুঝিবেই বা কে? থাক্ সে।
বিজ্লী সহসা চকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বাঃ, বেশ ত আমি! যা ক্ষ্যামা, শিগ্গির যা-বাবুর খাবার নিয়ে আয়, স্নান করে এসেচেন-বাঃ, আমি কেবল তামাসাই কচ্চি যে! বলিতে বলিতেই তাহার অনতিকাল পূর্বের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-বহৃতপ্ত কণ্ঠস্বর অকৃত্রিম সস্নেহ অনুতাপে যথার্থ-ই জুড়াইয়া গেল।
খানিক পরে দাসী একথালা খাবার আনিয়া হাজির করিল। বিজ্লী নিজের হাতে লইয়া আবার হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বলিল, মুখ তোল, খাও।
এতক্ষণ সত্য তাহার সমস্ত শক্তি এক করিয়া নিজেকে সামলাইতে - ছিল, এইবার মুখ তুলিয়া শান্তভাবে বলিল, আমি খাব না।
কেন? জাত যাবে? আমি হাড়ি না মুচি?
সত্য তেমনি শান্তকণ্ঠে বলিল, তা হলে খেতুম। আপনি যা তাই।
বিজ্লী খিল্খিল্ করিয়া হাসিয়া বলিল, হাবুবাবুও ছুরি-ছোরা চালাতে জানেন দেখচি! বলিয়া আবার হাসিল, কিন্তু তাহা শব্দমাত্র, হাসি নয়, তাই আর কেহ সে হাসিতে যোগ দিতে পারিল না।
সত্য কহিল, আমার নাম সত্য, হাবু নয়। আমি ছুরি-ছোরা চালাতে কখন শিখিনি, কিন্তু নিজের ভুল টের পেলে শোধরাতে শিখেচি।
বিজ্লী হঠাৎ কি কথা বলিতে গেল, কিন্তু চাপিয়া লইয়া শেষে কহিল, আমার ছোঁয়া খাবে না? না।
বিজ্লী উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার পরিহাসের স্বরে এবার তীব্রত মিশিল; জোর দিয়া কহিল, খাবেই। এই বলছি তোমাকে, আজি না হয় কাল, না হয় দু’দিন পরে খাবেই তুমি।
সত্য ঘাড় নাড়িয়া বলিল, দেখুন, ভুল সকলেরই হয়। আমার ভুল যে কত বড়, তা সবাই টের পেয়েচে, কিন্তু আপনারও ভুল হচ্চে আজ নয়, দুদিন পরে নয়, এ-জন্মে নয়, আগামী জন্মে নয়- কোন কালে আপনার ছোয়া খাব না। অনুমতি করুন, আমি যাই-আপনার নিশ্বাসে আমার রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে।
তাহার মুখের উপর গভীর ঘূণার এমনি সুস্পষ্ট ছায়া পড়িল যে তাহা ঐ মাতালটার চক্ষুও এড়াইল না। সে মাথা নাড়িয়া কহিল বিজ্লীবিবি, অরসিকেষু রহস্য নিবেদনম্। যেতে দাও - যেতে দাও —সকালবেলার আমোদটাই ও মাটি করে দিলে।
বিজ্লী জবাব দিল না, স্তম্ভিত হইয়া সত্যর মুখপানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। যথার্থই তাহার ভয়ানক ভুল হইয়াছিল। সে ত কল্পনাও করে নাই, এমনি মুখচোরা শান্ত লোক এমন করিয়া বলিতে পারে।
সত্য আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বিজ্লী মৃদুস্বরে কহিল আর একটু বসো।
মাতাল শুনিতে পাইয়া চেঁচাইয়া উঠিল, উঁ হুঁ হুঁ, প্রথম চোরে একটু জোর খেলবে-যেতে দাও-যেতে দাও-সুতো ছাড়ো-সুতে ছাড়ো-
সত্য ঘরের বাহিরে আসিয়া পড়িল; বিজ্লী পিছনে আসিয় পথরোধ করিয়া চুপি চুপি বলিল, ওরা দেখতে পাবে, তাই-নইলে হাতজোড় করে বলতুম, আমার বড় অপবাধ হয়েচে-
সত্য অন্যদিকে মুখ করিয়া রহিল।
সে পুর্নবার কহিল, এই পাশের ঘরটা আমার পড়ার ঘর একবার দেখবে না? একটিবার এসো, মাপ চাচ্ছি। না, বলিয়া সত্য সিঁড়ির অভিমুখে অগ্রসর হইল। বিজ্লী পিছনে পিছনে চলিতে চলিতে কহিল, কাল দেখা হবে?
না।
আর কি কখনো দেখা হবে না?
না!
কান্নায় বিজ্লীর কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল, ঢোঁক গিলিয়া জোর করিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া বলিল, আমার বিশ্বাস হয় না, আর দেখা হবে না। কি তাও যদি না হয়, বল, এই কথাটা আমার বিশ্বাস করবে।
ভগ্নাম্বর শুনিয়া সত্য বিস্মিত হইল, কিন্তু এই পনের-ষোল দিন ধরিয়া যে অভিনয় সে দেখিয়াছে, তাহার কাছে ত ইহা কিছুই নয়। তথাপি সে মুখ ফিরাইয়া দাঁডাইল। সে মুখেব বেখায় বেখায় সুদৃঢ় অপ্রত্যয় পাঠ করিয়া বিজ্লীর বুক ভাঙ্গিয়া গেল। কিন্তু সে কি করিবে? হায় হায়! প্রত্যয় করাইবার সমস্ত উপায়ই যে সে আবর্জনার মত স্বহস্তে ঝাট দিয়া ফেলিয়া দিয়াছে!
সত্য প্রশ্ন কবিল, কি বিশ্বাস করব?
বিজ্লীর ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু স্বর ফুটিল না। অশ্রু ভারাক্রান্ত দুই চোখ মুহুর্তেব জন্য তুলিয়াই অবনত করিল। সত্য তাহাও দেখিল, কিন্তু অশ্রুব কি নকল নাই। বিজলী মুখ না তুলিয়াও বুঝিল সত্য অপেক্ষা করিয়া আছে; কিন্তু সেই কথাটা যে মুখ দিয়া সে কিছুতেই বাহির কারতেই পারিতেছে না, যাহা বাহিরে আসিবার জন্য তাহার বুকের পাজরাগুলো ভাঙ্গিয়া গুঁডইয়া দিতেছে।
সে ভালবাসিয়াছে। সে ভালবাসার একটা কথা সার্থক করিবার লোভে সে এই রূপের ভাণ্ডার দেহটাও হয়ত একখণ্ড গলিত বস্ত্রের মতই ত্যাগ করিতে পারে—কিন্তু কে তাহা বিশ্বাস করিলে! সে যে দাগী আসামী! অপরাধের শতকোটি চিহ্ন সর্বাঙ্গে মাখিয়া বিচাবের সুমুখে দাঁড়াইয়া, আজ কি করিয়া সে মুখে আনিবে, অপরাধ করাই তাহার পেশা বটে, কিন্তু এবার সে নির্দোষ! যতই বিলম্ব হইতে লাগিল, ততই সে বুঝিতে লাগিল, বিচারক তাহার ফাঁসির হুকুম দিতে বসিয়াছে; কিন্তু কি করিয়া সে রোধ করিবে?
সত্য অধির হইয়া উঠিয়াছে; সে বলিল, চললুম।
বিজ্লী, তবুও মুখ তুলিতে পারিল না; কিন্তু এবার কথা কহিল। বলিল, যাও, কিন্তু যে-কথা অপরাধে মগ্ন থেকেও আমি বিশ্বাস করি, সে-কথা আবিশ্বাস করে যেন তুমি অপরাধী হয়ে না। বিশ্বাস করে, সকলের দেহতেই ভগবান বাস করেন এবং আমরণ দেহটাকে তিনি ছেড়ে চলে যান না। একটু থামিয়া কহিল, সব মন্দিরে দেবতার পূজা হয় না বটে, তবুও তিনি দেবতা। তাঁকে দেখে মাথা নোয়াতে পার, কিন্তু তাঁকে মাড়িয়ে যেতেও পার না। বলিয়াই পদশব্দে মুখ তুলিয়া দেখিল, সত্য ধীরে ধীবে নিঃশব্দে চলিয়া যাইতেছে।
স্বভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাইতে পারে, কিন্তু তাহাকে ত উড়াইয়া দেওয়া যায় না। নারীদেহের উপর শত অত্যাচার চলিতে পারে, কিন্তু নারীত্বকে ত অস্বীকার করা চলে না। বিজ্লী নর্ত্তকী, তথাপি সে যে নারী! আজীবন সহস্র অপরাধে অপরাধী, তবুও যে এটা নারীদেহ! ঘণ্টা-খানেক পরে সে যখন এ-ঘরে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার লাঞ্ছিত অর্দ্ধমৃত নারীপ্রকৃতি অমৃতস্পর্শে জাগিয়া বসিয়াছে। এই অত্যল্প সময়টুকুর মধ্যে তাহার সমস্ত দেহে যে কি অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাহা ঐ মাতালটা পর্যন্ত টের পাইল। সে-ই মুখ ফুটিয়া বলিয়া ফেলিল-কি বাইজী, চোখের পাতা ভিজে যো। মাইরি, ছোঁড়াটা কি একগুঁয়ে, অমন জিনিসগুলো মুখ দিলে না। দাও দাও, থালাটা এগিয়ে দাও ত, হ্যাঁ বলিয়া নিজেই টানিয়া লইয়া গিলিতে লাগিল।
তাহার একটি কথাও বিজ্লীর কানে গেল না। হঠাৎ তাহার নিজের পায়ে নজর পড়ায় পায়ে বাঁধা ঘুঙুরের তোড়া যেন বিছার মত তাহার দু’পা বেড়িয়া দাঁত ফুটাইয়া দিল, সে তাড়াতাড়ি সেগুলো খুলিয়া ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল।
একজন জিজ্ঞাসা করিল, খুললে যে? বিজ্লী মুখ তুলিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, আর পারব না, বলে।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ আর না। বাইজী মরেছে—
মাতাল সন্দেশ চিবাইতেছিল। কহিল, কি রোগে বাইজী?
বাইজী আবার হাসিল। এ সেই হাসি। হাসিমুখে কহিল, যে রোগে আলো জ্বালালে আঁধার মরে, সূর্য্যি উঠলে রাত্রি মরে-আজ, সেই রোগেই তোমাদের বাইজী চিরদিনের জন্যে মরে গেল বন্ধু।