মোগল-বিদুষী/গুল্‌বদন্

উইকিসংকলন থেকে

মোগল-বিদুষী

গুল্‌বদন্‌

 যে-সকল পুণ্যশীলা, জ্ঞানগরিমাশালিনী মহিয়সী মহিলার নাম মোগল-ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত থাকিবার যোগ্য, বেগম গুল্‌বদন্ তাঁহাদের অন্যতম!। তিনি ভারতে মোগলসাম্রাজ্যের স্থাপয়িতা অক্লান্তকর্মী, অধ্যবসায়শীল সম্রাট্ বাবরের কন্যা, উত্থান-পতনের বিচিত্র লীলাস্থলী হুমায়ূনের বৈমাত্রেয় ভগিনী, এবং মোগল-কুলচন্দ্র ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’ আখ্যার যোগ্যতম অধিকারী বাদশাহ্ আক্‌বরের পিতৃষ্বসা। গুল্‌বদনের সুদীর্ঘ জীবন ভূয়োদর্শনের আদর্শ; তিনি যথাক্রমে বাবর, হুমায়ূন্ ও আক্‌বর—মোগলের এই তিন পুরুষের অভ্যুদয়, ভাগ্যবিপর্য্যয় এবং প্রতিষ্ঠা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া মানব-জীবনের অপরিসীম অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ পাইয়াছিলেন। এই অনন্যসুলভ অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁহার স্বাভাবিক ধর্ম্মানুরাগ, কর্ত্তব্যনিষ্ঠা ও স্নেহমমতার অপূর্ব্ব মিশ্রণ তাঁহার জীবনকে এক অভাবনীয় বৈশিষ্ট্য দান করিয়াছে। তিনি যে ‘হুমায়ূন্-নামা’ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ বহু বিষয় স্থান পাইয়াছে। সুতরাং গুল্‌বদনের জীবনী, শুধু ব্যক্তিগত জীবন-কথা নহে—ইতিহাস—মোগল-সাম্রাজ্যের প্রথম ও প্রধান কাহিনী।

 আনুমানিক ১৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে কাবুলে গুল্‌বদনের জন্ম হয়। তাঁহার পিতা বাবর তখন কাবুলের একজন ক্ষুদ্র অধিপতি। কিন্তু মহামনা বাবর ঐ ক্ষুদ্ররাজ্যের ক্ষুদ্র বাদশাহীতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। যে দিগ্‌দিগন্তবিস্তৃত রাজ্য, অতুল ঐশ্বর্য্যের অক্ষয় ভাণ্ডার, স্বর্ণভূমি হিন্দুস্থান একদিন তাঁহারই ষষ্ঠতম পূর্ব্বপুরুষ তৈমুরের দুর্দ্দান্ত প্রতাপের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছিল, বীর্য্যবান্ বাবর সেই অপূর্ব্ব বিশাল রাজ্যটি করতলগত করিবার কল্পনায় বিভোর ছিলেন। শুধু কল্পনার বিভোর ছিলেন বলিলে ভুল হইবে, কেন না কন্যার জন্মকালে তিনি কার্য্যক্ষেত্রে বহুদূর অগ্রসর—বারবার বিফলপ্রযত্ন বাবর হিন্দুস্থান-বিজয়ের চেষ্টায় ব্যাপৃত। তারপর গুলের বয়ঃক্রম যখন দুই বৎসর, তখন তিনি পরিবারবর্গকে কাবুলে রাখিয়া হিন্দুস্থানে অভিযান করিয়াছেন। এই অভিযানই অবশেষে তাঁহাকে বিজয়-মাল্যে বিভূষিত করিয়া হিন্দুস্থানের অভিলষিত অধিপতি-পদে বরণ এবং কাবুলের চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত পরিজনগণকে অভূতপূর্ব্ব আনন্দে নিমগ্ন করিয়াছিল।

 এইস্থানে বাবরের মহিষীবৃন্দের একটু সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের অবতারণা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। তখন বেগমগণের মধ্যে দিল্‌দার, মাহম্, গুল্‌রুখ, এবং মুবারিকা, এই চারিটি বর্ত্তমান। দিল্‌দার বেগমের পাঁচ সন্তান;—গুল্‌রং নামে কন্যা সর্ব্বজ্যেষ্ঠা, তারপর গুল্‌চিহ্‌রা, তৎপরে পুত্র আবূ-নাসির—ইতিহাসে যিনি হিন্দাল্ নামে প্রসিদ্ধ, আবু-নাসিরের পরেই গুল্‌বদন্, গুলের পরে আল্‌ওয়ার নামে এক পুত্র।

 মাহম্‌কে বাবরের পাটরাণী বলা যাইতে পারে। তাঁহার গর্ভেই বাদশাহের জ্যেষ্ঠপুত্র— সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হুমায়ূনের জন্ম। সম্রাটের হৃদয়-রাজ্যে এবং পৌরজনমধ্যে মাহমের অসীম প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এই পতিসোহাগিনীর জীবনে একটি বড় ক্ষোভের কারণ ঘটিয়াছিল। তাঁহার যতগুলি সন্তান জন্মে, একমাত্র হুমায়ূন ব্যতীত একটিও জীবিত ছিল না—একে একে সবগুলিই শৈশবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। গুল্‌বদন্ যখন সবে দুই বৎসরের বালিকা, তখন মাহম্ তাহাকে কন্যারূপে গ্রহণ করেন। ইতিপূর্ব্বেই মাহম্‌কে চারিটি সন্তানের বিরোগ-বেদনা সহ্য করিতে হইয়াছিল। সন্তান-বিয়োগ-বিধুরা জননী স্নেহের ক্ষুধা মিটাইবার জন্যই হউক, অথবা নিজ শিশু-সন্তানের অভাবে দিল্‌দারের গর্ভজাত কন্যাকে পরমস্নেহে প্রতিপালন করিয়া স্বামীর তৃপ্তিসাধনের জন্যই হউক, গুল্‌কে আপনার অঙ্কে তুলিয়া লইয়া থাকিবেন। কিন্তু ইহাই শেষ নহে, দিলের অন্যতম পুত্র হিন্দাল্ যখন চারিদিনের শিশু, তখন তাহাকেও তিনি দত্তকরূপে গ্রহণ করেন। মহিষী দিল্‌দারের যে ইহাতে আপত্তি ছিল না, এমন নহে—আপত্তি যথেষ্টই ছিল। কিন্তু তিনি নিরুপায়;—মাহমের হস্তে গৃহের সর্ব্বময় প্রভুত্ব, তাহার উপর স্বামীর অভিপ্রায়; সকল দিক্ বিবেচনা করিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও সন্তানদ্বয়কে তাঁহার অঙ্কচ্যুত করিতে হইয়াছিল।

 মহিযী গুল্‌রুখের গর্ভে কামরান্, অস্করী, শাহ্‌রুখ্, সুল্‌তান্ আহ্‌মদ্ ও গুল্-ইজার বেগম, এই পাঁচটি সন্তান।

 বিবি মুবারিকা, ইউসুফ্‌জাই-প্রধানের কন্যা। এই পার্ব্বত্য প্রধান বাবরের আনুগত্য স্বীকার করিয়া তাহারই নিদর্শনস্বরূপ বাবরকে তাঁহার এই রূপলাবণ্যময়ী কন্যারত্ন দান করেন। ইঁহার কোনও সন্তানসন্ততি জন্মে নাই।

 বাবরের স্বজনগণ যখন অত্যন্ত চিন্তাকুলচিত্তে কাবুলে অবস্থান করিতেছিলেন, অমিততেজা, নির্ভীক, স্থিরধী বাবর তখন হিন্দুস্থানে ঘোর সমরে নিযুক্ত। কিন্তু এই পুরুষসিংহের প্রতি ভাগ্যলক্ষ্মী অসম্ভব প্রসন্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন। জয়, জয়, জয়— জয়ের পর জয়! পানিপথ, খানুয়া, ঘাগ্‌রা—একে একে এই তিন মহাসমরে বিজয়ী হইয়া তিনি হিন্দুস্থানের ভাগ্যবিধাতৃপদে অধিষ্ঠিত হইলেন। এতদিনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হইবার পর প্রিয়পরিজনের কথা বিশেষ করিয়া তাঁহার মনে উদিত হইল তিনি তাঁহাদিগকে হিন্দুস্থানে আসিতে লিখিলেন। কিন্তু তখন কাবুল হইতে হিন্দুস্থানে আসিবার পথ এখনকার ন্যায় সুগম ছিল না;—পথ সুদীর্ঘ, পাহাড়-পর্ব্বত এবং মরুকণ্টকিত। তাহার উপর নানা কারণে বাবরের আত্মীয়স্বজনগণের কাবুল পরিত্যাগ করিতে একটু বিলম্ব হইল। সুতরাং শুভসন্মিলন আর কোনক্রমেই যথাসময়ে ঘটিয়া উঠিল না। পরিজনগণের মধ্যে বাবরের প্রিয়তমা মহিষী মাহম্‌ই সকলের অগ্রবর্ত্তিনী হইয়াছিলেন; তিনি আর-সকলকে পশ্চাতে রাখিয়া যথাসম্ভব দ্রুতগতি স্বামিসন্দর্শনে আগমন করেন। বলা বাহুল্য মাহম্, গুল্‌বদন্‌কে সঙ্গে আনিতে ভুলেন নাই। বাবর ইঁহাদের যথারীতি সম্বর্দ্ধনা করিয়া আনিবার জন্য পূর্ব্বেই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। আলিগড়ের নিকট বাদশাহের লোকজনের সহিত মাহমের সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর তিনি যখন আগ্রায় পৌঁছেন (২৭শে জুন, ১৫২৯), তখন রাত্রি হইয়া গিয়াছে। গভীর রাত্রেই প্রাণাধিকা পত্নীর সহিত বাবরের শুভসম্মিলন ঘটিল। কিন্তু চারি বৎসর পূর্ব্বে যে নয়নানন্দ স্নেহের পুত্তলীকে সুদূর কাবুলে দেখিয়া আসেন, তাহার অদর্শনে বাদশাহ্ অধীর হইয়া উঠিলেন। মাহম্ রাত্রি হইবে বলিয়া আগ্রা আসিবার পথে গুল্‌কে আলিগড়েই রাখিয়া আসিয়াছিলেন। যাহা হউক, পরদিন প্রভাতে পিতা ও পুত্রীর সাক্ষাৎ হইল। পূর্ব্বে যখন গুল্ পিতাকে দেখিয়াছিল, তখন তাহার বয়স সবে দুই—সে জ্ঞানহীনা বালিকা মাত্র। পিতার সম্বন্ধে তাহার কোন ধারণা থাকিলে তাহা অতীব ক্ষীণ, অস্পষ্ট হইবারই কথা। এরূপ অপরিচিত-তুল্য পিতার কাছে শিশু-কন্যার পদে পদে একটা সসঙ্কোচ ভয়ের বাধা স্বভাবতঃই উপস্থিত হইয়া থাকে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, গুলের সেরূপ কিছুই হয় নাই। দর্শনমাত্র কন্যা পিতৃচরণে লুটাইয়া পড়িল। সন্তানবৎসল পিতা, পরমস্নেহে তাহাকে বক্ষে ধারণ করিয়া প্রশ্নের পর প্রশ্নে অস্থির করিয়া তুলিলেন। গুল্‌বদন্ স্বরচিত ‘হুমায়ূন্-নামায়’ লিখিয়াছেন,— ‘পিতার স্নেহপাশে আবদ্ধ হইয়া আমি তখন যে বিমল আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছিলাম, জীবনে তদপেক্ষা অধিক আনন্দের কল্পনা করা অসম্ভব।’

 সম্রাট্ তাহার পর কিছুদিন মাহম্ ও গুল্‌কে লইয়া আগ্রায় কাটাইলেন। দিনগুলি যে অতীব শান্তি-সুখে অতিবাহিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু অধিক দিন একস্থানে বাস করা, চিরসঞ্চরণশীল, চঞ্চলপ্রকৃতি সম্রাটের স্বভাববিরুদ্ধ; বিশেষ সেকালের আগ্রার আশপাশের দৃশ্য তাঁহার নিকট নিরতিশয় অপ্রীতিকর বোধ হইত। সৌন্দর্য্য ও মাধুর্য্যের উপাসক সম্রাট্ ঢোলপুর ও সীক্‌রীকে মনের মত করিয়া সাজাইয়া তুলিতেছিলেন। তিনি মাহম্ ও গুল্‌কে লইয়া ঐ দুইস্থান দেখিতে গেলেন।

 সীক্‌রীর উদ্যান-বাটিকার একাংশে বসিয়া বাবর আত্মকাহিনী ‘তুজুক্’ রচনা করিতেন। এইস্থানে একদিন একটি দুর্ঘটনা ঘটিল। মাহম্ ভগবদুপাসনায় রত; ভবনের সম্মুখে গুল্ বিমাতা মুবারিকার নিকট অবস্থিত। হঠাৎ শিশুসুলভ, ক্রীড়াচঞ্চল গুল্ বিমাতাকে করাকর্ষণ করিবার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিতে লাগিল। কিছুতেই প্রতিনিবৃত্ত না হওয়ায় মুবারিকাকে কন্যার আবদার রক্ষা করিতে হইল। কিন্তু পার্ব্বত্যনন্দিনী মুবারিকার আকর্ষণ যতই মৃদু, যতই কোমল হউক না কেন, তাহা গুলের কোমল বাহুলতার পক্ষে বিষম হইয়াছিল। একখানি অস্থি স্থানচ্যুত হওয়ায় বালিকা চীৎকার করিয়া উঠিল। সুখের বিষয়, অবিলম্বে চিকিৎসার ব্যবস্থা হওয়ায় ব্যাপার গুরুতর হইতে পারে নাই;—গুল্ ধীরে ধীরে সুস্থ হইয়া উঠে। এই ঘটনার পর বাবর আর তিলার্দ্ধও সীক্‌রীতে অবস্থান করেন নাই।

 আগ্রায় পৌঁছিয়াই সম্রাট্ শুনিলেন, অবশিষ্ট পরিজনগণ এতদিনে কাবুল হইতে আসিতেছেন। তিনি স্বয়ং অনেকটা পথ অগ্রসর হইয়া পরম শ্রদ্ধেয়া জ্যেষ্ঠা ভগিনী খান্‌জাদা বেগম ও অন্যান্য সকলকে যথাযোগ্য সম্মান ও সমাদরের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন।

 কিন্তু শেষের দিন ঘনাইয়া আসিয়াছিল। বাদ্‌শাহ্ বাবরের চরম আকাঙ্ক্ষা—হিন্দুস্থান-বিজয় শেষ, প্রিয় আত্মীয়বর্গ নিকটে,—প্রাণাধিক পুত্র হুমায়ূন্ রাজ্যভারগ্রহণের উপযুক্ত। বিদায়—এইবার বিদায়! বাদ্‌শাহের নয়নে কোন এক অজানা দেশের রশ্মিপাত হইয়াছে কে বলিবে? একদিন তিনি পরিজনবর্গসহ বাঘ্‌-ই-জান্‌-আফশান্ উদ্যানে উপস্থিত হইয়া প্রার্থনার পূর্ব্বে ‘ওজু’ করিবার স্থান দেখিতে দেখিতে বলিলেন,— ‘রাজত্ব ও রাজ্যশাসন-রশ্মি আকর্ষণ করিয়া আমার হৃদয় অবসন্ন। এইবার এই উদ্যানেই আমি চিরবিশ্রামলাভ করিব।’

 বাদ্‌শাহের বয়স আটচল্লিশ বৎসর; মধ্য-এশিয়া-সম্ভূত কঠোরশ্রমী এই বীরবরের পক্ষে বার্দ্ধক্যের বহু বিলম্ব; পদতলে নববিজিত ধনধান্যপূর্ণ, সুবিপুল স্বর্ণভূমি ভারত। কিন্তু তাঁহার মুখে এখনই বিদায়ের এ কি বিষাদময়ী বাণী! পতিপ্রাণা মহিষী মাহম্ ও অন্যান্য বেগমেরা অশ্রুসংবরণ করিতে পারিলেন না। মাহম্ তৎক্ষণাৎ খোদার আশীর্ব্বাদ মাগিয়া আশাপূর্ণ মধুর বাক্যে, স্বামীকে শান্তি ও সান্ত্বনা দিলেন।

 কিন্তু বাদ্‌শাহের শেষের দিন সত্যসতাই সমীপবর্ত্তী হইয়াছিল। তিনি আনন্দের অবিশ্রান্ত কলরোলের মধ্যে থাকিয়াও কেমন করিয়া যে নিঃশব্দ-পদসঞ্চারী মৃত্যুর আসন্ন আগমনের আভাস পাইয়াছিলেন, তাহা বলা দুরূহ। যদিও কঠোর কার্য্য, সংগ্রামসঙ্ঘর্ষ তাঁহার স্বাস্থ্যের অন্তরায়স্বরূপ হইয়াছিল, তথাপি স্বাস্থ্যভগ্ন হইবার মত কোন লক্ষণ তাঁহার দেহে প্রকাশ পায় নাই। তিনি স্থান হইতে স্থানান্তরে পরিভ্রমণ এবং আরব্ধ-কার্য্য পরিদর্শনাদি করিয়া সময়ের সদ্ব্যবহার করিতেছিলেন। তাহার পর তাঁহার মৃত্যুর যে বিবরণ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে, তাহাকে কোনক্রমেই স্বাস্থ্যহানি-ঘটিত মৃত্যু বলা যাইতে পারে না,—তাহা বাবরের অপূর্ব্ব আত্মবিসর্জ্জন বা ইচ্ছামৃত্যু!

 যাহা হউক, শেষের দিনগুলি সম্রাটের পক্ষে বড় শান্তিপ্রদ হইতে পারে নাই। একদিন বাদ্‌শাহ্‌-পরিবারে শোকের এক মর্ম্মভেদী হাহাকার ধ্বনি উঠিল। পুত্র আল্‌ওয়ার মীর্জ্জা সম্রাটের স্নেহপূর্ণ কোমল হৃদয়ে শেল হানিয়া অকালে ইহসংসার হইতে অপসৃত হইল। শোকাবেগ কথঞ্চিৎ প্রশমিত হইতে না হইতেই সংবাদ আসিল, সম্রাটের প্রাণাধিক জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী, হুমায়ূন্ মীর্জ্জা অসুস্থ—অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। উদ্বেগাকুলচিত্তে ত্বরায় বাদ্‌শাহ্‌ ও মাহম্ মথুরা পৌঁছিয়া পীড়িত পুত্রকে সঙ্গে লইয়া আগ্রা ফিরিলেন।

 হুমায়ূন্ তখন অতি ক্ষীণ, জীবনী শক্তিহীন; ঘোর অচেতন অবস্থা হইতে মাঝে মাঝে চেতনার কূলে উত্তীর্ণ হইতেছেন বটে, কিন্তু সে মুহূর্ত্তের জন্য। জীবনের কোন আশা নাই বলিয়া চিকিৎসকগণ মত প্রকাশ করিয়াছেন। পুত্রের অবস্থা দেখিয়া করুণারূপিনী মাহমের স্নেহার্দ্র কোমল হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছিল। কিন্তু বাদ্‌শাহের বিহ্বলতা দেখিয়া তাঁহাকে আত্মসংবরণ করিতে হইল। সম্রাট্‌কে সান্ত্বনা দিবার জন্য বলিলেন,—‘জাঁহাপনা, আপনি কেন আমার পুত্রের জন্য আকুল হইতেছেন? আপনি বাদ্‌শাহ্, আপনার আরও কত পুত্র; তাহাদের মুখ চাহিয়া হৃদয়কে শান্ত করুন। আমি যে কাতর হইতেছি, তাহার কারণ, আমার সবে এক পুত্র—এই হুমায়ূন্।’

 বাবর বলিলেন,—‘মহিষী, তুমি যাহা বলিতেছ, সব সত্য—আমার আরও পুত্র আছে; কিন্তু তোমার গর্ভজাত এই পুত্রটিকে আমি যত ভালবাসি, এত ভাল, আমি আর কাহাকেও বাসি না। মূমুর্ষু হুমায়ূন্ নীরোগ, সুখী, দীর্ঘজীবী হয়, ইহাই আমার প্রার্থনা; আর পুত্রগণের মধ্যে একমাত্র সে-ই আমার সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়, ইহাই আমার কামনা; কেন না আমি আর কাহাকেও তাহার সমকক্ষ মনে করি না।’

 বাদ্‌শাহ্ কোনক্রমেই সান্ত্বনালাভ করিতে পারিলেন না। মৃত্যুর করালছায়াঙ্কিত পুত্রের পাণ্ডুর মুখচ্ছবি নিরীক্ষণ করিতে করিতে তিনি যখন দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছেন, তখন একটি কথা শুনিয়া তিনি যেন অন্ধকার অকূল পাথারে আশার আলো দেখিতে পাইলেন। কথাটি এই—‘হুমায়ূনের যে অবস্থা, তাহাতে একমাত্র ভগবদনুগ্রহ ব্যতীত তাহার রক্ষার আর উপায় নাই। শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যদানে ভগবানের প্রসন্নতা লাভ করা আবশ্যক। ধর্ম্মপ্রাণ, সরল-বিশ্বাসী বাদ্‌শাহ্ তৎক্ষণাৎ সঙ্কল্প করিলেন, জীবনের তুল্য শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য জগতে আর কিছুই নাই,—তিনি আত্মজীবন-বিনিময়ে পুত্রের প্রাণরক্ষা করিবেন। ইহাতে বাদ্‌শাহের অন্তরঙ্গ হিতৈষিগণের ঘোরতর আপত্তি হইবে, তাহা বলাই বাহুল্য। তাঁহারা বলিলেন,—‘জাঁহাপনা, ধনরত্ন মানসিক করুন, না হয় ধনভাণ্ডার, কিংবা মণির সেরা যে কোহিনূর, পুত্রের জন্য তাহাই উৎসর্গ করুন—আপনার জীবন দান করিবেন না।’ বাবর শাহ্ অচল অটল, কোন কথাই তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল না। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন,—‘আমার পুত্রের জীবনের সঙ্গে তুলিত হইতে পারে, দুনিয়ায় কি এমন কোন মণি আছে?’ ইহার আর উত্তর নাই। উপস্থিত সকলে নীরব।

 বাবর ধীরে ধীরে হুমায়ূনের শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া তাহার শিরোদেশে একটিবার স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর গম্ভীরমুখে শয্যা প্রদক্ষিণ করিতে করিতে একান্ত মনে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন,—‘মেহেরবান খোদা, যদি জীবন দিলে জীবন মিলে, তাহা হইলে আমি বাবর শাহ্, পুত্র হুমায়ূনের জন্য আমি আমার জীবন, আমার সত্তা অর্পণ করিলাম।’

 বাবর সফলকাম হইয়াছিলেন; তৎক্ষণাৎ চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন,—‘কৃতকার্য্য হইয়াছি, আমি কৃতকার্য্য হইয়াছি। পুত্রের ব্যাধি আমি নিজ দেহে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইয়াছি!’ ক্রমে সুস্থকায় বাদ্‌শাহ্ ব্যাধিগ্রস্ত এবং তাঁহার মরণাহত নির্জ্জীব পুত্র সঞ্জীবিত ও সুস্থ হইলেন।

 তারপর রাজ্যের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ আহূত হইয়া সম্রাটের সম্মুখে উপস্থিত হুইলে, তিনি যুবরাজ হুমায়ূনকে তাহাদের হস্তে অর্পণ ও রাজ্যের উত্তরাধিকারী বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া সানন্দে সন্তুষ্টচিত্তে চিরশান্তিময় অমরলোকে প্রস্থান করিলেন (২৬শে ডিসেম্বর, ১৫৩০)। অতৃপ্ত রহিল,—সম্রাটের কীর্ত্তিসূচিত, বিশাল ভারতের রাজ্যভোগ-বাসনা; পড়িয়া রহিল —শোকস্মৃতিসমাচ্ছন্ন প্রাণপ্রতিমা প্রেয়সী মাহম্, বিচ্ছেদকাতর রোরুদ্যমান্ সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়স্বজন।


 বাবরের পরলোকগমনের পর হুমায়ূন্ যখন ভারতের রাজতক্তের অধিকারী হইলেন, তখন তাঁহার বয়স ২২ বৎসৱ। ইতিপূর্ব্বে এদেশের অভিনব শান্তিসুখকর আবহাওয়া তাঁহার তরল স্বভাবের উপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করিতে আরম্ভ করিয়াছিল;—তিনি বিলাসী, আলস্যপরতন্ত্র ও অহিফেনসেবী হইয়াছিলেন। প্রবীণ, চিরসতর্ক, মহাবল বাবরের শৌর্য-বীর্য্য ও শাসনের নিকট যে-সকল শত্রু এতদিন অবনতশির ছিল, এই তরুণ সম্রাটের শিথিল-শাসনের সুযোগে তাহারা আবার মহোৎসাহে মস্তকোত্তলন করিল। রাজপরিবারেও ঘোর অশান্তির অনল জ্বলিয়া উঠিল। বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কামরান্ পঞ্জাব, কাবুল, কন্দাহার ও ঘাজ্‌নী প্রদেশের অধিকার পাইয়াও সন্তুষ্ট হইতে পারিলেন না,—ভ্রাতার সিংহাসনের প্রতি লোলুপ ঈর্ষাদিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ফলে হুমায়ূনের রাজ্যলাভ তাঁহার সুখের হেতু না হইয়া অশান্তি ও বিড়ম্বনায় পর্য্যবসিত হইল। বস্তুতঃ, সিংহাসনারোহণকাল হইতে আরম্ভ করিয়া হুমায়ূনের পরবর্ত্তী জীবনের ইতিহাস— বিপ্লব, বিদ্রোহ, দুর্ঘটনা ও ভাগ্যবিপর্য্যয়ের শোচনীয় পুঞ্জীভূত ঘটনায় পরিপূর্ণ। এই সকল দুর্নিমিত্ত দুর্দ্দৈবের দ্রুততর পটক্ষেপণের মধ্যে স্নিগ্ধমধুর, চিত্তবিমোহন গুল্‌বদন্-চরিত্রের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ বড়-একটা ঘটিয়া উঠে না। কদাচিৎ কখনও যে ঘটনাসূত্রে বিদ্যুৎ চমকের ন্যায় তাঁহার দর্শন এবং পরমুহূর্ত্তেই অদর্শন ঘটে, তখনকার সেই ক্ষণিক চিত্র পাঠকগণের সম্মুখে প্রতিফলিত করিবার জন্যই হুমায়ুনের বিধিবিড়ম্বিত, বিঘ্নবহুল জীবনের ঘটনাপরম্পরার কিঞ্চিৎ ইতিহাস বিবৃত করিতে হইবে।

 বাবরের মৃত্যুর পরেও মহিষী মাহম্ কিছুকাল তাঁহার মৃতকল্প জীবন লইয়া কোনরূপে সংসার-অরণ্যে বিচরণ করেন। রাজ্যের নানাস্থানে বিদ্রোহ ও অশান্তির সূচন। তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিতে হইয়াছিল সন্দেহ নাই; কিন্তু বীরবর বাবরের ভুজবলে জিত ও শাসিত রাজ্যের, এবং প্রাণাধিক পুত্র হুমায়ূনের তেমন কোনও গুরুতর অমঙ্গল সংঘটিত হইবার পূর্ব্বেই, পতিপ্রাণা সাধ্বী স্বামীর অনুসন্ধানে অদৃশ্যলোকে প্রয়াণ করিলেন (৮ই মে, ১৫৩৩)। সুতরাং দুর্দ্দৈবের যে দুঃসহ কোপ অতঃপর বাদ্‌শাহ্-পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দুঃখের অতলতলে নিক্ষেপ করিয়াছিল, তাহা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।

 করুণারূপিণী মাহমের অভাবে বাদ্‌শাহ্‌-পরিবার শোকের গভীর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হইল। মহিষী, স্বামি-বিচ্ছেদের অসহ্য বেদনা নীরবে বহন করিয়া, স্নেহপীযূষদানে এতদিন সন্তানগণের পিতৃশোক ভুলাইয়া রাখিয়াছিলেন। তাহারা যেন মাহমের মাতৃরূপের মধ্যেই তাহাদের পিতার সন্ধান পাইত। পাছে বাবরের সন্তানগণ কোন প্রকারে মর্ম্মপীড়া বোধ করে, পাছে কোন আচরণে মহামান্য বাবরের সম্মান ও মর্য্যাদাহানি হয়, এই ভয়েই তিনি তটস্থ ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে সন্তানসন্ততিগণের মধ্যে শুধু যে মাতৃশোকের প্রবাহ বহিয়াছিল, তাহা নহে,—পিতৃশোকও উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছিল। গুল্‌বদন্ লিখিয়াছেন,— ‘তখন আমি যেন এই সংসার-অরণ্যে আপনাকে নিতান্ত নিঃসঙ্গ ও নিরাশ্রয় বোধ করিলাম। আমি দিবারাত্র তাঁহার জন্য শোক করিয়াছি, কত কাঁদিয়াছি, দুঃখে হাহাকার করিয়াছি। যখন আমি দুই বৎসরের শিশু, তখন আকাম্ (মাহম্) আমাকে কন্যারূপে গ্রহণ করেন, আর ১০ বছর বয়সের সময় তিনি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। এতদিন তিনি আমাকে পরম স্নেহে পালন করিয়াছিলেন।’

 যে সময়ে মানুষের জ্ঞানের উন্মেষ হয়, মানুষ মানুষকে আপনার বলিয়া জানিতে চিনিতে আরম্ভ করে, গুল্ জীবনের সেই সোণার ঊষায় মাহম্‌কে জননী বলিয়া অভিনন্দন করিয়াছিল। সুতরাং পিতার পরলোকের পর, মাহমের বিয়োগ তাহার কোমলকরুণ চিত্তে কিরূপ গভীর বেদনার সঞ্চার করিয়াছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়।

 কিছুদিন পরেই গুল্‌বদন্‌ ও হিন্দাল্‌— দুই ভাই ভগিনী, তাহাদের গর্ভধারিণী জননী দিল্‌দারের আশ্রয়ে গমন করেন। জননী দিল্‌দার যে উভয়কে পরমস্নেহে বক্ষে তুলিয়া লইয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু গুল্— স্নেহগুণমুগ্ধা কৃতজ্ঞহৃদয়া গুল্—যাহাকে তিনি আট বৎসর পূর্ব্বে শিশু অবস্থায় অঙ্কচ্যুত করিয়াছিলেন, —তাঁহার একান্ত আপনার সেই শিশু গুল্,—আজ কৈশোরের সীমান্তে পদার্পণ করিতে চলিয়াছে। মাহমের সংসারের আদর-যত্ন পাইয়া, তাঁহারই হৃদয়ের স্নেহরস আকর্ষণ করিয়াই কি আজ সে এত বড়টি হয় নাই? তাঁহাদের কথা সে কেমন করিয়া বিস্মৃত হইবে? এখন দিল্‌দার একাই তাহার জননী নহেন;—জননী তাহার দ্বিধা-বিভক্ত,—এক দিল্‌দার, অপর মাহম্। মাহমের স্নেহের বেদনাতুর স্মৃতি, আর সেখানে সে যে ভাই হুমায়ূন্‌কে পাইয়াছে—যাঁহার সঙ্গে তাহার আনন্দের, সহানুভূতির মধুর সম্পর্ক, তাঁহার কথা কত গভীরভাবে গুলের হৃদয়ে মুদ্রিত!

 গুলের মনে পড়ে, পিতার মৃত্যুর অনতিপূর্ব্বে ভ্রাতা হুমায়ূন্ যখন দুরারোগ্য কঠিন রোগে শয্যাগত, অসহনীয় যন্ত্রণায় মুহুর্মুহু বিলুপ্তচেতন, সেই নিদারুণ মুহূর্ত্তেও গুল্‌কে দেখিয়া তিনি কত স্বস্তি অনুভব করিয়াছিলেন; তাহাকে বক্ষদেশে ধারণ করিতে
সলীমগড়—রাজকারাগার
না পারিয়া কত দুঃখ করিয়াছিলেন। তারপর পিতার মৃত্যু হইল; ক্রমে মাতা মাহম্‌ও সংসার-রঙ্গমঞ্চ হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিলেন। ভ্রাতা ও ভগিনী উভয়েই শোকে মুহ্যমান হইয়াছিলেন সন্দেহ নাই। কিন্তু হুমায়ূন্ গুল্‌কে সান্ত্বনা দিবার জন্য যেন নিজের শোকও বিস্মৃত হইলেন। এত স্নেহ, এত সহানুভূতি কি এ সংসারে সত্যসত্যই দুর্ল্লভ নহে? সুতরাং হুমায়ূন্ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হইয়াও যে গুলের নিকট সহোদর অপেক্ষা প্রিয়তর হইবেন, আশ্চর্য্য কি?

 যাহা হউক, মাহম্ সংসারপাশ হইতে মুক্ত হইয়া বাঁচিলেন। রাজ্যের চতুর্দ্দিকে এতদিন যে বিদ্রোহের বহ্নি ধূমায়িত হইতেছিল, তাহা দেখিতে দেখিতে করাল লেলিহান রসনা বিস্তার করিয়া, বাদ্‌শাহ্-পরিবারকে গ্রাস করিতে উদ্যত হইল।

 প্রধানতঃ পাঠানগণকে নিপীড়িত ও পরাজিত করিয়াই মোগল-কুলগৌরব বাবর হিন্দুস্থানে মোগল-রাজত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। সুতরাং বিজিত পাঠানেরা যে মোগলের পরম শত্রুরূপে উপযুক্ত সুযোগের প্রতীক্ষায় দিন গণিতে থাকিবে, তাহার আর বৈচিত্র্য কি? হুমায়ূনের শাসন-শৈথিল্য অচিরে তাহাদের সেই অভিলষিত সুযোগ উপস্থিত করিল।

 পূর্ব্বাঞ্চলে মগধে মহাশক্তিধর চতুরচূড়ামণি শের খাঁ বিক্ষিপ্ত পাঠানগণকে কেন্দ্রীভূত করিয়া আবার ভাগ্যপরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইলেন। তিনি পূর্ব্বেই চুনারের দুর্গ হস্তগত করিয়া বিহারের অধিকার দৃঢ়তর করিয়া তুলিয়াছিলেন। শেরের উত্তরোত্তর ক্ষমতা-মদমত্ততার পরিচয় পাইয়া হুমায়ূন্ নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলেন না;—সসৈন্য তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযান করিলেন। চুনারদুর্গই তখন শেরের শৌর্য্যপ্রকাশের প্রধান অবলম্বন। বাদ্‌শাহীবাহিনী সর্ব্বাগ্রে এই কেল্লাটি অবরোধ করিয়া বসিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, এই অবরোধ শেরের তেমন কোন ক্ষতি বা অনিষ্টের কারণ না হইয়া বরং বিশেষ ইষ্টের কারণই হইয়াছিল। হুমায়ূনের সেনাদল যখন চুনার-অবরোধে ব্যপৃত, তখন শের খাঁ কৌশলে রোহ্‌তাসের সুদৃঢ় গিরিদুর্গ দখল করিয়া বসিলেন, আর তাঁহার দুর্দ্দান্ত সেনাদল মহা উল্লাসে বাঙ্গালার রাজধানী গৌড়ের ধনসম্পদ্ লুঠিতে লাগিল।

 চুনার-দুর্গ করগত করিয়া হুমায়ূন্ গৌড়াভিমুখে অগ্রসর হইলেন বটে, কিন্তু তাঁহার পৌঁছিবার পূর্ব্বেই শের গৌড়ের লুণ্ঠিত ধনরত্নাদি নিরাপদে ও নির্ব্বিঘ্নে রোহ্‌তাস-দুর্গে স্থানান্তরিত করিলেন। হুমায়ূন্ গৌড়ে প্রবেশ করিয়া সেখানকার শোভাসৌন্দর্য্যের মোহে এমনই আকৃষ্ট হইয়াছিলেন যে, তথা হইতে আর শীঘ্র তাঁহার নির্গমনের সম্ভাবনা রহিল না। বিলাসপ্রিয় বাদশাহের প্রমোদমগ্ন দিনগুলি যে কোথা দিয়া কেমন করিয়া অতিবাহিত হইতে লাগিল, তাহা যেন তাঁহার উপলব্ধ হইল না। দুঃখের বিষয়, কিছুকাল এইরূপে অতিবাহিত হইবার পর রাজধানীতে এক বিভ্রাটের সূচনা হইল। হুমায়ূনের শিথিল স্বভাব সম্বন্ধে ইতিমধ্যে অনেক কথাই চারিদিকে প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছিল। তাঁহার প্রতি অসন্তুষ্ট কতিপয় আমীর তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হিন্দাল্‌কে সিংহাসনে বসাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। হিন্দাল্ বিদ্রোহী হইলেন। সংবাদ পাইবামাত্র হুমায়ূনের সুখনিদ্রা চকিতে ভাঙ্গিয়া গেল,—তিনি অবিলম্বে আগ্রা যাত্রা করিলেন।

 কিন্তু উদ্যোগী পুরুষসিংহ শের খাঁও এদিকে নিশ্চিন্ত ছিলেন না। হুমায়ূনের প্রত্যাগমন-পথে তাঁহার সহিত যথোপযুক্ত রণসম্ভাষণের আশায় শক্তিসঞ্চয়পূর্ব্বক অপেক্ষা করিতেছিলেন। এক্ষণে বাদ্‌শাহী-বাহিনীকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া বক্‌সার ও চৌসার নিকট তাঁহাদের গতিরোধ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। শোন পার হইয়াই হুমায়ূন্‌কে প্রমাদ গণিতে হইল। উপায়ান্তর না দেখিয়া তিনি সন্ধির প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন। সন্ধির সর্ত্ত লইয়া কয়েক দিন অতিবাহিত হইল। ইতিমধ্যে একদিন রাত্রিশেষে শের অতর্কিতভাবে মোগল-শিবির আক্রমণ করিলেন। এই আক্রমণে অপ্রস্তুত মোগল-বাহিনীর দুর্দ্দশার অন্ত রহিল না;—তাহারা শ্রেণীবদ্ধ হইবার পূর্ব্বেই যুদ্ধের ফলাফল নির্ণীত হইয়া গেল। অনেকে নিরস্ত্র-অবস্থায় আততায়ীর তরবারিমুখে —অনেকে নৌসেতু ভগ্ন হওয়ায় সন্নিহিত নদীগর্ভে প্রাণ হারাইল। হুমায়ূন্-পত্নী, চারি সহস্র মোগল-কুলবধূর সহিত বন্দী হইলেন। কিন্তু শের শত্রু হইয়াও, মোগল-মহিলাগণের সম্বন্ধে যে যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা সকলেই স্বীকার করেন। তিনি উত্তরকালে তাঁহাদিগকে সসম্মানে প্রত্যর্পণ করিয়াছিলেন।

 নিদ্রোত্থিত সম্রাট্ সহসা শত্রুসৈন্যের বিপুল তরঙ্গোচ্ছ্বাস দেখিয়া অগ্রে পরিবার-পরিজনের প্রাণ ও মান বাঁচাইবার জন্য আকুল হইলেন। মহিষীর রক্ষার জন্য তখনই খাজা মুয়জ্জম্‌কে প্রেরণ করা হইল। কিন্তু তখন শত্রুর রণ-তাণ্ডবের মুখে দাঁড়ায় কাহার সাধ্য? হুমায়ূন্ আত্মরক্ষার্থ অশ্বপৃষ্ঠ হইতে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। অতুল সুখৈশ্বর্য্যের অধিকারী, রাজরাজেশ্বর ভারত-সম্রাটের বোধ হয় এই সলিল-শয্যাই অন্তিমশয্যা হইত; কিন্তু বিধাতার কৃপায় এই সময় নিজাম্ নামে এক ভিস্তি বায়ু পূর্ণ মশক লইয়া তাঁহার প্রাণরক্ষার্থ অগ্রসর হইল। এই ভিস্তির মশকের আশ্রয়েই হুমায়ূন্ নদী পার হইয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন।

 সহৃদয় কৃতজ্ঞ সম্রাট্ ভিস্তির এই উপকারের কথা বিস্মৃত হ’ন নাই। তিনি যথাসময়ে আগ্রায় পৌঁছিয়া দীন-হীন নিজাম্‌কে প্রতিশ্রুতিমত অর্দ্ধ দিবসের জন্য (গুলবদনের মতে দুইদিন) হিন্দুস্থানের মহামান্য বাদশাহের চিরগৌরবাহ আসনে বসাইয়া কৃতজ্ঞতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। অর্দ্ধ দিবস ভিস্তি-বাদ্‌শাহ্, খোশমেজাজে বহাল্ তবিয়তে বাদ্‌শাহী করিবার অধিকার পাইয়াছিল।

 হুমায়ূনের এই ব্যবস্থায় যে অনেকেই অবমানিত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই; এবং রাজ্য ও রাজনীতি হিসাবে এক নগণ্য ভিস্তিকে এরূপ মান-দান যে অশোভন ও অসঙ্গত তাহাও স্বীকার্য্য; কিন্তু এই ঘটনায় এক মুহূর্ত্তে আমরা যেন অপূর্ব্ব মধুর আরব্য রজনীর স্বপ্নালোকের সন্ধান পাই;— মুসলমান্ মানসলোকের আরাধ্য দেবতা, উদার মহৎ

হারুণ-অল্-রশিদের চরিত্রের একাংশ আমাদের নয়ন-সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠে।

 কিন্তু হুমায়ূন্ চৌসার রণক্ষেত্র হইতে এবার বড় মর্ম্মপীড়া, বড় অপমান বহন করিয়া ফিরিয়াছিলেন। শুধু যে পরাজয়, পলায়ন, সৈন্যক্ষয় তাঁহার এই মর্ম্মপীড়ার কারণ তাহা নহে; চৌসার রণতরঙ্গে বাদ্‌শাহী হারেমের কতিপয় সুন্দরী তৃণখণ্ডের মত কোথায় যে ভাসিয়া গেল, অনেক অনুসন্ধানেও তাহার নির্ণয় হইল না। এই নিরুদ্দিষ্টা ললনাগণের মধ্যে হুমায়ূনের পরম স্নেহের শিশুকন্যা আকীকা অন্যতমা। এই শিশুকন্যার জন্য সম্রাট্ বড়ই কাতর হইয়াছিলেন।

 ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দে হুমায়ূন্ গৌড়ে অভিযান করেন, আর ১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দে চৌসার যুদ্ধ। সুতরাং দুই বৎসর পরে বাদশাহ্ আগ্রা প্রত্যাবর্ত্তন করেন। এই অত্যল্পকালের মধ্যে বাদশাহের মাথার উপর দিয়া অচিন্তিতপূর্ব্ব কতই না পরিবর্ত্তনের স্রোত বহিয়া গিয়াছে! হুমায়ূন্ তাঁহার চিরপরিচিতা প্রাণাধিকা ভগিনী গুল্‌বদনের মুখের দিকে প্রশ্নপূর্ণ বিস্মিত-দৃষ্টিতে চাহিলেন— এ কে? তিনি যেন তাহাকে চিনিয়াও চিনিতে পারিলেন না। হুমায়ূন্ গৌড়-অভিযানকালে গুলের অবিবাহিতা বালিকা-মুর্ত্তি,— শিরে কুমারীর ‘তাক্’— দেখিয়া গিয়াছিলেন। আর আজ,— এ যে সদ্যোপ্রস্ফুটিত গোলাপের মত যৌবন-লাবণ্যে ঢল ঢল করিতেছে; শিরে তাহার পরিণীতা রমণীর শিরোভূষণ—লচক্!

 বস্তুতঃ ইতিমধ্যে চঘ্‌তাই-বংশীয় পিঞ্জর্ খাজা খাঁর সহিত গুলের পরিণয়-ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গিয়াছিল; তাই তাহার এ বেশপরিবর্ত্তন। যাহা হউক, পরমুহূর্ত্তেই হুমায়ূন্ তাহাকে চিনিতে পারিয়া স্নেহোদ্বেলিত আকুলকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন,— ‘গুল্, প্রবাসে তোমার কথা আমার প্রায়ই মনে হইত, আর আমার মন কেমন করিত। তোমাকে সঙ্গে লইয়া যাই নাই বলিয়া আমার কতই না আপ্‌শোষের কারণ হইয়াছিল। কিন্তু তারপর ভাগ্যে যখন পরাজয় ঘটিল, তখন ভাবিলাম, ভগবান্ যাহা করেন মঙ্গলের জন্যই। তোমাকে সঙ্গে লইয়া যাইবার ইচ্ছা হয় নাই বলিয়া তৎক্ষণাৎ আমি করুণাময় খোদাকে শত শত ধন্যবাদ করিয়াছি! আকীকাকে লইয়া গিয়া কি ভুলই করিয়াছিলাম। হায়! সেই শিশুর জন্য আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে।’

 যাহা হউক অবমানিত ও মর্ম্মপীড়িত সম্রাট্ পরাজয়ের প্রতিশোধ লইবার জন্য অতঃপর উপযুক্ত আয়োজন করিয়াছিলেন। ইহার ফলে কনৌজের রণক্ষেত্রে শেরের সহিত হুমায়ূনের আর একবার সঙ্ঘর্ষ হয় (১৫৪০, মে)।

 বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কামরান্ আগ্রায় হুমায়ূনের প্রতিনিধি-স্বরূপ ছিলেন। তিনি সুসময় বুঝিয়া সৈন্যসামন্তসহ লাহোরে প্রস্থান করিলেন এবং ভগিনী গুল্‌বদন্‌কে হস্তগত করিবার অভিপ্রায়ে হুমায়ূন্‌কে বারংবার অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিতে লাগিলেন,—‘আমার বড় অসুখ। দেখিবার শুনিবার কেহ নাই। গুল্‌বদন্‌কে পত্রপাঠমাত্র এখানে পাঠাইয়া দিলে আমি যারপরনাই উপকৃত হইব।’ ভ্রাতৃবৎসল, সরলমতি হুমায়ূনের হৃদয় গলিয়া গেল। তিনি ভ্রাতার ছলনা বুঝিতে না পারিয়া, গুল্‌বদন্‌কে লাহোরে যাইবার অনুরোধ করিলেন। গুলের হৃদয় অভিমানে ভরিয়া উঠিল। হুমায়ুন্‌কে যে তিনি কিরূপ স্নেহের চক্ষে দেখেন, তাহা এক অন্তর্যামী বই আর কেহ অবগত নহে। তারপর ভাই হইয়া ভাইকে যে বিপদ্‌কালে সাহায্য না করিয়া নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথ দেখে, হুমায়ুন্ গুল্‌কে তাহার নিকটে যাইতে বলিতেছেন। তিনি হুমায়ূন্‌কে অনুযোগ করিয়া লিখিলেন,— ‘ভাই, তুমি যে কখনও আমাকে তোমার সঙ্গসুখ হইতে বঞ্চিত করিয়া কামরানের নিকট যাইতে বলিবে, ইহা আমার ধারণারও অতীত। তুমি যাহাই বল না কেন, আমি আশৈশব যাঁহাদের অঙ্কে লালিত, বর্দ্ধিত, সেই মাতা ভগিনী বা আত্মীয়বর্গকে ছাড়িয়া কোথাও এক পা নড়িব না।’

 ভগিনীর প্রতি হুমায়ূনেরও স্নেহ অল্প নহে; তিনি করুণ স্নেহপূর্ণ ভাষায় গুল্‌কে লিখিলেন,—‘ভগিনী! তোমার সঙ্গ-সুখ হইতে বঞ্চিত হওয়া আদৌ আমার অভিপ্রেত নহে। তবে কামরান্ অসুস্থ; বারবার আমাকে অনুরোধ করিতেছে বলিয়াই তোমাকে যাইতে বলিতেছি। বিশেষ আমি এখন বড়ই বিপন্ন — সিংহাসন লইয়া চিন্তিত। এই বিপদ্-সাগর উত্তীর্ণ হইতে পারিলেই আবার তোমাকে আমার নিকট লইয়া আসিব।’

 স্নেহের দায় বড় দায়। গুল্ ভ্রাতার এ স্নেহের অনুরোধ কেমন করিয়া উপেক্ষা করিবে? একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাহাকে কামরানের নিকট লাহোরে যাইতে হইল।

 ওদিকে বিপুল আয়োজনসত্ত্বেও দৈববিড়ম্বিত হুমায়ূন্ শের শার সহিত আঁটিয়া উঠিতে পারিলেন না। ‘তরল-তরঙ্গা’ তটঘাতিনী গঙ্গা সহসা রণরঙ্গিনী মূর্ত্তিতে, বাদ্‌শাহী-বাহিনীকে গ্রাস করিতে উদ্যত হইলেন। আবার গঙ্গাগর্ভে শত শত সেনার সমরলীলার অবসান হইল। হুমায়ূন্ অল্পসংখ্যক অনুচর-সহচরসহ কোনক্রমে প্রাণ লইয়া ফিরিলেন।

 ফিরিলেন সত্য, কিন্তু হিন্দুস্থানের রাজসিংহাসন তখন তাঁহার নিকট ‘নিশার স্বপনসম’ অলীক। হৃতবল সম্রাট্ প্রবল আততায়ীর আসন্ন গ্রাস হইতে আগ্রা রক্ষা অসম্ভব জানিয়া প্রস্থান করিতে বাধ্য হইলেন।

 কিন্তু স্থান কোথায়? মাথা গুঁজিয়া দাঁড়াইবার মত যৎসামান্য একটু স্থানেরও যে হুমায়ূনের একান্ত অভাব। কাল যিনি আশ্রিতের আশ্রয়,—বিশাল বিপুল হিন্দুস্থানের রাজরাজেশ্বর, ভাগ্যবিধাতা,—যাঁহার অঙ্গুলী-হেলনে শত শত বীর রণাঙ্গনে শির ডারিতে সমুৎসুক, বিধির বিধানে আজ তিনি নিতান্ত নিরাশ্রয়— পথের ফকীর! কিন্তু পথের ফকীরেরও পথের আশ্রয় নিরাপদ; হুমায়ূনের পদে পদে ভয়, পলে পলে বিভীষিকা। সম্মুখে অন্ধকার —পশ্চাতে শের শাহ্!

 ভ্রাতৃগণের মধ্যে কামরান্‌ই অধিক শক্তিশালী। তিনি তখনও লাহোর পরিত্যাগ করেন নাই; কিন্তু তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ অপেক্ষা অরণ্যবাসও সহস্রগুণে শ্রেয়ঃ। ভ্রাতা হইয়াও তিনি শত্রুর অধম; সুযোগ এবং সুবিধা পাইলে যে-কোন মুহূর্ভে ভ্রাতার বুকে ছুরি বসাইতে প্রস্তুত। কিন্তু এ দুর্দ্দিনে তাঁহাকেই হুমায়ূনের মহা-আশ্রয় বলিয়া মনে হইল। একে তাঁহার নিজের নিঃসহায় অবস্থা, তাহার উপর হারেমের মহিলাবর্গ—বিমাতা দিল্‌দার, বৈমাত্রেয় ভগিনী গুল্‌চিহ্‌রা প্রভৃতি তাঁহার স্কন্ধে। আত্মচিন্তা অপেক্ষা অন্তঃপুরললনাগণের চিন্তাই তখন হুমায়ূনের সমধিক প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। তিনি মর্ম্মভেদীকণ্ঠে ভ্রাতা হিন্দাল্‌কে ডাকিয়া বলিলেন,—‘ভাই, স্নেহের পুত্তলী আকীকাকে হারাইয়া আমার পরিতাপের সীমা ছিল না। আমি কতবার তোমাদের বলিয়াছি, কেন তাহাকে আমি আমার চোখের উপরে ধরিয়া নিজের হাতে হত্যা করিলাম না! ভাই, আমার সম্মুখে আবার সেই বিষম সমস্যা উপস্থিত। পথ বিপদ্-সঙ্কুল; এই পথে কুল-ললনাগণকে নিরাপদে লইয়া যাওয়া নিতান্ত দুষ্কর।’

 মহিলাগণকে সঙ্গে লইয়া গেলে রক্ষকহীন অবস্থায় তাঁহাদের শত্রুহস্তে পতিত হইবার সম্ভাবনা,— হতাশক্ষুণ্ণ মর্ম্মপীড়িত হুমায়ূন্ তাই তাঁহাদের হত্যা করিয়া নিশ্চিন্ত হইতে চাহিতেছেন। হিন্দাল্ ভ্রাতার বিরুদ্ধে একবার বিদ্রোহী হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু সে ঘটনাচক্রে। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিঠুর বা স্নেহ-সহানুভূতিশূন্য নহেন। হুমায়ূনের চিত্তবিকার ও তাঁহার প্রস্তাবের মর্ম্ম বুঝিতে পারিয়া তিনি পুরমহিলাদের ভার স্বীয় স্কন্ধে গ্রহণ করিলেন; ভ্রাতাকে অভয় দিয়া বলিলেন,—‘জীবনের শেষমুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত আমি ইঁহাদের জন্য যুঝিব, হৃদয়ের শোণিত দিয়া আমি ইঁহাদের প্রাণরক্ষা করিব।’ হিন্দালের এই উক্তি শুধু অসার সান্ত্বনাতেই পর্য্যবসিত হয় নাই; শত্রুনিক্ষিপ্ত তীরের শতধারার মধ্য দিয়া তিনি তাঁহাদের নিরাপদে লাহোরে পৌঁছাইয়া দেন।

 ইহার পর হুমায়ূন্‌ও লাহোরে আসিয়া কামরানের শরণাপন্ন হইলেন। কুচক্রী কামরানের মনস্কামনা পূর্ণ হইল; ভাবিলেন, ভাগ্য এতদিনে সুপ্রসন্ন,—পথের কণ্টক আপনিই পথ বাহিয়া অনলকুণ্ডে আত্মবিসর্জ্জন করিতে আসিয়াছে! কিন্তু ধূর্ত্ত কামরান্ বাহিরে সে ভাবের আভাসমাত্রও প্রকাশ না করিয়া মুখে ভ্রাতৃপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাইতে লাগিলেন। সরল-স্বভাব হুমায়ূন্ যে কামরানের ছলনায় ভুলিবেন, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? তিনি নিশ্চিন্ত মনে তাঁহার সহিত কর্ত্তব্য সম্বন্ধে মন্ত্রণা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার অপর দুই ভ্রাতা হিন্দাল্ ও অস্করীও অবশ্য এই মন্ত্রণায় যোগদানের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইলেন না। কিন্তু দিনের পর দিন শুধু মন্ত্রণাই হয়, শূন্যগর্ভ বাক্‌সর্ব্বস্ব মন্ত্রণা আর কোন শুভফল প্রসব করে না,— হুমায়ূন্‌ও কোন স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন না। ভ্রাতৃদ্রোহী রাজ্যলোলুপ কামরান্ পরামর্শদানের ছলনায় অগ্রজকে লাহোরে ধরিয়া রাখিয়া শত্রুকর্ত্তৃক বিপন্ন করিবার চেষ্টায় ছিলেন। তাঁহার মনে এইরূপ দুরভিসন্ধি জাগিতেছিল যে, শের শাহের সহিত এই সুযোগে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইয়া পঞ্জাব ও লাহোর হস্তগত করিবেন। যদি একান্তই তাহাতে অকৃতকার্য্য হ’ন, তখন কাবুল লইয়া বুঝা-পড়া। কাবুল হুমায়ুনেরই প্রদত্ত রাজ্য। নিরুপায় হুমায়ূন্ শেষে অবশ্যই উহার জন্য লালায়িত হইবেন। কিন্তু কাবুলের অধিকার, কামরানের জান্ কবুল, কিছুতেই তিনি জ্যেষ্ঠকে ছাড়িয়া দিবেন না। মনে এই দুরভিসন্ধি, সুতরাং বৈঠকে কোন প্রকার কাজের কথা উপস্থিত হইলেই কূটতর্ক তুলিয়া তিনি তাহা পণ্ড করিয়া দিতেন। এইরূপ বর্ষণহীন অসার পরামর্শের ঘনঘটায় কিছুদিন অতিবাহিত হইবার পর কামরানের মনে যাহা ছিল, তাহাই হইল—হুমায়ূনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী শের শাহ্, দিল্লী ও আগ্রা অধিকার করিয়া ক্রমে একেবারে সর্‌হিন্দে আসিয়া উপস্থিত!

 মস্তকোপরি বিপদের কাল-মেঘ পুঞ্জীভূত। হুমায়ূন্ সহসা চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া প্রমাদ গণিলেন; কিন্তু চিন্তার আর অবসর নাই। ক্রুদ্ধ শার্দ্দূলের গহ্বর হইতে আত্মরক্ষার জন্য তাহারই শরণাপন্ন হইতে হইল। তিনি দূতমুখে শেরকে বলিয়া পাঠাইলেন, —‘এই কি ন্যায় ধর্ম্ম! আমি যে সমগ্র হিন্দুস্থান ছাড়িয়া দিয়া আসিলাম। শুধু এইটুকু—এই লাহোরের অধিকারটুকু শাহ্ আমাকে ছাড়িয়া দিবেন না? তিনি যে-পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছেন, তাহাই ওদিক হইতে তাঁহার বিপুল অধিকারের সীমানা নির্দ্ধারিত হউক।’

 শের গর্জ্জিয়া উঠিয়া মর্ম্মান্তিক বিদ্রূপের স্বরে কহিলেন,— ‘কাবুল! কাবুল! আমি কাবুল কাড়িয়া লই নাই, হুমায়ূনের জন্য রাখিয়া দিয়াছি। অতঃপর ঐ কাবুলেই তাঁহাকে ফিরিতে হইবে।’

 হায় রে ভূ-স্বর্গ!—দেবতুল্য পিতার জীবন-মরণ-পণে অর্জ্জিত মধুর সুন্দর সুদুর্ল্লভ হিন্দুস্থান! যার ফুল্ল-কুসুমিত কুঞ্জে শ্যামশষ্পসমাকীর্ণ প্রান্তরে, অমৃতনিস্রাবী নির্ঝরমূলে হুমায়ূন্ এতদিন স্বচ্ছন্দে বিচরণ করিয়াছেন, বিদায়! ওরে বিদায়!—সেই সোণার দেশ হইতে স্বর্গতাড়িত অভিশপ্ত আদমের ন্যায় হুমায়ূনের সুদুর সুকঠোর নির্ব্বাসন!

 মোগলের উচ্ছেদকামী শের শাহ্ রণসাজে সজ্জিত,—যে কোন মুহূর্ত্তে তাঁহাদের উপর বজ্রের ন্যায় সদম্ভে পতিত হইতে পারেন। সুসজ্জিত সুরম্য আবাসভবন, বহুমূল্য দুষ্প্রাপ্য বিলাসসম্ভার যেখানে যেমন ছিল, পড়িয়া রহিল,—শঙ্কিত মোগলপরিবার লাহোর হইতে ত্রস্তভাবে নিষ্ক্রান্ত হইলেন ৷

 হিন্দুস্থানে অবস্থান একান্ত অসম্ভব দেখিয়া হুমায়ূন্ বদখশান্ যাইবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। কাবুলের মধ্য দিয়াই বদখশান্ যাইবার পথ। সন্দিগ্ধ কামরান্ শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন—তাঁহার এতদিনের আশঙ্কা বুঝি সত্য সত্যই কার্য্যে পরিণত হয়! কাবুলের অতুল শোভাসম্পদের পথে উপনীত হইলে সেখান হইতে হুমায়ূন্ কি আর এক পদও সম্মুখে অগ্রসর হইবেন? কামরান্ অত্যন্ত তীব্রভাবে অগ্রজের কথার প্রতিবাদ করিতে লাগিলেন।

 ঘোর বিপদ্‌কালে ভ্রাতার এইরূপ নির্ম্মম আচরণে হুমায়ূন্ অতীব মর্ম্মাহত হইলেন। সম্মিলিত মোগল-বংশীয়গণ দেখিতে দেখিতে মনোমালিন্যের ফলে পথিমধ্যে বিভক্ত হইয়া পড়িল। কাবুলের জন্য একান্ত শঙ্কিত কামরান্ হুমায়ূনের সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া নিজের সুবিধানুরূপ পথ ধরিলেন। কনিষ্ঠ অস্করী পালিতমেষশাবকের ন্যায় নিরাপত্তিতে তাঁহার অনুবর্ত্তন করিল।

 আত্মীয়স্বজন-পরিত্যক্ত, হৃতরাজ্য, হতাশ, ব্যথিতচিত্ত সম্রাট্‌কে অবশেষে সিন্ধুর মরুপ্রান্তরের পথিক হইতে হয়। সঙ্গে কতিপয় প্রভুভক্ত বিশ্বস্ত অনুচর—যাহারা শুধু সম্পদের পারাবত নহে। সম্পদে-বিপদে সম্রাটের সম-অনুরাগী, এরূপ কয়েকজন পরীক্ষিত অনুচরসহ তিনি দীর্ঘকাল মরুভূমির দেশে দেশে, বাত্যা-বিতাড়িত স্খলিত বৃক্ষপত্রের ন্যায় বিচরণ করিয়াছিলেন। ইহার বিস্তারিত বর্ণনায় আমরা পাঠকের চিত্ত ভারাক্রান্ত করিব না। বর্ত্তমান জীবনবৃত্তের জন্য এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই সময়েই হুমায়ূনের জীবনে চরম অনর্থের আবির্ভাব হয়। দুঃখ ও কষ্ট, বিঘ্ন ও বিপত্তি তাঁহার মুল্যবান্ জীবনটিকে লইয়া যেন কন্দুকক্রীড়ায় প্রমত্ত হইয়াছিল।

 কিন্তু ঘোর দুর্গতির মধ্য দিয়া ভগবানের অদৃশ্য কল্যাণময় হস্ত যে মানুষের অভিনন্দনের জন্য কোন্ বরণডালা কিরূপে সাজাইয়া তুলেন, বুঝিয়া উঠা কঠিন। হুমায়ূন্ তাঁহার দুঃখপূর্ণ মরুপথের প্রান্ত হইতে যে অপার্থিব স্বর্গীয় কুসুম চয়ন করিতে সমর্থ হইলেন, সম্ভবতঃ সুখপূর্ণ রাজপথের পার্শ্বে তাহার সন্ধান মিলিত না।

 হিন্দাল্, মাতা দিল্‌দারকে লইয়া মূলতানের পাট্ নামক স্থানে শিবির সন্নিবেশ করিয়াছেন। হুমায়ূন্ তখন তাঁহার সন্নিহিত সিন্ধুপতির আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া লাঞ্ছিত ও প্রতারিত। এই সময় একদিন তিনি বিমাতা দিল্‌দারের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইয়া তাঁহারই পার্শ্বে এক অপরূপ বালিকামূর্ত্তি নিরীক্ষণ করিলেন। বালিকার চিত্তহরা রূপমাধুরী, হুমায়ূনের দাবদগ্ধ তৃষিত জীবনে কোন্ এক অপার্থিব অমৃত-নির্ঝরের মদিরস্বপ্ন বহন করিয়া আনিয়াছিল, কে বলিবে? বাদ্‌শাহ্ দর্শনমাত্র মুগ্ধ হইলেন। পরে যখন সংবাদ লইয়া জানিলেন, অবস্থা ভাল না হইলেও উত্তম কুলেই বালিকার জন্ম—তাঁহারই স্বর্গীয়া জননী মাহমের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়কন্যা, অলভ্যা নহে, তখন তাঁহার চিত্ত ঐ চতুর্দ্দশবর্ষীয়া বালিকার জন্য যারপরনাই লুব্ধ হইয়া উঠিল।

 কিন্তু প্রেমের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। রূপমুগ্ধ প্রেমোন্মত্ত সম্রাট্ বালিকার দর্শনলাভের জন্য পুনঃ পুনঃ হিন্দালের শিবিরে উপস্থিত হইয়া হতাশ হইতে লাগিলেন। শত উপরোধ-অনুরোধসত্ত্বেও সে দ্বিতীয়বার হুমায়ূনের সমক্ষে উপস্থিত হইতে চাহিল না; এমন কি একদিন স্পষ্টাক্ষরেই এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিল যে, তাহার বাহু যাঁহার কণ্ঠলগ্ন হইতে সমর্থ, এরূপ ব্যক্তিকেই সে পরিণয়পাশে আবদ্ধ করিতে পারে; কিন্তু এমন কাহাকেও সে স্বামিত্বে বরণ করিবে না, যাঁহার বস্ত্রপ্রান্ত স্পর্শ করিতে তাহার হস্ত পৌঁছাইবে না। বালিকার এই উক্তি হইতে উভয়ের অবস্থাগত ও মর্য্যাদাগত তারতম্য সূচিত হইতেছে বলিয়াই মনে হয়।

 প্রেমের স্বভাবই বোধ হয় এই, সে বাধা পাইলে অধিকতর উদ্দাম হইয়া উঠে। বিমাতা দিল্‌দারের শরণাপন্ন হইয়া প্রেমোন্মত্ত সম্রাট্ বালিকার জন্য অধীরভাবে দিন গণিতে লাগিলেন। আশা ও নিরাশার প্রতিকূল ও অনুকূল তরঙ্গের মধ্যে একটি একটি করিয়া চল্লিশ দিন অতিবাহিত হইবার পর তাঁহার মনোরথ পূর্ণ হইল। মহিষী দিল্‌দার বহু আয়াসে বালিকার মন ফিরাইতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অতঃপর এই পটমণ্ডপেই বাসর সাজাইয়া উৎকণ্ঠিত বাদ্‌শাহের শুভপরিণয়োৎসব সুসম্পন্ন করা হয় (সেপ্টেম্বর, ১৫৪১)। ইতিহাস প্রসিদ্ধ হামীদা বানুই এই পরিণয় বা প্রণয়-ব্যাপারের নায়িকা, এবং সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর চিরস্মরণীয় আক্‌বর শাহ্‌ই এই পরিণয়ের অমৃতময় ফল।

 কিন্তু এই শুভপরিণয়ের পর সম্রাটের অদৃষ্টাকাশ আরও ঘোরতর মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। কামরান্ ও অস্করী চিরবিরোধী, কেবল একটিমাত্র বৈমাত্রেয় ভ্রাতা তাঁহার স্বপক্ষে; এই বিবাহে সেই হিন্দাল্‌ও তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইয়া কন্দাহার চলিয়া গেলেন। সিংহাসন শত্রুকবলে। বন্ধু—বৈরী। অনুচরদল ছিন্নভিন্ন— আত্মীয়স্বজন বিমুখ। হায়, এ দুর্দ্দিনে চিরহিতৈষিণী, চিরস্নেহময়ী ভগিনী গুল্‌বদন্ কোথায়?

 রাজপরিবারের এই দুর্দ্দশার দিনে গুল্‌বদন্‌ কোথায় অবস্থিতি করিতেছিলেন, ইতিহাসে কোথাও তাহার উল্লেখ নাই; কিন্তু তিনি যে কাবুলে ছিলেন, পরবর্ত্তী ঘটনা হইতে তাহা অনুমান করা যায়।

 হুমায়ূনের শাসন শিথিল হইলে, ভ্রাতৃদ্রোহী কামরান্ সুযোগ বুঝিয়া তাঁহার বহুদিনের দুরাকাঙ্ক্ষা কার্য্যে পরিণত করিতে সচেষ্ট হইলেন। প্রথমেই তিনি হিন্দালের হস্ত হইতে কন্দাহারের অধিকার কাড়িয়া লইলেন এবং তাঁহার অনুমতি ব্যতীত স্থান ত্যাগ করিবে না, হিন্দালের নিকট এই প্রতিশ্রুতি লইয়া তাহাকে কাবুলে তাহার মাতার নিকট পাঠাইয়া দিলেন। এই সময় কাবুলে (১৫৪৩) হিন্দালের সহিত গুল্‌বদনের সাক্ষাৎ ঘটে। ইহা হইতে অনুমান হয়, গুল্‌বদন্‌ তখন কাবুলে কামরানের অন্তঃপুরবাসিনী; রাজ্যভ্রষ্ট প্রিয়ভ্রাতা হুমায়ূনের দুর্দ্দৈবে ব্যথিত চিত্তকে জননী-সেবায় ও পুত্রকন্যাপালনে সান্ত্বনাদান করিতেছেন।

 হুমায়ূন্ হৃতরাজলক্ষ্মী পুনরুদ্ধারের উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিন্তু বিরল-সুহৃদ্ ভারতবর্ষ হইতে কি উপায় হইবে? স্থির হইল, তিনি এই দুর্দ্দিনে সাহায্যলাভের আশায় পারস্য-সম্রাট্ শাহ্, তহ্‌মাস্পের শরণাগত হইবেন।

 পারস্য-গমনের সঙ্কল্প স্থির রাখিয়া হুমায়ূন্ কোয়েটার সন্নিকটে শাল্ মসতং পর্য্যন্ত অগ্রসর হইলে, হঠাৎ সংবাদ পাইলেন তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা অস্করী তাঁহাকে বন্দী করিবার দুরভিসন্ধিতে দুই সহস্র অশ্বারোহী সেনা লইয়া ধাবিত হইয়াছেন। অনন্যোপায় হুমায়ূন্ পলায়নের সঙ্কল্প করিলেন; কিন্তু সঙ্গে হামীদা ও এক বৎসরের শিশু আক্‌বর। ইহাদের লইয়া পলাইবার জন্য দ্বিতীয় অশ্বও তাঁহার ছিল না। সম্রাট্ একটি অশ্বের জন্য তর্দ্দী বেগের নিকট নিষ্ফল প্রার্থনা করিয়া অবশেষে হামীদাকে নিজ অশ্বে তুলিয়া লইয়া পলায়ন করিলেন। রৌদ্রের উত্তাপে এক বৎসরের শিশুকে সঙ্গে লওয়া নিরাপদ বিবেচিত হইল না। ‘হুমায়ূন্-নামায়’ গুল্‌বদন্ লিখিয়াছেন, পলায়নের ত্রস্ততায় শিশুপুত্র পরিত্যক্ত হইয়াছিল। অস্করী আসিয়া দেখিলেন, পিঞ্জর শূন্য। ভ্রাতৃবৈরী হইলেও তিনি শিশু ভ্রাতুষ্পুত্রের উপর সদয় হইয়া তাহাকে কন্দাহারে পত্নী সুল্‌তানম্ বেগমের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

 হুমায়ূনের দূত চুপী বাহাদুর যখন পারস্য-সম্রাটের নিকট রাজ্যহারা, পুত্রহারা, নিরাশ্রয় নরপতির জন্য আশ্রয় ভিক্ষা করিল, তখন শাহ্ তহ্‌মাস্পের বিস্ময়ের অবধি রহিল না। অদৃষ্টচক্রে, ক্রূর গ্রহকোপে রাজাধিরাজ আজ তাঁহার দ্বারে ভিখারী! পারস্যরাজ স্বয়ং অশ্বারোহণে অগ্রসর হইয়া অতিথিকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করিলেন।

 উদার-হৃদয় শাহ্ বিপন্ন সম্রাটকে বিমুখ করিলেন না;—হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার-সাধনে সহায়তা করিবার জন্য একদল রণনিপুণ সৈন্য দিলেন। এই মহাবল সমর-কুশল বাহিনী সাহায্যে অস্করীর কবল হইতে কন্দাহার পুনরুদ্ধৃত হইল—সঙ্গে সঙ্গে কামরানও কাবুলের অধিকার-ভ্রষ্ট হইলেন (১৫৪৫)। বিজয়-দুন্দুভি-নিনাদে হুমায়ূন্ কাবুলে প্রবেশ করিলেন। দীর্ঘকাল পরে গুল্‌বদনের সহিত সাক্ষাৎ। যাঁহার কল্যাণের নিমিত্ত খোদার দরবারে নিত্য কাতর প্রার্থনা জানাইয়াছেন, যাঁহার ভাগ্যবিপর্য্যয়ে নিরন্তর নীরবে অশ্রুপাত করিয়াছেন, উদয়মুখ মিহিরের ন্যায় আজ সেই জয়শীল ভ্রাতার সাক্ষাৎ পাইয়া স্নেহময়ী ভগিনীর কি আনন্দ! গুল্ লিখিয়াছেন,—‘পাঁচ বৎসর দীর্ঘবিচ্ছেদের পর আবার আমরা প্রিয়ভ্রাতা হুমায়ূন্‌কে পাইয়া আনন্দ-সাগরে ভাসিলাম।’ ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দের নবেম্বর হইতে ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দ—এই পাঁচ বৎসর কাল গুল্‌বদনের কাবুল-অবস্থানের ইহা অন্যতর প্রমাণ।

 পরাজিত কামরান্ আপাততঃ হুমায়ূনের বশ্যতা স্বীকার করিলেন বটে, কিন্তু ১৫৪৬ খ্রীষ্টাব্দে হুমায়ুন্‌ যখন অস্করীর সহিত কাবুল ত্যাগ করিয়া বদখশান্ অভিমুখে অভিযান করেন, সেই সুযোগে তিনি ভ্রাতার অনিষ্ট-চেষ্টায় পুনরায় বদ্ধপরিকর হইলেন, এবং সহসা কাবুলে উপস্থিত হইয়া, বিমাতা দিল্‌দারের গৃহ অধিকার করিয়া, তাঁহাকে অন্যত্র যাইবার আদেশ দিলেন। কিন্তু এই নির্ম্মম আচরণেও কামরান্ গুলের সহিত অসদ্ব্যবহার করেন নাই; তিনি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন,—‘তুমি স্বচ্ছন্দে এখানে অবস্থান কর,—মনে করিও ইহা তোমার নিজেরই গৃহ।’ কামরান্ কুসুম-সুকোমলা স্নেহময়ী ভগিনীকেই জানিতেন; মমতাময়ী নারী-প্রকৃতির অন্তরালে যে তেজস্বিনী ললনা বাস করিত,— তাহাকে চিনিতেন না। আজ তাঁহার এই অযাচিত অনুগ্রহ-দানে সহসা সে প্রচ্ছন্ন মূর্ত্তি সপ্রকাশ হইয়া বলিল,—‘কেন আমি তোমার অনুগ্রহ গ্রহণ করিব? যেখানে আমার মা, আমিও সেখানে?’

 কামরান্ এখন আত্মপক্ষ পুষ্ট ও দৃঢ় করিবার জন্য উদ্যোগী; তাঁহার বিশ্বাস, গুল্‌বদন্ যদি স্বামী খিজর্ খাজাকে পত্র লিখিয়া তাঁহার পক্ষ-অবলম্বনে অনুরোধ করেন, খাঁ তাহা উপেক্ষা করিতে পারিবেন না। কামরান্ তাই ভগিনীকে অনুরোধ করিলেন,—‘অস্করী ও হিন্দাল্ যেমন আমার ভাই, খিজর্ খাজা খাঁও আমার নিকট ঠিক তাই। আমাকে সাহায্য করিবার এই ত সময়।’ কিন্তু বুদ্ধিমতী গুল্‌বদন্‌ তাহাতে উত্তর দিলেন যে, এ যাবৎ তিনি স্বামীকে কখনও কোন পত্র লেখেন নাই; —খাঁও তাঁহার হস্তাক্ষরের সহিত পরিচিত নহেন। এখন তাঁহাকে পত্র লিখিলে তিনি উহা জাল চিঠি ভাবিতে পারেন। গুল্ আরও বলিলেন,—‘খাঁ যখন অন্যত্র অবস্থান করেন, তখন চিঠিপত্র পুত্রকে উদ্দেশ করিয়া লেখেন।’ এইরূপ বুঝাইয়া তিনি কামরান্‌কেই পত্র লিখিতে উপদেশ দিলেন। গুল্‌বদনের বয়স এ সময় ২৫ বৎসর হইবে। চাতুরী-বৃদ্ধ কামরান্ আজ এই বুদ্ধিমতী যুবতীর কাছে কূটনীতিতে পরাজিত হইলেন। গুলের উপদেশ সমীচীন মনে করিয়া তিনি অবিলম্বে খাঁকে সসম্মানে কাবুলে আসিবার জন্য অনুরোধ করিয়া পাঠাইলেন।

 গুল্‌বদন্ চিরদিনই হুমায়ূনের প্রতি আন্তরিক স্নেহশীলা— তাঁহার প্রকৃত হিতৈষিণী। তিনি ইহার বহুপূর্ব্বে বারবার স্বামীকে বলিয়া রাখিয়াছিলেন,—‘তোমার আর-সব ভাইরা কামরানের স্বপক্ষে থাকুক, ক্ষতি নাই; কিন্তু ভগবান্ করুন, কামরানের দলভুক্ত হইবার বাসনা ঘূণাক্ষরেও যেন কখন তোমার মনে স্থান না পায়। সাবধান! সহস্রবার সাবধান! কখনও সম্রাট্ হুমায়ূনের পক্ষ ত্যাগ করিও না।’ খাঁর হৃদয়ে পত্নীর সাবধান-বাণী চিরজাগরুক ছিল। কামরানের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ হইল।

 হুমায়ূন্ সৈন্যসংগ্রহ করিয়া, কামরানের হস্ত হইতে কাবুল পুনরুদ্ধার করিলেন (১৫৪৭, এপ্রিল)। ভীত কামরান্ ভ্রাতার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন যে, ভবিষ্যতে আর কখনও তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিবেন না;—বরং কায়মনোবাক্যে তাঁহার সহায়তাই করিবেন। মহানুভব বাবরের পুত্র সরল-হৃদয় হুমায়ূন্ পুনঃ পুনঃ প্রতারিত হইয়াও অকৃতজ্ঞ ভ্রাতার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসস্থাপন করিতে দ্বিধা বোধ করিলেন না। বিশেষতঃ বারবার এই দুর্ব্বৃত্তের দুর্ব্ব্যবহার ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইয়াও তিনি বিস্মৃত হইতে পারেন নাই—কামরান্ বাবরের পুত্র; আর বিস্মৃত হইতে পারেন নাই তাঁহার স্বর্গর্গত পিতার আদেশ—‘কামরানের সহিত চিরসদ্ব্যবহার করিও।’ ১৫৪৮ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট্—হিন্দাল্ অস্করী ও কামরানের সহিত সৌভ্রাতৃত্ব-বন্ধন দৃঢ় করিবার জন্য তলিকান্ নামক স্থানে এক মিলন উৎসবের আয়োজন করেন। চারিভ্রাতা মিলিত হইলে, তিনি বলিয়াছিলেন,—“লাহোরে গুল্‌বদন্ প্রায়ই বলিত, ‘আমার বড় ইচ্ছা, চারিভ্রাতাকে একবার একসঙ্গে দেখি।’ আজ আমরা প্রাতঃকাল হইতে সকলে একত্র রহিয়াছি; আমার কেবল সেই কথাই বারবার মনে হইতেছে। খোদার ইচ্ছায় আমাদের এই শুভসম্মিলন তাঁহারই মঙ্গলরাজ্যে অধিষ্ঠিত হউক। অন্তর্যামী জানেন, ভ্রাতৃগণের অনিষ্ট-চিন্তা ত দূরের কথা— কোনও মুসলমানের অমঙ্গল-কামনা আমার হৃদয়ে প্রচ্ছন্নভাবেও স্থান পায় না। সর্ব্বকল্যাণাকর খোদা তোমাদিগেরও হৃদয় এমনই পবিত্র ভ্রাতৃভাব ও শুভপ্রেরণায় পূর্ণ করুন,—আমাদের আজিকার বন্ধন অটুট ও অক্ষয় হউক!”

 কিন্তু ব্যর্থ বাসনা! যত্নে, সহৃদয়-ব্যবহারে কালসর্প বরং আপনার ক্রূর স্বভাব বিস্মৃত হয়, কিন্তু বারবার ক্ষমা ও সদয়-ব্যবহার লাভ করিয়াও কুটিলমতি কামরান্ আপনার হিংস্র-প্রকৃতি ত্যাগ করিতে পারিলেন না। তিনি ভ্রাতার হস্ত হইতে রাজদণ্ড কাড়িয়া লইবার অভিপ্রায়ে পুনরায় বদ্ধপরিকর হইলেন;—ইহাই তাঁহার শেষ উদ্যম। অতি গোপনে তাঁহার সৈন্য-সংগ্রহ হইতে লাগিল। কিন্তু সে সংবাদ হুমায়ূনের অবিদিত রহিল না। তিনি অবিলম্বে কৃতঘ্ন ভ্রাতাকে দমন করিবার জন্য হিন্দাল্‌কে সঙ্গে লইয়া যুদ্ধযাত্রা করিলেন। কামরান্ রাত্রিযোগে (২০শে নবেম্বর, ১৫৫১) জিরবর নামক স্থানে অতর্কিতভাবে হুমায়ূনের শিবির আক্রমণ করেন। এই অভাবনীয় বিপদ্‌পাতে হিন্দাল্ আত্মপ্রাণ-বিসর্জ্জনে সম্রাটের প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন। সে আত্মদানের করুণ কাহিনী গুলের ভাষায় আমরা লিপিবদ্ধ করিবঃ—

“সম্রাট্-সৈন্য জিরবরে উপস্থিত হইলে সংবাদ আসিল, কামরান্‌ রাত্রিযোগে হুমায়ূনের শিবির আক্রমণ করিবেন। হিন্দাল্ অবিলম্বে ভ্রাতা হুমায়ূনকে জানাইলেন,—‘সর্ব্বোচ্চ ভূমিতে সম্রাটের শিবির সন্নিবিষ্ট হউক এবং শিশুপুত্র আক্‌বরকে লইয়া সম্রাট্ সুরক্ষিতভাবে তথায় অবস্থিতি করুন।’
“সম্রাট ও ভ্রাতুষ্পুত্র সম্বন্ধে এইরূপ সুব্যবস্থা করিয়া বীরশ্রেষ্ঠ হিন্দাল্ একে একে আপন অনুচরবর্গকে আহ্বান করিয়া বলিলেন,—‘মনে রাখিও, সম্রাটের হিতার্থে তোমাদের আজীবনের অনুষ্ঠান, আজিকার একদিনের আত্মোৎসর্গের সমান। খোদার কৃপায় আজিকার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে ধন, মান, প্রভুত্ব—যাহার যাহা কিছু যাচ্ঞা, আমি অকাতরে আশাতীতরূপে তাহা পূর্ণ করিব।’ অতঃপর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতি অধ্যক্ষের স্থান ও কার্য্য নির্দ্দেশ করিয়া দিয়া হিন্দাল নিজের অস্ত্র ও বর্ম্ম আনিতে বলিলেন। কিন্তু পরিচ্ছদ-রক্ষক হস্ত প্রসারণ করিবামাত্র পশ্চাতে হাঁচি পড়িল;—অমঙ্গল আশঙ্কায় তাহার আর হাত উঠিল না।
“পরে যখন অস্ত্র বর্ম্ম লইয়া রক্ষক হিন্দালের নিকট উপস্থিত হইল, রাজভ্রাতা তাহার অকারণ বিলম্বের কারণ জানিতে চাহিলেন। রক্ষক সকল কথা নিবেদন করিলে, হিন্দাল্ বলিলেন,—‘ছি, ছি, তুমি ভুল করিয়াছ। অমঙ্গল-আশঙ্কায় নিবৃত্ত না হইয়া তোমার বরং বলা উচিত ছিল, খোদার আশীর্ব্বাদে আজিকার আত্মদান যেন সার্থক হয়।’ তিনি উপস্থিত সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,—‘বন্ধুগণ! তোমরা সাক্ষী, আমি এখন হইতে সর্ব্বপ্রকার নিষিদ্ধ ভক্ষ্য ও অন্যায়াচরণ পরিত্যাগ করিলাম।’ সকলে একযোগে আশীর্বচন উচ্চারণ করিলেন। হিন্দাল অস্ত্র বর্ম্ম পরিধান করিয়া পরিখায় পরিখায় উপস্থিত হইয়া সৈনিকগণকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। সেই সময় তাঁহার জনৈক অনুচর সহসা চীৎকার করিয়া উঠিল,—‘দুশমন দুশমন! খুন খুন!’ হিন্দাল্ তৎক্ষণাৎ অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া বলিলেন,—‘অসিমুখে-বিপন্ন নিজ অনুচরকে যে রক্ষা না করে, সে কাপুরুষ!’ কিন্তু তাঁহার সঙ্গিগণের একজনও অশ্ব হইতে অবতরণ করিল না। দুইবার শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ করিয়া হিন্দাল্ ধরাশায়ী হইলেন।
“মীর বাবা দোস্ত হিন্দালের মৃতদেহ বহন করিয়া তাঁহার শিবিরাবাসে লইয়া গেলেন। পাছে বাহিনীমধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়, এই আশঙ্কায় তিনি শিবিরদ্বারে প্রহরী রাখিয়া বলিয়া দিলেন যে, রাজভ্রাতা আহত; সম্রাটের আদেশ,—কাহারও প্রবেশ নিষেধ। মীর তৎপরে সম্রাটের নিকট উপস্থিত হইয়া বিষণ্নমুখে কহিলেন,—‘মীর্জ্জা হিন্দাল্ আহত।’ হুমায়ূন্ তৎক্ষণাৎ অশ্ব আনিতে আদেশ দিয়া বলিলেন,—‘আমি এখনই তাহাকে দেখিতে যাইব।’ মীর দৃঢ়স্বরে বলিল,—‘মীর্জ্জার আঘাত সাঙ্ঘাতিক; সম্রাটের সেখানে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। সম্রাটের আর বুঝিতে বাকি রহিল না। ব্যথিত হুমায়ূন্ বারবার আত্মসংযমের চেষ্টা করিলেও ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া তাঁহার অশ্রুপ্রবাহ ছুটিল। কিন্তু কর্তব্য শোকের মুখ চাহে না; বুক ভাঙ্গিয়া গেলেও সে তাহার কঠোর দায়িত্ব বিস্মৃত হয় না। অশ্রু মুছিয়া হুমায়ূন্ খিজর্ খাঁকে নির্দ্দেশ করিলেন,—‘মীর্জ্জা হিন্দালের মৃতদেহ তোমার জাগীর জূই-শাহীতে লইয়া গিয়া কবরের ব্যবস্থা কর।’
“উষ্ট্রের উপর শবাধার স্থাপিত হইলে, খিজর্ মর্ম্মভেদী বিলাপে দিঙ্মণ্ডল মুখরিত করিয়া, তাহার মুখরজ্জু ধরিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সে হৃদয়বিদারী স্বর সম্রাটের শ্রুতিগোচর হইলে, তিনি বলিয়া পাঠাইলেন, ‘খাঁকে বল—ধৈর্য্য বিনা উপায় নাই। এই নিদারুণ শোকে খাঁর অপেক্ষা আমি অধিকতর মর্ম্মপীড়িত, কিন্তু সম্মুখে শোণিতলোলুপ নিদারুণ শত্রু—কেবল প্রতিশোধতৃষ্ণায় অসীম ধৈর্য্যে হৃদয় বাঁধিয়া রাখিয়াছি।”

 যৌবনের পূর্ণ গরিমায়, বীরত্বের শ্রেষ্ঠ মহিমায়, আত্মদানের অবিনশ্বর গৌরবে, তেত্রিশ বর্ষ বয়সে মীর্জ্জা হিন্দাল্ অক্ষয়লোকে প্রয়াণ করিলেন (২০ নবেম্বর, ১৫৫১)।

 হিন্দালের মহিমময় মৃত্যু-সংবাদ কাবুলে পৌঁছিল। গুল্‌বদন্ বুক-ফাটা শোকে কাতর হইলেন। গুমরিরা গুমরিয়া তাঁহার মর্ম্মরোদন কঠোর পর্ব্বতপ্রদেশ প্রতিধ্বনিত করিল। শৈশবের মধুর দিনগুলি একে একে তাঁহার স্মরণপথে উদিত হইতে লাগিল। শোকভরে তিনি লিখিয়াছেন, ‘না জানি কোন্ নির্দ্দয়-হৃদয় এই নিরপরাধ যুবার অঙ্গে অস্ত্রাঘাত করিয়াছে! হায় খোদা, হিন্দালের পরিবর্ত্তে সাদৎ-ইয়ারকে লইয়া আমায় কেন পুত্রহারা করিলে না; খিজর্‌কে লইয়া আমার হৃদয়ে কেন চিরবৈধব্য বেদনা দিলে না; আর সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠবিধান আমার কেন জীবনান্ত করিলে না!’

আয় দরেঘা, আয় দরেঘা, আয় দরেঘা!
আফ্‌তাবম্ শুদ্ নিহান্ দর্ জের-ই-মেঘ!

 হায় রে, হায় রে, হায় রে দুঃখ! আমার সূর্য্য মেঘের আড়ালে ঢাকিয়া গেল!

 এদিকে দুর্ব্বৃত্ত কামরানের প্রায়শ্চিত্তের দিন সন্নিকট হইয়া আসিল। হিন্দালের অকাল-মৃত্যুর পর নিষ্ঠুর নিয়তি পুনরায় সম্রাটের উপর কৃপাকটাক্ষপাত করিলেন। নৈশযুদ্ধে পরাজিত হইয়া কামরান্ নানাস্থানে পলায়ন করিয়াও আত্মরক্ষা করিতে পারিলেন না;—বন্দীরূপে সম্রাটের নিকট আনীত হইলেন। হিন্দালের মৃত্যু ও আপনার প্রতি সহস্র দুর্ব্ব্যবহারের কথা স্মরণ করিয়াও ক্ষমাশীল সম্রাট্ কামরানের প্রতি গুরুতর দণ্ডবিধান করিতে পারিলেন না—কেবল যাবজ্জীবন বন্দী করিয়া রাখিবার আজ্ঞা দিলেন।

 কিন্তু সম্রাটের সদয়-বিধানে সভাস্থলে অসন্তোষের গুরুগুঞ্জনধ্বনি উঠিল। সমবেত আমীর-উমারা, সম্ভ্রান্ত ও মধ্যবিত্তজন, সভাসদ্, সৈনিক, উচ্চনীচ সকলে একবাক্যে বলিল,—‘রাজকর্ত্তব্য, সাম্রাজ্য-শাসন ভ্রাতৃবাৎসল্যের মুখাপেক্ষী নহে। এক্ষেত্রে ভ্রাতার প্রতি যদি মমতা করিতে হয়, সম্রাটের সিংহাসন পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। আর যদি রাজপদ বাঞ্ছিত হয়, ভ্রাতৃস্নেহ বিসর্জ্জন দেওয়াই বিহিত। কিব্‌চকের সঙ্কীর্ণ গিরি-সঙ্কটে এই দুর্ব্বৃত্ত কামরান্ সম্রাটের পবিত্র মস্তকে কিরূপ সাঙ্ঘাতিক আঘাত করিয়াছিল, তাহা কি স্মরণ নাই? আফ্‌গানদের সঙ্গে ষড়্‌যন্ত্র করিয়া এই প্রতারক শঠ, মীর্জ্জা হিন্দালের প্রাণ-সংহার করিয়াছে। অসংখ্য চঘ্‌তাই ইহারই জন্য মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। কত নিরপরাধ রমণী বন্দী হইয়া ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়াছে! আমাদের সন্তানসন্ততি-রমণীগণের উপর ভবিষ্যতে সে নিষ্ঠুর-নাট্যের পুনরভিনয় আমরা কিছুতেই ঘটিতে দিব না। পরলোকে জহান্নম্ প্রত্যক্ষ করিয়া সকলে শপথ করিতেছি—আমাদের জীবন, স্ত্রীপুত্র, সর্ব্বস্ব সম্রাটের একগাছি কেশরক্ষার্থ অকাতরে বলি দিব। কিন্তু মুক্তকণ্ঠে বলিব, কামরান্ সম্রাটের ভাই নয়,—দুশমন!’

 আর অধিক বাক্যব্যয় না করিয়া সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল,—‘যে দুর্ব্বৃত্ত ভ্রাতা রাজ্যধ্বংসকারী, তাহার শিরশ্ছেদই শ্রেয়।’ কিন্তু নৃপতির নিরতিশয় ভ্রাতৃবৎসল হৃদয়, এই সঙ্গতবিধানের অনুমোদন করিল না। অবশেষে দুর্ব্বলচিত্ত বাদশাহ্ অশান্ত ক্রোধের সে উচ্ছ্বসিত গর্জ্জন অবহেলা করিতে না পারিয়া, কামরান্‌কে অন্ধ করিয়া দিবার আদেশ দিলেন।

 ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের করাল-বহ্নি নির্ব্বাপিত হইলে, হুমায়ূনের তৃষিত চক্ষু কাবুলের গিরি-নির্ঝর-নন্দিত, তুষার-বলয়িত প্রদেশ হইতে পুনরায় দিল্লী ও আগ্রা অভিমুখে ধাবিত হইল। ১৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই নবেম্বর তিনি দ্বিতীয়বার হিন্দুস্থান-বিজয়ে অগ্রসর হইলেন, এবং পর বৎসর ২৩শে জুলাই দিল্লীতে আপনাকে সম্রাট্ বলিয়া ঘোষণা করিলেন। কিন্তু চিরবাঞ্ছিত রাজদণ্ড করগত হইবার কিছুদিন পরেই লোকান্তর হইতে সহসা তাঁহার আহ্বান আসিল। ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে, জানুয়ারীর শেষভাগে, একদিন অপরাহ্নে সম্রাট্, শের শাহ্-প্রতিষ্ঠিত শেরমণ্ডল ভবনে পাঠাগার-পরিদর্শন ও শুক্র গ্রহের উদয়কাল নির্ণয় করিতে গমন করেন। সোপান-অবতরণকালে সহসা পদস্খলিত হইয়া তাঁহার যে চৈতন্য বিলুপ্ত হয়, তাহা আর ফিরিয়া আসে নাই। দুর্ঘটনার তিনদিন পরে আটচল্লিশ বৎসর বয়সে চিরহতভাগ্য সম্রাট দুঃখ-শোক-তাপের অতীত দেশে চলিয়া গেলেন;—চিরবৈরী শের মৃত্যুতেও যেন শত্রুতা সাধন করিল।


 শের শাহ্‌ কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হইয়া হুমায়ূন যখন পবনচালিত ছিন্ন-পত্রের ন্যায় ইতস্ততঃ বিতাড়িত হইতেছিলেন, রাজ-অন্তঃপুরিকাগণ তখন ছিন্নহার কুসুমের ন্যায় বিক্ষিপ্ত। দ্বিতীয়বার সিংহাসন লাভ করিয়া, সম্রাট্‌ তাহাদিগকে কাবুল হইতে ভারতে আনিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন; কিন্তু নিষ্ঠুর শমন তাঁহাকে সে সাধ পূর্ণ করিতে অবসর দেয় নাই। পিতার মৃত্যুর পর বালক আক্‌বর ‘সম্রাট্‌’-পদে অভিষিক্ত হইয়া, প্রায় বৎসরাবধি শত্রুদমনে ব্যাপৃত ছিলেন। এইবার সিংহাসনে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইয়া, পুরমহিলাদের আনাইবার জন্য কয়েকজন বিশ্বস্ত আমীরকে কাবুলে পাঠাইলেন।

 ১৫৫৭ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ভাগে, সম্রাট্‌-জননী হামীদা বানু, গুলবদন্‌, সলীমা, হাজী ও গুলচিহ্‌রা বেগম, অন্যান্য কর্ম্মচারিগণের মহিলাবর্গসহ পশ্চিম সিওয়ালিকস্থ মানকোটের রাজশিবিরের নিকট আসিয়া পৌঁছিলেন। আক্‌বর প্রিয়সম্মিলনোল্লাসে উৎফুল্লচিত্তে অগ্রসর হইলেন। শত্রুর কঠোর হুঙ্কার, কামানের কুলীশ ঝঙ্কার, অস্ত্রের বিকট ঝণৎকার এক বৎসর নিরন্তর যাঁহার কর্ণকুহর প্রপীড়িত করিয়াছে, প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর যে তাঁহার পক্ষে কি আনন্দপ্রদ, তাহা ভুক্তভোগী ভিন্ন অপরের উপলব্ধি করা অসম্ভব। বিশেষতঃ সম্রাট্ এখনও বালক, স্বার্থপর সংসারের ছায়াপাতে হৃদয় এখনও কঠিন হয় নাই। স্বজনগণকে লইয়া সম্রাট্ মানকোটের শিবিরে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি প্রথমে মানকোট হইতে লাহোর, তৎপরে লাহোর হইতে ১৫৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর সপরিবারে দিল্লী যাত্রা করিলেন। এ কয়েক মাস সম্ভবতঃ রাজপরিবারবর্গ সম্রাট্-শিবিরের সন্নিকটে শিবিরাবাসে কালযাপন করিয়াছিলেন।

 ১৫৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে পুনরাগমন হইতে ১৫৭৪ খ্রীষ্টাব্দে তীর্থগমন পর্য্যন্ত দীর্ঘ সতর বৎসর কাল, আমাদের এই ক্ষুদ্র আখ্যায়িকার নায়িকা, নিজ জীবনেতিহাসের উপর দুর্ভেদ্য পটক্ষেপণ করিয়াছেন। ‘হুমায়ূন্-নামা’ পাঠে অতি অনবহিত পাঠকেরও উপলব্ধ হয় যে, এই আত্মগরিমাশূন্যা রমণী নিজ জীবন-কাহিনী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন,—একেবারে নির্ব্বাক্ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এমন কি প্রসঙ্গতঃ সাদৎ-ইয়ার ব্যতীত তিনি তাঁহার অপর পুত্রকন্যাগণেরও উল্লেখ করেন নাই। লোকলোচনান্তরালস্থিত মোগলের অন্তঃপুর হইতে নিবিড় অবগুণ্ঠনবতী এই রমণীর রমণীয় আখ্যান শুনিয়া তাঁহার অন্তরের সহিত ঘনিষ্ঠতর পরিচয়ের জন্য আগ্রহ হয়; কিন্তু সে প্রয়াস পুনঃ পুনঃ নিস্ফল হইয়া ফিরিয়া আসে। কল্পনা-নেত্রে আমরা দেখিতে পাই যে নিত্যকর্ম্মের বিরামে তাহার অবসরকাল এখন কবিতা-রচনায়, বিবিধ পুস্তক-পাঠে, সাম্রাজ্যের সংবাদ-আলোচনায়, কদাচিৎ বা উৎসবানন্দে অতিবাহিত হইতেছে। তাঁহার প্রচ্ছন্ন জীবনের যে চিত্রটি আমাদের মানসপটে সর্ব্বাপেক্ষা উজ্জ্বলবর্ণে ফুটিয়া উঠে, তাহা পতিসেবাপরায়ণা সহধর্ম্মিণীর এবং অপত্যস্নেহময়ী জননীর। কিন্তু এই বিদুষী প্রতিভাশালিনী রমণীকে কেবলমাত্র কল্যাণময়ী গৃহদেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া আমাদের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হয় না। আশৈশব যাঁহার অন্তশ্চক্ষু এই অপূর্ধ্ব দেশের অপূর্ব্ব আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, শোভাসৌন্দর্য্য, শিল্পচাতুর্য্য পর্যবেক্ষণ করিয়া আসিয়াছে,সে সম্বন্ধে তাঁহার চিন্তাধারা কি ভাবে প্রবাহিত হইয়াছিল,তাহা জানিবার জন্য মন স্বতঃই উৎসুক হয়। কিন্তু যতদূর আবিষ্কৃত হইয়াছে, হুমায়ূন্-নামাতে তাহার ইঙ্গিতমাত্র পাওয়া যায় না। অন্তঃপুরবাসিনী হইলেও তিনি যে নিরন্তর অবরোধে আবদ্ধ থাকিতেন, তাহা নহে; সম্রাট্-শিবির-সান্নিধ্যে তাঁহার শিবির অতি সম্মানের স্থান অধিকার করিত বলিয়া ইতিহাসে যে উল্লেখ আছে, তাহাতেই অনুমিত হয়, বাহিরের আলোক তাঁহার পক্ষে দুর্ল্লভ ছিল না। সে আলোকে ভারত-মহিলাগণের যে চিত্র এই মনস্বিনীর মানস-নেত্রে উদ্ভাসিত হইত, কে বলিবে তাহা ছায়াপাতমাত্র করিয়াই মিলাইয়া গিয়াছে? ভারতের সতীধর্ম্ম, জৌহর-ব্রতের অনুষ্ঠান কি এই পতিপরারণা রমণীর হৃদয়ে গভীরতর রেখা অঙ্কিত করে নাই?

 গুল্ যে ফুল অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন, নারীর সতীত্ব তাহার গৌরব,—দাম্পত্য-বন্ধনে রমণীর অক্ষুণ্ন বিশ্বস্ততা তাহার গর্ব্ব। বাবরের মাতামহী বন্দিনী হইলে তিনি বিজেতার জনৈক অনুচরের হস্তে 'সমর্পিতা হন। কিন্তু তেজস্বিনী আইস্-দৌলৎ তৎক্ষণাৎ সেই অনুচরকে হত্যা করিবার জন্য তাঁহার পরিচারিকাকে আদেশ দেন। এরূপ করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে আইস্ সগর্ব্বে বলিয়াছিলেন,—‘আমি ইউনুস্ খাঁর ধর্ম্মপত্নী!’ এই সংবাদ মোগল মহিলাগণের নিশ্চয়ই অবিদিত ছিল না। গুল্ও পারিবারিক-ইতিহাসে দেখিয়াছেন, তাঁহার স্বজাতীয়া বহু বন্দিনী শত্রুর সহিত পরিণীতা হইয়াছে এবং তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ শক্রর দেশে পতিসহ সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছে।

 কিন্তু হিন্দু-মহিলাগণের দাম্পত্যজীবন ও সতীধর্ম্ম তৈমুর-বংশোদ্ভব মহিলাগণের আদর্শ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রাজপুতরমণী বন্দিনী হইবার আশঙ্কায় উল্লাসে জীবন দান করে; রাজপুতগণ অসম-শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হইলে স্বহস্তে স্ত্রীপুত্রকন্যাগণকে হত্যা করিয়া, মৃত্যুযজ্ঞে জীবনাহুতি দেয়। শৈশবে পিতৃমুখে গুল্ বহুবার এই বিস্ময়কর কাহিনী শুনিয়াছেন; কিন্তু তখন তিনি বালিকা। এখন পতিপুত্রবতী নারী—সমাজের কঠিন সমস্যাগুলি উদারভাবে গ্রহণ করিতে শিখিয়াছেন। তারপর আক্‌বরের রাজ্যাঙ্কের প্রথমভাগে বহুবার সেই নিদারুণ মর্ম্মস্পর্শী দৃশ্যের অভিনয় হইয়াছে। মৃত্যুভয় এবং কঠোরতম যন্ত্রণা উপেক্ষ করিয়া হিন্দু-বিধবার স্বেচ্ছায় অগ্নিতে আত্মসমর্পণে, সতীধর্ম্মে গৌরবের আত্মবিসর্জ্জনে, কে জানে মুসলমান-রমণীর হৃদয় শ্রদ্ধায় পুষ্পিত হইয়া উঠিত কি না? ভ্রাতুষ্পুত্র আক্‌বরের হারেমে রাজপুত-ললনার সমাগমে গুল্‌বদন্ হিন্দু-রমণীগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রকৃতি-প্রবৃত্তি প্রভৃতির ঘনিষ্টতর পরিচয় পাইবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। কিন্তু ভাষার অনভিজ্ঞতা সে পক্ষে বিষম অন্তরায় হইয়াছিল। গুল্ যদি সে ভাষা বুঝিতেন, রাজপুত সতীত্ব ও বীরত্বের জ্বলন্ত কাহিনী শুনিয়া তিনি যে অধিকতর মোহিত হইতেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু একে দুর্বোধ ভাষা, তাহার উপর এই সকল হিন্দু রমণী সম্রাটের অন্তঃপুরে মুসলমান-রমণীগণ কর্তৃক কখন সমাদরে গৃহীত হন নাই। তথাপি দাম্পত্য-জীবনে এই হিন্দু-বেগমগণের নির্দ্দোষ আচরণ-দর্শনে গুল্‌বদন্ বুঝিয়াছিলেন যে, জীবনের কর্ত্তব্যপালনে দীক্ষাদান কোন ধর্ম্মেরই নিজস্ব নহে।

 কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানগণের মধ্যে ভাষা ধর্ম্ম, প্রকৃতি-প্রবৃত্তি সম্পূর্ণ বিভিন্ন হইলেও তীর্থের পবিত্রতা ও তীর্থদর্শনের ইতিকর্ত্তব্যতা সম্বন্ধে উভয় জাতি সমভাবে অনুপ্রাণিত হইত। অতঃপর যখন গুল্‌বদন্ পুনরায় আমাদের দর্শনপথে পতিত হ’ন, তখন তিনি প্রৌঢ়া রমণী, বয়স প্রায় ৫১ বৎসর,—সম্ভবতঃ বিধবা এবং মুসলমান-ধর্ম্মের অবশ্যপালনীয় পবিত্র ‘হজ্’-ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে পুণ্যতীর্থ মক্কাগমনার্থ একান্ত ব্যাকুলা। কিন্তু সম্রাট্ আক্‌বর তাঁহাকে বিদায় দিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক;—কেবল এখন-তখন করিয়া অকারণ কালহরণ করিতেছেন। সম্রাট্ স্বয়ং এই সময় হজ্-ব্রত পালনের জন্য একান্ত উৎসুক হইয়াছিলেন, এবং সম্ভবতঃ গুল্‌কে স্বয়ং সঙ্গে লইয়া যাইবার বাসনায় ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। কিন্তু আপাততঃ হিন্দুস্থান পরিত্যাগ করা তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর হইল না; তীর্থযাত্রীর বেশে একদল মক্কাযাত্রীর সহিত আগ্রা হইতে কিছুদূর গমন করা ভিন্ন তাঁহার ঐকান্তিক কামনাকে তৃপ্তিদান করিতে পারেন নাই। নিজে সফলকাম না হইলেও ইস্‌লাম ধর্ম্মের এই পবিত্র কর্তব্যপালনে-সমুৎসুক ব্যক্তিগণকে সম্রাট্ মুক্তহস্তে অর্থসাহায্য করিতেন, এবং প্রতি বৎসর জনৈক যোগ্য ব্যক্তিকে অধিনায়ক নির্ব্বাচিত করিয়া যাত্রীদের পাথেয় প্রভৃতির ব্যয় নির্ব্বাহার্থ তাহার হস্তে উপযুক্ত অর্থ ও দ্রব্যসম্ভার দিতেন। সম্রাট্ আক্‌বর বৎসর বৎসর তীর্থগমনাকাঙ্ক্ষা এইরূপে তৃপ্ত করিতে লাগিলেন; কিন্তু গুল্‌কে তীর্থগমনে বিরত রাখা তাঁহার পক্ষে ক্রমেই দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। অবশেষে সম্মতি প্রদান করিয়া তিনি পিতৃস্বসার তীর্থযাত্রার সর্ব্বপ্রকার সুব্যবস্থা করিয়া দিলেন।

 তীর্থযাত্রিগণের মধ্যে গুল্‌বদনের আত্মীয়ার সংখ্যাই অধিক। আবুল্-ফজল্, গুলের সহযাত্রীদলের মধ্যে কেবল প্রধানা মহিলাগণেরই নামোল্লেখ করিয়াছেন। যাত্রীদলের সমগ্র ব্যয়ভার রাজকোষ হইতে বহন করা হইয়াছিল। গুলের প্রধানা সঙ্গিনী ছিলেন—আক্‌বর-পত্নী সলীমা সুলতান্ বেগম। মুসলমান-বিধি অনুসারে সধবা স্ত্রীলোকের তীর্থগমন নিষিদ্ধ নহে,—ভার্য্যার প্রবল আগ্রহ থাকিলে তাঁহাকে তীর্থগমনে অনুমতিদান অপরিহার্য্য। সম্ভবতঃ ঐরূপ নির্ব্বন্ধাতিশয্যেই সলীমার তীর্থযাত্রা ঘটিয়াছিল। ইঁহাদের সঙ্গে ছিলেন, আক্‌বরের খুল্লতাত অঙ্করীর বিধবা-পত্নী সুলতানাম্; কামরানের দুই কন্যা—হাজী ও গুল্-ইজার বেগম; এবং গুল্‌বদনের পৌত্রী উম্‌-ই-কুলসুম্;—ইনি সাদৎ-ইয়ারের কন্যা কি না উল্লিখিত নাই। তালিকার শেষ নাম খিজর্ খাজাদুহিতা সলীমা খানম্—গুল্‌বদনের গর্ভজাত কন্যা কি না তাহাও অজ্ঞাত।

 ফতেপুর-সীক্‌রীতে যাত্রীদলের এক সঙ্গে মিলিত হইবার স্থান নির্দ্দিষ্ট ছিল, এবং ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই অক্টোবর যাত্রার দিন স্থিরীকৃত হয়। আগ্রা হইতে যাত্রা করিয়া গুল্‌বদনের সহযাত্রীরা একসঙ্গে সম্মিলিত হইলেন। সাধারণতঃ (মুসলমান) বৎসরের দশম মাসেই তীর্থগমনোদ্দেশে যাত্রীদল আগ্রা ত্যাগ করিত; কিন্তু গুল্‌বদন্ প্রভৃতি সপ্তম মাসেই যাত্রা করিয়াছিলেন। ইহার কারণ বোধ হয়, মহিলাগণের পক্ষে ক্লেশসহিষ্ণু সাধারণ যাত্রীদের ন্যায় দ্রুতগমন সম্ভবপর নহে। আত্মীয়াগণকে পথে কিয়দ্দূর সঙ্গদান করিবার নিমিত্ত সম্রাটের দুই পুত্র-সলীম্‌ ও মুরাদ যাত্রীদলের সহচর হইলেন। কুমারদ্বয়ের বয়ঃক্রম তখন যথাক্রমে পাঁচ ও চারি বৎসর! প্রথম বিশ্রামস্থান অবধি অগ্রসর করিয়া দিয়া যুবরাজ সলীম্ বিদায় লইয়া আগ্রায় ফিরিলেন। কথা ছিল, মুরাদ্ সুরাট বন্দর পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিবেন। গুলবদন্ শিশু মুরাদকে যে ক্লেশকর ও শ্রমসাধ্য কার্য্য হইতে নিরস্ত করিলেন। যাত্রীদলের প্রকৃত রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পিত হইয়াছিল—মুহম্মদ্ বাকী খাঁ কুকা, রূমী খাঁ-প্রমুখ আমীরবর্গের উপর।

 গুলের বর্ণনাকুশল লিপিচাতুর্য্যময়ী লেখনী এই অজানিত বিঘ্নবিপদ্‌সঙ্কুল সমুদ্রপথ, অপূর্ব্ব দৃশ্যদর্শন বা পুণ্যব্রতানুষ্ঠানের কোন বিবরণ লিপিবদ্ধ করে নাই। সুরাট হইতে সমুদ্রযাত্রা নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল সত্য, কিন্তু এই বন্দর সবে বৎসর দুইমাত্র সাম্রাজ্যভুক্ত হইয়াছে; তখনও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। পথ বিপদাকীর্ণ, গ্রামবাসী রাজপুতগণ নবীন বন্ধন ছেদন করিবার জন্য সশস্ত্র ফিরিতেছে। সম্ভবতঃ রাজআত্মীয়াগণকে বাদশাহী ফৌজের সাহায্যে এক সেনা-নিবাস হইতে অপর সেনা-নিবাস পর্য্যন্ত নিরাপদ পথ-অবলম্বনে গমন করিতে হয়। মোগল-সৈন্য তখন রাজপুতকুলতিলক রাণা প্রতাপের বিরুদ্ধে নিযুক্ত; অনুমান হয়, যাত্রীদল এই বাহিনী-সহায়ে, অবসাদক্লিষ্ট বক্রপথে গোগুণ্ডা হইতে আহ্‌মদাবাদ, এবং তথা হইতে জলপথে সুরাট গমন করেন।

 সমুদ্রপথ সে সময় নিরাপদ থাকিলেও যাত্রিগণকে এক বৎসর বন্দরে অপেক্ষা করিতে হইয়াছিল। আক্‌বর-নামায় প্রকাশ, সমুদ্রযাত্রার জন্য রাজ-অর্ণবপোত ‘ইলাহী’ নির্দ্দিষ্ট ছিল। ইহা ছাড়। ‘সলীমী’ নামক তুর্কী জাহাজও ভাড়া করা হয়। রাজমহিলাগণ ‘সলীমীতে’ আরোহণ করিলে, ‘ইলাহী’-আরোহিণীগণের মধ্যে অকারণ পর্ত্তুগীজ-জলদস্যু-ভীতি সঞ্চারিত হইয়াছিল। কিন্তু ইহাই বিলম্বের প্রকৃত কারণ বলিয়া মনে হয় না। ভারতসাগরে পর্ত্তুগীজগণের তখন প্রবল প্রতাপ; যথারীতি শুল্ক দিতে না পারিলে জলযাত্রার অনুমতি-পত্র মিলিত না। মিলিলেও তাহাতে ত্রাসের অবসান হইত না,—গুল্মাচ্ছাদিত কুপের ন্যায় অনেক সময় ছাড়পত্রে সাঙ্কেতিক ভাষায় হত্যার ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন থাকিত। যাহা হউক, এই অনুমতি-পত্রের অভাবই যে বিলম্বের কারণ তাহাতে সন্দেহ নাই।[১]

 মীর হজ্, সমস্ত বিঘ্নবিপত্তির কথা সম্রাট্‌কে জানাইলেন। অবিলম্বে সুরাটে উপস্থিত হইয়া যাত্রীদলের সমস্ত অসুবিধা দূর করিয়া যাত্রার সুবন্দোবস্ত করিবার জন্য সম্রাট্ ঈদরের ফৌজদার কিলিচ্ খাঁকে আদেশ দিলেন। কিলিচ্ কাম্বের জনৈক বণিক কল্যাণ রায়কে সঙ্গে লইয়া সুরাটে পৌঁছিলেন। এই বণিকের সাহায্যেই তিনি যাত্রীদলের ছাড়পত্র সংগ্রহ করিয়া দিয়া, যাত্রার সমস্ত বাধাবিপত্তি দূর করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। (Akbarnama, iii. 276 n.)

 স্থলপথে এই সকল বাধাবিপত্তির ফলে সমুদ্রযাত্রা করিতে গুল্‌বদনের এক বৎসর বিলম্ব হইয়া গেল। অবশেষে ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর তারিখে পয়গম্বরের পবিত্র নাম উচ্চারণ করিয়া যাত্রীরা জলপথে যাত্রা করিলেন। সুরাট হইতে একসঙ্গে যাত্রা করিলেও মধ্যপথে উভয় পোত বিচ্ছিন্ন হইয়া একখানি আরব-উপসাগর, অন্যখানি পারস্য উপসাগরের পথে গমন করে। অভীষ্ট তীর্থে কোন্‌খানি কোন্ বন্দরে উপস্থিত হইয়াছিল, ইতিহাসে তাহার উল্লেখ নাই।

 যাহা হউক, গুল্‌বদন্ সহযাত্রীদের সহিত নিরাপদে আরবে উপনীত হইয়া সেখানে সাড়ে তিন বৎসর অবস্থিতি করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি চারিবার [কর্‌বলা, কুম্, মশহদ্ ও মক্কা] হজ্-ব্রত পালন করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন।

 কিন্তু এই বহু আয়াসসাধ্য ক্লেশকর বিঘ্নবিপদ্‌সঙ্কুল তীর্থ-পর্য্যটনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও নিগূঢ় রহস্য কি, তাহা ভালরূপ হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিলে চিরতৃষাতুর জ্ঞানস্পৃহা পরিতৃপ্ত হয় না। যীশুর পবিত্রভূমি পালেষ্টাইন্, মুহম্মদের মক্কা, বুদ্ধের গয়া, হিন্দুর বারানসী-বৃন্দাবন কেবল কি বিভিন্ন দেশবাসীর সম্মিলনভূমি—লৌকিক আচার-ব্যবহার আদান-প্রদানের সাধারণ ক্ষেত্র, অথবা এই তীর্থযাত্রার কোন মহত্তর অভিপ্রায় আছে? কেন এই সর্ব্বদেশ সাধারণ বায়ু-বহ্নি-ব্যোম-অধিষ্ঠিত স্থানদর্শনের জন্য এত আকাঙ্ক্ষা, এত আগ্রহ, এত ক্লেশকর উদাম? গৃহমুখ, জীবনের চিরাভ্যস্ত পথ পরিত্যাগ করিয়া, কেন অজানিত বিঘ্নবিপদ্‌মুখে উল্লাসে আত্মসমর্পণ? আবার কেনই বা তাহার আচার-অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকলাপ সযত্নে পালন? মক্কার তিন ক্রোশ ব্যবধানে তীর্থ-পরিচ্ছদ্ (ইহরাম্) পরিধান; গমনপথে তীর্থ-মাহাত্ম্য-গান; সঙ্কল্পসিদ্ধি এবং ত্রুটিহীন দর্শনের জন্য সকাতর প্রার্থনা; সেই পবিত্র নিকষকৃষ্ণ প্রস্তরের স্পর্শ এবং অভিবাদন; সপ্তবার পুণ্যময়ী কাবা-পরিক্রমা; পবিত্র ‘সফা’ শৈলে আরোহণ এবং তদুপরি আন্তরিক প্রার্থনা-সহকারে পরিত্রাতা খোদার পদে আত্মনিবেদন; সফা হইতে মার্‌ওয়া শৈলে সপ্তবার দ্রুতগমনাগমন; প্রধান মস্‌জিদে সমবেত উপাসনা ও তথায় বিশ্বাসী-সম্প্রদায়ের প্রতি ধর্ম্মোপদেশ-শ্রবণ; অষ্টম দিবসে তীর্থে তীর্থে প্রার্থনা; দশাহে মীনাস্তম্ভনিচয়ের উপর লোষ্ট্রনিক্ষেপপূর্ব্বক সয়তান-নির্যাতন এবং এই দিবসেই পুণ্যময় হজ্‌ক্রিয়া বা পশু-বলিদান। (Ency. of Islam, ‘Hadjdj’, pp. 196-201). পর পর এই সকল অনুষ্ঠানের নিগূঢ় রহস্য কি, কে বলিবে? মনস্বিনী গুল্ এই সকল শাস্ত্রাদেশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। কেবল তাহাই নহে, দীর্ঘকাল তীর্থবাসে তিনি যে মদিনা-দর্শন এবং আরবের স্থানে স্থানে সাধু মহাত্মগণের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য দান করিতে গিয়াছিলেন, তাহা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু কি অপূর্ব্ব প্রেরণায় এই আয়াসসাধ্য আনুষ্ঠানিক আচার-সমূহ তিনি পালন করিয়াছিলেন, কি অলৌকিক উন্মাদনায় সন্তানসন্ততি প্রিয়পরিজনবর্গের মমতা, অধ্যয়নশীল নিশ্চিন্ত জীবন পরিহার করিয়া স্বেচ্ছায় সাগ্রহে তীর্থযাত্রার দুঃসহ ক্লেশভার বহন করিয়াছিলেন; পবিত্র তীর্থভূমি প্রথম চুম্বন করিয়া চিরঈপ্সিত দূর মন্দিরশীর্ষ-দর্শনে এই প্রগাঢ় ভক্তিমতি মহিলার অন্তরে কি ভাবের উদয় হইয়াছিল; কি ভাবে বিভোর হইয়া সাম্রাজ্যের সুখৈশ্বর্য্য ভুলিয়া সার্দ্ধ তিন বৎসর কাল আমাদের বিদুষী বাদ্‌শাহজাদী আরবের মরুময় প্রদেশে প্রবাসযাপন করিয়াছিলেন—সে অপূর্ব্ব হৃদয়-রহস্য আত্মগোপনপ্রিয়া গুলের সহিত চিরান্তরিত হইয়াছে;—কৌতূহলের শত চেষ্টাতেও সে প্রহেলিকা-দ্বার উদ্ঘাটিত হইবে না।

 ১৫৭৯ খ্রীষ্টাব্দে সঙ্গিনীদের লইয়া গুল্‌বদন্ ভারতাভিমুখে যাত্রা করিলে, পুনর্যাত্রার মীর হজ্ (অধিনায়ক) হইয়াছিলেন—খাজা ইয়াহিয়া। এই অনিশ্চিত বিপদ্‌সঙ্কুল পুনর্যাত্রার বিবরণ ঘটনাবৈচিত্র্যে বিস্ময়কর। প্রথমতঃ এডেনের অনতিদূরে পোতমগ্ন হইয়া যাত্রীদলকে কিছুদিন সেই জনবিরল স্থানে অবস্থিতি করিতে হয়। তখনকার এডেনে এখনকার মত তৃষ্ণার্ত্তের তৃপ্তিকর বরফ, অনাবৃষ্টির অভাব, এবং ব্রিটিশরাজের প্রতিষ্ঠা ছিল না। দ্বিতীয়তঃ, সেথানকার শাসনকর্তা যাত্রীদলের সহিত সদ্ব্যবহার করেন নাই,— যদিচ এই বিসদৃশ আচরণের জন্য তিনি প্রভৃ—তুর্কী অধিপতি তৃতীয় মুরাদের নিকট দণ্ডিত হইয়াছিলেন। কেবল একটিমাত্র সুখকর ঘটনায় এই উত্তপ্ত পর্ব্বত-পরিবেষ্টিত স্থলে সুদীর্ঘ প্রবাসপীড়িত যাত্রীদলের নিরাশ-তমসাচ্ছন্ন হৃদয়ে আশার আলোক সঞ্চারিত হইয়াছিল। ১৫৮০ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে দেখা গেল, দক্ষিণ দিক্ হইতে অনুকূল পবনে একথানি জাহাজ আসিতেছে। জাহাজ কাহার, জানিবার জন্য গুল্-ইজার ও খাজা ইয়াহিয়ার সহিত যুক্তি করিয়া গুল্‌বদন্, একখানি নৌকা পাঠাইয়া দিলেন। সৌভাগ্যক্রমে ঐ জাহাজের আরোহী ছিলেন সম্রাটের জনৈক কর্ম্মচারী বায়াজীদ্ বীয়াৎ ও তাঁহার স্ত্রীপুত্র। অনুকূল পবনের দুর্ল্লভ সুযোগ উপেক্ষা করিয়া বায়াজীদ্ স্বীয় পোতের গতিরোধ করাইয়া, সংবাদ আদান প্রদানপূর্ব্বক রাজপরিবারের অবস্থা-সঙ্কট বুঝিলেন; সম্ভবতঃ তাঁহারই চেষ্টায় বেগমগণের ভারত-প্রত্যাগমনের জন্য জাহাজের সুব্যবস্থা হইয়াছিল। (J. A. S. B., 1898, p. 315.)

 ঠিক কোন্ সময়ে রাজপরিবার এডেন ত্যাগ করেন, অথবা কখন তাঁহারা সুরাটে আসিয়া উপনীত হন, তাহা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। (A. Nama, iii. 570n). আবুল ফজলের মতে সাত মাস, বদায়ূনীর মতে এক বৎসর, গুল্‌বদন্‌কে এডেনে অবস্থান করিতে হইয়াছিল। তবে এ কথা ঠিক যে, ১৫৮০ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে বায়াজীদের জাহাজ যখন এডেনের নিকটবর্ত্তী হয়, তখন যাত্রীদল সেখানে অপেক্ষা করিতেছিলেন। যাত্রীদল এডেন হইতে যাত্রা করিয়া সুরাট বন্দরে অবতরণ করিলে, সেখানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সম্রাট্‌ও তখন সুদূর কাবুলে (জবুলিস্থানে)। সুতরাং রাজপরিবারবর্গ দীর্ঘকালের জন্য সুরাটে অবস্থান করিতে বাধ্য হইলেন। অবশেষে ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ্চ মাসে সকলে ফতেপুর-সীক্‌রীতে উপনীত হন।

 রাজধানী ফিরিবার মুখে গুল্‌বদন্ ও অন্যান্য মহিলারা আজ্‌মীরে চিশতী ফকীরদিগের পুণ্যপীঠ-দর্শনে গমন করেন। তথায় কুমার সলীমের (জাহাঙ্গীর) সহিত তাঁহাদের সাক্ষাৎ হয়। তখন প্রায় প্রত্যহ এক একজন আমীর সম্রাটের অভিবাদন ও সাদর সম্ভাষণ বহন করিয়া গুল্‌বদনের নিকট আসিতে লাগিলেন। অবশেষে ভরতপুর-রাজ্যের খানুয়া নামক স্থানে বেগমদিগের সহিত সম্রাটের সম্মিলন হয় (১৫৮২ এপ্রিল)।

 ফতেপুর-সীক্‌রীতে এক বিসদৃশ ব্যাপার গুল্‌বদনের স্বভাবতঃ স্থির চিত্তকে বিচলিত করিল। গুল্ দেখিলেন, ধর্ম্মযাজক একোয়া-ভাইভা কুমার মুরাদকে খ্রীষ্টধর্ম্মের নীতি শিক্ষা দিতেছেন। আক্‌বর যে খ্রীষ্টধর্ম্মের পবিত্র নিদর্শন-সমূহের উপর প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবান্ এবং এই ধর্ম্মপ্রাণ বিদ্বান্ মিশনরীকে বিশেষ প্রীতির চক্ষে দেখেন, সে কথাও গুল্ শুনিতে পাইলেন। একোয়াভাইভা বলেন, খ্রীষ্টধর্ম্মের প্রতি সম্রাটের এই প্রীতিদৃষ্টিতে হামীদা বানু ও হারেমের অন্যান্য বেগমেরা সাতিশয় অপ্রসন্ন হইয়া উঠিলেন, এবং ইঁহাদের অসন্তোষধ্বনি যে, গুল্‌বদন্ ও সম্রাটের হিন্দুপত্নীগণের কণ্ঠনিসৃত বিলাপে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সমগ্র হারেমের প্রতিকূলতায় সম্রাট্ একোয়াভাইভাকে আর আশ্রয় দিতে পারিলেন না।

 তীর্থ হইতে ফিরিয়া গুল্‌বদন্ আগ্রার রাজভবনে ‘হুমায়ূন-নামা’ রচনা করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার রচনা-পাঠে পাঠকের কল্পনানেত্রে যে চিত্র ভাসিয়া উঠে, তাহা পাণ্ডিত্যাভিমানী বিদুষীর নহে,—ভ্রাতৃস্নেহে আত্মবিস্মৃতা ভগিনীর। যে জীবন ভ্রাতার সেবায়, ভ্রাতার মঙ্গলকামনায় অতিবাহিত হইয়াছিল, তাহার সমাপ্তি—ভ্রাতার জীবনকাহিনী-রচনায়। কিন্তু ইহাই তাঁহার একমাত্র রচনা নহে; সেকালের রীতি অনুসারে গুল্ বহু ফার্সী কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। সাহিত্যে যে তাঁহার প্রগাঢ় অনুরাগ ও জ্ঞানস্পৃহা অতীব বলবতী ছিল, তাহা তাঁহার সংগৃহীত গ্রন্থরাশি ও প্রতিষ্ঠিত পুস্তকাগার হইতে নিঃসংশয়ে অনুমান করা যায়। মীর মহ্‌দী শীরাজী-রচিত ‘তাজ কিরতুল্ খওয়াতীনে’ গুলের কোন কবিতার এই দুইটি চরণ উদ্ধৃত আছে:

“হর্ পরী কে উ বা-আশিক্-ই-খুদ ইয়ার নীস্ত্।
তূ ইয়াকীন মীদান্ কে হেচ অঞ্জ উমর্ বর্-খুরদার্ নীস্ত!”

 —নিজ প্রেমিকের প্রতি বিমুখ পরী! তুমি নিশ্চয় জানিও যে, কেহই জীবন রূপ ফল পূর্ণরূপে আস্বাদন করে না।—অর্থাৎ, জীবন নশ্বর, তাহার মধ্যেই যতটুকু পার সুখভোগ করিয়া লও।

 সাম্রাজ্যের শাসন-সংরক্ষণে বা রাজনৈতিক ব্যাপারে গুল্‌বদন্ কখন হস্তক্ষেপ করিতেন না। দুর্গাবতী বা চাঁদ সুলতানার ন্যায় অরিহৃদয়ে, অসিমুখে রক্তরেখায় তাঁহার নাম কখন লিখিত হয় নাই সত্য; কিন্তু দীনদুঃখীর অন্তরে কৃতজ্ঞতার উজ্জ্বল অক্ষরে করুণাময়ী স্বয়ং যে নাম লিথিয়াছিলেন, তাহা খোদার পুণ্য নামের সহিত নিত্য উচ্চারিত হইত।

 অবরোধ-প্রথার প্রচলনে ভারত-মহিলাগণের কার্য্যের পরিধি অতি সঙ্কীর্ণ; কদাচিৎ অন্তঃপুর-নেপথ্যের বহির্ভাগে সংসার-রঙ্গমঞ্চের উপরে তাঁহাদের গৌরবাভিনয় প্রদর্শিত হয়; তথাপি এই নেপথ্যাভিনয়ের অলক্ষ্য প্রভাব মানব অন্তরে অন্তরে অনুভব করে;—গুল্ তাহার উজ্জল দৃষ্টান্তস্থল। বাবর-দুহিতা বালিকা গুল্ পিতার অসীম স্নেহপাত্রী ছিলেন; পরে হুমায়ূনের রাজত্বকালে সুখে দুঃখে ভ্রাতৃমুখে স্নেহময়ী ভগিনীর নাম; অতঃপর ভ্রাতুষ্পুত্র আকবর পিতৃষ্বসাকে যে অসীম শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন, ইতিহাসে সে নিদর্শনের অভাব নাই। সম্রাট্ অনেকবার তাঁহাকে ধনরত্ন উপহার দিয়াছেন (Badauni, ii. 332) এবং তাঁহার কোন উপরোধ কখন উপেক্ষা করেন নাই। গুলবদন ও পত্নী সলীমা সুলতানের অনুরোধেই তিনি শাহ্‌জাদা সলীমের বিদ্রোহ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছিলেন। কে বলিবে এইরূপ কত গুরুতর ব্যাপারে এই ধর্ম্মপ্রাণা মহিলার অদৃশ্য প্রভাব উদ্যত অশনির পতনরোধ না করিয়াছে? পর পর ভারতের দুইজন প্রতাপশালী সম্রাট্‌কে কল্যাণের পথে চালনা করিয়া সাম্রাজ্য ও সংসারের প্রভূত মঙ্গলসাধন করিয়াছে?

 সংসারে একজাতীয়া নারী আছেন যাঁহাদিগের সাহস ও বীর্যাবত্তা বীরকার্য্যে ব্যক্ত হয় না;—ব্যক্ত হয় নীরব সহিষ্ণুতায়;—যাঁহাদিগের কার্য্যের অভিব্যক্তি কল্যাণে। গুল্ সেই শ্রেণীর মহিলা। সূর্য্য নীরবে উদিত হন—নীরবে অন্ত যান; কিন্তু তাঁহারই আলোকে এই বৈচিত্র্যময়ী সৃষ্টি মানবের দৃষ্টিগোচর হয়। ইতিহাস যে-সকল কীর্ত্তি গৌরবে কীর্ত্তন করে, গুল্ সেরূপ কীর্ত্তিশালিনী ছিলেন না; কিন্তু উদীয়মান মোগল-সাম্রাজ্যের উপর এই বিদুষী মহিলা হুমায়ূন্-নামায় যে উজ্জ্বল আলোকপাত করিয়াছেন, তাহাই তাঁহার জীবনের অপূর্ব্ব গৌরবময়ী কীর্ত্তি, এবং সেইজন্যই তিনি ইতিহাস-সেবিগণের কৃতজ্ঞতা ও অক্ষয় শ্রদ্ধার অধিকারিণী। গুল্‌বদনের গৌরব-সৌরভ ঐতিহাসিক জগৎকে চির-আমোদিত করিবে।

 গুল্‌বদনের আয়ু-সূর্য্য ধীরে ধীরে অস্তাচল অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল; জীবনালোক ম্লান হইয়া আসিতেছে। মৃত্যুর দূরপ্রসারিণী দীর্ঘছায়াপাতে চক্ষু জ্যোতিঃহীন; কিন্তু ধর্ম্ম, পুণ্য, পবিত্রতায় তাঁহার অন্তরের দীপ্তি উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিতেছে। ইতিমধ্যে একবারমাত্র ইতিহাসে প্রসঙ্গতঃ তাঁহার নামোল্লেখ দেখা যায়—গুলের বয়ক্রম তখন ৭০ বৎসর। আক্‌বর-নামায় প্রকাশ, সেই সময় তাঁহার দৌহিত্র মুহম্মদ্-ইয়ার সম্রাটের বিরাগ- ভাজন হইয়া রাজদরবার পরিত্যাগ করেন।

 ইহার পর আরও দশ বৎসর কাটিয়া গেল। আক্‌বরের অর্দ্ধ শতাব্দীব্যাপী রাজ্যের দীর্ঘ দিবাও অবসানপ্রায়। গুলের জীবনে কাল-রজনী উদিত হইল। ১৬০৩ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে অশীতিবর্ষ বয়সে গুল্ আগ্রায় শেষ শয্যা গ্রহণ করিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত্তেও চিরসঙ্গিনী হামীদা তাঁহার শয্যাপার্শ্বে,—ননদিনীর শুশ্রূষাভার আর কাহারও হস্তে দিয়া তিনি নিশ্চিন্ত নহেন। হামীদা ননদিনীকে আদরে ‘জিউ’ (মহাশয়া) বলিয়া সম্ভাষণ করিতেন। যখন দেখিলেন, অন্তিম শয্যাশায়িনীর চক্ষে মৃত্যুর করাল ছায়া ঘনাইয়া আসিতেছে,—রুগ্ন ভগ্নদেহ হইতে চিরমুক্তি লাভ করিবার জন্য জীবনশ্বাস চঞ্চল হইয়াছে, তখন তিনি স্নেহভরে চিরতরে একবার শেষসম্ভাষণ করিলেন—‘জিউ’? উত্তর না পাইয়া হামীদা পুনরায় নাম ধরিয়া ডাকিলেন—‘গুল্‌বদন্’? মুমূর্ষু ধীরে ধীরে চক্ষুরুন্মীলন করিয়া ভগ্নকণ্ঠে বহুকষ্টে বলিলেন—‘আমি মরিতেছি, তুমি চিরজীবিনী হও।’ যে চক্ষু মোগল-ভাগ্যরবির প্রাতরুত্থান দেখিয়াছিল, তাহা চিরনিমিলিত হইল।

 পিতৃষ্বসার প্রতি অসীম শ্রদ্ধাবান্ সম্রাট্ আকবর কিছুদূর শবাধার বহন করিয়া চলিলেন। নীরব অশ্রুপাত ও ভাষাহীন দীর্ঘশ্বাস তাঁহার মর্ম্মবেদনার পরিচয় দিতে লাগিল। দেহচ্যুত আত্মার শান্তির নিমিত্ত বৃদ্ধ সম্রাট্ সৎকার্য্যে অকাতরে অর্থব্যয় করিলেন। মৃণ্ময় দেহ মৃত্তিকায় সমাহিত হইল।

 কিন্তু ধর্ম্মে প্রগাঢ় নিষ্ঠাবতী, কর্ম্মে কর্তব্যপরায়ণা, পতিপুত্র-পরিজনে একান্ত স্নেহশালিনী, সৌজন্য ও সারল্যের প্রতিমা গুল্, শমনের অন্তঃপুর সমাধির অভ্যন্তর হইতে কালের নিবিড় আবরণ ভেদ করিয়া আমাদের মানস পটে উদিত হন। তখন মনে হয়, যেন চিরপরিচিত সুহৃদ্‌কে হারাইয়াছি!


হুমায়ূন্-নামা

 বিংশ শতাব্দীর পূর্ব্বে যাঁহারা মোগল-রাজবংশের কথা আলোচনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের কেহই গুলবদনের ‘হুমায়ূন্-নামা’র সহিত পরিচিত ছিলেন না। সুপণ্ডিত ব্লকমানের পক্ষে ফার্সী পুঁথির সহিত পরিচয়লাভের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ছিল; কিন্তু গুল্‌বদন্ বেগমের হুমায়ূন্-নামার কথা তাঁহারও জানা ছিল না; থাকিলে গুল্‌বদনকে তিনি ‘আকবরের বেগম’ বলিয়া অনুমান করিতেন না! (Ain-i-Akbari, i. 48)

 হুমায়ূন-নামার ফার্সী পুঁথিখানি ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কর্ণেল জর্জ্জ উইলিয়াম্ হ্যামিল্‌টনের বিধবার নিকট হইতে ক্রয় করা হয়। সেই অবধি ইহা ব্রিটিশ মিউজিয়মে স্থান পাইয়াছে। বাখরগঞ্জের ইতিহাস-প্রণেতা সুপ্রসিদ্ধ বেভারিজ সাহেবের বিদুষী পত্নী ইহার ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশ করিয়া আমাদের ধন্যবাদভাজন হইয়াছেন।

 ‘আকবর-নামা’ আবুল ফজলের রচিত বাদশাহ্ আকবরের রাজত্বকালের সুবৃহৎ সরকারী ইতিহাস। এই গ্রন্থের উপাদান সংগ্রহ করিয়া দিবার জন্য বাদশাহ্ এক হুকুম জারি করেন। ইহার ফলে, হুমায়ূনের আফ্‌তাব্‌চী (পানপাত্রবাহক) জৌহর, এবং আকবরের বকাওলবেগী (রাজরন্ধনশালার পরিদর্শক) বায়াজীদ্ বীয়াতের স্মৃতিকথা রচিত হয়। বাদশাহ্ আক্‌বরের এই আদেশ-প্রচারের কথা আবুল-ফজল্ তাঁহার গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন। (Akbarnama, i. 29, 30, 33). খুব সম্ভব, এই রাজাদেশের ফলেই গুলবদন্ ‘হুমায়ূন-নামা’ রচনা করেন; কারণ তিনিও লিখিয়াছেন,—“বাদশাহ্ আক্‌বর আদেশ প্রচার করেন—বাবর ও হুমায়ূনের সম্বন্ধে যাহা জান, লিপিবদ্ধ কর।” এ অনুমান সত্য হইলে দেখা যাইতেছে, ‘হুমায়ূন-নামা’ রচনার তারিখ ১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দের (৯৯৫ হিঃ) কাছাকাছি। আবুল ফজল্ কিন্তু হুমায়ূন-নামা সম্বন্ধে নীরব। তবে তিনি যে আকবরনামা-রচনাকালে গুলবদনের পুঁথির সাহায্য লইয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ আছে।[২]

 হুমায়ূন-নামা সাহিত্য হিসাবে রচিত হয় নাই;—আবুল- ফজলের আকবর-নামার উপকরণ হিসাবে লিখিত। সাম্রাজ্য বা রাজদরবারের যে সমস্ত ঘটনা গুলবদন্ জানিতেন, বা বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হন, তাহাই অকপটে চলিত কথায় লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার রচনা সরল, সুন্দর,—লেখায় একটা স্বচ্ছন্দ গতির পরিচয় পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে তুর্কী শব্দের প্রয়োগ আছে। ইহা খুবই স্বাভাবিক; কারণ গুলবদন ও তাঁহার স্বামীর মাতৃভাষাই ছিল তুর্কী। তাঁহার ফার্সী-জ্ঞান অধ্যয়নলব্ধ মাত্র।

 হুমায়ূন-নামার প্রথমাংশে বাবরের কথা। ইহার অধিকাংশই বাবর বাদশাহের আত্মকথা হইতে গৃহীত। পিতার মৃত্যুকালে গুলবদনের বয়স মাত্র আট বৎসর, সুতরাং তাঁহার নিকট হইতে বাবরের রাজত্বকালের চাক্ষুষ বিবরণ জানিবার আশা করা যায় না।

 ইতিহাসের দিক্ হইতে হুমায়ূন্-নামার একটা বিশেষ সার্থকতা আছে। ইহা আবিষ্কৃত না হইলে বোধ হয় বাবরের পুত্রকন্যা, আত্মীয়স্বজন ও সে যুগের কয়েকটি পরিবারের সঠিক বৃত্তান্ত আমাদের নিকট অজ্ঞাত থাকিয়া যাইত। বাবর ও হুমায়ূনের জীবনী-লেখক আরস্কিন্ (Erskine) সাহেবেরও হুমায়ূন-নামা দৃষ্টিগোচর হয় নাই। ইহার সাহায্য পাইলে তাঁহার গ্রন্থে বর্ণিত বাবর ও হুমায়ূনের পরিবারবর্গের কাহিনী অধিকতর সম্পূর্ণতা লাভ করিত। হুমায়ূন্-নামা আকবরের বাল্যজীবনের ইতিহাসের উপরও বিশেষ আলোকপাত করে।

 নিজের অখ্যাতি দোষত্রুটি গোপন করাই মনুষ্য-চরিত্রের পক্ষে স্বাভাবিক। শাহ্ ইসমাইলের অধীনতা-স্বীকার, ঘাজ্‌দওয়ানের পরাজয়, আলাম্ লোদীর (সুলতান আলাউদ্দীনের) প্রতি অন্যায় আচরণ,—এ সব কথা বাবর তাঁহার আত্মকাহিনী ‘তুজুক-ই- বাবুরী’তে গোপন করিয়াছেন। জহাঙ্গীরও পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও শের আফ্‌কনের মৃত্যুর কারণ আত্মকাহিনীতে যথাযথ উল্লেখ করেন নাই। এমন কি স্নেহময়ী গুল্‌বদনও স্নেহের আতিশয্যে সহোদর হিন্দাল, ও বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হুমায়ূনের দোষত্রুটি ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছেন। তাঁহার গ্রন্থের তারিখগুলিও সাবধানে গ্রহণ করা উচিত।

 দুঃখের বিষয়, ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত হুমায়ূন্-নামার এই পুঁথিখানি অসম্পূর্ণ—শেষের কয়েক পৃষ্ঠা হারাইয়া গিয়াছে। হুমায়ূনের ভারত-বিজয়ের পূর্ব্বাবধি—মীর্জ্জা কামরান্‌কে অন্ধ করিয়া দেওয়া পর্য্যন্ত—এই খণ্ডিত পুঁথির শেষ সীমা। বায়াজীদ্ বীয়াতের স্মৃতিকথা—তারিখ-ই-হুমায়ূন্—সম্পূর্ণ হইলে তাহার নয়খানি পুঁথি নকল করা হয়। দুইখানি বাদশাহের পাঠাগারে, সলীম্ মুরাদ ও দানিয়াল্—তিন কুমারকে তিনখানি, গুলবদনের পাঠাগারে একখানি, এবং দুইখানি আবুল ফজলকে দেওয়া হয়; বাকি একখানি সম্ভবতঃ গ্রন্থকার নিজে রাখিয়াছিলেন। গুলবদনের হুমায়ূন্-নামাও একই উদ্দেশ্যে রাজাদেশে রচিত হয়, এবং বায়াজীদের পুঁথির মত, ইহারও যে একাধিক পুঁথি নকল হইয়াছিল, এরূপ অনুমান অসঙ্গত নহে। কিন্তু ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত পুঁথিখানি ছাড়া গুলবদনের গ্রন্থের দ্বিতীয় পুঁথি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।


  1. পর্ত্তুগীজদিগকে দামানের নিকটবর্ত্তী বুল্‌সার গ্রামখানির অধিকার দিয়া, গুলবদন তাহাদের নিকট হইতে তীর্থগমনের আবাক ছাড়পত্র সংগ্রহ করিয়াছিলেন। সম্রাটের আদেশমত তিনি যে এরূপ করেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তীর্থ হইতে ফিরিয়া তিনি রাজকর্ম্মচারিগণকে পর্ত্তুগীজদিগের হস্ত হইতে বুল্‌সার গ্রাম কাড়িয়া লইতে আদেশ দিয়াছিলেন।—Monserrate's Mongolicue Legationis Commentarius ed. by. H. Hosten, p. 625.
  2. “A passage about Babar (Bib. Ind., edit. I. 87) closely resembles the begam's on the same topic; and a divergence, noted by Mr. Erskine (Mems., 218n) as made from Babar's narrative by Abul-fazal, is made also by the begam.”—Humayun-Nama, p. 78n.