য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/ত্রয়োদশ পত্র

উইকিসংকলন থেকে

ত্রয়োদশ পত্র

ভারী কাজে ব্যস্ত। হাই তোলবার সময় নেই। সময় যদি নিলেমে বিক্রি হয় তা হলে যত ব্যস্ত লোক সংসারে আছে আমি সকলের চেয়ে চড়া দাম ডাকি— এত কাজ! এমন অবস্থায় তোমাদের চিঠি লেখা সামান্য কথা? এত ব্যস্ত অবস্থায় লিখতে বসলে কী বিপদ ঘটে জানো? মনের বাক্সের চাবি পকেট হাৎড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না; যদি বা বাক্স খোলা গেল তাড়াতাড়ি ব্যস্তসমস্ত ভাবে, হাঁস‍্ফাঁস্ করতে করতে, হুট‍্পাট্‌ ক’রে, যেখানে যত ভাব গোছানো ছিল খুঁজতে গিয়ে সমস্ত ওলটপালট বিপর্যস্ত করে ফেলি— এটা তুলছি, ওটা তুলছি, কিন্তু যেটা আবশ্যক সেইটে পাওয়া যায় না। লিখতে গেলে কথা পড়ে যায়। তাড়াতাড়িতে কর্ভার আগে ক্রিয়াকে আসন দেওয়া হয় ও কর্তা জায়গা না পেয়ে হয়তো কর্মের পিছনে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজকেরকার চিঠিতে এই রকম নানা ত্রুটি হবার সম্ভাবনা আছে, তবু কোনো প্রকারে আজকের মধ্যে চিঠিটা লিখতেই হবে। মনে আছে, তিন চার মেল আগে তোমাকে লাইন দশেকের যে-একটি চিঠি লিখেছিলেম তাতে তোমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেম যে, ‘শীঘ্রই তোমাকে একখানি বড়ো চিঠি লিখব।’ ‘লিখব’ ভবিষ্যৎকালবাচক ক্রিয়া। আজ থেকে প্রলয়কাল পর্যন্ত ভবিষ্যতের সীমা। তা ছাড়া যেমন একটি বাঁধা নিয়ম আছে যে, পয়সা চৌষট্টিটা হলেই টাকায় পরিণত হয়; তেমন কোনো শাস্ত্রেই এমন একটা ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট নিয়ম নেই যাতে অবিসম্বাদে বলা যায় যে, ‘শীঘ্র’ এত আনা হলে ‘দেরি’ টাকায় পরিণত হয়। অতএব তোমাদের এমন একটি অনিশ্চিত অনির্দিষ্ট আশায় আর বেশি দিন ফেলে রাখতে চাই নে।

 Christmas ফুরোলো, আবার দেখতে দেখতে আর-একটা উৎসব এসে পড়ল। আজ নূতন বর্ষের প্রথম দিন। কিন্তু তার জন্যে কিছুই গোলমাল দেখতে পাচ্ছি নে। নূতন বৎসর যে এখানে এমন নিঃশব্দপদসঞ্চারে আসবে তা জানতেম না। শুনেছি ফ্রান্সে লোকে নতুন বৎসরকে খুব সমাদরের সঙ্গে আবাহন করে। কাল পুরাতন বৎসরের শেষ রাত্রে আমাদের প্রতিবেশীরা বাড়ির জানলা খুলে রেখেছিল। তার কারণ এই হতে পারে যে, পাছে পুরানো বৎসর ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে, তার চলে যাবার ব্যাঘাত হয়— আর, পাছে নতুন বৎসর এসে জানলার কাছে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, তার ঘরে ঢুকতে বিশেষ কষ্ট হয়। এখেনে শীতে জানলা দরজা সমস্ত বন্ধ থাকে কি না, সুতরাং দরজা খুলে না দিলে নতুন বৎসর ঘরে ঢুকতে পান না, বাইরে দাঁড়িয়ে সর্দিতে মারা যান। আর পুরানো বৎসরের বাড়ি যাবার সময় হয়েছে, তাকে যদি অমন দরজা বন্ধ করে রাখো তবে সে ব্যক্তি দরজায় মাথা ঠুকে ঠুকে বাড়িময় দাপাদাপি করে বেড়াতে থাকবে। কিন্তু দুর্দশার কথা কী বলব, আমরা হচ্ছি ঘোরতর অসভ্য অজ্ঞান লোক—আমাদের বাড়ির জানলা কাল খুলে রাখা হয় নি, আমাদের চিমনির (ধোঁওয়ার নলের) ভিতর দিয়ে ছাড়া পুরাতন বৎসরের আর বেরোবার জায়গা ছিল না। আজ সকালে উঠে এই কথাটা আমাদের হঠাৎ মনে পড়ল। মনে পড়ে অবধি আমরা অনুতাপে সারা হচ্ছি। মনে করো প্রতি বাড়িতে ১৮৮০ খৃস্টাব্দ, আমাদের বাড়িতে ১৮৭৯। মনে করো যদি আমরা আর বাড়ির জানলা দরজা একেবারে না খুলি তা হলে আর পঁচাত্তর বৎসর বাঁচলেও ১৮৭৯ খৃস্টাব্দে মরি। কিম্বা যদি চিত্রগুপ্তের খাতায় ১৯৫৩ খৃস্টাব্দে তাঁর প্রভুর আলয়ে আমার শুভ পদার্পণ নির্দিষ্ট থাকে তা হলে সে শুভদিন আমার ভাগ্যে একেবারেই আসে না, চিরকালই আমি ১৮৭৯তে থাকি। মন্দ কী? চিরকালই যদি ১৮৭৯তে থাকতে পারি সে তো বেশ হয়। কিন্তু রোসো, একটু ভেবে দেখি। ১৮৭৯ খৃস্টাব্দে এমনিই কি আমার সুখের বৎসর গিয়েছে? আহা! এর আগে এমন কত বৎসর গিয়েছে যাদের ধরে রাখতে পারলে চিরজীবন ধরে রাখতুম! যা হয়ে গেছে তা তো হয়ে গেছে। এখন, আমার কুষ্টিতে লেখা আছে যে, ১৮৮১ খৃস্টাব্দে আমার ‘ধনরত্নানি’ একটি ভার্যা ও অনেক মিত্র লাভ হবে; মনে করছি ১৮৮২কে আর ঘরে ঢুকতে দেব না। যা হোক, নতুন বৎসরকে অনেক ক্ষণ ঘরের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, আসবামাত্রেই তাঁকে আবাহন করতে পারি নি তার জন্যে আমরা তাঁর কাছে শত শত ক্ষমা চাচ্ছি। নতুন বৎসরের আগমনে আজকের দিনের মুখশ্রী বড়ো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নি। আজ ভারী মেঘ ও অন্ধকার করে আছে। নতুন বৎসরের উপক্রমণিকা যদি এই রকম অন্ধকারাচ্ছন্ন হয় তবে এর উপসংহার না জানি কিরকম হবে। টর্কি থেকে বহুদিন হল আমরা আবার লন‍্ডনে এসেছি। টর্কিতে বসন্তের সঙ্গে প্রকৃতির ফুলশয্যা দেখেছিলেম। সেই উৎসব থেকে লন‍্ডনের এই ব্যস্ত ভাবের মধ্যে এসে পড়ে বড়ো ভালো লাগবে না। এখন আমি Mr Kর পরিবারের মধ্যে বাস করি। Mr. K, Mrs. K, তাঁদের চার মেয়ে, দুই ছেলে, তিন দাসী, আমি ও Toby বলে এক কুকুর হচ্ছে এই বাড়ির জনসংখ্যা। Mr. K হচ্ছেন একজন ডাক্তার। তাঁর মাথার চুল ও দাড়ি প্রায় সমস্ত পেকে গিয়েছে। বেশ বলিষ্ঠ ও সুশ্রী দেখতে। যেমন অমায়িক স্বভাব তেমনি অমায়িক মুখশ্রী। তাঁর পরিবারের সকলেই বড়ো ভালো লোক। আমার সঙ্গে অল্প দিনের আলাপেই বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে। Mrs. K আমাকে আন্তরিক যত্ন করেন। শীতের সময় আমি বিশেষ গরম কাপড় না পরলে তাঁর কাছে ভর্ৎসনা খাই। খাবার সময় যদি তাঁর মনে হয় আমি কম করে খেয়েছি, তা হলে যতক্ষণ না তাঁর মনের মতো খাই ততক্ষণ পীড়াপীড়ি করেন। বিলেতে লোকে কাশিকে বড়ো ভয় করে; যদি দৈবাৎ আমি দিনের মধ্যে দুবার কেশেছি তা হলেই তিনি জোর করে আমার স্নান বন্ধ করান, আমাকে দশ রকম ওষুধ গেলান, শুতে যাবার আগে আমার পায়ে খানিকটা গরম জল ঢালবার বন্দোবস্ত করেন—তবে ছাড়েন। বাড়ির মধ্যে সকলের আগে বড়ো Miss K ওঠেন। তিনি নীচে এসে ব্রেক‍্ফাস্ট্ তৈরি হয়েছে কিনা তদারক করেন; অগ্নিকুণ্ডে দু চার হাতা কয়লা দিয়ে ঘরটি বেশ উজ্জ্বল করে রাখেন। খানিকক্ষণ বাদে সিঁড়িতে একটা দুদ্দাড় পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। বুড়ো K শীতে হিহি করতে করতে খাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত। তাড়াতাড়ি আগুনে হাত পা পিঠ বুক তাতিয়ে খবরের কাগজ হাতে খাবার টেবিলে এসে বসলেন। তাঁর বড়ো মেয়েকে চুম্বন করলেন, আমার সঙ্গে সুপ্রভাত অভিবাদন হল। লোকটা ভারী প্রফুল্ল। আমার সঙ্গে খানিকটা হাসি-তামাসা হল, খবরের কাগজ থেকে এটা ওটা পড়ে শোনাতে লাগলেন। তাঁর এক পেয়ালা কফি শেষ হয়ে গেছে, এমন সময়ে তাঁর আর দুটি মেয়ে এসে তাঁকে চুম্বন করলেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্দোবস্ত ছিল যে, তাঁরা যে দিন Mr. Kর আগে উঠবেন সে দিন Mr. K তাঁদের পাঁচ সিকে দেবেন, আর যেদিন Mr. K তাঁদের আগে উঠবেন সে দিন Mr. Kকে তাঁদের চার আনা দিতে হবে। যদিও এত অল্প দিতে হত তবু Mr. Kর তাঁদের কাছে প্রায় দু তিন পাউণ্ড পাওনা হয়েছে। রোজ সকালে Mr. K তাঁর পাওনার জন্যে দাবি করেন। কিন্তু তাঁর দেনদাররা হেসেই উড়িয়ে দেন। Mr. K বলেন ‘এ ভারী অন্যায়!’ তিনি আমাকে মাঝে মাঝে মধ্যস্থ মেনে বলেন, ‘আচ্ছা, Mr. T তুমিই বলো, এরকম debt of honour ফাঁকি দেওয়া কি ভদ্রতা!’ যা হোক, রোজ রোজই Mr. Kর পাওনা বাড়ছে। তার পরে Mrs. K এলেন। আমাদের ব্রেক‍্ফাস্ট্ প্রায় সাড়ে নটার মধ্যে শেষ হয়। Mr. Kর বড়ো ছেলে আমাদের আগেই খাওয়া সেরে কাজে গিয়েছেন, আর Mr. Kর ছোটো ছেলেটি ও ছোটো মেয়েটি অনেকক্ষণ হল খাওয়া শেষ করেছে। একজনের কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। Toby কুকুরটি অনেক ক্ষণ হল এসে আগুনের কাছে আরামে বসে আছে। ছোট্ট কুকুরটি। তার ঝাকড়া-ঝাঁকড়া রোঁওয়া। রোঁওয়াতে চোখ মুখ ঢাকা। বুড়ো হয়েছে আর তার একটা চোখ কানা হয়ে গেছে। আদর পেয়ে পেয়ে এই ব্যক্তির কতকগুলি নবাবি চাল হয়েছে। drawing-room ছাড়া অন্য কোনো ঘরে তার মন বসে না। কথা নেই বার্তা নেই, ঘরের সকলের চেয়ে ভালো কেদারাটিতে অম্লানবদনে লাফিয়ে উঠে বসা হয়; ঘরে যদি একঘর লোক হয় তবুও বসে আছে, এক ব্যক্তির হয়তো বসবার জায়গা হচ্ছে না কিন্তু Tobyর তাতে আসে যায় না। কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ দৃপাত না করে দিব্য আরামে চৌকিতে তিনি বসেছেন; তার এক পাশে যদি আর কেউ এসে বসে অমনি তিনি মহা বিরক্ত হয়ে দর্পে সে চৌকি থেকে উঠে গিয়ে তৎক্ষণাৎ পাশের কৌচটির ওপরে গিয়ে বসে পড়েন। সকাল বেলায় ব্রেক‍্ফাস্টের সময় তাঁর তিনটি বিস্কুট বরাদ্দ আছে। বিস্কুটগুলি নিয়ে সে খাবার ঘরে বসে থাকে; যতক্ষণ না আমি গিয়ে সেই বিস্কুটগুলি নিয়ে তার সঙ্গে খানিকটা খেলা করি, একবার তার মুখ থেকে কেড়ে নিই, একবার গড়িয়ে দিই, ততক্ষণ তার খাওয়া হয় না। আমি খেলা না করলে সে কোনো মতেই খেতে রাজি হয় না। আমাকে সে বড়ো ভালোবাসে। আগে আগে যখন আমার উঠতে দেরি হত সে তার বরাদ্দ বিস্কুট নিয়ে আমার শোবার ঘরের কাছে বসে ঘেউ ঘেউ করত। কিন্তু গোল করলে আমি বিরক্ত হুতুম দেখে সে এখন আর ঘেউ ঘেউ করে না। আস্তে আস্তে পা দিয়ে দরজা ঠেলে; যতক্ষণ না আমি দরজা খুলে দিই, চুপ করে বাইরে বসে থাকে। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরলেই সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নেজ নেড়ে সুপ্রভাত সম্ভাষণ করে; তার পরে একবার বিস্কুটের দিকে চায় একবার আমার মুখের দিকে চায়। মনোগত ভাবটি এই যে, ‘প্রাতঃকৃত্য সারা হয়েছে? তা বেশ হয়েছে। এখন আমার বিস্কুটটি একবার গড়িয়ে দেও; আমার বড়ো খেলা করবার ইচ্ছে গিয়েছে।’ একএক সময় সন্ধে বেলায় পেছন দিকের দুটো পা গুটিয়ে সুমুখের দুটো পায়ের ওপর ভর দিয়ে মহাচিন্তিতভাবে বৃদ্ধ আগুনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। আধ ঘণ্টা যায়, এক ঘণ্টা যায়, Tobyর হুঁস নেই। তখন তাকে আদর করতে যাও, মাথায় হাত বুলোও, মহা-অসন্তুষ্ট-ভাবে গোঁ গোঁ করে, মাথা নাড়ে। ‘বিরক্ত কর কেন? ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে এখন উনি আমার মাথায় হাত বুলোতে এলেন!’ এ ব্যক্তি পূর্বজন্মে কী ছিল বলো দিকি? অ্যারিস্টট্‌ল্ ছিল না কি? যা হোক, সাড়ে নটার মধ্যে আমাদের ব্রেক‍্ফাস্ট্ শেষ হয়। তার পরে Mrs. K হাতে দস্তানা পরে দাসীদের নিয়ে চৌতলা থেকে একতলা পর্যন্ত, জিনিসপত্র গোছানো, ঘর দ্বার পরিষ্কার করানো ও সমস্ত গৃহকার্য তদারক করে উঠানাবা করেন। একবার রান্নাঘরে যান— সেখেনে শাকওয়ালা রুটিওয়ালা মাংসওয়ালার বিল দেখেন, যাকে যার চুকিয়ে দেবার দেন। মাঝে মাঝে ওপরে এসে Mr. Kর সঙ্গে গৃহকার্যের পরামর্শ হয়। রান্নাঘরের উপকরণ পরিষ্কার আছে কিনা ও যথাস্থানে আছে কিনা দেখেন; ভালো মাংস এনেছে কিনা, ওজনে কম বেশি হয়েছে কিনা সে সব দেখেন। রাঁধুনির সঙ্গে মাঝে মাঝে রান্নাতে যোগ দেন। এই রকম ব্রেক‍্ফাস্টের পর থেকে প্রায় বেলা একটা দেড়টা পর্যন্ত তাঁকে নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে তাঁর বড়ো মেয়ে যোগ দেন। মেজ মেয়ে Miss J দেখি, প্রত্যহ একটি ঝাড়ন নিয়ে drawing-room সাফ করেন। দাসীরা ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়, আর জিনিসপত্রে যাকিছু ধুলো লাগে তা তিনি নিজের হাতে ঝেড়েঝুড়ে সাফ করেন। এখানকার অনেক ভদ্রপরিবারেই drawing-roomএর জিনিসপত্র সাফ করবার ভার বাড়ির মেয়েরাই নেন, দাসীদের হাতে পাছে জিনিসপত্র ভেঙে যায় বা ভালোরূপে পরিষ্কার না হয়। তৃতীয় মেয়ে Miss A বালিসের আচ্ছাদন আসন মোজা কাপড় প্রভৃতি নানাবিধ সেলাইয়ে নিযুক্ত হন, চিঠিপত্র লেখেন, একএকদিন বাজনা ও গান অভ্যেস করেন। বাড়ির মধ্যে তিনিই গাইয়ে-বাজিয়ে। আজকাল স্কুল বন্ধ, ছোটো ছেলেটি ও মেয়েটি ভারী খেলায় মগ্ন। দেড়টার সময় আমাদের lunch খাওয়া আছে। lunch সমাপন করে আবার যিনি যাঁর কাজে নিযুক্ত হলেন। এই সময়ে visitorদের আসবার সময়। হয়তো Mrs. K Mr. Kর এক জোড়া ছেঁড়া মোজা নিয়ে চশমা পরে drawing roomএ বসে সেলাই করছেন। Miss A একটি পশমের জামা তাঁর ভাইপোর জন্যে তৈরি করে দিচ্ছেন। Miss J একটু অবসর পেয়ে আগুনের কাছে বসে হয়তো Green's History of the English People পড়তে নিযুক্ত হয়েছেন। বড়ো Miss K হয়তো তাঁর কোনো আলাপীর বাড়িতে visit করতে গিয়েছেন। তিনটের সময় হয়তো একজন visitor এলেন। দাসী drawing roomএ এসে বললে ‘Mr. ও Mrs. A’। বলতে বলতে ঘরের মধ্যে Mr. ও Mrs. A এলেন। মোজা জামা রেখে বই মুড়ে Mrs. K ও তাঁর কন্যারা আগন্তুকদের অভ্যর্থনা করলেন। weather ভালো কি মন্দ সে বিষয়ে পরস্পরের মতামত ব্যক্ত করলেন। Mrs. A বললেন, ‘Mr. Xএর ৪৩ বৎসর তিন মাস বয়সে হাম হয়। হাম হয়েছিল বলে তিনি চার দিন আপিসে যেতে পারেন নি। কাল আফিসে গিয়েছিলেন। তাঁর হাম হয়েছিল বলে আফিসের লোকেরা তাঁকে নির্দয় রূপে ঠাট্টা করতে আরম্ভ করেছে।’ Mrs. J বললেন, ‘অমন ব্যামো হলে কী দুর্দশা! একে তো ব্যামোর কষ্ট, তার ওপর কারও মমতা পাবার জো নেই। শুধু তাই নয়, ব্যামো হলে আবার তাই নিয়ে হাসি তামাসা ঠাট্টা খেয়ে বেড়াতে হয়।’ এই কথা থেকে ক্রমে হাম রোগের বিষয়ে যত কথা উঠতে পারে উঠল। Miss A বললেন, ‘Mr. Zএর তৃতীয় ছেলেটির হাম হয়েছে।’ তার থেকে কথা উঠল যে, Mr. Zএর যে এক cousin Miss Y অস্ট্রেলিয়ায় আছেন তাঁর Captain Wর সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেছে। এই রকম খানিক ক্ষণ কথোপকথন হলে পর তাঁরা চলে গেলেন। বিকেলে হয়তো আমরা সবাই মিলে একটু বেড়াতে গেলুম। বেড়িয়ে এসে সাড়ে ছটার সময় আমাদের ডিনার খাওয়া হয়। ডিনার খেয়ে ৭টার সময় আমরা সবাই মিলে drawing-roomএ গিয়ে বসি। আগুন জ্বলছে। ঘরটি বেশ গরম হয়ে উঠেছে। আমরা আগুনের চার দিকে ঘিরে বসলুম। এক-এক দিন আমাদের গান বাজনা হয়। আমি ইতিমধ্যে অনেক ইংরাজি গান শিখেছি। জাঁক করতে চাই না, কিন্তু তবু সত্যি কথা বলতে কী, এখানকার লোকে আমার গলার বেশ প্রশংসা করে। আমি গান করি। Miss A বাজান। Miss A আমাকে অনেকগুলি গান শিখিয়েছেন। কিন্তু প্রায় সন্ধে বেলায় আমাদের একটু-আধটু পড়াশুনা হয়। আমরা পালা করে ৬ দিনে ছ রকমের বই পড়ি। বই পড়তে পড়তে এক-এক দিন প্রায় ১১॥ - ১২ হয়ে যায়। ছেলেরা এখন শুতে গেছে।

 ছেলেদের সঙ্গে আমার ভারী ভাব হয়ে গেছে। তারা আমাকে Uncle Arthur বলে। Ethel ছোটো মেয়েটি আমাকে ভারী ভালোবাসে। তার ইচ্ছে যে, আমি কেবল একলা তারই Uncle Arthur হই। তার ভাই Tom যদি আমাকে Uncle Arthur বলে তবেই তার ভারী কষ্ট উপস্থিত হয়। একদিন Tom তার ছোটো বোনকে রাগাবার জন্যে একটু বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিল, ‘He is my Uncle Arthur!’ এই তো Ethel আমার গলা জড়িয়ে ধরে তার ছোটো ঠোঁট দুটি ফুলিয়ে ফুলিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। কত করে তাকে থামাই। Tom একটু অস্থির, কিন্তু ভারী ভালো মানুষ। খুব মোটাসোটা। মাথাটা খুব প্রকাণ্ড। মুখটা খুব ভারী ভারী। সে এক-এক সময়ে আমাকে এমন এক-একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে যে কী বলব। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘আচ্ছা, Uncle Arthur, ইন্দুররা কী করে?’ Uncle Arthur বললেন, ‘তারা রান্নাঘর থেকে চুরি করে খায়।’ সে একটু ভেবে বললে, ‘চুরি করে? আচ্ছা, চুরি করে কেন?’ Uncle বললেন, ‘তাদের ক্ষিদে পায় ব’লে।’ শুনে Tomএর বড়ো ভালো লাগল না। সে বরাবর শুনে আসছে যে, জিজ্ঞাসা না করে পরের জিনিস নেওয়া অন্যায়। আর একটি কথা না বলে সে চলে গেল। যদি তার বোন কখনো কাঁদে সে তাড়াতাড়ি এসে সান্ত্বনার স্বরে বলে, ‘Oh, poor Ethel, don't you cry! Poor Ethel!’ এমন মজা করে বলে যে সে হাসি চেপে রাখা দুঃসাধ্য। Ethelএর মনে মনে জ্ঞান আছে যে, সে একজন Lady। সে কেমন গম্ভীর ভাবে কেদারায় গিয়ে ঠেস দিয়ে বসে। Tomকে এক এক সময়ে ভর্ৎসনা করে বলা হয়, ‘আমাকে বিরক্ত কোরো না।’ একদিন Tom পড়ে গিয়ে কাঁদছিল। আমি তাকে বললেম, ‘ছি! কাঁদতে আছে!’ অমনি Ethel আমার কাছে ছুটে এসে জাঁক করে বললে, ‘Uncle Arthur, Uncle Arthur, আমি একবার ছেলেবেলায় রান্নাঘরে পড়ে গিয়েছিলেম, কিন্তু কাঁদি নি।’ উঃ! বয়স কত!

 Mr. N ডাক্তারের আর-এক ছেলে বাড়িতে থাকেন, কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই নে। তিনি সমস্ত দিন আফিসে থাকেন। কিন্তু আফিস থেকে এলেও তাঁর বড়ো একটা দেখা পাওয়া যায় না। তার কারণ কী জানো? তিনি Miss Iএর সঙ্গে engaged। তাঁদের দুজনে কোর্টশিপ চলছে। রবিবার দু বেলা তাঁকে নিয়ে তাঁর চর্চে যেতে হয়। যখন বিকেলে একটু অবসর পান, তাঁর বাড়িতে গিয়ে এক পেয়ালা চা খেয়ে আসেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধে বেলা তাঁদের বাড়িতে তাঁর নেমন্তন্ন আছে। এই রকমে তাঁর সময় ভারী অল্প। উভয়ে পরস্পরকে নিয়ে এমন সুখী আছেন যে, অবসর কাল কাটাবার জন্যে অন্য কোনো জীবের সঙ্গ তাঁদের আবশ্যক করে না। শুক্রবার সন্ধে বেলায় যদি আকাশ ভেঙে পড়ে তবু Mr. N পরিষ্কার করে চুলটি ফিরিয়ে, পমেটম মেখে, কোট brush করে ফিট‍্ফাট্ হয়ে, ছাতা হাতে করে বাড়ি থেকে বেরোবেনই। একবার খুব শীত পড়েছিল, আর তাঁর ভারী কাশি হয়েছিল; মনে করলেম আজ বুঝি বেচারির আর যাওয়া হয় না। কী আশ্চর্য! ৭টা বাজতে না বাজতেই দেখি তিনি ফিট্‌ফাট্ হয়ে নেবে এসেছেন। তাঁর বাপ মা বোনরা সবাই বললে ‘It is very foolish of you N’, কিন্তু বললে হয় কী! ‘নদী যবে চলে সিন্ধুপানে কার সাধ্য রোধে তার গতি।’ নদী তো বাপ মা বোনের উপরোধের শিক্ষাবাধা লঙ্ঘন ক’রে, কাশি হাঁচি ও রুমালে সর্দিঝাড়ার কলস্বর করতে করতে সিন্ধুর উদ্দেশে চলল। (উপমা কেমন হল বলো দেখি।) তখন বৃষ্টি পড়ছে, বরফ পড়ছে, রাস্তায় কাদা জমেছে। তার পরদিন সকালে সর্দিতে বেচারি মাথা তুলতে পারে না। এমন যন্ত্রণা!!

 যা হোক, আমার এই K-পরিবারের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সে দিন Miss N আমাকে বলছিলেন যে, প্রথম যখন তাঁরা শুনলেন যে একজন ভারতবর্ষীয় ভদ্রলোক তাঁদের মধ্যে বাস করতে আসছে, তাঁদের ভারী ভয় হয়েছিল। ‘ব্যক্তিটা কিরকম হবে না জানি! তার সাক্ষাতে আবার কিরকম আদব-কায়দা রেখে চলতে হবে! আমাদের কথা সে ভালো করে বুঝতে পারবে কি না!’— এই রকম নানাবিধ ভাবনায় তাঁদের তো রাতে ঘুম হয় না। যেদিন আমার আসবার কথা ছিল সেই দিন Miss A ও Miss J তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেন নি। তার পরে হয়তো যখন তাঁরা শুনলেন যে, একটা পোষমানা জীব তাঁদের বাড়িতে এসেছে, সে ব্যক্তির চেহারা দেখে বোধ হয় না যে তার কখনও মানুষের মগজের লাড়ু, মানুষের ঠ্যাঙের শিক-কাবাব বা খোকাখুকিভাজা খাওয়া অভ্যেস ছিল— মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলংকার পরে না— তখন তাঁরা বাড়িতে ফিরে এলেন। Miss J বলেন যে প্রথম প্রথম এসে যদিও আমার সঙ্গে কথাবার্তা করেছিলেন তবুও দু দিন পর্যন্ত আমার মুখ দেখেন নি। হয়তো তাঁর ভয় হয়েছিল যে, কী অপূর্ব ছাঁচে ঢালা মুখই না জানি দেখবেন। তার পরে যখন আমার মুখ দেখলেন তখন? তখন কী? আমার তো বিশ্বাস, তখন তাঁর মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না যে এই মুখ দেখে কোনো চক্ষুষ্মান ব্যক্তির মাথা ঘুরতে পারে। কিন্তু সেটা তোমাদের ঘোরতর কুসংস্কার। ওই তো সুমুখের আয়নায় আমার মুখটা দেখতে পাচ্ছি। কেন, কী মন্দ? মুখ দেখে তোমাদের কার মাথা ঘোরে নি সত্যি, কিন্তু জিজ্ঞাসা করি— তোমাদের মাথা আছে?

 যা হোক, এই পরিবারে আমি বেশ সুখে আছি। সন্ধে বেলা বেশ আমোদে কেটে যায়—গান, বাজনা, বই পড়া। সকলের সঙ্গে ভারী বন্ধুত্ব হয়েছে। আর Ethel তার Uncle Arthurকে মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে চায় না।