বিষয়বস্তুতে চলুন

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/দশম পত্র

উইকিসংকলন থেকে

দশম পত্র

স্ত্রীস্বাধীনতা সম্বন্ধে সম্পাদক-মহাশয়ের সঙ্গে আমার ঝগড়াটা নিতান্তই চলল দেখছি। কিন্তু সে তো এক প্রকার সুখেরই বিষয়। বিষয়টা গুরুতর; সে সম্বন্ধে দু পক্ষের মতামত ব্যক্ত হয়ে একটা আন্দোলন হওয়াই প্রার্থনীয়। কিন্তু কথাটা যতই গুরুতর ও সারবান হোক-না, আমার গলার দোষে মারা যায় বা! অর্থাৎ সম্পাদক-মহাশয় পাছে তাঁর অত্যুচ্চ অট্টহাস্যের প্লাবনে আমার ক্ষীণকণ্ঠের কথাগুলো একেবারে ভেঙে-চুরে উলটে-পালটে তোলপাড় করে ভাসিয়ে নিয়ে যান, কথাগুলো একেবারে পাঠকদের কানে ভালো করে না পৌঁছয়। এখেনে একটা সেখেনে একটা তাঁর ছুঁচোলো নোটের হাস্যবিষাক্ত খোঁচা খেয়ে খেয়ে আমার গরিব ভালোমানুষ মতগুলি প্রাণের দায়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দেশছাড়া হয় বা! পাঠক-মহাশয়েরা আমার কথাটা একবার অবধান করুন; আর কিছু নয়, লেখক-মহাশয় আমার কথাটা আপনাদের ভালো করে শুনতে দিচ্ছেন না। আমি একটা কথা বলতে মুখ খোলবার উপক্রম করেছি কি, অমনি তিনি দশটা কথা কয়ে একটা ঘোরতর কোলাহল উত্থাপন করেছেন আর আমার কথাটা একেবারে মাথা তুলতে পারে নি। পাঠকমহাশয়েরা যদি এক পক্ষের কথা শুনতে না পান ও গোলেমালে একটা ভুল বুঝে যান তবে বড়ো দুঃখের বিষয় হবে।

 লেখক-মহাশয়ের নোটের বিরুদ্ধে আমার প্রধান নালিশ ছিল এই যে, আমি যে কথা বলি নি সেই কথা আমার মুখে বসানো হয়েছে। তার উত্তরে তিনি বলেন যে, ‘লেখক কী ভাবে কী কথা বলিয়াছেন তাহার প্রতি তত আমাদের লক্ষ নহে যত পাঠকেরা তাঁহার কথা কী ভাবে গ্রহণ করিবেন তাহার প্রতি।’ দোহাই পাঠক-মহাশয়দের, আমি এক কথা বললে আপনারা আর-এক কথা যদি শোনেন তবে আমি গরিব মারা যাই কেন? আমি যদি বলি বিশ্বস্তর বাবুর দুই পা আর আপনাদের মধ্যে কেউ শোনেন বিশ্বম্ভর বাবুর চার পা, তা হলে যদি সম্পাদকমহাশয় আমার চুলের ঝুঁটি ধরে বিধিমতে নিগ্রহ করেন ও দশটা শাস্ত্র থেকে প্রমাণ উদ্ধৃত করে দশ জন পশুতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতের মত নিয়ে আমাকে দশ ঘণ্টা ধরে গম্ভীর ভাবে বোঝাতে আরম্ভ করেন যে বিশ্বম্ভর বাবুর দুই পায়ের অধিক পা হবার কোনো প্রকার সম্ভাবনা নেই— শুদ্ধ তাই নয়, তাই নিয়ে হাসি-টিটকিরি ক’রে, ঠাট্টা-মসকরা ক’রে, দশ জন ভদ্রলোকের কাছে আমাকে বিধিমতে অপদস্থ করেন যদি—তবে আমি সহ্য করি কী করে বলুন দেখি! শাশুড়িরা যে ঝিকে মেরে বউকে শিক্ষা দেন, তাতে যে অনেক সময়ে অনেক উপকার হয় সে বিষয়ে আমি দ্বিরুক্তি করি নে, কিন্তু আপনারা কি অস্বীকার করতে পারেন যে, উপকারটা বউয়ের হোক কিন্তু যদি কারু পিঠে বেদনা হয় তো সে ঝিয়েরই। আচ্ছা, ভালো— আমার পিঠ বেকার অবস্থায় পড়ে আছে আর সম্পাদক-মহাশয়ের মুষ্টির যদি আর কোনো কাজ না থাকে তবে আমার নিরীহ পিঠের ওপর যথেচ্ছাচার করুন, কিন্তু এটা যেন মনে থাকে সে কিলগুলো প্রাপ্য আপনাদের, কেবল সম্পাদক-মহাশয়ের অপূর্ব বিচারে সে কিলের ভার যিশুখৃস্টের মতো আপনাদের হয়ে সমস্ত আমাকেই বহন করতে হচ্ছে।

 লেখক-মহাশয়ের সঙ্গে আমার একটা বিবাদ ছিল এই যে, তিনি স্বাধীনতা অর্থে বেহায়ামো, অবিনয়, অসরলতা, উচ্চের প্রতি অ-ভক্তিমত্তা, নীচের প্রতি অ-দয়াদাক্ষিণ্য প্রভৃতি ঠাউরেছেন কেন? তার উত্তরে তিনি যা বলেন তার ভাবটা হচ্ছে এই যে, পাছে পাঠকেরা তাই ঠাউরে থাকেন এই কারণ-বশতঃ, আর কিছু নয়! কিন্তু আমার অপরাধ? ‘লেখক বিলাতি বিবিদের চাল-চোলধরণ-ধারণের আনুষঙ্গিক-রূপে স্ত্রীস্বাধীনতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছেন, এজন্য বিলাতানভিজ্ঞ অধিকাংশ লোকের মনে এইরূপ একটা কুসংস্কার জন্মিতে পারে যে কার্যতঃ স্ত্রীস্বাধীনতা আর কিছু নহে, কেবল বিবিদিগের চাল-চোল-ধরণ-ধারণ ইত্যাদি। ইহা একটি লোকবিখ্যাত বিষয় যে, বিবিদের shoppingএর জ্বালায়, নির্দোষ (?) আমোদাসক্তির জ্বালায়, তাহাদের স্বামীরা ধনে প্রাণে মারা যায়, অথচ স্ত্রীস্বাধীনতার একটু কোথাও পাছে আঁচড় লাগে এই ভয়ে তাঁহারা সকল অত্যাচার ঘাড় পাতিয়া লন— সকল বিষ হজম করিয়া ফেলেন।’ ইত্যাদি। এর থেকে অনেক কথা উঠতে পারে। প্রথমতঃ সম্পাদক-মহাশয় তা হলে এই কথা বলেন যে, বিবিদের চাল-চোল-ধরণে অবিনয়, অসরলতা, বেহায়ামো, উচ্চের প্রতি অ-ভক্তিমত্তা, নীচের প্রতি অ-দয়াদাক্ষিণ্য প্রকাশ পায়; দ্বিতীয়তঃ, যেন আমি বিবিদের অবিনয় অসরলতা বেহায়ামো প্রভৃতির আনুষঙ্গিক স্বরূপেই স্ত্রীস্বাধীনতা উল্লেখ করেছিলুম। সম্পাদক-মহাশয় যে কেন বলেন, বিবিরা অবিনয়ী, অসরল, উচ্চের প্রতি তাদের ভক্তি নেই, নীচের প্রতি দয়াদাক্ষিণ্য নেই—তা সম্পাদক-মহাশয়ই জানেন। একমাত্র shoppingএর উদাহরণ দিয়ে তিনি ইংরেজ-মহিলাদের স্কন্ধে অতগুলো পাপের বোঝা চাপিয়েছেন। আমি ইংলন্‌ডে যতই বেশি দিন থেকেছি ততই সেখানকার ইংরেজ-পরিবারের মধ্যে ভালো করে মিশেছি, আমি যতদূর জানি তাতে এ কথা আমি মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি (অনেক পাঠক-মহাশয়ের অযথা দেশানুরাগে হয়তো আঘাত লাগতে পারে) যে, সম্পাদক-মহাশয় ইংরাজ মহিলাদের প্রতি যতগুলি দোষারোপ করেছেন তার কোনোটা সত্য নয়। কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ অভিধানে যদি বিনয় অর্থে যথাসাধ্য কথার উত্তর না দিয়ে, ঘোমটা টেনে, সংকোচে নিতান্ত ম্রিয়মাণ হয়ে বসে থাকা না হয় তা হলে ইংরেজ ভদ্রমহিলারা বিনয়ের আদর্শ। ইংরাজ পরিবারের মধ্যে এমন কত শত বালিকা (আমাদের দেশের পূর্ণযৌবনা) দেখা যায় যারা সরলতার প্রতিমা, যারা তুষারের মতো, নিজের শুভ্র ললাটের মতো নিষ্কলঙ্ক; নিষ্কলঙ্ক অর্থে শুদ্ধ কার্যতঃ নিষ্কলঙ্ক নয়, তাদের মন বিশুদ্ধ; ছেলেবেলা থেকে তাদের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস স্ফূর্তি পেয়েছে, দাসীদের কাছ থেকে বা অসৎমনা সমবয়স্কা প্রতিবেশিনীদের কাছ থেকে বিয়ের কথা, বরের কথা, সংসারধর্মের কথা বা কোনো রকম অসৎ কথা একটিমাত্র শোনে নি— সর্বদা হাস্যোচ্ছ্বাসময়ী। উচ্চের প্রতি ভক্তিমত্তা যদি বল তবে তা ইংলন্‌ডে যেমন আছে এমন অন্যত্র সচরাচর পাওয়া যায় কি না সন্দেহ। যেখেনে Carlyleকে গাড়ি চড়ে যেতে দেখলে কত শত রাস্তার লোক টুপি খুলে গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটেছিল— যেখানে কোথায় Shakespeare একটা গাছ পুঁতেছিলেন, কোথায় Addisonএর একটা চৌকি আছে, সে-সমস্ত লোকে একেবারে তীর্থস্থান করে তুলেছে— যেখেনে একজন কবির পাণ্ডুলিপি, একজন খ্যাত ব্যক্তির নিজের হাতের নামসই পেলে লোকে আপনাকে কৃতকৃতার্থ মনে করে— সেখেনে উচ্চের প্রতি ভক্তিমত্তা নেই কী করে বলব? আর সেই উচ্চের প্রতি ভক্তিমত্তা হতে সেখানকার স্ত্রীলোকেরাই যে বিশেষ বঞ্চিত এমন নয়। এ কথার উত্তর তেমন আর কিছু হতে পারে না যেমন, একটিবার বিলেতে যাওয়া। কেননা আমি বলব ‘না’, সম্পাদক-মহাশয় বলবেন ‘হাঁ’, আবার আমি বলব ‘না’, আবার তিনি বলবেন ‘হাঁ’— এমন করে যতক্ষণে না হাঁপিয়ে পড়া যায় ততক্ষণ হয়তো ‘হাঁ’ ‘না’ চালানো যেতে পারে। কিন্তু খুব সম্ভবতঃ এ বিষয়ে সম্পাদক-মহাশয়ের আমার চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞতা আছে, সুতরাং এমন স্থলে আমার চুপ করে থাকাই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু সম্পাদক-মহাশয়ের মতে যাই হোক, আমি কখনো বিবিদের অবিনয় অসরলতা ইত্যাদির আনুষঙ্গিকরূপে স্ত্রীস্বাধীনতার উল্লেখ করেছি কি না সেইটি বিবেচ্য স্থল। বিলেতে নিমন্ত্রণসভায় স্ত্রীপুরুষ সকলে মিলে নির্দোষ আমোদপ্রমোদ করে, একটা নতুন ভালো বই উঠলে সে বিষয়ে পরস্পর আপনাদের মতামত ব্যক্ত করে, একটা নতুন যন্ত্র উঠলে গৃহকর্তা তাই নিয়ে অভ্যাগত ব্যক্তিবর্গকে দেখান, গৃহকর্ত্রী রোমে গিয়েছিলেন, সেখানকার প্রসিদ্ধ স্থানের যে-সকল ফোটোগ্রাফ নিয়েছিলেন তাই দেখিয়ে সকলকে আমোদে রাখেন ইত্যাদি প্রসঙ্গ উপলক্ষে কথায় কথায় আমি স্ত্রীস্বাধীনতা সম্বন্ধে নিজের মত ব্যক্ত করি; এর থেকে যদি কোনো বিলাতানভিজ্ঞ ব্যক্তি মনে করে থাকেন যে, shopping করাকেই স্ত্রীস্বাধীনতা বলে বা বিলাতের মহিলারা যা কিছু মন্দ-আচরণ করেন (সত্যই হোক আর জনশ্রুতিই হোক) তারই নাম স্ত্রীস্বাধীনতা, তা হলে বেয়াদবি মাপ করবেন) তাঁদের মস্তিষ্কের দোষ জন্মেছে এ কথা স্বীকার করতেই হয়।

 সত্য-সত্য যা কিছু দোষ করি, একে তো তার জন্যই আমরা ইহকালে পরকালে দায়ী; কিন্তু যে দোষ করি নি তার জন্যেও যদি কৈফিয়ত দিতে হয় তা হলে সংসারের পায়ে গড় করি! সম্পাদকমহাশয় মহা খাপা হয়ে চক্ষু রাঙিয়ে বলছেন, ‘য়ুরোপ ভিন্ন আর কোথাও যে স্ত্রীস্বাধীনতা নাই এমন নহে— জাপানে আছে, বোম্বাইয়ে আছে, কিন্তু সে-সকল নিয়ে আন্দোলন করা লেখকের উদ্দেশ্য নহে। সর্বদেশসম্মত স্ত্রীস্বাধীনতার বিশুদ্ধ আদর্শ নিয়ে আলোচনা করাও লেখকের উদ্দেশ্য নহে। ইংলন‍্ডে যেরূপ স্ত্রীস্বাধীনতা প্রচলিত তাই যা কেবল লেখকের একমাত্র আলোচ্য বিষয়, এরূপ যখন— তখন ইংলন্‌ডের প্রচলিত স্ত্রীস্বাধীনতা যে কী ভয়ানক বস্তু, তাহা যে শত সহস্র স্থানে নামে স্বাধীনতা কাজে স্বৈরচারিতালেখক সে-সকল কথার উল্লেখ না করাতে প্রকারান্তরে বলা হইয়াছে যে বিবিদের অনুকরণ করিলেই আমাদের কুলরমণীরা স্বাধীনতাপথে বিচরণ করিতে পারিবেন।’ ইংলন্‌ডের ধান ভানতে গিয়ে আমি জাপানের বা বোম্বায়ের শিবের গান তুলব, সম্পাদক-মহাশয় যদি কখনো এ রকম আশা করে থাকেন তা হলে বলা বাহুল্য আমার মতো প্রকৃতিস্থ লোকের কাছে সে আশা করা দুরাশা। আমি চোখে চশমা এঁটে, চাপকান প’রে, জগতের অজ্ঞানতিমিরমোচন নিতান্ত মহামূল্য মতগুলি অনুগ্রহপূর্বক পাঠকদের বিতরণ করছিলুম না; আমি বৈঠকখানায় বসে পাঠক-মহাশয়ের সঙ্গে দু দণ্ড গল্পসল্প করছিলুম। একটা গল্প থেকে আর একটা গল্প ওঠে। একটা নিমন্ত্রণসভা বর্ণনা করে সেই সূত্রে স্ত্রীস্বাধীনতার কথা আমার মনে এল, সে বিষয়ে আমার যা-কিছু বক্তব্য ছিল সব বলে ফেললুম। আমার সে বক্তব্যের মধ্যে ইংলন‍্ডের স্ত্রীস্বাধীনতার উল্লেখমাত্র ছিল না, আর, সত্যের খাতিরে সম্পাদক-মহাশয়ের কাছে নিতান্ত লজ্জার সহিত স্বীকার করতে হচ্ছে, জাপানের ও বোম্বায়ের স্ত্রীস্বাধীনতা আমার মনেও আসে নি। মনে আসে নি— অপরাধ হয়েছে বটে! তা, সম্পাদকীয় বেত্রাঘাতে মনে না আসবার জন্যে যথেষ্ট শাস্তিও পেয়েছি। আচ্ছা, নাহয় এবার থেকে আমি যখনি স্ত্রীস্বাধীনতার কথা ভাবব তখনি জাপান ও বোম্বায়ের কথা মনে করতে ভুলব না। সে কথা যাক, আমার মত হচ্ছে এই যে, বুট জুতো পরাকেও স্ত্রীস্বাধীনতা বলে না, গৌন পরাকেও স্ত্রীস্বাধীনতা বলে না, আর মটন দিয়ে রাই খেলেও স্ত্রীস্বাধীনতার ব্যত্যয় হয় না। যদি কোনো পাঠক এমন বুঝে থাকেন যে, বিবিরা যা করে তাই স্ত্রীস্বাধীনতা ও সেইজন্যে আমার প্রতি মহা রুক্ষ হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁকে আমার বিনীত নিবেদন এই যে, এই ভুল বোঝা সম্বন্ধে যদি কারু কোনো দোষ থাকে তো সেটা তাঁর বুদ্ধির। তাঁর কানের যদি এমন একটা সৃষ্টিছাড়া রোগ হয়ে থাকে যে, যা তাঁকে বলা যায় নি তা তিনি শোনেন তা হলে সে কান-দুটো যতক্ষণে না বিশেষরূপে মেরামত করা হয় ততক্ষণ তাঁর সঙ্গে আমার মতো লেখক কোনো এলাক্কা রাখেন না। যা হোক, আমি যদি বলি যে, ইংরাজ বিবিয়ানাকে স্ত্রীস্বাধীনতা বলে না (কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলি, জাপান-বিবিয়ানা বা বোম্বাই-বিবিয়ানাকেও স্ত্রীস্বাধীনতা বলে না) তা হলেই বোধ করি সম্পাদকমহাশয়ের সঙ্গে ও সম্বন্ধে আমার বিবাদটা চুকে গেল। কেননা সম্পাদক-মহাশয় একপ্রকার স্বীকারই করেছেন যে বিবিদের বিষাক্ত (!) অশোভন (!!) স্বাধীনতা পরিত্যাগ করে যদি ‘নির্বিষ শোভন’ স্বাধীনতা লেখক প্রচার করেন তা হলে তিনি তা আদরের সহিত গ্রহণ করবেন। অনর্থক একটা ভুল বোঝার দরুন গোড়াতেই তিনি তা করতে পারেন নি। ভালো, এখন তো সব মিটমাট হয়ে গেল— তবে এখন স্বস্তিবাচন-পূর্বক স্বাগতসম্ভাষণ করে আমার মতটিকে আদরের সহিত ঘরে নিয়ে যাওয়া হোক— দরজা থেকেই হাঁকিয়ে না দেওয়া হয়।

 সম্পাদক-মহাশয়ের সঙ্গে সাধারণ বিষয়ে তো এক রকম ঐক্য হল, এখন বিশেষ বিশেষ বিষয়ে এমনি ভালোয় ভালোয় মতের মিল তা হয়ে গেলে বড়ো খুশি হওয়া যায়। সম্পাদক-মহাশয় তো বললেন ‘নির্বিষ’ স্ত্রীস্বাধীনতার সঙ্গে তাঁর কোনো মনান্তর নেই; এখন কাকে তিনি ‘নির্বিষ স্ত্রীস্বাধীনতা’ বলেন সেইটে মীমাংসা হয়ে গেলেই অধিক বক্তব্য থাকে না সম্পাদক-মহাশয়ের লেখা দেখে বোধ হয়, স্ত্রীপুরুষের মধ্যে আলাপ মাত্র হওয়া তাঁর মতে প্রার্থনীয় নহে,[] কেননা ‘তাহাতে পাছে কু লোকে কু ভাবে, সু লোকে কু ভাবে ও স্বামীর মনে কু-আশঙ্কা স্থান পায়।’ তা যদি হয় তা হলে বাইরের কিছু দেখবার জন্যে মহিলাদের অন্তঃপুর থেকে বের হওয়াও প্রার্থনীয় নয়— কেননা পাছে তাতে করে ‘কু লোকে কু ভাবে, সু লোকে কু ভাবে, ও স্বামীর মনে কু-আশঙ্কা স্থান পাবার কোনো কারণ ঘটে।’[] তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, আমাদের দেশে স্ত্রীলোকের যতটুকু স্বাধীনতা আছে তাই ‘নির্বির্ষ’ স্বাধীনতা। কেন, তাঁদের তো নিশ্বাস ফেলবার স্বাধীনতা আছে, সেটা একটা ‘নির্বিষ স্বাধীনতা’; হাই তোলবার ও পান সাজবার স্বাধীনতা আছে, সেটা আর-একটা ‘নির্বিষ স্বাধীনতা’; আহার করবার স্বাধীনতা আছে, যদি কেউ আড়ি ক’রে তাতে বিষ না মিশিয়ে দেয় তা হলে সেটাও একটা ‘নির্বিষ স্বাধীনতা’! তা হলে তো আমাদের অনেক পরিশ্রম বেঁচে গেল, আর কিছু করবার নেই। কিন্তু সেইটে গোড়ায় বললেই তো হত। এটা কিরকম হল জানো? করুণরসে নিতান্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে একজন গরিবকে বলা হল, ‘আমার পকেটে যা আছে, বাপু, সব তুই নে।’ অথচ পকেটে একটি সিকি পয়সা মাত্র নেই। ভাগ্যি ছিল না, তাই তো এতটা করুণরসের কথা শোনা গেল। ‘পাছে কু লোক কু ভাবে ও সু লোক কু ভাবে এইজন্যেই কোনো স্ত্রীলোকের কোনো পরপুরুষের সহিত মেশা অবৈধ’— এর চেয়ে অযৌক্তিক কথা সচরাচর শোনা যায় না। এমন কী কাজ করা যেতে পারে যা কু লোকে কু না ভাবতে পারে, এমন-কি সু লোকের কু ভাবতে আটক থাকে? বলো-না কেন, আহার করা অবৈধ—দুধেতে প্রুসিক আসিড মেশানো থাকতে পারে, মাছের ঝোলে খানিকটা আফিম গোলা থাকতে পারে, আর ভাতের মধ্যে খানিকটা হোর্ভেল থাকাও নিতান্ত অসম্ভব নয়। যদি সম্পাদক-মহাশয় বলতেন পরপুরুষের সঙ্গে এমন করে মেশা কর্তব্য নয় যাতে করে সাধারণতঃ প্রকৃতিস্থ লোকে স্বভাবতই কু ভাবতে পারে, সে এক স্বতন্ত্র কথা হত; কিন্তু পাছে লোকে কু ভাবে সেইজন্যে একেবারে পরপুরুষের সঙ্গে মেশাই কর্তব্য নহে এ যে বড়ো ভয়ানক কথা! যদি বলো এমন স্থলে সাবধানে আহার করা উচিত যেখানে খাদ্যে বিষ থাকবার যথার্থ সম্ভাবনা আছে, তা হলে কথাটা মানি; কিন্তু খাদ্যে বিষ থাকা অসম্ভব নয় ব’লে আহার বন্ধ করতে পরামর্শ দিলে— আর যে-কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই তা পালন করুন-না কেন, আমি করি নে।[] পাছে ‘স্বামীর মনে কু-আশঙ্কা স্থান পায়’ এ সম্বন্ধেও পূর্বোক্ত কথাটা খাটে, অর্থাৎ পরপুরুষের সহিত যদি এমন করে মেশা যায় যাতে করে স্বামীর মনে কু-আশঙ্কা স্থান পাবার সম্ভাবনা থাকে তা হলে তার থেকে হানি হতে পারে, নতুবা নয়। সম্পাদক-মহাশয় বলেন ‘স্বামীর হয়তো এইরূপ একটা মাত্রা নির্ধারিত আছে যে, পরপুরুষের সহিত স্ত্রীলোকের এইটুকু মেলামেশাই ভালো, তাহা অপেক্ষা বেশি ঘনিষ্ঠতা ভালো না। যে স্ত্রী স্বামীকে ভালোবাসে সেই স্ত্রী সেই মাত্রাটি অতিক্রম করিয়া স্বামীর মনে আঘাত দিতে কুণ্ঠিত হইবে না তো কে হইবে?’ সত্যই তো। সচরাচর তো এমন হয়েই থাকে। jealous স্বামীরা পাছে মনে আঘাত পায় এইজন্যে তো য়ুরোপে অনেক হতভাগ্য রমণী ইচ্ছা করেই হোক বা শাসনভয়েই হোক সমাজে মেশে না। এখানেও অনেক সময়ে তাই ঘটবে। রমণীদের জীবন পর্যন্ত যখন স্বামীর ওপর নির্ভর করে তখন স্বামীর মন জুগিয়ে চলবার জন্যে প্রাণপণ করতে, ভালোবাসায় না হোক, দায়ে পড়ে হয়। সম্পাদক-মহাশয় বলেন ‘সে মাত্রা (মেলামেশার মাত্রা) কতটুকু স্বামীই তাহা জানে, স্ত্রী তাহা জানে না’। সে কী কথা! স্ত্রী তাহা জানে না এমনও হয়? হতে পারে, কোনো স্ত্রীবিশেষ কোনো স্বামীবিশেষের মনের ভাব ভালো করে বুঝতে পারে নি; কী করা যাবে বলো? তার জন্যে তাকে কষ্ট সইতেই হবে। কিন্তু তাই বলে চুলটা কাটতে মাথাটা কাটবে কে বলো? দু চার জনের জন্যে সকলে কষ্ট পাবে কেন? অন্তঃপুরবদ্ধ এমন তো অনেক স্ত্রীলোক আছে যারা স্বামীর মনের ভাব ভালো করে আয়ত্ত করতে পারে নি বলে পদে পদে কষ্ট পায়, তবে কি তুমি বিবাহটা একেবারে উঠিয়ে দেবে! অতএব কথা হচ্ছে এই যে, পরপুরুষের সহিত এমন করে মেশা উচিত নয় যাতে করে স্বামীর মনে কু-আশঙ্কা স্থান পায় ও সাধারণতঃ প্রকৃতিস্থ কু লোক বা স্থ লোকে ন্যায্যরূপে কু ভাবতে পারে। এতেও একটা ‘কিন্তু’ আছে। লোকের কু ও সু ভাবা অনেক সময়ে আবার দেশাচারের ওপর নির্ভর করে। একজন স্ত্রীলোক অতি ফিফিনে শান্তিপুরে শাড়ি পরলে কু লোকেও কু ভাবে না, হু লোকেও কু ভাবে না, স্বামীর মনেও কু-আশঙ্কা স্থান পায় না, কিন্তু সে যদি সেই ফিনফিনে শাড়িতে দৈবাৎ ঘোমটা দিতে ভুলে যায় তা হলে কু লোকেও কু ভাবে, সু লোকেও কু ভাবে, আর স্বামীর মনেও হয়তো কু-আশঙ্ক। স্থান পায়! অতএব নিরর্থক দেশাচারের পান থেকে একটু চুন খসলে যদি কু লোকে কু বা সু লোকে কু ভাবে, তা হলে সেটা গ্রাহ্য করা যাবে না। আজ আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে খোলা গাড়িতে একটু হাওয়া খেয়ে এলুম ব’লে যদি লোকে কু বলে তা তারা বলুক, কিন্তু যদি আমার স্ত্রী কোনো এক পুরুষের বাড়িতে সমস্ত দিন বা রাত্রি যাপন করে আসে তা হলে লোকে যদি কু ভাবে তা হলে সে কু ভাবাকে যথার্থ একটু সমীহ করে চলতে হয়। সম্পাদক-মহাশয় নানা উদাহরণ প্রয়োগ করে রাজকীয় স্বাধীনতা সম্বন্ধে যা বললেন, সে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার মতের ঐক্য হয়। উদ্ধত গর্বিত বিকৃত নীচস্বভাব অ্যাংগ্লো-ইন্‌ডিয়ানরা আমাদের যে রকম নিচু নজরে দেখে তারা যে আপনাদের স্বজাতি-প্রচলিত গ্যালাণ্ট্রি আমাদের পুরস্ত্রীদের প্রতি প্রয়োগ না করবে— তা আশ্চর্য নয়। কিন্তু তাতে বিশেষ কী এল গেল? স্ত্রী পুত্র পরিবার সমেত লাঙুল নাড়তে নাড়তে একটা গর্বস্ফীত অ্যাংগ্লো-ইন্‌ডিয়ানের পা চাটতে যাবার প্রয়োজন কী? অধীনতার প্রতি আমাদের যে রকম অনুরাগ, খোসামোদ আমাদের যে রকম উপজীব্য হয়ে উঠেছে, তাতে হয়তো আমাদের অনেকে স্ত্রীকন্যাগণকে স্বচ্ছন্দে একজন শ্বেতবদনের কাছে নিয়ে যাবেন, যদিও হয়তো নিজের কৃষ্ণচর্ম বন্ধুর কাছে বের করতে কুণ্ঠিত হবেন! সে রকম স্থলে তাঁরা ঠেকে শিখবেন। যদি আপনাদের নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করবার বল না থাকে তা হলে নাহয় ট্রেনে প্রভৃতি যাবার সময় বন্ধসন্ধ করে নিয়ে যাবেন, অ্যাংগ্লো-ইণ্ডিয়ান্‌দের কাছ থেকে সহস্র হস্ত দূরে থাকবেন। আমি বলি কি, আমাদের আপনাদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে স্ত্রী পুরুষে পরস্পর মেলা-মেশা আলাপ-পরিচয় হোক। নিমন্ত্রণসভায় স্ত্রীলোকেরা উপস্থিত থাকুন। যেখানে নানা প্রকার বিষয় আলোচনা চলছে সেখেনে তাঁরাও যোগ দেন। এই প্রকারে সংকীর্ণস্থানবদ্ধ তাঁদের কুঞ্চিত মন বিস্তার লাভ করুক, স্বাধীন মুক্তবায়ু-সেবনে স্বাস্থ্য উপভোগ করুন।


  1.   ইহা কোনো কালেই আমাদের অভিপ্রেত নহে— আমরা প্রখর স্ত্রীস্বাধীনতার বিরোধী, এই পর্যন্ত। প্রখর স্ত্রীস্বাধীনতা কাহাকে বলে তাহার সংজ্ঞা নির্দেশ করিবার প্রয়োজন নাই। ভা. স.
  2.   আমাদের দেশে স্ত্রীস্বাধীনতা নাই, সুতরাং স্ত্রীস্বাধীনতাকে কতরূপে যে মারপ্যাচ হইতে বাঁচাইয়া চলিতে হয় সে বিষয়েও তাঁহাদের অভিজ্ঞতা নাই, এমত স্থলে যদি ‘স্ত্রী-স্বাধীনতা চাই-ই চাই’ এই ভাবটি তাঁহাদের মনের ভিতর প্রবিষ্ট করিয়া দিয়া তাঁহাদিগকে খেপাইয়া তোলা হয়, তবে যাঁহারা ঐ মতানুসারে কার্য করিতে প্রবৃত্ত হইবেন তাঁহারা স্ত্রীস্বাধীনতার যে-একটি ভালো আদর্শ আছে তাহা অমান্য করিয়া প্রথর স্ত্রীস্বাধীনতার দিকেই আপনাদের সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি বল পৌরুষ প্রয়োগ করিবেন ইহা সম্ভব বোধ হয়; এইজন্য আমরা বলিতে চাই যে, যখনই স্ত্রী ও পুরুষদিগের মধ্যে মেলামেশার কথা উত্থাপন করা হয় তখনই এই বিষয়ে পাঠককে সাবধান করিয়া দেওয়া উচিত যে, স্ত্রীস্বাধীনতা মাত্রা অতিক্রম করিলে তাহা ঘোরতর বিষাক্ত হইয়া উঠে। ভা. স.
  3.   স্ত্রীস্বাধীনতা মাত্রা অতিক্রম করিলে তাহা দোষাক্রান্ত হয় ইহা লেখক স্বীকার করেন— সে মাত্রা যে কতটুকু তাহা গড়ে জনসাধারণে বিদিত আছে, তাহার কোনো বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সম্ভবে না। ভা. স.