য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/ষষ্ঠ পত্র

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পত্র

আমাদের ব্রাইটনের বাড়িটি সমুদ্রের কাছে একটি নিরালা জায়গায়, এক সার ২০।২৫টি বাড়ি, বাড়িগুলির নাম হচ্ছে Medina Villas। Villa শুনলে তোমাদের হঠাৎ মনে হবে বাগানবাড়ি। আমি লন‍্ডনে থেকে যখন প্রথম শুনলুম যে, আমরা মেদিনা ভিলায় বাস করতে যাচ্ছি তখন কত কী কল্পনা করেছিলুম তার ঠিক নেই— বাগান, গাছ, পালা, ফল, ফুল, মাঠ, সরোবর ইত্যাদি। বাড়িতে এসে যে দিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই বাড়ি, ঘর, রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া— ‘ভিলা’ত্বর মধ্যে আমাদের বাড়ির সামনে দু-চার হাত জমিতে ছু-চারটে গাছ পোঁতা আছে। বাড়ির দরজায় একটা লোহার কড়া (knocker) লাগানো আছে, সেইটেতে ঠক্ ঠক্ করলেম, আমাদের landlady এসে দরজা খুলে দিলে। আমাদের

দেশের তুলনায় এখানকার ঘরগুলো লম্বা চৌড়া ও উঁচুতে ঢের ছোটো। ছোটো ছোটো ঘরগুলো চার দিকে জানলা-বন্ধ, একটু বাতাস আসবার জো নেই, কেবল জানলাগুলো সমস্ত কাঁচের ব’লে আলো আসে। শীতের পক্ষে এ রকম ছোটোখাটো ঘরগুলো খুব ভালো, একটু আগুন জ্বাললেই সমস্ত বেশ গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু তা হোক— যে দিন মনে করো মেঘে চারি দিক অন্ধকার হয়ে গেছে, টিপ্ টিপ্‌ করে বৃষ্টি পড়ছে, তিন-চার দিন ধরে মেঘ বৃষ্টি অন্ধকারের এক মুহূর্ত বিরাম নেই, সে দিন এই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটার এক কোণে বসে আমার মনটা অত্যন্ত বিগড়ে যায়, কোনোমতে সময় কাটে না; এক, দুই, তিন ক’রে গুনে গুনে দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। খালি আমি ব’লে নয়, আমার ইংরেজ আলাপীরা বলেন সে রকম দিনে তাঁদের অত্যন্ত swear করার প্রবৃত্তি জন্মায়, (swear করা রোগটা সম্পূর্ণ য়ুরোপীয়, সুতরাং ওর বাঙ্গালা কোনো নাম নেই)— মনের ভাবটা অধার্মিক হয়ে ওঠে। ঘরগুলো যদি আরও একটু দরাজ হত তা হলেও মনের এ রকম খুঁৎখুঁতে ভাব অনেকটা দূর হত। ছোটো হোক, ঘরগুলো যথেষ্ট সাজানো; ছবি টেবিল চৌকি কৌচ ফুলদানি পিয়ানো ইত্যাদি গৃহসজ্জা। প্রায় প্রতি ঘরে এক-একটা বড়ো বড়ো আয়না আছে, খেতে শুতে বসতে নিজের মুখ দেখতে পাওয়া যায় —সুশ্রী মানুষের পক্ষে এ রকম মন্দ নয়, কিন্তু প্রতি পদে এই কালো মূর্তি দেখলে আয়নাগুলো ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। যত মনে করি সাহেব হয়েছি, ‘নেটিব’ত্ব যতই ভুলে যেতে চেষ্টা করি, ততই যে ঘরে যাই চার দিক থেকে আয়নাগুলো আমাদের কালো মুখ প্রকাশ করে যেন ভেংচাতে থাকে— এক এক সময় জ্বালাতন হয়ে উঠতে হয়। এখানকার বাড়িগুলো আমাদের দেশের কোঠাবাড়ির মতো তেমন মজবুত নয়, বাড়ির অধিকাংশ কাঠের। আমাদের দেশে এ রকম বাড়ি হলে বোধ হয় উইয়ে হজম করে ফেলে, বাতাসের ফুঁয়ে উড়ে যায়। যা হোক, এখানকার ঘরদুয়ারগুলি বেশ পরিষ্কার করে রাখে; বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে আর কোথাও এক তিল ধুলো দেখবার জো নেই, মেঝের সর্বাঙ্গ কার্পেট প্রভৃতি দিয়ে মোড়া, সিঁড়িগুলি পরিষ্কার তক্ তক্ করছে কোথাও একটুখানি দাগ নেই। আমাদের দেশের পরিষ্কারের সঙ্গে এখানকার পরিষ্কারের অনেকটা তফাত আছে। শিল্পজ্ঞান সৌন্দর্যজ্ঞান থেকে এখানকার লোকদের পরিষ্কার ভাবের জন্ম, আমাদের পরিষ্কার-ভাব বলে যেন একটা স্বতন্ত্র মনোবৃত্তি আছে। চোখে দেখতে খারাপ হলে এরা সইতে পারে না। প্রতি সামান্য বিষয়ে এদের ভালো দেখতে হওয়াটা প্রধান আবশ্যক। প্রতি পদে এরা সৌন্দর্যচর্চা করে। এখানকার পুরুষেরা টুপি খুলে সম্মান প্রদর্শন করে, কিন্তু এমন করে খোলে যাতে সেই সামান্য টুপি খোলাতেও শ্রী প্রকাশ পায়। বিশেষতঃ এখানকার মেয়েরা প্রতি হাত পা নাড়ায় শ্রীর প্রতি লক্ষ করে। কিছু নেবার জন্যে হাত বাড়ালে এমন করে বাড়ায় যাতে সুন্দর দেখায়, খাবার সময়ে এতটুকু মুখ মোছে যাতে খারাপ না দেখায়, পাছে লম্ব। পদক্ষেপ হয় ব’লে বিবিদের এক রকম নতুন ফেসানের কাপড় উঠেছে তাতে তাদের হাঁটুর কাছটা বাঁধা থাকে। এমন-কি আমি সম্প্রতি দুই-একটা কাগজে দেখতে পাই, একজন কাপড়ওয়ালা খুবভালো-দেখতে mourning dressএর বিজ্ঞাপন দিয়েছে, শোকবস্ত্রও সুশ্রী দেখতে হওয়া আবশ্যক। দোকান থেকে যা-কিছু জিনিস আসে তা সুশ্রী করে মোড়া থাকে, দোকানদারেরা এ রকম করে মোড়ার খরচটা অপ্রয়োজনীয় মনে করে না— যা দুদণ্ডের বেশি ব্যবহার করতে হবে না তাও সুন্দর দেখতে হওয়া আবশ্যক। এই রকম প্রতি পদে এদের শিল্পচর্চার উন্নতি হয়। প্রথম হয়তো এই রকম সুশ্রী অঙ্গচালনা প্রভৃতি অভ্যাসসাধ্য, কিন্তু ক্রমে সেটা স্বাভাবিক হয়ে যায় ও বংশাবলীক্রমে সংক্রামিত হতে থাকে। এ রকম শিল্পচর্চার ভাব খুব ভালো তার আর সন্দেহ নেই, কিন্তু একটা স্বতন্ত্র পরিষ্কারের ভাব থাকাও আবশ্যক। এখানকার লোকেরা খাবার পরে আঁচায় না; কেননা, আঁচানো-জল মুখ থেকে পড়ছে, সে অতি কুশ্রী দেখায়। শ্রীহানি হয় বলে পরিষ্কার হওয়া হয় না। এখানে যে রকম কাশি সর্দির প্রাদুর্ভাব তাতে ঘরে একটা পিকদানি নিতান্ত আবশ্যক, কিন্তু সে অতি কুশ্রী পদার্থ বলে ঘরে রাখা হয় না— রুমালে সমস্ত কাজ চলে। আমাদের দেশের যে রকম পরিষ্কার-ভাব তাতে আমরা বরঞ্চ ঘরে একটা পিকদানি রাখতে পারি, কিন্তু জামার পকেটে এ রকম একটা বীভৎস পদার্থ রাখতে ঘৃণা হয়। কিন্তু এখানে চোখেরই আধিপত্য। রুমাল কেউ দেখতে পাবে না, তা হলেই হল। চুলটি বেশ পরিষ্কার করে আঁচড়ানো থাকবে, মুখটি ও হাত দুটি বেশ সাফ থাকবে, তা হলেই লোকে সন্তুষ্ট থাকে— স্নান করবার বিশেষ আবশ্যক নেই। এখানে জামার উপরে অন্যান্য অনেক কাপড় পরে ব’লে জামার সমস্তটা দেখা যায় না, খালি বুকের ও হাতের কাছে একটু বেরিয়ে থাকে। এক রকম জামা আছে, তার যতটুকু বেরিয়ে থাকে ততটুকু জোড়া দেওয়া, সেটুকু খুলে ধোবার বাড়ি দেওয়া যায়। তাতে সুবিধা হচ্ছে যে, ময়লা হয়ে গেলে জামা বদলাবার কোনো আবশ্যক করে না, সেই জোড়া টুকরোগুলো বদলালেই হল। এখানকার দাসীদের কোমরে এক apron বাঁধা থাকে, সেইটি দিয়ে তাঁরা না পৌঁছেন এমন পদার্থ নেই। খাবার কাঁচের প্লেট যে দেখছ ঋক্ ঋক্ করছে সেটিও সেই সর্বপারক apronটি দিয়ে মোছা হয়েছে। কিন্তু তাতে কী হানি, দেখতে তো কিছু খারাপ দেখাচ্ছে না। এখানকার লোকেরা কিছু অপরিষ্কার নয়; আমাদের দেশে যাকে ‘নোংরা' বলে, তাই। আমাদের দেশের পরিষ্কার ও এখানকার পরিষ্কারের একটা মিলন হলেই বেশ সর্বাঙ্গসুন্দর মিলন হয়। ভালো দেখতে হওয়ার প্রতি আমাদের অত্যন্ত কম লক্ষ; কিন্তু তার প্রধান কারণ আমরা গরিব। শিল্পের দিকে মনোযোগ দেবার আমাদের অবসর নেই। এখানে পরিষ্কার ভাবের যে অভাব আমরা দেখতে পাই, সে অনেকটা শীতের জন্যে। আমরা, যে-কোনো জিনিস হোক্‌-না কেন, জল দিয়ে পরিষ্কার না হলে পরিষ্কার মনে করি নে। এখানে অত জল নিয়ে নাড়াচাড়া পোষায় না। তা ছাড়া শীতের জন্য এখানকার জিনিসপত্র শীঘ্র ‘নোংরা’ হয়ে ওঠে না। আমাদের দেশে প্রায় সর্বদা গা খোলা থাকে, তা ছাড়া গর্মিতে এমন অপরিষ্কার হয়ে উঠতে হয় যে, না নাইলে তিষ্ঠোবার জো নেই। এখানে শীতে ও গায়ের আবরণ থাকাতে শরীর তত অপরিষ্কার হয় না। এখানে জিনিসপত্র পচে ওঠে না। এই রকম পরিষ্কারের পক্ষে নানা বিষয়ে সুবিধে। আমাদের দেশে যে রকম পরিষ্কারের ভাব আছে, তেমনি পরিষ্কার হওয়ার বিষয়ে অনেক কুসংস্কারও আছে। মনে করো আমাদের দেশের পুষ্করিণীতে কী না ফেলে? সে তৈলাক্ত অপরিষ্কার জলকুণ্ডে স্নান করলে আবার স্নান করবার আবশ্যক হয়। তেল মেখে জলে দুটো ডুব দিলেই আমরা গা সাফ হল মনে করি। আমরা নিজের শরীর ও খাওয়াদাওয়।—সংক্রান্ত জিনিসের বিষয়ে বিশেষ পরিষ্কার থাকি, কিন্তু ঘর হুয়ার যথোচিত পরিষ্কার করি নে। আমাদের চার দিক এই রকম অপরিষ্কার থাকে বলে আমাদের স্বাস্থ্যও খারাপ। যা হোক, এ বিষয়ে আর অধিক বক্তৃতা দেব না। অন্যান্য দুই-এক কথা বলি।

 আমাদের দুই-একটি করে আলাপী হতে লাগল। ডাক্তার M একজন আধবুড়ো চিকিৎসাব্যবসায়ী। তিনি একজন প্রকৃত ইংরাজ। ইংলন্‌ডের বহির্ভূত কোনো জিনিস তাঁর পছন্দসই নয়। তাঁর কাছে ক্ষুদ্র ইংলন্‌ডই সমস্ত পৃথিবী, তাঁর কল্পনা কখনো Dover Channel পার হয় নি। আমাদের তিনি অত্যন্ত কৃপাচক্ষে দেখতেন, বোধ হয় তার প্রধান কারণ— আমাদের ইংলন্‌ডে জন্ম হয় নি। তাঁর কল্পনার এমন অভাব যে, তিনি মনে করতে পারেন না যারা Ten Commandments মানে না তাদের মিথ্যে কথা বলতে কী করে সংকোচ হতে পারে? অখ্রীস্ট লোকদের নীতির বিরুদ্ধে এই তাঁর প্রধান যুক্তি। যে ইংরাজ নয়, যে খ্রীস্টান নয়, এমন একটা অপূর্ব-সৃষ্টি দেখলে তাঁর কল্পনা অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়ে; তার মনুষ্যত্ব কী করে থাকতে পারে ভেবে পান না। তাঁর motto হচ্ছে: Gladly he would learn and gladly teach কিন্তু আমি দেখলুম তাঁর learn করবার ঢের আছে, কিন্তু teach করবার মতো সম্বল খুব কম। তাঁর স্বদেশীয় সাহিত্যের বিষয়ে তিনি আশ্চর্য কম জানেন; কতকগুলি মাসিক পত্রিকা পড়ে প্রতি মাসে দুই-চারিটি করে ভাসা-ভাসা জ্ঞান লাভ করেন। ক্রমশ জানতে পারলুম, তিনি আমাদের মনে মনে uneducated বলে জানেন, কেননা তিনি কল্পনা করতে পারেন না একজন Indian কী করে educated হতে পারে। এখানকার বিবিরা শীতকালে হাত গরম রাখবার জন্যে এক রকম গোলাকার পদার্থের মধ্যে হাত গুঁজে রাখে তাকে muff বলে, প্রথম বিলেতে এসে সেই অপূর্ব পদার্থ যখন দেখি তখন Dr.Mকে সে দ্রব্যটা কী জিজ্ঞাসা করি। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন, muff পদার্থটা আমি জানি নে শুনে তিনি ভেবে খুন। এর চেয়ে educationএর অভাব কী হতে পারে বলো। muff বলে একটা সামান্য পদার্থ, যা বিলেতের একটা সামান্য অশিক্ষিত চাষা পর্যন্ত দেখলে বলে দিতে পারে, তা আমি জানি নে! এমন ভয়ংকর ভোঁতা কল্পনা আমি আর কখনো দেখি নি। কিন্তু আমি এখানকার অনেক লোকের রোগ দেখিছি, তাঁরা আশা করেন আমরা তাঁদের। সমাজের প্রতি ছোটোখাটো বিষয় জানব। একদিন একটা নাচে গিয়েছিলুম, একজন বিবি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বধূটিকে (bride) তোমার কিরকম লাগছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘নববধূটি কে?’ অতগুলি মেয়ের মধ্যে একজন নববধূ কোথায় আছেন তা আমি কিছুই জানতুম না। শুনে সে বিবিটি একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলেন; তিনি বললেন, ‘তাঁর মাথায় orange blossom দেখে চিনতে পার নি?’ আমার অপ্রস্তুত হবার কোনো কথা ছিল না, কিন্তু বিবিটি যে রকম আশ্চর্য হয়ে উঠেছিলেন তাতে আমাকে খানিকটা অপ্রস্তুত হতে হল। থতমত খেয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ওঁর স্বামী সঙ্গে এয়েছেন?’ বিবিটি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘স্বামী আসেন নি। নববিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী নেই!’ আমি ভয় পেয়ে ভাবলেম, আর অধিক প্রশ্ন করা শ্রেয় নয়। বিবিটি ভাবলেন, ‘কোথাকার একটা নিউজিলান‍্ডরের সঙ্গে কথা কচ্ছি। এ orange blossom দেখে bride চিনতে পারে না, আবার জিজ্ঞাসা করে bride এর সঙ্গে স্বামী এয়েছে কিনা! Shocking!’ তাঁরা মনে করেন, এত সামান্য বিষয় আমাদের আত্মপ্রত্যয় থেকে জানা উচিত। এই রকম এখানকার অনেক লোকের ভাব দেখিছি। যা হোক, Dr. Mএর কাছে এই রকম অনেক বিষয়ে আমার educationএর অভাব প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি সহজেই মনে করেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি muff কাকে বলে জানে না সে যে Shakespeare পড়েছে সে absurd!’

 দুই মিস Kর সঙ্গে আলাপ হল। তাঁরা এখানকার পাদ্রির মেয়ে। পাড়ার পরিবারদের দেখাশুনো, Sunday Schoolএর বন্দোবস্ত করা, working menদের জন্যে Temperance সভা স্থাপন ও তাদের আমোদ দেবার জন্যে সেখানে গিয়ে গান বাজনা করা— এই-সকল কাজে তাঁরা দিন রাত্রি ব্যস্ত আছেন। বিদেশী বলে আমাদের তাঁরা অত্যন্ত যত্ন করতেন। নগরে কোথাও আমোদ উৎসব হলে আমাদের খবর দিতেন, আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, অবসর পেলে সকালে কিম্বা সন্ধ্যে বেলায় এসে আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন, ছেলেদের নিয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে গান শেখাতেন, এক-এক দিন তাঁদের সঙ্গে রাস্তায় বেড়াতে যেতুম। এই রকম আমাদের যথেষ্ট যত্ন ও আদর করতেন। বড়ো Miss K অত্যন্ত ভালো মানুষ ও গম্ভীর। একটা কথার উত্তর দিতে কেমন থতমত খেতেন। ‘হাঁ—না— তা হবে— জানি নে’ এই রকম তাঁর উত্তর। এক-এক সময় কী বলবেন ভেবে পেতেন না, এক-এক সময় একটা কথা বলতে বলতে মাঝখানে থেমে পড়তেন, আর কথা জোগাত না— সুতরাং বাকিটুকু আমাদের কল্পনার ওপর রেখে দিতেন। তাঁকে কোন বিষয়ে তাঁর মত জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিব্রত হয়ে পড়তেন। তাঁকে যদি জিজ্ঞাসা করা যেত ‘আজ কি বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে?’ তিনি বলতেন, ‘কী করে বলব!’ তিনি বুঝতেন না সে বিষয়ে আমরা তাঁর মুখ থেকে এ কথা অভ্রান্ত বেদবাক্য শুনতে চাচ্ছি নে, তিনি কী আন্দাজ করেন তাই জানতে চাচ্ছি। কিন্তু তিনি আন্দাজ করতে নিতান্ত নারাজ। ছোটো Miss Kর মতো প্রশান্ত প্রফুল্লতার ভাব আর দেখি নি। একটি মূর্তিমান সন্তোষের ভাব। দেখে মনে হয় কোনো কালে তাঁর মনের কোনোখানে এক তিল আঁচড় পড়ে নি। খুব ভালো মানুষ, সর্বদাই হাসি খুশি গল্প। কাপড়-চোপড়ের আড়ম্বর নেই— কোনো প্রকার ভাণ নেই; অত্যন্ত শাদাসিদে।

 ডাক্তার Mএর বাড়িতে একদিন আমাদের সান্ধ্যনিমন্ত্রণ হল। এখানকার নেমন্তন্নে আমাদের দেশের মতো খাওয়াই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় গান-বাজনা আমোদ-প্রমোদের জন্যই দশ জনকে ডাকা হয়। আমরা সন্ধ্যের সময় গিয়ে হাজির হলুম। একটি ছোটো ঘরে অনেকগুলি মহিলা ও পুরুষের সমাগম হয়েছে। ঘরে প্রবেশ করে কর্তা-গিন্নিকে আমাদের সম্মান জানালুম। সমাগত লোকদের সঙ্গে যথাযোগ্য অভিবাদন সম্ভাষণ ও আলাপ হল। ঘরে জায়গার এত টানাটানি ও লোক এত বেশি যে চৌকির অত্যস্ত অভাব হয়েছিল; অধিকাংশ পুরুষে মিলে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছিলুম। নতুন কোনো অভ্যাগত মহিলা এলে গিন্নি কিম্বা কর্তা তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ করে দিচ্ছেন, আলাপ হবা মাত্র তাঁর পাশে গিয়ে একবার বসছি কিম্বা দাঁড়াচ্ছি ও হুই একটা করে কথাবার্তা আরম্ভ করছি। প্রায় weather নিয়ে কথা আরম্ভ হয়; মহিলাটি বললেন, ‘Dreadful weather!’ সে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ মতের ঐক্য হল। তার পরে তিনি অনুমান করলেন যে আমাদের পক্ষে অর্থাৎ Indianদের পক্ষে এমন weather বিশেষ trying ও আশা করলেন আকাশ শীঘ্র পরিষ্কার হয়ে যাবে ইত্যাদি। তার পরে এই সূত্রে নানা কথা উঠল আর-কি। সভার মধ্যে দুইজন সুন্দরী উপস্থিত ছিলেন, বলা বাহুল্য যে তাঁরা জানতেন তাঁরা সুন্দরী। বিলেতে আত্মসৌন্দর্যঅনভিজ্ঞা যুবতী দেখবার জো নেই! এখানে সৌন্দর্যের পুজো হয়; এখানে রূপ কোনোমতে গুপ্ত থাকতে পারে না, রূপাভিমান সুপ্ত থাকতে পারে না; চার দিক থেকে প্রশংসার কোলাহল তাকে জাগিয়ে তোলে; রূপের আলো দেখবা মাত্র ভক্তদের পতঙ্গহৃদয় চার দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে ঘিরে ফেলে ও রূপসী যে দিকে যান সেই ফড়িঙের দল তার চতুর্দিকে লাফিয়ে চলতে থাকে। ball roomএ তাঁর দর অত্যন্ত চড়া; নাচে তাঁর সাহচর্য-সুখ পাবার জন্যে দরখাস্তের পর দরখাস্ত আসছে; তাঁর রুমাল কুড়িয়ে দেবার জন্যে শত শত হাত প্রস্তুত, তাঁর তিলমাত্র কাজ করে দেবার জন্য শত শত কায়মনোবাক্যে দিবারাত্রি নিযুক্ত। রূপবান পুরুষদেরও যথোচিত আদর আছে, তারা এখানকার drawing roomএর darling হয়ে ওঠে, যুবতীরা তাদের আদর দিয়ে দিয়ে অনর্থ করে তোলে। আমি দেখছি, এ কথা শুনে তোমার এখানে আসতে অত্যন্ত লোভ হবে। তোমার মতো সুপুরুষ এখানকার মতো রূপমুগ্ধ দেশে এলে এখানকার হৃদয়রাজ্যে এত ভাঙচুর লোকসান করতে পার যে, সে একটা নিদারুণ করুণরসোদ্দীপক ব্যাপার হয়ে ওঠে। তা হলে চতুর্দিক থেকে—

ঘন
নিশ্বাস প্রলয়বায়ু, অশ্রুবারিধারা
আসার, জীমূতমন্ত্র হাহাকাররব—

তুলে দেও। তা হলে তোমার হৃদয়টিকেও খরচের খাতায় লিখতে হয়; এত নিশ্বাস-প্রলয়বায়ুতে ও অশ্রুবারিধারা-আসারে কেউ যদি টিঁকে থাকতে পারেন তা হলে তেমন লোকের মন spiritএ ডুবিয়ে যত্নপূর্বক preserve করে British Museum রেখে দেওয়া উচিত, তেমন মন ফরমাস দিলে পাওয়া যায় না। বিলেতে রূপের চেয়ে recommendation letter খুব কম আছে। এ রকম অবস্থায় রূপ কখনো লুকিয়ে থাকতে পারে না। যা হোক, নিমন্ত্রণসভায় Miss H-দ্বয় রূপসীশ্রেষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁরা হুজনেই কেমন চুপচাপ গম্ভীর হয়ে ছিলেন। বড়ো যে মেশামেশি হাসিখুশি তা ছিল না। ছোটো মিস একটা কৌচে গিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন, আর বড়ো মিস দেয়ালের কাছে এক চৌকি অধিকার করলেন। আমার বোধ হয়, তার কারণ আমরা দুই-এক জন ছাড়া ঘরে আর কেউ যুবক ছিল না। তরুণনেত্র তাঁদের রূপ ও সাজসজ্জা যেমন উপভোগ করতে পারে এমন তো আর চসমা-চক্ষু পারে না। যা হোক, আমরা দুই-এক জনে তাঁদের আমোদে রাখবার জন্যে নিযুক্ত হলুম। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি কথোপকথনশাস্ত্রে তেমন বিচক্ষণ নই, এখানে যাকে উজ্জ্বল (bright) বলে তা নই, অনর্গল গল্প হাসি আসে না ও আকারে-ইঙ্গিতে কথার আভাসে আমি রূপসীকে জানিয়ে দিতে পারি নে যে, আমার চকোরনেত্র তাঁর রূপের জ্যোৎস্না ও আমার কর্ণচাতক তাঁর বাক্যধারা পান করে স্বর্গসুখ ভোগ করছে। বরঞ্চ এক-এক সময় তাঁরা আমার গম্ভীর মুখ ও সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা শুনে তার উলটো স্থির করেন। এ রকম অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়; কেননা আমার হৃদয় বাস্তবিক অত্যন্ত ‘gallant’, যদিও আমার বাইরের ভাব দেখলে লোকের মন ঠিক তার উলটো সিদ্ধান্তে উপস্থিত হবে। গৃহকর্তা একজন সংগীতশাস্ত্রজ্ঞতাভিমানিনী প্রৌঢ়া মহিলাকে বাজাতে অনুরোধ করলেন, তিনি এই অনুরোধের জন্যে এতক্ষণ আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন। গৃহের মহিলাদের মধ্যে তাঁর বয়স সব চেয়ে বেশি, এই জন্যে তিনি সব চেয়ে বেশি সাজগোজ করে এসেছিলেন— তাঁর দু হাতের দশ আঙুলে যত আংটি ছিল সভাস্থ সকল লোকের আঙুলের আংটির সমষ্টি তার অর্ধেক হবে। কিন্তু হাজার সাজসজ্জা করুন, তিনি বেশ জানতেন যে তাঁর রূপের বাজার সম্পুর্ণ দেউলে হয়ে গেছে। সুতরাং তিনি আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন, কখন তাঁর বাজাবার অবসর আসবে। আমি যদি নিমন্ত্রণকর্তা হতুম আর আগে থাকতে না জানতুম যে তিনি পিয়ানো বাজাতে পারেন, তা হলে তাঁর দশ আঙুলের বিশটা আংটি দেখে আমি বুঝতে পারতুম যে, তিনি পিয়ানো বাজাবেন ব’লে বাড়ি থেকে স্থির সংকল্প করে এয়েছেন। যখন একজন কোনো বিখ্যাত বাজিয়ে আপনার কেরামতি দেখাবার জন্যে বাজাতে বসে তখন তা আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে ওঠে। আমি এখানকার গান বা বাজনার টপ্পা বা খেয়াল বেশ বুঝতে পারি, এক-একটা খুব ভালো লাগে, কিন্তু কালোয়াতি কোলাহলে এক-একবার আমাকে অত্যন্ত অধীর করে তোলে। তাঁর বাজনা সাঙ্গ হলে পর গৃহকর্ত্রী আমাকে গান গাবার জন্যে অনুরোধ আরম্ভ করলেন। আমি বড়ো মুশকিলে পড়লুম। আমি জানতুম, আমাদের দেশের গানের ওপর যে তাঁদের বড়ো অনুরাগ আছে তা নয়। তবে আমাকে গান করতে বলবার তাৎপর্য কী? গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী দুজনেই আমার গান পূর্বে শুনেছিলেন, সে গানগুলো তাঁদের অত্যন্ত হাস্যজনক লেগেছিল। তাঁদের তাতে এত আমোদ বোধ হয়েছিল যে বাড়িতে গিয়েই কর্তা-গিন্নিতে মিলে পরামর্শ করলেন যে, আগামী নেমন্তন্নে এই কালো Indianটাকে চীৎকার করাতে হবে—তা হলে অভ্যাগত ব্যক্তিবর্গের পক্ষে সে ভারী একটা ‘treat’ হবে। আমি মনে মনে সে সমস্তই জানি, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কী করি বলো? যদি বা ভদ্রতার খাতিরও লঙ্ঘন করতে পারতেন, কিন্তু পাশ থেকে যখন সুন্দরী Miss H তাঁর মিষ্টতম আদরের স্বরে বললেন ‘Yes, do give us a song Mr. T!’ তখন Mr. T বাক্য ব্যয় না করে গান গাওয়ার ভূমিকা-স্বরূপ দুই-একটি আরম্ভসূচক কাশিধ্বনি করলেন। সমস্ত সভা শান্ত হল। আমি ভাবতে লাগলুম, কী গান গাব। আমি নিজে যে গানগুলি ভালোবাসি সেগুলিকে এমন উলুবনে ছড়াতে কেমন প্রাণে লাগে; সে গানগুলি শুনে যে সকলে হাসবে তা আমি সহ্য করতে পারতুম না। একটা গান তো আরম্ভ করলেম। এমন শোচনীয় অবস্থায় আমি আমার জীবনে আর কখনো পড়ি নি; কোনো প্রকার করে গোটা কতক হুর ও কথার সমষ্টি গলার ভিতর থেকে বের করেছিলেম আর-কি। সভাস্থ Miss ও Mrs. -দের এত হাসি পেয়েছিল যে, সে স্রোতের উচ্ছ্বাসে ভদ্রতার বাঁধ টলমল করছিল— কোনোমতে তাঁরা হাসি গোপন করতে পারছিলেন না, কেউ কেউ হাসিকে কাশির রূপান্তরে পরিণত করলেন, কেউ কেউ হাত থেকে কী যেন পড়ে গেছে ভাণ করে ঘাড় নিচু করে হাসি লুকোতে চেষ্টা করছেন, একজন কোনো উপায় না দেখে তাঁর পার্শ্বস্থ সহচরীর পিঠের পেছনে মুখ লুকোলেন; যাঁরা কতকটা শান্ত থাকতে পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে চোখে চোখে টেলিগ্রাফ চলছিল। সেই সংগীতশাস্ত্রবিশারদ প্রৌঢ়াটির মুখে এমন একটু মৃদু ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের হাসি লেগেছিল যে, সে দেখে শরীরের রক্ত জল হয়ে আসে। এই রকম অবস্থায় আমার মতো ভালোমানুষ যে কী দুরবস্থায় পড়েছিল তা তোমরা বেশ কল্পনা করতে পারছ। গান যখন সাঙ্গ হল তখন আমার মুখ কান লাল হয়ে উঠেছে, কেবল কালো রঙ বলে কেউ দেখতে পায় নি। চার দিক থেকে একটা প্রশংসার কোলাহল উঠল, কিন্তু অত হাসির পর আমি আর সে দিকে বড়ো কর্ণপাত করলেম না। ছোটো Miss H আমাকে গানটা ইংরিজিতে অনুবাদ করে বলতে অনুরোধ করলেন, আমি অনুবাদ করলেম— গানটা হচ্ছে ‘প্রেমের কথা আর বোলো না’। তিনি অনুবাদটা শুনে আমাকে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের দেশে প্রেমের স্বাধীনতা আছে নাকি!’ ভারতবর্ষের লোকেরা হ্যাট কোট পরে কি না, জ’ন্মে অবধি ইংরিজি কয় কি না ও শীতকালে কখনো বরফের ওপরে skate করে কি না যিনি জানতেন না, তিনি এ খবরটি কোথা থেকে পেয়েছেন! আমি তো মুশকিলে পড়ে গেলুম, নতশিরে দুই-একটা অ্যাঁ-য়োঁ করলুম আর-কি! যা হোক, সেই সন্ধ্যের মধ্যে আমাকে দুবার গান করতে হয়েছিল। এই রকম গানবাজানা গল্পসল্প চলতে লাগল। কতকগুলি রোমের ভগ্নাবশেষের ফোটোগ্রাফ ছিল, সেইগুলি নিয়ে গৃহকর্ত্রী কতকগুলি অভ্যাগতকে জড়ো করে দেখাতে লাগলেন। ডাক্তার M একটা telephone কিনে এনেছেন, সেইটি নিয়ে তিনি কতকগুলি লোকের কৌতূহল তৃপ্ত করছেন। পাশের ঘরে টেবিলে খাবার সাজানো আছে। এক-একবার গৃহকর্তা এসে এক-একজন পুরুষের কানে কানে বলে যাচ্ছেন, Miss অথবা Mrs. অমুককে supper-স্থানে নিয়ে যাও; তিনি গিয়ে সেই মহিলার কাছে তাঁকে খাবার ঘরে নিয়ে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করলেন ও তাঁর বাহু গ্রহণ করে তাঁকে পাশের ঘরে আহারস্থলে নিয়ে গেলেন। এ রকম সভায় সকলে মিলে একেবারে খেতে যায় না, তার কারণ তা হলে আমোদ-প্রমোদের স্রোত অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। একে একে সকলের খাওয়া হয়ে যায়। এই রকম একসঙ্গে পুরুষ মহিলা সকলে মিলে গানবাজনা গল্প আমোদপ্রমোদ আহারাদিতে একটা সন্ধ্য। কাটানো গেল।

 আমরা একটা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবের সময়েই লোকজন একত্রে ডেকে খাওয়াদাওয়া করি। আমাদের মধ্যে পরস্পর মিলনের উপলক্ষ্য খুব কম। তা ছাড়া, যাঁদের সভার অধিষ্ঠাত্রী করা উচিত সেই মহিলারাই আমাদের নিমন্ত্রণসভায় উপস্থিত থাকেন না। খাওয়াদাওয়াই হচ্ছে আমাদের প্রধান আমোদ— তা ছাড়া আর বাকি যে-সব আমোদ, যেমন বাইনাচ যাত্রা গান প্রভৃতি, সমস্তই ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্যে। কিন্তু ইন্দ্রিয়তৃপ্তির চেয়ে উচ্চতর আমোদ যে মানুষ পরস্পরে সমভাবে মিলে মেশামেশি করা, পরস্পর পরস্পরকে আমোদ দেবার জন্যে নিজের সমস্ত গুণ প্রকাশ করা, পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে প্রশংসা ও মমতা পাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা, সে-সকল আমাদের মধ্যে নেই। কতকগুলো নীচ শ্রেণীর ভাড়াটে মেয়ে বা এক রাত্তিরের জন্যে ধার-করা গাইয়ে যখন জঘন্য অঙ্গভঙ্গী করছে, বা ভাবসম্পর্কশূন্য রাগিণী ভাঁজছে, তখন আমরা একদল নিমন্ত্রিত লোক হাঁ করে তাকিয়ে থাকি ও ‘বাহবা বাহবা’ করি। কিন্তু পরস্পরকে আমোদ দেবার জন্যে আমরা সকলে মিলে গানবাজনা আমোদপ্রমোদ করি নে। এই রকম কেনা বা ভাড়া-করা আমোদ আমরা নাট্যশালা বা রঙ্গভূমিতে প্রত্যাশা করি; কিন্তু যখন একজন বন্ধুর বাড়িতে জড়ো হয়েছি তখন সকল ভদ্রলোকে মিলে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুতা ও সদ্ভাবের চর্চা করাই উচিত। আমরা যখন বাইনাচ-দেখা গানশোনা বা ঐ রকম কোনো আমোদের জন্যে একত্র হই তখন মনে হয় কতকগুলো লোক একটা নাট্যগৃহে গেছে, কেবল প্রভেদের মধ্যে সেখেনে টিকিট কিনতে হয় না। সে রকম নিমন্ত্রণসভায় গেলে, মানুষ যে সামাজিক জীব, সে কেবল কতকগুলো প্রাণী আঁচড়া-আঁচড়ি না করে একত্রে রয়েছে দেখেই বোধ হয়। পরস্পরকে আমোদের জন্যে পরস্পরের উপর নির্ভর করতে হয় না। একজন গান করছে বা নাচছে আমরা সকলে মিলে শুনছি বা দেখছি, যদি নিজের নিজের বাড়িতে বসে শোনা বা দেখা যেত, তা হলে আমরা পরিশ্রম স্বীকার করে এক জায়গায় জড়ো হতেম না। মেয়ে পুরুষে একত্রে মিলে আমোদপ্রমোদ করাই তো স্বাভাবিক। মেয়েরা তো মনুষ্যজাতির অন্তর্গত, ঈশ্বর তো তাদের সমাজের এক অংশ করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষে মানুষে আমোদপ্রমোদে মেশামেশি করাকে একটা মহাপাতক, সমাজ বিরুদ্ধ, রোমাঞ্চজনক ব্যাপার করে তোলা শুদ্ধ অস্বাভাবিক নয়, তা অসামাজিক, সুতরাং এক হিসেবে অসভ্য। পুরুষেরা বাইরের সমস্ত আমোদপ্রমোদে লিপ্ত রয়েছে, আর মেয়েরা তাদের নিজস্ব সম্পত্তি একটা পোষা প্রাণীর মতো অন্তঃপুরের দেয়ালে শৃঙ্খলে বাঁধা আছে। এক দল বুদ্ধিমান বিবেচনাশক্তিবিশিষ্ট জীবকে কত শত শতাব্দী হতে নির্দয় লোকাচারের শাসন পীড়ন দমন বন্ধন করে করে পোষা জন্তুর চেয়ে নির্জীব বশীভূত সংকুচিত সংকীর্ণমন করে তোলা হয়েছে, সে একবার ভালো করে কল্পনা করে দেখতে গেলে সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে। কোনো একজন মানুষের ’পরে এ রকম সম্পূর্ণ একাধিপত্য করা— একজন বুদ্ধি ও হৃদয় -বিশিষ্ট মানুষকে জন্তুর মতো, এমন-কি, তার চেয়ে অধম একটা ব্যবহার্য জড়পদার্থের মতো সম্পূর্ণরূপে নিজের প্রয়োজনের জিনিস করে তোলা— যদি তার এক তাল সুখের জন্যে তোমার এক তিল সুখের ব্যাঘাত হয় তা হলে সেটুকুও উচ্ছিন্ন করে দেওয়া— যদি তোমার ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্যে তাকে চিরস্থায়ী কষ্ট পেতে হয় তবে তাও অম্লানবদনে তার স্কন্ধে স্থাপন করা— এ-সকল যদি পাপ না হয় তবে নরহত্যা করাও পাপ নয়; সমাজের অর্ধেক মানুষকে পশু করে ফেলা যদি ঈশ্বরের অভিপ্রেত বলে প্রচার করো তা হলে তাঁর নামের অপমান করা হয়। মেয়েদের সমাজ থেকে নির্বাসিত করে দিয়ে আমরা কতটা সুখ ও উন্নতি থেকে বঞ্চিত হই তা বিলেতের সমাজে এলে বোঝা যায়। আমরা অনেক জিনিস না দেখলে দূর থেকে কল্পনা করতে পারি নে, এমন-কি বিশ্বাস করতে পারি নে। এখেনে যতগুলি ভারতবর্ষীয় এয়েছেন, সর্ব প্রথমেই তাদের চোখে কী ঠেকেছে?— এখানকার সমাজের সুখ ও উন্নতি -সাধনে মহিলাদের নিতান্ত-প্রয়োজনীয় সহায়তা। যাঁরা স্ত্রীস্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন, এখেনে এসে নিশ্চয়ই তাঁদের মতের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে।’

 এখানকার নিমন্ত্রণসভা শিক্ষার যে কত সাহায্য করে তার ঠিক নেই। মুখে মুখে কথাবার্তায় মেয়ে-পুরুষদের মধ্যে জ্ঞান ছড়িয়ে যায়। বিনা কষ্টে ও অলক্ষিত ভাবে মনের একটা শিক্ষা হতে থাকে। একটা বিষয়ে নানা লোকের মত শুনতে পাওয়া যায়; কিরকম করে মত গঠিত করতে হয়, কিরকম করে মত ব্যক্ত করতে হয় ও কিরকম করে মতের প্রতিবাদ করতে হয়, সে বিষয় প্রতি মুহূর্তে অভ্যাস হতে থাকে। সমাজে মিশতে গেলে নানা বিরোধী মতের একটা সংঘাত উপস্থিত হয়, সুতরাং একটা বিষয়ের চার দিক দেখতে পাওয়া যায়। যদি দৈবাৎ বিবেচনা না করে একটা মত স্থির করো অমনি সে মত চারি দিক থেকে হুঁচট খেতে থাকে, সুতরাং তোমাকে অনেকটা সাবধান হতে হয়। সাহিত্য বিজ্ঞান রাজনীতি -সম্বন্ধীয় খবর দেখতে দেখতে মুখে মুখে সমস্ত দেশময় রাষ্ট্র হয়ে যায়। একটা নতুন বই যদি ভালো হয়ে থাকে, তবে মুখে মুখে তার বিজ্ঞাপন প্রচার হয় ও দেশের মেয়ে-পুরুষ সকলেই সে বইয়ের অস্তিত্ব জানতে পারে। এই রকম করে চার দিকের বাতাসে যেন জ্ঞান ছড়িয়ে যায়, নিশ্বেসের সঙ্গে যেন জ্ঞান লাভ করা যায়। এখানকার নিমন্ত্রণসভা গুণীদের উৎসাহ দেবার প্রধান স্থান। সভায় তাদের সম্মানের আর সীমা নেই। ষাঁদের সংগতি ও যোগ্যতা আছে তাঁরা সকলেই গুণীদের নিমন্ত্রণ করতে চান। এখানকার নিমন্ত্রণসভার তাঁরা 'lion'—— সিংহ। মহা মহা কুলীন ব্যক্তিদের ঘরে তাঁরা পদধূলি দিলে শত শত Duchess Countessরা আপনাদের কৃতার্থ মনে করেন। এখানে গুণের আদর দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। আমাদের দেশের গুণীলোকদের যখন মনে করি তখন মনে হয়, তাঁরা যদি ইংলন্‌ডে জন্মাতেন তা হলে তাঁদের পক্ষে ভালো হত। স্ত্রী পুরুষে পরস্পরের কাছে থেকে প্রশংসা ও মমতা পাবার জন্যে আপনার আপনার গুণের চর্চা করতে থাকে। সবসুদ্ধ জড়িয়ে এখানকার মেশামেশির ভাব অতি সুন্দর। সে না দেখলে ভালো বোঝবার যো নেই। বাইনাচ দেখে, গান শুনে ও লুচি সন্দেশ হজম বা বদ-হজম করে যে ফল হয়, তার চেয়ে এখানকার সমাজে মিশলে যে মনের কত উন্নতি হয় তা আমি এই ক্ষুদ্র চিঠির মধ্যে যথেষ্ট বর্ণনা করতে পারি নে।

 এখানে আবার মিলনের উপলক্ষ্য কত প্রকার আছে তার সংখ্যা নেই। ডিনার, বল, conversazione, চা-সভা, lawn-parties, excursions, picnics ইত্যাদি। Thackeray বলেন: English Society has this eminent advantage over all others—that is if there be any society left in the wretched distracted old European continent- that it is above all others a dinner-giving society. অবসর পেলে এক সন্ধ্যে বন্ধুবান্ধবদের জড় করে আহারাদি করা ও আমোদপ্রমোদ করে কাটানো এখানকার পরিবারের অবশ্যকর্তব্য কাজের মধ্যে। ডিনার-সভার বর্ণনা করতে বসা বাহুল্য। ডাক্তার Mএর বাড়িতে যে partyর কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি, তার সঙ্গে ডিনার-পার্টির প্রভেদ কেবল দক্ষিণ হস্তের ব্যাপারে (এ ম্লেচ্ছদের দেশে ভক্ষণটা আবার দক্ষিণ বাম উভয় হস্তের ব্যাপার)। আমি একবার এখানকার একটি বোট-যাত্রা ও picnic partyর মধ্যে ছিলুম। এখানকার একটি রাবিবারিক সভার সভ্যেরা এই বোট-যাত্রার উদ্যোগী। এ সভার সভ্য ও সভ্যারা sabbath-পালনের বিরোধী। তাই জন্যে তাঁরা রবিবারে একত্র হয়ে নির্দোষ আমোদপ্রমোদ করেন। এই রাবিবারিক সভার সভ্য আমাদের এক বাঙালি মিত্র ম- মহাশয় আমাদের অনুগ্রহ করে টিকিট দেন। লন‍্ডন থেকে রেলওয়ে করে টেম‍্সের ধারের এক গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছলেম। গিয়ে দেখলুম টেম‍্সে একটা প্রকাণ্ড নৌকা বাঁধা রয়েছে, আর প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন রবিবার-বিদ্রোহী মেয়েপুরুষে একত্র হয়েছে। দিনটা অন্ধকার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, আর যাঁদের যাঁদের আসবার কথা ছিল তাঁরা সকলে আসেন নি। আমার নিজের বড়ো এ পার্টিতে যোগ দেবার ইচ্ছে ছিল না; কিন্তু ম- মহাশয় নাছোড়বান্দা, তিনি আমাকে বিশেষ করে লোভ দেখালেন যে সেখেনে অনেক সুন্দরীর সমাগম হচ্ছে। শুনে আমি একটু যত্ন ও পরিশ্রম -পূর্বক সাজগোজ করে যথাসময়ে হাজির হলুম। গিয়ে দেখি বোটে কেবল একটি মহিলা আছেন যাঁকে দূর থেকে দেখলে হঠাৎ সুন্দরী বলে ভ্রম হয়, আর বাকি মহিলাদের (তাঁদের প্রতি আমি অসম্মান করছি নে) কাউকেই আমার চোখে দর্শনযোগ্য বলে ঠেকে নি। যে একটি-মাত্র রূপসী ছিলেন তাঁর চার দিকে এমন একটি ঘন ব্যুহ বদ্ধ হয়েছিল যে তা ভেদ করবার চেষ্টা করা আমার মতো ক্ষীণপ্রাণীর পক্ষে দুরাশা। সুতরাং আমি সে টক আঙুর ফল পরিত্যাগ করে ম— মহাশয়ের কাছে গিয়ে কৈফিয়ত চাইলুম। কিন্তু কৈফিয়ত সন্তোষজনক হোক আর না হোক ফলে সমানই কথা। আমরা অনেক ভারতবর্ষীয় একত্র হয়েছিলুম। বোধ হয় ম- মহাশয় সকলকেই সুন্দরীর লোভ দেখিয়েছিলেন, কেননা, সকলেই প্রায় বাহারে সাজগােজ করে গিয়েছিলেন। অনেকেই গলায় লাল ফাঁসি (necktie) বেঁধে এয়েছিলেন, অন্যের গলায় ফাঁসি লাগানাে তাঁদের আন্তরিক অভিপ্রায়; আর ম— মহাশয় স্বয়ং তাঁর neck-tieএ একটি তলবারের আকারের পিন গুঁজে এয়েছিলেন। আমাদের মধ্যে একজন তাঁকে ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেশের সমস্ত tieএ যে তলবারের আঘাত করা হয়েছে, ওটা কি তারই বাহ্য লক্ষণ?’ তিনি হেসে বললেন ‘তা নয় গাে, বুকের কাছে একটা কটাক্ষের ছুরি বিঁধেছে, ওটা তারই চিহ্ন।’ দেশে থাকতে বিঁধেছিল কি এখানে বিঁধেছে তা কিছু বললেন না। ম— মহাশয়ের হাসি-তামাশার বিরাম নেই; সে দিন তিনি নৌকার সমস্ত লোকের সঙ্গে সমস্ত দিন ঠাট্টা ও গল্প করে কাটিয়েছিলেন। একবার তিনি সমস্ত মহিলাদের হাত দেখে গুনতে আরম্ভ করেছিলেন— তখন তিনি এত হাস্যজনক কথা বলেছিলেন ও বােট-সুদ্ধ মহিলাদের এত প্রচুর পরিমাণে হাসিয়েছিলেন যে, সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর উপর আমার মনে মনে একটুখানি দ্বেষের উদ্রেক হয়েছিল। বােট-সুদ্ধ মেয়ে যখন হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছিলেন, তখন আমি এবং আর দুই-চারিটি পুরুষ অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়েছিলেম। যথাসময়ে বােট ছেড়েছিল। নদী এত ছােটো যে, আমাদের দেশের খালের কাছাকাছি পৌঁছয়। জায়গায় জায়গায় নদীর ধারের দৃশ্য মন্দ নয়, কিন্তু সবসুদ্ধ জড়িয়ে যে বিশেষ সুন্দর দেখতে তা নয়। নৌকোর মধ্যে আমাদের আলাপ পরিচয় গল্পসল্প চলতে লাগল। একজন ইংরেজের সঙ্গে আমাদের একজন দিশি লােকের ধর্মসম্বন্ধীয় তর্ক উঠল। আমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ হল, তিনি তাঁদের ইংরিজি সাহিত্যের কথা তুললেন; তাঁর শেলীর কবিতা অত্যন্ত ভালাে লাগে, সে বিষয়ে আমার সঙ্গে তাঁর মতের সম্পূর্ণ মিল হল দেখে তিনি ভারী খুশি হলেন; তিনি আমাকে বিশেষ করে তার বাড়ি যেতে অনুরোধ করলেন ও বললেন, সেখানে গিয়ে আমরা দুজনে সাহিত্য আলোচনা করব। ইনি ইংরিজি সাহিত্য ও তাঁর নিজের দেশের রাজনীতি ভালো রকম করে চর্চা করেছেন, কিন্তু যেই ভারতবর্ষের কথা উঠল অমনি তাঁর অজ্ঞতা বেরিয়ে পড়ল। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কোন্ রাজার অধীনে?’ আমি অবাক হয়ে বললুম, ‘ব্রিটিশ গবর্মেণ্টের।’ তিনি বললেন, ‘তা আমি জানি, কিন্তু আমি বলছি কোন্ ভারতবর্ষীয় রাজার অব্যবহিত অধীনে।’ কী ভয়ানক! কলকাতার বিষয়ে এঁর জ্ঞান এই রকম। তিনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন— ‘আমার অজ্ঞতা মাপ করবেন; ভারতবর্ষের বিষয়ে আমাদের ঢের জানা উচিত, কিন্তু লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি আমি এ বিষয়ে খুব কম জানি।’ এই রকম বোটের ছাতের উপর আমাদের কথাবার্তা চলতে লাগল; আমাদের মাথার উপরে একটা কাপড়ের আচ্ছাদন আছে; বোটের ঘরের মধ্যে আহারের আয়োজন হচ্ছে, সেখেনে স্থান নেই! মাঝে মাঝে টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি হচ্ছে, কাপড়ের আচ্ছাদনে সেটা নিবারণ করছে। কিন্তু হঠাৎ এমন ঘোরতর বাতাস ও বৃষ্টি হতে আরম্ভ হল যে কিছুতে নিবারণ হবার যো নেই। যে দিকে বৃষ্টির ছাঁট পৌঁচচ্ছে না সেই দিকে মেয়েদের রেখে আমরা আর-এক পাশে এসে ছাতা খুলে দাঁড়ালুম। ওমা, দেখি, আমাদের দিশি বন্ধু। ক— মহাশয় সেই মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন, আমি তাঁকে যথেষ্ট ঠাট্টা করে নিয়েছিলেম; তিনি বার বার করে বললেন যে, বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া ছাড়া তাঁর অন্য অভিসন্ধি ছিল না। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি তা বিশ্বাস করি নে। আমি তাঁকে তখনি শাসিয়ে রেখেছিলেম যে, দেশে এ কথা রাষ্ট্র করে দেব; তিনি তখন বিশ্বাস করেন নি। তুমি এক কাজ কোরো তো— বিকেলে সেই ঘরটাতে যখন তোমাদের পাশার বৈঠক বসবে তখন তামাকের ধোঁয়ার সঙ্গে এই কথাটা ঘরের চারি দিকে বিস্তার করে দিয়ো। কিম্বা তা যদি না কর তোত বিশ্বম্ভর দাদাকে এই কথাটা অতি গোপনে বোলো ও কাউকে বলতে বিশেষ করে বারণ কোরো, তা হলেই সপ্তাহের মধ্যে সকলের কানেই উঠবে। যা হোক, সে দিন আমরা বৃষ্টিতে তিনচার বার করে ভিজেছিলেম। এই রকম ভিজতে ভিজতে আমরা আমাদের গম্য স্থানে গিয়ে পৌঁছলেম। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু আকাশে মেঘ আছে ও জমি ভিজে। মাঠে নেবে আমাদের খাওয়াদাওয়া করবার কথা ছিল, কিন্তু আকাশের ভাবগতিক দেখে তা আর হল না। খাবার সময় দেখি, আহারের অত্যন্ত বিস্তৃত আয়োজন। আমাদের partyর যিনি প্রধান তিনি আমার অল্প খাওয়া দেখে বললেন যে, আমার picnicএর উপযুক্ত ক্ষিধে নেই; কিন্তু তাঁর খাওয়ার পরিমাণ থেকে যদি picnicএর উপযুক্ত ক্ষিধের পরিমাণ অনুমান করে নিতে হয় তা হলে, আমি যদি গাছের পাতা ও হত্তুকি খেয়ে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে সহস্র বৎসর উপরে পা ও নীচে মাথা রেখে বৃকোদর ও অগস্ত্যমুনির আরাধনা করি তবু আমার picnicএর উপযুক্ত ক্ষিধে হয় না। খাওয়াদাওয়ার পর আমরা নৌকা থেকে নেবে বেড়াতে বেরলেম। কোনো কোনো প্রণয়ীযুগল একটি ছোটো নৌকা নিয়ে দাঁড় বেয়ে চললেন, কেউ বা হাতে হাতে ধরে নিরিবিলি কানে কানে কথা কইতে কইতে মাঠে বেড়াতে লাগলেন। আমাদের সঙ্গে একজন ফোটোগ্রাফওয়ালা তার ফোটোগ্রাফের সরঞ্জাম সঙ্গে করে এনেছিল, আমরা সমস্ত দল মাঠে দাঁড়ালেম— আমাদের ফোটোগ্রাফ নেওয়া হল। সে যন্ত্রে এক সেকেণ্ডের মধ্যে ফোটোগ্রাফ নেওয়া যায়, সুতরাং একটু-আধটু নড়লে-চড়লেও বড়ো একটা হানি হয় না। সহসা ম—মহাশয়ের খেয়ালে গেল যে আমরা যতগুলি কৃষ্ণমূর্তি আছি একত্রে সকলের ছবি নেওয়া হবে। আমাদের মধ্যে দুই-একটি জন-বৃষের পুষ্যি বাছুর ছিলেন, তাঁরা এ প্রস্তাবে ইতস্ততঃ করতে লাগলেন— পাছে কৃষ্ণমূর্তির দলের মধ্যে তাঁরাও পড়েন। কিন্তু এরকম একটা ‘invidious distinction’ করা তাদের মনঃপূত নয়। কিন্তু ম— মশায় ছাড়বার পাত্র নন; তিনি ধরে বেঁধে দাঁড় করিয়ে আমাদের ছবি নেওয়ালেন। যা হোক, ছবি নেওয়া প্রভৃতি সাঙ্গ হলে পর নৌকা লন‍্ডন-অভিমুখে ছাড়া হল। তখন ভগবান মরীচিমালী তাঁহার সহস্ররশ্মিসংযমনপুরঃসর অস্তাচলচূড়াবলম্বী কনকজলধরপটল-শয়নে বিশ্রান্ত মস্তক বিন্যাস-পূর্বক অরুণবর্ণ নিদ্রাতুর লোচন মুদ্রিত করিলেন; বিহগকুল স্ব স্ব নীড়ে প্রত্যাবর্তন করিল; গাভীবৃন্দ হম্বারব করিতে করিতে গোপালের অনুবর্তন করিয়া গোষ্ঠাভিমুখে গমন করিতে লাগিল। আমরা লন‍্ডনের অভিমুখে যাত্রা করলেম। আমরা এক গাড়িতে কতকগুলি দিশিলোক ছিলেম ও আমাদের সঙ্গে একজন ইংরেজ পুরুষ ও ইংরেজ মহিলা ছিলেন। ম— মহাশয় আমাদের সঙ্গে ছিলেন, সুতরাং আমাদের হাসি-তামাশার আর অন্ত ছিল না। এইখানে তোমাকে একটা ঘোরতর গুপ্ত খবর দিচ্ছি, খবরদার আর কাউকে বোলো না। গাড়িতে আমাদের চ— মহাশয়ের রকম-সকম যদি দেখতে তবে অবাক হয়ে যেতে। মিস ড—য়ের সঙ্গে তিনি যে রকম ফিস্ ফিস্ করে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলেন, মাঝে মাঝে তাঁর মুখের ’পর যে রকম ভাবপূর্ণ দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন ও ঠিক তাঁর পাশে যে রকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিলেন, যে, তাতে ক— মহাশয় ম— মহাশয় ও র— মহাশয়ের মধ্যে একটা রহস্যপূর্ণ চোখ-টেপাটেপি পড়ে গেল; ম— মহাশয় বাংলায় বলে উঠলেন, ‘দুই ডাক্তারে মিলে দুজনের মনের উপর surgery প্র্যাকটিস করছেন নাকি?’ চ— মহাশয় ডাক্তার এবং মিস ড—ও ডাক্তার।

 ১ স্ত্রী-স্বাধীনতা বিষয়ে অতি সাবধানে কথাবার্তা কহা উচিত। ইংলন্‌ডে গেলেই বঙ্গীয় ইউরোপ-যাত্রীদের চর্মচক্ষে কী-যে এক বিস্ময়জনক ছবি পড়ে, তাহাতে করিয়া তাঁহাদের জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন একেবারেই বন্ধ হইয়া যায়; ইংলন্‌ডের জলবায়ু স্বতন্ত্র, ইংলন্‌ডের পুরাবৃত্ত স্বতন্ত্র, ইংলন্‌ডের জনসমাজের রুচি স্বতন্ত্র—আমাদের দেশের জলবায়ু পুরাবৃত্ত জনসমাজের রুচি স্বতন্ত্র- ইংলন্‌ডীয় প্রকৃতির উপর ইংলন্‌ডের সমাজ প্রতিষ্ঠিত, আমাদের দেশীয় প্রকৃতির উপর আমাদের দেশীয় সমাজ প্রতিষ্ঠিত—ইউরোপ-যাত্রী বঙ্গযুবকদের এ জ্ঞানটি সহসা বিলুপ্ত হইয়া যায়। লেখককে যদি জিজ্ঞাসা করি ‘তুমি আমাদের দেশীয় প্রকৃতিকে সমূলে উমূলন করিয়া তাহার স্থানে ইংলন্‌ডীয় প্রকৃতিকে সিংহাসনস্থ করিতে চাও?'— তাহা শুনিবামাত্র তিনি হয়তো শিহরিয়া উঠিয়া তৎক্ষণাৎ স্পষ্টাক্ষরে ‘না’ বলিবেন। আমাদের দেশের আচার ব্যবহার সভ্যতা যাহা-কিছু সমস্তই আমাদের দেশীয় প্রকৃতির গর্ভজাত সস্তান-সন্ততি, অগ্রে সেই প্রকৃতিকে উমূলন না করিয়া তিনি কিরূপে তাহার সেই সন্তান-সন্ততিগুলির উচ্ছেদ-কামনাকে মনে স্থান দিতে পারেন? অনতিপূর্বে বহুতর ইংলন‍্ডীয় স্ত্রী-সমারোহের মধ্যে তিনি যখন একজনের মুখে দেশীয় স্ত্রীলোকোচিত মাধুর্য ও ভাবভঙ্গী অবলোকন করিয়াছিলেন তখন তাঁহার কেন এত ভাব লাগিয়াছিল? তখন তো বহিশ্চারিণী বহুভাষিণী ব্যাপিকা সমাজরাজ্ঞী অপেক্ষা অন্তঃপুরচারিণী মৃদুভাষিণী লজ্জাশীলা গৃহলক্ষ্মীর সৌন্দর্য তাঁহার চক্ষে ভালো লাগিয়াছিল। এখন কি তাঁহার সে ভাব অন্তরিত হইয়াছে? তাহা তো বোধ হয় না—তিনি এক দিকে অধিক ঝোঁক দেওয়াতে লেখনীর বেগ সম্বরণ করিতে পারেন নাই, ইহাই সম্ভব মনে হয়। শুধু কেবল স্বাধীনতা হইলেই যদি স্ত্রীদিগের আর কোনো গুণের প্রয়োজন না হইত তাহা হইলে আমরা লেখকের মতে সম্পূর্ণ মত দিতে পারিতাম। কিন্তু তাহা তো নহে— যেমন স্বাধীনতা চাই তাহার সঙ্গে তেমনি শোভন লজ্জাশীলতা, বিনয়, সরলতা, উচ্চের প্রতি ভক্তিমত্তা, নীচের প্রতি দয়া দাক্ষিণ্য ইত্যাদি অনেকগুলি গুণ থাকা চাই তবেই তাঁহারা স্ত্রীলোকের আদর্শ-রূপে বরণীয় হইতে পারেন। নচেৎ স্ত্রীস্বাধীনতার আর-এক নাম স্বৈরচারিতা, ব্যাপিকতা, প্রগল্ভতা হইয়া দাঁড়ায়। প্রকৃত কথা এই যে, আমাদের দেশে এক্ষণে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষাবিষয়ক স্বাধীনতা, রুচিবিষয়ক স্বাধীনতা ইত্যাদি অনেক স্বাধীনতার অপ্রতুল রহিয়াছে। তাহার সঙ্গে কী-মাত্রা স্ত্রীস্বাধীনতা ভালোয় ভালোয় ঢেঁকিয়া থাকিতে পারে তাহাই এখন বিবেচনাস্থলে। ইংলন্‌ডের আর-আর স্বাধীনতার সঙ্গে ইংলন্‌ডোচিত স্ত্রীস্বাধীনতা ইংলন্‌ডেই শোভা পায়; তেমনি যদি আমাদের দেশোচিত স্ত্রীস্বাধীনতা নৈসর্গিক শোভায় সমুখিত হয় তবেই ভালো। নইলে— মাথাটা খুব প্রকাণ্ড, ধড়খানি ছোটোখাটো— অথবা মাথায় হ্যাট, গায়ে জামা, পায়ে চটি—এইরূপ এক কিম্ভূতকিমাকার স্বাধীনতা সকলের সহিত খাপছাড়া হইয়া দিনকতক মিথ্যা দাপাদাপি করিয়া বেড়াইলে তাহাতে কাহার যে কী উপকার হইবে তাহা তো বুঝা যায় না। ‘উঃ ইনি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করিয়াছেন’— এরূপ যদি কেউ মনে করেন তবে তাঁহাদের জানা উচিত যে, এ স্বাধীনতা আত্মার স্বাধীনতাও নহে, দেশের স্বাধীনতাও নহে, কেবল পরপুরুষগণের সহিত স্ত্রীলোকগণের আমোদ-প্রমোদে মেলা-মেশ—ইহা কতদূর প্রকৃতরূপে স্বাধীনতা নামের যোগ্য তাহাই সন্দেহস্থল। স্ত্রীরা যেমন গৃহকর্মের উপযুক্ত, পুরুষেরা সেইরূপ বহির্ব্যাপারে ব্যাপৃত থাকিবার উপযুক্ত। স্ত্রীগণের মধ্যে যাঁহারা কাজের লোক তাঁহারা অধিকাংশ কাল গৃহাভ্যন্তরে থাকিতে বাধ্য হন, এবং পুরুষদিগের মধ্যে যাঁহারা কাজের লোক তাঁহারা অধিকাংশ কাল বাহিরে বিচরণ করিতে বাধ্য হন। অন্তঃপুরে থাকা স্ত্রীজনের পক্ষে সুবিধা বলিয়াই স্ত্রীলোকের অন্তঃপুরবাসের প্রথা প্রচলিত হইয়াছে; পুরুষেরা স্বার্থপর বলিয়া ওরূপ প্রথা প্রচলিত হইয়াছে এ কথা কোনো কার্যের কথা নহে। পুরুষেরা স্বার্থপর বলিয়া ছেলে-পিলে মানুষ করে না, রাঁধেবাড়ে না, ইত্যাদি কথা যদি সত্য হয় তবে এ কথাও কেন না সত্য হইবে যে, স্ত্রীরা স্বার্থপর বলিয়া আপিসে বেরোয় না, লাঙল চষে না, মোট বয় না ইত্যাদি। অন্তঃপুর একটা কারাগার, অন্তঃপুরবাসিনীরা একটা বোবা জানোয়ার, পিতামাতাকে ভূমিষ্ঠ হইয়। প্রণাম করা দাসত্ব, এ-সকল ইংরাজি বাঁধি বোল ইংরাজের মুখেই শোভা পায়—বিশেষতঃ সেই-সব মানোয়ারীই বলো আর জানোয়ারই বলো তাঁহাদের মুখে যাহারা নারিকেলের ছোবড়া ভক্ষণ করিয়া তাহার অবশিষ্ট অংশকে আঁটি মনে করিয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। যে ব্যক্তি আপন পিঙ্গলনয়নে কল্পনার দূরবীক্ষণ প্রয়োগ করিয়া আমাদের অন্তঃপুরবাসিনীদিগকে কেবল শাসনভয়ে জড়সড় হইয়া সকল কার্য করিতে দেখে, যাহারা দেখে যে পতিকে রাঁধিয়া বাড়িয়া খাওয়ানোতে পতির প্রতি পত্নীর ভালোবাসা প্রকাশ পায় না, পত্নীর প্রতি পতির নির্দয় শাসনই প্রকাশ পায়; কুলরমণীরাযে যে-সে পুরুষের সঙ্গে আমোদ করিয়া বেড়ায় না সে কেবল পতির শাসনভয়ে, পতির প্রতি ভালোবাসা তাহার কারণ নহে; এমন-কি যাহারা পুত্রের ভূমিষ্ঠ প্রণামে পিতৃভক্তি দেখে না, দাসত্বমাত্রই দেখে; তাহারা আমাদের দেশীয় সভ্যতার ছোবড়াটুকুই সার পদার্থ, সুতরাং সেই মহার্হ সভ্যতাকে নিতান্ত অসার পদার্থ, মনে করিবে ইহা তো ধরাই আছে। কিন্তু তাহার প্রকৃত সার পদার্থ যে তাহার ভিতরকার শাঁস ইহা যদি একজন বাঙালিরও চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া দেখাইতে হয় তবে সে বড়ো রহস্য। একজন বাঙালিকে যদি শিখাইতে হয় যে অন্তঃপুর গৃহিণীগণের কারাগার নহে, কিন্তু তাঁহাদের সাধের নিকেতন— পিতামাতার প্রতি পুত্রের নম্র ব্যবহার ভক্তি এবং ভালোবাসার নিদর্শন, তাহার মধ্যে কঠোরতা কিছুমাত্র নাই—স্ত্রীলোকেরা-যে যে-সে পুরুষের সঙ্গে মিলিয়া-মিশিয়া আমোদ করে না সে কেবল এই জন্যে যে, তাহাদের পবিত্র গার্হস্থ্যভাব আমোদপ্রমোদ অপেক্ষা সহস্রগুণ অধিক যত্নের ধন— এই-সকল ষৎপরোনান্তি দুরূহ বিষয়ের নিগূঢ় তত্ত্ব যদি বাঙালিকে শিক্ষা দিতে হয় তবে নূতন একটা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি না করিলে আর চলে না।

—ভারতী-সম্পাদক