যোগাযোগ/১৬

উইকিসংকলন থেকে

১৬

 দু-দিন পরেই নবগোপাল এসে বললে, “কী করি একটা পরামর্শ দাও।”

 বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “কেন? কী হয়েছে?”

 “সঙ্গে গোটাকতক সাহেব,—দালাল হবে, কিংবা মদের দোকানের বিলিতি শুঁড়ি, কাল পীরপুরের চরের থেকে কিছু না হবে তো দু-শ কাদাখোঁচা পাখি মেরে নিয়ে উপস্থিত। আজ চলেছে চন্দনদহের বিলে। এই শীতের সময় সেখানে হাঁসের মরসুম—রাক্ষুসে ওজনের জীবহত্যা হবে,অহিরাবণ মহীরাবণ হিড়িম্ব ঘটোৎকচ ইস্তিক কুম্ভকর্ণের পর্যন্ত পিণ্ডি দেবার উপযুক্ত,—প্রেতলােকে দশমুণ্ড রাবণের চোয়াল ধরে যাবার মতাে।”

 বিপ্রদাস স্তম্ভিত হয়ে রইল, কিছু বললে না।

 নবগােপাল বললে, “তােমারই হুকুম ওই বিলে কেউ শিকার করতে পাবে না। সেবার জেলার ম্যাজিস্ট্রেটকে পর্যন্ত ঠেকিয়েছিলে— আমরা তো ভয় করেছিলুম তােমাকেও পাছে সে রাজহাঁস ভুল করে গুলি করে বসে। লােকটা ছিল ভদ্র, চলে গেল। কিন্তু এরা গাে-মৃগ-দ্বিজ কাউকে মানবার মতো মানুষ নয়। তবু যদি বল তো একবার না হয়—”

 বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে বললে, “না না, কিছু বােলাে না।”

 বিপ্রদাস বাঘ শিকারে জেলার মধ্যে সব-সেরা। কোনাে একবার পাখি মেরে তার এমন ধিক্‌কার হয়েছিল যে, সেই অবধি নিজের এলেকায় পাখি মারা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে।

 শিয়রের কাছে কুমু বসে বিপ্রদাসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নবগােপাল চলে গেলে সে মুখ শক্ত করে বললে, “দাদা, বাবণ করে পাঠাও।”

 “কী বারণ করব?”

 “পাখি মারতে।”

 “ওরা ভুল বুঝবে কুমু, সইবে না।”

 “তা বুঝুক ভুল। মান-অপমান শুধু ওদের একার নয়।”

 বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে মনে-মনে হাসলে। সে জানে কঠিন নিষ্ঠার সঙ্গে কুমু মনে-মনে সতীধর্ম অনুশীলন করছে। ছায়েবানুগতাস্বচ্ছা। সামান্য পাখির প্রাণ নিয়ে কায়ার সঙ্গে ছায়ার পথভেদ ঘটবে না কি?

 বিপ্রদাস স্নেহের স্বরে বললে, “রাগ করিস নে কুমু, আমিও একদিন পাখি মেরেছি। তখন অন্যায় বলে বুঝতেই পারি নি। এদেরও সেই দশা।”

 অক্লান্ত উৎসাহের সঙ্গে চলল শিকার, পিকনিক, এবং সন্ধ্যেবেলার ব্যাণ্ডের সংগীতসহযােগে ইংরেজ অভ্যাগতদের নাচ। বিকালে টেনিস; তা ছাড়া দিঘির নৌকোর ’পরে তিন-চার পর্দা তুলে দিয়ে বাজি রেখে পালের খেলা;—তাই দেখতে গ্রামের লােকেরা দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে যায়। রাত্রে ডিনারের পরে চীৎকার চলে, “ফর হী ইজ এ জলি গুড ফেলো।” এই সব বিলাসের প্রধান নায়কনায়িকা সাহেব-মেম, তাতেই গাঁয়ের লােকের চমক লাগে। এরা যে সােলার টুপি মাথায় ছিপ ফেলে মাছ ধরে, সেও বড়ো অপরূপ দৃশ্য। অন্য পক্ষে লাঠিখেলা কুস্তি নৌকোবাচ যাত্রা শখের থিয়েটার এবং চারটে হাতির সমাবেশ এর কাছে লাগে কোথায়?

 বিবাহের দুদিন আগে গায়ে-হলুদ। দামি গহনা থেকে আরম্ভ করে খেলার পুতুল পর্যন্ত সওগাত যা বরের বাসা থেকে এল তার ঘটা দেখে সকলে অবাক। তার বাহনই বা কত! চাটুজ্যেরা খুব দরাজ হাতেই তাদের বিদেয় করলে।

 অবশেষে জনসাধারণকে খাওয়ানাে নিয়ে বৈবাহিক কুরুক্ষেত্রের দ্রোণপর্ব শুরু হল।

 সেদিন ঢােল পিটিয়ে সর্বসাধারণের নিমন্ত্রণ মধুসাগরের তীরে মধুপুরীতে। রবাহূত অনাহূত কারও বাদ নেই। নবগােপাল রেগে

আগুন। এ কী আস্পর্ধা! আমরা হলুম জমিদার, এর মধ্যে উনি ওঁর মধুপুরী খাড়া করেন কোথা থেকে?

 এদিকে ভােজের আয়ােজনটা খুব ব্যাপকরূপেই সকলের কাছে প্রকাশমান হয়ে উঠল। সামান্য ফলার নয়। মাছ দই ক্ষীর সন্দেশ ঘি ময়দা চিনি খুব শোরগােল করে আমদানি। গাছতলায় মস্ত-মস্ত উনন পাতা; রান্নার জন্যে নানা আয়তনের হাঁড়ি হাঁড়া মালসা কলসী জালা; সারবন্দি গােরুর গাড়িতে এল আলু বেগুন কাঁচকলা শাকসবজি। আহারটা হবে সন্ধ্যের সময় বাঁধা রােশনাইয়ের আলােয়।

 এদিকে চাটুজ্যেদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভােজন। দলে দলে প্রজার মিলে নিজেরাই আয়ােজন করেছে। হিন্দুদের মুসলমানদের স্বতন্ত্র জায়গা। মুসলমান প্রজার সংখ্যাই বেশি—রাত না পােয়াতেই তারা নিজেরাই রান্না চড়িয়েছে। আহারের উপকরণ যত না হোক, ঘন ঘন, চাটুজ্যেদের জয়ধ্বনি উঠছে তার চতুর্গুণ। স্বয়ং নবগােপালবাবু বেলা প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত অভুক্ত অবস্থায় বসে থেকে সকলকে খাওয়ালেন। তার পরে হল কাঙালিবিদায়। মাতব্বর প্রজারা নিজেরাই দানবিতরণের ব্যবস্থা করলে। কলধ্বনিতে জয়ধ্বনিতে বাতাসে চলল সমুদ্রমন্থন।

 মধুপুরীতে সমস্তদিন রান্না বসেছে। গন্ধে বহুদূর পর্যন্ত আমােদিত। খুরি ভাঁড় কলাপাতা হয়েছে পর্বতপ্রমাণ। তরকারি ও মাছকোটার আবর্জনা নিয়ে কাকেদের কলরবের বিরাম নেই—রাজ্যের কুকুরগুলােও পরস্পর কামড়াকামড়ি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিয়েছে। সময় হয়ে এল, রােশনাই জ্বলেছে, মেটিয়াবুরুজের রােশনচৌকি ইমনকল্যাণ থেকে কেদারা পর্যন্ত বাজিয়ে চলল। অনুচরপরিচরেরা থেকে-থেকে উদ্বিগ্নমুখে রাজাবাহাদুরের কানের কাছে ফিস ফিস করে জানাচ্ছে এখনও খাবার লােক যথেষ্ট এল না। আজ হাটের দিন, ভিন্ন এলেকা থেকে যারা হাট করতে এসেছে তাদের কেউ কেউ পাত-পাড়া দেখে বসে গেছে। কাঙাল-ভিক্ষুকও সামান্য কয়েকজন আছে।

 মধুসূদন নির্জন তাঁবুর ভিতর ঢুকে মুখ অন্ধকার করে একটা চাপা হুংকার দিলে,—“হুঁ।”

 ছোটো ভাই রাধু এসে বললে, “দাদা, আর কেন? চলো।”

 “কোথায়?

 “ফিরে যাই কলকাতায়। এরা সব বদমাইশি করছে। এদের চেয়ে বড়ো বড়ো ঘরের পাত্রী তোমার কড়ে আঙুল নাড়ার অপেক্ষায় বসে। একবার তু করলেই হয়।”

 মধুসূদন গর্জন করে উঠে বললে, “যা চলে।”

 এক-শ বছর পূর্বে যেমন ঘটেছিল আজও তাই। এবারেও একপক্ষের আড়ম্বরের চুড়োটা অন্যপক্ষের চেয়ে অনেক উঁচু করেই গড়া হয়েছিল, অন্যপক্ষ তা রাস্তা পার হতে দিলে না। কিন্তু আসল হারজিত বাইরে থেকে দেখা যায় না। তার ক্ষেত্রটা লোকচক্ষুর অগোচরে।

 চাটুজ্যেদের প্রজারা খুব হেসে নিলে। বিপ্রদাস রোগশয্যায়; তার কানে কিছুই পৌঁছল না।