যোগাযোগ/৩

উইকিসংকলন থেকে

 এইবার কন্যাপক্ষের কথা।

 নুরনগরের চাটুজ্যেদের অবস্থা এখন ভালাে নয়। ঐশ্বর্যের বাঁধ ভাঙছে। ছয়-আনি শরিকরা বিষয় ভাগ করে বেরিয়ে গেল, এখন তারা বাইরে থেকে লাঠি হাতে দশ-আনির সীমানা খাবলে বেড়াচ্ছে। ছাড়া রাধাকান্ত জীউর সেবায়তি অধিকার দশে-ছয়ে যতই সূক্ষ্মভাবে ভাগ করবার চেষ্টা চলছে, ততই তার শস্য অংশ স্থূলভাবে উকিলমােক্তারের আঙিনায় নয়-ছয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ল, আমলারাও বঞ্চিত হল না নুরনগরের সে-প্রতাপ নেই— আয় নেই, ব্যয় বেড়েছে চতুর্গুণ। শতকরা ন-টাকা হারে সুদের ন-পাওআলা মাকড়সা জমিদারির চারদিকে জাল জড়িয়ে চলেছে।

 পরিবারে দুই ভাই, পাঁচ বােন। কন্যাধিক্য-অপরাধের জরিমানা এখনও শেষ হয় নি। কর্তা থাকতেই চার বােনের বিয়ে হয়ে গেল কুলীনের ঘরে। এদের ধনের বহরটুকু হাল আমলের, খ্যাতিটা সাবেক আমলের। জামাইদের পণ দিতে হল কৌলীন্যের মােটা দামে ও ফাঁকা খ্যাতির লম্বা মাপে। এই বাবদেই ন-পার্সেণ্টের সূত্রে গাঁথা দেনার ফঁসে বারো পার্সেণ্টের গ্রন্থি পড়ল। ছােটো ভাই মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললে, বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে আসি, রােজগার না করলে চলবে না। সে গেল বিলেতে, বড় ভাই বিপ্রদাসের ঘাড়ে পড়ল সংসারের ভার।

 এই সময়টাতে পূর্বোক্ত ঘােষাল ও চাটুজ্যেদের ভাগ্যের ঘুড়িতে পরস্পরের লখে লখে আর-একবার বেধে গেল। ইতিহাসটা বলি।

 বড়ােবাজারের তনসুকদাস হালওআইদের কাছে এদের একটা মােটা অঙ্কের দেনা। নিয়মিত সুদ দিয়ে আসছে, কোনাে কথা ওঠে নি। এমন সময়ে পূজোর ছুটি পেয়ে বিপ্রদাসের সহপাঠী অমূল্যধন এল আত্মীয়তা দেখাতে। সে হল বড়ো অ্যাটর্নি-আপিসের আর্টিকেল্‌ড্, হেড্-ক্লার্ক। এই চশমা-পরা যুবকটি নুরনগরের অবস্থাটা আড়চোখে দেখে নিলে। সেও কলকাতায় ফিরল আর তনসুকদাসও টাকা ফেরত চেয়ে বসল; বললে, নতুন চিনির কারবার খুলেছে, টাকার জরুরি দরকার।

 বিপ্রদাস মাথায় হাত দিয়ে পড়ল।

 সেই সংকটকালেই চাটুজ্যে ও ঘোষাল এই দুই নামে দ্বিতীয়বার ঘটল বন্দ্ব-সমাস। তার পূর্বেই সরকারবাহাদুরের কাছ থেকে মধুসূদন রাজখেতাব পেয়েছে। পূর্বোক্ত ছাত্রবন্ধু এসে বললে, নতুন রাজা খােশমেজাজে আছে, এই সময়ে ওর কাছ থেকে সুবিধেমতাে ধার পাওয়া যেতে পারে। তাই পাওয়া গেল— চাটুজ্যেদের সমস্ত খুচরো দেনা একঠাঁই করে এগারাে লাখ টাকা সাত পার্সেট সুদে। বিপ্রদাস হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

 কুমুদিনী ওদের শেষ অবশিষ্ট বােন বটে, তেমনি আজ ওদের সম্বলেরও শেষ অবশিষ্ট দশা। পণ জোটানাের, পাত্র জোটানাের কথা কল্পনা করতে গেলে আতঙ্ক হয়। দেখতে সে সুন্দরী, লম্বা ছিপ্‌ছিপে, যেন রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ড; চোখ বড়ো না হােক একেবারে নিবিড় কালাে, আর নাকটি নিখুঁত রেখায় যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি। রঙ শাঁখের মতো চিকন গৌর; নিটোল দুখানি হাত; সে-হাতের সেবা কমলার বরদান, কৃতজ্ঞ হয়ে গ্রহণ করতে হয়। সমস্ত মুখে একটি বেদনায় সকরুণ ধৈর্যের ভাব।

 কুমুদিনী নিজের জন্যে নিজে সংকুচিত। তার বিশ্বাস, সে অপয়া। সে জানে, পুরুষরা সংসার চালায় নিজের শক্তি দিয়ে, মেয়েরা লক্ষ্মীকে ঘরে আনে নিজের ভাগ্যের জোরে। ওর দ্বারা তা হল না। যখন থেকে ওর বােঝবার বয়স হয়েছে তখন থেকে চারিদিকে দেখছে দুর্ভাগ্যের পাপদৃষ্টি। আর, সংসারের উপর চেপে আছে ওর নিজের আইবুড়ো-দশা, জগদ্দল পাথর, তার যতবড়ো দুঃখ, ততবড়াে অপমান। কিছু করবার নেই, কপালে করাঘাত ছাড়া। উপায় করবার পথ বিধাতা মেয়েদের দিলেন না, দিলেন কেবল ব্যথা পাবার শক্তি। অসম্ভব একটা কিছু ঘটে না কি? কোনাে দেবতার বর, কোনাে যক্ষের ধন, পূর্বজন্মের কোনাে একটা বাকিপড়া পাওনার এক মুহূর্তে পরিশােধ? এক-একদিন রাতে বিছানা থেকে উঠে বাগানের মর্মরিত ঝাউগাছগুলাের মাথার উপরে চেয়ে থাকে, মনে-মনে বলে, “কোথায় আমার রাজপুত্র, কোথায় তােমার সাতরাজার ধন মানিক, বাঁচাও আমার ভাইদের, আমি চিরদিন তােমার দাসী হয়ে থাকব।”

 বংশের দুর্গতির জন্য নিজেকে যতই অপরাধী করে, ততই হৃদয়ের সুধাপাত্র উপুড় ক’রে ভাইদের ওর ভালােবাসা দেয়— কঠিন দুঃখে নেংড়ানো ওর ভালোবাসা। কুমুর ’পরে তাদের কর্তব্য করতে পারছে না বলে ওর ভাইরাও বড়ো ব্যথার সঙ্গে কুমুকে তাদের স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এই পিতৃমাতৃহীনাকে উপরওয়ালা যে স্নেহের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন ভাইরা তা ভরিয়ে দেবার জন্যে সর্বদা উৎসুক। ও যে চাঁদের আলোর টুকরাে, দৈন্যের অন্ধকারকে একা মধুর করে রেখেছে। যখন মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যের বাহন বলে নিজেকে সে ধিক্কার দেয়, দাদা বিপ্রদাস হেসে বলে, কুমু, তুই নিজেই তো আমাদের সৌভাগ্য— তােকে না পেলে বাড়িতে শ্রী থাকত কোথায়?”

 কুমুদিনী ঘরে পড়াশুনা করেছে। বাইরের পরিচয় নেই বললেই হয়। পুরােনাে নতুন দুই কালের আলাে-আঁধারে তার বাস। তার জগৎটা আবছায়া— সেখানে রাজত্ব করে সিদ্ধেশ্বরী, গন্ধেশ্বরী, ঘেঁটু, ষষ্ঠী; সেখানে বিশেষ দিনে চন্দ্র দেখতে নেই; শাঁখ বাজিয়ে গ্রহণের কুদৃষ্টিকে তাড়াতে হয়, অম্বুবাচীতে সেখানে দুধ খেলে সাপের ভয় ঘোচে; মন্ত্র প’ড়ে, পাঁঠা মানত ক’রে, সুপুরি আলো-চাল ও পাঁচ পয়সার শিন্নি মেনে, তাগাতাবিজ প’রে,সে জগতের শুভ-অশুভের সঙ্গে কারবার; স্বস্ত্যয়নের জোরে ভাগ্য সংশোধনের আশা— সে-আশা হাজারবার ব্যর্থ হয়। প্রত্যক্ষ দেখা যায় অনেক সময়েই শুভলগ্নের শাখায় শুভফল ফলে না, তবু বাস্তবের শক্তি নেই প্রমাণের দ্বারা স্বপ্নের মােহ কাটাতে পারে। স্বপ্নের জগতে বিচার চলে না, একমাত্র চলে মেনে-চলা। এ-জগতে দৈবের ক্ষেত্রে যুক্তির সুসংগতি, বুদ্ধির কর্তৃত্ব, ভালাে-মন্দর নিত্যতত্ত্ব নেই বলেই কুমুদিনীর মুখে এমন একটা করুণা। ও জানে, বিনা অপরাধেই ও লাঞ্ছিত। আট বছর হল সেই লাঞ্ছনাকে একান্ত সে নিজের বলেই গ্রহণ করেছিল— সে তার পিতার মৃত্যু নিয়ে।