যোগাযোগ/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
◄  ৩৭
৩৯  ►

৩৮

 পরের দিন সকালে মোতির মা যখন কুমুর জন্যে এক বাটি দুধ নিয়ে এল, দেখলে কুমুর দুই চোখ লাল, ফুলে আছে, মুখের রঙ হয়েছে পাঁশের মতো। সকালে ছাদের যে-কোণে আসন পেতে পুব দিকে মুখ করে সে মানসিক পূজায় বসে, ভেবেছিল সেইখানেই কুমুকে দেখতে পাবে। কিন্তু আজ সেখানে নেই, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই যে একটুখানি ঢাকা ছাদ, সেইখানেই দেয়ালের গায়ে অবসন্ন ভাবে ঠেসান দিয়ে সে মাটিতে বসে। আজ বুঝি ঠাকুরের উপর রাগ করেছে। নিরপরাধ ছেলেকে নিষ্ঠুর বাপ যখন অকারণ মারে তখন সে যেমন কিছুই বুঝতে পারে না, অভিমান করে আঘাত গায়ে পেতে নেয়, প্রতিবাদ করবারও চেষ্টা করতে মুখে বাধে, ঠাকুরের ’পরে কুমুর আজ সেই রকম ভাব। আহ্বানকে সে দৈব বলে মেনেছিল, সে কি এই অশুচিতার মধ্যে, এই আন্তরিক অসতীত্বে? ঠাকুর নারীবলি চান বলেই শিকার ভুলিয়ে এনেছেন নাকি;—যে-শরীরটার মধ্যে মন নেই সেই মাংসপিণ্ডকে করবেন তার নৈবেদ্য? আজ কিছুতে ভক্তি জাগল না। এতদিন কুমু বার বার করে বলেছে, আমাকে তুমি সহ্য করো— আজ বিদ্রোহিণীর মন বলছে, তোমাকে আমি সহ্য করব কী করে? কোন্ লজ্জায় আনব তোমার পূজা? তোমার ভক্তকে নিজে না গ্রহণ করে তাকে বিক্রি করে দিলে কোন্ দাসীর হাটে—যে হাটে মাছমাংসের দরে মেয়ে বিক্রি হয়, যেখানে নির্মাল্য নেবার জন্যে কেউ শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজার অপেক্ষা করে না, ছাগলকে দিয়ে ফুলের বন মুড়িয়ে খাইয়ে দেয়।

 মোতির মা যখন দুধ খাবার জন্যে অনুরোধ করলে, কুমু বললে, “থাক্।”

 মোতির মা বললে, “কেন, থাকবে কেন আমার দুধের বাটির অপরাধ কী?”

 কুমু বললে, “এখনও স্নান করি নি, পূজা করি নি।”

 মোতির মা বললে, “যাও তুমি স্নান করতে, আমি অপেক্ষা করে থাকব।”

 কুমু স্নান সেরে এল। মোতির মা ভাবলে, এইবার সে খোলা ছাদের কোণটাতে গিয়ে বসবে। কুমু মুহূর্তের জন্যে অভ্যাসের টানে ছাদের দিকে যেতে পা বাড়িয়েছিল, গেল না, ফিরে আবার সেই মাটিতে এসে বসল। তার মন তৈরি ছিল না।

 মোতির মাকে কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “দাদার চিঠি কি আসে নি?”

 চিঠি খুব সম্ভব এসেছে মনে করেই আজ খুব ভোরে মোতির মা নিজে লুকিয়ে আপিস-ঘরে গিয়ে চিঠির দেরাজটা টানতে গিয়ে দেখলে সেটা চাবি দিয়ে বন্ধ। অতএব এখন থেকে চুরির উপর বাটপাড়ি করবার রাস্তা আটক রইল।

 মোতির মা বললে, “ঠিক বলতে তো পারি নে, খবর নিয়ে দেখব।”

 এমন সময় হঠাৎ শ্যামা এসে উপস্থিত; বললে, “বউ, তোমাকে এমন শুকনো দেখি যে, অসুখ করে নি তো?”

 কুমু বললে, “না।”

 “বাড়ির জন্যে মনটা কেমন করছে। আহা, তা তো হতেই পারে। তা তোমার দাদা তো আসছেন, দেখা হবে।”

 কুমু চমকে উঠে শ্যামার মুখের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চাইলে।

 মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “এ খবর তুমি কোথায় পেলে বকুলফুল?”

 “ওই শোনো! এ তো সবাই জানে। আমাদের রান্নাঘরের পার্বতী যে বললে, ওঁর বাপের বাড়ির সরকার এসেছিল রাজাবাহাদুরের কাছে, বউয়ের খবর নিতে; তার কাছে শুনেছে, চিকিৎসার জন্যে বউয়ের দাদা আজকালের মধ্যেই কলকাতায় আসছেন।”

 কুমু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “তাঁর ব্যামো কি বেড়েছে?”

 “তা বলতে পারিনে। তবে এমন কিছু ভাবনার কথা নেই, তাহলে শুনতুম।”

 শ্যামা বুঝেছিল, ওর দাদার খবর মধুসূদন কুমুকে দেয় নি, যে-বউয়ের মন পায় নি, পাছে সে বাড়িমুখো হয়ে আরও অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কুমুর মনটাকে উসকিয়ে দিয়ে বললে, “তোমার দাদার মতো মানুষ হয় না, এই কথা সবার কাছেই শুনি। বকুলফুল, চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে, ভাঁড়ার দিতে হবে। আপিসের রান্না চড়াতে দেরি হলে মুশকিল বাধবে।”

 মোতির মা দুধের বাটিটা আর-একবার কুমুর কাছে এগিয়ে নিয়ে বললে, “দিদি, দুধ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে ফেলো। লক্ষ্মীটি।”

 এবার কুমু দুধ খেতে আপত্তি করলে না।

 মোতির মা কানে-কানে জিজ্ঞাসা করলে,“ভাঁড়ার-ঘরে যাবে আজ?”

 কুমু বললে, “আজ থাক্; গোপালকে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দাও।”

 একটা কালো কঠোর ক্ষুধিত জরা বাহির থেকে কুমুকে গ্রাস করেছে রাহুর মতো। যে পরিণত বয়স শান্ত স্নিগ্ধ শুভ্র সুগম্ভীর, এ তো তা নয়; যা লালায়িত, যার সংযমের শক্তি শিথিল, যার প্রেম বিষয়াসক্তিরই স্বজাতীয়, তারই স্বেদাক্ত স্পর্শে কুমুর এত বিতৃষ্ণা। ওর স্বামীর বয়স বেশি বলে কুমুর কোনো আক্ষেপ ছিল না, কিন্তু সেই বয়স নিজের মর্যাদা ভুলেছে বলে তার এত পীড়া। সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন একটা ফলের মতো, আলো-হাওয়ায় মুক্তির মধ্যে সে পাকে, কাঁচা ফলকে জাঁতায় পিষলেই তো পাকে না। সময় পেল না বলেই আজ ওদের সম্বন্ধ কুমুকে এমন করে মারছে, এত অপমান করছে। কোথায় পালাবে। মোতির মাকে ওই যে বললে, গোপালকে ডেকে দাও, সে এই পালাবার পথ খোঁজা—বৃদ্ধ অশুচিতার কাছ থেকে নবীন নির্মলতার মধ্যে, দূষিত নিশ্বাসবাষ্প থেকে ফুলের বাগানের হাওয়ায়।

 একটা পাতলা তুলো-ভরা ছিটের জামা গায়ে দিয়ে হাবলু সিঁড়ির দরজার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে দাঁড়াল। ওর মায়ের মতোই বড়ো বড়ো কালো চোখ, তেমনিই জল-ভরা মেঘের মতো সরস শামলা রঙ, গাল দুটো ফুলো ফুলো, প্রায় ন্যাড়া করে চুল ছাঁটা।

 কুমু উঠে গিয়ে সংকুচিত হাবলুকে টেনে এনে বুকে চেপে ধরলে; বললে, “দুষ্ট ছেলে, এ দুদিন আস নি কেন?”

 হাবলু কুমুর গলা জড়িয়ে ধরে কানে-কানে বললে, “জেঠাইমা, তোমার জন্যে কী এনেছি বলো দেখি?”

 কুমু তার গালে চুমু খেয়ে বললে, “মানিক এনেছ গোপাল।”

 “আমার পকেটে আছে।”

 “আচ্ছা, তবে বের করো।”

 “তুমি বলতে পারলে না।”

 “আমার বুদ্ধি নেই, যা চোখে দেখি তাও বুঝতে পারি নে, যা দেখি তা আরও ভুল বুঝি।”

 তখন হাবলু খুব আস্তে আস্তে পকেট থেকে ব্রাউন কাগজের একটা পুঁটুলি বের করে কুমুর কোলের উপর রেখে দৌড়ে পালাবার উপক্রম করলে।

 “না, তোমাকে পালাতে দেব না।”

 পুঁটুলিটা হাত দিয়ে চাপা দিয়ে ব্যস্ত হয়ে হাবলু বললে, “তাহলে এখন দেখো না।”

 “না, ভয় নেই, তুমি চলে গেলে তখন খুলব।”

 “আচ্ছা জেঠাইমা, তুমি জটাইবুড়িকে দেখেছ?”

 “কী জানি, হয়তাে দেখে থাকব, কিন্তু চিনতে সময় লাগে।”

 “একতলায় উঠোনের পাশে কয়লার ঘরে সন্ধ্যের সময় চামচিকের পিঠে চড়ে সে আসে।”

 “চামচিকের পিঠে চড়ে সে আসে?”

 “ইচ্ছে করলেই সে খুব ছােট্ট হতে পারে, চোখে প্রায় দেখাই যায় না।”

 “সেই মন্তরটা তার কাছে শিখে নিতে হবে তো।”

 “কেন, জ্যেঠাইমা?”

 “আমি যদি পালাবার জন্যে কয়লার ঘরে ঢুকি তবুও যে আমাকে দেখতে পাওয়া যায়।”

 হাবলু এ- কথাটার কোনাে মানে বুঝতে পারলে না। বললে, “কয়লার মধ্যে সিঁদুরের কৌটো লুকিয়ে রেখেছে। সেই সিঁদুর কোথা থেকে এনেছে জান?”

 “বােধ হয় জানি।”

 “আচ্ছা, বলো দেখি।”

 “ভােরবেলাকার মেঘের ভিতর থেকে।”

 হাবুল থমকে গেল। তাকে ভাবিয়ে দিলে। বিশেষ-সংবাদদাতা তাকে সাগর পারের দৈত্যপুবীর কথা বলেছিল। কিন্তু জেঠাইমার কথাটা মনে হল বিশ্বাসযােগ্য, তাই কোনো বিরুদ্ধ তর্ক না তুলে বললে, “যে-মেয়ে সেই কৌটো খুঁজে বের করে সিঁদুরটিপ কপালে পরবে, সে হবে রাজরানী।”

 “সর্বনাশ! কোনাে হতভাগিনী খবর পেয়েছে নাকি?”

 “সেজোপিসিমার মেয়ে খুদি জানে। ঝুড়ি নিয়ে ছন্নু যখন সকালে কয়লা বের করতে যায় রোজ খুদি সেইসঙ্গে যায়—ও একটুও ভয় করে না।”

 “ও-যে ছেলেমানুষ, তাই রাজরানী হতেও ভয় নেই।”

 বাইরে ঠাণ্ডা উত্তরে হাওয়া দিচ্ছিল তাই মোতিকে নিয়ে কুমু ঘরে গেল; সেখানে সোফায় বসে ওকে কোলে তুলে নিলে। পাশের তেপাইয়ে ছোটো রুপোর থালিতে ছিল শীতকালের ফুল—গাঁদা, কুন্দ, দোপাটি, জবা। প্রতিদিনের জোগান-মতো এই ফুলই মালীর তোলা। কুমু ছাদের কোণে বসে সূর্যোদয়ের দিকে মুখ করে দেবতাকে উৎসর্গ করে দেবে বলে এরা অপেক্ষা করে আছে। আজ তার সেই অনিবেদিত ফুল থালাসুদ্ধ নিয়ে সে হাবলুর কাছে ধরল; বললে, “নেবে ফুল?”

 “হাঁ নেব।”

 “কী করবে বলো তো?”

 “পুজো পুজো খেলব!”

 কুমুর কোমরে একটা সিল্কের রুমাল গোঁজা ছিল, সেইটেতে ফুলগুলি বেঁধে দিয়ে ওকে চুমো খেয়ে বললে, “এই নাও।” মনে-মনে ভাবলে, “আমারও পুজো-পুজো খেলা হল।” বললে, “গোপাল, এর মধ্যে কোন্ ফুল তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে, বলো তো?”

 হাবলু বললে, “জবা।”

 “কেন জবা ভালো লাগে বলব?”

 “বলো দেখি।”

 ও যে ভোর না হতেই জটাইবুড়ির সিঁদুরের কৌটো থেকে রঙ চুরি করেছে।”

 হাবলু খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে ভাবলে। হঠাৎ বলে উঠল, “জেঠাইমা, জবাফুলের রঙ ঠিক তােমার শাড়ির এই লাল পাড়ের মতো।” এইটুকুতে ওর মনের সব কথা বলা হয়ে গেল।

 এমন সময় হঠাৎ পিছনে দেখে মধুসূদন। পায়ের শব্দ পাওয়া যায় নি। এখন অন্তঃপুরে আসবার সময় নয়। এই সময়টাতে বাইরের আপিস-ঘরে ব্যাবসা-ঘটিত কর্মের যত উচ্ছিষ্ট পরিশিষ্ট এসে জোটে; এই সময় দালাল অসে, উমেদার আসে, যত রকম খুচরাে খবর ও কাগজপত্র নিয়ে সেক্রেটারি আসে। আসল কাজের চেয়ে এই-সব উপরি-কাজের ভিড় কম নয়।