যোগাযোগ/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
◄  ৪৬
৪৮  ►

৪৭

 কালু ঘরে ঢুকতেই কুমু তাকে প্রণাম করলে।

 কালু বললে, “ছোটোখুকী, এসেছ? এইবার দাদার সেরে উঠতে দেরি হবে না।”

 কুমুর চোখ ছলছল করে উঠল। অশ্রু সামলে নিয়ে বললে, “দাদা, তোমার বার্লিতে নেবুর রস দেবে না?”

 বিপ্রদাস উদাসীন ভাবে হাত ওলটালে, অর্থাৎ না হলেই বা ক্ষতি কী। কুমু জানে, বিপ্রদাস বার্লি খেতে ভালোবাসে না, তাই ও যখনই দাদাকে বার্লি খাইয়েছে বার্লিতে নেবুর রস এবং অল্প একটু গোলাপজল মিশিয়ে বরফ দিয়ে শরবতের মতো বানিয়ে দিত। সে আয়োজন আজ নেই, তবু বিপ্রদাস আপন ইচ্ছে কাউকে জানায়ও নি, যা পেয়েছে তাই বিতৃষ্ণা সঙ্গে খেয়েছে।

 বার্লি ঠিকমতো তৈরি করে আনবার জন্যে কুমু চলে গেল।

 বিপ্রদাস উদ্বিগ্নমুখে জিজ্ঞাসা করলে, “কালুদা, খবর কী বলো।”

 “তোমার একলার সইয়ে টাকা ধার দিতে কেউ রাজি হয় না, সুবোধের সই চায়। মাড়োয়ারি ধনীদের কেউ কেউ দিতে পারে, কিন্তু সেটা নিতান্ত বাজিখেলার মতো করে—অত্যন্ত বেশি সুদে চায়, সে আমাদের পোষাবে না।”

 “কালুদা, সুবোধকে তার করতে হবে আসবার জন্যে। আর দেরি করলে তো চলবে না।”

 “আমারও ভালো ঠেকছে না। সেবারে তোমার সেই আংটি-বেচা টাকা নিয়ে যখন মূল দেনার এক অংশ শোধ করতে গেলুম, মধুসূদন নিতে রাজিই হল না; তখনই বুঝলুম সুবিধে নয়। নিজের মর্জিমতো একদিন হঠাৎ কখন ফাঁস এঁটে ধরবে।”

 বিপ্রদাস চুপ করে ভাবতে লাগল।

 কালু বললে, “দাদা, ছোটোখুকী যে হঠাৎ আজ সকালে চলে এল, রাগারাগি করে আসে নি তো? মধুসূদনকে চটাবার মতো অবস্থা আমাদের নয়, এটা মনে রাখতে হবে।”

 “কুমু বলছে ওর স্বামীর সম্মতি পেয়েছে।”

 “সম্মতিটার চেহারাটা কী রকম না জানলে মন নিশ্চিন্ত হচ্ছে না। কত সাবধানে ওর সঙ্গে ব্যবহার করি সে আর তোমাকে কী বলব দাদা। রাগে সর্ব অঙ্গ যখন জ্বলছে তখনও ঠাণ্ডা হয়ে সব সয়েছি, গৌরীশংকরের পাহাড়টার মতো, দুপুর-রোদ্দরেও তার বরফ গলে না। একে মহাজন তাতে ভগ্নীপতি, একে সামলে চলা কি সোজা কথা।”

 বিপ্রদাস কোনো জবাব না করে চুপ করে ভাবতে লাগল।

 কুমু এল বার্লি নিয়ে। বিপ্রদাসের মুখের কাছে পেয়ালা ধরে বললে, “দাদা, খেয়ে নাও।”

 বিপ্রদাস তার ভাবনা থেকে হঠাৎ চমকে উঠল। কুমু বুঝতে পারলে, গভীর একটা উদ্বেগের মধ্যে দাদা এতক্ষণ ডুবে ছিল।

 কালু যখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কুমু তার পিছন পিছন গিয়ে বারান্দায় ওকে ধরে বললে, “কালুদা, আমাকে সব কথা বলতে হবে।”

 “কী কথা বলতে হবে, দিদি?”

 “তোমাদের কী একটা নিয়ে ভাবনা চলছে।”

 বিষয় আছে ভাবনা নেই, সংসারে এও কি কখনো সম্ভব হয় খুকী? ও যে কাঁটাগাছের ফল, খিদের চোটে পেড়ে খেতেও হয়, পাড়তে গিয়ে সর্বাঙ্গ ছড়েও যায়।”

 “সে-সব কথা পরে হবে, আমাকে বলো কী হয়েছে।”

 “বিষয়কর্মের কথা মেয়েদের বলতে নিষেধ।”

 “আমি নিশ্চয় জানি তোমাদের কী নিয়ে কথা হচ্ছে। বলব?”

 “আচ্ছা, বলো।”

 “আমার স্বামীর কাছে দাদার ধার আছে, সেই নিয়ে।”

 কোনো জবাব না দিয়ে কালু তার বড়ো বড়ো দুই চোখ সকৌতুক বিস্ময়হাস্যে বিস্ফারিত করে কুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

 “আমাকে বলতেই হবে, ঠিক বলেছি কি না।”

 “দাদারই বোন তো, কথা না বলতেই কথা বুঝে নেয়।”

 বিয়ের পরে প্রথম যেদিন বিপ্রদাসের মহাজন বলে মধুসূদন আস্ফালন করে শাসিয়ে কথা বলেছিল, সেইদিন থেকেই কুমু বুঝেছিল দাদার সঙ্গে স্বামীর সম্বন্ধের অগৌরব। প্রতিদিনই একান্তমনে ইচ্ছে করেছিল, এটা যেন ঘুচে যায়। বিপ্রদাসের মনে এর অসম্মান যে বিঁধে আছে তাতে কুমুর সন্দেহ ছিল না। সেদিন নবীন যেই বিপ্রদাসের চিঠির ব্যাখ্যা করলে অমনি কুমুর মনে এল, সমস্তর মূলে আছে এই দেনাপাওনার সম্বন্ধ। দাদার শরীর কেন যে এত ক্লান্ত, কোন কাজের বিশেষ তাগিদে দাদা কলকাতায় চলে এসেছে, কুমু সমস্তই স্পষ্ট বুঝতে পারলে।

 “কালুদা, আমার কাছে লুকিয়ো না, দাদা টাকা ধার করতে এসেছে।”

 “তা, ধার করেই তো ধার শুধতে হবে; টাকা তো আকাশ থেকে পড়ে না। কুটুম্বদের খাতক হয়ে থাকাটা তো ভালো নয়।”

 “সে তো ঠিক কথা, তা টাকার জোগাড় করতে পেরেছ?”

 “ঘুরে ঘেরে দেখছি; হয়ে যাবে, ভয় কী।”

 “না, আমি জানি, সুবিধে করতে পার নি।”

 “আচ্ছা, ছোটোখুকী, সবই যদি জান, আমাকে জিজ্ঞাসা করা কেন? ছেলেবেলায় একদিন আমার গোঁফ টেনে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিলে, গোঁফ হল কেমন করে? বলেছিলুম, সময় বুঝে গোঁফের বীজ বুনেছিলুম বলে। তাতেই প্রশ্নটার তখনই নিষ্পত্তি হয়ে গেল। এখন হলে জবাব দেবার জন্যে ডাক্তার ডাকতে হত। সব কথাই যে তোমাকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে সংসারের এমন নিয়ম নয়।”

 “আমি তোমাকে বলে রাখছি, কালুদা, দাদার সম্বন্ধে সব কথাই আমাকে জানতে হবে।”

 “কী করে দাদার গোঁফ উঠল, তাও?”

 “দেখো, অমন করে কথা চাপা দিতে পারবে না। আমি দাদার মুখ দেখেই বুঝেছি, টাকার সুবিধে করতে পার নি।”

 “নাই যদি পেরে থাকি, সেটা জেনে তোমার লাভ হবে কী?”

 “সে আমি বলতে পারি নে, কিন্তু আমাকে জানতেই হবে। টাকা ধার পাও নি তুমি?”

 “না, পাই নি।”

 “সহজে পাবে না?”

 “পাব নিশ্চয়ই, কিন্তু সহজে নয়; তা দিদি, তোমার কথার জবাব দেওয়ার চেষ্টা ছেড়ে পাবার চেষ্টায় বেরোলে কাজ হয়তো কিছু এগোতে পারে। আমি চললুম।”

 খানিকটা গিয়েই আবার ফিরে এসে কালু বললে, “খুকী, এখানে যে তুমি আজ চলে এলে, তার মধ্যে তো কোনো কাঁটাখোঁচা নেই? ঠিক সত্যি করে বল।”

 “আছে কি না তা আমি খুব স্পষ্ট করে জানি নে।”

 “স্বামীর সম্মতি পেয়েছ?”

 “না-চাইতেই তিনি সম্মতি দিয়েছেন।”

 “রাগ করে?”

 “তাও আমি ঠিক জানি নে; বলেছেন ডেকে পাঠাবার আগে আমার যাবার দরকার নেই।”

 “সে কোনো কাজের কথা নয়, তার আগেই যেয়ো, নিজে থেকেই যেয়ো।”

 “গেলে হুকুম মানা হবে না।”

 “আচ্ছা, সে আমি দেখব।”

 দাদা আজ এই যে বিষম বিপদে পড়েছে, এর সমস্ত অপরাধ কুমুর, এ-কথা না মনে করে কুমু থাকতে পারল না। নিজেকে মারতে ইচ্ছে করে, খুব কঠিন মার। শুনেছে এমন সন্ন্যাসী আছে যারা কণ্টকশয্যায় শুয়ে থাকে, ও সেইরকম করে শুতে রাজি, যদি তাতে কোনো ফল পায়। কোনো যোগী, কোনো সিদ্ধপুরুষ যদি ওকে রাস্তা দেখিয়ে দেয় তা হলে চিরদিন তার কাছে বিকিয়ে থাকতে পারে। নিশ্চয়ই তেমন কেউ আছে, কিন্তু কোথায় তাকে পাওয়া যায়। যদি মেয়েমানুষ না হত, তা হলে যা হয় একটা কিছু উপায় সে করতই। কিন্তু মেজদাদা কী করছেন। একলা দাদার ঘাড়ে সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কোন্ প্রাণে ইংলণ্ডে বসে আছেন?

 কুমু ঘরে ঢুকে দেখে, বিপ্রদাস কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বিছানায় পড়ে আছে। এমন করলে শরীর কি সারতে পারে! বিরুদ্ধ ভাগ্যের দুয়ারে মাথা কুটে মরতে ইচ্ছে করে।

 দাদার শিয়রের কাছে বসে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে কুমু বললে, “মেজদাদা কবে আসবেন?”

 “তা তো বলতে পারি নে।”

 “তাঁকে আসতে লেখো না।”

 “কেন বল্ দেখি।”

 “সংসারের সমস্ত দায় একলা তোমারই ঘাড়ে, এ তুমি বইবে কী করে?”

 “কারও বা থাকে দাবি, কারও বা থাকে দায়; এই দুই নিয়ে সংসার। দায়টাকেই আমি আমার করেছি, এ আমি অন্যকে দেব কেন?”

 “আমি যদি পুরুষমানুষ হতুম জোর করে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতুম।”

 “তাহলেই তো বুঝতে পারছিস কুমু, দায় ঘাড়ে নেবার একটা লোভ আছে। তুই নিজে নিতে পারছিস নে বলেই তোর মেজদাদাকে দিয়ে সাধ মেটাতে চাস। কেন, আমিই বা কী অপরাধ করেছি।”

 “দাদা, তুমি টাকা ধার করতে এসেছ?”

 “কিসের থেকে বুঝলি?”

 “তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি। আচ্ছা, আমি কি কিছুই করতে পারি নে?”

 “কী ক’রে, বলো?”

 “এই মনে করো, কোনো দলিলে সই করে। আমার সইয়ের কি কোনো দামই নেই?”

 “খুবই দাম আছে; সে আমাদের কাছে, মহাজনের কাছে নয়।”

 “তোমার পায়ে পড়ি দাদা, বলো আমি কী করতে পারি।”

 “লক্ষ্মী হয়ে শান্ত হয়ে থাক্, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর, মনে রাখিস সংসারে সেও একটা মস্ত কাজ। তুফানের মুখে নৌকো ঠিক রাখাও যেমন একটা কাজ, মাথা ঠিক রাখাও তেমনি। আমার এসরাজটা নিয়ে আয়, একটু বাজা।”

 “দাদা, আমার বড়ো ইচ্ছে করছে একটা কিছু করি।”

 “বাজানোটা বুঝি একটা-কিছু নয়।”

 “আমি চাই খুব একটা শক্ত কাজ।”

 “দলিলে নাম সই করার চেয়ে এসরাজ বাজানো অনেক বেশি শক্ত। আন্ যন্ত্রটা।”