যোগাযোগ/৫৫

উইকিসংকলন থেকে
◄  ৫৪
৫৬  ►

৫৫

 সেদিন সকালে অনেকক্ষণ ধরে কুমু তার দাদার ঘরে বসে গানবাজনা করেছে। সকালবেলাকার সুরে নিজের ব্যক্তিগত বেদনা বিশ্বের জিনিস হয়ে অসীমরূপে দেখা দেয়। তার বন্ধনমুক্তি ঘটে। সাপ গুলো যেন মহাদেবের জটায় প্রকাশ পায় ভূষণ হয়ে। ব্যথার নদীগুলি ব্যথার সমুদ্রে গিয়ে বৃহৎ বিরাম লাভ করে। তার রূপ বদলে যায়, চঞ্চলতা লুপ্ত হয় গভীরতায়। বিপ্রদাস নিশ্বাস ছেড়ে বললে, “সংসারে ক্ষুদ্র কালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয় কুমু, চিরকালটা থাকে আড়ালে; গানে চিরকালটাই আসে সামনে, ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে, তাতেই মন মুক্তি পায়।”

 এমন সময়ে খবর এল, “মহারাজ মধুসূদন এসেছেন।”

 এক মুহূর্তে কুমুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল; তাই দেখে বিপ্রদাসের মনে বড়ো বাজল, বললে, “কুমু তুই বাড়ির ভিতরে যা। তোকে হয়তো দরকার হবে না।”

 কুমু দ্রুতপদে চলে গেল। মধুসূদন ইচ্ছে করেই খবর না দিয়েই এসেছে। এ-পক্ষ আয়োজনের দৈন্য ঢাকা দেবার অবকাশ না পায় এটা তার সংকল্পের মধ্যে। বড়ো ঘরের লোক ব’লে বিপ্রদাসের মনের মধ্যে একটা বড়াই আছে ব’লে মধুসূদনের বিশ্বাস। সেই কল্পনাটা সে সইতে পারে না। তাই আজ সে এমনভাবে এল যেন দেখা করতে আসে নি, দেখা দিতে এসেছে।

 মধুসূদনের সাজটা ছিল বিচিত্র, বাড়ির চাকর-দাসীরা অভিভূত হবে এমনতরো বেশ। ডোকাটা বিলিতি শার্টের উপর একটা রঙিন ফুলকাটা সিল্কের ওয়েস্ট্ কোট, কাঁধের উপর পাট-করা চাদর, যত্নেকোঁচানো কালাপেড়ে শান্তিপুরে ধুতি, বার্নিশ-করা কালো দরবারি জুতো, বড়ো বড়ো হীরেপান্না ওআলা আংটিতে আঙুল ঝলমল করছে। প্রশস্ত উদরের পরিধি বেষ্টন করে মোটা সোনার ঘড়ির শিকল, হাতে একটি শৌখিন লাঠি, তার সোনার হাতলটি হাতির মুণ্ডের আকারে নানা জহরতে খচিত। একটা অসমাপ্ত নমস্কারের দ্রুত আভাস দিয়ে খাটের পাশের একটা কেদারায় বসে বললে, “কেমন আছেন বিপ্রদাসবাবু, শরীরটা তো তেমন ভালো দেখাচ্ছে না।”

 বিপ্রদাস তার কোনো উত্তর না দিয়ে বললে, “তোমার শরীর ভালোই আছে দেখছি।”

 “বিশেষ ভালো যে তা বলতে পারি নে— সন্ধ্যের দিকটা মাথা ধরে, আর খিদেও ভালো হয় না। খাওয়াদাওয়ার অল্প একটু অযত্ব হলেই সইতে পারি নে। আবার অনিদ্রাতেও মাঝে মাঝে ভুগি, ওইটেতে সব চেয়ে দুঃখ দেয়।”

 শুশ্রূষার লোকের যে সর্বদা দরকার তারই ভুমিকা পাওয়া গেল।

 বিপ্রদাস বললে, “বোধ করি আপিসের কাজ নিয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে।”

 “এমনিই কী! আপিসের কাজকর্ম আপনিই চলে যাচ্ছে, আমাকে বড়ো কিছু দেখতে হয় না। ম্যাক্‌নটন সাহেবের উপরেই বেশির ভাগ কাজের ভার, সার আর্থর পীবডিও আমাকে অনেকটা সাহায্য করেন।

 গুড়গুড়ি এল, পানের বাটায় পান ও মসলা নিয়ে চাকর এসে দাঁড়াল, তার থেকে একটি ছোটো এলাচ নিয়ে মুখে পুরল, আর কিছু নিলে না। গুড়গুড়ির নল নিয়ে দুই-একবার মৃদু মৃদু টান দিলে। তার পরে গুড়গুড়ির নলটা বাঁ হাতে কোলের উপরেই ধরা রইল। আর তার ব্যবহার হল না। অন্তঃপুর থেকে খবর এল, জলখাবার প্রস্তুত। ব্যস্ত হয়ে বললে, “ওইটি তো পারব না। আগেই তো বলেছি, খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে খুব ধরকাট করেই চলতে হয়।”

 বিপ্রদাস দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলে না। চাকরকে বললে, “পিসিমাকে বলে গে, ওঁর শরীর ভালো নেই, খেতে পারবেন না।”

 বিপ্রদাস চুপ করে রইল। মধুসূদন আশা করেছিল, কুমুর কথা আপনিই উঠবে। এতদিন হয়ে গেল, এখন কুমুকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব বিপ্রদাস আপনিই উদ্বিগ্ন হয়ে করবে—কিন্তু কুমুর নামও করে না যে। ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে রাগ জন্মাতে লাগল। ভাবলে এসে ভুল করেছি। সমস্ত নবীনের কাণ্ড। এখনই গিয়ে তাকে খুব একটা কড়া শাস্তি দেবার জন্যে মনটা ছট্‌ফট্‌ করতে লাগল।

 এমন সময় সাদাসিধে সরু কালাপেড়ে একখানি শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা টেনে কুমু ঘরে প্রবেশ করলে। বিপ্রদাস এটা আশা করে নি। সে আশ্চর্য হয়ে গেল। প্রথমে স্বামীর, পরে দাদার পায়ের ধুলো নিয়ে কুমু মধুসূদনকে বললে, “দাদার শরীর ক্লান্ত, ওঁকে বেশি কথা কওয়াতে ডাক্তারের মানা। তুমি এই পাশের ঘরে এস।”

 মধুসূদনের মুখ লাল হয়ে উঠল। দ্রুত চৌকি থেকে উঠে পড়ল। কোল থেকে গুড়গুড়ির নলটা মাটিতে পড়ে গেল। বিপ্রদাসের মুখের দিকে না চেয়েই বললে, “আচ্ছা, তবে আসি।”

 প্রথম ঝোঁকটা হল হন্ হন্ করে গাড়িতে উঠে বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু মন পড়েছে বাঁধা। অনেক দিন পরে আজ কুমুকে দেখেছে। ওকে অত্যন্ত সাদাসিধে আটপৌরে কাপড়ে এই প্রথম দেখলে। ওকে এত সুন্দর আর কখনাে দেখে নি। এমন সংযত, এত সহজ। মধুসূদনের বাড়িতে ও ছিল পােশাকি মেয়ে, যেন বাইরের মেয়ে, এখানে সে একেবারে ঘরের মেয়ে। আজ যেন ওকে অত্যন্ত কাছের থেকে দেখা গেল। কী স্নিগ্ধ মূর্তি। মধুসূদনের ইচ্ছে করতে লাগল, একটু দেরি না করে এখনই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ও আমার, ও আমারই, ও আমার ঘরের, আমার ঐশ্বর্যের, আমার সমস্ত দেহমনের, এই কথাটা উলটেপালটে বলতে ইচ্ছে করে।

 পাশের ঘরে একটা সােফা দেখিয়ে কুমু যখন বসতে বললে তখন ওকে বসতেই হল। নিতান্ত যদি বাইরের ঘর না হত তা হলে কুমুকে ধরে সােফায় আপনার পাশে বসাত। কুমু না বসে একটা চৌকির পিছনে তার পিঠের উপর হাত রেখে দাঁড়াল। বললে, “আমাকে কিছু বলতে চাও?”

 ঠিক এমন সুরে প্রশ্নটা মধুসূদনের ভালাে লাগল না, বললে, “যাবে না বাড়িতে?”

 “না।”

 মধুসূদন চমকে উঠল—বললে, “সে কী কথা!”

 “আমাকে তােমার তাে দরকার নেই।”

 মধুসূদন বুঝলে, শ্যামাসুন্দরীর খবরটা কানে এসেছে, এটা অভিমান। অভিমানটা ভালোই লাগল। বললে, “কী যে বল তার ঠিক নেই। দরকার নেই তাে কী। শূন্য ঘর কি ভালাে লাগে?”

 এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি করতে কুমুর প্রবৃত্তি হল না। সংক্ষেপে আরএকবার বললে, “আমি যাব না।”

 “মানে কী? বাড়ির বউ বাড়িতে যাবে না—?”

 কুমু সংক্ষেপে বললে, “না।”

 মধুসূদন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “কী! যাবে না! যেতেই হবে!”

 কুমু কোনো জবাব করলে না। মধুসূদন বললে, “জান পুলিস ডেকে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি ঘাড়ে ধরে! ‘না’ বললেই হল?”

 কুমু চুপ করে রইল। মধুসূদন গর্জন করে বললে, “দাদার স্কুলে নুরনগরি কায়দা শিক্ষা আবার আরম্ভ হয়েছে?”

 কুমু দাদার ঘরের দিকে একবার কটাক্ষপাত করে বললে, “চুপ করো, অমন চেঁচিয়ে কথা কোয়ো না।”

 “কেন? তোমার দাদাকে সামলে কথা কইতে হবে নাকি? জান এই মুহূর্তে ওকে পথে বার করতে পারি।”

 পরক্ষণেই কুমু দেখে ওর দাদা ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘকায়, শীর্ণদেহ, পাণ্ডুবর্ণ মুখ, বড়ো বড়ো চোখদুটো জ্বালাময়, একটা মোটা সাদা চাদর গা ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, কুমুকে ডেকে বললে, “আয় কুমু, আয় আমার ঘরে।”

 মধুসূদন চেঁচিয়ে উঠল, বললে, “মনে থাকবে তোমার এই আস্পর্ধা! তোমার নুরনগরের নুর মুড়িয়ে দেব তবে আমার নাম মধুসূদন।”

 ঘরে গিয়েই বিপ্রদাস বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করলে, কিন্তু ঘুমে নয়, ক্লান্তিতে ও চিন্তায়। কুমু শিয়রের কাছে বসে পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। এমনি করে অনেকক্ষণ কাটলে পর ক্ষেমা পিসি এসে বললে, “আজ কি খেতে হবে না কুমু? বেলা যে অনেক হল।”

 বিপ্রদাস চোখ খুলে বললে, “কুমু, যা খেতে যা। তোর কালুদাকে পাঠিয়ে দে।”

 কুমু বললে, “দাদা, তোমার পায়ে পড়ি, এখন কালুদাকে না, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করে।”

 বিপ্রদাস কিছু না বলে সুগভীর বেদনার দৃষ্টিতে কুমুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিক বাদে নিশ্বাস ফেলে আবার চোখ বুজলে। কুমু ধীরে ধীরে বেরিয়ে গিয়ে দরজা দিল ভেজিয়ে।

 একটু পরেই কালু খবর পাঠাল যে আসতে চায়। বিপ্রদাস উঠে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসল। কালু বললে, “জামাই এসে অল্পক্ষণ পরেই তো চলে গেল। কী হল বলো তো। কুমুকে ওদের ওখানে ফিরে নিয়ে যাবার কথা কিছু বললে কি?”

 “হাঁ। বলেছিল। কুমু তার জবাব দিয়েছে, সে যাবে না।”

 কালু বিষম ভীত হয়ে বললে, “বল কী দাদা! এ যে সর্বনেশে কথা!”

 “সর্বনাশকে আমরা কোনোকালে ভয় করি নে, ভয় করি অসম্মানকে।”

“তা হলে তৈরি হও, আর দেরি নেই। রক্তে আছে, যাবে কোথায়। জানি যে, তোমার বাবা ম্যাজিস্ট্রেটকে তুচ্ছ করতে গিয়ে অন্তত দু-লাখ টাকা লোকসান করেছিলেন। বুক ফুলিয়ে নিজের বিপদ ঘটানো, ও তোমাদের পৈতৃক শখ। ওটা অন্তত আমার বংশে নেই, তাই তোমাদের সাংঘাতিক পাগলামিগুলো চুপ করে সইতে পারি নে। কিন্তু বাঁচব কী করে?”

 বিপ্রদাস উঁচু বাঁ হাঁটুর উপর ডান পা তুলে দিয়ে তাকিয়ায় মাথা রেখে চোখ বুজে খানিকক্ষণ ভাবলে। অবশেষে চোখ খুলে বললে, “দলিলের শর্ত অনুসারে মধুসূদন ছ-মাস নোটিশ না দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা দাবি করতে পারে না। ইতিমধ্যে সুবোধ আষাঢ় মাসের মধ্যেই এসে পড়বে— তখন একটা উপায় হতে পারবে।

 কালু একটু বিরক্ত হয়েই বললে, “উপায় হবে বইকি। বাতিগুলো এক দমকায় নিবত, সেইগুলো একে একে ভদ্ররকম করে নিববে।”

 “বাতি তলার খোপটার মধ্যে এসে জ্বলছে, এখন যে-ফরাস এসে তাকে যে-রকম ফুঁ দিয়েই নেবাক না—তাতে বেশি হা-হুতাশ করবার কিছু নেই। ওই তলানির আলোটার তদ্বির করতে আর ভালো লাগে না, ওর চেয়ে পুরো অন্ধকারে সোয়াস্তি পাওয়া যায়।”

 কালুর বুকে ব্যথা বাজল। সে বুঝলে, এটা অসুস্থ মানুষের কথা, বিপ্রদাস তো এ-রকম হালছাড়া প্রকৃতির লোক নয়; পরিণামটাকে ঠেকাবার জন্যে বিপ্রদাস এতদিন নানারকম প্ল্যান করছিল। তার বিশ্বাস ছিল কাটিয়ে উঠবে। আজ ভাবতেও পারে না—বিশ্বাস করবারও জোর নেই।

 কালু স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে বিপ্রদাসের মুখের দিকে চেয়ে বললে, “তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না ভাই, যা করবার আমিই করব। যাই একবার দালাল-মহলে ঘুরে আসি গে।”

 পরদিন বিপ্রদাদের কাছে এক ইংরেজি চিঠি এল। মধুসূদনের লেখা। ভাষাটা ওকালতি ছাঁদের—হয়তো বা অ্যাটর্নিকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। নিশ্চিত করে জানতে চায় কুমু ওদের ওখানে ফিরে আসবে কি না, তার পরে যথাকর্ত‌ব্য করা হবে।

 বিপ্রদাস কুমুকে জিজ্ঞাসা করলে, “কুমু, ভালো করে সব ভেবে দেখেছিস?”

 কুমু বললে, “ভাবনা সম্পূর্ণ শেষ করে দিয়েছি, তাই আমার মন আজ খুব নিশ্চিন্ত। ঠিক মনে হচ্ছে, যেমন এখানে ছিলাম তেমনি আছি—মাঝে যা-কিছু ঘটেছে সমস্ত স্বপ্ন।”

 “যদি তোকে জোর করে নিয়ে যাবার চেষ্টা হয়, তুই জোর করে সামলাতে পারবি?”

 “তোমার উপর উৎপাত যদি না হয় তো খুব পারব।”

 “এইজন্যে জিজ্ঞাসা করছি যে, যদি শেষকালে ফিরে যেতেই হয় তা হলে যত দেরি করে যাবি ততই সেটা বিশ্রী হয়ে উঠবে। ওদের সঙ্গে সম্বন্ধ সূত্র তোর মনকে কোথাও কিছুমাত্র জড়িয়েছে কি?”

 “কিছুমাত্র না। কেবল আমি নবীনকে, মোতির মাকে, হাবলুকে ভালোবাসি। কিন্তু তারা ঠিক যেন অন্য বাড়ির লোক।”

 “দেখ্ কুমু, ওরা উৎপাত করবে। সমাজের জোরে, আইনের জোরে উৎপাত করবার ক্ষমতা ওদের আছে। সেইজন্যেই সেটাকে অগ্রাহ্য করা চাই। করতে গেলেই লজ্জা সংকোচ ভয় সমস্ত বিসর্জন দিয়ে লোকসমাজের সামনে দাঁড়াতে হবে, ঘরে-বাইরে চারি দিকে নিন্দের তুফান উঠবে, তার মাঝখানে মাথা তুলে তোর ঠিক থাকা চাই।”

 “দাদা, তাতে তোমার অনিষ্ট, তোমার অশান্তি হবে না?”

 “অনিষ্ট অশান্তি কাকে তুই বলিস কুমু? তুই যদি অসম্মানের মধ্যে ডুবে থাকিস তার চেয়ে অনিষ্ট আমার আর কী হতে পারে? যদি জানি যে, যে-ঘরে তুই আছিস সে তোর ঘর হয়ে উঠল না, তোর উপর যার একান্ত অধিকার সে তোর একান্ত পর, তবে আমার পক্ষে তার চেয়ে অশান্তি ভাবতে পারি নে। বাবা তোকে খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু তখনকার দিনে কর্তারা থাকতেন দূরে দূরে। তোর পক্ষে পড়াশুনোর দরকার আছে তা তিনি মনেই করতেন না। আমিই নিজে গোড়া থেকে তোকে শিখিয়েছি, তোকে মানুষ করে তুলেছি। তোর বাপ-মার চেয়ে আমি কোনো অংশে কম না। সেই মানুষ করে তোলার দায়িত্ব যে কী আজ তা বুঝতে পারছি। তুই যদি অন্য মেয়ের মতো হতিস তা হলে কোথাও তোর ঠেকত না। আজ যেখানে তোর স্বাতন্ত্র্যকে কেউ বুঝবে না, সম্মান করবে না, সেখানে যে তোর নরক। আমি কোন্ প্রাণে তোকে সেখানে নির্বাসিত করে থাকব? যদি আমার ছোটো ভাই হতিস তা হলে যেমন করে থাকতিস তেমনি করেই চিরদিন থাক্‌-না আমার কাছে।”

 দাদার বুকের কাছে খাটের প্রান্তে মাথা রেখে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কুমু বললে, “কিন্তু আমি তোমদের তো ভার হয়ে থাকব না? ঠিক বলছ?”

 কুমুর মাথায় হাত বুলোত বুলোতে বিপ্রদাস বললে, “ভার কেন হবি বোন? তোকে খুব খাটিয়ে নেব। আমার সব কাজ দেব তোর হাতে। কোনো প্রাইভেট সেক্রেটারি এমন করে কাজ করতে পারবে না। আমাকে তোর বাজনা শোনাতে হবে, আমার ঘোড়া তোর জিম্মেয় থাকবে। তা ছাড়া জানিস আমি শেখাতে ভালোবাসি। তোর মতো ছাত্রী পাব কোথায় বল? এক কাজ করা যাবে, অনেক দিন থেকে পারসি পড়বার শখ আমার আছে। একলা পড়তে ভালো লাগে না। তোকে নিয়ে পড়ব, তুই নিশ্চয় আমার চেয়ে এগিয়ে যাবি, আমি একটুও হিংসে করব না দেখিস।”

 শুনতে শুনতে কুমুর মন পুলকিত হয়ে উঠল, এর চেয়ে জীবনে সুখ আর কিছু হতে পারে না।

 খানিক পরে বিপ্রদাস আবার বললে, “আরও একটা কথা তোকে বলে রাখি কুমু, খুব শীঘ্রই আমাদের কাল বদল হবে, আমাদের চালও বদলাবে। আমাদের থাকতে হবে গরিবের মতো। তখন তুই থাকবি আমাদের গরিবের ঐশ্বর্য হয়ে।”

 কুমুর চোখে জল এল, বললে, “আমার এমন ভাগ্য যদি হয় তো বেঁচে যাই।”

 বিপ্রদাস মধুসূদনের চিঠি হাতে রাখলে, উত্তর দিলে না।