যোগাযোগ/৭

উইকিসংকলন থেকে

 সেদিন তৃতীয়া; সন্ধ্যাবেলায় ঝড় উঠল। বাগানে মড়্ মড়্ করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। থেকে-থেকে বৃষ্টির ঝাপটা ঝাঁকানি দিয়ে উঠছে ক্রুদ্ধ অধৈর্যের মতো। লোকজন খাওয়াবার জন্যে যে-চালাঘর তােলা হয়েছিল তার করােগেটেড লােহার চাল উড়ে দিঘিতে গিয়ে পড়ল। বাতাস বাণবিদ্ধ বাঘের মতাে গোঁ গোঁ করে গােঙরাতে গােঙরাতে আকাশে আকাশে লেজ ঝাপটা দিয়ে পাক খেয়ে বেড়ায়। হঠাৎ বাতাসের এক দমকে জানলাদরজাগুলো খড়্ খড়্ করে কেঁপে উঠল। কুমুদিনীর হাত চেপে ধরে মুকুন্দলাল বললেন, “মা কুমু, ভয় নেই, তুই তাে কোনাে দোষ করিস নি। ওই শোন্ দাঁতকড়মড়ানি, ওরা আমাকে মারতে আসছে।”

 বাবার মাথায় বরফের পুঁটুলি বুলােত বুলােতে কুমুদিনী বলে, “মারবে কেন বাবা? ঝড় হচ্ছে, এখনই থেমে যাবে।”

 “বৃন্দাবন? বৃন্দাবন...চন্দ্র...চক্রবর্তী! বাবার আমলের পুরুত—সে তাে মরে গেছে—ভূত হয়ে গেছে বৃন্দাবনে। কে বললে সে আসবে?”

 “কথা কোয়াে না বাবা, একটু ঘুমােও।”

 “ওই যে, কাকে বলছে, খবরদার, খবরদার।”

 “কিছু না, বাতাসে বাতাসে গাছগুলােকে ঝাঁকানি দিচ্ছে।”

 “কেন, ওর রাগ কিসের? এতই কী দোষ করেছি, তুই বল্ মা।”

 “কোনাে দোষ কর নি বাবা। একটু ঘুমােও।”

 “বিন্দে দূতী? সেই যে মধু অধিকারী সাজত।

মিছে কর কেন নিন্দে
ওগাে বিন্দে শ্রীগােবিন্দে—”

 চোখ বুজে গুন্ গুন্ করে গাইতে লাগলেন।—

“কার বাঁশি ঐ বাজে বৃন্দাবনে।
সই লাে সই
ঘরে আমি রইব কেমনে?”

 “রাধু, ব্র্যাণ্ডি লে আও।”

 কুমুদিনী বাবার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, “বাবা, ও কী বলছ?” মুকুন্দলাল চোখ চেয়ে তাকিয়েই জিভ কেটে চুপ করেন। বুদ্ধি যখন অত্যন্ত বেঠিক তখনও এ কথা ভােলেন নি যে, কুমুদিনীর সামনে মদ চলতে পারে না।

 একটু পরে আবার গান ধরলেন,

“শ্যামের বাঁশি কাড়তে হবে,
নইলে আমায় এ বৃন্দাবন ছাড়তে হবে।”

 এই এলােমলো গানের টুকরােগুলাে শুনে কুমুর বুক ফেটে যায়— মায়ের উপর রাগ করে, বাবার পায়ের তলায় মাথা রাখে, যেন মায়ের হয়ে মাপ-চাওয়া।

 মুকুন্দ হঠাৎ ডেকে উঠলেন, “দেওয়ানজি!”

 দেওয়ানজি আসতে তাকে বললেন “ওই যেন ঠক্ ঠক্ শুনতে পাচ্ছি।”

 দেওয়ানজি বললেন, “বাতাসে দরজা নাড়া দিচ্ছে।”

 “বুড়ো এসেছে, সেই বৃন্দাবনচন্দ্র— টাক মাথায়, লাঠি হাতে, চেলির চাদর কাঁধে। দেখে এস তো। কেবলি ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ করছে। লাঠি না খড়ম?”

 রক্তবমন কিছুক্ষণ শান্ত ছিল। তিনটে রাত্রে আবার আরম্ভ হল। মুকুন্দলাল বিছানার চারিদিকে হাত বুলিয়ে জড়িতস্বরে বললেন, “বড়ােবউ, ঘর যে অন্ধকার! এখনও আলাে জ্বালবে না?”

 বজরা থেকে ফিরে আসবার পর মুকুন্দলাল এই প্রথম স্ত্রীকে সম্ভাষণ করলেন— আর এই শেষ।

 বৃন্দাবন থেকে ফিরে এসে নন্দরানী বাড়ির দরজার কাছে মূর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁকে ধরাধরি করে বিছানায় এনে শােয়াল। সংসারে কিছুই তাঁর আর রুচল না। চোখের জল একেবারে শুকিয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সান্ত্বনা নেই। গুরু এসে শাস্ত্রের শ্লোক আওড়ালেন, মুখ ফিরিয়ে রইলেন। হাতের লােহা খুললেন না— বললেন, “আমার হাত দেখে বলেছিল আমার এয়ােত ক্ষয় হবে না। সে কি মিথ্যে হতে পারে?”

 দূরসম্পর্কের ক্ষেমা ঠাকুরঝি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “যা হবার তা তাে হয়েছে, এখন ঘরের দিকে তাকাও। কর্তা যে যাবার সময় বলে গেছেন, বড়োবউ ঘরে কি আলাে জ্বালবে না?”

 নন্দরানী বিছানা থেকে উঠে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাব, আলাে জ্বালতে যাব। এবার আর দেরি হবে না।” বলে তাঁর পাণ্ডুবর্ণ শীর্ণ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন হাতে প্রদীপ নিয়ে এখনই যাত্রা করে চলেছেন।

 সূর্য গেছেন উত্তরায়ণে, মাঘ মাস এল, শুক্লা চতুর্দশী। নন্দরানী কপালে মােটা করে সিঁদুর পরলেন, গায়ে জড়িয়ে নিলেন লাল বেনারসি শাড়ি। সংসারের দিকে না তাকিয়ে, মুখে হাসি নিয়ে চলে গেলেন।