রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/৪

উইকিসংকলন থেকে

(৪)

কল্যাণমাণিক্য ও বাদসাহী ফৌজ

 যশোধরমাণিক্যের সহিত বাদসাহ যে সমর করিয়াছিলেন তাহার উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়ায় পুনরায় দিল্লী হইতে মুর্শিদাবাদের নবাবের নিকট হস্তিবল সংগ্রহের জন্য এক তাগিদ আসিল। নবাব ত্রিপুরা আক্রমণের জন্য তোড়জোড় করিতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিক ধূলি সমাচ্ছন্ন করিয়া নবাবের ফৌজ ঝড়ের মেঘের মত ত্রিপুরার আকাশে উদিত হইল, মহা দুর্দ্দিন উপস্থিত! কল্যাণমাণিক্য দূতমুখে এই সংবাদ শুনিয়া অসীম সাহসে বুক বাঁধিয়া সমরায়োজন করিতে লাগিলেন। ত্রিপুরার স্বাধীনতা রক্ষায় ত্রিপুর বীরেরা সমরে ঝাঁপাইয়া পড়িতে লাগিল। মোগল সৈন্য ত্রিপুরার সীমান্তে আসিয়া পড়িল, নবাবের পত্র লইয়া দূত ত্রিপুর-শিবিরে পৌঁছিলে মহারাজের সম্মুখে পত্র পাঠ হইল। তাহাতে লেখা ছিল, ত্রিপুরেশ্বর যেন বাদশাহের নজরানা স্বরূপ সহস্র হস্তী পাঠাইয়া দেন। ত্রিপুর দরবার হইতে জানান হইল, ত্রিপুরেশ্বর বশ্যতা স্বীকারে অসমর্থ, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জ্জন দিবেন, তথাপি মাথা নীচু করিবেন না।

 বীরত্বপূর্ণ ত্রিপুরলিপি পাঠে মোগল শিবিরে রণচাঞ্চল্য জাগিয়া উঠিল। দুই পক্ষে ঘোর সংগ্রাম বাঁধিয়া গেল। মহারাজ কল্যাণমাণিক্য স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। কৈলাগড়ে ত্রিপুর সৈন্যের সমাবেশ হইল, কমলা সাগরের পশ্চিমে মোগল সেনাবাস রচিত হইল। জীবণ পণ করিয়া ত্রিপুর সেনা দুর্জ্জয় সাহসে যুঝিতে লাগিল। গোবিন্দনারায়ণ সৈন্যের অগ্রভাগ রক্ষা করিতে লাগিলেন আর মহারাজ স্বয়ং ত্রিপুর বাহিনীর মেরুদণ্ডস্বরূপ হইয়া রণক্ষেত্রে ত্রিপুর সৈন্য চালনা করিতে লাগিলেন। যেখানে উদ্যম ভঙ্গ লক্ষিত হইতেছিল, শাণিত কৃপাণহস্তে বর্ম্মপরিহিত মহারাজ সেইখানে অশ্বারোহণে যাইয়া যুদ্ধের গতি ফিরাইয়া দিতেছিলেন। এইভাবে এক অখণ্ড তেজে ত্রিপুরসৈন্যেরা যুঝিতে লাগিল। মোগলসৈন্যেরা তখন উপায়ান্তর না দেখিয়া যুদ্ধের শেষ অস্ত্র কামান প্রয়োগ করিল। বড় বড় কামানের গোলা আসিয়া কৈলাগড়ে পড়িতে লাগিল। গোবিন্দনারায়ণ মহারাজকে আনিয়া গোলা দেখাইলেন। তখন যুদ্ধের কৌশল পরিবর্ত্তন করিয়া শত্রুপক্ষকে বুঝান হইলে যেন ত্রিপুরসৈন্যেরা রণক্ষেত্র হইতে হঠিয়া গেল। কারণ সম্মুখ সমর ত্যাগ করিয়া সৈন্যেরা পর্ব্বতগাত্রে গা ঢাকা দিয়া রহিল। যখন তোপ দাগা বিরাম হইল তখন গোবিন্দনারায়ণ বুঝিলেন, ত্রিপুর সৈন্য সমূলে বিধ্বস্ত হইয়াছে ভাবিয়া এইবার মোগলেরা তাহাদের গড় ছাড়িয়া অগ্রসর হইতে পারে।

 তখন সন্ধ্যা সমাগত, কল্যাণমাণিক্য শিবিরে বিশ্রাম করিতে করিতে কুলদেবতা স্মরণ করিতেছেন—স্বদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন, এ যাত্রা সে স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকিবে কি? গোবিন্দনারায়ণের উপর প্রধান সেনাপতির ভার অর্পণ করিয়া মহারাজ বিশ্রাম করিতেছিলেন, তখন যুদ্ধ থামিয়া গিয়াছে। মহারাজ মুক্ত আকাশে দেখিলেন একটি একটি তারা ফুটিতেছে, ইহারা জয় পরাজয়ের বার্ত্তা বহন করে—ত্রিপুরার ভাগ্যে জয় না পরাজয়?

 গভীর নিশীথে গোবিন্দনারায়ণ মোগল শিবির আক্রমণ করিলেন, ত্রিপুর সৈন্যের অতর্কিত আগমনে মোগল বাহিনী বে-কায়দায় পড়িয়া গেল। সুযোগ বুঝিয়া গোবিন্দনারায়ণ এরূপ প্রবল চাপ দিলেন যে মোগল সৈন্য চূর্ণ বিচূর্ণ হইতে লাগিল। দুর্গ প্রাকারে নাকাড়া বাজিলেও মোগলের সৈন্যসজ্জা ঘটিয়া উঠিল না। চতুর্দ্দিকে বিশৃঙ্খলা, অর্দ্ধসুপ্ত সৈনিকেরা চোখ কচ্‌লাইয়া দেখিল—এ কাহারা? হাতে কৃপাণ তুলিয়া লইবার পূর্ব্বেই তাহাদের ছিন্নমুণ্ড ধূলিতে গড়াইতে লাগিল। গোবিন্দনারায়ণের সমরকৌশলে মোগলেরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইল, বাদসাহী ফৌজের যাহারা হতাবশিষ্ট ছিল তাহারা প্রাণ লইয়া কোনওরূপে পলায়ন করিল। মোগলের পরাজয় বার্ত্তায় ত্রিপুরার খ্যাতি দিগ্‌দিগন্ত ছাইয়া গেল, প্রধান সেনাপতি গোবিন্দনারায়ণের জয়-ঘোষণায় ত্রিপুরা রাজ্য মুখরিত হইয়া উঠিল!

 যুদ্ধজয়ের অনতিকাল মধ্যেই মহারাজ কল্যাণমাণিক্য গোবিন্দনারায়ণকে যৌবরাজ্য প্রদান করেন, শুভদিনে এই পুণ্যকার্য্য অনুষ্ঠিত হইল। মহারাজের শেষকাল বহুবিধ পুণ্যকার্য্যের সহিত জড়িত হইয়া রহিয়াছে। ভারত ইতিহাসে হর্ষবর্দ্ধন সম্বন্ধে যেরূপ দান-কাহিনী প্রচলিত আছে, কল্যাণমাণিক্য সম্বন্ধেও সেইরূপ আখ্যান শুনা যায়। বিবিধ দানের মধ্যে তাঁহার তুলাদান বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছে। যজ্ঞ-হোম অন্তে মহারাজ তুলাদণ্ডে ধর্ম্মের আসনে বসিলেন—অপর দিকে ধনরত্ন রাখিয়া তাঁহার সমান ওজন করা হইল। তখন আসন হইতে নামিয়া আসিয়া মহারাজ সেই ধনরত্ন উৎসর্গ করিয়া দান করিলেন। নিজ পুরোহিত সিদ্ধান্তবাগীশকে তিন হস্তী, পঞ্চ অশ্ব, বস্ত্র, অলঙ্কার এবং মেহেরকুলে এক গ্রাম উৎসর্গ করিয়া দিলেন। তাঁহার তুলাদান কালে উদয়পুরে পঞ্চদশ সহস্র ব্রাহ্মণ আসিয়াছিলেন। সেতুবন্ধ মথুরা বারাণসী উড়িষ্যা প্রভৃতি দেশ হইতে দানগ্রাহীরা সমাগত হইয়াছিল। চন্দ্রপুরে উদয়মাণিক্য প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রনাথ গোপীনাথ মূর্ত্তি অমরমাণিক্যের রাজত্বকালে মঘেরা লইয়া গিয়াছিল, নিজ বাহুবলে চট্টগ্রাম হইতে সেই মূর্ত্তির পুনরুদ্ধার সাধন করিয়া শূণ্যমঠে স্থাপন করেন। সেই মঠের বাম পার্শ্বে ধর্ম্মমঠ নামে নূতন এক মঠ স্থাপন করেন, পুরসম্মুখে বিষ্ণুমন্দির নির্ম্মাণ করিয়া তাহার পূর্ব্বদিকে দোলমঞ্চ নির্ম্মাণ করেন, তাহারই সম্মুখভাগে দুর্গাগৃহ নির্ম্মিত হইল। উদয়পুরে তাঁহার পুণ্যকীর্ত্তিসমূহ ভগ্নাবস্থায় আজিও দেখিতে পাওয়া যায়।

 “কৈলাগড় দুর্গ মধ্যে কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তর নির্ম্মিত সিংহবাহিনী মহিষাসুর-মর্দ্দিনী দশভুজা ভগবতী মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ প্রতিমার নিম্নভাগে একটি শিবলিঙ্গ খোদিত থাকায় কালীমূর্ত্তি বলিয়া আখ্যাত হয় (তদন্তে দুর্গমধ্যে চ স্থাপয়ামাস কালিকাং—সংস্কৃত রাজমালা)। এই দেবীর মন্দির দুর্গমধ্যস্থিত উচ্চ ভূমিতে অবস্থিত। মহারাজ কল্যাণমাণিক্য এই মন্দিরের নির্ম্মাণকার্য্য শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই। দুর্গের পশ্চাদ্ভাগে অনন্তবিস্তৃত পর্ব্বতশ্রেণী, তাহার সম্মুখভাগে যতদূর দৃষ্টি সঞ্চালিত হয় সমতল ক্ষেত্র করতলস্থ রেখার ন্যায় দৃষ্ট হইয়া থাকে। কিন্তু সমতল ক্ষেত্র হইতে এই মন্দির কিম্বা দুর্গ কিছুমাত্র লক্ষ্য হয় না।”[১]

 এই দুর্গের আশ্রয়েই ত্রিপুরসৈন্য বাদসাহী ফৌজের পরাজয় সাধনে সক্ষম হয়। “মহারাজ কল্যাণমাণিক্য ‘হরগৌরী’ নাম স্বীয় নামের সহিত সংযুক্ত করিয়া স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন।” (কৈলাসসিংহ প্রণীত রাজমালা, পৃঃ ৮০) ১৬৬০ খৃষ্টাব্দে ৮০ বৎসর বয়সে সুদীর্ঘ ৩৪ বৎসর রাজত্ব করিয়া মহারাজ পরলোক গমন করেন।

 কল্যাণমাণিক্য গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে ত্রিপুর সিংহাসনে আরোহণ করেন। মহারাজ বিজয়মাণিক্যের কালে ত্রিপুরা রাজ্য গৌরবের উচ্চ সীমায় আরোহণ করে, তৎপর সুযোগ্য বংশধরের অভাবে এবং সেনাপতির সিংহাসন অধিকারহেতু ত্রিপুর-রাষ্ট্রে পুনরায় দুর্ব্বলতা প্রবিষ্ট হয়। যদিচ অমরমাণিক্যের সুদৃঢ় ভুজবলে রাষ্ট্রের পুনরুদ্ধার ঘটে তথাপি তাঁহার পুত্রগণ মুকুটের প্রলোভনে মঘরাজের নিকট যে পরিমাণে হৃতশক্তি হন সে পরাজয়ের বেগ তাঁহার পরবর্ত্তী রাজগণ প্রতিরোধ করিতে সমর্থ হন নাই। ত্রিপুরা রাজ্য ক্রমেই দিকে দিকে খর্ব্ব হইয়া আসিতেছিল। কল্যাণমাণিক্য স্বীয় অমিত বাহুবলে পুনরায় নষ্টশক্তির কিয়ৎপরিমাণে উদ্ধার সাধন করিয়াছিলেন এবং যে গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, পরলোক গমন-কালে সেই নৈরাশ্যের তিমির ভেদ করিয়া আশার আলোকে ত্রিপুরা রাজ্য ভরিয়া তুলিয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার অতুলনীয় কীর্ত্তি।

 ১৫৭৩ শকাব্দে কল্যাণমাণিক্য, উদয়পুরে ধন্যমাণিক্য নির্ম্মিত শিবমন্দিরের সংস্কারসাধন করেন।

 শ্রীশ্রীকল্যাণদেবস্ত্রিপুর-নরপতি…প্রাদাৎ…ভক্তিতঃ শঙ্করায়।

 শাকে ১৫৭৩।

  1. কৈলাস সিংহ প্রণীত রাজমালা, পৃঃ ৮২।