রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/৫

উইকিসংকলন থেকে


(৫)

গোবিন্দমাণিক্য ও নক্ষত্র রায়

 ১৬৬০ খৃষ্টাব্দে পিতৃসিংহাসন আরোহণ করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গোবিন্দমাণিক্যের আখ্যানভাগ অবলম্বনে ‘রাজর্ষি’ ও ‘বিসর্জ্জন’ রচনা করেন। কবির অমর লেখনী দ্বারা গোবিন্দমাণিক্যের নাম বঙ্গভাষায় চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। মহাকবির রচনা দ্বারা ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এরূপ গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হন যে তাঁহাদের অপেক্ষা শৌর্য্যে বীর্য্যে ইতিহাসে উচ্চস্তরের বীর থাকিলেও, সেই সকল বীর ইতিহাসের পাতায়ই নিবদ্ধ থাকিয়া যান, তাঁহাদের নাম সাহিত্যজগতে আসে না। ইতালীর অমর কবি দান্তে তদীয় বন্ধু কেসেলাকে যে অমর আসন দান করিয়া গিয়াছেন, তাহা ইতালীয় বহু বীরের ভাগ্যে ঘটে নাই। রবীন্দ্রনাথও তেমনি গোবিন্দমাণিক্যকে বাঙ্গালী জাতির মনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, শৌর্য্যে বীর্য্যে ত্রিপুর সিংহাসনে তাঁহা অপেক্ষা গরীয়ান্ রাজা বসিলেও তাঁহাদের নাম ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত রহিয়াছে, কিন্তু সাহিত্যের বাতায়নে তাঁহারা সম্পূর্ণ অপরিচিত।

 গোবিন্দমাণিক্যের অভিষেক কার্য্য মহাসমারোহে সম্পন্ন হইল। মোগল সমরে যাঁহার বলবীর্য্যের পরীক্ষা হইয়াছিল তাঁহার হস্তে ত্রিপুরার দাজদণ্ড ন্যস্ত হওয়ায় সকলের চিত্তে আশার সঞ্চার হইয়াছিল। কিন্তু ঈর্ষীর মনে তাহাতে সুখ হয় না, তাঁহার বৈমাত্র ভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের মনে রাজ্যলোভ ক্রমেই প্রবল হইতে লাগিল। রাজপুত ইতিহাসে রাণা প্রতাপের সহিত শক্ত সিংহের যে সম্বন্ধ দাঁড়াইয়াছিল, গোবিন্দমাণিক্যের সহিত নক্ষত্ররায়ের সেই সম্বন্ধ সৃষ্টি হইল। গোবিন্দমাণিকের কানে নানা কথা ভাসিয়া আসিতে লাগিল। নক্ষত্ররায়কে ঘেরিয়া চক্রান্তকারীদের সাহায্যে ষড়যন্ত্রের জাল ক্রমেই জটিল হইয়া উঠিল। রাণা প্রতাপকে সমুচিত শাস্তি দিবার জন্য শক্ত যেমন আকবরের শরণাপন্ন হইয়াছিলেন, নক্ষত্ররায়ও তেমনি মোগল দরবাৱে আশ্রয়প্রার্থী হইয়াছিলেন।

 ভ্রাতৃবিরোধের করালছায়াপাতে ত্রিপুর-রাষ্ট্রের শান্তি সুখ অন্তর্হিত হইতেছিল। সে সময়ে সাজাহান-পুত্র সুজা বাঙ্গালার শাসন কর্ত্তা, নক্ষত্ররায় তাঁহার সহিত রাজদ্রোহমূলক সম্বন্ধ স্থাপনে অগ্রসর হইয়াছেন দেখিয়া গোবিন্দমাণিক্যের উদার হৃদয় ব্যথিত ও বিচলিত হইল। ‘রাজর্ষি’তে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার অমর লেখনী দ্বারা গোবিন্দমাণিক্যের অপূর্ব্ব স্বদেশ প্রীতি ও অতুলনীয় আত্মত্যাগ ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। অভিষেক হইবার কয়েক মাস মধ্যেই গোবিন্দমাণিক্য যখন বুঝিতে পারিলেন, নক্ষত্ররায় রাজমুকুটের লোভে স্বদেশের সর্ব্বনাশ ঘটাইবে তখন তিনি রাজর্ষির ন্যায় সর্ব্বস্ব ত্যাগে কৃতসঙ্কল্প হইলেন! পাত্রমিত্র মন্ত্রী সভাসদ্ সকলের পরামর্শ অনায়াসে পরিহার করিয়া মহারাজ নক্ষত্র রায়ের সহিত সাক্ষাৎ কামনা করিলেন। নিভৃতে দুই ভাইয়ের মিলন হইল। মহারাজ বলিলেন “ভাই, তুমি যখন সিংহাসন চাও, নবাবের সাহায্যের
মহারাজ নক্ষত্ররায়কে সিংহাসনে বসাইয়া রাজমুকুট পরাইয়া দিলেন।
প্রয়োজন কি? এসো, আমিই তোমাকে সকলের সমক্ষে সিংহাসনে বসাইয়া রাজা বলিয়া ঘোষণা করি।” তাহাই হইল, পাত্র মিত্র মন্ত্রী সভাসদে দরবার গৃহ পূর্ণ হইল, মহারাজ নক্ষত্ররায়কে সিংহাসনে বসাইয়া রাজমুকুট পরাইয়া দিলেন। তারপর সভা লক্ষ্য করিয়া মহারাজ বলিলেন, “অদ্য হইতে নক্ষত্ররায় আমার স্থলে অভিষিক্ত হইলেন, ভাইকে সিংহাসনে বসাইয়া আমি সানন্দে বনে চলিয়া যাইতেছি! আমার স্বদেশের কল্যাণ হউক, ইহাই আমি বিধাতার নিকট প্রার্থনা করি।” মহারাজের বাক্য শুনিয়া সকলের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিল। এইরূপে উদয়পুর যখন অশ্রুজলে ভাসিতেছিল গোবিন্দমাণিক্য রাণী গুণবতী ও কয়েকজন পরিজন সহ নিঃশব্দে রাজধানী পরিত্যাগ করিয়া বনের পথে অদৃশ্য হইলেন।

 ভ্রাতৃবিরোধের সমরানল জ্বলিয়া না উঠিতেই নিভিয়া গেল। গোবিন্দমাণিকোর অপূর্ব্ব আত্মত্যাগে বিরোধের দাবানল আত্মপ্রকাশ করিবার সুযোগ পাইল না। যদি মহারাজ স্বেচ্ছায় নিজ অধিকার ছাড়িয়া না দিতেন তবে পরিণাম কি হইত তাহা দিল্লীর সিংহাসনের দিকে দৃষ্টি করিলেই অনায়াসে প্রতীত হয়। ঠিক সেই সময়ে ময়ূরসিংহাসনের লোভে ভারতব্যাপী সমরানল জ্বলিয়া উঠে এবং দারার ছিন্নমুণ্ড ভূমিতে গড়াইয়া পড়ে।