রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৩

উইকিসংকলন থেকে

(৩)

পাঠান বিদ্রোহ

 বিজয়মাণিক্যের বিপুল সেনা মধ্যে একটি পাঠান ফৌজ গঠিত হইয়াছিল। চট্টগ্রামে মুসলমান শক্তি বৃদ্ধি পাইতেছিল দেখিয়া বিজয়মাণিক্য দুই হাজার সৈন্য লইয়া স্বয়ং যুদ্ধ যাত্রা করেন। তাঁহার সঙ্গে এক সহস্ৰ পাঠান সৈন্য গিয়া মিলিত হইবে এইরূপ কথা রহিল। বিজয়মাণিক্য চলিয়া যাওয়ার পর পাঠানদের সহিত উজিরের ঝগড়া বাঁধিয়া গেল। রাজকোষ হইতে অর্থের ব্যবস্থা হইলেও বেতন বাকী পড়িয়াছিল, সেইজন্য পাঠানেরা ক্ষেপিয়া উঠিয়া উজিরকে মারিয়া ফেলে। উজিরের পুত্র প্রতাপনারায়ণ ভয়ে পলাইয়া গেলেন। উজিরের মৃত্যুর পর পাঠানেরা বিদ্রোহের জন্য চেষ্টা পাইতে লাগিল, পূর্ব্ববঙ্গের এ অঞ্চলে যত পাঠান ছিল তাহাদের একত্র হইবার চেষ্টা চলিল। তাহাদের মধ্যে পরামর্শ হইল রাজধানী লুট করিতে হইবে এবং চট্টগ্রামের পথে বিজয়মাণিক্যকে অবরোধ করিয়া তাঁহার প্রাণ সংহার করিতে হইবে। কিন্তু ইহা অচিরেই মহারাজের কানে উঠিল, তখন বিজয়মাণিক্য সংহার মূর্ত্তি ধরিয়া স্বয়ং রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন এবং পাঠান সেনাকে ধরাশায়ী করিলেন। যাহারা প্রাণ লইয়া পলাইতে পারিল তাহারা গৌড়ে যাইয়া নবাবের দরবারে লাঞ্ছনার কথা নিবেদন করিল।

 বিজয়মাণিক্য পাঠান দলনের দ্বারা যেমন স্বরাজ্য নিষ্কণ্টক করিলেন তেমনি অমিত বিক্রমে নবাব সৈন্য পরাজিত করিয়া চট্টগ্রামের পূর্ণ আধিপত্য লাভ করিলেন। চট্টগ্রাম হইতে বিতাড়িত হওয়ায় পূর্ব্ববঙ্গ অঞ্চলে নবাবের অধিকার খর্ব্ব হইয়া পড়িল। নবাব সুলেমান বীর পুরুষ ছিলেন, উড়িষ্যা বিজয় দ্বারা তাঁহার যশ চতুর্দ্দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং ত্রিপুরেশ্বর হইতে তাঁহার পরাভব বিজয়ীর যশোরাশি ম্লান করিয়া ফেলিয়াছিল। ইহার প্রত্যুত্তর স্বরূপ নবাব নিজ শ্যালক মমারক খাঁকে সেনাপতি করিয়া দশ হাজার পদাতিক ও দুই হাজার অশ্বারোহী সৈন্য দিয়া চট্টগ্রাম জয় করিতে পাঠাইলেন। পাঠানবাহিনী ঝড়ের ন্যায় সহসা আসিয়া পড়িল, তজ্জন্য চট্টগ্রামে সেনা সন্নিবেশ পূর্ব্ব হইতে রাখা হয় নাই, কাযেই চট্টগ্রাম জয় করিতে পাঠানদের বেগ পাইতে হয় নাই। মমারক খাঁ সুলেমানের বিজয় কেতন চট্টগ্রামে উড়াইয়া দিলেন।

 যখন বিজয়মাণিক্য ভগ্নদূত মুখে এ সংবাদ শুনিতে পাইলেন তখন তাঁহার ক্রোধানল জ্বলিয়া উঠিল। তিনি সেনাপতিগণকে যুদ্ধ সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া চট্টগ্রাম অভিমুখে সসৈন্যে তাহাদিগকে রওয়ানা করাইলেন। সুদীর্ঘ আট মাস ধরিয়া চট্টল অবরোধ চলিল, কিন্তু পাঠান সেনানী মমারক খাঁকে তাহারা কিছুতেই হঠাইতে পারিল না। বিজয়মাণিক্য সেনাপতিদের অকৃতকার্য্যতায় অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন, বাহিরে এভাব প্রকাশ না করিয়া তাহাদিগকে চট্টগ্রাম হইতে ডাকাইয়া আনিলেন। রাজার ডাকে তাহারা যুদ্ধ স্থগিত রাখিয়া রাজধানীতে আসিয়া ভয়ে ভয়ে রাজদর্শন করিল। মহারাজ বিজয়মাণিক্য যেমন বীর ছিলেন তেমনি রসগ্রাহী পুরুষও ছিলেন। জয়ন্তী রাজের সহিত রসিকতাই তাহার নিদর্শন। সেনাপতিদের নিয়া এইবার যে রসিকতা করিলেন তাহার তুলনা ইতিহাসে অল্পই দেখা যায়। ভীত সেনাপতিগণকে সম্বোধন করিয়া মহারাজ বলিলেন, “চট্টল সংগ্রামে তোমাদের বীরত্বে মুগ্ধ হইয়া পুরস্কারস্বরূপ আমি তোমাদিগকে এক একটি চরখা দিতেছি,
পুরস্কার স্বরূপ আমি তোমাদিগকে এক একটি চরখা দিতেছি
অস্ত্র ফেলিয়া তোমরা নিজ নিজ ঘরে যাও, ঘরে গিয়া চরখা কাটায় মন দাও।” সেনাপতিরা মাথা নীচু করিয়া রহিল। তখন এক একটি চরখা দিয়া তাহাদিগকে রাজদ্বার হইতে বিতাড়িত করা হইল।