রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৫

উইকিসংকলন থেকে

(৫)

বিজয়মাণিক্যের জয়যাত্রা

 দিল্লীর সিংহাসনে আকবর সমাসীন—মোগল রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে—সুতরাং পাঠানের দুর্দ্দিন ঘনাইয়া আসিল। বঙ্গদেশ জয়ের পরিকল্পনা চলিতে লাগিল, গৌড়ের নবাব সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িলেন। বিজয়মাণিক্য এই সুযোগে অভিযান যাত্রার আয়োজন করিলেন। শুভ দিনে অভিযান যাত্রা করিল। বাঙ্গলার ইতিহাসে ইহা এক স্মরণীয় দিন। এই বিজয় বাহিনী ছাব্বিশ হাজার পদাতিক, পাঁচ হাজার অশ্বারোহী, কতিপয় গোলন্দাজ ও পাঁচ হাজার নৌকা লইয়া গঠিত হইয়াছিল। জলে স্থলে ত্রিপুরসেনা অজেয় হইয়া দেশদেশান্তর অবলীলাক্রমে জয়স্রোতে ভাসাইয়া ঢাকা জিলার সোণার গাঁয়ে পৌঁছিল। সুবর্ণগ্রামে নবাবের ফৌজ পরাজিত হইয়া পলায়ন করিল। সুবর্ণ গ্রামে প্রথম উপনিবেশের কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে এবং তথাকার ব্রহ্মপুত্রে লাঙ্গলবন্ধ স্নানের ইতিহাসও বর্ণিত হইয়াছে। সেখানে যাইয়া বিজয় মাণিক্যের লাঙ্গলবন্ধ স্নানের অভিলাষ হইল এবং স্নান কার্য্য সমারোহে সম্পন্ন হইল। প্রথমে মহারাজ ব্রহ্মপুত্রে স্নান করিলেন, যেখানে পরশুরাম ধ্বজ আরোপণ করিয়াছিলেন সেইখানে ত্রিপুরেশ্বরের ধ্বজ আরোপিত হইয়াছিল। সোণার নিশান উড়িতে লাগিল, মহারাজ ধ্বজঘাটে দানে বসিলেন। বহু ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে বিষ্ণু প্রীত্যর্থে সোণা দান করা হইল। তারপর ব্রাহ্মণকে পাঁচদ্রোণ জমি ধ্বজঘাটের সমীপে দেওয়া হইল, সেইস্থান আজিও “পাঁচ দোনা” নামে প্রসিদ্ধ। তারপর মহারাজ লক্ষ্মা ও পদ্মাতে স্নান তর্পণ করিয়াছিলেন।

 পদ্মাতীরে মহারাজ কিছুকাল বজরায় বাস করিতেছিলেন এবং শরীররক্ষী প্রহরীরা চড়ের উপর পাহারা দিতেছিল। এমন সময় দূরে এক গাছের উপরে দুইজন লুকাইয়া আছে এইরূপ দেখিতে পাইয়া সন্দেহে তাহাদিগকে ধরা হয় এবং বিজয়মাণিক্যের সমীপে আনা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায় ইহারা গৌড়ের নবাবের প্রেরিত চর, মহারাজের কোন অনিষ্ট অভিপ্রায়ে আসে নাই, ত্রিপুর সৈন্যেরা দেখিতে কিরূপ, ইহাদের অস্ত্রশস্ত্র কি আকারের, ঘোড়া চড়ার রীতি কেমন এগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখিয়া নবাবের গোচর করার জন্যই নবাব পাঠাইয়াছেন। মহারাজ এই কথা বিশ্বাস করিয়া তাহাদিগকে গৌড়ে যাইতে দিলেন, প্রাণে মারিলেন না। ইহাতে বিজয়মাণিকোর গভীর উদারতা প্রকাশ পায়।

 সোণার গাঁ জয়ের পর ত্রিপুর সেনা বিক্রমপুর পরিক্রমণ করিয়া আসিল, তথাকার বাঙ্গালীর শীর্ষসমাজ মহারাজকে নতশির হইয়া অভিনন্দন জানাইল। তৎপর বিজয়বাহিনী শ্রীহট্ট অঞ্চল ঘুরিয়া স্বদেশে ফিরিল। বিজয়মাণিকোর জয় যাত্রা সত্য সত্যই জয়যুক্ত হইয়াছিল। ফিরিবার পথে মহারাজ বর্ত্তমান কৈলাসহর বিভাগের অন্তর্গত ঊনকোটি তীর্থ পরিদর্শন করিয়াছিলেন।

 রাজধানীতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি অনেক সৎকর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন—তুলাপুরুষ, দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর বিবিধ কীর্ত্তির সহিত তাঁহার নাম জড়িত। ১৫২৮ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়া মহারাজ বিজয়মাণিক্য সগৌরবে সুদীর্ঘ ৪৭ বৎসর রাজত্ব করেন। ত্রিপুরার সিংহাসনে তিনি যখন সমাসীন তখন দিল্লীর তক্ততাউসে ভাগ্যবিপর্য্যয় ঘটিয়া হুমায়ুন সরিয়া গেলেন, শেরসাহ বসিলেন, পুনরায় নিয়তির চক্রে পাঠান শাসন অন্তে হুমায়ুন আসিয়া পড়িলেন এবং তাঁহার মৃত্যুর পর আকবর প্রতিষ্ঠিত হইলেন। রাজপুতানার ইতিহাসে এই সময় উদয়সিংহপ্রতাপসিংহের আবির্ভাব কাল। এই ভাবে ভারত ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে বিজয়মাণিক্য ত্রিপুরার সিংহাসন অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। বিজয়মাণিকোর খ্যাতি যে আকবর বাদসাহের দরবারেও পৌঁছিয়াছিল তাহার প্রমাণ ‘আইনী আকবরী’ গ্রন্থ। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবুলফজল বিজয়মাণিক্যের নামের সহিত ঘনিষ্ঠভাবেই পরিচিত ছিলেন, তদীয় আইনী তাকবরী গ্রন্থে এইরূপ লিখিত হইয়াছে—“ভাটী প্রদেশের (হুগলী নদীর তীর হইতে মেঘনার তীর পর্য্যন্ত) সহিত সংলগ্ন একটি স্বাধীন রাজ্য আছে। সেই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা, রাজার নাম বিজয়মাণিক্য। যিনি রাজা হন তিনিই নামের অন্তে “মাণিক্য” উপাধি ধারণ করেন। সেই রাজ্যের আমীর ওমরাহগণ “নারায়ণ” উপাধি পাইয়। থাকেন। এই রাজার দুই লক্ষ পদাতি ও এক সহস্র হস্তী আছে কিন্তু অশ্ব অতি বিরল।[১] “বিজয়মাণিক্যের পরলোক গমনের বৎসর রলফ ফিছ নামে এক পাশ্চাত্য পর্য্যটক এতদঞ্চলে আসিয়াছিলেন। তাঁহার ভ্রমণ বৃত্তান্তে এইরূপ উল্লেখ আছেঃ—“সাতগাঁও হইতে আমি ত্রিপুরেশ্বরের রাজ্যের মধ্য দিয়া চট্টগ্রামে গমন করিয়াছিলাম।”[২]

 বিজয়মাণিক্যের জীবন সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল, তিনি জ্যোতিষ গণনায় একান্ত আস্থাবান্‌ ছিলেন। একদিন তাঁহার দুই পুত্রের কোষ্ঠীর ফল বিচারে দেখিলেন জ্যেষ্ঠের কোষ্ঠীতে অঙ্গচ্ছেদ যোগ রহিয়াছে ও কনিষ্ঠের রাজযোগ রহিয়াছে। পাছে দুই ভাইয়ে রাজ্য লইয়া যুদ্ধ বাধে এই ভয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে উড়িষ্যাধিপতি মুকুন্দের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। যাহাতে কুমার সুখে স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারে সেই জন্য সেখানে ভূসম্পত্তি ক্রয় করিয়া প্রচুর ধনরত্ন দিলেন। কুমারকে বুঝাইয়া দিলেন, তুমি সেখানে থাকিয়া জগন্নাথ সেবা করিবে, এই আমার অভিপ্রায়। পিতৃভক্ত পুত্র পিতার আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া সিংহাসনের মমতা ছাড়িয়া সুদূর উড়িষ্যায় চলিয়া গেলেন। এদিকে রাজার কনিষ্ঠ পুত্র অনন্ত ক্রমে বড় হইলেন। প্রধান সেনাপতি গোপীপ্রসাদ নারায়ণের কন্যার সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। মহারাজ হয়ত ভাবিয়াছিলেন তাঁহার অবর্ত্তমানে অনন্ত ইঁহার নিকট সহায়তা পাইবেন কিন্তু ঘটনা দাঁড়াইল অন্যরূপ!

  1. কৈলাস সিংহের রাজমালা হইতে উদ্ধৃত।
  2. From Satagaon I travelled by the country of the King of Tippara—Ralph Fitchকৈলাস সিংহের রাজমালা।