রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৬

উইকিসংকলন থেকে

(৬)

অনন্তমাণিক্য

 বিজয়মাণিক্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ত্রিপুরার রাজলক্ষ্মী যেন কিছুকালের জন্য অন্তর্হিতা হইয়া গেলেন। তাঁহার গৌরবে ত্রিপুরার যে আসন আকাশে উঠিয়াছিল তাঁহার জীবনান্তের সঙ্গেই উহা যেন ধূলিসাৎ হইয়া গেল। অনন্তমাণিক্য সিংহাসনে অভিষিক্ত হইলেন বটে কিন্তু গোপীপ্রসাদই সর্ব্বেসর্ব্বা হইয়া উঠিলেন।

 দৈত্যনারায়ণের পুনরভিনয় চলিল। অনন্তমণিক্যের দুর্ব্বলতা চরমে পৌঁছিল, এমন কি আহার বিষয়েও তিনি স্বাধীন ছিলেন না, শ্বশুরের গৃহে যাইয়া খাইয়া আসিতেন। তাহাতে এইরূপ ধারণা জন্মিল যেন শ্বশুর খাইতে দেন বলিয়া তিনি খাওয়া পান। গোপীপ্রসাদের কন্যা বয়সে কচি হইলেও বুদ্ধিমতী ছিলেন। রাজাকে বলিলেন—শ্বশুরঘরে কে নিত্য খায়? রাজার পক্ষে খাওয়া ত কিছুতেই শোভে না। দুর্ব্বল অনন্তমাণিক্য উত্তর করিলেন—“না খাইয়া উপায় কি? যখন পিতা এঁর হাতে আমাকে রাখিয়া গিয়াছেন তখন এঁর শাসনের বাহিরে যাই কি করিয়া?” এইরূপ বাক্যে রাণী ব্যথিতা হইলেন, ইহা কি রাজবাক্য? রাজার দুর্ব্বলতায় গোপীপ্রসাদ বুঝিলেন রাজা তাঁহার মুঠোর মধ্যে, সিংহাসন ও তাঁহার মধ্যে ব্যবধান যাহা কিছু তাহা এরই জন্য, একে সরাইতে পারিলে রাজমুকুট হেলায় তাঁহার মাথায় আসিয়া পড়িবে।

 অনন্তমাণিক্যকে মারিবার জন্য ষড়যন্ত্র চলিল, গোপীপ্রসাদ কংসের ন্যায় বধের উপায় ভাবিতে লাগিলেন। গদা ভীম নামক মল্লের নিকট অনন্তমণিক্যের মল্লবিদ্যা শিখিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। গোপী প্রসাদ একে ইঙ্গিত করিলেন মল্লবিদ্যা অভ্যাসের ফাঁকে সহসা এর শ্বাস রোধ করিতে হইবে। কিন্তু গদা ভীম ইহাতে কিছুতেই রাজি হয় নাই। অবশেষে নিজ ভাগিনেয় মর্দ্দন নারায়ণকে এ কার্য্যে নিযুক্ত করেন। মর্দ্দনের হাতেই অনন্তমাণিক্যের জীবনান্ত ঘটিল। অনন্তমাণিক্যের রাজত্বকাল অতি অল্প।

 অনন্তমাণিক্যের বধ সাধন করিয়া ম্যাকবেথের ন্যায় গোপীপ্রসাদ উদয়মাণিক্য নাম ধরিয়া ১৫৭৭ খৃষ্টাব্দে রাজপাটে বসিলেন। বিধবা রাণী অনন্তমাণিক্যের সহমরণ ইচ্ছা করিলে গোপীপ্রসাদ বাধা দেন। তখন রাণী পিতাকে তীব্র ভাষায় কটূক্তি করিলেন—“তুমি রাজহন্তা, তোমার গতি ক্ষুরধার নরক।” এই বলিয়া রাণী রাজসিংহাসন দাবী করিলে গোপীপ্রসাদ রাজপাট উদয়পুরের সন্নিকটস্থ চন্দ্রপুর গ্রামে তুলিয়া নেন এবং নিজ নামে “উদয়পুর” নামকরণ করেন, ইহার পরিমাণ চারি দ্রোণ চারিকাণি ভূমি। সেইখানে এক মঠ নির্ম্মাণ করিয়া চন্দ্রগোপীনাথ নামে এক বিগ্রহ স্থাপন করেন।

 ত্রিপুরারাজ্যে ম্যাকবেথের শাসন প্রবর্ত্তিত হইল—পবিত্র রাজবংশের ধারা বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। চতুর্দ্দিকে ঘোর অশান্তির সৃষ্টি হইল, গোপীপ্রসাদের অত্যাচারের সীমা রহিল না, নারী হরণে, ইহার নামে সকলে শিহরিয়া উঠিতে লাগিল। ত্রিপুরা রাজ্যের এই দুর্দ্দশার কাহিনী যথাসময়ে গৌড়েশ্বরের কানে উঠিল। মমারক খাঁর মর্ম্মান্তিক মৃত্যু ও চট্টলের পরাভব কাহিনী গৌড় ভুলিতে পারে নাই। এই সুযোগে পুনরায় চট্টল আক্রমণের জল্পনা কল্পনা চলিল।