রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/১

উইকিসংকলন থেকে

রাজমালা

(১)

মহারাজ যযাতি

 বেদে পুরূরবার নাম প্রসিদ্ধ। ইঁহার আয়ু নামে পুত্র হয়। আয়ুর পুত্র নহুষ, নহুষের ছয় পুত্র জন্মে—তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ যতির বৈরাগ্য উদয় হওয়ায় ইনি রাজ্যভার গ্রহণ করেন নাই। সুতরাং পিতার বিপুল রাজত্বে দ্বিতীয় পুত্র যযাতির অধিকার জন্মে। মহারাজ যযাতির দুই বিবাহ। শুক্রাচার্য্য-কন্যা দেবযানীগর্ভে তাঁহার যদু ও তুর্ব্বসু নামে দুই পুত্র আর বৃষপর্ব্বার কন্যা শর্ম্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু নামে তিন পুত্র জন্মে। কোনও কারণে শুক্রাচার্য্য ক্রুদ্ধ হইয়া যযাতিকে এই বলিয়া শাপ দেন, “তুমি যদিও বয়সে এখনো বৃদ্ধ হও নাই, আমি শাপ দিতেছি তোমার শরীর অচিরে জরায় জীর্ণ হইয়া যাউক, তুমি আশী বছরের বুড়ার ন্যায় একেবারে জড়সড় হইয়া পড়।’ কি দারুণ শাপ! মুনি ঋষিদের মুখের কথা বাহির হইলে, ইহা কখনো বিফল হইবার নয়। মহারাজ যযাতি ভয়ে এতটুকু হইয়া গেলেন, অনুনয় করিয়া কহিলেন—‘প্রভো, এই সংসারের সাধ আমার এখনো মিটে নাই;
আমি শাপ দিতেছি, তোমার শরীর
অচিরে জীর্ণ হইয়া যাউক।
মনের মধ্যে ভোগের আশা তেমনি রহিয়া গিয়াছে, আপনি শাপ দিয়া শরীরকে বুড়া করিয়া ফেলিলেন কিন্তু মন ত বুড়া হইল না; এখন এর একটা উপায় করুন।’ শুক্রাচার্য্যের মনে বুঝি দয়ার সঞ্চার হইল। তিনি বলিলেন—‘আচ্ছা, আমি এর একটা উপায় করিতেছি। তোমাকে এই বর দিতেছি, তুমি নিজের জরা অপরকে দিতে পারিবে। যদি কোন তরুণ তোমার জরা গ্রহণ করে তবেই তুমি শাপমুক্ত হইলে।’

 যযাতি এইরূপে অভয় পাইয়া নিজ পুত্রগণকে তাঁহার জরা গ্রহণ করিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু পুত্রগণ একে একে অসম্মতি জানাইল। তখন সর্ব্বকনিষ্ঠ পুরু পিতৃআদেশ পালন করিতে সম্মতি জানাইল। পিতৃভক্ত পুরু কহিল—‘পিতঃ, যে পুত্র আপনা হইতেই পিতার অভিপ্রায় বুঝিয়া অনুরূপ কায করে সে পুত্র উত্তম; পিতার আদেশে যে কায করে সে মধ্যম; অশ্রদ্ধায় যে তৎকার্য্য পালন করে সে অধম, আর যে পুত্র আদেশ পালন করে না সে পিতার বিষ্ঠা মাত্র।’ এই প্রকার বলিয়া পুরু সানন্দে পিতার জরা গ্রহণ করিল। এদিকে মহারাজ যযাতি পুত্রের যৌবন পাইয়া রাজত্ব করিতে লাগিলেন।

 দীর্ঘকাল রাজ্য ভোগ করিতে করিতে যযাতির বৈরাগ্য উপস্থিত হইল। সংসার অসার বোধ হইল; যাহা পূর্ব্বে মধুর লাগিয়াছিল এখন তাহা তিক্ত ঠেকিতে লাগিল। পিতৃভক্ত পুরুকে কহিলেন–‘বৎস, সংসারের সাধ মিটিয়াছে; তোমার যৌবন তোমাকে ফিরাইয়া দিতেছি এই লও, আমার জরা ফিরাইয়া দাও। আমি পরমপুরুষের ধ্যান করিতে বনে যাইতেছি।’

 এই বলিয়া মহারাজ যযাতি পুত্রকে যৌবন ফিরাইয়া দিয়া তাহার নিকট হইতে নিজের জরা গ্রহণ করিলেন।
মহারাজ যযাতি পুত্রকে যৌবন ফিরাইয়া দিলেন
পিতৃভক্তির পুরস্কার স্বরূপ পুরুকে তাঁহার নিজের রাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন এবং পুরুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃগণকে পুরুর অধীনে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে স্থাপন করেন। দক্ষিণ পূর্ব্বদিকে দ্রুহ্যুকে, দক্ষিণ দিকে যদুকে, পশ্চিমদিকে তুর্ব্বসুকে এবং উত্তরদিকে অনুকে রাজা করিয়া দিলেন। মহারাজ যযাতি এই ভাবে মায়ার বন্ধন এড়াইয়া বনে চলিয়া গেলেন। কালক্রমে নির্ম্মল পরব্রহ্ম বাসুদেবে ভাগবতী গতি লাভ করিলেন। ‘পরে ঽমলে ব্রহ্মণি বাসুদেবে লেভে গতিং ভাগবতীং’ (শ্রীমদ্ভাগবত, ৯।১৯।২৫)।