বিষয়বস্তুতে চলুন

রাজমোহনের স্ত্রী/একবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

একবিংশ পরিচ্ছেদ

জীবন-গ্রন্থের শেষ অধ্যায়—এবং এই গ্রন্থেরও

 সেদিন সন্ধ্যায় ঝড় বহিল, চারিদিক কালো হইয়া আসিল। বাতাসের গর্জ্জন, সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্রাম বৃষ্টির পর, বজ্রনিনাদে আকাশ কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল। মথুর ঘোষ একা বসিয়া ছিল। সে যেন ঝড়ের মুহুর্মুহু বিশ্রামের মধ্যে শাঁখের ধ্বনির মত একটা শব্দ শুনিতে পাইল— তাহার মনে হইল, দুইবার সে যেন স্পষ্ট শুনিয়াছে। প্রথমটা সে ভাবিল, যাহাদের সাহায্য তাহার জীবনে কলঙ্ক ও দুর্দ্দশা আনয়ন করিয়াছে, তাহাদের আহ্বান সে আর গ্রাহ্য করিবে না; কিন্তু ইশারার শব্দ প্রতিবারেই উচ্চ হইতে উচ্চতর হইয়া উঠিল, আহ্বানের গুরুত্ব মথুর ক্রমশই অধিক অনুভব করিল। অবশেষে সে উঠিয়া পড়িল এবং ঝড় মাথায় করিয়া নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইল —এই স্থানেই বহু কলঙ্কিত অভিনয়ের সূচনা ইতিপূর্ব্বে হইয়াছে। একটি গাছের নীচে যে মূর্ত্তিটি দণ্ডায়মান ছিল, দস্যু-সর্দ্দার বলিয়া তাহাকে চিনিয়া লইতে মথুরের বিলম্ব হইল না।

 একটু ব্যঙ্গ করিয়াই মথুর বলিল, ব্যাপারখানা কি? তোমাদের সঙ্গে অনেক খেলাই হ’ল, এবার আমাকে রেহাই দাও। কলঙ্ক যথেষ্ট হয়েছে—যথেষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা তোমরা করেছ।

 সর্দ্দার শান্তভাবে জবাব দিল, জোচ্চুরির কাজ আমরা কিছু করি নি, যথাসাধ্য ভাল করতেই চেয়েছিলাম। আমাদের যারা সঙ্গী করে, শাস্তি তাদের শেষ পর্য্যন্ত ভোগ করতেই হয়।

 শয়তান মহাপুরুষকে ধর্ম্মশিক্ষা দিতে শুরু করিল! পাঠককে প্রশ্ন করি, সে কি অন্যায় করিতেছিল?

 মথুর রাগতভাবে বলিল, আমাদের যে আর কোনও সম্পর্ক নেই, তা তুমি নিজেই ভাল জান। এই ঝড়ের রাতে আমাকে ডাকলে কেন?

 বিষন্ন সর্দ্দার বলিল, কারণ? কারণ এই সময় ছাড়া বাইরে বের হবার উপায় নেই। জান তো পুলিস আমাদের পিছু নিয়েছে।

 —তা হ’লে একেবারে রাধাগঞ্জ ছেড়ে যাও না কেন?

 সর্দ্দারের মুখে পুরানো বাঁকা হাসি যেন একবার ফুটিয়া উঠিল, তুমি তো আগে এ ধরনের কথা বলতে না বাবু, এখন বুঝি দিন খুব খারাপ পড়েছে! যা পার ভাব, কিন্তু এ কথা তোমাকে বললে বিশ্বাস করবে যে, আমরা যাদের কাজ করি অথবা যারা আমাদের কাজ করে সকলের সম্বন্ধেই আমরা ভাল ধারণাই পোষণ করি।

 মথুর প্রশ্ন করিল, মানে?

 বিষাদক্লিষ্ট কণ্ঠে সর্দ্দার বলিল, যে এতদিন ছায়ার মত আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত, দেখছ সে সঙ্গে নেই।

 —তা তো দেখছি, সে লোকটা গেল কোথায়? তার নামটা কি যেন? ভিখু না?

 —সে ধরা পড়েছে। মথুর চমকাইয়া উঠিল এবং কাঁপিতে কাঁপিতে প্রশ্ন করিল, আরও কিছু দুর্ঘটনা ঘটে নি তো?

 সর্দ্দারের স্বর হতাশাপূর্ণ, তাও ঘটেছে বাবু, ভিখু সব স্বীকার করেছে।

 মথুর উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, কি স্বীকার করেছে?

 হতাশ সর্দ্দার বলিল, অনেক কিছুই। যা বলেছে, তাতেই তোমাকে আর আমাকে কালাপানি পার হতে হবে। আমি কিন্তু ধরা দিচ্ছি না। রাধাগঞ্জে এই আমার শেষ। তুমি আমাদের ভাল করতে চেয়েছিলে, পাছে কেউ কোনদিন বলে যে তোমার ভাল আমরা করি নি, তাই তোমাকে সাবধান করতে এসেছি।

 উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া দস্যু-সর্দ্দার ঝোপের আড়ালে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

 মথুর বাড়ি ফিরিয়া ঘণ্টা দুয়েক ভাবিল—তাহার মনের জোর ছিল, সহজেই সে সাহস সঞ্চয় করিতে পারিল। সে জানিত, পুলিস অর্থলোলুপ, অসৎ; তাহার অর্থের অভাব নাই; পুলিসকে ঘুষ দিয়া সে বশ করিবে। কিন্তু এক জায়গায় একটু গোল ছিল। সদরে ম্যাজিস্ট্রেটের আসনে একজন ধূর্ত্ত অতি চটপটে আইরিশম্যান অধিষ্ঠিত এবং সব কিছু ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করার বদ স্বভাবও তাঁহার ছিল। তিনি প্রায়শই পুলিসের অনেক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবার চেষ্টা করিতেন। কিন্তু মথুর ঘোষ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিল যে, যেমন করিয়াই হউক সেই অনধিকারচর্চ্চাকারী আইরিশম্যানের কাছে ভিখুকে দিয়া তাহার স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করাইবে।

 কে একজন ছুটিয়া ঘরে প্রবেশ করাতে তাহার চিন্তায় বাধা পড়িল; তাহার সর্ব্বাঙ্গ দিয়া বৃষ্টির জল ঝরিতেছে, কাদায় গা মাখামাখি। আগন্তুক জিলাকোটে তাহারই নিযুক্ত একজন বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী।

 লোকটি চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, বাবু, পালান, আর এক মুহূর্ত্তও দেরি করবেন না।

 বিমূঢ় মথুর বলিল, ব্যাপার কি?

 —ভিখু নামের কে একজন আজ বেলা এগারোটার সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকার করেছে যে, সে কতকগুলি ডাকাতি আর রাহাজানি আপনার কথাতেই করেছে—নিশ্চয়ই সে মিথ্যা বলেছে হুজুর।

 মথুর যন্ত্রচালিতের মত বলিল, কি! ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই স্বীকার করেছে?—তাহার মুখ মৃতের মত বিবর্ণ হইয়া উঠিল।

 কর্ম্মচারীটি বলিল, আজ্ঞে, স্বীকারোক্তি লেখা হবার পরেই আমি এখানে রওনা হয়েছি; আমার মনে হচ্ছে রাত্রের মধ্যেই তিনি রাধাগঞ্জে পৌঁছবেন।

 মথুর আবার যন্ত্রের মত উচ্চারণ করিল, রাধাগঞ্জে—রাত্রির মধ্যেই।

 লোকটি আবার বলিল, পালান হুজুর, শিগগির পালান।

 মথুর আবার সেই ভাবেই বলিল, হ্যাঁ, পালাব।

 লোকটি চলিয়া গেল।

 পরদিন প্রভাতে সেই ব্যস্তবাগীশ আইরিশম্যান মথুর ঘোষের বাড়িতে উপস্থিত হইলেন, স্বয়ং মথুর ঘোষকে হাতে হাতকড়ি পরাইতে। তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ বহু বিচিত্র পরিচ্ছদধারী একদল কনস্টবল এবং অসংখ্য জনতা। ম্যাজিস্ট্রেট জাতীয় জীবটি দেখিতে কেমন এবং কি ধরনের খেলা তিনি খেলিতে আসিয়াছেন তাহা দেখিবার জন্য সকলেই উৎসুক হইয়া গলা বাড়াইতে লাগিল। মথুর ঘোষের বাড়িতে প্রবেশ করিয়া তন্নতন্ন করিয়া খোঁজা হইল, কিন্তু তাহাকে পাওয়া গেল না।

 শেষে মথুর ঘোষকে পাওয়া গেল। গুদাম-মহলের যে ঘরে মাধবকে এবং তাহার মত অন্যান্য অনেককে বন্দী করিয়া রাখা হইয়াছিল, ঠিক সেই ঘরেই স্বয়ং গৃহকর্ত্তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। সে গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে।