রাজমোহনের স্ত্রী/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ
চোরের ওপর বাটপাড়ি
আগন্তুকদের একজন বলিল, আরে চোয়াড়, নিজের পরিবারকে খুন করবি নাকি? সে নিজে যে সাধু উদ্দেশ্য লইয়া আসে নাই, তাহা তাহার চেহারাতেই প্রকট হইতেছিল; তাহার হাতের ছোরাখানিও একবার ঝলকিয়া উঠিল।
রাজমোহন ও গর্জ্জন করিয়া আগন্তুকদের দিকে ধাবিত হইল, প্রশ্ন করিল, কে তোরা? তাহার হাতের ছুরি দ্রুত আবর্ত্তিত হইতে লাগিল।—আমার ঘরে ডাকাতি!
ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া আগন্তুকদের একজন উত্তর দিল, আস্তে, আস্তে; গোলমাল করলে তোমার ঘরের লোকেরাই জেগে উঠ্বে। ডাকাত নয় দোস্ত, একটু নিরীক্ষণ ক’রে দেখ, আমাদের চিনতে পারবে। তারপর মাতঙ্গিনীর দিকে চাহিয়া তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, ওগো বাছা, একবার আলোটা এদিকে নিয়ে এস তো, দেখা যাক তোমার স্বামী তার বন্ধুদের মুখ মনে রাখতে পারে কি না!
কিন্তু মাতঙ্গিনীর তখন সম্পূর্ণ জ্ঞান লুপ্ত না হইলেও সে মুহ্যমানের মত পড়িয়া ছিল, তাহার জীবনের উপর অতর্কিত আক্রমণ এবং এই অপ্রত্যাশিত বাধা দুইই তাহাকে বিমূঢ় করিয়া ফেলিয়াছিল।
রাজমোহন বলিল, শত্রু হও, মিত্র হও, আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে —আর তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে তোমার পরিবারকে নিকেশ কর। দুঃসাহসী আগন্তুকের মুখ একটা পৈশাচিক হাসিতে উদ্ভাসিত হইল। রাজমোহন উন্মাদের মত গর্জ্জন করিয়া উঠিল, আমার যা খুশি করব, আমাকে ঠেকাবে কে শুনি!এবং পরক্ষণেই সে ছুটিয়া গিয়া আগন্তুকের বুকে ছুরি বসাইতে উদ্যত হইল। আগন্তুক বিদ্যুৎগতিতে সরিয়া গিয়া সে আঘাত হইতে আত্মরক্ষা করিল এবং নিজের বিশাল তরবারির এক আঘাতে রাজমোহনের হাতের ক্ষুদ্র অস্ত্র দশ হাত দূরে নিক্ষেপ করিল। নিমেষ ফেলিতে না ফেলিতে সে সজোরে লৌহমুষ্টিতে রাজমোহনের হাত চাপিয়া ধরিল। এতক্ষণ-পর্য্যন্ত-নীরব সঙ্গীটিকে লক্ষ্য করিয়া সে বলিল, ভিখু, আলোটা এদিকে ধর্ তো, আমার মুখটা ওকে দেখতে দে। বাপ রাজু, এ চাঁদ-মুখ বাবা, তোমার চন্দ্রবদনী স্ত্রী এ মুখ দেখলে খুশিই হবে। ভিখু প্রদীপ আনিয়া তাহার সঙ্গীর মুখের কাছে ধরিল!
রাজমোহন বিস্ময়ে চীৎকার করিয়া উঠিল, সর্দ্দার! আগন্তুক জবাব দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, সর্দ্দার! যা হোক তবু চিনতে পারলে দেখছি! বন্ধুরা এত সহজে কি বন্ধুদের ভোলে?
রাজমোহনের রাগ কিন্তু ইহাতে প্রশমিত হইল না, সমান ক্রুদ্ধকণ্ঠে সে বলিল, তোমরা এখানে কেন? আমার বাড়িতে চড়াও হবার মানে কি?
—আগে বল, তোমার বউকে খুন করতে যাচ্ছিলে কেন।
—সে খোঁজে তোমার প্রয়োজন? দেখ, ভালয় ভালয় বলছি কেটে পড়, সর্দ্দার-টর্দ্দার আমি মানি না, না গেলে লাথি মেরে বের করব |
সর্দ্দার ঠাট্টা করিয়া বলিল, বটে! কুলুপ-কলে তো প’ড়ে আছ, লাথি মারবে কে শুনি?
আমার পা এখনও স্বাধীন আছে —বজ্রনির্ঘোষে এই কথা বলিয়া রাজমোহন তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে এমন প্রচণ্ড পদাঘাত করিল যে, ডাকাতসর্দ্দারের লোহার মত দেহও কয়েক পা পিছাইয়া গেল, এবং রাজমোহনের বদ্ধ হাত দুইটিও মুক্ত হইল।
রাজমোহন তাহার ছুরিখানির দিকে ধাবিত হইতেছে দেখিয়া সর্দ্দার চীৎকার করিয়া বলিল, ভিখু, ওকে ধর্, বেঁধে ফেল্। —হুকুম শেষ হইতে না হইতে ভিখুর ভীমবাহু রাজমোহনকে ধরিয়া ফেলিয়া ভূপাতিত করিল। সর্দ্দার ধুলিলুষ্ঠিত রাজমোহনের বুকের উপর বাঘের মত ক্ষিপ্র গতিতে ঝাঁপাইয়া পড়িল এবং সে যতক্ষণ এইভাবে তাহাকে ধরিয়া রাখিল ততক্ষণ অন্যজন মাতঙ্গিনীর কাপড় টাঙাইবার আনলার বাঁশ হইতে দড়ি খুলিয়া শক্ত করিয়া তাহার হাত দুইটি বাঁধিয়া ফেলিল।
সর্দ্দার বলিল, বিশ্বাসঘাতক, তোমার প্রাণ এখন আমার হাতে।
—তা হতেই পারে, তোমরা দুজন, আমি একা। কিন্তু আমি কি করেছি যে, আমার সঙ্গে এই ব্যবহার করছ?
—কি করেছ? বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। তোমার ভায়রা ভাইকে বাঁচাবার জন্যে তুমি কি তাকে আগে থাকতে সাবধান করনি! চুকলিখোর কোথাকার! সর্দ্দারের চোখ দুইটি রাগে জ্বলিতে লাগিল —তুমিই খবর পাঠিয়েছ, তোমাকে মরতে হবে।
রাজমোহন বলিল, আমি? আমি তাকে খবর দিয়েছি?
—আকাশ থেকে পড়লে দেখছি! তুমি নয় তো কে? বোকামি হয়েছে আমারই। বিশ্বাস করেছিলাম তোমার ভায়রার বিরুদ্ধে আমাদের তুমি সাহায্য করবে। তুমিও কম শয়তান নও। আমাদের সামনে মাধবের নামে তুমি যে সব কথা বলতে তাতেই তো তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম!
রাজমোহন তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করিয়া বলিল, সত্যি বলছি, আমি খবর দিই নি। সর্দ্দারকে সে ভাল রকমেই চিনিত বলিয়াই নিজের জীবন সম্বন্ধে তাহার যথেষ্ট আশঙ্কা হইতেছিল —বিশ্বাস কর, আমি একাজ করি নি; মনে করে দেখ, আমি তোমাদের সঙ্গেই বাড়ি ছেড়ে গেছি এবং ফিরে না আসা পর্য্যস্ত তোমাদের সঙ্গেই ছিলাম; এক মুহূর্ত্তের জন্যে তোমাদের সঙ্গ কি আমি ছেড়েছি?
—থাক থাক, ঢের চালাকি হয়েছে—,ছেলের হাতের মোয়া পেয়েছ আর কি! এই দেয়ালের পাশে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তোমার স্ত্রী ঠিক ঘুমুচ্ছে কি না দেখবার জন্যে একবার ঘরের ভেতর আস নি তুমি? তাকে সব ব’লে তুমি তার হাত দিয়েই খবর পাঠিয়েছ, আমরা বুঝি না? বল যে, এও মিথ্যা সে খবর না দিলে আর কে খবর দিতে পারে শুনি!
—স্বীকার করছি সেই খবর দিয়েছে, কিন্তু আমার অজান্তে। আমি যখন ঘরে ঢুকেছিলাম তখন সে সত্যি ঘুমুচ্ছিল। যে কোনও দিব্যি করতে বল করতে রাজি আছি।
সর্দ্দর রূঢ় কণ্ঠে বলিল, ঢের মিথ্যে বলেছ, আর নয়। তোমাকে চিনতে আর বাকি নেই | তোমার মতলব যদি খারাপি না হবে, মাধব ঘোষের বাড়ি থেকে হাঁক শোনবার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি পালিয়ে এলে কেন? তোমার মতলব হাসিল হয়েছে, তখন আর থেকে দরকার? শোন বন্ধু, ঢের বয়স হ’ল আমার, এত সহজে আমাকে ঠকাতে পারবে না। মরতে প্রস্তুত হও।
রাজমোহনের নিশ্বাস লইতে কষ্ট হইতেছিল। সর্দ্দারের বিপুল বপুখানি তাহার বুকে চাপিয়া বসিয়াছিল এবং যথেষ্ট শক্ত হইলেও আর অধিকক্ষণ সে গুরুভার সহ্য করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছিল। সে বলিয়া উঠিল, দোহাই তোমার, আমাকে ছেড়ে দাও, ইষ্টদেবতার দিব্যি ক’রে বলছি—এ কথা ঠিক নয়, মায়ের দিব্যি, আমি কিছুই জানি না।
—তোমার স্ত্রীইবা এ কাজ করলে কেমন করে? সে তো ঘুমুচ্ছিল! এই প্রশ্ন করিয়া দস্যুসর্দ্দার রাজমোহনের বুক হইতে নামিয়া বসিল, কিন্তু হাত দুইটি তাহার গলা হইতে নামাইল না—প্রয়োজন হইলে গলা চাপিয়া ধরা কঠিন হইবে না।
—সে হয়ত ঘুমের ভাণ ক’রে প’ড়ে ছিল।
—হা হা, খুব বোকা পেয়েছ আমাকে! আমি চেয়েছিলাম ঘরের দেওয়ালের পাশ থেকে দূরে গিয়ে পরামর্শ করতে, তুমিই বললে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াতে। কোনও কুমতলব না থাকলে তুমি তা বলবে কেন? তুমি মাধব ঘোষের কাছে আমাদের নামে লাগিয়েছ, কে জানে কালকে পুলিশের কাছে লাগাবে কিনা! মাধব তোমাকে নিশ্চয়ই বাঁচাবার চেষ্টা করবে আর তুমি বেঁচে থাকলে আমাদের স্বস্তি নেই—খুব পালিয়ে এসেছিলে, নইলে এতক্ষণ সাবাড় হয়ে যেতে।
রাজমোহন হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া বলিল, আচ্ছা, তোমরা এখন ঘরে ঢুকে দেখলে কি? মাধবের কাছে খবর দেবার জন্যে যাকে পাঠিয়েছিলাম বলছ, আমি তাকেই খুন করতে যাই নি? তোমরা না এলে এতক্ষণ কোথায় থাকত সে?
—হুঁ। সর্দ্দার দেন একটু দ্বিধায় পড়িল, পরামর্শ চাহিয়া তাহার নির্ব্বাক সঙ্গীর মুখের দিকে সে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল।
ভিখু বলিল, হ্যাঁ সর্দ্দার, ও ঠিকই বলছে।
রাজমোহন তখন ভয়ে কাঁপিতেছে, সে বলিল, আমাকে যে কারণে তোমরা দোষী করছ, ঠিক সেই কারণেই আমি ওকে খুন করছিলাম।
সর্দ্দার লাফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া চীৎকার করিতে লাগিল, মাগী গেল কোথায়? ওকেই খুন কর। সে রাজমোহনের স্ত্রীকে রাজমোহনের শাণিত ছুরির নীচে যেখানে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিল সেখানে ছুটিয়া গেল। এক স্থানে কয়েকটা কাপড় গাদা করা ছিল, সেখানেও সে হাতড়াইতে লাগিল। নির্ব্বাণোন্মুখ প্রদীপের আলোকে স্পষ্ট কিছু দেখা যাইতেছিল না।
—হতভাগী গেল কোথায়? ভেবেছে ফাঁকি দিয়ে পালাবে, সেটি হচ্ছে না বাবা, খুঁজে বের করবই তোকে।
রাজমোহনের কণ্ঠস্বর ততক্ষণে স্বাভাবিক হইয়াছে, সে বলিল, থাম, আমি ছাড়া আর কেউ আমার স্ত্রীর অঙ্গস্পর্শ করতে পারবে না। আমার বাঁধন খুলে দাও।
সর্দ্দার ঘরের চারিদিকে দাপাদাপি করিয়া ফিরিতেছিল। সে ভিখুর দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল, ভিখু, দড়িটা খুলে দে, আমি চুলের মুঠি ধরে ওকে বের করছি। ভিখু তরবারির আঘাতে রাজমোহনের হাতের বাঁধন কাটিয়া দিল। সর্দ্দার আর একটা কাপড়ের গাদায় হাত দিয়া বলিয়া উঠিল, হেৎ, খালি কাপড়ই দেখছি; দাড়া মাগী, পালাবি কোথায়?— ঘর্ম্মাক্তকলেবরে বিছানার পাশে আসিয়া সর্দ্দার তাহার উপর যথেচ্ছ হাতিয়ার চালাইতে লাগিল কিন্তু মাতঙ্গিনী কোথায়?
সর্দ্দার হাকিল, ভিখু, বাতিটা নিয়ে আয়, তক্তপোশের তলায় লুকুল কি না দেখি। —ভিখু আলোটা বেশ করিয়া উস্কাইয়া লইয়া আসিল, রাজমোহনও পিছনে পিছনে আসিল; হামাগুঁড়ি দিয়া তিনজনেই দেখিল, কেহই সেখানে নাই।
বাতিটা উঁচু করিয়া ধরিয়া তাহারা ঘরের আনাচে কানাচে সর্ব্বত্র খোঁজ করিল কিন্তু মাতঙ্গিনীকে দেখিতে পাইল না। রাজমোহন দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া চীৎকার করিয়া বলিল, দরজার দিকে চেয়ে দেখ, খোলা না? আমি ঘরে ঢুকে হুড়কো বন্ধ করেছিলাম। হতভাগা পালিয়েছে।
মাতঙ্গিনী সত্যই পলাইয়াছিল। সর্দ্দার ও তাহার স্বামী যখন পরস্পরের প্রাণ লইয়া ঘোর যুদ্ধে মত্ত ছিল তখন তাহার কথা তাহদের স্মরণ ছিল না। এই দুই বর্ব্বর অপেক্ষা হৃদয় যাহাদের অল্প কঠোর তাহারা মাতঙ্গিনীকে একবার দেখিলে তাহার কথা ভুলিতে পারিত না। অলক্ষিতভাবে মাতঙ্গিনী দরজা পর্য্যন্ত গিয়া সন্তর্পণে দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে—শব্দ যদি কিছু হইয়াও থাকে যুদ্ধরত দুই মহাবীরের আস্ফালনে তাহা কাহারও শ্রুতিগোচর হয় নাই।
সর্দ্দার ব্যস্ত হইয়া বলিল, ওকে ধরা চাই, নইলে ও আমাদের সর্ব্বনাশ করবে।
রাজমোহন বলিল, হ্যাঁ, তাই চল, কিন্তু সাবধান আমার স্ত্রীর গায়ে কেউ হাত তুলোনা, তাকে তোমরা ধর কিন্তু খুন করতে হ’লে আমিই করব; আমি যদি তা না করি তোমরা আমাকে মেরে ফেলো! আর কেউ যেন ওকে না ছোঁয়। চল, আমিই আগে আগে যাচ্ছি।
তিনজনেই দ্রুত বাহির হইয়া গেল। আকাশ তখনও মেঘাচ্ছন্ন ছিল, টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টিও পড়িতেছিল। সর্ব্বত্র পলাতক সুন্দরীর অনুসন্ধান করা হইল। এদিকে প্রভাত হইতে বিলম্ব ছিল না, সময় অত্যন্ত কম।
প্রথমেই রাজমোহন কনকের বাড়ি গিয়া উঁকি মারিয়া দেখিবে ঠিক করিল। সর্দ্দার ও সে পা টিপিয়া টিপিয়া কনকের কুটীর পর্য্যন্ত গেল, তারপর দাওয়ায় উঠিয়া ঝাঁপ তুলিয়া ভিতরে চাহিয়া দেখিল, আলোকের অভাব সত্ত্বেও স্পষ্টই বুঝা যাইতেছিল, মা ও মেয়ে ঘুমাইতেছে।
আশেপাশের ঝোপে ঝাড়ে খোঁজা হইল, কিন্তু কোন ও সন্ধান মিলিল না। মেঘাচ্ছন্ন সিক্ত প্রত্যুষের স্থলে রৌদ্রময় লোহিতাভ প্রভাতের সূচনা দেখা গেল, দস্যুরা আর অধিকক্ষণ বাহিরে থাকা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিল না। তাহারা রাত্রিতে কোথায় মিলিত হইবে, তাহা স্থির করিয়া লইয়া পরস্পর পৃথক হইল। সর্দ্দার একথা জানাইতে ভুলিল না যে, রাজমোহন যদি অনুপস্থিত হয় তাহা হইলে—বাক্যটি সমাপ্ত না করিয়া সে একটি কুৎসিত শপথ উচ্চারণ করিল।