বিষয়বস্তুতে চলুন

রাজমোহনের স্ত্রী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

স্বামি-সম্ভাষণ

 সঙ্গিনীর সহিত কনকময়ী গৃহাভিমুখে চলিল। কনকের সঙ্গিনী স্বভাবতই লজ্জাশীলা —পথে মথুর ও মাধব তাহাকে দেখিতে পাইয়াছে ভাবিয়া তাহার লজ্জার আর অবধি রহিল না। সে কিছুক্ষণ নীরবে চলিয়া শেষে বলিল, কি পোড়াকপালে বাতাস দিদি, কি নাকালটাই হ’ল আজ!

 কনক হাসিয়া বলিল, কেন, ভগ্নীপতি কি তোমার মুখ দেখে নি কখনও?

 তরুণী। তার কথা বলছি না, আর একজন যে কে ছিল।

 কনক। আরে, সে যে মথুরবাবু।

 তরুণী। আমার ভগ্নীপতির জোঠতুতে ভাই?

 কনক। হ্যাঁ গো, হ্যাঁ।

 তরুণী। কি লজ্জা! এ কথা কাউকে বলিস না ভাই।

 কনক। মরণ আর কি! আমার যেন আর গল্প করার কথা নেই!

 কনক হাসিতেছিল। তরুণীর ইহাতে ক্রোধ হইল। বলিল, এমন জানলে তোমার সঙ্গে আসতাম না। কনক আরও হাসিতে লাগিল।

 ইতিমধ্যে তরুণী তাহার গৃহসন্নিধানে আসিয়া পড়িয়াছিল। দরজার দিকে দৃষ্টি পড়িতেই তরুণী ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। কনক দেখিল, তরুণীর স্বামী রাজমোহন দরজায় দাঁড়াইয়া—তাহার দুই চোখ দিয়া যেন অগ্নিবর্ষণ হইতেছিল। সে তরুণীর কানে কানে বলিল, আজ দেখছি একটা প্রলয় ঘটবে, তোর সঙ্গে যাব কি?

 রাজমোহনের স্ত্রী বলিল, না না, তুমি থাকলে হিতে বিপরীত হবে। তুমি বাড়ি যাও।

 কনক অন্য পথ ধরিল। তরুণী যতক্ষণ গৃহে প্রবেশ না করিল, রাজমোহন ততক্ষণ কিছুই বলিল না। তরুণী জলের কলসী রান্নাঘরের দাওয়ায় নামাইল। রাজমোহন তাহার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর অবধি আসিয়াছিল। বলিল, দাঁড়াও একটু। সে কলসীর সমস্ত জল উঠানে ঢালিয়া দিল। রাজমোহনের প্রাচীনা পিসী হাঁ-হাঁ করিয়া আসিয়া তাহাকে ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন।

 “চুপ কর্ মাগী হারামজাদী—বলিয়া রাজমোহন বারিশূন্য কলসীটা বেগে দূরে নিক্ষেপ করিল; এবং স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া অপেক্ষাকৃত মৃদু অথচ অন্তর্জ্বালাকর স্বরে কহিল, তবে রাজরাণী, কোথায় যাওয়া হইয়াছিল?

 “রমণী অতি মৃদুস্বরে দার্ঢ্য সহকারে কহিল, জল আনিতে গিয়াছিলাম।

 “যথায় স্বামী তাঁহাকে দাঁড়াইতে বলিয়াছিল তিনি তথায় চিত্রার্পিত পুত্তলিকার ন্যায় অস্পন্দিতকায় দাঁড়াইয়াছিলেন।

 “রাজমোহন ব্যঙ্গ করিয়া কহিল, জল আনিতে গিয়াছিলে! কারে বলে গিছলে ঠাকুরাণি?

 “কাহারেও বলে যাই নাই।

 “রাজমোহন আর ক্রোধ-প্রবাহ সম্বরণ করিতে পারিল না, চিৎকার স্বরে কহিল, কারেও বলে যাও নাই—আমি দশ হাজার বার বারণ করেছি না?

 “অবলা পূর্ব্বমত মৃদুভাবে কহিল, করেছ।

 “তবে গেলি কেন হারামজাদি?

 “রমণী অতি গর্ব্বিত বচনে কহিল, আমি তোমার স্ত্রী। তাঁহার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, কণ্ঠস্বর বদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল।

 “গেলে কোন দোষ নাই বলিয়া গিয়াছিলাম।

 “অসমসাহসের কথা শুনিয়া রাজমোহন একেবারে অগ্নিসম হইয়া উঠিলেন; বজ্রনাদবৎ চিৎকারে কহিলেন, আমি তোকে হাজার বার বারণ করেছি কি না? এবং ব্যাঘ্রবৎ লম্ফ দিয়া চিত্রপুত্তলিসম স্থিররূপিণী সাধ্বীর কোমল কর বজ্রমুষ্টে এক হস্তে ধরিয়া প্রহারার্থ দ্বিতীয় হস্ত উত্তোলন করিলেন।

 “অবলাবালা কিছু বুঝিলেন না, প্রহারোদ্যত হস্ত হইতে এক পদও সরিয়া গেলেন না, কেবল এমন কাতর চক্ষে স্ত্রীঘাতকের প্রতি চাহিয়া রহিলেন যে, প্রহারকের হস্ত যেন মন্ত্রমুগ্ধ রহিল। ক্ষণেক নীরব হইয়া রহিয়া রাজমোহন পত্নীর হস্ত ত্যাগ করিল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ পূর্ব্বমত বজনিনাদে কহিল, তোরে লাথিয়ে খুন করব।”

 তরুণী তথাপি নীরব, কেবল তাহার চোখ দিয়া দরদরধারে জল ঝরিতে লাগিল। ইহা দেখিয়া রাজমোহন কিঞ্চিৎ নরম হইল। তাহার হাত আর চলিল না বটে, কিন্তু রসনা অবিরল কটূক্তি বর্ষণ করিয়া চলিল। তাহাতেও যখন তরুণী কোন কথা কহিল না, তখন রাজমোহন ধীরে ধীরে শান্ত হইল।

 রাজমোহনকে শান্ত হইতে দেখিয়া পিসীর সাহস বাড়িল। তিনি অগ্রসর হইয়া ভ্রাতুষ্পুত্রবধূর হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর লইয়া গেলেন এবং যাইতে যাইতে অত্যন্ত সাবধানে রাজমোহনের প্রতি দুইএকটি বাক্যবাণ নিক্ষেপ করিতে ছাড়িলেন না। রাজমোহনের রাগ যখন পূরাপূরি পড়িয়া আসিয়াছে বুঝিলেন, তখন তিনি একটি একটি করিয়া রাজমোহনের সমস্ত কটূক্তিরই জবাব দিলেন। রাজমোহন নিজের রাগে নিজেই গজরাইতেছিল, পিসীর বাক্যবাণের প্রতি সে বড় একটা নজর দিল না। শেষে পিসী-ভাইপো নিরস্ত হইয়া দুইজনে দুই দিকে গেলেন। পিসী বউমাকে শান্ত করিতে গেলেন, রাজমোহন কাহার মুণ্ডপাত করিবে তাহাই ভাবিতে লাগিল।