রাজা সাহেব/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।


হার-জিত।

 মন্ত্রী মহাশয় দরবারে আগমন করিয়া উপবেশন করিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই রাজা মহাশয় আগমন করিয়া দরবারে প্রবেশ করিলেন। রাজা মহাশয়ের অবস্থা আর কি বল করিব। রাজা ত রাজাই, চেহারা রাজার মত, পোষাক-পরিচ্ছদ রাজার মত, আদব কায়দা, চাল চলন মাজায় মত। তিনি রাজ-কায়দায়—রাজধরনে গমন করিয়া তাহার রবিবার স্থানে উপবেন করিলেন। একজন অনুচর তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ একটী ক্যাসবাক্স হন্তে সেই দরবার গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং রাজা মহাশয়ের সম্মুখে সেই বাক্সটী স্থাপিত করিয়া দূরে গিয়া দণ্ডায়মান মহিল। মালা মহাশয় যে সময় দরবার গৃহে প্রবেশ করেন, সেই সময় সেই গৃহস্থিত ব্যক্তিমাত্রই দণ্ডায়মান হইয়া আপন আপন পদমর্যাদা অনুযায়ী রাজা মহাশয়কে অভিবাদন করিবেন। বলা বাহুল্য যে, আমাদিগের এসিস্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয়ও অপরাপর কর্মচারীবর্ণের ন্যায় রাজা মহাশয়কে অভিবাদন করিতে বিস্মৃত হইলেন না। রাজা মহাশয় উপবেশন করিলে সকলে রাজ-দরবারের রীতি-অনুযায়ী উপবেশন করিলেন। উপবেশন করিবার সময় এসিষ্টে সেক্রেটারী মহাশয়ের দিকে রাজা মহাশয়ের নয়ন আকৃষ্ট হইল। তিনি মন্ত্রী মহাশষের দিকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই বাবুটা কে? ইহাকে ইতিপূর্বে আর কখন দেখিয়াছি বলিয়া ত আমার বোধ হয় না।

 উত্তরে মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “ইতিপুর্বে ইহাকে আপনি আর কখনও দেখেন নাই।” এই বলিয়া রাজা মহাশয়ের নিকট তিনি এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের পরিচয় প্রদান করিলেন, এবং পরিশেষে কহিলেন, “ইহারই টাকা ঋণ করিবার কথা আপনাকে পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম।”

 মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় কহিলেন, “ইহাকে একটু অপেক্ষা করিতে বলুন, টাকা দেওয়া যাইবে। এই বলিয়া সেই নবাগত লোকদিগের প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আপনারা কতক্ষণ আসিয়াছেন? আজ আমার আসিতে একটু বিলম্ব হইয়াছে, তজ্জন্য আমাকে মাপ করিবেন। যাই হোক, এখন আসুন-কার্য্য আরম্ভ করা যাউক, বিলম্বে আয় প্রয়োজন কি?

 রাজ মহাশয়েয় মুখ হইতে এই কথা বহির্গত হইবামাত্র একজন অনুচর একজোড়া তাস আনিয়া রাজা মহাশয়ের সম্মুখে রাখিয়া দিল। আগন্তুক কয়েক ব্যক্তিও তাঁহার নিকটে গমন করিয়া উপবেশন করিল। খেলা আরম্ভ হইল। ক্থায় কথায় হাজার দু হাজার টাকায় হার-জিত হইতে লাগিল। দরবারস্থ সমস্ত লোক অতীব, মনোযোগের সহিত ক্রীড়া দেখিতে লাগিলেন। দাওয়ানজী মহাশয় আগন্তুক দিগের নিকট বসিয়া ইঙ্গিতে দুই এক কথা তাহাদিগকে বলিয়া দিতে লাগিলেন। তাহারাও সেই অনুযায়ী কার্য্য করিয়া কেবল জিতিতে লাগিল, এবং রাজা মহাশয় ক্রমে হারিতে লাগিলেন।

 এই সময় রাজা মহাশয় এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারীর দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “কেমন মহাশয়! আপনার এইরূপ একটু আধটু ক্রীড়া করা অভ্যাস আছে কি?”

 উত্তরে সেক্রেটারী মহাশয় কহিলেন, “না মহাশয়। ইতিপূর্ব্বে এরূপ ক্রীড়ায় হস্তক্ষেপ করা দুরে থাকুক, অপর কাহাকেও এরূপ ক্রীড়া করিতে দেখি নাই।”

 প্রত্যুত্তরে রাজা মহাশয় কহিলেন, “এ অতি সামান্য খেলা। যে কোন ব্যক্তি একটু মনোযোগের সহিত দেখিলেই তখনই শিখিতে পারেন। তাহার দৃষ্টান্ত দেখুন; ইহারা এ ক্রীড়া আদৌ জানিতেন না। আমার নিকট শিক্ষা করিলেন; আশ্চর্য্য দেখুন, এখন আমাকেই ইহাদিগের নিকট পরাস্ত হইতেই হইতেছে!”

 এই বলিয়া ক্রীড়ায় পুনরায় মনঃসংযোগ করিলেন। দুই একবার জিতিতেও লাগিলেন, কিন্তু প্রায়ই হারিতে লাগিলেন। সেই সময় মন্ত্রী মহাশয়ের দিকে একবার লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “পাট ক্রয় করিতে পারদর্শী লোকের কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে পারিয়াছেন কি?”

 মন্ত্রী। বিশেষরূপ চেষ্টা দেখিতেছি। কিন্তু সেরূপ উপযুক্ত লোক এখনও স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। লোকের অভাব কি? দুই এক দিবসের মধ্যে সমস্ত ঠিক করিয়া লইব।  পুনরায় ক্রীড়া চলিতে লাগিল। পুনরায় রাজা মহাশয় পরাভূত হইতে লাগিলেন। এইরূপে প্রায় দুই ঘণ্টা কাল ক্রীড়া হইবার পর হার-জিতের হিসাব হইল। সেই সময় জানিতে পারা গেল যে, রাজা মহাশয় পঁচিশ হাজার টাকা জিতিয়াছেন। কিন্তু এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা হারিয়া গিয়াছেন; সুতরাং হিসাবে রাজা মহাশয় লক্ষ টাকার জন্য দায়ী হইলেন।

 এইরূপে অনেকগুলি টাকা একবারে হারিয়া যাওয়ায় তিনি একটু দুঃখিত হইলেন সত্য; কিন্তু ক্যাসবাক্স খুলিয়া একতাড়া নোট বাহির করিয়া উহাদিগের হস্তে প্রদান করিলেন। কারেন্সি অফিস হইতে নূতন নেটের তাড়া বাহির হইবার সময় যেরূপভাবে লাল সূতার দ্বারা উহা বাঁধা থাকে, এ নোটগুলিও সেইরূপভাবে বাঁধা। এই তাড়ার উপরিস্থিত একখানি নোটের উপর সকলের দৃষ্টি পড়িল; উহা একখানি হাজার টাকার নোট। সুতরাং সকলেই তখন অনুমান করিল যে, এ নোটের তাড়ায় একশত নোট আছে, এবং প্রত্যেক নোট এক হাজার টাকার। যাহার হস্তে রাজা মহাশয় সেই নোটের তাড়া অপর্ণ করিলেন, তিনি উহা, না গণিয়া আপনার পকেটেই রাখিয়া দিলেন।

 ইহার পরই সে দিবসের নিমিত্ত ক্রীড়া শেষ হইয়া গেল। পরদিবস এই সময়ে পুনরায় ক্রীড়া আরম্ভ করিবেন, এইরূপ স্থির করিয়া রাজা মহাশয় গাত্রোখান করিবার উদ্যোগ করিলেন। সেই দিবস অনেকগুলি টাকা তিনি হারিলেন বলিয়া, হার মনে একটু অশান্তির উদয় হইয়াছে, ইহাই সকলে অনুমান হইল।