রাজা সাহেব (৩য় অংশ)/দশম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দশম পরিচ্ছেদ।


নূতন বিপদ—অপার ভাবনা।

 পরদিবস নিয়মিত সময়ে এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয় পুনরায় রাজবাড়ীতে গমন করিলেন। অপরাপর দিবস রাজবাড়ীতে গমন করিলে তথায় যে লোকদিগকে দেখিতে পাইতেন, আজ আর তাহাদিগের কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় একজন পরিচারকের সহিত সাক্ষাৎ হইল মাত্র। তাহাকে দেখিয়া এসিস্ট সেক্রেটারী বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমার কেমন আছেন, কোন সংবাদ পাইয়াছি কি? রাজা সাহেব এখন কোথায় আছেন?” চাকর কোন প্রকার উত্তর প্রদান না করিয়া, বিষন্নবদনে দরবার গৃহ দেখাইয়া দিল। এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুও তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, এবং অপর কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া পূর্বপরিচিত সেই দরবার গৃহে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 সেক্রেটারী বাবু দেখিলেন, আজ দরবার গৃহ শূন্য। লোকজন প্রভৃতি আজ কেহই সে গৃহে নাই, কেবলমাত্র মন্ত্রী মহাশয় একাকী নিতান্ত বিষন্নবদনে বসিয়া রহিয়াছেন। এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুকে দেখিয়া মন্ত্রী মহাশয় তাহাকে রসিতে কহিলেন। তিনি সেইস্থানে উপবেশন করিবামাত্র মন্ত্রী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমার বাহাদুর কেমন। আছেন। তিনি ভাল আছেন ত?”

 উত্তরে মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “কুমার বাহাদুরের কথা আর জিজ্ঞাসা করিবেন না। জানি না, জগদীয় কি কারণে আমাদিগের উপর নিতান্ত নির্দয় হইয়া গত রজনীতে কুমার বাহাদুরকে লইয়া গিয়াছেন। সেই শোকে সকলেই বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছেন, এই নিমিত্ত আজ আপনি আর কাহাকেও এখানে দেখিতে পাইতেছেন না। কেবল যে আমাকে দেখিতেছেন, সেও কেবল আপনার নিমিত্ত। অদ্য আপনার এইস্থানে আগমন করিবার কথা ছিল; আপনি আগমন করিয়া কাহাকেও দেখিতে না পাইলে মনে কি ভাবিবেন? এই বিবেচনায় আপনার অপেক্ষায় আমি এই স্থানে বসিয়া রহিয়াছি। এই ভয়ানক বিপদের পর আমি আর মজা মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারি নাই, বা আপনাকে যে টাকা প্রদান করিতে হইবে, তাহা তাঁহার নিকট হইতে চাহিয়া লইতে সমর্থ হই নাই। এদিকে আপনি যদি সেইস্থানে গমন করিতে বিলম্ব করেন, তাহা হইলেও বিশেষরূপে কার্যের ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। এরূপ অবস্থায় কি করা কর্তব্য, তাহা আমি কিছুই স্থির করি। উঠিতে পারিতেছি না।”

 সেক্রেটারী। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা সত্য। যে কার্যে আমাকে গমন করিতে হইতেছে, যত বিলম্বে সেই কার্যে গমন করিব, ততই কার্যের ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। পাট আমদানীয় সময় প্রায় শেষ হইয়া আসিতেছে। আরও দশ পাঁচ দিবসের মধ্যে একরূপ আমদানী হইবে, পরে কিন্তু কম পড়িয়া আসিবে। আমদানী কমিয়া গেলে, এত পাট ক্রয় একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িবে।

 মন্ত্রী। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক। বিলম্বে যে সবিশেষ ক্ষতি হইবে, তাহা আমি এইস্থানে বসিয়াই বেশ বুঝিতে পারিতেছি। আমদানী কমিয়া গেলে পাটের মূল্য অধিক হইবারই সম্ভাবনা। তদ্ব্যতীত আমাদিগের প্রয়োজনীয় সকল পাটই যে পাওয়া যাইবে, তাহারই বা ভরসা কি? যে পরিমাণ পাটের সাটা মহারাজ গ্রহণ করিয়াছেন, তাহার সমস্ত যদি তিনি প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে তাহার পক্ষে কি অপমান, তাহা একবার ভাবুন দেখি? আমার বিবেচনায় আপনি আর বিলম্ব করিবেন না, অদ্যই পাট ক্রয় করিবার স্থানে গমন করুন। সেইস্থানে গমন করিয়াই কিছু পাট ক্রয় করিতে পারিবেন না। আপনাদিগের থাকিবার স্থান ঠিক করিতে, পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত আপনাকে সাহায্য করিতে পারে, এরূপ লোকজন সংগ্রহ করিতে, এবং পাট ক্রয় করিয়া আপাততঃ তাহা কোথায় রাখিবেন, তাহার বন্দোবস্ত করিতে, অভাব পক্ষে আপনার দুই তিন দিবস অতীত হইয়া যাইবে। যে পর্যন্ত এই সকল বন্দোবস্ত ঠিক না হইবে, সেই পর্যন্ত পাট ক্রয় আরম্ভ করিতে সমর্থ হইবেন না। আপনি অথই গমন করিয়া এই সকল বিষয় স্থির করিয়া লউন। এদিকে মহারাজার শোকাবেগও একটু কমিয়া যাউক। যেমন কিমি একটু প্রকৃতিস্থ হইবেন, অমনি আমি তাঁহার নিকট হইতে টাকা চাহিয়া লইয়া আপনার নিকট পাঠাইয়া দিব। আর দুই তিন দিবসের মধ্যে যদি তাহাকে কোন কথা বলিবার সুযোগ নাই পাই, তাহা হইলেও আপনি টাকা পাইবেন। আমাদিগের হস্তে যে সকল তহবিল আছে, তাহা হইতে কোন খরচ না করিলে দুই তিন দিবসের মধ্যে লক্ষ টাকা জমিয়া যাইবে। রাজা মহাশয়ের সহিন্ত সাক্ষাৎ না হইলে তাহার বিনা অনুমতিতে আমি সেই টাকা পাঠাইয়া দিতে পারিব। অতএব সে বিষয়ে কিছুমাত্র চিন্তা নাই। আপনি আর কালবিলম্ব করিবেন না, অদ্যই এইস্থান হইতে গমন করিয়া যাহাতে সুচারুরূপে কার্যনির্বাহ করিতে পারিবেন, তাহার বন্দোবস্ত করুন।

 মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয় আর কালবিলম্ব করিতে পারিলেন না। তাঁহার প্রস্তাবে মত দিয়া, সেইদিবসই কলিকাতা পরিত্যাগ করিবেন, এইরূপ বলিয়া মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন। যাইবার সময় তাহার নিজের কার্য্যের বিষয় মন্ত্রী মহাশয়কে একবার কহিলেন। উত্তরে মন্ত্রী মহাশয় বলিলেন, “তাহার নিমিত্ত আপনাকে আর কোন কথা বলিতে হইবে না। আপনি আপনার রাজা মহাশয়কে পত্র লিখিয়া দিউন। যে দিবস তিনি আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, সেই দিবসই আমি তাহার কার্য শেষ করিয়া দিব।”

 বলা বাহুল্য, পাট ক্রয় করিতে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে যে সকল বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন, সেই সকল বন্দোবস্ত করিয়া লইবার নিমিত্ত এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটায়ী বাবু সেইদিবস রাত্রিতেই কলিকাতা পরিত্যাগ করিলেন। কলিকাতা পরিত্যাগ করিবার পূর্বে তাহার মনিবকে এক পত্র লিখিয়া জানাইলেন যে, টাকার সমস্তই ঠিক হইয়া গিয়াছে। তাহার পরিচিত জনৈক উকীলের বাড়ীতে দলিল লেখাপড়া হইতেছে। এক মাসের মধ্যে কলিকাতায় আসিয়া যে দিবস সেই দলিল তিনি রেজেষ্টারী করিয়া দিবেন, সেই দিবসই টাকা প্রাপ্ত হইবেন। রাজা মহাশয়কে যেরূপভাবে পত্র লিখিলেন, তাহার সর্বপ্রধান কর্মচারীকে ও সেইরূপ ভাবে আর এক পত্র লিখিলেন। অধিকন্তু তাহাকে এই লিখিয়া দিলেন যে, রাজা মহাশয়ের কলিকাতায় আগমনের দিবস স্থির হইলে, তারযোগে যেন তাহাকে পূর্বে সংবাদ প্রদান করা হয়।

 এদিকে এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু তাহার ভ্রাতার সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া গেলেন যে, তাহার নামে যে সকল পত্রাদি আসিবে, তাহা তিনি খুলিয়া পাঠ করিবেন। তাহার মধ্যে যদি কোন বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় না থাকে, তাহা হইলে সেই সকল পত্রাদি এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুর নিকট পাট ক্রয় করিবার স্থানে পাঠাইয়া দিবেন। সেইস্থান হইতে তিনি উহার উত্তর লিথিয়া দিবেন। কোন পত্রে যদি কোন সবিশেষ প্রয়োজনীয় কর্মের উল্লেখ থাকে, বা রাজা মহাশয়ের কলিকাতায় আসিবার দিন স্থির করিয়া যদি কেহ কোন পত্র লেখেন, তাহা হইলে তাহাকে তারযোগে সংবাদ প্রদান করিলে যত শীঘ্র পারেন, তিনি কলিকাতায় আগমন করিবেন। এইরূপ ভাবে বন্দোবস্ত করিয়া তিনি কলিকাতা পরিত্যাগ করিলেন।

 সময়মত এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু পাট ক্রয় করিবার বন্দোবস্ত করিতে সিরাজগঞ্জে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াই মন্ত্রী মহাশয়কে এক পত্র লিখিলেন।

 এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু ইতিপূর্বে আর কখন সিরাজগঞ্জে পদার্পণ করেন নাই। সুতরাং সেই স্থানে তিনি সম্পূর্ণ রূপে অপরিচিত হইলেও, ক্রমে ক্রমে সমস্ত কার্যের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া লইতে লাগিলেন। যে স্থানে থাকিলে পাট খরিদ করিবার বিশেষরূপ সুযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা হয়, এরূপ স্থান দেখিয়া তাহার থাকিবার স্থান স্থির করিয়া লইলেন, যেরূপ লোকজন নিযুক্ত করিলে ঐ পাট খরিদ কার্য অনায়াসেই সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইবেন, বাছিয়া বাছিয়া ও বিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া সেইরূপ লোকজন নিযুক্ত করিতে আরম্ভ করিলেন। পাট খরিদ হইলে যে স্থানে উহা রাখিতে হইবে অনেক দেখিয়া শুনিয়া সেইরূপ একটী স্থানেরও বন্দোবস্ত করিলেন। এই সকল কার্য শেষ করিতে প্রায়ই ৩৪ দিবস অতীত হইয়া গেল, এইরূপে পাট ক্রয় করিতে আরম্ভ করিতে হইলে যে সকল বন্দোবস্তের বিশেষ প্রয়োজন, তাহার সমস্তই স্থির করিয়া মন্ত্রী মহাশয়কে দ্বিতীয় পত্র লিখিলেন। কিন্তু কোন পত্রেরই কোন উত্তর না পাইয়া টাকা পাঠাইয়া দিবার নিমিত্তই উপরির্য্যুপরি আরও দুই একখানি পত্র লিখিলেন; কিন্তু তাহারও কোন উত্তর আসিল না। এইরূপে তিন চারি দিবসের পরিবর্তে ক্রমে আট দশ দিবস অতীত হইয়া গেল, তথাপি টাকাও আসিল না, বা পত্রের উত্তরও পাইলেন না। তখন কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া এক টেলিগ্রাফ করিলেন। তাহারও কোনরূপ উত্তর না পাইয়া, সেক্রেটারী বাবু অতিশয় চিন্তিত হইলেন। এইরূপে প্রায় পনর দিবস বিনাকার্যে অতিবাহিত হইয়া গেল। পাটের আমদানী ক্রমে কমিয়া আসিতে লাগিল। তখন অনন্যোপায় হইয়া সমস্ত বিষয় বিবৃত করিয়া আপনার ভ্রাতাকে এক পত্র লিখিলেন। সেই পত্রের উত্তরে তাহার ভ্রাতার নিকট হইতে অবগত হইলেন, “যে বাড়ীতে রাজা মহাশয় বাস করিতেন, তথায় গমন করিয়া দেখিলাম যে, সেই বাড়ীতে এখন লোকজন কেহই বাস করে না, তাহার সদর দ্বার তালাবদ্ধ আছে। রাজা মহাশয় উক্ত বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া যে কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহাও সেখানকার কেহই বলিতে পারিল না।”

 ভ্রাতার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেক্রেটারী বাবু যে কতদুর ভাবিত হইলেন, তাহা আর কি বলিব? কখনও ভাবিলেন, রাজা মহাশয় কোথায় উঠিয়া গেলেন, তাহা কিরূপে স্থির করিব? কখনও ভাবিলেন, এত বড় একটা রাজা মনের কষ্টে যদি সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াই থাকেন, তাহা হইলে তিনি যে কোথায় উঠিয়া গিয়াছেন, তাহা অনায়াসেই জানিতে পারা যাইবে। আবার ভাবিলেন, যদি রাজা মহাশয়ের কোনরূপ সন্ধান না করিয়া উঠিতে পারি, তাহা হইলে মনিবের নিকট যে কিরূপ লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হইব, তাহা বলিতে পারি না। তাহার উপর আমার নিজের পাঁচ হাজার টাকা আদায় হইবার উপায় কি? কখনও ভাবিলেন, পূর্ব্বে শুনিতাম যে, কলিকাতা জুয়াচোরে পরিপূর্ণ। ইহা ত সেই প্রকার কোন জুয়াচারের খেলা নহে? আবার ভাবিলেন যে, এত বড় বাড়ী, এত লোকজন কি কখনও জুয়াচারের সম্ভবে? এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু সিরাজগঞ্জ পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন।

 পরদিবস অতি প্রত্যুষে সেক্রেটারী বাবু আপনার ভ্রাতা ও অপরাপর দুই একজন বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে লইয়া যে বাড়ীতে রাজা বাস করিতেন, সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন যে, দ্বারে একমাত্র দ্বারবান্ ভিন্ন সেই বাড়ীর ভিতর জনমানব কেহই নাই। বাড়ীর সম্মুখে লেখা আছে যে, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। এই অবস্থা দেখিয়া সেক্রেটারী বাবু সেই দ্বারবানুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই বাড়ীতে যে রাজা মহাশয় বাস করিতেন, তিনি এখন কোথায় গমন করিয়াছেন?”

 দ্বারবান্। কে এই বাড়ীতে বাস করিত, তাহা আমি জানি না। যে পর্যন্ত আমি কর্মে নিযুক্ত হইয়াছি, সেই গর্য্যন্ত এ বাড়ী খালিই দেখিতেছি।

 এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী। কতদিন হইতে তুমি কর্মে নিযুক্ত হইয়াছ?

 দ্বারবান। দিন পর হইবে।

 সেক্রেটারী। কে তোমাকে নিযুক্ত করিয়াছে?

 দ্বারবান্। যাঁহার বাড়ী, তিনিই আমাকে কর্মে নিযুক্ত করিয়াছেন।

 সেক্রেটারী। যাঁহার বাড়ী তাহার নাম কি?  দ্বারবান্। নাম অমি বলিতে পারি না। তাঁহার থাকিবার বাড়ী জানি—সুকিয়া স্ট্রীটে তাহার বাড়ী। আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। আপনি যেরূপ ভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, এইরূপ ভাবে কত লোক যে প্রত্যহ আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাহা আর কি বলিব? সকলের কথার উত্তর দিতে দিতে আমি জ্বালাতন হইয়া গিয়াছি। ঐ দেখুন—একটা লোক আসিতেছেন, উনি প্রায় প্রত্যহই আসিয়া আমাকে এইরূপে জ্বালাতন করেন।

 দ্বারবান এই কথা বলিলে পর সেই লোকটী আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইনেন, এবং এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! আপনারা এখানে কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?”

 সেক্রেটারী। এই বাটীতে যে রাজা মহাশয় বাস করিতেন, তাহারই অনুসন্ধান করিতেছি।

 আগন্তুক। রাজা মহাশয়ের কোন সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি?

 সেক্রেটারী। তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত এইমাত্র আমরা, এখানে আগমন করিতেছি, এবং এই বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া, রাজা মহাশয় কোথায় উঠিয়া গিয়াছেন, তাহাই দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিতেছি; এমন সময় আপনি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

 আগন্তুক। রাজা মহাশয়ের অনুসন্ধানে আপনারা এইমাত্র আসিয়াছেন, আমি কিন্তু গত পনর দিবস হইতে তাহার অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছি। এ পর্য্যন্ত কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই।  সেক্রেটারী। আপনি কি নিমিত্ত রাজা মহাশয়ের সন্ধান করিয়া ফিরিতেছেন?

 আগন্তুক। সে দুঃখের কথা আপনাকে আর কি বলিব? আমার নিকট হইতে তিনি প্রায় সহস্র টাকা মূল্যের কাপড় ক্রয় করিয়াছেন, কিন্তু একটামাত্র পয়সাও এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হই নাই। যে তারিখে আমাকে টাকা দিবার কথা ছিল, সেই তারিখে আসিয়া দেখি যে, এ বাটী খালি পড়িয়া রহিয়াছে। ইহাতে না আছেন রাজা, না আছেন তাহার লোকজন।

 সেক্রেটারী। এত বড় একটা রাজা এই বাড়ী হইতে উঠিয়া অপর কোন বাড়ীতে গমন করিয়াছেন, তাহার সন্ধান হইবে না, ইহাও বড় আশ্চর্যের কথা!

 আগন্তুক। আমি এখন যেরূপ জানিতে পারিতেছি, তাহাতে আমার বোধ হইতেছে যে, এ বাড়ীতে কোন রাজা কোন সময়েই বাস করেন নাই। রাজা বলিয়া যে এই বাড়ীতে বাস করিত, সে একজন জুয়াচোর, এবং মন্ত্রী, দাওয়ান প্রভৃতি যত লোকজন এই বাড়ীতে থাকিত, তাহারা সকলেই সেই জুয়াচারের দলের লোক।

 সেক্রেটারী। আপনি কি বলেন মহাশয়! ইহারা কি সকলেই জুয়াচোর? যদি ইহারা জুয়াচার হয়, তাহা হইলে ইহারা আমার কি সর্বনাশই করিল।

 আগন্তুক। কেন মহাশয়। আপনার নিকট হইতেও উহারা কিছু লইয়াছে নাকি?

 সেক্রেটারী। নিতান্ত কিছু নহে মহাশয়! পাঁচ হাজার টাকা লইয়াছে! আপনি কি ঠিক জানিতে পারিয়াছেন যে, উহারা জুয়াচার?

 আগন্তুক। আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে ঠিক বলিয়াই বোধ হয়।

 সেক্রেটারী। আপনার নিকট হইতে কাপড় ক্রয় করিবার কালে কোন দালাল দালালী করিয়াছিল কি?

 আগন্তুক। ইহার ভিতর একজন দালাল ছিল বটে; কিন্তু তাহারও আর কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না, সেও এখন পলাতক। সেক্রেটারী। সেই দালালের নাম আপনি কি জানেন?

 আগন্তুক। সে আমাদিগের বাজারের দালাল। তাহাকে বহুদিবস হইতে আমি চিনি, তাহার নাম ভগবান দাস।

 সেক্রেটারী।আমার ও দালাল ছিল—ভগবান দাস। ভগবান দাসকে পাওয়া যাইতেছে না? সেও কি পলায়ন করিয়াছে? কি সর্ব্বনাশ! মনে মনে এ পর্যন্ত যাহর ভরসা করিতেছিলাম, সেও জুয়াচোর? কি ভয়ানক! এ জগতে কাহাকে বিশ্বাস করিব? আগন্তুক। আপনিও দেখিতেছি, আমার মত ভগবান দাসকে বিশ্বাস করিয়াছিলেন।

 সেক্রেটারী। যেমন বিশ্বাস করিয়াছিলাম, তেমনই তাহার উপযুক্ত ফল প্রাপ্ত হইলাম। যাহা হউক, এখন এই বাড়ী যাহার, চলুন দেখি মহাশয়! একবার তাহার নিকট গমন করি। তাহার বাড়ী কে ভাড়া লইয়াছিল, তাহার যদি তিনি কোনরূপ সন্ধান বলিয়া দিতে পারেন।  আগন্তুক। তাহা দেখিতে কি আর আমি বাকি রাখিয়াছি মহাশয়! বাড়ীওয়ালা বাবু আমাদিগের প্রয়োজনীয় কোন সংবাদই প্রদান করিতে পারেন না। তিনি বলেন যে, একদিবস একজন লোক তাহার নিকট আগমন করেন, এবং এক মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়া এই বাড়ী এক মাসের নিমিত্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু একমাস পূর্ণ হইতে না হইতেই কাহাকেও কিছু না বলিয়া চলিয়া যান। এই কথা যখন তিনি জানিতে পারেন, সেই সময় যাহাতে এই খালি বাড়ী কেহ কোনরূপে নষ্ট করিতে না পারে, এই নিমিত্ত এই দারোয়ানকে এইস্থানে নিযুক্ত করিয়া রাখিয়া দিয়াছেন। যে ব্যক্তি এই বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহাকে পূর্বে তিনি কখনও দেখেন নাই, বা তাহার নামও অবগত নহেন; কিন্তু যদি পুনরায় তাহাকে তিনি দেখিতে পান, তাহা হইলে তাহাকে চিনিতে পারিবেন।

 সেক্রেটারী। সে উপায়ও নাই। তবে এখন কি করা যায় মহাশয়?

 আগন্তুক। ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি ত কোন উপায়ই দেখিতেছি না।

 সেক্রেটারী। তবে কি আমাদিগের এতগুলি টাকা মারা যাইবে?

 আগন্তুক। টাকা মারা যাইবে, বলিতেছেন কি মহাশয়। মারা ত গিয়াছে। টাকা আদায়ের আমি কোন উপায়ই দেখিতে পাইতেছি না।

 উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এরূপ সময়ে অপর এক ব্যক্তি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল, ও সেক্রেটারী মহাশয়কে সেইস্থানে দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা এখানে কাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আসিয়াছেন?”

 সেক্রেটারী। রাজা সাহেবের অনুসন্ধানে আমরা এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, তুমিও কি তাহার অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছ?

 নবাগত। হাঁ মহাশয়, আমিও আজ কয়েক দিবস পর্যন্ত তাঁহার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, কিন্তু কোন স্থানে তাহাদিগের কিছু অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। |

 সেক্রেটারী। কেন তুমি তাহাদিগের অনুসন্ধান করিতেছ? তুমিও কি তাহাদিগের কর্তৃক কোন প্রকারে প্রতারিত হইয়াছ?

 নবাগত। হাঁ মহাশয়! উহারা আমার বিশেষরূপে সর্বনাশ করিয়াছে, আমি উহাদিগের কর্তৃক বিশেষরূপে প্রতারিত হইয়াছি।

 সেক্রেটারী। তুমি কিরূপে প্রতারিত হইয়াছ, তুমিও কি পাট খরিদ করিতে গমন করিয়াছিলে?

 নবাগত। না মহাশয়, আমি পাট খরিদ করিতে যাই নাই।

 সেক্রেটারী। তবে কি তোমার নিকট হইতে উহারা কাপড় খরিদ করিয়াছিল? নবাগত। না মহাশয়, আমার কাপড়ের দোকান নাই, বা আমার নিকট হইতে উহার কাপড় খরিদ করিয়া আমাকে প্রতারিত করে নাই।

 সেক্রেটারী। তাহা হইলে তুমি কিরূপে প্রতারিত হইয়াছ?  নবাগত। আপনি রাজা সাহেবের বাড়ীর ভিতর নিশ্চয়ই গমন করিয়াছিলেন?

 সেক্রেটারী। অন্দরের ভিতর যাই নাই কিন্তু সদরের সমস্ত স্থানই প্রায় দেখিয়াছি।

 নবাগত। ঐ সকল স্থান কিরূপ সজ্জিত ছিল?

 সেক্রেটারী। উত্তম উত্তম তৈজসপত্র দ্বারা ভালরূপেই সজ্জিত ছিল।

 নবাগত। এই বাড়ীতে যত দ্রব্য দেখিয়াছেন, সমস্তই আমার। আমার নিকট হইতে ঐ সকল দ্রব্য এক মাসের জন্য ভাড়া করিয়া আনিয়া এই বাড়ী সুসজ্জিত করা হয়। ঐ সকল দ্রব্যাদির নিমিত্ত যে ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল, তাহা দেওয়া দূরে থাক, আজ কয় দিবস হইতে তাহাদিগের কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না। আমার বোধ হয়, ঐ সকল দ্রব্যাদির সহিত উহারা এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে।

 সেক্রেটারী। উহারা যে কোথায় গিয়াছে, তাহার কিছু তথ্য কি জানিতে পারিয়াছ?

 নবাগত। না, মহাশয়।

 সেক্রেটারী। তুমি ঐ সকল দ্রব্য কেন দিয়াছিলে?

 নবাগত। আমরা ঐরূপ দিয়া থাকি। ইহাই আমাদিগের ব্যবসা। ইহার কর্মচারীগণ ইহাকে মফস্বলের জনৈক রাজা বলিয়া আমার নিকট পরিচয় প্রদান করে ও কহে, কন্যার বিবাহ উপলক্ষে তিনি কলিকাতায় আগমন করিয়া বাড়ী ভাড়া করিয়াছেন, এক মাসের মধ্যেই বিবাহ শেষ হইয়া যাইবে। বিবাহের পরে আমার দ্রব্যাদি ফিরাইয়া দিবেন ও ভাড়ার টাকা মিটাইয়া দিয়া আপন দেশে গমন করিবেন। উহাদিগের কথায় বিশ্বাস করিয়া আমি দ্রব্যাদি প্রদান করিয়াছিলাম। কিন্তু এখন এইরূপ বিপদে ঠেকিয়াছি।

 সেক্রেটারী। তিনি কোন স্থানের রাজা তাহা আপনাকে বলিয়াছিলেন কি?

 নবাগত। না, কেবল মাত্র এই কথা বলিয়াছিলেন, যে তিনি মফস্বলের রাজা, কিন্তু কোন্ স্থানের তাহা স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই।

 সেক্রেটারী। এই জুয়াচের দলের হস্তে দেখিতেছি আপনিও পড়িয়াছেন এবং উহারা আপনারও সর্বনাশ করিয়াছে। এইরূপ উভয়ের মধ্যে কথাবার্তা হইবার পর, সেই আগন্তুক দোকানদারদ্বয়ের নাম ও ঠিকানা জানিয়া লইয়া এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু নিতান্ত দুঃখিতমনে ও চিন্তিতন্তঃকরণে আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন। বাসায় গিয়া অপরাপর বন্ধু বান্ধবদিগকে এই সকল কথা বলিলেন। যিনি এই সকল কথা শুনিলেন, তিনিই সেক্রেটারী বাবুর দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, এবং অতঃপর কোন উপায় অবলম্বন করিলে অর্থগুলির পুনরুদ্ধার ও অপরাধীগণ দণ্ডিত হইতে পারে, সকলে মিলিয়া সেই বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে ইহাই স্থিরীকৃত হইল যে, পুলিসের সর্ব প্রধান কর্মচারীর সাহায্য গ্রহণ করিতে না পারিলে কিছুই হইতে পারিবে না। এইরূপ পরামর্শ স্থিরীকৃত হইলে কলিকাতার পুলিসের সর্ব প্রধান কর্মচারীর সহিত যে প্রধান লোকের বিশেষরূপ আলাপ পরিচয় আছে, এরূপ কোন একজন গণ্যমান্য লোকের সহায়তায় তিনি পুলিসের সাহায্য প্রাপ্ত হইবার উপায় স্থির করিতে লাগিলেন। এদিকে সমস্ত অবস্থা বর্ণন করিয়া এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু তাঁহার মনিব রাজা মহাশয়কে পত্র লিখিলেন, এবং তাঁহাকে আপাতত কলিকাতায় আসিতে নিষেধ করিলেন।