রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

রাণী না খুনি?[১]

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 একদিবস সন্ধ্যার সময় আমাদিগের সদর আফিস হইতে কাগজপত্র আসিবার পর দেখিলাম, অপরাপর কাগজ-পত্রের সহিত একখানি দরখাস্ত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সেই দরখাস্তের সত্যাসত্যের বিষয় অনুসন্ধান করিবার ভার আমার উপর ন্যস্ত আছে। দরখাস্তখানি আমি আদ্যোপান্ত পাঠ করিলাম। দেখিলাম, বড়বাজারের একজন প্রধান জহরত-ব্যবসায়ী এই দরখাস্ত করিতেছেন। সেই দরখাস্তের মর্ম্ম এইরূপ:—

 “আজ কয়েকদিবস অতীত হইল, কতকগুলি জহরত খরিদ করিবার নিমিত্ত, একজন রাণী আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক একজন লোক ছিল, তিনি জহরতের দালাল, কি রাণীজির লোক, তাহা আমরা অবগত নহি। দালালি করিতে ইতিপূর্ব্বে আমরা কখন তাহাকে দেখি নাই, অথচ রাণীজির সহিত তাহাকে কথা কহিতে শুনিয়াছি। রানীজি একখানি গাড়িতে করিয়া আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি গাড়ি হইতে অবতরণ করেন নাই, বা আমাদিগের সহিত কোনরূপ কথাবার্ত্তাও কহেন নাই। তাঁহার যাহা কিছু বলিবার প্রয়োজন হইয়াছিল, তাঁহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর প্রমুখাৎই তিনি সমস্ত বলিয়াছিলেন। রাণীজি আমাদিগের দোকানে আসিয়া কতকগুলি জহরত খরিদ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এবং কতকগুলি জহরতও দেখিতে চাহেন। সেই সকল জহরতের মধ্য হইতে প্রায় দশ হাজার টাকার মূল্যবান্‌ কয়েকখানি জহরত পসন্দ করিয়া বলিয়া যান, সেই সকল জহরত যেন তাঁহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। সেই স্থানে জহরত লইয়া কোন ব্যক্তি গমন করিলে, তিনি সেই সকল দ্রব্য নগদ মূল্যে গ্রহণ করিবেন, এবং আরও যদি কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হয়, এরূপ মনে করেন, তাহাও তাহাকে বলিয়া দিবেন। এই কথা বলিয়া রাণীজি প্রস্থান করেন; কিন্তু তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক যে লোকটী আগমন করিয়াছিলেন, তিনি আমাদিগের লোককে রাণীজির বাড়ীতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার মানসে সেই স্থানেই অপেক্ষা করেন। আমাদিগের দোকানের অতিশয় বিশ্বাসী রামজীলাল নামক যে একজন বহু পুরাতন কর্ম্মচারী ছিলেন, তিনি সেই জহরত লইয়া কালীবাবুর সহিত একখানি গাড়িতে প্রস্থান করেন। সেই সময় হইতে আর রামজীলাল প্রত্যাবর্ত্তন করেন নাই, বা জহরত কি তাহার মূল্যও এ পর্য্যন্ত পাঠাইয়া দেন নাই। আমরা এ পর্য্যন্ত নানা স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি, তাঁহার দেশে পর্য্যন্ত টেলিগ্রাফ করিয়াছি; কিন্তু কোন স্থান হইতেই তাঁহার কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হই নাই। এখন আমরা বুঝিতে পারিতেছি না যে, রামজীলালের ও তাহার নিকটস্থিত সেই বহমূল্য জহরতগুলির অবস্থা এখন কি হইয়াছে। এই নিমিত্ত এই আবেদন-পত্রের দ্বারা সরকারের সাহায্য গ্রহণ করিতেছি, তাঁহারা অনুসন্ধান করিয়া, যাহাতে রামজীলাল ও জহরতগুলির অনুসন্ধান হয়, তাহার চেষ্টা করুন। বলা বাহুল্য, এই অনুসন্ধান করিতে যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা আমরা প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।”

 এই দরখাস্তের অনুসন্ধানের ভার আমার উপর ন্যস্ত হইলে, আমি কিন্ত সেই রাত্রিতে উহার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম না। পরদিবস হইতে উহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলাম; কিন্তু কালীবাবু ও রামজীলাল সম্বন্ধে নানা প্রকার তর্ক আসিয়া মনে উপস্থিত হইতে লাগিল।

 একবার ভাবিলাম, রামজীলাল নিশ্চয়ই একজন সামান্য বেতনের কর্ম্মচারী হইবেন, দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত তাঁহার হস্তে একবারে পতিত হইয়াছে, এ লোভ সম্বরণ করা তাঁহার পক্ষে কতদূর সম্ভব? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, রামজীলাল যে ধনীর কার্য্য করিয়া থাকেন, তিনি নিজেই বলিতেছেন যে, রামজীলাল একজন বহু পুরাতন ও অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী। যদি তাঁহার কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে অনেক সময় তাঁহার হস্তে যে অনেক অর্থ আসিয়া পড়ে, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় এই সকল জহরত বা তাহার মূল্য গ্রহণ করিয়া পলায়ন করা রামজীলালের পক্ষে কতদূর সম্ভব, তাহা স্থির করিয়া উঠা নিতান্ত নহজ নহে।

 দ্বিতীয়তঃ, যে রাণীজি জহরত খরিদ করিতে আগমন করিয়াছিলেন, তিনিই বা কে? এবং তাঁহার সমভিব্যাহারে কালীবাবু নামক যে বাক্তি আগমন করিয়াছিলেন, তিনিই বা কে? রাণীজি যদি প্রকৃতই রাণীজি হইবেন, তাহা হইলে তিনি নিজে বাজারে জহরত খরিদ করিতেই বা আসিবেন কেন? বাড়ীতে বসিয়া সংবাদ পাঠাইলেই ত অনেক বড় বড় জহুরী তাঁহার নিকট জহরত লইয়া যাইত। আর যদি তিনি নিজেই জহরত খরিদ করিবার মানসে বাজারে আসিলেন, তাহা হইলে কেবলমাত্র এক কালীবাবু ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি তাঁহার সহিত আগমন করিল না কেন? আর কালীবাবু তাঁহার নিজের লোক, কি বাজারের দালাল, তাহারই বা ঠিকানা কি? কালীবাবু যদি তাঁহার নিজের লোকই হইবেন, তাহা হইলে তাঁহাকে দোকানে পরিত্যাগ করিয়া তিনি কেবলমাত্র সহিস-কোচবানের সঙ্গেই বা গমন করিলেন কিরূপে? আর যদি কালীবাবু বাজারের দালালই হইবেন, তাহা হইলে রাণীজি তাহার সহিত বাজারে আসিতে কিরূপে সাহসী হইলেন? এরূপ অবস্থার ইহার ভিতরের কথা অনুমান করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। তবে রাণীজি যদি কোন রাজবংশীয়া দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক হন, তাহা হইলে এইরূপ ভাবে অনায়াসেই তিনি বাজারে আসিতে সমর্থ হইবেন; কিন্তু প্রকৃত রাণী এরূপ ভাবে বাজারে আসিতে কখনই সাহসী হইতে পারেন না। আরও এক কথা, রামজীলীল যদি প্রকৃতই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া প্রস্থান করিয়া থাকেন, এবং কালীবাবু যদি তাঁহার সহিত এই অসৎকার্য্যে মিলিত না থাকেন, অথচ কালীবাবু যদি প্রকৃতই একজন দালাল হন, তাহা হইলে দালালী লইবার প্রত্যাশায় কালীবাবু সেই জহরতের দোকানে এ পর্য্যন্ত আর প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন না কেন? আবার মনে হইল, আজকাল রাজা বা রাণী সাজিয়া যে সকল ভয়ানক ভয়ানক জুয়াচুরি হইয়া থাকে, ইহা সেই প্রকারের কোন একরূপ জুয়াচুরি নয় ত? যদি তাহাই হয়, যদি সেইরূপ ভাবে কোনরূপ জুয়াচুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে রামজীলাল কোথায় গমন করিল? ইহার অনুসন্ধানের ভিতর বড়ই গোলযোগ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে; এক কথা ভাবিতে গেলে, অপর আর একটা কথা মনে আসিয়া সমস্ত চিন্তাকেই সন্দেহে পরিণত করিয়া দিতেছে। এ সম্বন্ধে আর কোন কথা ভাবিব না, কল্য প্রাতঃকাল হইতে ইহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। অনুসন্ধানে যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিব, তখন তাহার উপর নির্ভর করিয়া সবিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া দেখিব, এই অনুসন্ধান আমার দ্বারা সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে পারে কি না। বদি কৃতকার্য্য হইব মনে করি, তাহা হইলে ইহাতে সম্পূর্ণরূপে হস্তক্ষেপ করিব। নতুবা উর্দ্ধতন কর্ম্মচারীগণকে বলিয়া, এই অনুসন্ধানের ভার অপরের হস্তে প্রদান করিব। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোন বিষয় চিন্তা করিব না, ইহা স্থির করিলাম; কিন্তু কার্য্যে তাহা পরিণত করিতে পারিলাম না।


  1. কালীবাবুর সংক্ষিপ্ত জীবনী, এবং রাণীজির আমূল বৃত্তান্ত যদি কেহ অবগত হইতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তিনি শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত ডিটেক্‌টিভ-পুলিস ৫ম কাণ্ড “পাহাড়ে মেয়ে” নামক পুস্তক পাঠ করিলে, সমস্ত বিষয় বিশদ্‌রূপে অবগত হইতে পারিবেন।
    দাঃ দঃ প্রঃ।