রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুন্ধান করিলাম না। পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া যে বাড়ী রাণীজি ভাড়া করিয়াছিলেন, সেই বাড়ীর উদ্দেশে গমন করিলাম। দিবাভাগে সেই বাড়ীটী আর একবার দেখিয়া লইলাম, দরজার উপর যে কাগজ লাগান ছিল, তাহা হইতে বাড়ীর অধিকারীর নাম এবং তাঁহার ঠিকানা লিখিয়া লইলাম। সেই বাড়ীর সন্নিকটে যে একটী মুদীর দোকান ছিল, সেই মুদী এই বাড়ী সম্বন্ধে কোন কথা অবগত আছে কি না, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার নিকটেও একবার গমন করিলাম, এবং তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই বাড়ীটী কি ভাড়া দেওয়া যাইবে?”

 মুদী। এই বাড়ীতে প্রায়ই ভাড়াটিয়া থাকে, যদি উহা খালি থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহা ভাড়া দেওয়া হইবে।

 আমি। সেই বাড়ী এখন খালি আছে, কি অপর কোন ব্যক্তি উহা গ্রহণ করিয়াছে, তাহা আপনি অবগত আছেন কি?

 মুদী। আমার বোধ হয়, এই বাড়ী খালি নাই, উহা ভাড়া হইয়া গিয়াছে।

 আমি। আপনি জানেন, কে উহা ভাড়া লইয়াছে?

 মুদী। তাহা আমি জানি না।

 আমি। তবে আপনি কিরূপে জানিলেন যে, সেই বাড়ী ভাড়া হইয়া গিয়াছে?

 মুদী। আজ কয়েকদিবস হইল, আমি এই বাড়ীর দরজা খোলা দেখিতে পাই। আরও দেখিতে পাই, সেই দরজার সম্মুখে একখানি জুড়িগাড়ি ও একথানি কম্পাস গাড়ি দাঁড়াইয়াছিল। তাহাতেই আমি অনুমান করিতেছি, কোন বড়লোক এই বাড়ী ভাড়া লইয়া থাকিবে।

 আমি। আমি এই বাড়ীর সম্মুখে গিয়াছিলাম, দেখিলাম, উহার দরজায় লেখা আছে, “এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে” এবং সদর দরজা তালা দ্বারা বন্ধ করাও আছে।

 মুদী। তাহা হইলে বোধ হয়, এই বাড়ী এখনও খালি আছে।

 আমি। আপনি জানেন, এই বাড়ীর ভাড়া কত?

 মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি অবগত নহি।

 আমি। এই বাড়ীর চাবি কাহার নিকট থাকে, তাহা আপনি বলিতে পারেন কি?

 মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি জানি না। দরজায় ষে কাগজ মারা আছে, তাহাতে লেখা নাই?

 আমি। যে স্থানে এই বাড়ী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে হইবে, তাহা লেখা আছে; কিন্তু কোন্‌ স্থানে এই বাড়ীর চাবি আছে, তাহা লেখা নাই। তাহাই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম।

 মুদী। তাহা হইলে মালিকের বাটীতে গমন করিলেই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন, এবং বাড়ীর চাবিও পাইবেন।

 আমি। সেই ভাল, তাহা হইলে আমি সেই স্থানেই গমন করি।

 এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া সেই বাটীর মালিকের উদ্দেশে চলিলাম। বাটীর দরজার উপর যে ঠিকানা লেখা ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া একটু অনুসন্ধান করাতেই সেই বাটীর মালিকের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি তাঁহার বাটী হইতে বাহিরে আসিয়াই আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি নিমিত্ত আমার অনুসন্ধান করিতেছেন?”

 আমি। আপনার যে একখানি বাটী খালি আছে, তাহা আপনি ভাড়া দিবেন কি?

 মালিক। হাঁ, আমার বাটী খালি আছে, এবং উহা ভাড়াও দেওয়া যাইবে; কিন্তু আজকাল নহে। দিনকতক পরে আসিলেই সেই বাটী আপনি পাইতে পারিবেন।

 আমি। আপনার সেই বাটীর ভাড়া কত?

 মালিক। পঞ্চাশ টাকা।

 আমি। এখন সেই বাটী ভাড়া দিতে আপনার সবিশেষ কোনরূপ প্রতিবন্ধক আছে কি?

 মালিক। না থাকিলে আর আমি আপনাকে বলিব কেন?

 আমি। কি প্রতিবন্ধক আছে, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

 মালিক। অপর কোনরূপ প্রতিবন্ধক নাই। আজ কয়েক দিবস হইল, একটী বাবু একমাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়া একমাসের নিমিত্ত সেই বাটী ভাড়া লন, এবং আমার নিকট হইতে সেই বাটীর চাবি লইয়া যান। যখন তিনি সেই বাটী ভাড়া লন, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, পশ্চিমদেশ হইতে একজন রাণী কলিকাতা দেখিবার নিমিত্ত আগমন করিবেন, এবং তিনিই সেই বাড়ীতে দশ বারদিন থাকিবেন মাত্র। সেই বাবুটী আমাকে এই কথা বলিয়া আমার বাড়ী ভাড়া লন, এবং বাড়ীর চাবি লইয়া যান। দুই তিনদিবস পরেই সেই বাড়ীর চাবি তিনি আমাকে ফিরাইয়া দিয়া যান, ও বলিয়া যান যে, রাণীজির বোধ হয়, এখন আসা হইল না। তবে যদি ইহার মধ্যে তিনি আইসেন, তাহা হইলে আমি আসিয়া পুনরায় চাবি লইয়া যাইব। একমাসের মধ্যে যদি তিনি আসেন, তাহা হইলে সেই বাড়ী আপনি অপরকে একমাস পরে অনায়াসেই ভাড়া দিতে পারেন। এখন বলুন দেখি মহাশয়! একমাসের মধ্যে আমি সেই বাড়ী অপরকে কিরূপে ভাড়া দিতে পারি? প্রকৃত প্রস্তাবে বলিতে হইলে, সেই বাড়ী আমার হইলেও একমাসের মধ্যে উহাতে হস্তক্ষেপ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।

 আমি। একমাস পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আপনার বোধ হয়, আর কোনরূপ আপত্তি হুইবে না।

 মালিক। কিছু না। একমাস কেন, একমাসের প্রায় অর্দ্ধেক গত হইয়া গেল, যে কয়দিবস বাকী আছে, তাহার পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আর কোনরূপ আপত্তি নাই।

 আমি। এই কয়দিবসের মধ্যে আপনি বাড়ী ভাড়া না দিন; কিন্তু উহা একটীবার দেখিতে বোধ হয়, আপনার কোনরূপ আপত্তি নাই?

 মালিক। তাহাতে আর আপত্তি কি? আপনার যখন ইচ্ছা হয়, তখনই আপনি গিয়া আমার বাড়ী দেখিতে পারেন।

 আমি। আপনার যদি কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে এখনই গিয়া আমি আপনার বাড়ী দেখিয়া আসিতে পারি।

বাটী দেখিয়া যদি আমার মনোমত হয়, তাহা হইলে সেই বাটী ভাড়া লইয়া কথাবার্ত্তা শেষও হইয়া যাইতে পারে।

 মালিক। আপনাকে বাটী দেখাইতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই; কিন্তু আপনার সহিত গমন করিতে পারে, এরূপ কোন লোক এখন এ স্থানে উপস্থিত নাই। আমারও কোন একটী সবিশেষ প্রয়োজনে এখনই বাহির হইয়া যাইতেছি; সুতরাং আমিও এখন আপনার সহিত গমন করিতে পারিতেছি না। আপনি অনুগ্রহ-পুর্ব্বক অপর কোন সময়ে আগমন করিবেন, সেই সময় হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, না হয়, অপর কোন লোককে আপনার সঙ্গে পাঠাইয়া দিব। আমি এখনই সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতাম; কিন্তু মহাশয়! মার্জ্জনা করিবেন, আপনি আমার নিকট একবারে অপরিচিত বলিয়া, সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতে পারিলাম না। কলিকাতা সহর, অনেক দেখিয়া শুনিয়া চলিতে হয়।

 আমি। আচ্ছা মহাশয়! তাহাই হইবে। অপর আর এক সময় আসিয়া আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এবং সেই সময় চাবি লইয়া গিয়া আপনার বাটী দেখিয়া লইব।

 মালিক। তাহা হইলে আমি এ্রখন আমার কার্য্যে গমন করিতে পারি?

 আমি। আর একটী কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

 মালিক। আর কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?

 আমি। যে বাবুটী আপনার নিকট হইতে একমাসের জন্য বাটী ভাড়া লইয়াছিল, তাহাকে আপনি চিনেন কি?

 মালিক। তিনি আমার নিকট পরিচিত নহেন।

 আমি। তিনি কোথায় থাকেন, তাহা আপনি বলিতে পারেন?

 মালিক। না।

 আমি। আমি যদি অনুসন্ধান করিয়া তাঁহাকে আপনার নিকট আনিতে পারি, এবং এখন হইতে আমাকে সেই বাটী ভাড়া দিতে যদি তাঁহার কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে সেই বাটী আপনি আমাকে ভাড়া দিতে পারিবেন কি?

 মালিক। তাহা পারিব না কেন, তাঁহার কোনরূপ আপত্তি না থাকিলেই হইল।

 সেই বাটীর মালিকের সহিত এইরূপ কথাবার্ত্তা হইবার পর, অপর আর কোন সময়ে পুনরায় তাঁহার নিকট আগমন করিব, এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম; তিনিও আপন কার্য্যে গমন করিলেন।

প্রথম অংশ সম্পূর্ণ


পৌষ মাসের সংখ্যা,

“রাণী না খুনি?”

(শেষ অংশ)

(অর্থাৎ অপরিচিত ব্যক্তিকে বিশ্বাস

করিবার চূড়ান্ত ফল!)

যন্ত্রস্থ।