বিষয়বস্তুতে চলুন

রাণী না খুনি? (শেষ অংশ)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 যাঁহার নিকট হইতে কালীবাবু বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন, তাঁহাকে সেই বাড়ীতে আনিবার নিমিত্ত আমি পুর্ব্ব হইতেই বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্যকে একখানি গাড়িতে করিয়া লইয়া, যখন আমি সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন আমার বেশ অনুমান হইল যে, উভয়েরই হিতাহিত জ্ঞান যেন তিরোহিত হইয়াছে, এবং উহারা আমাকে কি বলিবার নিমিত্ত যেন প্রস্তুত হইতেছে। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাহারা তাহাদিগের মনের ভাব কতক পরিমাণে পরিবর্ত্তিত করিয়া লইল; যাহা বলিতে যাইতেছিল, তাহা আর বলিল না।

 আমাদিগের সেই স্থানে উপস্থিত হইবার একটু পরেই আর একখানি গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। উহার মধ্য হইতে দুইজন আরোহী বহির্গত হইলেন। একজন আমারই অধীনস্থ কর্ম্মচারী; অপর বাক্তি সেই বাড়ীর অধিকারী। তিনি কালীবাবুকে দেখিয়াই কহিলেন, “এই বাবুটীই একমাসের নিমিত্ত আমার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন।” কালীবাবুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “কেমন মহাশয়! এখন আমি এই বাড়ী অপর আর কাহাকেও ভাড়া দিতে পারি?”

 কালীবাবু তাঁহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া নিতান্ত স্থিরভাবে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল।

 বাড়ীর অধিকারী চাবি হস্তে সেই বাড়ীর দরজা খুলিতে গিয়া দেখেন, সেই বাড়ীর সম্মুখে দ্বারবানবেশে একটা লোক বসিয়া রহিয়াছে। তাহাকে দেখিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে? আমার বাড়ীর দরজায় রসিয়া রহিয়াছ?” সেই ব্যক্তি তাঁহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, আমার ইঙ্গিত অনুসারে সেই স্থান হইতে উঠিয়া একটু দূরে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। বলা বাহুল্য, সেই ব্যক্তিও আমাদিগের একজন কর্ম্মচারী। আমাদিগের অবর্ত্তমানে কেহ সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না পারে, এই নিমিত্তই তাঁহাকে সেই স্থানে পূর্ব্ব হইতেই রাখা হইয়াছিল।

 বাড়ীর অধিকারী সেই বাড়ীর চাবি খুলিয়া দিলেন। আমরা সকলেই সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।

 আমরা সকলে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমতঃ উপরের, এবং পরিশেষে নীচের সমস্ত ঘরগুলি উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, সমস্ত ঘরগুলিই খালি, কোন ঘরে কিছুই নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সকলেই সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার উদ্যোগ করিতেছেন, এরূপ সময়ে নিম্নের একখানি ঘরের দিকে আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। বলা বাহুল্য, সেই ঘরের ভিতর আমরা পূর্ব্বেই গমন করিয়াছিলাম। আমি পুনরায় সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহের মেঝের প্রস্তরের একস্থানে কতকগুলি মক্ষিকা ঘন ঘন বসিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই বাড়ীর অপরাপর গৃহগুলি পুনরায় সবিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম; কিন্ত আর কোন স্থানে মক্ষিকা বসিতে দেখিতে পাইলাম না। সেই বাড়ীটা নূতন প্রস্তত হইয়াছিল, উহাতে যে সকল নর্দ্দমা বা ময়লা জল প্রভৃতি ফেলিবার স্থান আছে, সেই সকল স্থানও উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু আর কোন স্থানেই মক্ষিকা প্রভৃতি বসিতে দেখিতে পাইলাম না। তখন স্বভাবতই আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। আমি আমার মনের ভাব অপরাপর কর্ম্মচারীগণকেও কহিলাম। সকলেই আমার মতে মত দিয়া কহিলেন, ‘এই স্থানটী একবার ভাল করিয়া দেখিবার প্রয়োজন হইয়াছে।’ সুতরাং সেই স্থানের প্রস্তর কয়েকখানি একবারে উঠাইয়া ফেলিবার প্রয়োজন হইল।

 সেই বাড়ীর অধিকারী মহাশয়কে সেই কথা বলাতে তিনি প্রথমতঃ আমাদিগের প্রস্তাবে অসম্মত হইয়া গৃহের প্রস্তরগুলি উঠাইয়া ফেলিতে নানারূপ আপত্তি করিতে লাগিলেন; কিন্ত আমরা কেহই তাঁহার আপত্তিতে কর্ণপাত না করিয়া কোদালি ও সাবল প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সেই সকল দ্রব্য সংগ্রহ করিতেও আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট হইল না। সেই বাড়ীর একটী গৃহের ভিতর কতকগুলি চুন, সুরকি, বালী এবং সাবল, কোদালি প্রভৃতি রাখা ছিল। সেই স্থান হইতে সাবল ও কোদালি প্রভৃতি আনাইয়া, সেই স্থানের প্রস্তর উঠাইয়া ফেলা হইল। উঠাইবার সময় বেশ অনুমান হইল, উহা যেন একটু আল্‌গা ভাবে বসান রহিয়াছে, এবং যেন নূতন বসান বলিয়া বোধ হইল। সেই স্থানের দুই তিনখানি প্রস্তর উঠাইতে উঠাইতে সেই স্থান হইতে প্রথমে অল্প, এবং পরিশেষে অধিক পরিমাণে দুর্গন্ধ বাহির হইতে আরম্ভ হইল। যখন সেই স্থান হইতে ক্রমে পচাগন্ধ বাহির হইতে লাগিল, সেই সময় আমাদিগের মনে নানারপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। সেই সময় আমরা সকলে মিলিয়া শীঘ্র শীঘ্র সেই স্থানের মাটী ক্রমে উঠাইয়া ফেলিতে লাগিলাম। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে আমাদিগের সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হইল না; মাটী যতই উঠাইতে লাগিলাম, ততই যেন উহা আল্‌গা বোধ হইতে লাগিল।

 কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য আমাদিগের সহিত সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে দেখিয়া তাহাদিগের বাক্যালাপ বন্ধ হইল, মুখ কালিমা বর্ণ ধারণ করিল, চক্ষু যেন ঈষৎ রক্তিমবর্ণ ধারণ করিতে লাগিল। সেই স্থানে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া, আর তাহারা দাঁড়াইতে পারিল না; নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।

 সেই স্থান হইতে অধিকাংশ মাটী এইরূপে উঠাইতে উঠাইতে ক্রমে একটা গলিত মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়িল। সেই মৃতদেহ দেখিয়া স্পষ্টই অনুমান হইতে লাগিল, উহা কোন পুরুষের মৃতদেহ। কিন্তু উহা এতদূর বিকৃত ভাব ধারণ করিয়াছিল যে, উহা কাহার দেহ, তাহা চিনিতে পারা গেল না; কিন্ত আমরা সকলেই অনুমান করিয়া লইলাম, সেই দেহ রামজীলালের দেহ ভিন্ন আর কাহারও দেহ নহে।

 মৃত্তিকাগর্ভ হইতে সেই মৃতদেহটী আমরা সবিশেষ সতর্কতার সহিত উঠাইলাম; দেহ হইতে গলিত মাংস স্খলিত হইতে দিলাম না। সেই দেহ গলিত অবস্থা ধারণ করিয়াছিল সত্য; কিন্তু তাহার পরিধানে যে সকল বস্ত্রাদি ছিল, তাহার একখানিও কোনরূপে নষ্ট হইয়াছিল না।

 সেই স্থান হইতে মৃতদেহ বাহির করিবার পর, কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের অবস্থা যে কিরূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহার যথাযথ বর্ণনার ক্ষমতা আমার নাই। উহাদিগকে দেখিয়া, সেই সময় সহজে অনুমান করা কঠিন হইল যে, উহারা জীবিত কি মৃত। দশ বিশ ডাকের কম উহাদিগের মুখ হইতে প্রায়ই বাক্য উচ্চারিত হইল না, সহজে কোন কথার উত্তর আর একবারেই পাইলাম না। আমাদিগের প্রশ্নের উত্তরে কেবল উহারা বলিতে লাগিল যে, আমরা ইহার কিছুই অবগত নহি। সেই সময়ে আমাদিগের মধ্যে কোন কোন কর্ম্মচারী ত্রৈলোক্যকেই রাণীজি বলিয়া সম্বোধন করিতে লাগিল; কিন্ত ত্রৈলোক্য সেই সকল কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।

 সেই মৃতদেহ বাহির করিবার পরই একজন কর্ম্মচারীকে বড়বাজারে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রামজীলালের মনিব এবং তাঁহার দোকানের আর কয়েকজন কর্ম্মচারীর সঙ্গে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহারা রামজীলালের দেহ বলিয়া কোনরূপেই চিনিতে পারিলেন না; কিন্তু তাঁহার পরিহিত বস্ত্রাদি দেখিয়া তাঁহাদিগের আর চিনিতে বাকী থাকিল না। সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, ‘এই মৃতদেহ রামজীলালের।’

 যখন সেই মৃতদেহ রামজীলালের বলিয়া স্থিরীকৃত হইল, তখন যেরূপ ভাবে আমরা এ পর্য্যন্ত কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে রাখিয়াছিলাম, এখন আর তাহাদিগকে সেইরূপে রাখিলাম না। এখন তাহারা খুনী মোকদ্দমার আসামীরূপে পরিগণিত হইল। এখন উভয়কেই আমরা বন্ধনাবস্থায় রাখিলাম, এবং উভয়কে পৃথক্‌ পৃথক্‌ স্থানে রাখিয়া পৃথক্‌ পৃথক্‌রূপে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্ত ত্রৈলোক্যের নিকট হইতে কোন কথা প্রাপ্ত হইলাম না। যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারই উত্তরে সে কহিল, “আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।”