রাণী না খুনি? (শেষ অংশ)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 কালীবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কালীবাবু! তুমি পূর্ব্ব হইতে এ সম্বন্ধে এত মিথ্যা কথা বলিয়া আসিতেছ কেন?”

 কালী। কেন মহাশয়! আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম?

 আমি। আবার বলিতেছ, “আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম?” যে ব্যক্তি জহরত খরিদ করিয়াছেন, তিনি পূর্ব্বে বঙ্গদেশীয় একজন জমিদার-পুত্ত্র ছিলেন; কিন্তু এখন দেখিতে দেখিতে তিনি একজন পশ্চিমদেশীয় জমিদার হইয়া পড়িলেন?

 কালী। উনি বাঙ্গালি কি পশ্চিমদেশীয় লোক, তাহা আমি সেই সময় ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।

 আমি। ভাল, ইহাই যেন বুঝিতে না পারিয়াছিলে; কিন্ত যাহার বাড়ী তুমি পূর্ব্বে জানিতে না, এখন তাহার বাড়ী তুমি কিরূপে আমাকে দেখাইয়া দিতে সমর্থ হইলে?

 কালী। তাহার বাড়ী আমি চিনি না, একথা যদি পূর্ব্বে আমি আপনাকে বলিয়া থাকি, তাহাও ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।

 আমি। ইহাও যদি তুমি ভুল-ক্রমে বলিয়া থাক, তাহা হইলে তুমি পূর্ব্বে কিরূপে বলিয়াছিলে যে, জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয় রামজীলালের নিকট হইতে ত্রৈলোক্যের ঘরে বসিয়া খরিদ করেন, অথচ এখন দেখিতেছি, তুমি তাঁহার বাড়ীতে গিয়া তাঁহার নিকট সেই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া আসিয়াছ? ইহার কোন্‌ কথা প্রকৃত?

 কালী। ইহার উভয় কথাই প্রকৃত। আমি পূর্ব্বেও বলিয়াছিলাম, এখনও বলিতেছি যে, আমার কথা সমস্তই প্রকৃত। ইহার মধ্যে একটীও মিথ্যা কথা নাই। আমি জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া বিক্রয় করিয়া আসি সত্য; কিন্ত টাকাগুলি ত্রৈলোক্যের এই গৃহে বসিয়া আমি রামজীলালের হস্তে প্রদান করি। তিনি উহা উত্তমরূপে গণিয়া-গাথিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া যান।

 আমি। একথা ত ঠিক নহে, তুমি প্রথমে বলিয়াছিলে, জমিদার-পুত্ত্র ত্রৈলোক্যের গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত খরিদ করেন, এবং সেই স্থানেই তিনি তাহার মূল্য রামজীলালের হস্তে প্রদান করেন।

 কালী। এরূপ কথা বলিয়াছি বলিয়া ত এখন আমার স্মরণ হইতেছে না।

 আমি। তাহা হইলে আমাদিগের শুনিবারই ভুল হইয়া থাকিবে। সে যাহা হউক, রাণীজির কথাটা কি?

 কালী। রাণীজি আবার কে?

 আমি। যে রাণীজি জুড়িগাড়ি করিয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন?

 কালী। আমার জানিত কোন রানীজি জুড়িগাড়ি করিয়া বড়বাজারে গমন করেন নাই। জমিদার মহাশয় গিয়াছিলেন, সে কথা ত আমি পূর্ব্বেই আপনাদিগকে বলিয়াছি।

 আমি। জমিদার মহাশয় বলেন, তিনি জহরত খরিদ করিবার নিমিত্ত বড়বাজারে একবারেই গমন করেন নাই। ইহাতে বোধ হইতেছে, জমিদার মহাশয় মিথ্যা কথা কহিতেছেন?

 কালী। তিনি মিথ্যা কথা বলিতেছেন, একথা আমি বলিতে পারি না; তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন। বড় মানুষের সকল সময় সকল কথা মনে থাকে না।

 আমি। জমিদার মহাশয় যে জুড়িতে করিয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, সেই জুড়ি তুমি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলে কেন?

 কালী। আমি জুড়িগাড়ি ভাড়া করিয়া আনিব কেন?

 আমি। কেবল জুড়িগাড়ি নহে, একখানি কম্পাস গাড়িও যে তুমি ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলে?

 কালী। মিথ্যা কথা।

 আমি। মিথ্যা কি সত্য, তাহা পরে জানিতে পারিবে। যে বাড়ীটী তুমি একমাসের নিমিত্ত ভাড়া করিয়াছিলে, তাহাতে কোন রাণীজি আসিয়া বাস করিয়াছিল?

 কালী। আমি বাড়ী ভাড়া করির কেন?

 আমি। কেন বাড়ী ভাড়া করিবে, তাহা তুমিই জান। তোমার বাড়ী ভাড়া করিবার কারণ আমি জানি না বলিয়াই আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।

 কালী। আপনারা এ সকল নূতন মিথ্যা কথা কোথা হইতে বাহির করিলেন? মহাশয়! আমি আপনাকে একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি; আপনি আমার কথায় রাগ করিবেন না। আপনাদিগের তদারকের গতিই কি এইরূপ? কাজের কথার দিকে আপনারা একবারের নিমিত্ত দৃষ্টিপাত না করিয়া, কেবল বাজে বিষয় অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছেন। কোথায় আপনারা ফেরারী আসামীর অনুসন্ধান করিবেন, তাহা না করিয়া কেবল কতক বাজে বিষয় লইয়া মিথ্যা মিথ্যা ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। এরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিলে, এতক্ষণ ত আসামী ধরা পড়িল!

 আমি। আমার কথায় তুমি রাগ করিও না। এই কার্য্যে যে আমি নূতন ব্রতী, তাহা বোধ হয়, তুমি অবগত আছ। সেই কারণেই সকল কথা সহজে আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না বলিয়াই, ইহার ব্যাপার উত্তমরূপে জানিয়া লইবার নিমিত্তই তোমাকে এতগুলি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং আরও দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছাও আছে। এই সকল বিষয় প্রথমতঃ আমি ভালরূপ অবগত হইয়া, তাহার পর, আসামীর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, ইহা আমার সম্পূর্ণরূপ ইচ্ছা। এতগুলি টাকা লইয়া রামজীলাল যে এখনও কলিকাতায় আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। আমার বিশ্বাস, সে তাহার নিজের দেশে প্রস্থান করিয়াছে। সে যাহা হউক, আমিও তাহাকে অল্পে ছাড়িতেছি না। তাহার নিমিত্ত যদি তাহার দেশে পর্য্যন্তও আমাকে গমন করিতে হয়, তাহাতেও আমি প্রস্তুত আছি।

 আমার এই কথা শুনিয়া কালীবাবু মুখে অতিশয় সন্তোষের ভাব প্রকাশ করিয়া আমাকে কহিলেন, “আপনার যদি আর কোন কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন থাকে, তাহা একটু শীঘ্র জিজ্ঞাসা করিয়া লউন। কারণ, কোন কার্য্যান্তরে এখনই গমন করিবার আমার সবিশেষ প্রয়োজন আছে।”

 কালীবাবু আমাকে এই কথাগুলি বলিল সত্য; কিন্তু সেই সময় তাহার অবস্থা এরূপ পরিবর্ত্তিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইতে লাগিল যে, যেন সে কোনমতেই আমার সম্মুখে দাঁড়াইতে আর সমর্থ হইতেছে না।

 আমি। তোমাকে আমি এখন কেবলমাত্র একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।

 কালী। কি?

 আমি। যে পশ্চিমদেশীয় জমিদার তোমার নিকট হইতে জহরত গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহার সমভিব্যাহারে তুমি আর কোন বাড়ীতে গমন করিয়াছিলে কি?

 কালী। গিয়াছিলাম বৈকি। ত্রৈলোক্যের গৃহে তাঁহাকে কয়েকবার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম। ত্রৈলোক্য ত আপনার সম্মুখেই বসিয়া আছে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন না কেন; তাহা হইলেই ত জানিতে পারিবেন, আমার কথা সত্য কি না।

 আমি। ত্রৈলোক্যকে আমি আর কি জিজ্ঞাসা করিব? তুমি যাহা বলিতেছ, সেও তাহাই বলিবে। তুমি যদি সেই জমিদারকে অপর কোন বাড়ীতে লইয়া না গিয়া থাক, তাহা হইলে আর এক খানি বাড়ী কাহার নিমিত্ত এবং কিসের জন্য় ভাড়া করিয়াছিলে?

 আমার এই কথা শুনিবামাত্রই ত্রৈলোক্যের যেন হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। সে একবার আমার মুখের দিকে তাকাইয়া কালীবাবুর মুখের দিকে তাকাইতে লাগিল। দেখিলাম, ত্রৈলোক্যের সঙ্গে সঙ্গে কালীবাবুরও মুখ শুখাইয়া উঠিয়াছে। আরও তাহার মুখ দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, সে তাহার মনের ভাব গোপন করিতে বিধিমতে চেষ্টা করিতেছে; কিন্তু কোনরূপেই যেন কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছে না।

 আমার কথা শুনিয়া কালীবাবু যেন একটু রাগ ভাব প্রকাশ করিল ও কহিল, “কি মহাশয়! আপনি আমার সহিত ঠাট্টা করিতেছেন, না বসিয়া বসিয়া স্বপ্ন দেখিতেছেন?”

 আমি। একরূপ স্বপ্নই বটে; নূতন বাড়ী ভাড়া করার নাম শুনিয়া তোমরা একবারেই চমকাইয়া উঠিলে যে! কোন রাণীজি আসিয়া একমাসকাল বাস করিবেন বলিয়া, একমাসের জন্য কোন বাড়ী তুমি ভাড়া কর নাই?

 কালী। না।

 আমি। আমি যদি সেই বাড়ী তোমাদিগকে দেখাইয়া দিতে পারি?

 কালী। যখন আমি বাড়ী ভাড়া করি নাই, তখন আপনি আমাকে কিরূপে দেখাইয়া দিবেন? আর অপর কোন বাক্তির নিমিত্ত যদি একখানি বাড়ী ভাড়াই করিতাম, তাহা হইলেই বা কি ক্ষতি হইত? অপরের নিমিত্ত আমি বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলাম, কি না করিয়াছিলাম, তাহার সহিত এ মোকদ্দমার কি সংস্রব আছে, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 আমি। এই মোকদ্দমার সহিত বাড়ী ভাড়ার কোনরূপ সংস্রব থাকুক, আর না থাকুক, তুমি অপর কোন বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলে কি না, তাহাই আমি জানিতে চাই।

 কালী। না।

 আমি। তাহা হইলে তুমি ও ত্রৈলোক্য, তোমরা উভয়েই আমার সহিত আগমন কর। তুমি আমাকে দেখাইয়া দেও, আর না দেও, আমি সেই বাড়ী তোমাদিগকে দেখাইয়া দিতেছি।

 কালী। আমার একটী সবিশেষ প্রয়োজন আছে, এখন আমি আপনার সহিত গমন করিতে পারিব না।

 আমি। আমার সহিত যাইতেই হইবে। সহজে তুমি আমার সহিত না যাও, অসহজে যাইবে।

 এই বলিয়া আমি কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। তাহারা উভয়েই আমার সহিত গমন করিতে অস্বীকৃত হইয়াছিল; কিন্তু আমি তাহা না শুনিয়া একরূপ বলপ্রয়োগ করিয়াই তাহাদিগকে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমার সমভিব্যাহারী কেবল একজন কর্ম্মচারী সেই স্থানে রহিলেন মাত্র।