রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
কলিকাতার তদানীন্তন অবস্থা ও ইহার প্রধান ব্যক্তিগণ।
১৮২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে লাহিড়ী মহাশয় কলিকাতার দক্ষিণ উপনগরবর্ত্তী কালীঘাটের সন্নিকটস্থ চেতলা নামক স্থানে নিজ জ্যেষ্ঠের বাসাতে আসিলেন। জ্যেষ্ঠ কেশবচন্দ্র ভ্রাতার শিক্ষার কিরূপ বন্দোবস্ত করেন, এই চিন্তাতে উদ্বিগ্ন হইতে লাগিলেন। তখন চেতলার সন্নিকটে ইংরাজী স্কুল ছিল না। কেশবচন্দ্র ভ্রাতাকে উত্তমরূপ ইংরাজী শিক্ষা দিবার সংকল্প করিয়াছিলেন, তাহা করিতে হইলে তাহাকে কলিকাতাতে রাখা চাই, কিন্তু এই সুকুমার বয়সে সহোদরকে কোথায় রাখেন, কে বা তাহাকে ইংরাজী স্কুলে প্রবিষ্ট করিয়া দেয়, কিসেই বা তাহার থাকিবার ও শিক্ষার ব্যয়াদি নিৰ্ব্বাহ হয়, এই সকল ভাবিয়া দারুণ দুশ্চিন্তায় কালযাপন করিতে লাগিলেন।
কিন্তু এই সময়ে তিনি একটী কাজ করিয়াছিলেন, যাহার ইষ্টফল লাহিড়ী মহাশয়ের পরজীবনে দেখা গিয়াছিল। এরূপ অনুমান করা যায় কলিকাতাতে আসিবার পূর্ব্বেই তৎকালপ্রচলিত রীতি অনুসারে রামতনু কিছুদিন পারস্য ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন, এবং স্বল্পরূপ ইংরাজী পড়িতে ও লিখিতে শিখিয়া আসিয়াছিলেন। কেশবচন্দ্র প্রাতে ও সন্ধ্যাতে শিক্ষকের ভার গ্রহণ করিয়া কনিষ্ঠের এই দুই বিষয়ের উন্নতিসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি নিজে পারসী ও আরবীতে পারদর্শী ছিলেন; সুতরাং সে বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করিতে লাগিলেন। দ্বিতীয়তঃ খাতা বাঁধিয়া দিয়া ভ্রাতাকে মনোযোগ সহকারে ইংরাজী লিখাইতে লাগিলেন। উত্তরকালে কেহ লাহিড়ী মহাশয়ের হাতের ইংরাজী লেখার প্রশংসা করিলে তিনি বলিতেন “দাদা এই লেখার ভিত্তিস্থাপন করিয়াছিলেন।”
এইরূপে কেশচন্দ্রের অবিশ্রাস্ত যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে নবাগত সহোদরের শিক্ষা এক প্রকার চলিল। কিন্তু তাহ কেশবের মনঃপূত হইত না। কারণ দিবসের অধিকাংশ ভাগ তাহাকে কৰ্ম্মস্থানে থাকিতে হইত, তখন বালক রামতনু বাসায় ভৃত্য বা দাসীর হস্তেই থাকিতেন। চেতলার দাস দাসীগণকে এখনও যেরূপ বিকৃত দেখা যায়, তখন তাহারা যে কিরূপ ছিল তাহা বলিতে পারি না। সর্ব্বত্রই দেখিতেছি তীর্থস্থানের সন্নিকটে সামাজিক নীতির অবস্থা অতি জঘন্য। বহুসংখ্যক অস্থায়ী, গতিশীল, নরনারী এই সকল স্থানে সর্ব্বদাই আসিতেছে ও যাইতেছে। ইহাদের মধ্যে অনেকে অজ্ঞ ও অশিক্ষিত, তাহাদিগকে প্রবঞ্চনা করিয়া বা পাপে লিপ্ত করিয়া কিছু উপার্জ্জন করিবার মানসে অনেক স্বার্থপর, ধর্ম্মজ্ঞানশূন্য লোক এই সকল তীর্থস্থানের চারিদিকে বাস করে। দুশ্চরিত্রা নারীদিগের গৃহে এই সকল স্থান পূর্ণ হইয়া যায়। যাত্রাদিগকে বাসা লইতে হইলে অনেক সময়ে এই সকল নারীদের ভবনেই বাসা লইতে হয়। তাহারা দিনে যাত্রীদিগকে বাসা দিয়া ও রাত্রে বারাঙ্গনাবৃত্তি করিয়া দুই প্রকারে উপার্জ্জন করিতে থাকে। যখন রূপ ও যৌবন গত হয় তখন ইহাদের অনেকে ভদ্রগৃহস্থ দিগের গৃহে দাসীবৃত্তি অবলম্বন করে। চেতলা তখন এই শ্রেণীর পুরুষ ও নারীতে পূর্ণ ছিল। বর্ত্তমান সময়ের ন্যায় তখনও চেতলা বাণিজ্যের একটা প্রধান স্থান ছিল। বর্ষে বর্ষে ইংলণ্ডে যে সকল চাউলের রপ্তানী হইত চেতলা সে সকল চাউলের সর্বপ্রধান হাট ছিল। এতদর্থে সুদুর বাখরগঞ্জ প্রভৃতি স্থান হইতে এবং দক্ষিণ মগরাহাট, কুলপী প্রভৃতি স্থান হইতে শত শত চাউলের নৌকা ও শালতী আসিয়া কালীঘাটের সন্নিকটবর্ত্তী টালির নালা নামক খালকে পূর্ণ করিয়া রাখিত। সুতরাং পূর্ব্ববঙ্গনিবাসী চাউলের গোলাদার, আড়তদার ও বাঙ্গাল মাঝী প্রভৃতিতে চেতলা পরিপূর্ণ ছিল। এরূপ প্রবাসবাসী, বণিকদলের আবাসস্থানে কিরূপ লোকের সমাগম হয় সকলেই তাহা অবগত আছেন। সকলেই অনুমান করিতে পারেন কিরূপ সামাজিক জলবায়ুর মধ্যে ও কিরূপ সংসর্গে বালক, রামতনু চেতলাতে থাকিতেন। সৌভাগ্যের বিষয় এরূপ স্থলে ও এরূপ সংসর্গে অধিক দিন থাকিতে হয় নাই।
কেশবচন্দ্র এরূপ স্থানে ও এরূপ সংসর্গে ভ্রাতাকে রাখিয়া সুস্থির থাকিতে পারিতেন না। কিরূপে তাহাকে সরাইতে পারেন সর্ব্বদা সেই চিন্তা করিতেন। অবশেষে এক সুযোগ উপস্থিত হইল। একদিন কালীশঙ্কর মৈত্র নামক নদীয়া জেলা নিবাসী একজন ভদ্রলোক কর্ম্মপ্রার্থী হইয়া কেশবচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তখন গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার নামে কালীশঙ্করের একজন আত্মীয় ব্যক্তি মহাত্মা ডেভিড হেয়ারের প্রতিষ্ঠিত কোনও বিদ্যালয়ে পণ্ডিতী করিতেন এবং হেয়ারের প্রিয়পাত্র ছিলেন। এই গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার সংস্কৃত কলেজের সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের ভ্রাতুষ্পুত্র। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার প্রথমে শ্রীরামপুরের মিশনারি কেরী সাহেবের শিক্ষকরূপে ও কৃত্তিবাসের রামায়ণের সংস্কর্ত্তা ও প্রকাশকরূপে বঙ্গসমাজে পরিচিত হন। পরে ১৮২৪ সালে সংস্কৃত কালেজ স্থাপিত হইলে, তাহার সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। ইহারই নিকটে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার উৎকৃষ্ট পাঠনার রীতির অনেক আখ্যায়িকা সংস্কৃত কলেজে প্রচলিত আছে। যখন তাঁহার বয়ঃক্রম ৬০।৬৫ বৎসরেরও অধিক হইবে, এবং যখন কালেজে আসা যাওয়া তাঁহার পক্ষে কঠিন বোধ হইত, তখনও কালিদাসের শকুন্তলা বা ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ পড়াইবার সময়ে তিনি এমনি তন্ময় হইয়া যাইতেন যে পড়াইতে পড়াইতে ভাবাবেশে আসন ত্যাগ করিয়া দাড়াইতেন ও বর্ণিত বিষয়ের অভিনয় করিতে প্রবৃত্ত হইতেন। অপর শিক্ষকদিগের মধ্যে কেবল D. L. Richardsonএর বিষয়েও এইরূপ শুনিয়াছি, তিনিও সেক্সপীয়র পড়াইবার সময়ে আত্মহারা হইতেন।
যাহা হউক এই সময়ে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার কলিকাতা সহরের একজন অগ্রগণ্য পণ্ডিত ছিলেন, এবং তাহার ভ্রাতুপুত্র গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার হেয়ারের একজন প্রিয়পাত্র ছিলেন। কেশবচন্দ্র, কালীশঙ্কর মৈত্রকে কর্ম্মলাভ বিষয়ে সহায়তা করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন; কিন্তু তাহার প্রতিদান স্বরূপ এই কথা থাকিল, যে কালীশঙ্কর গৌরমোহনকে ধরিয়া রামতনুকে হেয়ারের স্কুলে ভর্ত্তি করিয়া দিবেন। গৌরমোহন এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তখন কৌলীন্য ও বংশমর্য্যাদার প্রতি মানুষের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। লাহিড়ী মহাশয় বলিতেন, যে তিনি কুলীনের সন্তান বলিয়া বিদ্যালঙ্কার আনন্দের সহিত তাঁহার সহায়তা করিতে প্রবৃত্ত হন।
একদিন গৌরমোহন, বালক রামতনুকে চেতলা হইতে আনাইয়া, সঙ্গে করিয়া গ্রে সাহেবের গঙ্গাতীরবর্ত্তী ভবনে হেয়ারের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলেন। হেয়ারের গৃহে প্রতিদিন প্রাতে ও সন্ধাতে উমেদার ও স্কুলের বালকের অপ্রতুল হইত না। বালকগণ আসিলে হেয়ার তাহাদিগকে শুধু মুখে যাইতে দিতেন না; পরিতোষপূর্ব্বক মিঠাই খাওয়াইয়া ছাড়িতেন। তাহার ভবনের সন্নিকটে এক মিঠাইওয়ালার দোকান ছিল; তাহার সহিত হেয়ারের ঐ প্রকার বন্দোবস্ত ছিল। বিদ্যালঙ্কার; বালক রামতনুকে সেই মিঠাইওয়ালার দোকানে বসাইয়া রাখিয়া, হেয়ারের নিকটে গেলেন এবং তাঁহাকে ভর্ত্তি করিবার জন্য সাধ্যসাধনা করিতে লাগিলেন। হেয়ার এরূপ অনুরোধ উপরোধে উত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। তথন স্বীয় স্বীয় বালকদিগকে ইংরাজী শিখাইবার জন্য লোকের এমন ব্যগ্রতা জন্মিয়াছিল যে হেয়ারের পক্ষে বাটীর বাহির হওয়া কঠিন হইছিল। বাহির হইলেই দলে দলে বালক —“me poor boy, have pity on me, me take in your school” বলিয়া তাহার পাল্কীর দুই ধারে ছুটিত। তদ্ভিন্ন পথে ঘাটে বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিগণ তাঁহাকে অনুরোধ উপরোধ করিতেন। যে সময়ে বিদ্যালঙ্কার বালক রামতনুকে লইয়া উপস্থিত হন, সে সময়ে হেয়ার ফ্রী বালক লওয়া এক প্রকার বন্ধ করিয়াছিলেন; যে কয়টী ফ্রী রাখিয়াছিলেন সমুদয় পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং তিনি বিদ্যালঙ্কারের অনুরোধ রক্ষা করিতে পারিলেন না, বলিলেন—“খালি নাই, এখন লইতে পারিব না।”
বিদ্যালঙ্কার হেয়ারের নারীসুলভ কোমল প্রকৃতি বিলক্ষণ বুঝিতেন। তিনি নিরাশ না হইয়া লাহিড়ী মহাশয়কে বলিয়া দিলেন—“হেয়ারের পাল্কীর সঙ্গে সঙ্গে কিছুদিন ছুটিতে হইবে।” বালক রামতনু তাহাই করিতে লাগিলেন। তিনি হাতিবাগানে বিদ্যালঙ্কারের বাসা হইতে সকাল সকাল আহার করিয়া, কোনও দিন বা অনাহারে, হেয়ার বহির্গত হইবার পূর্ব্বেই, গ্রে সাহেবের ভবনের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইতেন; এবং তাঁহার পাল্কীর সহিত ছুটিতে আরম্ভ করিতেন। হেয়ারের পাল্কী নানা স্থানে বাইত, এবং এক এক স্থানে অনেকক্ষণ বিলম্ব করিত। রামতনু সর্ব্বত্রই যাইতেন ও অপেক্ষা করিতেন। একদিন অপরাহ্নে হেয়ার স্বীয় ভবনে ফিরিয়া আসিয়া পাল্কী হইতে অবতরণ করিয়া দেখিলেন বালকটীর মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। অনুমানে বুঝিলেন সেদিন তাহার আহার হয় নাই। জিজ্ঞাসা করিলেন—“তোমার কি ক্ষুধা পাইয়াছে? কিছু আহার করিবে?” বালক রামতনু আহারের কথা শুনিয়াই ভয় পাইলেন; বিদেশীয় ও বিধর্ম্মী লোকের ভবনে আহার করিলে পাছে জাতিচ্যুত হইতে হয়, তাই ভয়ে ভয়ে বলিলেন,—“না, আমার ক্ষুধা পায় নাই।” হেয়ার তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলে—“আমাকে সত্য বল, আমার বাটীতে তোমাকে খাইতে হইবে না, ঐ মিঠাইওয়ালা তোমাকে খাইতে দিবে। সত্য করিয়া বল আজ আহার করেছ কি না?” বালক রামতনু কাঁদিয়া ফেলিলেন, বলিলেন—“আজ আমার খাওয়া হয় নাই।” তথন মহামতি হেয়ার তাঁহার মিঠাইওয়ালাকে পেট ভরিয়া মিঠাই খাইতে দিতে বলিলেন। এই প্রকারে দিবাশেষে অনেক দিন হেয়ারের মিঠাইওয়ালার নিকট তাঁহার দিনের আহার মিলিত।
এইরূপে প্রায় দুই মাসেরও অধিক কাল গত হইল। শেষে হেয়ার বুঝিলেন এ বালক ছাড়িবার পাত্র নয়, বিদ্যা শিক্ষা বিষয়ে ইহার অতিশয় আগ্রহ। তখন তাঁহাকে ফ্রী বালকদের দলে লইতে স্বীকৃত হইলেন। এই অবস্থার এক নূতন বিঘ্ন আাসিয়া উপস্থিত হইল। স্কুলের বালকদিগের পরিচ্ছন্নতার দিকে হেয়ারের অতিশয় দৃষ্টি ছিল। বালকগণ যেরূপ অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থাতে স্কুলে আসিত তাহা দেখিয়া তিনি ক্লেশ পাইতেন। কোন কোনও দিন স্কুল বসিবার বা ভাঙ্গিবার সময়ে তিনি গামছা হস্তে স্কুলের দ্বারে দাঁড়াইতেন এবং প্রবেশ বা নির্গমনের সময় সর্ব্বাপেক্ষা অপরিচ্ছন্ন বালকদিগকে ধরিয়া তিরস্কার পূর্ব্বক মায়ের মত উত্তমরূপে গা মুছিয়া দিতেন। বালকদিগকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখিবার জন্য তিনি ফ্রী বালকদিগের সম্বন্ধে এই নিয়ম করিয়াছিলেন যে তাহাদিগকে স্কুলে প্রবিষ্ট করিবার সময় তাহাদের অভিভাবকদিগকে একখানা একরারনামা লিখিয়া দিতে হইবে যে কোন বালক যদি অপরিচ্ছন্ন অবস্থাতে স্কুলে আসে তাহা হইলে অভিভাবককে জরিমানা দিতে হইবে।
লাহিড়ী মহাশয়কে ভর্ত্তি করিবার সময়ে সেই প্রশ্ন উঠিল। হেয়ার বলিলেন,—তাঁহার জ্যেষ্ঠকে উক্ত প্রকার একরারনামা লিখিয়া দিতে হইবে। কেশবচন্দ্র ধর্মভীরু লোক ছিলেন। তিনি ভাবিলেন আমি যখন কলিকাতায় থাকি না, তখন সহোদর কি অবস্থাতে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাইতেছে তাহা দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নহে; এরূপ স্থলে আমি কিরূপে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করি। তিনি এক প্রকার নিরাশ হইয়া ছাড়িয়া দিলেন। অবশেষে বিদ্যালঙ্কার অনেক বুঝাইয়া তাঁহাকে রাজি করিলেন। রামতনু স্কুল সোসাইটীর স্থাপিত স্কুলে ফ্রীবালকরপে ভর্ত্তি হইলেন। ঐ স্কুল পরে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল, ও তৎপরে হেয়ার স্কুল নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছে। এই স্থানে মহাত্মা হেয়ারের জীবনচরিত কিছু বলা আবশ্যক।
ডেভিড হেয়ার ১৭৭৫ গ্রীষ্টীকে স্কটলণ্ডদেশে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮০০ সালে ঘড়িওয়ালার কাজ লইয়া এদেশে আগমন করেন। এখানে বাসকালে কর্ম্মসূত্রে এদেশীয় অনেক ভদ্রলোকের সহিত তাঁহার বন্ধুতা হয়। হেয়ার নিজে উচ্চদরের শিক্ষিত লোক ছিলেন না, কিন্তু ইহা অনুভব করিয়াছিলেন যে এদেশে ইংরাজী শিক্ষা প্রচলিত না হইলে এদেশের লোকের অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটিবে না। তদনুসারে তাঁহার দোকানে কেহ ঘড়ি কিনিতে বা মেরামত করিতে গেলেই তিনি এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতেন। ১৮১৪ সালে রামমোহন রায় যখন কলিকাতাতে অবস্থিত হইলেন, তখন অল্পকালের মধ্যই উভয়ের মধ্যে মিত্রতা জন্মিল। ১৮১৬ সালে একদিন হেয়ার স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া রামমোহন রায়ের আত্মীয়-সভার এক অধিবেশনে উপস্থিত হইলেন। সভা ভঙ্গের পর দুই বন্ধুতে ইংরাজী শিক্ষা প্রবর্ত্তিত করিবার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে অনেক কথাবার্ত্তা হইল। অবশেষে স্থির হইল যে এদেশীয় বালকগণকে ইংরাজী শিক্ষা দিবার জন্য একটী স্কুল স্থাপন করা হইবে। আত্মীয় সভার অন্যতম সভ্য বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় এই প্রস্তাব তদানীন্তর সুপ্রিমকোটের প্রধান বিচারপতি (Sir Hyde East) মহোদয়ের নিকট উপস্থিত করেন এবং তাঁহার উৎসাহ ও যত্নে হিন্দু কালেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহার বিবরণ পর পরিচ্ছেদে দেওয়া যাইবে। মহাবিদ্যালয় বা বর্ত্তমান হিন্দুস্কুল প্রতিষ্ঠিত হইলে, হেয়ার তাহার কমিটীর একজন সভ্য নিযুক্ত হইলেন। তিনি ডাক্তার এইচ, এইচ উইলসনের (Dr. H. H. Wilson) পরামর্শের অধীন থাকিয়া অবিশ্রান্ত মনোযোগের সহিত স্কুলটীর উন্নতি সাধনে নিযুক্ত হইলেন।১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি দিবসে হিন্দুকলেজ খোলা হয়। সেই বৎসরেই হেয়ারের প্রধান উদ্যোগে ও তৎকালীন ইউরোপীয় ও দেশীয়, ভদ্রলোকদিগের সাহায্যে স্কুলবুক সোসাইটী নামে একটী সভা স্থাপিত হইল। ঐ সভার সভ্যগণ ছাত্রগণের পাঠোপযোগী ইংরাজী ও বাঙ্গালা নানাপ্রকার গ্রন্থ প্রণয়ন ও মুদ্রিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এই সভার স্থাপন বঙ্গদেশের নবযুগের একটী প্রধান ঘটনা। কারণ এই সভার মুদ্রিত গ্রন্থাবলী এদেশে শিক্ষার এক নূতন দ্বার ও নূতন রীতি উন্মুক্ত করিয়াছিল। রামমোহন রায় তাঁহার বন্ধু হেয়ারের সহায় হইয়া নূতন ধরণের স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ সকল প্রণয়ন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি একখানি বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও জ্যাগ্রাহি নাম দিয়া একখানি ভূগোলবিবরণ লিখিয়াছিলেন। তাঁহার প্রণীত ব্যাকরণ পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু জ্যাগ্রাহির উদ্দেশ পাওয়া যাইতেছে না। এতদ্ভিন্ন আরও অনেকে এই সভার সাহায্যে নানাপ্রকার ইংরাজী ও বাঙ্গালা পুস্তক প্রণয়ন করিতে লাগিলেন।
১৮১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হেয়ারের উদ্যোগে স্কুল সোসাইটী নামে আর একটী সভা স্থাপিত হইল। হেয়ার ও রাধাকান্ত দেব তাহার সম্পাদকের পদগ্রহণ করিলেন। কলিকাতার স্থানে স্থানে নূতন প্রণালীতে ইংরাজী ও বাঙ্গালা শিক্ষার জন্য স্কুল স্থাপন করা এই সোসাইটীর উদ্দেশ্য ছিল। হেয়ার ইহার প্রাণ ও প্রধান কার্য্য-নির্ব্বাহক ছিলেন। তিনি ইহার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করিতে লাগিলেন। এমন কি সেজন্য তাঁহার ঘড়ির ব্যবসায় রক্ষা করা অসম্ভব হইয়া উঠিল। তিনি তাঁহার বন্ধু গ্রেকে ঘড়ির কারবার বিক্রয় করিয়া, সেই অর্থে সহরের মধ্যে কিঞ্চিৎ ভূমি ক্রয় পূর্ব্বক তদুৎপন্ন আয় দ্বারা নিজের ভরণ পোষণের ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে লগিলেন; এবং অনন্যকর্ম্মা হইয়া এদেশের বালকদিগের শিক্ষাদান কার্যে নিযুক্ত হইলেন। ঠনঠনিয়া, কালীতলা, আড়পুলী প্রভৃতি কতিপয় স্থানে তিনি কয়েকটী বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন। প্রতিদিন প্রাতে আহার করিয়া, একখানি পাল্কীতে আরোহণ পূর্ব্বক, তিনি স্বীয় নামে প্রসিদ্ধ বর্ত্তমান হেয়ার ষ্ট্রীট হইতে বাহির হইতেন। প্রথমে তাঁহার নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠশালা ও স্কুলগুলি পরিদর্শন করিতেন; তৎপরে যে সকল দরিদ্র বালকের পীড়ার সংবাদ পাইতেন, তাহাদের ভবনে গিয়া তাহাদিগের ঔষধ ও পথ্যাদির ব্যবস্থ। করিতেন; অবশেষে হিন্দুকালেজে গিয়া উপস্থিত হইতেন; সেখানে প্রত্যেক শ্রেণীর, বলিতে কি প্রত্যেক বালকের, কার্য্য পরিদর্শন করিতেন; এইরূপে সমস্ত দিন সহরের নানা স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন; সায়ংকালে বাস ভবনে ফিরিয়া যাইতেন। আমরা সেকালের লোকের মুখে শুনিয়াছি, অনেক বালকের আত্মীয় স্বজন নিজ নিজ ভবনে হেয়ারের মুখ এতবার দেথিতেন যে অনেকে তাঁহাকে আপনার লোক মনে করিতেন। স্কুলের বালকদিগের প্রতি হেয়ারের যে কি প্রেম ছিল তাহা বর্ণনীয় নহে। তাহাদিগকে দেখিলে তাঁহার এত আনন্দ হইত, যে তিনি আর সকল কাজ ভুলিয়া যাইতেন। মধ্যে মধ্যে স্কুলে আসিবার সময় নিম্নশ্রেণীর শিশুদিগের জন্য খেলিবার বল কিনিয়া আনিতেন। স্কুলের ছুটী হইলে ঐ বল উর্দ্ধে ধরিয়া উদ্বাহু হইষা শিশুদলের মধ্যে দাঁড়াইতেন; তাঁহারা চারিদিক হইতে আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিত; কেহ কোমর জড়াইত; কেহ গাত্র বহিয়া উঠিবার চেষ্টা করিত; কেহ বা স্কন্ধে ঝুলিত; তিনি তাহাতে মহা আনন্দ অনুভব করিতেন। তাঁহার ফ্রী বালকগুলির প্রতি তাঁহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তাহাদিগকে তিনি বিশেষভাবে নিজ সন্তানের ন্যায় জ্ঞান করিতেন। রামতনুকে তিনি সেই শ্রেণীভুক্ত করিয়া লইলেন এবং চিরদিন তাঁহাকে সেইভাবে দেখিতেন।
লাহিড়ী মহাশয় যে দিন হেয়ারের স্কুলে প্রবিষ্ট হন, সেই দিন আর একজন উত্তরকাল-প্রসিদ্ধ ব্যক্তি তাঁহার সঙ্গে একশ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। তিনি রাজা দিগম্বর মিত্র। তাঁহার তৎকালের সহাধ্যায়ীদের মধ্যে আর একজনের নাম উল্লেখযোগ্য, ইনি ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল। ইনি পরে ডেপুটী মাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটী কালেক্টাররূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন।
লাহিড়ী মহাশয়কে ভর্ত্তি করিবার সময় হেয়ার জিজ্ঞাসা করিলেন— “তোমার বয়স কত?”
লাহিড়ী মহাশয় বলিলেন—“১৩ বৎসর।”
হেয়ার বলিলেন—“না, তোমার বয়স ১২র অধিক নয়।”
লাহিড়ী মহাশয় পুনরায় বলিলেন—“১৩ বৎসর।”
তথাপি হেয়ার বলিলেন, “না—১২ বৎসর”—এবং তাহাই লিখিয়া লইলেন। এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া লাহিড়ী মহাশয় উত্তরকালে বিস্ময় প্রকাশ করিতেন। আমাদের বোধ হয় হেয়ার জানিতেন, যে এ দেশের লোকে বালক ত্রয়োদশ বর্ষে পদার্পণ করিলেই, তাহাকে ১৩ বৎসর বলে, কিন্তু ইংরাজী হিসাবে তাহা ১২ বৎসর, সেই জন্যই এই প্রকার করিয়া থাকিবেন।
সে সময়ে ইংরাজী শিক্ষকের অল্পতাবশতঃ প্রথম শ্রেণীর বালকগণ অনেক সময়ে নিম্নতন শ্রেণী সকলে মনিটারের কাজ করিত। লাহিড়ী মহাশয় যখন সপ্তম শ্রেণীতে পাঠ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন প্রথম শ্রেণীর যাদব ও আদিত্য নামে দুইটী বালক মনিটারের কাজ করিত। এই দুইটী মনিটারের বিষয়ে লাহিড়ী মহাশয়ের শেষে এইমাত্র মনে ছিল যে যাদব বালকদিগকে অতিশয় প্রহার করিত এবং তাহাদের মধ্যে যাহাদের অবস্থা ভাল তাহাদের নিকট হইতে মিঠাই খাইবার পয়সা লইত। আদিত্য জাতিতে রজক ছিল। সে নাকি পরে একটা স্কুল করিবার ছল করিয়া দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের নিকট হইতে ৭০০৲ সাত শত টকা ঠকাইয়া লইয়াছিল।
বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়া পড়িবার ব্যবস্থা ত এক প্রকার হইল; কিন্তু কাহার আশ্রয়ে থাকিয়া পাঠ করেন, সেই এক মহাচিন্তা। প্রথমে কেশবচন্দ্রের অনুরোধে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার তাঁহাকে আপনার বাসায় রাখিতে সম্মত হইলেন। রামতনু সেখানে থাকিয়া স্কুলে পড়িতে লাগিলেন। সে কালে কর্ম্মস্থানে পরিবার সঙ্গে বইয়া যাইবার রীতি ছিল না। কলিকাতাতে যাঁহারা বিষয় কর্ম্ম করিতেন, তাঁহারা সচরাচর হয় কোনও পদস্থ আত্মীয়ের আশ্রয়ে, না হয় দুই দশজনে একত্র হইয়া বাসা করিয়া থাকিতেন। গ্রামের মধ্যে এক ব্যক্তি কৃতী ও উপার্জ্জনশীল হইলে তাঁহার জ্ঞাতি কুটুম্বদিগের মধ্যে অনেকে একে একে আসিয়া তাঁহার কলিকাতাস্থ বাসাতে আশ্রয় লইতেন। কেহ বা কর্ম্মের আশায় নিষ্কর্ম্মা বসিয়া খাইতেন; কেহ বা কর্ম্ম কাজ করিয়া সামান্য উপার্জ্জন করিতেন। এরূপ ব্যক্তিদিগকে অন্নদান করা ভদ্র-গৃহস্থ মাত্রেরই একটা কর্ত্তব্যের মধ্যে পরিগণিত ছিল। অধিকাংশস্থলেই পাকাদি কার্য্যের জন্য স্বতন্ত্র পাচক রাখা হইত না। এই অন্নাশ্রিত বা নিষ্কর্ম্মা ব্যক্তিগণই পালা করিয়া রন্ধনাদি করিতেন। তাহা লইয়া সময়ে সময়ে ঘোর বিবাদ উপস্থিত হইত। একজনের কার্য্য অপরে করিতে চাহিত না। আপনাদের মধ্যে কোনও অল্পবয়স্ক বালক থাকিলে অধিকাংশ স্থলেই বাসার নিষ্কর্ম্মা ব্যক্তিগণ তিরস্কার ও তাড়নাদির প্রভাবে তাহাদিগকে বশবর্ত্তী করিয়া তাহাদিগের দ্বারা অধিকাংশ কাজ করাইয়া লইবার চেষ্টা করিত। এই সকল কলিকাতা-প্রবাসী নিষ্কর্ম্মা লোকের স্বভাব চরিত্র কিরূপ হইত তাহার বর্ণনার প্রয়োজন নাই। এইমাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে সে সময়ে উপার্জ্জক কলিকাতা প্রবাসীদিগের মধ্যে এরূপ লোক অনেক দেখা যাইত যাঁহারা জীবনে অন্ততঃ একবার চরিত্র-স্খলন জনিত কুৎসিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হইতেন। তখন সুরাপানটা প্রবল হয় নাই; কিন্তু কলিকাতা প্রবাসীদিগের অনেকে গাঁজা ও চরস প্রভৃতিতে পরিপক্ক হইতেন।
অল্পবয়স্ক বালকগণ স্থানাভাবে এইরূপ বাসাতে এইরূপ সঙ্গে আসিয়াই বাস করিত। তাহার ফল কিরূপ হইত। তাহ। সহজেই অনুমেয়। বালকদিগের রুচি, আলাপ, আামোদ, প্রমোদ সমুদয় কলুম্বিত হইয়া যাইত। বয়ঃপ্রাপ্ত পুরষদিগের অসঙ্কুচিত আলাপ ও ইয়ারকীর মধ্যে বাস করিয়া তাহার অকালপক্ক হইয়া উঠিত। তাহাদের বয়সে যাহা জানা উচিত নয় তাহা জানিত ও তদনুরূপ আচরণ করিত। অনেকে ফিনফিনে কালাপেড়ে ধুতি পরিয়া, বুট পায়ে দিয়া, দাঁতে মিশি লাগাইয়া ও বাঁকা শিঁতে কাটিয়া সহরের বাবুদের অনুকরণের প্রয়াস পাইত; চরস গাঁজা প্রভৃতি খাইতে শিখিত; এবং অনেক সময়ে তদপেক্ষাও গুরুতর পাপে লিপ্ত হইত।বালক রামতনু বিদ্যালঙ্কারের হাতিবাগানস্থ বাসাতে এইরূপ সংসর্গে বাস করিতে লাগিলেন। শুনিয়াছি বিদ্যালঙ্কারের নিজের স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না; সুতরাং তাহার বাসাটী আরও ভয়ঙ্কর স্থান ছিল। বাসার লোকে বালক রামতনুকে সর্ব্বদা রাঁধাইত এবং অপরাপর প্রকারে খাটাইত, সেজন্য তাঁহার পাঠেরও অত্যন্ত ব্যাঘাত হইত।
ক্রমে এই কথা কেশবচন্দ্রের কর্ণগোচর হওয়াতে তিনি কনিষ্ঠকে লইয়া শ্যামপুকুর নামক স্থানে স্বীয় পিতার মাতুল-পুত্র রামকান্ত খাঁ মহাশয়ের ভবনে রাখিয়া দিলেন। খাঁ মহাশয় সে সময়ে নীলের দালালি করিতেন। এখানে আসিয়া রামতনু একটু স্নেহ ও যত্ন পাইতে লাগিলেন। খাঁ মহাশয় সপরিবারে সহরে বাস করিতেন। তাঁহার গৃহিণী বালক রামতনুকে ভালবাসিতেন। কেশবচন্দ্র কনিষ্ঠের দুগ্ধ ও টিফিনের ব্যয় দিতেন, কিন্তু তদ্ব্যতীত আর সকলই তিনি ঐ গৃহে পাইতেন। কেবল তাহা নহে, শ্যামপুকুরে আসিয়া তাহার আর একটা লাভ হইল। তাঁহার সহপাঠী বালক দিগম্বর মিত্র তখন শ্যামপুকুরের নিকটস্থ শ্যামবাজারে নিজের মাতুলালয়ে বাস করিতেন। রামতনু দিগম্বরের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য তাঁহার মাতুলালয়ে গেলে দিগম্বরের মাতার সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় হয়। দিগম্বরের জননী তাহাকে স্বীয় পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন এবং সর্ব্বদা সংবাদ লইতেন। পিতার গৃহে ভাল দ্রব্য কিছু হইলেই ডাকিয়া খাওয়াইতেন, এবং সময়ে সময়ে যথাসাধ্য সাহায্য করিতেন। সংক্ষেপে বলিতে গেলে তিনি বিদেশে তাঁহার মাসীর কাজ করিতেন। এই স্নেহ ভালবাসার কথা চিরদিন লাহিড়ী মহাশয়ের স্মৃতিতে জাগরূক ছিল। তিনি কৃতজ্ঞতাপূর্ণ-হৃদয়ে অনেকবার এই স্নেহের বিষয় উল্লেখ করিতেন।
তখন সহাধ্যায়ীদিগের মধ্যে এরূপ প্রণয় সর্ব্বদা জন্মিত। সহরস্থ সহাধ্যায়ী বন্ধুদিগের জননীরা অনেক সময়ে বাস্তবিক মাতৃস্বসার কাজ করিতেন। অনেক সময়ে প্রবাসবাসী বালকগণকে অনেক বিপদ ও প্রলোভন হইতে বাঁচাইতেন। আমাদেরই বালককালে এরূপে কতবার সুরক্ষিত হইয়াছি। অনেক স্থলে প্রবাসবাসী বালকগণ সহাধ্যায়ীদিগের জননীদিগকে মা বা মাসী ও তাঁহাদের ভগিনীদিগকে দিদি বা বোন বলিয়া ডাকিত, এবং যথার্থই সেই প্রকার ব্যবহার পাইত। যাহারা জননী ও ভগিনীগণের স্নেহ ও ভালবাসা হইতে দূরে আসিয়া পুরুষদলের নীচ আমোদের মধ্যে পড়িয়া থাকিত, তাহাদের পক্ষে এই স্নেহ ও ভালবাসা যে কি মহা ইষ্টসাধন করিত তাহা এখন বাক্যে বর্ণনা করিতে পারি না। উত্তরকালে যাঁহারা বঙ্গদেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, তাহাদের অনেকে নারীগণের এইরূপ অযাচিত স্নেহ পাইয়া মানুষকে ভালবাসিতে শিখিয়াছিলেন। পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাল্যবন্ধু গোপালচন্দ্র ঘোষের জননী রাইমণির কথা সকলেই অবগত আছেন। রাইমণি প্রবাস-সমাগত ঈশ্বরচন্দ্রের মাসীর স্থান অধিকার করিয়া, তাহার অতুলনীয় স্নেহ ও যত্নের দ্বারা কিরূপে তাঁহার হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন, তাহা বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত জীবনচরিত হইতে তাহ উদ্ধৃত করিতেছি—
“তাহার একমাত্র পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ আমার প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন। পুত্রের উপর জননীর যেরূপ স্নেহ ও যত্ন থাকা উচিত ও আবশ্যক, গোপালচন্দ্রের উপর রাইমণির স্নেহ ও যত্ন তদপেক্ষা অধিকতর ছিল তাহাতে সংশয় নাই। কিন্তু আমার আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস এই, স্নেহ ও যত্ন বিষয়ে আমায় ও গোপালে রাইমণির অণুমাত্র বিভিন্নতা ছিল না। ফল কথা এই, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা, প্রভৃতি সদ্গুণ বিষয়ে রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্য্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই দয়াশীল সৌম্যমূর্ত্তি আমার হৃদয়মন্দিরে দেবীমূর্ত্তির ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া বিরাজমান রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার কথা উপস্থিত হইলে তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্ত্তন করিতে করিতে অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না। আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। আমার বোধ হয় সে নির্দ্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির সেই দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে, এবং ঐ সমস্ত গুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয় তাহা হইলে তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমণ্ডলে নাই।”
ঠিক কথা! বিদ্যাসাগর যে কলিকাতার ন্যায় প্রলোভনপূর্ণ স্থানে পদার্পণ করিয়া সুরক্ষিত হইয়াছিলেন, তাহা অনেকটা রাইমণির স্নেহের গুণে। রামতনু বাবুও যে সুকুমার বয়সে, পাপপ্রলোভনের মধ্যে বাঁচিয়াছিলেন, তাহাও যে অনেকটা রামকান্ত খাঁ মহাশয়ের গৃহিণীর ও দিগম্বর মিত্রের মাতার স্নেহের গুণে তাহাতে কি সন্দেহ আছে? মাতা ও ভগিনীর স্নেহ ছাড়িয়া যিনি আসিয়াছিলেন, তাহার পক্ষে এই স্নেহ এক মহা রক্ষাকবচের ন্যায় হইয়াছিল।
হায়! বর্ত্তমানকালে সহাধ্যায়ীদিগের ও তাঁহাদের পরিবারবর্গের সহিত সে সখ্যভাব আর দেখা যায় না। এক্ষণে এক একটী শ্রেণীতে ৬০।৭০ এরও অধিক বালক বসে, সুতরাং সম্বৎসরের মধ্যে বালকে বালকে আলাপ পরিচয় হওয়া কঠিন, সখ্যস্থাপন ত দূরের কথা। লোকে মনে করিয়া থাকে, লিখিয়া পড়িয়া কৃতী ও কার্য্যক্ষম হওয়ার নামই শিক্ষা, কিন্তু গুরু শিষ্যে ভক্তির সম্বন্ধ, বালকে বালকে সখ্যভাব যে শিক্ষার একটা প্রধান অঙ্গ তাহা অনেকে জানে না, সেই জন্য বর্ত্তমান শিক্ষা-প্রণালীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা রামতনু লাহিড়ীর ন্যায় মানুষ প্রস্তুত হওয়া এক প্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিতেছে।
অতঃপর কলিকাতার তদানীন্তন স্বাস্থ্যের অবস্থার বিষয়ে কিছু বলা আবশ্যক। বর্ত্তমান গ্যাসালোকে আলোকিত, প্রশস্ত-রাজ-বর্ত্ম-মণ্ডিত, ড্রেণ-সমন্বিত কলিকাতাতে যাঁহারা বাস করিতেছেন, তাহারা সে সময়কার স্কুলের বালকগণের কঠোর তপস্যার ভাব কল্পনাতেও আনিতে পারিবেন না। তখন কলিকাতায় আসিলে অধিকাংশ বালকই এক বৎসরের মধ্যে অন্ততঃ একবার গুরুতর পীড়ার দ্বারা আক্রান্ত হইত। এই পীড়া সচরাচর অজীর্ণতাদোষ রূপ দ্বার দিয়া প্রবেশ করিত; পরে জ্বর বিকার দিয়া উপসংহার করিত। দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায়, ইহারই কয়েক বৎসর পরে বিদ্যাশিক্ষার্থ আসিয়া কিছু দিন রামতনু বাবুর বাসাতেছিলেন। তিনি সে সময়কার কলিকাতার অবস্থা যাহা বর্ণনা করিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করিতেছি—
“তৎকালে মফঃস্বলের যে সকল লোক প্রথমে কলিকাতা যাইতেন তাহাদের মধ্যে অনেকেরই অজীর্ণ রোগ হইত। এ পীড়াকে ‘লোণা লাগা’ কহিত। যাঁহারা তথায় অল্পকাল থাকিয়াই প্রত্যাগমন করিতেন, তাঁহারা বাটী আসিয়া লোণ কাটাইবার নিমিত্ত কাঁচা, থোড় খাইতেন, ঘোল ও কল্মির ঝোল পান করিতেন, এবং গাত্রে কাঁচা হরিদ্রা মাখিতেন। অত্যল্প গুরুপাক দ্রব্যেই আমার অসুখ হইত, একারণ আমি আহারের বিষয়ে অত্যন্ত সাবধান থাকিতাম। তুথাপি দুই মাসের মধ্যে আমার অরুচি জন্মিল; এবং ক্রমশঃ বল এককালে গেল। মৃৎপাত্রে অধিক দিন লবণ থাকিলে, যেমন তাহা জীর্ণ হইয়া যায়, আমার শরীর ঠিক সেইরূপ হইল। অত্যল্প আঘাতেই আমার গাত্রের ত্বক্ উঠিতে লাগিল। শরীরের বর্ণ শ্বেত হইয়া গেল। ঔষধ সেবনে কোনও উপকার না হওয়াতে নৌকাযোগে গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলোম। পরদিন হইতেই শরীর সুস্থ হইতে আরম্ভ হইল।”
এখন মফস্বল হইতে পীড়িত হইয়া লোকে সুস্থ হইবার জন্য কলিকাতা নগরীতে আগমন করে; তখন কলিকাতাতে দুইমাস থাকিলেই লোকের শরীর ভগ্ন হইত এবং কলিকাতা হইতে বাহির হইলে তৎপর দিনই শরীর সুস্থ হইতে আরম্ভ হইত! সে সময়ে কলিকাতার যে অবস্থা ছিল তাহাতে এরূপ ঘটনা কিছুই বিচিত্র ছিল না। তখন জলের কল ছিল না; প্রত্যেক ভবনে এক একটী কূপ ও প্রত্যেক পল্লীতে দুই চারিটী পুষ্করিণী ছিল। এই সকল পচা দুর্গন্ধময় জলপূর্ণ পুষ্করিণীতে কলিকাতা পরিপূর্ণ ছিল। অনুমান করি, যখন কলিকাতার পত্তন হয় তখন বর্ত্তমান রাজধানীর আদিম স্থানে দুই একটী ক্ষুদ্র গ্রাম ভিন্ন সমগ্র স্থান ধানের ক্ষেত ছিল। সহর যেমন বাড়িয়াছে লোকে ধানের ক্ষেতে পুষ্করিণী খনন করিয়া করিয়া বাস্তু ভিটা প্রস্তুত করিয়াছে। এইরূপে প্রত্যেক গৃহস্থের গৃহের সঙ্গে সঙ্গে এক একটী ক্ষুদ্র পুষ্করিণী হইয়াছে। এই অনুমানের আর একটী প্রমাণ এই যে উক্ত পুষ্করিণী সকল সহরের পূর্ব্বাংশেই অধিক পরিমাণে দৃষ্ট হইত; কারণ সুতানুটী, গোবিন্দপুর প্রভৃতি আদিম গ্রাম সকল নদী পার্শ্বেই অবস্থিত ছিল; সেখানে অধিক পুষ্করিণীর প্রয়োজন ছিল না।
এই পুষ্করিণীগুলি জ্বরের উৎস স্বরূপ ছিল। এতদ্ভিন্ন গবর্ণমেণ্ট স্থানে স্থানে কয়েকটী দীঘিকা খনন করিয়াছিলেন, তাহাতে কাহাকেও স্নান করিতে দিতেন না; সেইগুলি লোকের পানার্থ ছিল। তন্মধ্যে লালদিঘী সর্ব্বপ্রধান ছিল। উড়িয়া ভারিগণ ঐ জল বহন করিয়া গৃহে গৃহে যোগাইত। যখন জলের এই প্রকার দুরবস্থা তখন অপরদিকে সহরের বহিরাকৃতি অতি ভয়ঙ্কর ছিল। এখনকার ফুটপাথের পরিবর্ত্তে প্রত্যেক রাজপথের পার্শ্বে এক একটী সুবিস্তীর্ণ নর্দ্দামা ছিল। কোন কোনও নর্দ্দামার পরিসর আট দশ হাতের অধিক ছিল। ঐ সকল নর্দ্দামা কর্দ্দম ও পঙ্কে এরূপ পূর্ণ থাকিত, যে একবার একটী ক্ষিপ্ত হস্তী ঐরপ একটী নর্দ্দামাতে পড়িয়া প্রায় অর্দ্ধেক প্রোথিত হইয়া যায়, অতি কষ্টে তাহাকে তুলিতে হইয়াছিল। এই সকল নর্দ্দামা হইতে যে দুর্গন্ধ উঠিত তাহাকে বর্দ্ধিত ও ঘনীভূত করিবার জন্যই যেন প্রতি গৃহেই পথের পার্শ্বে এক একটী শৌচাগার ছিল। তাহাদের অনেকের মুখ দিন রাত্রি অনাবৃত থাকিত। নাসারন্ধ্র উত্তমরূপে বস্ত্রদ্বারা আবৃত না করিয়া সেই সকল পথ দিয়া চলিতে পারা যাইত না। মাছি ও মশার উপদ্রবে দিন রাত্রির মধ্যে কখনই নিরুদ্বেগে বসিয়া কাজ করিতে পারা যাইত না। এই সময়েই বালক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কলিকাতাতে আসিয়া বলিয়াছিলেন,—
“রেতে মশা দিনে মাছি,
দুই নিয়ে কল্কেতায় আছি।”
সহরের স্বাস্থ্যের অবস্থা যেরূপ ছিল, নীতির অবস্থা তদুপেক্ষা উন্নত ছিল না। তখন মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, উৎকোচ, জাল, জুয়াচুরী প্রভৃতির দ্বারা অর্থ সঞ্চয় করিয়া ধনী হওয়া কিছুই লজ্জার বিষয় ছিল না। বরং কোনও সুহৃদ্গোষ্ঠীতে পাঁচজন লোক একত্র বসিলে এরূপ ব্যক্তিদিগের কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা হইত। ধনিগণ পিতামাতার শ্রাদ্ধে, পুত্র কন্যার বিবাহে, পূজা পার্ব্বণে প্রভূত ধন ব্যয় করিয়া পরস্পরের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেন। সিন্দুরীয়াপটীর প্রসিদ্ধ মল্লিকগণ পুত্রের বিবাহে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া নিঃস্ব হইয়া গিয়াছেন। যে ধনী পূজার সময় প্রতিমা সাজাইতে যত অধিক ব্যয় করিতেন এবং যত অধিক পরিমাণে ইংরাজের খানা দিতে পারিতেন, সমাজ মধ্যে তাঁহার তত প্রশংসা হইত। ধনী গৃহস্থগণ প্রকাশ্যভাবে বারবিলাসিনীগণের সহিত আমোদ প্রমোদ করিতে লজ্জা বোধ করিতেন না। তখন উত্তরপশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যভারতবর্ষ হইতে এক শ্রেণীর গায়িকা ও নর্ত্তকী সহরে আসিত, তাহারা বাইজী এই সম্ভ্রান্ত নামে উক্ত হইত। নিজ ভবনে বাইজীদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া আনা ও তাহাদের নাচ দেওয়া ধনীদের একটা প্রধান গৌরবের বিষয় ছিল। কোন ধনী কোন্ প্রসিদ্ধ বাইজীর জন্য কত সহস্র টাকা ব্যয় করিয়াছেন সেই সংবাদ সহরের ভদ্রলোকদিগের বৈঠকে বৈঠকে ঘুরিত এবং কেহই তাহাকে তত দোষাবহ জ্ঞান করিত না। এমন কি বিদেশিনী ও যবনী কুলটাদিগের সহিত সংসৃষ্ট হওয়া দেশীয় সমাজে প্রাধান্য লাভের একটা প্রধান উপায় স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল।
এই সময়ে সহরের সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ভদ্র গৃহস্থদিগের গৃহে “বাবু” নামে এক শ্রেণীর মানুষ দেখা দিয়াছিল। তাহারা পারসী ও স্বল্প ইংরাজী শিক্ষার প্রভাবে প্রাচীন ধর্ম্মে আস্থাবিহীন হইয়া ভোগসুখেই দিন কাটাইত। ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিঞ্চিৎ বর্ণনা করিব? মুখে, ভ্রুপার্শ্বে ও নেত্রকোলে নৈশ অত্যাচারের চিহ্নস্বরূপ কালিমা রেখা, শিরে তরঙ্গায়িত বাউরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে ফিন্ফিনে কালাপেড়ে ধুতি, অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বনিয়ান, গলদেশে উত্তমরূপে চুনট করা উড়ানী, ও পায়ে পুরু বগ্লস সমন্বিত চিনের বাড়ীর জুতা। এই বাবুর দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাপ আকড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত; এবং খড়দহের মেলা, ও মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইত।
এই সময়ে ও ইহার কিঞ্চিৎ পরে সহরে গাঁজা খাওয়াটা এত প্রবল হইয়াছিল যে সহরের স্থানে স্থানে এক একটা বড় গাঁজার আড্ডা হইয়াছিল। বাগবাজার, বটতলা ও বৌবাজার প্রভৃতি স্থানে এরূপ একটা একটা আড্ডা ছিল। বৌবাজারের দলকে পক্ষীর দল বলিত। সহরের ভদ্রগৃহের নিষ্কর্ম্ম। সন্তানগণের অনেকে পক্ষীর দলের সভ্য হইয়াছিল। দলে ভর্ত্তি হইবার সময়ে এক একজন এক একটী পক্ষীর নাম পাইত এবং গাঁজাতে উন্নতিলাভ সহকারে উচ্চতর পক্ষীর শ্রেণীতে উন্নীত হইত! এবিষয়ে সহরে অনেক হাস্যোদ্দীপক গল্প প্রচলিত আছে। একবার এক ভদ্রসন্তান পক্ষীর দলে প্রবেশ করিয়া কাঠঠোক্রার পদ পাইল। কয়েক দিন পরে তাহার পিতা তাহার অনুসন্ধানে আড্ডাতে উপস্থিত হইয়া যাহাকে নিজ সন্তানের বিষয় প্রশ্ন করেন, সেই পক্ষীর বুলি বলে, মানুষের ভাষা কেহ বলে না! অবশেষে নিজ সন্তানকে এক কোণে দেখিতে পাইয়া যখন গিয়া তাহাকে ধরিলেন, অমনি সে “কড়ড়্ঠক্” করিয়া তাহার হস্তে ঠুক্রাইয়া দিল!
কবি, পাঁচালী ও বুলবুলীর লড়াইএর একটু বর্ণনা আবশ্যক। কবির গান সচরাচর দুইদলে হইত। কোনও একটা পৌরাণিক আখ্যায়িকা অবলম্বন করিয়া দুই দল দুই পক্ষ লইত। মনে করুন একদল হইল যেন কৃষ্ণ-পক্ষ আর এক দল হইল যেন গোপী-পক্ষ। এই উভয় দলে উত্তর প্রত্যুত্তরে এক দলের পর অপর দল গান করিত। যে দল সর্ব্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে লোকের চিত্তরঞ্জন করিতে পারিত তাহাঁদেরই জয় হইত। এই সকল উত্তর প্রত্যুত্তর অধিকাংশ স্থলে পৌরাণিকী আখ্যায়িকা পরিত্যাগ করিয়া ব্যক্তিগত ভাবে দলপতিদিগের উপরে আসিয়া পড়িত এবং অতি কুৎসিত, অভদ্র, অশ্লীল ব্যঙ্গোক্তিতে পরিপূর্ণ থাকিত। অনেক সময়ে যাহার এইরূপ ব্যঙ্গোক্তির মাত্রা যত অধিক হইত সেই তত অধিক পরিমাণে লোকের চিত্তরঞ্জন করিতে পারিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হইতে সহরে হরু ঠাকুর ও তাঁহার চেলা ভোলা ময়রা, নীলুঠাকুর, নিতাই বৈষ্ণর প্রভৃতি কবিওয়ালাগণ প্রসিদ্ধ হইয়াছিল। যে সময়ের কথা বলিতেছি তখনও সহরে অনেক বিখ্যাত কবিওয়ালা ছিল। ইহাদের লড়াই শুনিবার জন্য সহরের লোক ভাঙ্গিয়া পড়িত। কবিওয়ালাদিগের দলে এক একজন দ্রুতকবি থাকিত; তাহাদিগকে সুরকার বা বাঁধনদার বলিত। বাঁধনদারেরা উপস্থিত মত তখনি তখনি গান বাঁধিয়া দিত। বঙ্গের প্রসিদ্ধ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিছুদিন কোনও কবির দলে বাঁধনদারের কাজ করিয়াছিলেন। দ্রুতকবিত্বের একটী দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতেছে। সে সময়ে আণ্টুনী ফিরিঙ্গী নামে একজন কবিওয়ালা ছিল। আণ্টুনী ফরাসডাঙ্গাবাসী একজন ফরাসিসের সন্তান; বাল্যকালে কুসঙ্গে পড়িয়া বহিয়া যায়; ক্রমে প্রতিভাবলে কবিওয়ালা হইয়া উঠে। আণ্টুনী নিজে একজন দ্রুতকবি ছিল। আণ্টুনী একবার গান বাধিল।
“ ও মা মাতঙ্গি, না জানি ভকতি স্তুতি জেতে আমি ফিরিঙ্গী।”
তৎপরক্ষণেই প্রতিদ্বন্দ্বীদলের দলপতি মাতঙ্গীর হইয়া উত্তর দিল;—
“যিশুখ্রীষ্ট ভজ গে যা তুই স্ত্রীরামপুরের গিজ্জেতে,
জাত ফিরিঙ্গী জাবড়জঙ্গী পারবনাক তরাতে। ইত্যাদি।
এরূপ উত্তর প্রত্যুত্তর সব্বদাই হইত। হাপ আকড়াইগুলি অধিকাংশ স্থলে সখের দল ছিল। তাহাতে ভদ্রপরিবারের যুবকগণ দলবদ্ধ হইয়া নানা বাদ্যযন্ত্রসহ গান করিত।
পাঁচালীর ব্যাপার অন্য প্রকার। ইহার কিঞ্চিৎ পরবর্ত্তী সময়ে তাহার বিশেষ প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। তাহাতে এক ব্যক্তি মূল-গায়ক স্বরূপ হইয়া সুর ও তান সহকারে, পদ্যে কোনও পৌরাণিক আখ্যায়িকা বর্ণন করিত ও মধ্যে মধ্যে সদলে সেই ভাবসূচক এক একটা গান করিত। ইহাও-লোকে অতিশয় পছন্দ করিত। লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস, গঙ্গানারায়ণ নস্কর প্রভৃতি কয়েকজন পাঁচালীওয়ালা তৎকালে প্রসিদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু পাঁচালী গায়কদিগের মধ্যে দাশরথী রায়ের নামই সুপ্রসিদ্ধ। ইনি ১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দে বর্দ্ধমান জেলাস্থ বাদমুড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ-পর্জয়ন্ত জীবিত ছিলেন। দশরথী প্রথমে কোনও কবির-দলে বাঁধনদার ছিলেন। একবার বিরোধীদলের নিকট পরাস্ত হইয়া স্বীয় জননীর তাড়নার সে পথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক পাঁচালী গানের পথ অবলম্বন করিয়াছিলেন। এই পাঁচালী এত অভদ্রতা ও অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট ছিল এবং ইহাতে অসঙ্গত অনুপ্রাস ও উপমার এত ছড়াছড়ি থাকিত যে এখন আমাদের আশ্চর্য্য বোধ হয় কিরূপে লোকে তাহাতে প্রীত হইত। কিন্তু তখন লোকে পাঁচালী গান শুনিবার জন্য পাগল হইত।
বুলবুলির লড়াই দেখা ও ঘুড়ী উড়ান সে সময়ে সহরের ভদ্রলোকদিগের একটা মহা আনন্দের বিষয় ছিল। এক একটা স্থানে লোহার জাল দিয়া ঘিরিয়া বহু সংখ্যক বুলবুলী পক্ষী রাখা হইত; এবং মধ্যে মধ্যে ইহাদের মধ্যে লড়াই বাঁধাইয়া দিয়া কৌতুক দেখা হইত। সেই কৌতুক দেখিবার জন্য সহরের লোক ভাঙ্গিয়া পড়িত। ঢাউসঘুড়ী, মানুষঘুড়ী, প্রভৃতি ঘুড়ীর প্রকার ও প্রণালী বহুবিধ ছিল; এবং সহরের ভদ্রপৃহের নিষ্কর্ম্মা ব্যক্তিগণ গড়ের মাঠে গিয়া ঘুড়ীর খেলা দেখিতেন।
সহুরের লোকের ধর্ম্মভাবের অবস্থা তখন কি প্রকার ছিল তাহার কিঞ্চিৎ বিবরণ শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রণীত মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিতে উদ্ধৃত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র উক্তি হইতে তুলিয়া দেওর যাইতেছে।
“বেদের যে সকল কর্ম্মকাণ্ড, উপনিষদের যে ব্রহ্মজ্ঞান, তাহার আদর এখানে কিছুই ছিল না। কিন্তু দুর্গোৎসবের বলিদান, নন্দোৎসবের কীর্ত্তন, দোলযাত্রীর আবীর, রথযাত্রার গোল, এই সকল লইয়াই লোকের মহা আমোদ ছিল। লোকে মনের আনন্দে কালহরণ করিত। গঙ্গাস্নান, ব্রাহ্মণ বৈঞ্চবে দান, তীর্থভ্রমণ, অনশনাদি দ্বারা তীব্রপাপ হইতে পরিত্রাণ পাওরা যায়, পবিত্রতা লাভ করা যায়, পুণ্য অর্জন করা যায়, ইহা সকলের মনে একেবারে স্থির বিশ্বাস ছিল; ইহায় বিপক্ষে কেহ একটিও কথা বলিতে পারিতেন না। অল্পের বিচারই ধর্ম্মের কাষ্ঠাভাব ছিল; অন্নশুদ্ধির উপরেই বিশেষরূপে চিত্তশুদ্ধি নির্ভর করিত। স্বপাক হবিষ্য ভোজন অপেক্ষা আর অধিক পবিত্রকর কর্ম্ম কিছুই ছিল না। কলিকাতার বিষয়ী ব্রাহ্মণেরা ইংরাজদিগের অধীনে বিষয় কর্ম্ম করিয়াও স্বদেশীয়দিগের নিকটে ব্রাহ্মণজাতির গৌরব ও আধিপত্য রক্ষা করিবার জন্য বিশেষ যত্ন করিতেন। তাঁহারা কার্য্যালয় হইতে অপরাহ্নে ফিরিয়া আসিয়া অবগাহন স্নান করিয়া ম্লেচ্ছসংস্পর্শজনিত দোষ হইতে মুক্ত হইতেন এবং সন্ধ্যা-পূজাদি শেষ করিয়া দিবসের অষ্টম ভাগে আহার করিতেন। ইহাতে তাঁহারা সর্ব্বত্র পূজ্য হইতেন এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাঁহদের যশ সর্ব্বত্র ঘোষণা করিতেন। যাঁহার এত কষ্ট স্বীকার করিতে না পারিতেন তাঁহারা কার্য্যালয়ে যাইবার পূর্ব্বেই সন্ধ্যা পূজা হোম সকলই সম্পন্ন করিতেন; এবং নৈবেদ্য ও টাকা ব্রাহ্মণদিগের উদ্দেশে উৎসর্গ করিতেন, তাহাতেই তাঁহাদের সকল দোষের প্রায়শ্চিত্ত হইত। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তখন সংবাদ পত্রের অভাব অনেক মোচন করিতেন। তাঁহারা প্রাতঃকালে গঙ্গাস্নান করিয়া, পূজার চিহ্ন কোশাকুশি হস্তে লইয়া, সকলেরই দ্বারে দ্বারে ভ্রমণ করিতেন এবং দেশ বিদেশের ভালমন্দ সকল প্রকার সংবাদই প্রচার করিতেন। বিশেষতঃ কে কেমন দাতা, শ্রাদ্ধ দুর্গোৎসবে কে কত পুণ্য করিলেন, ইহারই সুখ্যাতি ও অখ্যাতি সর্ব্বত্র কীর্ত্তন এবং ধনদাতাদিগের যশ ও মহিমা সংস্কৃত শ্লোক দ্বারা বর্ণন করিতেন। ইহাতে কেহ বা অখ্যাতির ভয়ে, কেহ বা প্রশংসা লাভের আশ্বাসে, বিদ্যাশূন্য ভট্টাচার্য্যদিগকেও যথেষ্ট দান করিতেন। শূদ্র ধনীদিগের উপরে তাঁহাদের আধিপত্যের সীমা ছিল না। তাঁহারা শিষ্যবিত্তাপহারক মন্ত্রদাতা গুরুর দ্যায় কাহাকেও পাদোদক দিয়া, কাহাকেও পদধূলি দিয়া যথেষ্ট ধন উপার্জ্জন করিতেন। ইহার নিদর্শন অদ্যাপি গ্রামে নগরে বিদ্যমান রহিয়াছে। তখনকার ব্রাহ্মণপণ্ডিতের ন্যায়শাস্ত্রে ও স্মৃতিশাস্ত্রে অধিক মনোযোগ দিতেন এবং তাহাতে যাঁহার যত জ্ঞানানুশীলন থাকিত, তিনি তত মান্য ও প্রতিষ্ঠাভাজন হইতেন। কিন্তু তাঁহাদের আদিশাস্ত্র বেদে এত অবহেলা ও অনভিজ্ঞতা ছিল যে, প্রতি দিন তিনবার করিয়া যে সকল সন্ধ্যার মন্ত্র পাঠ করিতেন, তাহার অর্থ অনেকে জানিতেন কি না সন্দেহ।”একদিকে যখন সহরের এই প্রকার অবস্থা তখন অপরদিকে ঘোর আন্দোলনে সহর কম্পিত হইতেছিল। সে আন্দোলনের প্রথম কারণ রামমোহন রায়ের উত্থাপিত ধর্ম্মান্দোলন। এই যুগ-প্রবর্ত্তক মহাপুরুষের জীবনচরিত সকলেরই বিদিত, তথাপি সংক্ষেপে কিঞ্চিৎ বর্ণন করিতেছিঃ—
১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত খানাকুল কৃষ্ণনগরের সন্নিহিত রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম হয়। তাহার পিতা রামকান্ত রায় শৈশবে তাহাকে নিজভবনে সামান্যরূপ শিক্ষা দিয়া ৯।১০ বৎসর বয়সের সময়ে পারসী ও আরবী ভাষা শিক্ষার জন্য পাটনা নগরে প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি ১৫।১৬ বৎসর পর্য্যন্ত থাকিয়া পারসী ও আরবীতে সুশিক্ষিত হন। এরূপ জনশ্রুতি যে পাটনা বাসকালে কোরাণ পাঠ করিয়া হিন্দুদিগের প্রচলিত পৌত্তলিকতার প্রতি তাহার অশ্রদ্ধা জন্মে। ষোড়শবর্ষ বয়ঃক্রম কালে তিনি ঐ পৌত্তলিক প্রণালীর দোষকীর্ত্তন করিয়া পারসীতে এক গ্রন্থ রচনা করেন। তাহা লইয়া নাকি তাঁহার পিতার সহিত মনান্তর ঘটে। সেই মনান্তর নিবন্ধন তিনি পিতৃভবন পরিত্যাগ পূর্ব্বক সন্ন্যাসী ফকীরদের সঙ্গে দেশভ্রমণে বহির্গত হন। নানা দেশ ও নানা তীর্থ পর্য্যটন করিয়া অবশেষে তিব্বতদেশে উপস্থিত হন। সেখানে বৌদ্ধমতাবলম্বীদিগের কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতার প্রতিবাদ করাতে, তাহারা তাঁহার প্রাণহানি করিতে উদ্যত হয়। তখন তিনি তিব্বতবাসিনী কতিপয় রমণীর সাহায্যে রক্ষা পাইয়া স্বদেশে পলাইয়া আসেন। আসিয়া কাশীধামে সংস্কৃত ভাষার অনুশীলনে নিযুক্ত হন। এই সময়ে তাঁহার পিতার সহিত তাঁহার পুনরায় সম্মিলন হয়। পিতা তাঁহাকে স্বদেশে ফিরাইয়া আনেন এবং বিষয়কর্ম্মে প্রবৃত্ত করেন। পিতার আদেশে দ্বাবিংশতি বর্ষ বয়ঃক্রম কালে তিনি স্বীয় চেষ্টাতে ইংরাজী ভাষা অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করেন এবং ইংরাজগবর্ণমেণ্টের অধীনে চাকুরী স্বীকার পূর্ব্বক রামগড়, ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে কিছুদিন কর্ম্ম করিয়া, অবশেষে রঙ্গপুরের কালেক্টর ডিগ্বী সাহেবের শেরেস্তাদার বা দেওয়ানের পদে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৮০৩ অব্দে রামকান্ত রায়ের মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মুরশিদাবাদে গমন করেন; এবং সেখানে “তহতুল মোহদ্দীন” নামক তাঁহার সুপ্রসিদ্ধ পারসী ভাষাতে লিখিত গ্রন্থ মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন। পরে দশ বৎসর বিষয়কর্ম্ম করিয়া তিনি ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা নগরে স্থায়ী রূপে আসিয়া বাস করেন।
তিনি কলিকাতার আসিবার পূর্ব্বে রঙ্গপুরে থাকিতেই ধর্ম্মসংস্কার বিষয়ে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন। সেখানে বিষয়কর্ম্ম করিয়া যে কিছু অবসর পাইতেন, তাহা নানা সম্প্রদায়ের লোকের সহিত ধর্ম্মালোচনাতে যাপন করিতেন। সায়ংকালে তাঁহার ভবনে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, সাধু, সন্ন্যাসী, মুসলমান মৌলবী, জৈন মারোয়ারী প্রভৃতি অনেক সম্প্রদায়ের লোকের সমাগম হইত। রাজা তাঁহাদের মধ্যে সমাসীন হইয়া সকলের বাগ্বিতণ্ডা শুনিতেন এবং যথাসাধ্য মীমাংসা করিবার চেষ্টা করিতেন। এখানেও তিনি সকল শ্রেণীর নিকটে একেশ্বর বাদ প্রচার করিতেন। এরূপ জনরব যে তিনি রঙ্গপুরে থাকিতে পারস্য ভাষায় একেশ্বর বাদ প্রতিপাদক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তিক রচনা করিয়াছিলেন; এবং বেদান্তদর্শন অনুবাদ করিয়াছিলেন। এই সকল আন্দোলনের ফলস্বরূপ রঙ্গপুরেই তাঁহার এক প্রবল প্রতিদ্বন্দী দেখা দিয়াছিলেন। তাঁহার নাম গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য্য। ইনিও জজ সাহেবের দেওয়ানীপদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। অনেক লোক ইহারও অনুগত ছিল। ইনি রামমোহন রায়ের মত খণ্ডনের উদ্দেশে “জ্ঞানাঞ্জন” নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন, সেই গ্রন্থ ১৮৩৮ সালে কলিকাতাতে সংশোধিত আকারে মুদ্রিত হয়।
ইহা সহজেই অনুমিত হইতে পারে যে, এই সকল আলোচনা ও গ্রন্থ-প্রচার দ্বারা দেশ মধ্যে সর্ব্বত্রই আন্দোলন স্রোত প্রবাহিত হইয়াছিল। সুতরাং তাঁহার কলিকাতা আগমনের পূর্ব্বেই তাঁহার প্রবর্ত্তিত আন্দোলন-তরঙ্গ এখানে পৌঁছিয়াছিল। তিনি কলিকাতাতে পদার্পণ করিবামাত্রই অগ্রসর, উদার, চিন্তাশীল, ও সংস্কার-প্রয়াসী কতিপর ব্যক্তি তাঁহার সহিত সম্মিলিত হইলেন। এতদ্ভিন্ন কতকগুলি বিষয়ী লোক তাঁহাকে পদস্থ ও ক্ষমতাশালী জানিয়া তাহার দ্বারা স্বীয় স্বীয় স্বার্থসিদ্ধি করিবার মানসে তাঁহাকে আশ্রয় করিলেন। তিনি এই সকলকে লইয়া ১৮১৫ সালে “আত্মীয়-সভা” নামে একটী সভা স্থাপন করিলেন। তাহাতে বেদান্তধর্ম্মের ব্যাখ্যা ও বিচার হইত। এই শাস্ত্রীয় বিচারে সহরের অনেক বড় বড় লোক মধ্যে মধ্যে উপস্থিত থাকিতেন।
এ সম্বন্ধে একদিনের ঘটনা বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী নামক একজন মান্দ্রাজ প্রদেশীয় পণ্ডিত কলিকাতাতে আগমন করেন, এবং দম্ভ করিয়া বলেন যে বঙ্গদেশে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ নাই, এজন্য রামমোহন রায় বেদ বেদান্তের দোহাই দিয়া যাহা ইচ্ছা বলিতেছেন; তিনি বেদোক্ত প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করিবেন যে প্রতিমা-পূজাই শ্রেষ্ঠ পূজা। এই সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার করিবার জন্য বিহারীলাল চৌবে নামক উত্তর পশ্চিমাঞ্চলবাসী একজন ব্রাহ্মণের ভবনে এক মহাসভার আয়োজন হয়। সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত রামমোহন রায়ের দলের বিচার হইবে এই বার্ত্তা সহরে প্রচার হইলে, সভাতে লোকে লোকfরণ্য হইয়া গেল। রামমোহন রায় সদলে, হিন্দুসমাজপতি রাধাকান্ত দেব পণ্ডিতগণ সমভিব্যাহারে ও সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী স্বীয় বন্ধুবান্ধব সহ, সভাস্থলে উপস্থিত হইলেন। বৈদিক-শাস্ত্র-জ্ঞানবিহীন দেশীয় ব্রাহ্মণগণ সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সমক্ষে হাঁ করিতে পারিলেন না। কেবল রামমোহন রায়ের সহিত সমানে সমানে বাগ্যু্দ্ধ চলিল। তুমুল শাস্ত্রীয় বিচারের পর সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী পরাভব স্বীকার করিলেন; নিরাকার ব্রহ্মোপাসনাকে শ্রেষ্ঠ উপাসনা বলিয়া স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন। ‘রামমোহন রায় সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীকে বিচারে পরাস্ত করিয়াছেন,’ এই বার্ত্তা যখন তাড়িত বার্ত্তার ন্যায় সহরে ব্যাপ্ত হইল, তখন তাঁহার বিপক্ষগণের ক্রোধ ও আক্রোশ দশগুণ বাড়িয়া গেল।
একদিকে যেমন আত্মীয় সভার অধিবেশন ও শাস্ত্রীয় বিচারাদি চলিল, অপর দিকে তেমনি একেশ্বরবাদ প্রতিপাদন করিয়া গ্রন্থের পর গ্রন্থ প্রকাশিত হইতে লাগিল।
আত্মীয় সভা স্থাপন করিয়া রামমোহন রায় কিরূপ উৎসাহের সহিত প্রচলিত ধর্ম্ম ও সমাজ সংস্কারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ এইমাত্র উল্লেখ করা যাইতে পারে যে ১৮১৫ হইতে ১৮২০ খৃষ্টাব্দ এই পাচ বৎসরের মধ্যে তিনি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি প্রকাশ করিলেন। বেদান্তদর্শনের অনুবাদ ১৮১৫; বেদান্তসার, এবং কেন ও ঈশোপনিষদের অনুবাদ, ১৮১৬; কঠ, মুণ্ডক ও মাণ্ডুকোপনিষদের অনুবাদ, এবং হিন্দু একেশ্বরবাদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ ইংরাজী ও বাঙ্গালাতে ১৮১৭; সতীদাহ সম্বন্ধীয় বিচার পুস্তক, বৈষ্ণব গোস্বামীর সহিত বিচারপুস্তক, গায়ত্রীর ব্যাখ্যা পুস্তক, এবং সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তকের ইংরাজী অনুবাদ—১৮১৮; সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তক, মুণ্ডক ও কঠোপনিষদের ইংরাজী অনুবাদ—১৮১৯। এই সকল গ্রন্থের উত্তরে তাঁহার বিরোধিগণ তাঁহার প্রতি অভদ্র কটূক্তিপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করিতে লাগিলেন। রামমোহন রায় অপরাজিতচিত্তে ঐ সমুদয় কটূক্তি সহ্য করিতে লাগিলেন।
রামমোহন রায়ের ধর্ম্মবিচার প্রথমে হিন্দুদিগের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। তিনি বেদান্তদর্শনাদি অনুবাদিত ও মুদ্রিত করিয়া স্বদেশীয়দিগের মধ্যে বিতরণ করিতেছিলেন, এবং আত্মীয় সভার অধিবেশনে সেই সকল বিষয়ের বিচার করিতেছিলেন। তন্নিবন্ধন তাঁহার প্রতি স্বদেশবাসিগণের বিদ্বেষ এতদূর বর্দ্ধিত হইয়াছিল, যে ১৮১৭ সালে যখন মহাবিদ্যালয় বা হিন্দুকালেজ স্থাপিত হয়, তখন সহরের ভদ্রলোকগণ তাঁহার সহিত এক কমিটীতে কার্য্য করিতে সম্মত হন নাই। রামমোহন রায় উক্ত বিদ্যালয়ের কমিটী হইতে তাড়িত হইয়া নিজে ধর্ম্মানুমোদিত শিক্ষা দিবার জন্য একটী বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন। এই সকল আন্দোলন ত পূর্ব্ব হইতেই চলিতেছিল, ইহার উপরে আবার ১৮২০ সালে রামমোহন রায় যীশুর উপদেশাবলী নামে এক পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮২১ খ্রীষ্টাব্যে রামমোহন রায়ের সংশ্রবে আসিয়া বাপ্তিষ্ট (Bapitst) সম্প্রদায়ভুক্ত মিশনারি মিষ্টার উইলিয়াম আডাম খ্রীষ্টীয় ত্রীশ্বরবাদ পরিত্যাগ পূর্ব্বক একেশ্বরবাদ অবলম্বন করেন। এই প্রসঙ্গে শ্রীরামপুরের মিশনারিগণের সহিত রামমোহন রায়ের বিবাদ উপস্থিত হয়। তিনি উপর্য্যুপরি একেশ্বরবাদ প্রতিপাদক কয়েক খানি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৮২৬ সালে রামতনু বাবু যখন বিদ্যারম্ভ করিলেন, তখন রামমোহন রায় হিন্দু ও খ্রীষ্টান উভয় দলের অপ্রিয় ও উভয়ের কটূক্তির লক্ষ্যস্থল হইয়া রহিয়াছিলেন। বাবুদের বৈঠকখানাতে, রাজপথে, লোক সমাগম স্থলে, এমন কি স্কুলের বালকদিগের মধ্যেও এই সকল বিষয়ে কথাবার্ত্তা ও বাগ্বিতণ্ডা সর্ব্বদা চলিত।
এতদ্ভিন্ন তখন সহরের লোকের চিত্তকে উত্তেজিত করিবার আর একটী কারণ উপস্থিত হইয়াছিল। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে কমিটী অব্ পবলিক ইনষ্ট্রকশন্ নামে একটা কমিটী স্থাপিত হয়। তাহার বিবরণ পরে দেওয়া যাইবে। ঐ কমিটী তদানীন্তন প্রাচ্যশিক্ষা-পক্ষপাতীদিগের পরামর্শে কলিকাতাতে একটা সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করা স্থির করেন। রাজা রামমোহন রায় দেখিলেন এদেশীয়দিগের শিক্ষার জন্য যে এক লক্ষ টাকা নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহার সমগ্র কেবল প্রাচ্যশিক্ষার উৎসাহদানেই ব্যয়িত হইতে চলিল। তখন তিনি এই কার্য্যের প্রতিবাদ করিয়া তদানীন্তন গবর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্ষ্ট বাহাদুরকে এক পত্র লিখিলেন। ঐ পত্রে তিনি প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিলেন এদেশীয়দিগকে ইংরাজী ভাষা ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষা না দিলে, ইহাদের জাতীয় জীবনের উন্নতি হইবে না। এই বিষয় লইয়া রাজপুরুষদিগের মধ্যে এবং দেশের বড়লোকদিগের মধ্যে দুইটী দল হইয়া পড়িল। একদল বলিতে লাগিলেন প্রাচীন যাহা ছিল তাহাই ভাল, তাহাই রাখিতে হইবে; আর এক দল বলিতে লাগিলেন, প্রাচীনের কিছুই ভাল নয়, যাহা কিছু প্রাচ্য সকলি, মন্দ, যাহা কিছু প্রতীচ্য সকলি ভাল। এই দ্বিতীয় দল এই সময় হইতে বঙ্গদেশে প্রবল হইয়া উঠিল। ইহার বিবরণ পরে দেওয়া যাইবে। যাহা হউক এই ১৮২৬ সালে এই উভয় দলের বিবাদে কলিকাতা সমাজ অতিশয় আন্দোলিত ছিল।
আর এক কারণে তখন সহরের লোকের মন অতিশয় উত্তেজিত ছিল। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে লর্ড আমহার্ষ্ট গবর্ণর জেনেরলের পদে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৮২৫ সালের অক্টোবর মাসে কলিকাতার সন্নিকটেই এক হত্যাকাণ্ড ঘটে, তাহাতে হিন্দুবিধবাগণের সহমরণ প্রথা নিবারণ সম্বন্ধে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হয়, এবং সহমরণ প্রথা নিবারিত না হইলেও তৎসম্বন্ধ কতকগুলি নিয়ম স্থাপিত হয়। লর্ড আমহার্ষ্টের পত্নী একজন মনস্বিনী ও সুলেখিকা স্ত্রীলোক ছিলেন। তিনি প্রতিদিনের ঘটনাবলীর দৈনিক লিপি লিখিয়া রাখিতেন। তদ্দ্বারা সে সময়কার অনেক কথা জানিতে পারা যায়। সেই দৈনিক লিপি হইতে উক্ত হত্যাকাণ্ডের নিম্নলিখিত বিবরণ উদ্ধৃত হইতেছেঃ—
“A young man having died of cholera his widow resolved to mount the funeral pile. The usual preparations were made, and the licences procured from the magistrate. The fire was lighted by the nearest relations; when the flame reached her, however, she lost courage, and amid a volume of smoke and the deafening screams of the mob, tomtoms, drums &c. she contrived to slip down unperceived, and gained a neighbouring jungle. At first she was not missed; but when the smoke subsided, it was discovered she was not on the pile. The mob became furious and ran into the jungle to look for the unfortunate young creature, dragged her down to the river, put her into a dingy, and showed off to the middle of the stream, where they forced her violently overboard and she sank to rise no more”
এই ঘটনাতে কলিকাতাবাসী ইংরাজগণ অতিশয় উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন; এবং রামমোহন রায়ের দলস্থ ব্যক্তিগণ সতীদাহ নিবারণের জন্য আবার আন্দোলন উপস্থিত করিলেন। লর্ড আমহার্ষ্ট ব্রহ্মযুদ্ধে অনেকের, বিশেষতঃ বিলাতের প্রভুদিগের,অপ্রিয় হইয়াছিলেন, সুতরাং তিনি একেবারে এ প্রথা রহিত করিতে সাহসী হইলেন না; কিন্তু কতকগুলি কঠিন নিয়ম স্থাপন করিলেন। সেগুলি এই—(১ম) কোনও সহগমনার্থিনী বিধবাকে স্বামীর দেহের সঙ্গে ভিন্ন অন্যরূপে দগ্ধ করা হইবে না, বা অপর কোনও প্রকারে হত্যা করা হইবে না; (২য়) সহগমনার্থিনী বিধবাগণের অপরের দ্বারা মাজিষ্ট্রেটের অনুমতি পত্র লইলে চলিবে না, নিজে মাজিষ্ট্রেটের সমক্ষে উপস্থিত হইয়া অভিপ্রায় জানাইতে হইবে ও অনুমতি লইতে হইবে, (৩য়) সতীর সহমরণে সহায়তাকারী কোনও ব্যক্তি গবর্ণমেণ্টের চাকুরী পাইবে না; (৪র্থ) সহমৃতা বিধবার মৃতপতির কোনও সম্পত্তি থাকিলে তাহা গবর্ণমেণ্টের বাজেয়াপ্ত হইবে।
এস্থলে উল্লেখ করা কর্ত্তব্য যে সহমরণ নিবারণের চেষ্টা এই প্রথম নহে। ইহার কিঞ্চিৎ ইতিবৃত্ত আছে।
এদেশে ইংরাজ রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সময় হইতেই ইংরাজ রাজপুরুষগণের দৃষ্টি এই নৃশংস প্রথার উপরে পতিত হইয়াছিল। কিন্তু প্রথম প্রথম এদেশের প্রজাগণের মনোরঞ্জন করা তাঁহাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল; পাছে এদেশের লোকের ধর্ম্ম বা সামাজিক বিষয়ে হস্তার্পণ করিলে বিদ্রোহাগ্নি প্রজ্বলিত হর এই ভয়ে তাঁহারা সর্ব্বদা সংকুচিত থাকিতেন; সুতরাং তাঁহাদের চক্ষের সমক্ষে শত শত বিধবাকে মৃতপতির চিতানলে দগ্ধ করা হইত, তাহা তাঁহারা দেখিয়াও দেখিতেন না। এমন কি ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ইংরাজদিগের কাশীমবাজারস্থ কুঠির সমক্ষেই রামচাদ পণ্ডিত নামক একজন মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের অষ্টাদশ বর্ষীয়া বিধবা পত্নী সহমৃতা হন। তখন সার ফ্রান্সিস রসেল কুঠীর অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি, তাহার পত্নী, ও পরবর্তীকাল-প্রসিদ্ধ মিষ্টর হলওয়েল সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। হলওয়েল (Holwell) স্বচক্ষে যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহা লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। শুনিতে পাওয়া যায় লেডী রসেল (Lady Russel) নাকি ঐ রমণীকে বাঁচাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার সকল প্রয়াস ব্যর্থ হয়। ইংরেজকর্ম্মচারিগণ দাড়াইয়া দেখিলেন, কিন্তু কিছু বলিতে সাহসী হইলেন না।
এই ভাবে বহুদিন গেল। অবশেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমি একটু দৃঢ়তর রূপে স্থাপিত হইলেই এই প্রথা নিবারণের জন্য কিছু করা উচিত বলিয়া তাঁহারা অনুভব করিতে লাগিলেন। ১৮০৫ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই জুলাই গবর্ণর জেনারেলের প্রাইভেট সেক্রেটারি বিধবাদিগকে যাহাতে বলপূর্ব্বক দাহ করা না হয় তাহার উপায় বিধান করিবার জন্য তৎকালীন নিজামত আদালতকে এক পত্র লিখিলেন। এথানে বলা আবশ্যক যে তৎকালে গবর্ণর জেনেরাল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁহার আইনাদি প্রণয়ন করিবার অধিকার ছিল না। দেওয়ানী আইনাদি প্রণয়ন করিতে হইলে তাঁহাকে সদর দেওয়ানী আদালতের সম্মতি ও ফৌজদারী কিছু করিতে হইলে নিজামত আদালতের অনুমতি লইতে হইত। কারণ উক্ত উভয় আদালত ইংলণ্ডাধিপতির অধীন ছিল এবং তাঁহাদের অনুমতি ইংলণ্ডাধিপতির অনুমতি বলিয়া পরিগণিত হইত। তদনুসারে তদানীন্তন গবর্ণর জেনেরাল ঐ প্রশ্ন নিজামত আদালতের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন। নিজামত আদালতে ঘনশ্যাম ভট্টাচার্য্য নামে একজন কোর্ট পণ্ডিত ছিলেন। তাঁহাকে সহমরণ বিষয়ে কতকগুলি প্রশ্ন করা হইল। স্বনাম ভট্টাচার্য্য বলিলেন বিধবাকে পতির চিতার সহিত বাঁধিয়া দেওয়া শাস্ত্র ও সদাচার উভয়-বিরুদ্ধ। ইহার পরে বহুদিন পর্য্যন্ত এবিষয়ে আর কিছু করা হইল না।
১৮১২ খৃষ্টাব্দের ৩রা আগষ্ট বুন্দেলখণ্ডের মাজিষ্ট্রেট কয়েকটী সহমরণের কথা নিজামত আদালতের গোচর করিয়া তাহদের অভিপ্রায় জানিবার ইচ্ছা করিয়া পত্র লিখিলেন। তদনুসারে ৩রা সেপ্টেম্বর নিজামত আদালতের রেজিষ্ট্রার গবর্ণর জেনেরালকে বিধবাদিগের প্রতি অত্যাচার নিবারণ প্রার্থনীয় বলিয়া পত্র লিখিলেন। ইহার পরেও কয়েক বৎসর অতীত হইয়া গেল। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে গবর্ণমেণ্ট অব ইণ্ডিয়া এই প্রথা বিষয়ে বিশেষ অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এই অনুসন্ধান কার্য্য শেষ হইলে ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে কতকগুলি রাজবিধি প্রণীত হইল। এই আদেশ প্রচার হইল যে সহগমনার্থিনী বিধবাকে অগ্রে জেলার মাজিষ্ট্রেট বা অন্য কোনও রাজকর্ম্মচারীর নিকট অনুমতি পত্র লইতে হইবে। এই বিধি প্রচার হইলেই হিন্দুসমাজ মধ্যে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। বহুসহস্র লোকের স্বাক্ষর করাইয়া পুর্ব্বোক্ত রাজবিধি রহিত করিবার জন্য এক আবেদন পত্র প্রেরিত হইল। এই সময়ে রামমোহন রায় এই বিবাদের রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হইলেন। শাস্ত্রানুসারে সহমরণ যে হিন্দু বিধবার শ্রেষ্ঠ কর্ত্তব্য নয় তাহা প্রদর্শন করিবার জন্য তিনি লেখনী ধারণ করিলেন। তিনি বাঙ্গালা ও ইংরাজীতে পুস্তিক লিখিয়া প্রচার করিলেন; এবং পূর্ব্বোক্ত আবেদন পত্রের প্রতিবাদ করিয়া ও গবর্ণমেণ্টকে ধন্যবাদ দিয়া এক আবেদন পত্র গবর্ণর জেনারেলের নিকট প্রেরণ করিলেন। ইহাও প্রাচীন সমাজের লোকের তাঁহার প্রতি খড়্গহস্ত হইবার একটা প্রধান কারণ হইল।
১৮২৫ সালের আন্দোলনে পুরাতন দলাদলিটা আবার পাকিয়া উঠিল। রামমোহন রায়ের দল ও রাধাকান্ত দেবের দল দুই দলে আবার তর্ক বিতর্ক চলিল। রামমোহন রায়ের “কৌমুদী” ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “চন্দ্রিকা” সতীদাহের বিপক্ষে ও স্বপক্ষে প্রবন্ধ প্রকাশ করিতে লাগিল। এরূপ শুনিতে পাওরা যায় এই সময়ে রামমোহন রায়ের নামে গান বাঁধিয়া লোকে পথে পথে গাইত। সেই গীত স্কুলের বালকদিগের মুখে মুখে ঘুরিত। সে সঙ্গীতের কিয়দংশ এই,—সুন্নাই মেলের স্কুল,
বেটার বাড়ী থানাকুল,
বেটা সর্বনাশের মূল
ও তৎসৎ বলে বেটা বানিয়েছে স্কুল।
ও সে জেতের দফ, করলে রফা
মজালে তিন কুল।
এই সময়ে কলিকাতা সমাজ থে দুই বিরোধী দলে বিভক্ক হইজাছিল, তাহার প্রধান প্রধান কতিপয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ করিলেই তদানীন্তন সামাজিক অবস্থা৷ সকলের হৃদয়ঙ্গম হইবে। রামমোহন রায়ের দলের প্রধান। টাকীর কালীনাথ রায়, (মুন্সী) মথুরানাথ মল্লিক, রাজকৃষ্ণ সিংহ, তেলিনী পাড়ার অন্নদাপ্রসাদ। বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতি। এতদ্ভিন্ন তারচিাদ চক্রবর্তী, চন্দ্রশেখর দেব প্রভৃতি কতিপয় ইংরাজীশিক্ষিত ব্যক্তিও তাহার অমুচর ছিলেন। প্রাচীন হিন্দুদলে রাধাকান্ত দেব, মতিলাল শীল, রামকমল সেন প্রভৃতি সহরের প্রায় সমগ্র বড়লোক ছিলেন। ইহাদের কাহার কাহারও সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত দিয়া এ পরিচ্ছদের উপসংহার করিতেছি।
দ্বারকানাথ ঠাকুর।
ইংরাজদিগের প্রাচীন দুর্গ বিনষ্ট হওয়ার পর তাহারা বর্ধন আবার গোবিন্দপুর গ্রাম লইয়া নূতন ফোর্ট উইলিয়াম নামক হর্গ নির্মাণ করিতে আরম্ভ করেন, তথন জয়রাম ঠাকুর নামক একজন। দেশীয় ভদ্রলোকের উল্লেখ দেখা যায়। দ্বারকানাথ এই জম্বরাম ঠাকুরের বংশজাত। ১৭৯৪ সালে ইহার জন্ম হয়। ইনি বাল্যকালে (Sherburne) সাধুগণ নামক একজন ফিরিঙ্গীর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন; এতদ্ভিন্ন পারসী ও। আরবী ভাষাতেও ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন। যৌবনের প্রারম্ভে ফাংসন (Fergusson) নামক একজন বারিষ্টারের নিকট আইন শিক্ষা করেন। ইহাতে আইন আদালতের কার্য্যকলাপ বিষয়ে পারদর্শিতা জন্মিয়াছিল। তৎপরে তিনি কিছু দিন নীল ও রেশমের রপ্তানীর কাজ করেন। অবশেষে নিমকের এজেন্ট প্লাউডেন (Plowden) সাহেবের দেওয়ানী পদে প্রতিষ্ঠিত হন। তখন নিমক মহলের দেওয়ানী। লইলেই লোকে দুইদিনে ধনী হইয়া উঠিত। এইরূপে সহরের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ধনী হইয়াছিলেন। দ্বারকানাথ ও কতিপর বৎসরের মধ্যে ধনবান হইয়া বিষয় কাৰ্য্য হইত্বে অবসৃত হন; এবং ‘স্কার টেগোর এও কোং নামক এক কোম্পানি স্থাপন করিয়া স্বাধীন বণিকরাপে কাৰ্য্য আরম্ভ করেন। তদ্ভিন্ন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’ নামে এক ব্যাঙ্কের প্রধান। নিৰ্বাহকৰ্ত্তী হন। সহৃদয়তাবদান্ত্যতা প্রভৃতি সদগুণে তাহার সমকক্ষ লোক কলিকাতাতে ছিল না॥ তাহার উপার্জন শক্তি যেমন অস্তৃত, দানশক্তি ও তেমনি অস্তৃত ছিল। ১৮২৬ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুর সহরের সভ্রাত্ত ধনীদের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি এবং রামমোহন রায়ের দক্ষিণ হস্তস্বরূপ। ছিলেন। ইহার অপরাপর কীৰ্ত্তি পরে উল্লিখিত হইবে। ১৮৪৬ সালে ইংলণ্ডে ইহার মৃত্যু হয়।
রাধাকান্ত দেব।
ইনি পরে শব্দকল্পদ্রুম প্রণেতা রাজা তার রাধাকান্ত দেব নামে। প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন। ইনি লর্ড ক্লাইবের মুন্সী নবকৃষ্ণ দেবের প্রতিষ্ঠিত কলিকাতার সভাবাজারের রাজবংশসম্ভত গোপীমোহন দেবের পুত্র। তাহার পিতা গোপীমোহন দেব দেশের কল্যাণকর অনেক কার্যে সহায়তা করিতেন। এই সভাবাজারের রাজবংশ চিরদিন কলিকাতা হিন্দু সমাজের অগ্রণী হইয়া রহিয়াছেন। ১৭৯৩ সালে রধোকান্ত দেবের জন্ম হয়। ইনি ইংরাজী, পারসী, আরবী ও সংস্কৃতে বিশেষ বুৎপন্ন হইয়াছিলেন। রামমোহন রারের ধর্মান্দোলন। উপস্থিত হইলে কলিকাতার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ ইহাকেই তাহাদের প্রতিপালক ও সনাতন হিন্দুধর্মের রক্ষকরূপে বরণ করেন। তিনিও সেই কাৰ্য্যে দেহ মন নিয়োগ করিয়াছিলেন। কিন্তু তদ্ব্যতীত দেশহিতকর। অপরাপর কার্য্যের সহিত ও তাঁহার যোগ ছিল। হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৭। ১৮১৮ সালে যখন স্কুলবুক সোসাইটী ও স্কুল। সোসাইটীদ্বয় স্থাপ্লিত হয়, তখন তিনি উৎসাহদাতাদিগের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি ও দ্বিতীয় সভার অতর সম্পাদক ছিলেন। বর্ষে বর্ষে নিজের ভবনে নবপ্রতিষ্ঠিত ফুল সকলের বালক দিগকে সমবেত করিয়া পারিতোষিক বিতরণ করিতেন; এবং স্ত্রীশিক্ষার উন্নতি বিধানের জন্য নিজে “স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক' নামে এক গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। এই ১৮২৬ সালে কলিকাতা সহরে। সনাতন হিন্দুধর্মের রক্ষকরূপে অগ্রণী হইয়া তিনি দণ্ডায়মান। পরে ইনি রাজসম্মান সূচক তার উপাধি প্রাপ্ত হইয়া, বছকাল হিন্দুসমাজপতির সন্মনিত. পদে . প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া, ১৮৬৭ সালে ৭৫ বৎসর বয়সে বৃন্দাবন ধামে মানব-বাঁীলা সম্বরণ "
, করেন।রামকমল সেন।
ইনি সুবিখ্যাত কেশবচন্দ্র সেন মহাশয়ের পিতামহ। ইনি সম্ভবতঃ ১৭৯৫ কি ১৭৯৬ সালে গঙ্গাতীরবর্তী গৌরীভা গ্রামে। বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। রামকমলের পিতা হুগলীতে ৫০ টাকা বেতনে শেরেস্তাদারী করিতেন। রামকমল ১৮০১ সালে শিক্ষার জষ্ঠ্য কলিকাতায় আগমন করেন। ১৮০৪ সালে ডাক্তার হন্টারের (IDrWilliam Hunter) প্রতিষ্ঠিত হিন্দুস্থানী প্রেসে একটী কন্ব পান। ১৮১০ সালে ডাক্তার লীডেন (Lewdien) ও ডাক্তার এইচ, এইচ, উইলসন (H. l. Wilson) ঐ প্রেসের সত্বাধিকারের অংশী হন। ১৮৯১ সালে ডাক্তার হন্টার ও ডাক্তার। লীডেন। কলিকাতা ত্যাগ করিয়া জাবা দ্বীপে গমন করেন; তথন ডাক্তার উইলসন। হিন্দুস্থানী প্রেসের একমাত্র সত্বাধিকারী থাকেন; এবং রামকমল প্লাহার। মানেজার নিযুক্ত হন। ১৮১২ সালে রামকমল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে একটিী কম পান॥ ১৮১৮। ১৮১৯ সালে ডাক্তার উইলসনের সাহায্যে রামকমল এসিয়াটীক সোসাইটীর কেরাণীগিরি কৰ্ম্মে নিযুক্ত হন। পরে তিনি নিজের প্রতিভাপরিশ্রম ও কার্য্যদক্ষতার গুণে উক্ত সোসাইটীর দেশীয় সম্পাদক ও কমিটীর সভ্যরূপে মনোনীত হইয়াছিলেন। অবশেষে তিনি টাকশালের দেওমান ও বেঙ্গল ব্যাঙ্কের কোষাধ্যক্ষ হইয়াছিলেন। তাহার সময়ে যে যে দেশহিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠান হয়, তাহার অনেকের সঙ্গে তাহার যোগ ছিল। ১৮১৭ সালে হিন্দুকালেজ স্থাপিত হইলে তিনি তাহার কমিটীতে ছিলেন। কিছুদিন নবপ্রতিষ্টিত সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতা করিয়াছিলেন। বর্তমান। নেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে লর্ড উইলিরাম বেন্টিঙ্ক যে মেডিকেল কমিশন নিয়োগ করেন তিনি তাহার একজন সভ্য ছিলেন। এতদ্ভিন্ন উচ্চশ্রেণীর একখানি বৃহৎ ইংরাজী অভিধান প্রকাশ করিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন। ১৮৪৪ খ্রীষ্টাকে ইহার দেহান্ত হয়।
মতিলাল শীল।
১৭৯১ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতার কলুটোরা নামক স্থানে যুবর্ণবণিক কুলে ইহার জন্ম হয়। ইহার পিতা চৈতন্যচরণ শীল কাপড়ের ব্যবসায় করিতেন। ইনি পঞ্চম বৰ্ষ। বয়সে পিতৃহীন হইয়া ভালরূপ বিদ্যা শিক্ষা করিরার সুযোগ পান নাই। তবে গুরুমহাশয়ের পাঠশালে বাঙ্গালা ও শুভঙ্করী উত্তমরূপ শিখিয়াছিলেন। সপ্তদশ বর্ণ বয়ঃক্রম কালে কলিকাতার আরতির বাগানের মোহনচাঁদ দের কন্যার সহিত ইহার বিবাহ হয়। এই বিবাহই ইঁহার সমুদয় ভাবী উন্নতির সহায় হইয় উঠে। তিনি নিজ শ্বশুরের সহিত তীর্থভ্রমণ উদ্দেশে যাত্রা করিয়া উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে নানা দেশ পরিভ্রমণ পূর্ব্বক প্রভূত অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া আসেন। ফিরিয়া আসিয়া ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে একটা সামান্য কার্য্যে নিযুক্ত হন। সেখানে থাকিতে থাকিতে ১৮১৯ সালে নিজে স্বাধীন ভাবে বোতল ও কর্কের ব্যবসা আরম্ভ করেন। এই ব্যবসায়ে অনেক লাভ হয়। অল্পদিনের মধ্যেই কেল্লার কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া বিদেশাগত জাহাজ সকলের মুচ্ছুদিগিরি কর্ম্ম আরম্ভ করেন। ইহাতে তিনি প্রভূত ধনশালী হইয়াছিলেন। ক্রমে র্তাহার কাজ ও তৎসঙ্গে ধনাগমও বাড়িতে থাকে। অবশেষে তিনি কলিকাতার কোম্পানির কাগজের বাজারের হর্ত্তা কর্তা বিধাতা হইয়া উঠেন। কিন্তু তাহার প্রশংসার বিষয় এই তিনি ধনার্জনের জন্য অসৎপন্থা কখনও অবলম্বন করেন নাই। তিনি শিষ্ট, মিষ্টভাষী ও পরোপকারী লোক ছিলেন। ১৮৪২ অব্দে একটা অবৈতনিক কলেজ স্থাপন করেন। তাহা এখনও তাহার বদান্যতার প্রমাণ স্বরূপ রহিয়াছে। ১৮৫৪ সালে ৬৩ বৎসর বয়সে তাহার মৃত্যু হয়। এই ১৮২৬ সালে তিনি একজন সহরের উন্নতিশীল ধনী ও নেতাদিগের মধ্যে প্রধান-শ্রেণীগণ্য ছিলেন। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সে সময়ে দুই দলে বিভক্ত হইয়া কলিকাতা সমাজকে মহা আন্দোলন ক্ষেত্র করিয়া তুলিয়াছিলেন। তখন ব্রহ্মোপাসনা স্থাপন, ইংরাজীশিক্ষা প্রচলন, ও সহমরণ নিবারণ, এই তিনট আলোচনার বিষয় ছিল; এবং স্কুলের বালকগণও এই আলোচনার আবর্ত্তের মধ্যে আকৃষ্ট হইয়া পড়িত। এই জন্য এই সকলের বিশেষ ভাবে উল্লেখ করিলাম। বঙ্গদেশের নবযুগের সূচনাক্ষেত্রে, এই আন্দোলনের রঙ্গভূমিতে, বালক রামতনু কলিকাতায় আসিয়া বিদ্যারম্ভ করিলেন। বালক রামতনু যদিও তখন এই সমুদর গোলমালের ভিতরে প্রবেশ করিতে পারিতেন না, তথাপি পথে ঘাটে যে বাগ্বিতণ্ডা, যে আন্দোলন চলিত তিনি কিয়ংপরিমাণে তাহার অংশী না হইয়াও থাকিতে পারিতেন না। বরংপ্রাপ্ত ব্যক্তিদিগের মধ্যে যেমন রামমোহন রায়ের দল ও রাধাকান্ত দেবের দল দুই দল হইয়াছিল, তেমনি স্কুলের বালক দিগের মধ্যেও দুই দল হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে সর্ব্বদা তর্ক বিতর্ক হইত; এবং কখন কখনও মুখামুখি ছাড়িয়া হাতাহাতি পর্য্যন্ত দাঁড়াইত।
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন উইলিয়াম কেরি
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন কৃত্তিবাস ওঝা
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন কালিদাস
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন উইলিয়াম শেকসপিয়র
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন রামমোহন রায়
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন কার্তিকেয় চন্দ্র রায়
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন দাশরথি রায়
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছেন গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য্য
- যে রচনায় উল্লিখিত হয়েছে জ্ঞানাঞ্জন