রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ/নবম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

নবম পরিচ্ছেদ

বিদ্যাসাগর-যুগ।

 এক্ষণে আমরা বঙ্গসমাজের ইতিবৃত্তের যে যুগে প্রবেশ করিতেছি, তাহার প্রধান পুরুষ পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এককালে রামমোহন রায় যেমন শিক্ষিত ও অগ্রসর ব্যক্তিগণের অগ্রণী ও আদর্শপুরুষরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন এবং তাঁহার পদভরে বঙ্গসমাজ কাঁপিয়া গিয়াছিল, এই যুগে বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই স্থান অধিকার করিরাছিলেন। মানব-চরিত্রের প্রভাব যে কি জিনিস, উগ্র-উৎকট-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তেজীয়ান পুরুষগণ ধনবলে হীন হইয়াও যে সমাজমধ্যে কিরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন, তাহা আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিয়া জানিয়াছি। সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণের সস্তান, যাঁহার পিতার দশ বার টাকার অধিক আয় ছিল না, যিনি বাল্যকালে অধিকাংশ সময় অৰ্দ্ধাশনে থাকিতেন, তিনি এক সময় নিজ তেজে সমগ্র বঙ্গসমাজকে কিরূপ কাঁপাইয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিলে মন বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়। তিনি এক সময়ে আমাকে বলিয়াছিলেন—“ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতাশুদ্ধ পায়ে টক্‌ করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” আমি তখন অনুভব করিয়াছিলাম, এবং এখনও অনুভব করিতেছি যে তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা সত্য। তাঁহার চরিত্রের তেজ এমনি ছিল যে, তাঁহার নিকট ক্ষমতাশালী রাজারাও নগণ্য ব্যক্তির মধ্যে। সেই চরিত্রবীর পুরুষের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত দিয়া এই পরিচ্ছেদ আরম্ভ করিতেছি, কারণ একদিকে লাহিড়ী মহাশয়ের সহিত অকপট মিত্রতা সূত্রে তিনি বদ্ধ ছিলেন, অপর দিকে বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ ইতিবৃত্ত গঠন বিষয়ে তিনি এই যুগের সর্বপ্রধান পুরুষ ছিলেন।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮২০ সালে, মেদিনীপুর জেলার অন্তঃপাতী বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যে ব্রাহ্মণকুলে তিনি জন্মিলেন, তাঁহারা গুণগৌরবে ও তেজস্বিতার জন্য সে প্রদেশে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার পিতামহ রামজয় তর্ক্কভূষণ কোনও পারিবারিক বিবাদে উত্যক্ত হইয়া স্বীয় পত্নী দুর্গাদেবীকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক কিছুকালের জন্য দেশান্তরী হইয়া গিয়াছিলেন। দুর্গাদেবী নিরাশ্রয় হইয়া বীরসিংহ গ্রামে স্বীয় পিতা উমাপতি তর্ক্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠপুত্র ঠাকুরদাস সেই সময় হইতে ঘোর দারিদ্র্যে বাস করিয়া জীবন-সংগ্রাম আরম্ভ করেন। তাঁহার বয়ঃক্রম যখন ১৫ বৎসর হইবে তখন জননীর দুঃখনিবারণার্থ অর্থোপার্জ্জনের উদ্দেশে কলিকাতাতে আগমন করেন। এই অবস্থাতে তাঁহাকে দারিদ্র্যের সহিত যে ঘোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল, তাঁহার হৃদয়বিদারক বিবরণ এখানে দেওয়া নিম্প্রয়োজন। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে অনেক দিনের পর, অনেক ক্লেশ ভূগিয়া, অবশেষে একটা ৮ টাকা বেতনের কর্ম্ম পাইয়াছিলেন। এই অবস্থাতে গোঘাটনিবাসী রামকান্ত তর্ক্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবর্তী দেবীর সহিত ঠাকুরদাসের বিবাহ হয়, ঈশ্বরচন্দ্র ইহাদের প্রথম সন্তান।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় শৈশবে কিয়ৎকাল গ্রাম্যপাঠশালাতে পড়িয়া পিতার সহিত কলিকাতাতে আসেন। কলিকাতাতে আসিয়া তাঁহার পিতার মনিব
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বড়বাজারের ভাগবতচরণ সিংহের ভবনে পিতার সহিত বাস করিতে আরম্ভ করেন। পিতাপুত্রে রন্ধন করিয়া খাইতেন। অতি কষ্টে দিন যাইত। এই সময়ে ভাগবতচরণ সিংহের কনিষ্ঠা কন্যা রাইমণি তাঁহাকে পুত্রাধিক যত্ন করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোমল হৃদয় কোনও দিন সে উপকার বিস্মৃত হয় নাই। বৃদ্ধবয়সেও রাইমণির কথা বলিতে দর দর বারে তাঁহার চক্ষে জলধারা বহিত।

 কলিকাতাতে আসিয়া কয়েক মাস পাঠশালে পড়িবার পর, বিদ্যাসাগর মহাশয়েয় পিতা তাহাকে কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করিয়া দেন। কালেজে পদার্পণ করিবামাত্র তাঁহার অসাধারণ প্রতিভা শিক্ষক ও ছাত্র সকলের গোচর হইল। ১৮২৯ সালের জুন মাসে তিনি ভর্ত্তি হইলেন, ছয় মাসের মধ্যেই মাসিক ৫৲ টাকা বৃত্তি প্রাপ্ত হইলেন। সেই বৃত্তি সহায় করিয়া তিনি অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। ক্রমে কালেজের সমুদয় উচ্চবৃত্তি ও পুরস্কার লাভ করিলেন। সে সময়ে মফস্বলের ইংরাজ জজদিগের আদালতে এক একজন জজ-পণ্ডিত থাকিতেন। হিন্দু ধর্ম্মশাস্ত্র অনুসারে ব্যবস্থা দেওয়া তাহাদের কার্য্য ছিল। সংস্কৃত কালেজের উত্তীর্ণ ছাত্রগণ ঐ কাজ প্রাপ্ত হইতেন। তাহা একটা প্রলোভনের বিষয় ছিল। কিন্তু উক্ত কর্ম্মপ্রার্থীদিগকে ল কমিটী নামক একটী কমিটীর নিকট পরীক্ষা দিয়া কর্ম্ম লইতে হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বয়ঃক্রম যখন ১৭ বৎসরের অধিক হইবে না, তখন ল কমিটীর পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হইয়া ত্রিপুরার জজ-পণ্ডিতের কর্ম্ম প্রাপ্ত হন; কিন্তু পিতা ঠাকুরদাস এত দূরে যাইতে দিলেন না।

 ১৮৪১ সালে তিনি কালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া বিদ্যাসাগর উপাধি পাইয়া ফোর্ট উইলিয়াম কালেজের প্রধান পণ্ডিতের পদ প্রাপ্ত হন। এই পদ প্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি বাড়ীতে বসিয়া ইংরাজী শিখিতে আরম্ভ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সকলে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়াই জানেন, কিন্তু তিনি ইংরাজীতে কিরূপ অভিজ্ঞ ছিলেন, কি সুন্দর ইংরাজী লিখিতে পারিতেন, তাহা অনেকে জানেন না; এমন কি তাঁহার হাতের ইংরাজী লেখাটীও এমন সুন্দর ছিল যে, অনেক উন্নত উপাধিধারী ইংরাজীওয়ালাদের হাতের লেখাও তেমন সুন্দর নয়। এ সমুদয় তিনি নিজ চেষ্টা যত্নে করিয়াছিলেন। তাঁহার আত্মোন্নতি সাধনের ইচ্ছা এরূপ প্রবল ছিল যে তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়া তাঁহার বন্ধুবান্ধব সকলেরই মনে ঐ ইচ্ছা সংক্রান্ত হইয়াছিল। তাহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুইটী বিষয়ের উল্লেখ করা যাইতে পারে। বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন ফোর্ট উইলিয়াম কালেজে প্রতিষ্ঠিত, তখন তথাকার কেরাণীর কর্ম্মট খালি হইলে, তাঁহারই চেষ্টাতে তাঁহার তদানীন্তন বন্ধু বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সে কর্ম্মটী প্রাপ্ত হন। দুর্গাচরণ বাবু ঐ পদ প্রাপ্ত হইলেই বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে ঐ কর্ম্মে থাকিয়া, মেডিকেল কালেজে ভর্ত্তি হইয়া চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করিতে প্রবৃত্ত করেন। তাহাই দুর্গাচরণ বাবুর সকল ভাবী উন্নতি ও প্রতিষ্ঠার কারণ। ইনি সুপ্রসিদ্ধ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যেপাধ্যায়ের পিতা। এই সময়ে আর এক বন্ধুর দ্বারা আর এক কার্য্যের সূত্রপাত হয়। প্রেসিডেন্সি কালেজের ভূতপূর্ব্ব সংস্কৃতাধ্যাপক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় অবসরকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত পড়িতে আরম্ভ করেন। তাঁহাকে সংস্কৃত শিখাইতে প্রবৃত্ত হইয়াই বিদ্যাসাগর মহাশয় অনুভব করিলেন যে, তাঁহারা নিজে যে প্রণালীতে সংস্কৃত শিখিয়াছিলেন সে প্রণালীতে ইঁহাকে শিখাইলে চলিবে না, অনর্থক অনেক সময় যাইবে। সুতরাং নিজে চিন্তা করিয়া এক নূতন প্রণালীতে তাঁহাকে সংস্কৃত পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। ইহা হইতেই তাঁহার উত্তর কালে রচিত উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ-কৌমুদী প্রভৃতির সূত্রপাত হইল।

 ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কালেজের এসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদ শূন্য হইলে বিদ্যাসাগর মহাশয় ঐ পদ পাইলেন। কিন্তু উক্ত কালেজের অধ্যক্ষ রসময় দত্ত মহাশয়ের সহিত মতভেদ হওয়াতে দুই এক বৎসরের মধ্যে ঐ পদ পরিত্যাগ করিতে হইল। ১৮৫০ সালের প্রারম্ভে দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ফোর্ট উইলিয়াম কালেজের কেরাণীগিরি কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া চিকিৎসা ব্যবসায় আরম্ভ করাতে, মার্শেল সাহেবের অনুরোধে, মাসিক ৮০ টাকা বেতনে, বিদ্যাসাগর মহাশয় ঐ কর্ম্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু সে পদে তাঁহাকে অধিক দিন থাকিতে হয় নাই। ঐ সালেই তাঁহার বন্ধু মদনমোহন তর্ক্কালঙ্কার মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিতের কর্ম্ম পাইয়া চলিয়া যাওয়াতে সংস্কৃত কালেজের সাহিত্যাধ্যাপকের পদ শূন্য হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতি মহাত্মা বেথুনের পরামর্শে ঐ পদ গ্রহণ করিলেন। সেই পদ হইতে ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদ প্রাপ্ত হন। অধ্যক্ষের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াই তিনি নানা প্রকার সংস্কার কার্য্যে হস্তার্পণ করেন। প্রথম, প্রাচীন সংস্কৃত পুস্তকগুলির রক্ষণ ও মুদ্রণ; (২য়) ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্য জাতির ছাত্রগণের জন্য কালেজের দ্বারা উদ্ঘাটন; (৩য়) ছাত্রদিগের বেতন গ্রহণের রীতি প্রবর্ত্তন, (৪র্থ) উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ প্রভৃতি সংস্কৃত শিক্ষার উপযোগী গ্রন্থাদি প্রণয়ন, (৫ম) ২ মাস গ্রীষ্মাবকাশ প্রথা প্রবর্ত্তন (৬ষ্ঠ) সংস্কৃতের সহিত ইংরাজী শিক্ষা প্রচলন। সংস্কৃত কালেজের শিক্ষা প্রণালীর মধ্যে এই সকল পরিবর্ত্তন সংঘটন করিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যে কত চিন্তা ও কত শ্রম করিতে হইয়াছিল তাহা আমরা এখন কল্পনা করিতে পারি না। সে কালের লোকের মুখে তাঁহার শ্রমের কথা যাহা শুনিয়াছি, তাহা শুনিলে আশ্চর্যাম্বিত হইতে হয়।”

 ইহার পর দিন দিন তাঁহার পদবৃদ্ধি ও খ্যাতি প্রতিপত্তি বাড়িতে লাগিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি ১৮৪৭ সালে তাঁহার “বেতাল পঞ্চবিংশতি” মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়। “বেতাল” বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগের সূত্রপাত করিল। তৎপরে ১৮৪৮ সালে “বাঙ্গালার ইতিহাস” ১৮৫০ সালে “জীবনচরিত” ১৮৫১ সালে “বোধোদয়” ও “উপক্রমণিকা,” ১৮৫৫ সালে “শকুন্তলা” ও “বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রস্তাব” প্রকাশিত হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলের নিকট পরিচিত হইল।

 শিক্ষাবিভাগে ইনস্পেক্টারের পদ সৃষ্ট হইলে বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদের উপরে, নদীয়া, হুগলি, বর্দ্ধমান ও মেদিনীপুরের ইনস্পেক্টারের পদ প্রাপ্ত হন। এক দিকে যখন তাঁহার পদ ও শ্রম বাড়িল, তখন অপর দিকে তিনি এক মহাব্রতে আত্মসমর্পণ করিলেন। সেই সালেই বিধবা-বিবাহ হিন্দুশাস্ত্রানুমোদিত ইহা প্রমাণ করিবার জন্য গ্রন্থ প্রচার করিলেন। বঙ্গদেশে আগুন জলিয়া উঠিল। কিন্তু সমাজসংস্কারে এই তাঁহার প্রথম হস্তক্ষেপ নয়। ১৮৪৯ সালে মে মাসে বেথুন সাহেৱ যখন বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করেন, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি ও তাঁহার বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার বেথুনের পৃষ্ঠপোষক হইয়া দেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন কার্য্যে আপনাদের দেহ মন প্রাণ সমর্পণ করেন।

 ১৮৫৬ সাল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাল। এই বৎসরে তাঁহার কার্য্যপটুতা যে কত তাহা জানিতে পারা গেল। এক দিকে বিধবাবিবাহের প্রতিপক্ষগণের আপত্তিখগুনার্থ পুস্তক প্রণয়ন, বিধবাবিবাহ প্রচলনার্থ রাজবিধি প্রণয়ণের চেষ্টা, কার্যতঃ বিধবাবিবাহ দিবার আয়োজন, এই সকলে তাঁহাকে ব্যাপৃত হইতে হইল; অপরদিকে এই সময়েই শিক্ষাবিভাগের নব-নিযুক্ত ডিরেক্টার মিষ্টার গর্ডন ইয়ংএর সহিত তাঁহার ঘোরতর বিবাদ বাঁধিয়া গেল। এই বিবাদ প্রথমে জেলায় জেলায় বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন লইয়া ঘটে। বিদ্যাসাগর মহাশয় নদীয়া, হুগলী, বৰ্দ্ধমান ও মেদিনীপুর এই কয় জেলার স্কুল ইনস্পেক্টরের পদ প্রাপ্ত হইলেই নানা স্থানে বালকদিগের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপনে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি মনে করিলেন এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের জন্য তাঁহার যে আস্তরিক ইচ্ছা ছিল, তাহা কিয়ৎপরিমাণে কার্য্যে পরিণত করিবার সময় ও সুবিধা উপস্থিত। তিনি উৎসাহেব সহিত তাঁহার সংকল্প সাধনে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু ইয়ং সাহেব, বালিকাবিদ্যালয় স্থাপনের জন্য গবর্ণমেণ্টের অর্থ ব্যয় করিতে অস্বীকৃত হইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রেরিত বিল স্বাক্ষর করিলেন না। এই সংকটে বিদ্যাসাগর মহাশয় লেপ্টনাণ্ট গভর্ণরের শরণাপন্ন হইলেন। সে যাত্রা তাঁহার মুখ রক্ষ হইল বটে, কিন্তু ডিরেক্টার তাঁহার প্রতি হাড়ে চটিয়া রহিলেন। কথায় কথায় মতভেদ ও বিবাদ হইতে লাগিল। এই বিবাদ ও উত্তেজনাতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চিত্ত এই বৎসরের অধিকাংশ সময় অতিশয় আন্দোলিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিবিধ চেষ্টাসত্ত্বেও এই বিবাদের মীমাংসা না হওয়ায় অবশেষে ১৮৫৮ সালে তাঁহাকে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে হয়।

 এদিকে ১৮৫৬ সালের অগ্রহায়ণ মাসে তাঁহার অন্যতম বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয় এক বিধবার পাণিগ্রহণ করিলেন। তাহাতে বঙ্গদেশে যে আন্দোলন উঠিল, তাহার অনুরূপ জাতীয় উত্তেজনা আমরা অল্পই দেখিয়াছি। ইতিপূর্ব্বে শাস্ত্রানুসারে বিধবাবিবাহের বৈধতা লইয়া যে বিচার চলিতেছিল তাহা পণ্ডিত ও শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের মধ্যেই বদ্ধ ছিল। রাজবিধিপ্রণয়নের চেষ্টা আরম্ভ হইলে, সেই আন্দোলন কিঞ্চিৎ পাকিয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় শাস্ত্রীয় বিচারে সন্তুষ্ট না থাকিয়া যখন কার্যতঃ বিধবাবিবাহ প্রচলনে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন আপামর সাধারণ সকল লোকে একেবারে জাগিয়া উঠিল। পথে, ঘাটে, হাটে বাজারে, মহিলাগোষ্ঠীতে এই কথা চলিল। শান্তিপুরের তাঁতীরা “বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে” —এই গানাঙ্কিত কাপড় বাহির করিল। এমন কি বিদ্যাসাগরের প্রাণের উপরেও লোকে হাত দিবে এরূপ আশঙ্কা বন্ধুবান্ধবের মনে উপস্থিত হইল।

 এই সকল অবিশ্রান্ত পরিশ্রম ও সংগ্রামের মধ্যে যে কতিপয় বন্ধু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে উৎসাহ ও হৃদয়ের অনুরাগ দানে সবল করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে লাহিড়ী মহাশয় একজন। তিনি ১৮৫৭ সালে উত্তরপাড়া স্কুল হইতে বদলী হইয়া বারাসত স্কুলে গমন করেন। সেখানে প্রায় দেড় বৎসরকাল প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বারাসত কলিকাতা হইতে বেশী দূরে নয়; সুতরাং লাহিড়ী মহাশয় সেখান হইতে আসিয়া সর্ব্বদাই সহরে বন্ধুবান্ধবের সহিত মিলিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাদের মধ্যে একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন।

 লাহিড়ী মহাশয় শিক্ষকতা সূত্রে স্বল্পকালের জন্যও যেখানে বাস করিয়াছেন সেইখানেই তাঁহার স্মৃতি রাথিয়া আসিয়াছেন। সে সময়ে বারাসত স্কুলে যাঁহার তাঁহার নিকটে পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারা এখনও ভক্তিতে গদ গদ হইয়া তাঁহার দৈনিক জীবনের বর্ণনা করিয়া থাকেন। তাঁহার চরিত্রে তাহারা কর্তব্যপরায়ণতার আদর্শ দেখিয়াছিলেন। শিক্ষকতা কার্য্যে এরূপ দেহ মন প্রাণ ঢালিয়া দেওয়া কেহ কখনও দেখে নাই; ঘড়ির কাঁটাটীর ন্যায় যথাসময়ে তাঁহাকে নিজ কর্ম্মস্থানে দেখা যাইত; তৎপরে যে সময়ের যে কাজটী, তাহার প্রতি মুহুর্তকালের অমনোযোগ হইত না। ছাত্রগণের হৃদয়ে জ্ঞানষ্পৃহা উদ্দীপ্ত করিবার জন্য, তাহাদের চরিত্র ও নীতি উন্নত করিবার জন্য, এবং সকল সাধু বিষয়ে তাঁহাদের উৎসাহ ও অনুরাগ বৰ্দ্ধিত করিবার জন্য, তাহার অবিশ্রান্ত মনোযোগ দৃষ্ট হইত। যেমন তিনি একদিকে ছাত্রগণের মানসিক উন্নতির প্রতি দৃষ্টি রাখিতেন, তেমনি অপরদিকে নিজে মানসিক উন্নতির প্রতি যত্নবান ছিলেন। অবসরকালে দেখা যাইত হয় তিনি বাগানে বৃক্ষগণের পরিচর্য্যাতে নিযুক্ত, না হয় পাঠে গভীররূপে নিমগ্ন। এই সময়ে উদ্ভিদ-বিদ্যা ও উদ্যান-রচনার প্রতি তাঁহার বিশেষ মনোযোগ দৃষ্ট হইয়াছিল। তিনি কতিপয় ছাত্রের সহিত স্কুলগৃহের নিকটস্থ ভূমিখণ্ডও তাগ করিয়া লইয়াছিলেন। নিজে কিয়ৎ পরিমাণ ভূমি লইয়া ছাত্রদিগের এক জনকে এক একখণ্ড ভূমি দিয়াছিলেন। নিজে আপনার নির্দিষ্ট ভূমিখণ্ডে পরিশ্রম করিয়া তাঁহাদিগকে শ্রমশীলতার দৃষ্টান্ত দেখাইতেন।

 লাহিড়ী মহাশয় যখন বারাসতে প্রতিষ্ঠিত তখন ১৮৫৭ সালের মিউটনীর হাঙ্গামা উপস্থিত হয়। ১৮৫৭ সালের প্রারম্ভে গভর্ণমেণ্ট স্থির করেন যে সৈন্যবিভাগে এক প্রকার নুতন বন্দুক প্রচলিত করিবেন। ঐ বন্দুকের গুলিপূর্ণ টোটার উপরকার কাগজ দাঁত দিয়া কাটিয়া বন্দুকে পূরিতে হইত। সেই সকল টোটা দমদমের কারখানাতে প্রস্তুত হইতে লাগিল। দমদম হইতে এই কথা উঠিল যে দুই প্রকার টোটা প্রস্তুত হইতেছে; এক প্রকার টোটার উপরকার কাগজ গো-বসার দ্বারা, অপর প্রকার টোটার কাগজ শূকর-বসার দ্বারা লিপ্ত করিয়া প্রস্তুত করা হইতেছে; গো-বসা-লিপ্ত টোটা হিন্দুদিগকে ও শূকর বসা-নির্ম্মিত টোটা মুসলমানদিগকে দেওয়া হইবে। প্রজাগণকে স্বধর্ম্মচ্যুত করা ইংরাজদিগের উদ্দেশ্য। এই জনরবের কিছুমাত্র মূল ছিল না; এবং নুতন টোটা তখনও বাহির হয় নাই। অথচ এই জনরবে সিপাহীদিগের মন বড়ই উত্তেজিত হইয়া উঠিল। সিপাহীদিগের মধ্যে অযোধ্যা প্রদেশের অধিবাসী অনেক ছিল। তাহাদের মন লক্ষ্ণৌএর নবাবের পদচ্যুতি নিবন্ধন অগ্রেই উত্তেজিত ছিল। লর্ড ডালহউসি যে ভাবে অযোধ্য রাজ্য ব্রিটিশ রাজ্যভুক্ত করিয়াছিলেন, তাহাকে তৎপ্রদেশীয় প্রজাকুল জবরদস্তী ও বিশ্বাসঘাতকতা বলিয়া অনুভব করিয়াছিল। অযোধ্যা প্রদেশবাসী সৈন্যদলের মনে সেই অসন্তোষ প্রধুমিত বহ্নির ন্যায় রহিয়াছিল। তাহার উপরে টোটা কাঁটার জনরব বাতাসের ন্যায় আসিল। ১৮৫৭ ফেব্রুয়ারি মাসে বারাকপুরে সিপাহীদিগের মধ্যে গভীর অসন্তোষের লক্ষণ সকল প্রকাশ পায়; কিন্তু সে অসন্তোষের গভীরতা কত কর্তৃপক্ষ তখন তাহা ধরিতে পারিলেন না।

 কিছুদিন পরে বারাকপুর হইতে একদল সৈন্য কোনও বিশেষ কারণে বহরমপুরে প্রেরিত হয়। তখন বহরমপুরে একদল সিপাহী সৈন্য ছিল। বারাকপুর হইতে নবাগত সিপাহীগণ তাহাদের কাণে কাণে নুতন টোটার কি বিবরণ বলিল তাহাতে সিপাহীরা একেবারে উত্তেজিত হইয়া উঠিল। সেখানে একদিন ইংরাজ-সৈন্যাধ্যক্ষদিগের সহিত সিপাহীদিগের মারামারি হইল। এই সংবাদ কলিকাতার পৌছিলে লর্ড ক্যানিং ঐ সকল সিপাহীকে বারাকপুরে আনিয়া সকলের সমক্ষে তাহাদিগকে কর্ম্মচ্যুত করিতে আদেশ করিলেন। তদনুসারে তাহাদিগকে বারাকপুরে আনিয়া সমুদা সিপাহী সৈন্যদলের সমক্ষে তাহদের অস্ত্র শস্ত্র কাড়িয়া লইয়া তাহাদিগকে সৈন্যদল হইতে বিদায় দেওয়া হইল। অন্য সময় হইলে এই শাস্তি দ্বারা অনিষ্টকর ফল না ফলিয়া ইষ্ট ফলই হইত। কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে তাহার বিপরীত ঘটিল। কর্ম্মচ্যুত সিপাহীদিগের মধ্যে অনেকে অযোধ্য প্রভৃতি প্রদেশের লোক ছিল। তাহারা কর্ম্মচ্যুত হইয়া স্বীয় স্বীয় দেশে ফিরিবার সময় নুতন টোটার কথা লইয়া গেল। বিশেষতঃ তৎতৎস্থানের সিপাহীদিগের কর্ণে সেই কথা তুলিল; এবং কিরূপে তাহারা স্বধর্ম্ম রক্ষার্থ অস্ত্রধারণ করিয়াছিল এবং সেজন্য নিগৃহীত হইয়াছে তাহাও গৌরব ও স্পৰ্দ্ধার সহিত প্রচার করিয়া দিল। চারিদিকে প্রধূমিত অগ্নির ন্যায় অসন্তোষ ব্যাপ্ত হইতে লাগিল।

 অবশেষে সেই প্রধূমিত অসন্তোষ ১০ই মে দিবসে মিরাট নগরে বিদ্রোহাগ্নির আকারে প্রজলিত হইয়া উঠিল। সেখানে ৬ই মে দিবসে ৮৫ জন দেশীয় সৈনিক কাওয়াজের সময় টোটা লইতে অস্বীকৃত হওয়াতে তাহাদিগকে কোর্টমার্শালের বিচারে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ইহাতে অপরাপর সিপাহিগণ তাহাদিগকে ধর্ম্মের জন্য নিপীড়িত বলিয়া, সদলে বিদ্রোহী হইয়া, ১০ই মে দিবসে জেলের কয়েদিদিগকে ছাড়িয়া দেয়; রাজকোষ লুণ্ঠন করে; অস্ত্রাগার হস্তগত করে; অনেক ইংরাজকে হত্যা করে; এবং অবশেষে দিল্লীয় নাম-মাত্র সম্রাট বৃদ্ধ বাহাদুর সাকে পুনরায় রাজসিংহাসনে বসাইয়া স্বাধীনতার পতাকা উড়াইবার মানসে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে। তাহারা ১১ই মে দিল্লী অধিকার করে। এই সংবাদ দেশে প্রচার হইলে যে, যে স্থানে দেশীয় সিপাহী সৈন্য ছিল, সর্ব্বত্রই বিশেষ উত্তেজনা দৃষ্ট হইতে লাগিল। রাজপুরুষগণ সতর্ক হইয়া বিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন; ভয় ও মৈত্রী প্রভৃতির দ্বারা যতদূর হয় কিছুই করিতে অবশিষ্ট রাখিলেন না। কিন্তু সকল চেষ্টাই বিফল হইল। যেমন গ্রীষ্মের দিনে ঘরে আগুন লাগিলে দেখিতে দেখিতে এক ঘর হইতে অপর এক ঘরে লাগিয়া যায়, সেই প্রকার দেখিতে দেখিতে বিদ্রোহাগ্নি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল।

 এই সুযোগ পাইয়া যাহাদের কোন না কোনও কারণে পূর্ব্বাবধি ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের প্রতি বিদ্বেষ-বুদ্ধি ছিল, এমন কতকগুলি লোক এই বিদ্রোহব্যাপারের সারথ্য কার্য্যে অবতীর্ণ হইলেন। তন্মধ্যে ফৈজাবাদের মৌলবী, বিস্তুরের নানা সাহেব, ঝান্সীর রাণী ও নুন্সির সেনাপতি তাঁতিয়া টোপী সর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। ফৈজাবাদের মৌলবী একজন মুসলমান ধর্ম্মাচার্য্য, লক্ষ্নৌএর নবাবকে পদচ্যুত করাতে তিনি ইংরাজদেগের প্রতি জাতক্রোধ হইয়াছিলেন। নবাবের পরিবারস্থ ব্যক্তিদিগের সহিত তাঁহার আলাপ ও আত্মীয়তা ছিল। তাহাদের অবনতিকে তিনি নিজধর্মের অধঃকরণ বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। তিনি এই সময়ে বিদ্রোহীদলের একজন প্রধান উৎসাহ-দাতা হইয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার দৃষ্টান্তে অযোধ্যার সহস্ৰ সহস্র ব্যক্তি বিদ্রোহে যোগ দিয়াছিল। তিনি নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়া যুদ্ধ করিতেও কুষ্ঠিত হন নাই।

 নানাসাহেব মহারাষ্ট্রীয় প্রসিদ্ধ বাজীরাওর পোষ্যপুত্র। তিনি পেনসন প্রাপ্ত হইয়া একপ্রকার বন্দীদশাতে কানপুরের সন্নিকটবর্ত্তী বিঠুর নামক স্থানে বাস করিতেছিলেন। ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট তাঁহার কোন কোন ও প্রার্থনা অগ্রাহ্য করাতে তিনি ইংরাজদিগের প্রতি চটিয়াছিলেন। তিনিও এই সুযোগ পাইয়া বিদ্রোহের অপর একজন সারথি হইলেন।

 ঋান্সীর রাণীও ঐ প্রকার কোনও কারণে ইংরাজদিগের প্রতি চটয়াছিলেন। তিনিও এই বিদ্রোহে যোগ দিলেন। তাঁহার স্বাদশহিতৈষণা ও বীরত্ব দেখিয়া ইংরাজগণও মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন।

 কোন স্থানে কবে বিদ্রোহাগ্নি জ্বলিল তাহার বিশেষ বিবরণ দেওয়া উদ্দেশ্য নহে। এইমাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, বিদ্রোহাগ্নি উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের নানাস্থানে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। এমন কি বক্সর, আরা প্রভৃতির ন্যায় বেহারের অন্তর্গত স্থান সকলেও ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। তন্মধ্যে কানপুরেই লোমহর্ষণ হত্যাকাণ্ড হইয়াছিল। নানাসাহেবের প্ররোচনাতে বিদ্রোহী সিপাহিগণ উৎসাহিত হইয়া সেখানকার ইংরাজগণকে কয়েক দিন একটা বাড়ীতে অবরুদ্ধ করিয়া রাখে; তৎপরে তাহাদিগকে নৌকাযোগে অন্য স্থানে প্রেরণ করিবার আশা ও অভয় দিয়া তাহাদিগকে বাহিরে আনিয়া, নৌকাতে আরোহণ করাইয়া, তাহাদের অধিকাংশকে গুলি করিয়া হত্যা করে। অবশেষে যে সকল ইংরাজ রমণী ও বালক বালিকা থাকে তাহাদিগকে কিছুদিন অবরুদ্ধ রাখা হয়; কিন্তু প্রতিশোধের দিন নিকটে আসিতেছে দেখিয়া তাহাদিগকেও সদলে হত্যা করিয়া একটা কূপের মধ্যে তাহাদের মৃতদেহ নিক্ষেপ করে। এতদ্ব্যতীত ১২৬ জন ইংরাজ যাহাঁদের অধিকাংশ স্ত্রীলোক ও বালকবালিকা ছিল) ফতেগড় হইতে নৌকাযোগে পলাইয়া আসিতেছিল, নানার আদেশে তাহাদিগকে নৌকা হইতে নামাইয়া হত্যা করা হয়। এই নিদারুণ হত্যা বিবরণ নানাসাহেবের নামের উপর অবিনশ্বর কলঙ্কের রেখার ন্যায় চিরদিন বিদ্যমান থাকিবে। কারণ স্ত্রীলোক ও বালক বালিকার হত্যা সকল দেশের সামরিক নীতির বিরুদ্ধ-কার্য্য।  ১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে কলিকাতাতে এরূপ জনরব উঠিল যে বিদ্রোহী সিপাহীগণ আসিতেছে, তাহারা কলিকাতা সহরের সমুদয় ইংরাজত্বে হত্যা করিবে এবং কলিকাতা সঙ্কর লুট করিবে। এই জনরবে কলিকাতার অনেক ইংরাজ কেল্লার মধ্যে আশ্রয় লইলেন; দেশীয় বিভাগেও লোকে কি হয় কি হয় বলিয়া ভয়ে ভয়ে দিনযাপন করিতে লাগিল। ইংরাজ ফিরিঙ্গী ও দেশীয় খ্রীষ্টানগণ সর্ব্বদা অস্ত্র শস্ত্র লইয়া বেড়াইতে লাগিলেন। বন্দুকের দোকানের পসার অসম্ভবরূপ বাড়িয়া গেল। ইংরাজগণ ভয়ে ভীত হইয়া গবর্ণর জেনারেল লর্ড ক্যানিংকে অনেক অদ্ভুত পরামর্শ দিতে লাগিলেন,—কালাদের অস্ত্র শস্ত্র হরণ কর, কঠিন সামরিক আইন জারি কর, ইত্যাদি; ক্যানিং তাহাতে কর্ণপাত করিলেন না। এজন্য ইংরাজের তাহার নাম Clemency Canning “দয়াময়ী ক্যানিং” রাখিলেন। আজ শোনা গেল দেশীয় সংবাদ পত্র সকলের স্বাধীনতা হরণ করা হইবে; কালি কথা উঠিল, রাত্রি ৮টার পর যে মাঠের ধারে যায় তাহাকেই গুলি করে; সন্ধ্যার পর বাজার বন্ধ হইত; একটা জিনিসের প্রয়োজন হইলে পাওয়া যাইত না; লোকে নিজ বাসাতে দুই চারিজনে বসিয়া অসংকোচে রাজ্যের অবস্থা ও রাজনীতি সম্বন্ধে নিজ নিজ মত প্রকাশ করিতে সাহস করিত না, মনে হইত প্রাচীরগুলি বুঝি শুনিতেছে! কিছু অধিক রাত্রে গড়ের মাঠের সন্নিকটবর্ত্তা রাস্তা দিয়া আসিতে গেলেই পদে পদে অস্ত্রধারী প্রহরী জিজ্ঞাসা করিত, “হুকুমদার” অর্থাৎ (Who comes there?) তাহা হইলেই বলিতে হইত “রাইরত হায়” অর্থাৎ আমি প্রজা, নতুবা ধরিয়া পরীক্ষা করিয়া তবে ছাড়িত। এইরূপে সকল শ্রেণীর মধ্যে একটা ভয় ও আতঙ্ক জন্মিয়া কিছুদিন আমাদিগকে স্থির থাকিতে দেয় নাই।

 যাহা হউক ইংরাজগণ সত্ত্বর বিদ্রোহাগ্নি নির্ব্বাপিত করিলেন। দিল্লী ও লক্ষ্মৌ পুনরায় তাহাদের হস্তগত হইল। প্রতিশোধের দিন যখন আসিল তখন তাহারাও নৃশংসতাচরণ করিতে ক্রটী করিবেন না। ইংরাজসৈন্যগণ যতদূর অগ্রসর হইত, তাহাদের গমনপথের উভয় পার্শ্বে দোষী নির্দোষী, হতাহত দেশীয় প্রজার মৃতদেহে আকীর্ণ হইতে লাগিল! এক এলাহাবাদে ৮০০ শত দেশীয় প্রজাকে ফাঁসি দেওয়া হইল!

 ক্রমে সমগ্র, দেশে, আবার শাস্তি স্থাপিত হইল। ১৮৫৮ সালে মহারাণী প্রজাদিগকে অভয়দান করিয়া ভারত সাম্রাজ্য নিজে হস্তে লইলেন; ষ্টেট-সেক্রেটারির পদ সৃষ্ট হইল; কলিকাতা সহৱ আলোকমালাতে মণ্ডিত হইল; চারিদিকে আনন্দধ্বনি উঠিল। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গদেশের ও সমাজের এক মহোপকার সাধিত হইল; এক নবশক্তির সূচনা হইল; এক নব আকাঙ্ক্ষা জাতীয় জীবনে জাগিল। সে জন্যই ইহার কিঞ্চিৎ বিস্তৃত বিবরণ দিলাম।

 বিদ্রোহজনিত উত্তেজনাকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ নামক সাপ্তাহিক ইংরাজী কাগজ এক মহোপকার সাধন করিল। পেট্রিয়ট সারগর্ভ সুযুক্তি-পূর্ণ তেজস্বিনী ভাষাতে কর্তৃপক্ষের মনে এই সংস্কার দৃঢ়রূপে মুদ্রিত করিবার প্রয়াস পাইলেন যে, সিপাহী-বিদ্রোহ কেবল কুসংস্কারাপন্ন সিপাহিগণের কার্য্য মাত্র, দেশের প্রজাবর্গের তাহার সহিত যোগ নাই। প্রজাকুল ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুরক্ত, এবং তাঁহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে। পেট্রিয়টের চেষ্টাতে লর্ড ক্যানিংএর মনেও এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল; সেজন্য এদেশীয়দিগের প্রতি কঠিন শাসন বিস্তার করিবার জন্য ইংরাজগণ যে কিছু পরামর্শ দিতে লাগিলেন, ক্যানিং তাহার প্রতি কর্ণপাত করিলেন না। পূর্ব্বেই বলিয়াছি সেই কারণে তাঁহার স্বদেশীয়গণ তাঁহার Clemency Canning বা 'দয়াময়ী ক্যানিং” নাম দিল। এমন কি তাহাকে দেশে ফিরাইয়া লইবার জন্য ইংলণ্ডের প্রভূদিগকে অনেকে পরামর্শ দিতে লাগিলেন। পার্লেমেণ্টেও সে কথা উঠিয়াছিল; কিন্তু ক্যানিংএর বন্ধুগণ পেট্রিয়টের উক্তি সকল উদ্ধৃত করিয়া দেখাইলেন যে এদেশবাসিগণ ক্যানিংএর প্রতি কিরূপ অনুরক্ত, এবং ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের প্রতি কিরূপ কৃতজ্ঞ। পেট্রিয়ট এই সময়ে এদেশীয়দিগের অদ্বিতীয় মুখপাত্র হইয়া উঠিল। হরিশ্চন্দ্র একদিকে যেমন গবর্ণমেণ্টের সর্ব্বপ্রকার বৈধ শাসনকে সমর্থন করিতেন, তেমনি অপরদিকে ইংরাজগণের সর্বপ্রকার অবৈধ আচরণের প্রতিবাদ করিতেন। সকলে উত্তেজনাতে পড়িয়া স্থিরবুদ্ধি হারাইয়াছিল, কেবল পেট্রিয়ট হারায় নাই; এজন্য রাজপুরুষগণের নিকট ইহার আদর বাড়িয়া গেল। এরূপ শুনিয়াছি পেট্রিয়ট বাহির হইবার দিন লর্ড ক্যানিংএয় ভৃত্য আসিয়া পেট্রিয়ট আফিসে বসিয়া থাকিত, প্রথম কয়েকখানি কাগজ মুদ্রিত হইলেই লইয়া যাইত। হিন্দু পেটিয়টের এই প্রভাব দেখিয়া দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ পুলকিত হইয়া উঠিলেন। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশনের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ এবং রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি নব্যবঙ্গের নেতৃগণ হরিশের পৃষ্ঠপোষক হইয়া তাহাকে উৎসাহ দিতে লাগিলেন।
হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

 হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জীবনচরিত বঙ্গসমাজের ইতিবৃত্তে চিরস্মরণীয়। একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান নিরবচ্ছিন্ন আত্ম চেষ্টা ও যত্বের দ্বারা কতদূর উন্নতি করিতে পারে, হরিশ তাহার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি ১৮২৪ সালে, কলিকাতার দক্ষিণ উপনগরবর্ত্তী ভবানীপুর নামক স্থানে, স্বীয় মাতামহের ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা রামধন মুখোপাধ্যায় রাঢ়ীয় কুলীনদেগের মধ্যে কুলমর্য্যাদাতে অগ্রগণ্য ছিলেন। কুলপ্রথা অনুসারে তিনি তিনটী বিবাহ করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে হরিশ সর্ব্বকনিষ্ঠ পত্নী রক্মিণী দেবীর গর্ভজাত। হরিশের জ্যেষ্ঠ এক সহোদর ছিলেন তাঁহার নাম হারাণ চন্দ্র। শৈশবাবধি হরিশ ঘোর দ্বারিদ্র্যে বাস করিতে অভ্যস্ত হন। কিছুকাল কোনও পাঠশালে পড়িবার পর তিনি অবৈতনিক ছাত্ররূপে ইউনিয়ান স্কুল নামক একটা স্কুলে প্রেরিত হন। এখানে ছয় বৎসর পাঠ করিয়া ১৪ কি ১৫ বৎসরের সময় দারিদ্রোর তাড়নায় পাঠ সাঙ্গ করেন। সেই বয়সেই উহাকে অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টাতে বিব্রত হইতে হয়। কর্ম্ম কি সহজে জোটে? বালক হরিশ উমেদারী করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। অবশেষে দশ টাকা বেতনের একটী সামান্য চাকুরী জুটল। কিছুদিন তাহা করিয়া বেতনবৃদ্ধির আশা না দেখিয়া তাহা পরিত্যাগ করিলেন। তৎপরে আরও কিছুকাল দারিদ্র্যদুঃখ ভোগ করার পর, মিলিটারি অডিটার জেনেরালের আফিসে ২৫ টাকা মাসিক বেতনের এক কর্ম্ম পাইলেন। এই কর্ম্মটী তাহার সর্ববিধ উন্নতির মূল কারণ হইল। তিনি অন্নবস্ত্রের চিন্তা হইতে একটু নিষ্কৃতি পাইয়াই আগ্রহ ও উৎসাকের সহিত আপনার জ্ঞানোন্নতি সাধনে নিযুক্ত হইলেন। কিনিয়া ও ভিক্ষা করিয়া গ্রন্থ সংগ্রহ পূর্ব্বক পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিতে না পারিয়া কিঞ্চিং বেতন বৃদ্ধি হইলেই কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরীর চাঁদাদায়ী সভ্য হইয়া, সেখানে গিয়া পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। প্রতিদিন আফিসের ছুটীর পর লাইব্রেরিতে গিয়া বসিতেন ও সন্ধাপর্য্যন্ত ইংরাজী সংবাদপত্র ও পত্রিকাদি পাঠ করিতেন; তদ্ভিন্ন রাশি রাশি গ্রন্থ বাড়ীতে আনিয়া রাত্রে পাঠ করিতেন। এই রূপ শোনা যায়, এই সময়ে পাঁচ মাস কালের মধ্যে ৫৭ খানি বান্ধাই এডিনবরা রিভিউ, দুই তিন বার পড়িয়া হৃদগত করিয়াছিলেন।

 হরিশ একদিকে যেমন পড়িতেন, অপরদিকে তৎকাল প্রচলিত ইংরাজী সাময়িক পত্রে মধ্যে মধ্যে লিখিতেন। সে সময়ে হিন্দুকালেজের পুর্ব্বতন ছাত্র কাশীপ্রসাদ ঘোষ Hindu Intelligencer নাম এক ইংরাজী কাগজ সম্পাদন করিতেন, তাহাতে হরিশের লিখিত প্রবন্ধাদি সর্ব্বদা বাহির হইত। এই লেখার জন্য শিক্ষিত দলে তিনি সুপরিচিত হইয়া পড়িলেন। তিনি ২৫৲ টাকার কর্ম্মে প্রবেশ করিয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া তাঁহার বেতন ৪০০৲ চারি শত টাকা হইয়াছিল। তিনি মৃত্যুকাল পর্যন্ত, ঐ কর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

 ১৮৫২ সালে হরিশের মান সন্ত্রম এমন হইয়াছিল যে অপরাপর সভ্যগণের আগ্রহে এই সালে তিনি ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সভার সভ্যপদে প্রবেশ করেন। প্রবেশ করিয়াই তিনি আইন, আদালত, রাজনীতি প্রভৃতির মর্ম্ম অবগত হইবার জন্য এমনি মনোনিবেশ করিলেন যে, ত্বরায় তিনি ঐ এসোসিএশনের পরামর্শদাতৃগণের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি হইয়া উঠিলেন। একদিকে যেমন রাজনীতি সম্বন্ধে দেশের সর্ব্ববিধ হিতকর বিষয়ে তিনি পরামর্শদাতা ও সহায় হইলেন, তেমনি অপরদিকে কতিপয় বন্ধুর সহিত সমবেত হইয়া তাঁহার বাসভূমি ভবানীপুরে একটা ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করিলেন। তিনি ঐ সমাজের একজন উৎসাহী সভ্য ও সম্পাদক ছিলেন। তিনিই সর্ব্বাগ্রে ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারার্থে ইংরাজী বক্তৃতার প্রথা প্রবর্ত্তিত করেন। এই সময়ে তাঁহার প্রদত্ত কতকগুলি বক্তৃতা মুদ্রিত হইয়াছে।

 এই সকল দেশহিতকর কার্য্যের মধ্যে অনুমান ১৮৫৩ সালে মধুসূদন রায় নামক একজন স্বদেশ-হিতৈষী ধনী ব্যক্তি একটা মুদ্রাযন্ত্র ক্রয় করিয়া একখানি সাপ্তাহিক ইংরাজী সংবাদপত্র বাহির করিবার অভিপ্রায় করিলেন। তিনিই “হিন্দু পেট্রিয়ট” বাহির করিয়া কিছুদিন অপরের দ্বারা চালাইয়া পরে হরিশ চন্দ্রকে তাঁহার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। হরিশ মনের মত একটা কাজ পাইয়া, ঐ পত্রিকা সম্পাদনে দেহ মন নিয়োগ করিলেন। কিন্তু তখন ইংরাজী সংবাদপত্র পড়িবার লোক অল্পই ছিল; সুতরাং অনেক চেষ্টা করিয়াও হিন্দু পেট্রিয়টের গ্রাহক এক শতের অধিক হইল না। এই অবস্থাতে কিছুদিন পেট্রিয়ট চালাইয়া মধুসূদন রায় নিজপ্রেস অপরকে বিক্রয় করিয়া “পেট্রিয়ট” হরিশ চন্দ্রকে দিয়া পশ্চিম যাত্রা করিলেন।  হরিশ কাগজ ভবানীপুরে তুলিয়া লইয়া গেলেন। এখানে আসিয়া তাঁহার ভ্রাতা হারাণ চন্দ্রকে নামতঃ প্রেস ও কাগজের সত্ত্বাধিকারী করিয়া উৎসাহসহকারে কাগজ চালাইতে লাগিলেন। তাঁহার বিদ্যা বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার গুণে পেট্রিয়ট কিরূপ শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিল তাঁহার বিবরণ অগ্রেই দিয়াছি। সিপাহী বিদ্রোহ উপস্থিত হইলে পেটিয়টের শক্তি অদ্বিতীয় হইয়া উঠিল।

 হরিশের যে লেখনী লর্ড ডালহউসির অযোধ্যাধিকারের সময়ে অগ্নি উদ্গীরণ করিয়াছিল, তাহাই মিউটিনীর সময়ে ক্যানিংএর পৃষ্ঠপোষক হইয়শান্তিস্থাপনের প্রয়াস পাইয়াছিল। সেই লেখনী আবার নীলকরদিগের অত্যাচার নিবারণার্থ সশস্ত্র হইয়া দাঁড়াইল। নীলকর-অত্যাচার-নিবারণ হরিশের এক অক্ষয় কীর্ত্তি। এই কার্য্যে তিনি দেহ, মন, অর্থ, সামর্থ্য লকলি নিয়োগ করিয়াছিলেন। নীলকর হাঙ্গামার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত এইঃ—

 বিগত শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতেই যশোহর, নদীয়া, পাবনা প্রভৃতি নানা জেলাতে নীলের চাষ আরম্ভ হয়। ইংরাজগণ কোম্পানি করিয়া নীলের চাষ আরম্ভ করেন। অল্প রায়ে অধিক লাভ করা তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল; সুতরাং তাঁহারা তাহার নানা প্রকার উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে দাদন দেওয়া একটা প্রধান। দাদনের অর্থ কুষীদিগকে অগ্রিম অর্থ দেওয়া। দরিদ্র কৃষকগণ অগ্রিম অর্থ পাইলে আরও অনেক কাজে লাগাইতে পারিবে বলিয়া দাদন হইত; এবং ভাল ভাল জমিতে নীল বুনিবে এবং অপরাপর প্রকারে নীলকরদিগের সাহায্য করিবে বলিয়া প্রতিশ্রুত থাকিত। তৎপরে তাহারা নীলকরদিগের দাসরূপে পরিণত হইত। নীলকরগণ জোর করিয়া উৎকৃষ্ট জমিতে নীল বুনাইয়া লইতেন; বলপূর্ব্বক তাহাদিগের গোলাঙ্গলাদি ব্যবহার করিতেন; তাহাদের আদেশানুসারে কার্য্য করিতে না চাহিলে প্রহার, কয়েদ, গৃহদা প্রভৃতি নৃশংস অত্যাচার করিতেন; এবং অনেক স্থলে জমিদার হইয়া বসিয়া অবাধ্য প্রমাদিগকে একেবারে ধনে প্রাণে সারা করিতেন।

 কয়েক বৎসরের মধ্যে এই সকল, অত্যাচার এতই অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল যে, গবর্ণমেণ্ট উপদ্রব নিবারণের উদ্দেশ্যে নুতন আইন করিতে বাধ্য হইলেন। কিন্তু তাহাতে বিবাদ পাকিয়া গেল। অবশেষে অনুমান ১৮৫৮ কি ৫৯ সালে লক্ষ লক্ষ প্রজা ধর্ম্মঘট করিয়া প্রতিজ্ঞারূঢ় হইল যে নীলের দাদন লইবে না, বা নীলের চাষ করিবে না। তখন নীলকর ইংরাজগণ তাঁহাদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করিলেন। যশোর, নদীয়া প্রভৃতি জেলার জমিদারগণের ও প্রজাগণের সহিত নীলকরদিগের ঘোর বিবাদ বাঁধিয়া গেল। অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। জেলার মাজিষ্ট্রেট প্রভৃতি নীলকরদিগের স্বজাতীয়, সুতরাং প্রজারা প্রায়ই সুবিচার লাভ করিত না। কিন্তু তাহারা ইহাতেও দমিত না; অনেকে ধনে প্রাণে সারা হইয়া যাইত, তবু নিরস্ত হইত না। এই সময়ে হরিশচন্দ্র অত্যাচরিত প্রজাবৃন্দের পক্ষ হইয়া লেখনী ধারণ করিলেন। অবশেষে প্রধানতঃ তাঁহারই চেষ্টাতে গবর্ণমেণ্ট এই ১৮৬০ সালেই “ইণ্ডিগো কমিশন” নামে এক কমিশন নিযুক্ত করিলেন। তাহার সভ্যগণ জেলার জেলায় ঘুরিয়া নীলের অত্যাচার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। হরিশ কমিশনের সমক্ষে সাক্ষ্য দিলেন। চারিদিক হইতে নীলকরদিগের উপরে ছি ছি রব উঠিল। নীলকরগণ জাতক্রোধ হইয়া আর্কিবল্‌ড হিল্‌স নামক একজন নীলকরকে খাড়া করিয়া পেট্রিয়টের নামে আদালতে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। প্রথমে সুপ্রিম কোর্টে ফৌজদারি মোকদ্দমা উপস্থিত করা হইল। ভবানীপুর সুপ্রিম কোর্টের এলাকাভূক্ত নয় বলিয়া সে মোকদ্দমা উঠিয়া গেল। কিন্তু এই সকল গোলমালে হরিশের ভগ্ন শরীরে আর সহিল না। ১৮৬১ সালের জুন মাস ৩৭ বৎসর বয়সে তিনি এলোক হইতে অন্তর্হিত হইলেন।

 মানুষের দেহে আর কত সয়! সে সময়ে যাহারা হরিশের দুরন্ত পরিশ্রম দেখিয়াছেন, তাহারা বলেন যে রাত্রির কয়েক ঘণ্টা কাল ব্যতীত হরিশের আর বিশ্রাম ছিল না। একে “পেট্রিয়ট” পত্রিকার সম্পাদকতা কাজ, সেজন্য তাঁহাকে রাশি রাশি সংবাদপত্র পড়িতে হইত, ও প্রবন্ধাদি লিখিতে হইত, তদুপরি দিবারাত্রি নীলকর প্রপীড়িত প্রজাবৃন্দের সমাগম। তাহার ভবন সর্ব্বদা লোকারণ্য থাকিত। কাহারও দরখাস্ত লিখিয়া দিতে হইতেছে, কাহাকেও উকিলের নিকট সুপারিস চিঠী দিতে হইতেছে, কাহারও মোকদ্দমার হাল শুনিতে হইতেছে; বিশ্রাম নাই। অনেক দিন আফিস হইতে ফিরিয়া মাত্রি দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত আর আফিসের পোষাক বদলাইবার সময় পাইতেন না। আফিসের কলম ছাড়িয়া আসিয়া আবার কলম ধরিয়া বসিয়া যাইতেন। তাঁহার জননী এই গুরুতর শ্রমের প্রতিবাদ করিয়া টিক্ টিক্‌ করিতেন। বলিতেন “ওরে মানুষের শরীরে এত শ্রম সবে না, ওরে মারা পড়বি, ওরে কলম রাখ।” তদুত্তরে তিনি বলিতেন —“মা, তোমার সব কথা শুনবো, কিন্তু এই গরীব প্রজাদের জন্যে যা করছি তাতে বাধা দিও না, ওরা ধনে প্রাণে সারা হলো, এ কাজ না করে আমি ঘুমাতে পারবে না।” কিন্তু এই অতিরিক্ত শ্রমের ফল এই হইত যে, যে পেট্রিয়টের কাজ সপ্তাহ ধরিয়া করিলে অপেক্ষাকৃত লঘু হইত, তাহা দুই দিনে সারিতে হইত, সুতরাং সে দুই দিন সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিতে হইত। এই গুরুতর শ্রমে দেহ মন যখন ক্লান্ত হইয়া পড়িত, তখন শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের তদানীন্তন প্রথানুসারে সুরা-বিষ পান করিয়া আপনার অবসন্ন দেহ মনকে সজাগ রাখিবার চেষ্টা করিতেন।

 এরূপ শুনিয়াছি যে ইহার কিছু পূর্ব্বে তাঁহার প্রথম পত্নীর মৃত্যু হয়। সেই শোকের অবস্থাতে তাঁহার নবপরিচিত ধনী বন্ধুগণ তাঁহাকে সুরাপান ও অন্যান্য নিন্দিত আমোদে লিপ্ত করিয়া তাঁহার শোকাপনোদনের চেষ্টা পান। তাহা হইতেই তাহার সর্ব্বজনপ্রশংসিত চরিত্রে কালির রেখা পড়ে; তাহা হইতেই তাঁহার পানাসক্তি প্রবল হয়। এই বিবরণ যখন শুনি, তখন চক্ষে জল আসে আর বলি—হায়! স্কচ কবি বরন্‌স লাঙ্গল ফেলিয়া যদি এডিনবরা নগরে না আসিতেন তাহা হইলে যেমন ভাল হইত, তেমনি আমাদের দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান হরিশের পদবৃদ্ধি যদি না হইত, তিনি যদি কলিকাতার ধনীদের আদরে ছেলে হইয়া না দাঁড়াইতেন, তবে বুঝি ভাল হইত। ধনীর কয়েকদিনের জন্য তাঁহাকে স্বন্ধে করিয়া নাচিয়া গেলেন, দিয়া গেলেন মদের বোতল ও দারুণ পীড়া। ক্ষতি যাহা হইবার হরিশের পরিবারবর্গের হইল; এবং সর্ব্বোপরি হতভাগিনী বঙ্গভূমির হইল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হরিশ্চন্দ্রের ন্যায় এমন বিমল হৃদয়ে, দেহ মন প্রাণ দিয়া, স্বদেশের সেবা অতি অল্প লোকেই করিয়াছে।

 না জানি নীলকরগণ কি জাতক্রোধই হইয়াছিলেন। হরিশের মৃত্যুর পরেও তাঁহাদের ক্রোধ থামিল না। যে আর্কিবল্ড হিলস্ তাঁহার নামে প্রথমে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছিলেন, তিনিই তদনন্তর তাঁহার বিধবা পত্নীকে প্রতিবাদীশ্রেণীগণ্য করিয়া আলিপুর কোর্টে দশ হাজার টাকার দাবী করিয়া, দেওয়ানী মোকদ্দমা চালাইতে অগ্রসর হইলেন। হিলসের পশ্চাতে নীলকরগণ ছিলেন, হরিশের বিধবার পশ্চাতে কেহই ছিল না। এদেশীয়দিগের মধ্যে সে একতা কোথায়? কাজেই বন্ধুদিগের পরামর্শে হরিশের বিধবাকে আপসে মিটাইতে হইল। কিন্তু তথাপি বাদীর খরচার হিসাবে এক হাজার টাকা দিবার জন্য অঙ্গীকার করিতে হইল। এই এক হাজার টাকা অনেক কষ্টে সংগ্রহ করিয়া বিধবার বসতবাটী-খানি ক্রোক হইতে উদ্ধারি করিতে হইয়াছিল!

 যাহা হউক এক দিকে যখন ইণ্ডিগো কমিশন, ও পেট্রিয়টের সহিত বিবাদ প্রভৃতির উপক্রম, তখন অপর দিকে ১৮৬০ সালের আশ্বিন মাসে দীনবন্ধু মিত্রের সুবিখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ নাটক প্রকাশিত হইল। এই আর এক ঘটনা যাহাতে বঙ্গসমাজে তুমুল আন্দোলন তুলিয়াছিল। কোন গ্রন্থ বিশেষে যে সমাজকে এতদূর কম্পিত করিতে পারে তাহা অগ্রে আমরা জানিতাম না। “নীলদর্পণ” কে লিখিল, তাহা জানিতে পারা গেল না; কিন্তু বাসাতে বাসাতে “ময়রাণী লো সই নীল গেজেছ কই?” ইত্যাদি দৃশ্যের অভিনয় চলিল। যতদূর স্মরণ হয় মাইকেল মধুসূসদন দত্ত এই গ্রন্থ ইংরাজীতে অনুবাদ করেন। পাদরী জেম্‌স লং সাহেব তাহা নিজের নামে প্রকাশ করিলেন। ইংলণ্ডেও আন্দোলন উপস্থিত হইল। নীলকরগণ আসল গ্রন্থকারকে না পাইয়া ইংলিসমান পত্রিকার সম্পাদককে মুখপাত্র করিয়া ১৮৬১ সালের ১৯ শে জুলাই লংএর নামে আদালতে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন।

 এরূপ মোকদ্দমা পূর্ব্বে কখনও হয় নাই। লং বিধিমতে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন যে তিনি বিদ্বেষবুদ্ধিতে কোনও কার্য্য করেন নাই। তিনি বহুবর্ষ হইতে দেশীয় সংবাদপত্রের ও ভাষায় লিখিত গ্রন্থাদির ভাব গবর্ণমেণ্টের গোচর করিয়া আসিতেছিলেন। নীলদর্পণের অনুবাদ সেই কার্য্যেরই অঙ্গস্বরূপ। কিন্তু তদানীন্তন ইংরাজপক্ষপাতী জজ সার মর্ডাণ্ট ওয়েল্‌স সে কথার প্রতি কর্ণপাত করিলেন না। তাহার বিচারে লংএর এক মাস কারাবাস ও এক হাজার টাকা জরিমানা হইল। তখন নীলকর বিদ্বেষ এদেশীয়দিগের মনে এমন প্রবল যে জরিমানার হুকুম হইবামাত্র, মহাভারতের অনুবাদক সুপ্রসিদ্ধ কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয়, জরিমানার হাজার টাকা গুণিয়া দিলেন। এরূপ শুনিয়াছি যে আরও অনেক দেশীয় ভদ্রলোক আদালতে জরিমানার টাকা দিবার জন্য টাকা লইয়া উপস্থিত ছিলেন।

 বলিতে কি ১৮৫৬ হইতে ১৮৬১ পর্য্যস্ত এই কাল বঙ্গসমাজের পক্ষে মহেন্দ্রক্ষণ বলিলে হয়। এই কালের মধ্যে বিধবাবিবাহের আন্দোলন, ইণ্ডিয়ান মিউটিনী, নীলের হাঙ্গামা, হরিশের আবির্ভাব, সোমপ্রকাশের অভ্যুদয়, দেশীয় নাট্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের তিরোভাব ও মধুসূদনের আবির্ভাব কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ ও ব্রাহ্মসমাজে নবশক্তির সঞ্চার প্রভৃতি ঘটনা ঘঠিয়াছিল। ইহার প্রত্যেকটাই বঙ্গসমাজকে প্রবলরূপে আন্দোলিত করিয়াছিল, প্রত্যেকটারই ইতিবৃত্ত গভীর অভিনিবেশ, সহকারে আলোচনার যোগ্য।

 নীলদর্পণ নাটকের যে এত আদর হইয়াছিল, তাহার একটা কারণ এই ছিল যে, সে সময়ে বঙ্গসমাজে নাট্যকাব্যের নব-অভ্যুদয় ও রঙ্গালয়ের আবির্ভাব নিবন্ধন লোকের মনে এক প্রকার উত্তেজনা চলিতেছিল। বঙ্গদেশে নাট্যকাব্যের অভ্যুদয় একটা বিশেষ ঘটনা তৎপুর্ব্বে যাত্রা, কবি, হাপ আকড়াই প্রভৃতি লোকের আমোদ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার একমাত্র উপায় ছিল। অধিকাংশ স্থলে এই যাত্রা, কবি ও হাপ আকড়াই অভদ্র ও অশ্লীল বিষয়ে পূর্ণ থাকিত। ইংরাজী শিক্ষা দেশমধ্যে যেমন ব্যাপ্ত হইতে লাগিল, সেই সঙ্গে সঙ্গে এই সকলের প্রতি শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের বিতৃষ্ণ জন্মিতে লাগিল। অনেকে যাত্রা কবি প্রভৃতিতে উপস্থিত থাকিতে লজ্জা বোধ করিতে লাগিলেন। তখন বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যে বসিয়া সুরাপান, ও হাস্য পরিহাস প্রভৃতি করাই তাঁহাদের একমাত্র সামাজিক আমোদ অবশিষ্ট রহিল। শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের মধ্যে অনেকে ইংরাজগণের স্থাপিত রঙ্গালয়ে গিয়া অভিনয় দর্শন করিতেন। সে সময়ে (১৮৫৬। ৫৭ সালে) সহরে ইংরাজদের একটা প্রসিদ্ধ রঙ্গালয় ছিল, তাহাতে দেশের অনেক শিক্ষিত লোক ও বড়লোক অভিনয় দেখিতে যাইতেন। দেখিয়া আসিয়া আমাদের মধ্যে এরূপ রঙ্গালয় নাই কেন বলিয়া ক্ষোভ করিতেন। তাহার ফলস্বরূপ সহরের দুই একজন বড়লোক উদ্যোগী হইয়া ইংরাজী শিক্ষিত ব্যক্তিদিগকে অভিনেতা করিয়া ইংরাজী নাটক অভিনয় করিয়া বন্ধুবান্ধবের চিত্ত-বিনোদন করিবার চেষ্টা করিতে আরম্ভ করিলেন। এ চেষ্টা তখন সম্পূর্ণ নূতন ছিল না। ইহার অনেক কাল পূর্ব্বে স্বপ্রসিদ্ধ প্রসন্নকুমার ঠাকুর মহাশয় একবার নিজের সুঁড়োর বাগানে এইচ, এইচ, উইলসন সাহেবের অনুবাদিত উত্তররামচরিত অভিনয় করিয়া বন্ধুবান্ধবকে দেখাইয়াছিলেন।

 দেশীয় ভদ্রলোকদিগের মধ্যে ইংরাজী অভিনয়ের আদর দেখিয়া ১৮৫৪ সালে ইংরাজদিগের রঙ্গালয়ের লোকের উদ্যোগী হইয়া ওরিয়েণ্টাল সেমিনারী ভবনে “ওরিয়েণ্টাল থিয়েটার” নামে এক শাখা রঙ্গালয় স্থাপন পুর্ব্বক সেক্সপীয়রের নাটক সকলের অভিনয় আরম্ভ করিলেন। তাহাতে দেশীয় শিক্ষিত সমাজে ইংরাজী অভিনয়ের ধূম লাগিয়া গেল। রঙ্গালয়ের অভিনয় একটা বৃতিকের মধ্যে দাঁড়াইল। স্কুলের ছেলে ছোকরার স্বীয় স্বীয় দলে ছোট ছোট রকমে ম্যাকবেথ প্রভৃতির অভিনয় আরম্ভ করিল। কিন্তু ক্রমে ধনিগণ অনুভব করিলেন যে ইংরাজী নাটক অভিনয় করিলে সাধারণের প্রীতিকর হয় না। এই জন্য বাঙ্গালী নাটকের অভিনয়ের দিকে তাহাদের দৃষ্টি পড়িল। এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের অন্যতম অধ্যাপক রামনারায়ণ তর্করত্ন মহাশর কোনও ধনি-প্রদত্ত পারিতোষিক লাভের উদ্দেশে “কুলীনকুল সর্ব্বস্ব” নামক এক নাটক রচনা করিয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহাশয়ের প্ররোচনায় ওরিয়েণ্টাল থিয়েটারে একবার তাহার অভিনয় হয়। ইহাতেই দেশীর নাটক অভিনয়ের দ্বার খুলিয়া গেল। তৎপরে ১৮৫৭ সালে সিমুলীয়ার বিখ্যাত ধনী অশুতোষ দেব (ছাতু বাবু) উদ্যোগী হইয়া শকুন্তলাকে বাঙ্গালা নাটকাকারে পরিণত করিয়া অভিনর করাইলেন। তৎপরেই মহাভারতের অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয় নিজ ভবনে বেণীসংহার নাটকের অভিনয় করাইলেন; এবং কিছু দিন পরে মহাসমারোহে তাহার নিজের অনুবাদিত বিক্রমোর্ব্বশী নাটকের অভিনয় হইল। দেখিতে দেখিতে সহরে বাঙ্গালা নাটক অভিনয়ের প্রথা প্রবর্ত্তিত হইয়া গেল।

 এইসকল অভিনয় দেখিয়া পাইকপাড়ার রাজপরিবারের দুই ভাই, রাজা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্রের এবং (মহারাজ) যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মনে একটা দেশীয় রঙ্গালয় স্থাপনের সংকল্প জন্মিল। তাঁহারা তিন জনে পরামর্শ করিয়া বেলগাছিয়া নামক উদ্যানে এক নাট্যালয় স্থাপন করিলেন; এই নাট্যালয় বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগ আনিয়া দিবার পক্ষে উপায়-স্বরূপ হইল। ইহা অমর কবি মধুসূদনের সহিত আমাদের পরিচয় করাইয়া দিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ১৮৫৬ সালে মান্দ্রাজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া তদানীন্তন কলিকাতার পুলিস কোর্টে কাজ করিতেছিলেন। কলিকাতার লোক তাঁহাকে চিনিত না। কেবল হিন্দুকালেজের কতিপয় সহাধ্যায়ী মাত্র তাঁহাকে চিনিতেন। বাবু গৌরদাস বসাক তাঁহাদের মধ্যে একজন। গৌরদাস বাবু তাঁহাকে নূতন নাট্যালয়ের উদ্যোগী ধনীদের সহিত পরিচিত করিয়া দেন। তাঁহারা ঐ নাট্যালয়ে ১৮৫৮ সালে সংস্কৃত রত্নাবলী নাটকের অনুবাদ করিয়া অভিনয় করিলেন। মধুসূদন তাঁহার ইংরাজী অনুবাদ করিয়া দিলেন। সেই ইংরাজী অনুবাদ দেখিয়াই মধুসূদনের বিদ্যাবুদ্ধির প্রতি রাজাদের নিরতিশয় 
মহারাজা স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, কে, সি, এস্‌, আই।
শ্রদ্ধা জন্মিল। মধুসূদন প্রাচীন সংস্কৃত নাটকের নিয়মবদ্ধ রীতি ত্যাগ পূর্ব্বক নুতন প্রণালীতে “শর্ম্মিষ্ঠা” নাটক রচনা করিলেন। তাহা সকলের হৃদয়-গ্রাহী হইল। মধুসূদনের প্রতিভার বিমল রশ্মি বঙ্গীয় সাহিত্যাকাশকে অপূর্ব্বরাগে অনুরঞ্জিত করিল। তাঁহার পদ্মাবতী, বুড়ো শালিকের ঘাড়ের রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা, কৃষ্ণকুমারী প্রভৃতি অপরাপর নাটক ক্রমে প্রণীত ও অভিনীত হইতে লাগিল।

 তাঁহার জীবনচরিতকার বলেন যে এই বেলগাছিয়া রঙ্গালয়ের সম্পর্ক হইতেই মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দ রচনার সূত্রপাত। তিনি নিজের প্রণীত কোন কোনও নাটকে ইংরাজ কবিদিগের অনুকরণে নায়ক-নায়িকার উক্তি প্রত্যুক্তিমধ্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা রচনা করিয়া যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহাশয়ের নিকট পাঠ করেন। এই বিষয় লইয়া উক্ত ঠাকুর মহাশয়ের সহিত তাঁহার মতভেদ উপস্থিত হয়। ঠাকুর মহাশয় বলেন যে ফরাসি ভাষার ন্যায় বাঙ্গালা ভাষা অমিত্রাক্ষর ছন্দের অনুকুল নহে। মধুসূদন প্রতিবাদ করিয়া বলেন—“বাঙ্গালা ভাষা যে সংস্কৃত ভাষার কণ্ঠ, তাহাতে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রচুর পরিমাণে লক্ষিত হয়, বাঙ্গালাতে কেন হইবে না? আমি অমিত্রাক্ষরে কাব্য রচনা করিয়া দেখাইব।” এই বলিয়া তনি “তিলোত্তমা” রচনা করিতে বসেন; এবং অল্পকাল মধ্যেই তাহার কিয়দংশ লিখিয়া বন্ধুগণের হস্তে অর্পণ করেন। ১৮৬০ সালে “তিলোত্তম-সম্ভব” কাব্যের কিয়দংশ রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত “বিবিধার্থ সংগ্রহ” নামক মাসিক পত্রে প্রকাশিত হয়। ইহার পরে তিন বৎসরের মধ্যেই মধুসূদনের অসাধারণ প্রতিভা দেখিতে দেখিতে প্রাতঃসূর্য্যের ন্যায় উঠিয়া যেন মাধ্যাহ্নিক রেখাকে অতিক্রম করিয়া গেল! তাঁহার ব্রজাঙ্গনা কাব্যমেঘনাদবধ প্রভৃতি প্রকাশিত হইলে তাঁহার কবিত্বখ্যাতি দেশমধ্যে ব্যাপ্ত হইল।

 বঙ্গসাহিত্য আকাশে মধুসূদন যখন উদিত হইলেন তথনও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রতিভার স্নিগ্ধ জ্যোতি তাহা হইতে বিলুপ্ত হয় নাই। কোথার আমরা গুপ্ত কবির রসিকতা ও চিত্তরঞ্জক ভাব সকলের মধ্যে নিমগ্ন ছিলাম, আর কোথায় আমাদেব চক্ষের সম্মুখে ধক্ ধক্ করিয়া কি প্রচণ্ড দীপ্তি উদিত হইল। বঙ্গসাহিত্যে সেই অপূর্ব্ব প্রদোষকালের কথা আমরা কখনই বিস্তৃত হইব না। সংস্কৃত কবি এক স্থানে বলিয়াছেনঃ—

ষাত্যেকতোস্তশিখরং পতিরোষধীনাং
আবিষ্কৃতারুণপুরঃসর একতোর্কঃ।

 একদিকে ওষধিপতি চন্দ্র অস্ত যাইতেছেন, অপরদিকে অরুণকে অগ্রসর করিয়া দিবাকর দেখা দিতেছেন।

 বঙ্গসাহিত্যজগতে যেন সেই প্রকার দশা ঘটিল! ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভার কমনীয় কান্তির মধ্যে মধুসূদনের প্রদীপ্ত রশ্মি আসিয়া পড়িল। বঙ্গসাহিত্যের পাঠকগণ আননের সহিত এক নূতন জগতে প্রবেশ করিলেন। মধুসূদনের গ্রন্থাবলী যখন প্রকাশিত হইল, তখন বঙ্গসমাজে মহা আলোচনা উপস্থিত হইল। বঙ্গীয় পাঠকগণ মধুসূদনের স্বপক্ষ ও বিপক্ষ দুই দলে বিভক্ত হইলেন। এক দল “প্রদানিয়া”, “সাত্ত্বনিয়া” প্রভৃতি পদকে বাঙ্গালা ভাষার যথেচ্ছাচার বলিয়া উপহাস ও বিদ্রুপ করিতে লাগিলেন; এবং মধুসূদনের অনুসরণে কাব্য রচনা করিয়া তাহাকে অপদস্থ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার প্রমাণ স্বরূপ ‘ছুঁছুন্দরীবধ কাব্যের” উল্লেখ করা যাইতে পারে। যাহারা ইহার কিঞ্চিৎ আভাস পাইতে চান, তাঁহারা পণ্ডিত প্রবর রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশরের রচিত বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিবৃত্তে উক্ত কাব্য হইতে উদ্ধৃতাংশ পাঠ করিয়া দেখিবেন। এক পক্ষ এক দিকে যখন এইরূপ বিরোধী, অপর পক্ষ অপরদিকে তেমনি গোঁড়া স্কুল ও কলেজের উচ্চশ্রেণীর অধিকাংশ বালক এই গোঁড়ার দলে প্রবেশ করিল। নব-প্রণীত অমিত্রাক্ষর ছন্দ কিরূপে ছন্দ ও যতির প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া পড়িতে হইবে, তাহা সকলে বুঝিতে পারিত না; দুই একজন অগ্রসর চালাক ছেলে মধুসূদনের নিজের মুখে শুনিয়া আসিয়াছে বলিয়া আসিয়া আমাদিগকে পড়িয়া শুনাইত। এক জন পড়িত বিশ জনে শুনিত। আমরা ঐ চালাক ছেলেদিগকে খুব বাহাদুর মনে করিতাম। এইরূপে ইংরাজ কবি কাউপার যেমন পোপ ও ড্রাইডেনের ছন্দ নিগড়ে দৃঢ়বদ্ধ ইংরাজী কাব্যে স্বাধীনতা ও ওজস্বিতা প্রবিষ্ট করিয়া নবজীবন আনয়ন পক্ষে উপায়স্বরূপ হইয়াছিলেন, তেমনি মধুসূদনের অলৌকিক প্রতিভা ভারতচন্দ্র ও গুপ্ত কবির রচিত ছন্দ-নিগড় হইতে বঙ্গীয় কাব্যকে উদ্ধার করিয়া তাহাতে ওজস্বিত ঢালিয়া নবজীবনের সঞ্চার করিল! মধুসুদন প্রধানতঃ অমিত্রাক্ষর ছন্দে নিজ প্রতিভাকে প্রকাশ করিয়াছিলেন বলিয়া এরূপ মনে করিতে হইবে না যে, মিত্রাক্ষর ছদ রচনাতে তিনি কম নিপুণ ছিলেন। তাহার রচিত ব্রজাঙ্গনা কাব্য তাহার প্রমাণ। ইহাতে তিনি মিত্রাঙ্গরে সরস সুমিষ্ট কবিতাতে মধুঢালিয়া রাখিয়াছেন।  অগ্রে যে কবিদ্বয়ের কথা বলা গেল তাঁহাদের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত উল্লেখ করা যাইতেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।

 সুখের বিষয়ে এত দিনের পর ইঁহার সমস্ত গ্রন্থাবলী মুদ্রিত হইতে আরস্তু হইয়াছে এবং ইহার বিশ্বাসযোগ্য জীবনচরিত পাওয়া যাইতেছে। ইনি কাচড়াপাড়ার বৈদ্যবংশীয় হরিনারায়ণ গুপ্তের দ্বিতীয় পুত্র। বাঙ্গালা ১২১৮ সালের ফান্তুন মাসে ইহার জন্ম হয়। ইহার পিতার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তিনি স্বীয় কুল ক্রমাগত চিকিৎসা ব্যবসায় পরিত্যাগ পুর্ব্বক স্বগ্রামের নিকটবর্ত্তী এক কুঠীতে ৮ টাকা বেতনের একটী কর্ম্ম করিতেন। কলিকাতা যোড়াসাঁকোতে ঈশ্বর চন্দ্রের মাতামহের আলয়। মাতামহ রামমোহন গুপ্ত উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে চাকুরী করিতেন। তাঁহার অবস্থাও তাদৃশ ভাল ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখন দশ বৎসর, তখন তাঁহার মাতৃবিয়োগ হয়। মাতৃবিয়োগের পর তিনি মাতামহের আলয়ে আসিয়া অধিকাংশ সময় থাকিতেন। এরূপ শুনিতে পাওয়া যায় যে, তিনি তৎকালে পড়াশুনাতে বড় অনাবিষ্ট ছিলেন। পাঠশালে যাইতেন বটে, কিন্তু পড়াশুনা অপেক্ষ খেলা ও দুষ্টামিতে বেশি মনোযোগী ছিলেন। বলিতে গেলে শিক্ষা যাহাকে বলে ঈশ্বরচন্দ্র তাহার কিছুই পান নাই। ইংরাজী শিক্ষা ত হইলই না; বাঙ্গালাও নিজে পড়িয়া যাহা শিখিলেন তাহাই একমাত্র সম্বল হইল। কিন্তু এই সম্বল লইয়াই তিনি অচিরকালের মধ্যে বাঙ্গালার সুকবি ও সুলেখক রূপে পরিচিত হইলেন।

 যৌবনের প্রারম্ভে পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র নন্দকুমার ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের সহিত তাঁহার আত্মীয়তা জন্মে। তাঁহাদেরই ভবনে তিনি অবসরকাল যাপন করিতেন। তাঁহাদেরই আশ্রয়ে, তাঁহাদেরই উৎসাহে, তাঁহার কবিত্বশক্তির স্ফূর্ত্তি হয়। তিনি অনেক সময় মুখে মুখে কবিতা রচনা করিয়া তাহাদিগকে শুনাইতেন; সখের কবির দলে গান বাধিতেন; বিশেষ বিশেষ ঘটনা ঘটিলে কবিতা রচনা করিয়া সকলের চিত্তবিনোদন করিতেন। এই যোগেন্দ্র মোহন ঠাকুরের প্ররোচনাতে, তাঁহারই সাহায্যে, বাঙ্গালা ১২৩৭ সালে, বা ইংরাজী ১৮৩০ সালে “সংবাদ-প্রভাকর” সাপ্তাহিক আকারে প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র তাহার সম্পাদন-ভার গ্রহণ করেন। সাপ্তাহিক প্রভাকর, প্রধানতঃ ইহার পদ্যময় প্রবন্ধ সকলের গুণে, সত্বর লোকের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করিল। দেখিতে দেখিতে ইহার গ্রাহক ও লেখক সংখ্যা বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। ঈশ্বরচন্দ্র দেশের অগ্রগণ্য ব্যক্তিদিগের মধ্যে একজন হইয়া দাঁড়াইলেন। পূর্বেই উক্ত হইয়াছে সুপ্রসিদ্ধ অক্ষয়কুমার দত্তের উৎসাহদাতাদিগের মধ্যে তিনি একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। অক্ষয়বাবু ইংরাজী পত্রিকাদি হইতে সংবাদ সংগ্রহ করিয়া দিতেন। ঈশ্বরচন্দ্রই তাঁহাকে তত্ত্ববোধিনী সভায় সভ্য হইতে প্ররোচনা করেন; এবং তিনিই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সহিত তাঁহাকে পরিচিত করিয়া দেন। বলিতে গেলে উত্তরকালে অক্ষয়কুমার দত্ত যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তই তাঁহার ভিত্তি স্থাপন করেন। কেবল তত্ত্ববোধিনী সভা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র তৎকালের অনেক সভা সমিতির সহিত সংযুক্ত ছিলেন; এবং বক্তৃতাদি করিয়া সকলকে উৎসাহিত করিতেন।

 তৎপরে ১২৩৯ সালে যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের কাল হওয়াতে “প্রভাকর” কিছুকালের জন্য উঠিয়া যায়। কিন্তু ঐ সালেই আন্দুলের জমীদার জগন্নাথ প্রসাদ মল্লিক মহাশয়ের উদ্যোগে “রত্নাবলী” নামে একথানি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মহেশ্চন্দ্র পাল নামক এক ব্যক্তি নামতঃ তাঁহার সম্পাদক ছিলেন; কিন্তু লিপিকার্য্যে তাঁহার পারদর্শিতা না থাকাতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়কেই সম্পাদকতা কার্যো বিশেষ সহায়তা করিতে হইত। কিন্তু একার্য্যে তিনি অধিক দিন থাকিতে পারেন নাই। কিছুদেিনর মধ্যেই স্বাস্থ্যের হানি নিবন্ধন সকল কার্য্য হইতে অবসৃত হইয়া কটকে তাঁহার পিতৃব্য শ্যামামোহন রায় মহাশয়ের আবাসে গিয়া কিছুদিন অবস্থিতি করেন। সেখানে একজন দণ্ডীর নিকট তন্ত্রশাস্ত্র পাঠ করিয়া তাহা বাঙ্গাল কবিতাতে অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হন। বাঙ্গালা ১২৪৩ সালের বৈশাখ মাসে ঈশ্বরচন্দ্র কটক হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া আবার প্রভাকরকে পুনরুর্জ্জীবিত করেন। তখন প্রভাকর সপ্তাহে তিন বার প্রকাশিত হইতে লাগিল। ১৮৪৫ সালের আষাঢ় মাস হইতে তাহা দৈনিক রূপে পরিণত হয়। এইবারে ঈশ্বরচন্দ্র অনেক পণ্ডিত ও সুলেখক ব্যক্তিকে স্বীয় কার্য্যের সহায়তার জন্য ব্রতী করিলেন। তন্মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগণার চাঙ্গড়িপোতা গ্রামনিবাসী হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন মহাশয় একজন প্রধান সহায় ছিলেন। ইনি “সোমপ্রকাশের” জন্মদাতা খ্যাতনামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের পিতা ও আমার মাতামহ।

 এখন হইতে “প্রভাকর” উদীয়মান রবিয় ন্যায় দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি-সম্পন্ন হইয়া উঠিতে লাগিল। প্রভাকরের কবিতা পড়িবার জন্য বাঙ্গাল দেশের লোক পাগল হইয়া উঠিল। প্রভাকর বাহির হইলে বিক্রেতৃগণ রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া ঐ সকল কবিতা পাঠ করিত এবং দেখিতে দেখিতে কত কাগজ বিক্রয় হইয়া যাইত! ক্রমে দেশে ঈশ্বরচন্দ্রী কবিদল দেখা দিল; এবং বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগের সূত্রপাত হইল। এখন যেমন ছোট বড়, পুরুষ স্ত্রীলোক যিনি কবিতা রচনা করেন তিনিই রবীন্দ্রনাথের ছাঁচে চালিয়া থাকেন, তখন কবিতা রচনার জন্য যে কেহ লেখনী ধারণ করিতেন তিনি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ঈশ্বরচন্দ্রের ছাঁচে ঢালিতেন। দেখিতে দেখিতে ঈশ্বরচন্দ্রের অনুকরণে শিষ্য-প্রশিষ্য-শাখা-প্রশাখা-সমন্বিত এক কবি-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইল। এই শিষ্যদলের মধ্যে সুধীরঞ্জন প্রণেতা দ্বারকানাথ অধিকারী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, হরিমোহন সেন, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনোমোহন বসু পরবর্তী সময়ে খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন। ইহাদের মধ্যে পদ্মিনীর উপাখ্যান প্রণেতা রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় কিয়ৎপরিমাণে গুরুর পদবী অতিক্রম করিয়া কিছু মৌলিকত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন। তাঁহার রচিত কবিতা এক সময় বঙ্গদেশের পাঠকবৃন্দকে বিশেষ আনন্দ প্রদান করিয়াছিল। আমাদের যৌবনকালে যে সকল ব্যক্তির প্রতিভা আমাদিগকে কাব্যজগতে প্রবেশ করিবার জন্য উন্মুখ করছিল, তন্মধ্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই।

 যাহা হউক ১৮৫৩ সালে ঈশ্বরচন্দ্র “পাষণ্ড-পীড়ন” নামক এক পত্র বাহির করেন। “ভাস্কর” পত্রের সম্পাদক গৌরীশঙ্কুর তর্কবাগীশ মহাশর কর্ত্তৃক প্রকাশিত “রসরাজ” পত্রের সহিত কবিতাযুদ্ধ ও গালাগালি করা ঐ “পাষণ্ড-পীড়নের” প্রধান কার্য্য হইয়া উঠে। তখন বঙ্গীয় আসরে প্রতিনিয়ত যে কবির লড়াই চলিত, সাহিত্যক্ষেত্রে সেই কবির লড়াইকে অবতীর্ণ করা উক্ত পত্রদ্বয়ের উদ্দেশ্য ছিল। সে অভদ্র, অশ্লীল, ব্রীড়াজনক উক্তি প্রত্যুক্তির বিষয় স্মরণ করিলে এখনও লজ্জা হয়। ইহাতে বঙ্গসাহিত্যজগতে এরূপ অশ্লীলতার স্রোত বহিয়াছিল, যাহার অনুরূপ নিকৃষ্ট রুচি আর কোনও দেশের ইতিবৃত্তে দেখা যায় না। প্রকাশ পত্রে যে সে সকল বিষয় কিরূপে প্রকাশিত হইত তাহা ভাবিলে আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়।

 সুখের বিষয় যে বাঙ্গালা ১২৫৪ সালের মধ্যেই পাষণ্ড-পীড়ন উঠিয়া যায়। বোধ হয় পাঠকবর্গের বিরক্তিই তাঁহার প্রধান কারণ হইয়া থাকিবে। কারণ ঐ ১২৫৪ সালেই ঈশ্বরচন্দ্র “সাধুরঞ্জন” নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। এখানিতে তাঁহার শিষ্য-মণ্ডলীর কবিতা ও প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হইত। এই পত্র বহুদিন জীবিত ছিল। ১২৬০ সাল হইতে ঈশ্বরচন্দ্র এক একখানি স্থূলকায় মাসিক প্রভাকর প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। তিনি ১২৬২ সালের আষাঢ় মাসে রায় গুণাকর ভারতচন্দ্রের জীবনচরিত সম্বলিত গ্রন্থাবলী পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এই তাঁহার প্রথম পুস্তক প্রকাশ। ১২৬৪ সালে প্রবোধপ্রভাকর নামে আর একখানি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তিনি আর দুইটী কার্য্যে হস্তার্পণ করিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই। প্রথম, বঙ্গীয় কবিগণের জীবনচরিত ও কাব্যসংগ্রহ। দ্বিতীয়, শ্রীমদ্ভাগবতের বাঙ্গালা অনুবাদ। এই উভয় কার্য্যেই তিনি হস্তার্পণ করিয়াছিলেন এবং তজ্জন্য প্রভূত পরিশ্রমও করিয়াছিলেন, কিন্তু উভয় কার্য্য সম্পন্ন করিবার পূর্ব্বেই তাঁহার দেহান্ত হয়। ১২৬৫ সালের মাঘ মাসের মাসিক ‘প্রভাকর প্রকাশ করিবার পরই তিনি কঠিন জ্বররোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুশষায় শয়ন করেন, এবং সেই জ্বরেই ১১ই মাঘ দিবসে তাঁহার মৃত্যু হয়।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

 ঈশ্বরচন্দ্র যখন মৃত্যুশষ্যাতে শয়ান, তখন মধুসূদন লোকচক্ষের অগোচয়ে থাকিয়া প্রতিভা-বলে উঠিয়া দাঁড়াইবার জন্য দুরন্ত পরিশ্রম করিতেছিলেন। মধুসূদন যশোর জেলাস্থ সাগরদাঁড়ী নামক গ্রামবাসী রাজনারায়ণ দত্তের পুত্র। তাঁহার পিতা কলিকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের একজন প্রসিদ্ধ উকীল ছিলেন; এবং তদুপলক্ষে কলিকাতায় উপনগরবর্ত্তী খিদিরপুর নামক স্থানে বাস করিতেন। ইংরাজী ১৮০৪ সালে, ১৫ জানুয়ারী তাঁহার জন্ম হয়। তাঁহার জননী জাহ্নবী দাসী কাটিপাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা। জাহ্নবীর জীবদ্দশাতেই বিলাস-পরায়ণ রাজনারায়ণ আর তিনটী বিবাহ করিয়াছিলেন। দুইটী সহোদর ভ্রাতার অকালে মৃত্যু হওরায় মধুসূদন স্বীয় জননীর একমাত্র পুত্র ছিলেন। সুতরাং তিনি শৈশববধি মায়ের অঞ্চলের নিধি, আদুরে ছেলে ছিলেন। রাজনারায়ণেয় অর্থের অভাব ছিল না; সুতরাং অর্থের দ্বারা সস্তানকে যতদূর আদর দেওয়া যায়,
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
 মধুসূদনের পিতামাতা পুত্রকে তাহা দিতে কখনই কৃপণতা করিতেন না। মধুসূদন প্রথমে সাগরদাঁড়ীতে জননীর নিকট থাকিয়া পাঠশালাতে, বিদ্যা শিক্ষা আরম্ভ করেন। ১২। ১৩ বৎসর বয়সে তাঁহার পিতা তাঁহাকে নিজের খিদিরপুরের বাটীতে আনিয়া হিন্দুকালেজে ভর্তি করিয়া দেন। কালেজে পদার্পণ করিবামাত্র মধুসূদনের আশ্চর্য ধীশক্তি সকলের গোচর হইল। তিনি ১৮৩৭ সালে কালেজে প্রবিষ্ট হইয়া ১৮৪১ সাল পর্যন্ত তথায় পাঠ করিয়াছিলেন। এই অল্পকালের মধ্যে সিনিয়ার স্কলারশিপের শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ করেন; এবং সকল শ্রেণীতেই অগ্রগণ্য বালকদিগের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছিলেন। সে সময়ে যাঁহারা তাঁহার সমাধ্যায়ী ছিলেন, তাঁহারা বলেন যে তিনি গণিত বিদ্যায় একেবারে অবহেলা প্রকাশ করিতেন এবং কাব্য ও ইতিহাস পাঠেই অধিক মনোযোগী ছিলেন। আদুরে ছেলের চরিত্রে যে সকল লক্ষণ প্রকাশ পায় তাহা এ সময়ে তাঁহার চরিত্রে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হইত। তিনি অমিতব্যয়ী, বিলাসী, আমোদ-প্রিয়, কাব্যানুরাগী ও বন্ধুবান্ধবের প্রতি প্রীতিমান ছিলেন। ধুলিমুষ্টির ন্যায় অর্থমুষ্টি ব্যয় করিতেন। সে সময়ে সুরাপান ইংরাজী শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের মধ্যে একটা সৎসাহসের কার্য্য বলিয়া গণ্য ছিল; মধুসূদনের সময়ে কালেজের অনেক ছাত্র সুরাপান করাকে বাহাদুরির কাজ মনে করিত। মধু তাঁহাদের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ছিলেন। এতদ্ব্যতীত অপরাপর অসমসাহসিক পাপকার্য্যেও তিনি লিপ্ত হইতেন। পিতামাতা দেখিয়াও দেখিতেন না; বরং অর্থ যোগাইয়া প্রকারান্তরে উৎসাহদান করিতেন। যাহা হউক, বিবিধ উচ্ছৃঙ্খলতা সত্ত্বেও মধুসুদন জ্ঞানানুশীলনে কখনই অমনোযোগী হইতেন না। কালেজে তিনি কাপ্তেন রিচার্ডসনের নিকট ইংরাজী-সাহিত্য পাঠ করিতেন। সৎক্ষেত্রে পতিত কৃষির ন্যায় রিচার্ডসনের কাব্যানুরাগ মধুর হৃদয়ে পড়িয়া সুন্দর ফল উৎপন্ন করিয়াছিল। তিনি ছাত্রাবস্থাতেই ইংরাজী কবিতা লিখিতে আরম্ভ করেন। প্রতিভার শক্তি কোথায় যাইবে! সেই ইংরাজী কবিতাগুলিতে তাঁহার যথেষ্ট কবিত্বশক্তি প্রকাশ পাইয়াছে।

কবিতারচনাতে ও পাঠ্যবিষয়ে তাঁহার কৃতিত্ব দেখিয়া সকলেই অনুমান করিতেন যে মধু কালে দেশের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি হইবেন। মধুর পিতামাতাও বোধ হয় সেই আশা করিতেন। কিন্তু যে প্রতিভার গুণে মধু অসাধারণ শক্তি প্রদর্শন করিতেন; সেই প্রতিভাই তাঁহাকে সুস্থির থাকিতে দিল না। যৌবনের উন্মেষ হইতে না হইতে তাঁহার আভ্যন্তরীণ শক্তি তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিতে লাগিল। গতানুগতিকের চিরপ্রাপ্ত বীথিকা তাঁহার অসহনীয় হইয়া উঠিল। দশজনে যাহা করিতেছে, দশজনে যাহাতে সস্তুষ্ট আছে, তাহা তাঁহার পক্ষে ঘৃণার বস্তু হইয়া উঠিল; তাঁহার প্রকৃতি নুতন ক্ষেত্র, নূতন কাজ, নূতন উত্তেজনার জন্য লালায়িত হইতে লাগিল।

 ইত্যবসরে তাহার জনকজননী তাঁহার এক বিবাহের প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। একটা আট বৎসরের বালিকা, যাহাকে চিনি না জানি না, তাঁহাকে বিবাহ করিতে হইবে, এই চিন্তা মধুকে ক্ষিপ্ত-প্রায় করিয়া তুলিল। তিনি পলায়নের পরামর্শ করিতে লাগিলেন। পলাইবেন কোথায়? একেবারে বিলাতে! তাহা না হইলে আর প্রতিভার খেয়াল কি! কার সঙ্গে যাইবেন, টাকা কে দিবে, সেখানে গিয়া কি করিবেন, তাহার কিছুরই স্থিরতা নাই; যখন পলাইতে হইবেই, তখন দেশ ছাড়িয়া একেবারে বিলাতে পলানই ভাল! পরামর্শ স্থির আগে হইল, টাকার চিন্তা পরে আসিল। ‘টাকা কোথায় পাই, বাবা জানিলে দিবেন না, মার নিকটেও পাইব না, আর ত কাহাকেও কোথায়ও দেখি না। শেষে মনে হইল মিশনারিদিগের শরণাপন্ন হই, দেখি তাঁহারা কিছু করিতে পারেন কি না। গেলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকটে; তিনি নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিলেন যে তাঁহার মনে খ্রীষ্টধর্ম্ম গ্রহণ অপেক্ষা বিলাত যাওয়ায় বাতিকটাই বেশী। এইরূপে আরও কয়েক দ্বারে ফিরিলেন। শেষে কি হইল, কি দেখিলেন, কি শুনিলেন, কি ভাবিলেন, কি বুঝিলেন, তাঁহার বন্ধুরা কিছুই জানিতে পারিলেন না।

 ১৮৪৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে বন্ধুগণের মধ্যে জনরব হইল যে, মধু খ্রীষ্টান হইবার জন্য মিশনারীদিগের নিকট গিয়াছে। অমনি সহরে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। হিন্দুকালেজের প্রসিদ্ধ ছাত্র ও সদর দেওয়ানী আদালতের প্রধান উকীল রাজনারায়ণ দত্তের পুত্র খ্রীষ্টান হইতে যায়—এই সংবাদে সকলের মন উত্তেজিত হইয়া উঠিল। রাজনারায়ণ পুত্রকে প্রতিনিবৃত্ত করিবার জন্য চেষ্টার অবধি রাখিলেন না। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। উক্ত সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রারম্ভে তিনি খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত হইলেন।

 আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারি তাঁহার পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনের মনে কিরূপ আঘাত লাগিল। কিন্তু তাঁহারা তাঁহাকে অর্থ সাহায্য করিতে বিরত হইলেন না। খ্রীষ্টধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া মধু হিন্দু কালেজ পরিত্যাগ করিলেন এবং বিধিমতে খ্রীষ্টীয় শাস্ত্র শিক্ষা করিবার জন্য বিশপস কালেজে প্রবেশ করিলেন। এখানে তিনি ১৮৪৩ সাল হইতে ১৮৪৭ সাল পর্য্যন্ত ছিলেন; এবং এখানে অবস্থানকালে হিব্রু, গ্রীক, লাটিন প্রভৃতি নানা ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু বিশপস কালেজেই বা কে তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখে? তাঁহার বিলাতগমনের খেয়ালটার যে কি হইল তাহার প্রকাশ নাই; কিন্তু বঙ্গদেশ তাঁহার পক্ষে আবার অসহ্য হইয়া উঠিল। আবার গতানুগতিকের প্রতি বিতৃষ্ণ জন্মিল; অবশেষে একদিন কাহাকেও সংবাদ না দিয়া একজন সহাধ্যায়ী বন্ধুর সহিত মাক্সাজে পলাইয়া গেলেন।

 মাদ্রাজে গিয়া তিনি এক নুতন অভাবের মধ্যে পড়িলেন। অর্থের জন্য তাঁহাকে কখনও চিন্তিত হইতে হয় নাই। দেশে থাকিতে পিতামাতা তাঁহার সকল অভাব দূর করিতেন। সেখানে তাঁহাকে নিজের উদরায় নিজে উপার্জ্জন করিতে হইল। কিন্তু তিনি ইংরাজী রচনাতে যেরূপ পারদর্শী ছিলেন, তাঁহার কাজের অভাব হইল না। তিনি মান্দ্রাজ সহরের ইংরাজ—সম্পাদিত কতকগুলি সংবাদপত্রে লিখিতে আরম্ভ করিলেন। অল্পকালের মধ্যেই তাঁহার খ্যাতি প্রতিপত্তি হইয়া উঠিল। ১৮৪৯ সালে “Captive Lady” নামে একখানি ইংরাজী পদ্যগ্রন্থ মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলেন। তাহাতে তাঁহার কবিত্বশক্তির ও ইংরাজীভাষাভিজ্ঞতার যথেষ্ট প্রশংসা হইল। কিন্তু মহাত্মা বেথুনের ন্যায় ভাল ভাল ইংরাজগণ তাহা দেখিয়া বলিলেন যে বিদেশীয়ের পক্ষে ইংরাজী কবিতা লিখিয়া প্রতিষ্ঠালাভের চেষ্টা করা মহা ভ্রম; তদপেক্ষা এরূপ প্রতিভা স্বদেশীয় ভাষাতে নিয়োজিত হইলে দেশের অনেক উপকার হইতে পারে।

 তাঁহার প্রতিভা আবার তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। সেখানে একজন ইংরাজমহিলার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক আর একটা ইংরাজমহিলাকে পত্নীভাবে লইয়া ১৮৫৬ সালে, আবার দেশে পলাইয়া আসিলেন। কিন্তু হায় দেশে আসিয়া কি পরিবর্ত্তনই দেখিলেন। পিতা মাতা এ জগতে নাই; আত্মীয় স্বজন বিধর্ম্মী বলিয়া তাঁহাকে মন হইতে পরিত্যাগ করিয়াছেন; পৈতৃক সম্পত্ত্বি অপরের গ্রাস করিয়া বসিয়াছে; বাল্যসুহৃদ ও সহাধ্যারিগণ তাঁহাকে ভুলিয়া গিয়াছেন; এবং নানা স্থানে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছেন; নব্যবঙ্গের রঙ্গভূমিতে নুতন একদল নেতা আসিয়াছেন, তাঁহাদের ভাব গতি অন্য প্রকার; এইরূপে মধুসূদন স্বদেশে আসিয়াও যেন বিদেশীয়দিগের মধ্যে পড়িলেন। এই অবস্থাতে তাঁহার বন্ধু গৌরদাস বসাকের সাহায্যে কলিকাতা পুলিস আদালতে ইণ্টারপ্রিটারি কর্ম্ম পাইয়া, তাহা অবলম্বন পুর্ব্বক দিন যাপন করিতে লাগিলেন।

 কিরূপে তাঁহার বন্ধু গৌরদাস বাবু তাঁহাকে পাইকপাড়ার রাজাদ্বয়ের ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহাশয়ের সহিত পরিচিত করিয়া দেন, কিরূপে তাঁহারা সংস্কৃত রত্নাবলী নাটকের বাঙ্গালা অনুবাদ করাইয়া বেলগাছিয়া রঙ্গালয়ে তাঁহার অভিনয় করান ও তৎসূত্রে উক্ত অনুবাদের ইংরাজী অনুবাদ করিয়া কিরূপে মধুসূদন শিক্ষিতব্যক্তিগণের নিকট পরিচিত হন, তাহা পূর্ব্বে কিঞ্চিৎ বর্ণন করিয়াছি। বলিতে কি ঐ রত্নাবলীর ইংরেজী অনুবাদ মধুসূদনের প্রতিভা বিকাশের হেতুভূত হইল। তিনি সংস্কৃত নাটক রচনার রীতির দোষগুণ ভাল করিয়া অনুভব করিলেন; এবং এক নবপ্রণালীতে বাঙ্গালা নাটক রচনার বাসনা তাঁহার অন্তরে উদিত হইল। তিনি তদনুসারে ১৮৫৮ সালে “শর্ম্মিষ্ঠা” নামক নাটক রচনা করিয়া মুদ্রিত করিলেন। মহা সমারোহে তাহা বেলগাছিয়া রঙ্গালয়ে অভিনীত হইল। তৎপরেই মধুসুদন প্রাচীন গ্রীসদেশীয় পুরাণ অবলম্বন করিয়া “পদ্মাবতী” নামে আর একখানি নাটক রচনা করেন। এই উভয় গ্রন্থে তিনি যশোলাভে কৃতকার্য্য হইয়া বাঙ্গালা ভাষাতে গ্রন্থ রচন বিষয়ে উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। ইহার পরেই তিনি “একেই কি বলে সভ্যতা” ও “বুড়োশালিকের ঘাড়ের রে” নামে দুই খানি প্রহসন রচনা করেন। তৎপরে ১৮৬০ সালে রাজেদ্রলাল মিত্র-সম্পাদিত “বিবিধার্থসংগ্রহ” নামক পত্রে তাঁহার নব অমিত্রাক্ষর ছন্দে প্রণীত “তিলোত্তম-সম্ভব কাব্য” প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয়; এবং অল্পকাল পরেই পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়। তিলোত্তমা বঙ্গসাহিত্যে এক নূতন পথ আবিষ্কার করিল। বঙ্গীয় পাঠকগণ নূতন ছন্দ, নূতন ভাব, নূতন ওজস্বিতা দেখিয়া চমকি উঠিলেন। মধুসূদনের নাম ও কীর্ত্তি সর্ব্বসাধারণের আলোচনার বিষয় হইল।

 ইহার পরে তিনি “মেঘনাদবধ” কাব্য রচনাতে প্রবৃত্ত হন। ইহাই বঙ্গ সাহিত্য সিংহাসনে তাহার আসন চিরদিনের জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। তাহার জীবনচরিতকার সত্যকথাই বলিয়াছেন, এবং আমাদেরও ইহা অত্যাশ্চর্য্য বলিয়া মনে হয় যে তাঁহার লেখনী যখন “মেঘনাদের” বীররস চিত্রনে নিযুক্ত ছিল, তখন সেই লেখনীই অপরদিকে “ব্রজাঙ্গনার” সুললিত মধুর রস চিত্রনে ব্যাপৃত ছিল। এই ঘটনা তাঁহার প্রতিভাকে কি অপুর্ব্ববেশে আমাদের নিকট আনিতেছে! একই চিত্রকর একই সময়ে কিরূপে এরূপ দুইটী চিত্র চিত্রিত করিতে পারে! দেখিয়া মনে হয়, মধুসূদনের নিজ প্রকৃতিকে দ্বিভাগ করিবার শক্তিও অসাধারণ ছিল। তাঁহার জন্যই বোধ হয় এত দুঃখ দরিদ্র্যের মধ্যে, এত ঘনঘোর বিধাদের মধ্যে, এত জীবনব্যাপী অতৃপ্তি ও অশাস্তির মধ্যে বসিয়া তিনি কবিতা রচনা করিতে পারিয়াছেন!

 যাহা হউক তিনি কলিকাতাতে আসিয়া একদিকে যেমন কাব্য-জগতে নবযুগ আনয়নের চেষ্টা করিতে লাগিলেন, অপরদিকে জ্ঞাতিগণের হস্ত হইতে নিজ প্রাপ্য পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সে বিষয়ে কতদূর কৃতকার্য হইয়াছিলেন, তাহা বলিতে পারি না। তবে এ কথা নিশ্চিত, যে তিনি যাহা কিছু পাইয়াছিলেন ও যাহা কিছু নিজে উপার্জ্জন করিতেন, হিসাব করিয়া চলিতে পারিলে তাহাতেই এক প্রকার দিন চলিবার কথা ছিল। কিন্তু পিতামাতার যে আদুরে ছেলে জীবনে একদিনের জন্য আয় ব্যয়ের সমতার প্রতি দৃষ্টিপাত করে নাই, সে আজ তাহা করিবে কিরূপে? কিছুতেই মধুর দুঃখ ঘুচিত না। প্রবৃত্তিকে যে কিরূপে শাসনে রাখিতে হয় তাহা তিনি জানিতেন না। মনে করিতেন প্রবৃত্তির চরিতার্থতাই মুখ। রাবণ তাহার আদর্শ, “ভিখারী রাঘব” নহে; সুতরাং হস্তে অর্থ আসিলেই তাহা প্রবৃত্তির অনলে আহুতির ন্যায় যাইত! সুধের জোয়ার দুইদিনের মধ্যে ফুরাইয়া, মধু ভাটার কাটখানার মত, যে চড়ার উপরে, সেই চড়ার উপরে পড়িয়া থাকিতেন। কেহ কি মনে করিতেছেন ঘৃণার ভাবে এই সকল কথা বলিতেছি? তা নয়। এই সরস্বতীর বরপুত্রের দুঃখ দারিদ্র্যের কথা স্মরণ করিয়া চক্ষের জল রাখিতে পারি না; অথচ এই কাব্যকাননের কলকণ্ঠ কোকিলকে ভাল না বাসিয়াও থাকিতে পারি না। অন্ততঃ তাঁহাতে একটা ছিল না; প্রদর্শনের ইচ্ছ ছিল না। কপটতা বা ভণ্ডামির বিন্দুমাত্র ছিল না। এই জন্য মধুকে ভালবাসি। আর একটা কথা, এমন প্রাণের তাজা ভালবাসা মানুষকে অতি অল্পলোকেই দেয়, এজন্যও মধুকে ভালবাসি। মধুসূদনের প্রতিভা আবার তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। ইংরাজ কবি সেক্সপীয়র বলিয়াছেন 'কবিগণ পাগলের সামিল।' তাই বটে; ১৮৬১ সালে মধুসূদনের মাথায় একটা নূতন পাগলামি বুদ্ধি আসিল। সেটা এই যে তিনি বিলাতে গিয়া বারিষ্টার হইবেন। লোকে বলিতে পারেন, এটা আবার পাগলামি কি? এত সদবুদ্ধি। যদি এ পৃথিবীতে বারিষ্টারি করিবার অনুপযুক্ত কোনও লোক জন্মিয়া থাকেন, তিনি মধুসূদন দত্ত। তাঁহার প্রকৃতির অস্থি মজ্জাতে বারিষ্টারির বিপরীত বস্তু ছিল; আইন আদালতের গতি লক্ষ্য করা, মক্কেলদিগের কাছে বাধা থাকা, নিয়মিত সময়ে নিয়মিত কাজ করা, তিনি ইহার সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি তাহা বুঝলেন ন। ১৮৬২ সালের জুন মাসের প্রারম্ভে পত্নী ও শিশু কন্যা ও পুত্রকে রাখিয়া বারিষ্টার হইবার উদ্দেশ্যে বিলাত যাত্রা করিলেন। সেখানে গিয়া ৫ বৎসর ছিলেন। এই পাঁচ বৎসর তাঁহার দারিদ্র্যের ও কষ্টের সীমা পরিসীমা ছিল না। যাহাদের প্রতি নিজের বিষয় রক্ষা ও অর্থসংগ্রহের ভার দিয়া গিয়াছিলেন, এবং যাহাদের মুখাপেক্ষা করিয়া স্ত্রী পুত্র রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহারা সে বিশ্বাসানুরূপ কার্য্য করিল না। হায়! দেশের কি অধোগতিই হইয়াছে! তাঁহার স্ত্রী পুত্র কষ্ট সহ্য করিতে না পারিয়া ১৮৬৩ সালে বিলাতে তাঁহার নিকট পলাইয়া গেল। তাহাতে তাঁহার ব্যয়বৃদ্ধি হইয়া দারিদ্র্য ক্লেশ বাড়িয়া গেল। তিনি ইংলণ্ডে প্রাণধারণ করা অসম্ভব দেখিয়া, ফরাসিদেশে পলাইয়া গেলেন। সেখানে ঋণদায় ও কয়েদের ভয়ে তাঁহার দিন অতিকষ্টেই কাটিতে লাগিল। অনেক দিন সপরিবারে অনাহারে বাস করিতে হইতে; প্রতিবেশিগণের মধ্যে দয়াশীল ব্যক্তিদিগের সাহায্যে সে ক্লেশ হইতে উদ্ধার লাভ করিতেন। এরূপ অবস্থাতেও তিনি কবিতা রচনাতে বিরত হন নাই। এই সময়েই তাঁহার “চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী” রচিত হয়। ইহাই তাঁহার অলোকসামান্য প্রতিভার শেষফল বলিলে হয়। ইহার পরেও তিনি কোন কোনও বিষরে হস্তার্পণ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার পূর্ণতা সম্পাদন করিতে পারেন নাই।

 বিদেশবাসের দুঃখ কষ্টের মধ্যে পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার দুঃখের কথা জানিয়া তাঁহাকে সাহায্য করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন। যথাসময়ে তাঁহার সাহায্য না পাইলে, আর তাঁহার দেশে ফিরিয়া আসা হইত না। যাহা হউক তিনি উক্ত মহাত্মার সাহায্যে রক্ষা পাইয়া কোনও প্রকারে বারিষ্টারিতে উত্তীর্ণ হইয়া দেশে ফিরিয়া আসিলেন। বারিষ্টারি কার্য্যে সুদক্ষ হইবার উপযুক্ত বিদ্যা বুদ্ধি তাঁর ছিল, ছিল না কেবল স্থিরচিত্ততা, তাঁহার মনের স্থিতি-স্থাপকতা শক্তি যেন অসীম ছিল। তিনি দুঃখের মধ্যে যখন পড়িতেন, তখন ভাবিতেন, আপনার প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া চলিবেন, কিন্তু স্বন্ধের জোয়ালটা একটু নামাইলেই নিজ মূর্ত্তি ধরিতেন, আবার সুখের আলোর পশ্চাতে ছুটতেন। দেশে যখন ফিরিয়া আসিলেন, তখন তাঁহার নাম সম্ভ‌্রম আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, সাহায্য করিবার লোক আছে, যদি আপনাকে একটু সংযত করিয়া, নিজ কর্ত্তব্যে মন দিয়া বসিতেন, বারিষ্টারিতেই কিছু করিয়া উঠিতে পারিতেন। কিন্তু পাগলা কীটে তাঁহাকে সুস্থির বা সংযত হইতে দিল না। তিনি কয়েক বৎসর নানাস্থানে ঘুরিয়া নিজ অবস্থার উন্নতির জন্য বিফল চেষ্টা করিলেন। অবশেষে ১৮৭৩ সালের জুন মাসে নিতান্ত দৈন্যদশায় উপায়ান্তর না দেখিয়া, কলিকাতা আলিপুরের জেনারেল হস্পিটাল নামক হাসপাতালে আশ্রয় লইলেন। তাঁহার পত্নী হেনরিয়েটা তখন মৃত্যুশয্যায় শয়ানা! মধুসূদনের মৃত্যুর তিন দিন পূর্ব্বে হেনরিয়েটার মৃত্যু হইল। মৃত্যুশয্যাতে সমগ্র জীবনের ছবি মধুসূদনের স্মৃতিতে উদিত হইয়া তাঁহাকে অধীর করিয়াছিল। এরূপ শুনিতে পাওয়া যায় যে মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকাইয়া তাঁহার নিকট খ্রীষ্টধর্ম্মে অবিচলিত বিশ্বাস স্বীকার পূর্ব্বক ও পরমেশ্বরের নিকট নিজ দুস্কৃতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া দেহত্যাগ করেন। ১৮৭৩ সাল, ২৯ শে জুন রবিবার, তিনি ভবধাম পরিত্যাগ করেন।

 যে ১৮৫৬ হইতে ১৮৬১ সাল পর্য্যন্ত কালকে বঙ্গসমাজের মাহেন্দ্রক্ষণ বলিয়াছি, সেই কালের মধ্যে আর যে যে ঘটনা ঘটিয়াছিল এবং যে যে প্রতিভা: শালী ব্যক্তি দেখা দিয়াছিলেন, তাহাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পরে দিব। এক্ষণে এই কালের অন্তর্গত দুই একটা ঘটনা আনুষঙ্গিকরূপে উল্লেখ করা আবশ্যক বোধ হইতেছে। কাল আইন (Black Acts) এর আন্দোলনের উল্লেখ অগ্রেই করিয়াছি। সে আন্দোলন একবার উঠিয়া থামিয়াছিল মাত্র। ১৮৫৭ সালের প্রারম্ভে আবার সেই আন্দোলন উঠে। অনেক দিন হইতে ইংরাজ কর্ত্তৃপক্ষ, এবং হাইকোর্টের, জজগণ অনুভব করিয়া আসিতেছিলেন, যে মফস্বলবাসী ইংরাজদিগকে সম্পূর্ণরূপে কোম্পানির ফৌজদারি আদালতের অধীন না করিলে এদেশীয় গরীব প্রজাদিগের উপরে তাঁহাদের, দৌরাত্ম্য নিবারণ করিতে পারা যাইবে না। ১৮৫৬ সালের মধ্যে নীলকরদিগের অত্যাচারের কথা কর্তৃপক্ষের ও কলিকাতাবাসী ইংরাজগণের কর্ণগোচর হওয়াতে সেই মনের ভাব প্রবল হইয়া উঠে। তদনুসারে ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে, কলিকাতা হাইকোর্টের চীফ জষ্টিস্ সুপ্রসিদ্ধ সার বার্ণেস পীকক্‌ গবর্ণর জেনারেলের মন্ত্রিসভাতে কোম্পানির মফস্বলস্থ ফৌজদারি আদালতের এলাকা বৰ্দ্ধিত করিবার ও ইংরাজগণকে তদধীন করিবার উদ্দেশ্যে এক বিল উপস্থিত করেন। ইহাতে ইংরাজগণের মধ্যে আবার এক আন্দোলন উপস্থিত হয়। কিন্তু এবারে তাহারা কোম্পানির আদালতের অধীন হইব না, এই রবটী না তুলিয়া, এদেশীয় বিচারকদিগের বিচারাধীন হইব না, এবং ইংরাজ জুরির সহায়তা ভিন্ন তাহাদের বিচার হইবে না, এই বাণী ধরিলেন। ইহা কতকটা ইলবার্ট বিলের আন্দোলনের ন্যায়। ইংরাজদিগের চেম্বর অব কমার্স, ট্রেড্‌স এসোসিএসন, ইণ্ডিগো প্লাণ্টার্স এসোসিএশন প্রভৃতি সমুদয় সভা এই আন্দোলনে যোগ দিয়া টাউনহলে এক প্রকাণ্ড সভা করিলেন। রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশনের প্রধান প্রধান সভ্যগণ এই আন্দোলনের প্রতি উদাসীন থাকিলেন না। তাহারা হরিশের ও হিন্দু পেট্টিয়টের সাহায্যে দেশের লোককে জাগ্রত করিয়া তুলিলেন। দেশের মান্য গণ্য সমুদয় শিক্ষিত ব্যক্তি সমবেত হইয়া ১৮৫৭ সালের এপ্রেল মাসে টাউন হলে এক সভা করিলেন। ঐ সভাতে কোর্ট অব ডাইরেক্টারদিগের নিকটে প্রেরণের জন্য এক আবেদন পত্র গৃহীত হইল। সে আবেদন পত্রে ১৮০০ লোকের স্বাক্ষর হইয়াছিল। কিন্তু তৎপরেই মিউটনীর হাঙ্গামা উপস্থিত হওয়াতে তৎপরবর্ত্তী নবেম্বর মাসের পূর্ব্বে তাহা যথাস্থানে প্রেরণ করা হয় নাই। এদেশীয়দিগের আবেদন পত্রের দশা যাহা হয়, ঐ আবেদন পত্রের দশাও তাহাই হইয়াছিল। রাজরা বাহা ভাল বুঝিলেন তাহাই করিলেন, আবেদনকারীদিগের ফেউ ফেউ করা সার হইল। এপ্রেল মাসে টাউনহলে যে সভা হয়, তাহার উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে সুবিখ্যাত বাগ্মী জর্জ টমসন সাহেবের উপস্থিতি একটা বিশেষ ঘটনা। তিনি ঐ সালে আবার একবার এদেশে আসিয়াছিলেন। তৎপরে বোধ হয় মিউটনীর গোলমাল উপস্থিত হওয়াতে নিজ কার্ধ্যসাধনের সুযোগ না দেখিয়া দেশে ফিরিয়া যান।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি এই কালের একজন প্রধান পুরুষ ছিলেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁহার পশ্চাতে রামগোপাল ঘোষ, দিগম্বর মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রভৃতি নব্যবঙ্গের তদানীন্তন নেতা ও ডিরোজিও শিষ্যদলের অগ্রণী ব্যক্তিগণ উৎসাহদাতারূপে ছিলেন। কাহার, কাহারও মুখে এইরূপ ক্ষোভের কথা শুনিতে পাই যে রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতিই দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান হরিশকে সুরাপানে লিপ্ত করিয়াছিলেন। এ অপবাদ কতদূর সত্য তাহা জানি না; তবে তাহারা যে হরিশের পৃষ্ঠপোষক, উৎসাহদাতা, ও পরামর্শদাতা ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। বলা বাহুল্য যে লাহিড়ী মহাশল্পও এই উৎসাহদাতা বন্ধুদিগের মধ্যে একজন ছিলেন। মিউটনীর হাঙ্গামা উপস্থিত হইবার সময়ে আমরা তাঁহাকে বারাসতে রাখিয়া আসিয়াছি। বারাসত হইতে তিনি ১৮৫৮ সালে দ্বিতীয় বার কৃষ্ণনগর কলেজে যান।

 কৃষ্ণনগর হইতে ১৮৫৯ সালে কলিকাতার দক্ষিণবর্ত্তী রসাপাগলা নামক স্থানে টিপু সুলতানের বংশীয়দিগের শিক্ষার জন্য স্থাপিত ইংরাজী স্কুলে দ্বিতীয় শিক্ষক হইয়া আসেন। টিপু সুলতান নিহত হইলে ইংরাজগণ যখন তাহার বংশীয়দিগকে বন্দী করিয়া আনেন, তখন তাঁহাদিগকে অযোধ্যার নবাবের ন্যায় কলিকাতার উপকণ্ঠেই রাখা স্থির করেন। তদনুসারে রসাপাগলা নামক স্থানে তাঁহাদের উপনিবেশ স্থাপন করা হয়। ইহাদিগকে রসাতে স্থাপন করিয়াই গবর্ণমেণ্ট ইহাদের বংশধরগণের শিক্ষার উপায় বিধানার্থ অগ্রসর হন। মহা সমারোহে এক ইংরাজী স্কুল স্থাপিত হয়। যে সময়ে লাহিড়ী মহাশয় সেখানে দ্বিতীয় শিক্ষকরূপে গমন করেন, তখন মিঃ স্কট্ নামে একজন ইংরাজ হেড মাষ্টার ছিলেন। সে সময়ে যাঁহারা রসাপাগলা স্কুলে লাহিড়ী মহাশয়ের নিকট পাঠ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মুখে শুনিয়াছি যে, প্রথম শ্রেণীর ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি পড়াইবার ভার তাঁহার প্রতি ছিল; সেই সকল বিষয় তিনি এমন সুন্দররূপে পড়াইতেন ষে ছাত্রগণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় থাকিত। তাঁহার ভূগোল পাঠনার রীতির বিষয় পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি। ছাত্রেরা বুঝুক, না বুঝুক, ভালবাসুক, না বাসুক, তাহাদের মস্তিষ্কে কতকগুলি জ্ঞাতব্য বিষয় প্রৰিষ্ট করাইয়া দিতেই হইবে, এ রীতিকে তিনি অন্তরের সহিত ঘৃণা করিতেন। তিনি যে বিষয় ছাত্রদিগকে শিখাইতে যাইতেন, সে বিষয়ে আগে তাহাদের কৌতুহল জন্মাইবার চেষ্টা করিতেন। তৎপ্রসঙ্গে নানা কথা বলিয়া, সমগ্র বিষয়টা তাঁহাদের মনের সমক্ষে উপস্থিত করিতেন; তৎপরে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসু দেখিয়া সেই জ্ঞাতব্য বিষয়টা তাহাদের নিকট উপস্থিত করিতেন। একবার তাহা উত্তমরূপে বিধৃত করিয়া তৎপরেই আবার প্রশ্নের দ্বারা ছাত্রদিগের মুখ হইতে বাহির করিবার চেষ্টা করিতেন। এইরূপে বিষয়টা জন্মের মত ছাত্রগণের মনে মুদ্রিত হইয়া যাইত। ইহার ভিতরে যদি ছাত্রদিগের অন্তরে কোনও মহৎ সত্য বা উদার ভাব মুদ্রিত করিবার অবসর আসিত তাহা হইলে তিনি উৎসাহে আত্মহারা হইয়া যাইতেন। তখন আর পাঠ্য বিষয়ে মন থাকিত না। এই সকল কারণে পাঠ্যগ্রন্থে পাঠের উন্নতি আশানুরূপ হইত না। সেজন্য তিনি কখন কখনও কর্তৃপক্ষের বিরাগ-ভাজন হইতেন। পূর্ব্বেই বলিয়ছি তাঁহার ছাত্রগণ পাঠ্য বিষয়ে অধিক উন্নতি করিত না বটে, কিন্তু যেটুকু পড়িত তাহাতেই ব্যুৎপত্তি লাভ করিত; এবং তদ্ভিন্ন নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করিয়া সুশিক্ষিত হইত। কেবল তাহা নহে, হৃদয় মন চরিত্রে এমন কিছু পাইত যাহা চিরদিনের মত জীবনপথের সম্বল হইয়া থাকিত। রসাপাগলাতে লাহিড়ী মহাশয় যে অল্পকাল ছিলেন, তাহার মধ্যেও অনেক যুবককে প্রকৃত সাধুতার পথ দেখাইয়া যান।

 রসাপাগলাতে অবস্থান কালে তিনি কলিকাতার অতি সন্নিকটেই থাকিতেন; সুতরাং সর্ব্বদাই কলিকাতার বন্ধুদিগের সহিত গিয়া মিশিতেন। রামগোপাল ঘোষের ভবন তাঁহার নিজের বাড়ীর মত ছিল। অবসর পাইলেই সেখানে গিয়া রাত্রি যাপন করিতেন। সেই সূত্রে তৎকাল-প্রসিদ্ধ প্রায় প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তির সহিত তাঁহার আলাপ ও আত্মীয়তা হইয়াছিল। অবশ্য তিনি সুরাপানের গোষ্ঠীতে থাকিতেন। কিন্তু তাহার ফল এই হইত যে, তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া অপর সকলকে সংযত হইয়া চলিতে হইত। কেহই অভদ্র আচরণ করিতে সাহস করিত না। আমি লাহিড়ী মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি যে এই সময়ে তিনি একটী বিশেষ কারণে বহুদিনের জন্য সুরাপান পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। একদিন তিনি দেখিলেন যে রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের সম্পৰ্কীয় একটা যুবক অতিরিক্ত সুরাপান করিয়া অতি অভদ্র আচরণ করিতেছে। দেখিয়া তাহার অতিশয় লজ্জা বোধ হইল, তিনি রামগোপাল ঘোষকে বলিলেন—“দেখ রামগোপাল, আমাদের সুরাপান দেখিয়া বাড়ীর ছেলের খারাপ হইয়া যাইতেছে। আজ তোমার * * * এর অতি অভদ্র আচরণ দেখিয়াছি। এস আমরা স্বরাপান পরিত্যাগ করি।” রামগোপাল বাবু বোধ হয় সে উপদেশ গ্রহণ করিলেন না; কিন্তু তদবধি লাহিড়ী মহাশয় বহুকাল সুরাপান করেন নাই। পুরাতন বন্ধুদিগকে ভালবাসিতেন; সুরা-গোষ্ঠীতে থাকিতেন; কিন্তু সুরাপান করিতেন না। এ নিয়ম বহুবৎসর ছিল। পরে অসুস্থ হইয়া পড়িলে ডাক্তারদিগের ও বন্ধুগণের পরামর্শে এ নিয়ম ভঙ্গ হয়। আমার বিশ্বাস তাহাতে তাঁহার দেহ মনের মহা অনিষ্ট সাধন করিয়াছিল।

 রসাপাগলা হইতে লাহিড়ী মহাশয় ১৮৬০ সালের প্রারম্ভে বরিশাল জেলা স্কুলের হেডমাষ্টার হইয়া গমন করেন। সেখানে তিনমাস মাত্র ছিলেন। কিন্তু সেই অল্পকালের মধ্যে ছাত্রগণের মনে অবিনশ্বর স্মৃতি রাখিয়া আসিয়াছেন। এই সময় যাঁহারা তাঁহার নিকট পাঠ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই এখন প্রাচীন। তাঁহাদের মুখে শুনিতে পাই যে মধুবিন্দুর চারিদিকে যেমন পিপীলিকাশ্রেণী যোটে, তেমনি সন্ধ্যার সময় বালকগণ লাহিড়ী মহাশয়ের চারিদিকে যুটিত। তিনি স্কুলগৃহের নিকটস্থ পুষ্করিণীর বাঁধাঘাটে তাহাদের মধ্যে সমাসীন হইয়া বিবিধ বিষয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতেন; এবং কথোপকথনচ্ছলে নানা তত্ত্ব - তাঁহাদের গোচর করিতেন। ইহার আকর্ষণ এমনি ছিল যে, বালকগণ গুরুজনের নিকট তিরস্কার সহ্য করিয়াও সেখানে আসিতে ছাড়িত না। কোন কোনও বালক সেই হইতে চিরজীবনের মত সাধুতার দিকে গতি পাইয়াছে। তাঁহারা এক একজন এখন কর্ম্মক্ষেত্রে দণ্ডায়মান। সকলেই লাহিড়ী মহাশয়কে চিরদিন গুরুর ন্যায় ভক্তি শ্রদ্ধা করিয়া আসিয়াছেন; এবং এখনও তাঁহার স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করিতেছেন।

 বরিশাল হইতে ১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে লাহিড়ী মহাশয় আবার কৃষ্ণনগর কালেজে আসিলেন। এই কৃষ্ণনগর কালেজ হইতেই ১৮৬৫ সালের নবেম্বর মাসে পেন্সন লইয়া কর্ম্ম হইতে অবসৃত হন। তিনি যথন পেন্সনের জন্য আবেদন করেন তখন মিঃ আলফ্রেড স্মিথ, কৃষ্ণনগর কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। লাহিড়ী মহাশয়ের আবেদন ডিরেক্টারের নিকট প্রেরণ করিবার সময় স্মিথ সাহেব লিখিয়াছিলেন:—

 “In parting with Baboo Ram Tanoo Lahiri I may be allowed to say that Government will lose the Services of an educational officer, than whom no officer has discharged his public duties with greater fidelity, zeal and devotion, o. i has laboured more assiduously and successfully for the moral elevation of his pupils.”

 অর্থ-বাবু রামতনু লাহিড়ীকে বিদায় নিবার সময় আমি বলিতে চাই যে ইনি চলিয়া গেলে গবর্ণমেণ্ট এমন একজন শিক্ষক হারাইবেন, যাঁহার অপেক্ষা আর কোনও শিক্ষক অধিক বিশ্বস্ততা, উৎসাহ ও তৎপরতার সহিত স্বীয় কর্তব্যসাধন করেন নাই অথবা ছাত্রগণের নৈতিক উন্নতির জন্য অধিক শ্রম করেন নাই, বা সে বিষয়ে অধিক কৃত কার্য্যতা লাভ করেন নাই।”

 কালেজের অধ্যক্ষ তাঁহার পত্রে যে কয়েকটা কথা বলিয়াছিলেন তাহা শত শত হৃদয়ের অন্তর্নিহিত বাণীর পুনরুক্তি মাত্র। যদি কোনও মানুষের সম্বন্ধে এ কথা সত্য হয়—"তিনি শিক্ষক হইয়াই জন্মিয়াছিলেন,” তাহা লাহিড়ী মহাশয়ের সম্বন্ধে। তিনি যে শিক্ষকতা কার্য্যে অসাধারণ কৃতকার্য্যতা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাঁহার ভিতরকার কথা এই বুঝিয়াছি যে তিনি নিজে চিরজীবন আপনাকে শিক্ষাধীন রাখিয়াছিলেন। কোনও নুতন বিষয় জানিবার জন্য তাঁহার যে ব্যগ্রতা ও জানিলে যে আনন্দ দেখিয়াছি, অন্য কোনও মানুষে সেরূপ আগ্রহ বা আনন্দ দেখি নাই। উত্তরকালে যখন তিনি অশীতিপর স্থবির, তখনও কাহারও মুখে কোনও ভাল কথা শুনিলে, আনন্দে অস্থির হইয়া উঠিতেন; বলিতেন “রসো, রসে কথাটা লিখে নি” এই বলিয়া স্মারক-লিপির পুস্তকখানি বাহির করিতেন। শিক্ষকাবস্থাতে ছাত্রগণকে যখন শিক্ষা দিতেন, তখন কোনও বালক যদি কখনও তাহার কোনও ভ্রম প্রদর্শন করিত, বা তাহার কৃত কোনও ব্যাখ্যা অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর ব্যাখ্যা দিতে পারিত, তাহা হইলে তিনি শিশুর ন্যায় বিনীতভাবে শুনিতেন, এবং ব্যাখ্যাটী উৎকৃষ্ট হইলে আনন্দ প্রকাশ করিতেন।

 এই কৃষ্ণনগর কলেজে শেষ অবস্থানকালের কয়েকটী গল্প শুনিয়াছি। একবার লাহিড়ী মহাশয় পাঠ্য বিষয়ের কোনও এক অংশের ব্যাখ্যা করিতেছেন, ইতিমধ্যে একটা বালক বলিল, “মহাশয়, ওটার মানে ত ওরকম নয়।” তিনি অমনি তন্মনষ্ক, “সে কি? তুমি কি আর কোনও অর্থ জান না কি?” তখন বালকটী আর এক প্রকার ব্যাখ্যা দিতে প্রবৃত্ত হইল। ব্যাখ্যা শুনিয়া লাহিড়ী মহাশয় অতিশয় আনন্দিত হইলেন, “এ মানে তুমি কোথায় পেলে?” অনুসন্ধানে জানিলেন, তাহার একজন শিক্ষিত আত্মীয় বলিয়া দিয়াছেন। তখন প্রীত হইয়া বলিলেন—“এমন শিক্ষিত উপযুক্ত লোক যার ঘরে তার ভাবনা কি?” আর একটা গল্প ইহা অপেক্ষাও সুন্দর। একবার একটা বালক তাঁহার প্রদত্ত কোনও ব্যাখ্যার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করিল। তখন তিনি আর এক বার অধিকতর বিশদরূপে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন; যখন কৃতকার্য হইলেন না, তখন অন্ততম শিক্ষক উমেশচন্দ্র দন্ত মহাশয়কে ডাকিয়া আনিলেন —“তুমি আমার ক্লাসের ছেলেদিগকে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেও।” তখন ছাত্রমহলে, ছাত্রমহলে কেন দেশের শিক্ষিতদলে, সুপ্রসিদ্ধ উমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের ইংরাজী ভাষাভিজ্ঞ বলিয়া মহা খ্যাতি ছিল। তিনি আসিয়া যখন বিষয়টা ব্যাখ্যা করিয়া দিলেন, লাহিড়ী মহাশয় বলিলেন– দেখিলে আমি ঠিক ব্যাখ্যাই দিয়াছিলাম, তবে ওর মত আমার ইংরাজীতে বিদ্যা নাই, তাই অমন সুন্দর করে বুঝাতে পারি নাই। ওঁর মত কয়টা মানুষ বাঙ্গাল দেশে ইংরাজী জানে?” বাস্তবিক ইংরাজী বিদ্যা বিষয়ে তাঁহার বন্ধু উমেশচন্দ্র দত্তের প্রতি তাঁহার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। বাৰ্দ্ধক্যে ইংরাজী ভাষার কোনও বিষয় লইয়া আমাদের সহিত তর্ক হইলে উমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়কে নজীরের মত উল্লেখ করিয়া বলিতেন, “উমেশের চেয়ে তোমরা ইংরাজী জন কি না।”

 তাঁহার এই সময়ের শিক্ষকতা সম্বন্ধে আর একটা কথা শুনিয়াছি, তাহা বোধ হয় শিক্ষকতা কার্য্যের প্রারম্ভ হইতেই তাঁহার চরিত্রে ছিল। অনেক শিক্ষক অনেক সময় ছাত্রদিগের সমক্ষে নিজ অজ্ঞতা প্রকাশ করিতে লজ্জিত হন। নিজে যা জানেন না, সেটাও জানেন এইরূপ দেখান, এবং কোনও রূপে যোড়াতাড়া দিয়া, গোঁজা মিলন দিয়া, ছাত্রদিগকে বুঝাইবার প্রয়াস পান। বলা বাহুল্যমাত্র যে লাহিড়ী মহাশয় এরূপ আচরণকে অতি নিন্দনীয় মনে করিতেন। ছাত্রগণ কোনও প্রশ্ন করিলে, যদি তাঁহার সদুত্তর দেওয়া কঠিন মনে করিতেন, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ বলতেন—“দেখ এটা আমার জানা নাই, জানিয়া কাল তোমাকে বলিব।” তৎপরে গৃহে গিয়া সে বিষয়ে চিন্তা করিতেন, বা বিশ্রামগৃহে উমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের নিকট জানিয়া লইতেন। পরে আসিয়া প্রশ্নকর্ত্তাকে জানাইয়া দিতেন।

 যতদূর জানা যায়, বরিশালে থাকিবার সময়েই তাঁহায় স্বাস্থ্য ভগ্ন হয়, এবং কৃষ্ণনগরে আসিয়াই তাঁহাকে কিছু দীর্ঘকালের জন্য ছুটী লইতে হয়। ছটী লইয়া তিনি কলিকাতার সন্নিকটে বালী উত্তরপাড়াতে ছিলেন। সেখান হইতে কৃষ্ণনগরেই গমন করেন, এবং সেখান হইতে ১৮৬৫ সালে পেনশন লইয়া কর্ম্ম হইতে অবসৃত হন।

 এই কয়েক বৎসরের মধ্যে তাঁহার পারিবারিক জীবনে অনেকগুলি ঘটনা ঘটে। ১৮৫৭ সালের চৈত্রমাসে বৃদ্ধ পিতা রামকৃষ্ণ স্বর্গারোহণ করেন। লাহিড়ী মহাশয় উপবীত পরিত্যাগ করার পর তিনি মর্ম্মাহত হইয়াছিলেন; এবং শেষ দশাতে কেবল ইষ্টদেবতার নাম করিয়াই দিন যাপন করিতেন। তাঁহার অবসান কাল সেইরূপ সাধুর প্রস্থানের উপযুক্তই হইয়াছিল। অপর দুই ঘটনা তাঁহার দুই পুত্রের জন্ম। দ্বিতীয় পুত্র শরৎকুমারের ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দে ৩রা ভাদ্র দিবসে কলিকাতা সহরে জন্ম হয়। ১৮৬২ সালের মাঘ মাসে কৃষ্ণনগরে তৃতীয় পুত্র বসন্তকুমার জন্মগ্রহণ করেন।