রাশিয়ার চিঠি/পল্লীসেবা

উইকিসংকলন থেকে

পল্লীসেবা

শ্রীনিকেতনের উৎসবে কথিত

বেদে অনন্তস্বরূপকে বলেছেন আবিঃ, প্রকাশস্বরূপ। তাঁর প্রকাশ আপনার মধ্যেই সম্পূর্ণ তাঁর কাছে মানুষের প্রার্থনা এই যে, “আবিরাবীৰ্ম এধি”—হে আবি, আমার মধ্যে তােমার আবির্ভাব হােক। অর্থাৎ, আমার আত্মায় অনন্তস্বরূপের প্রকাশ চাই। জ্ঞানে প্রেমে কর্মে আমার অভিব্যক্তি অনন্তের পরিচয় দেবে, এতেই আমার সার্থকতা। আমাদের চিত্তবৃত্তি থেকে, ইচ্ছাশক্তি থেকে, কর্মোদ্যম থেকে অপূর্ণতার আবরণ ক্রমে ক্রমে মােচন করে অনন্তের বঙ্গে নিজের সাধর্ম্য প্রমাণ করতে থাকব, এই হচ্ছে মানুষের ধর্মসাধনা।

 অন্য জীবজন্তু যেমন অবস্থায় সংসারে এসেছে সেই অবস্থাতেই তাদের পরিণাম। অর্থাৎ, প্রকৃতিই তাদের প্রকাশ করেছে এবং সেই প্রকৃতির প্রবর্তন মেনেই তারা প্রাণযাত্রা নির্বাহ করে, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু নিজের ভিতর থেকে নিজের অন্তরতর সত্যকে নিরন্তর উদ্ঘাটিত করতে হবে নিজের উদ্যমে—মানুষের এই চরম অধ্যবসায়। সেই আত্মােপলব্ধ সত্যেই তার প্রকাশ, প্রতিনিয়ন্ত্রিত প্রাণযাত্রায় নয়। তাই তার দুরূহ প্রার্থনা এই যে, সকল দিকেই অনন্তকে যেন প্রকাশ করি। তাই সে বলে, ভূমৈব সুখং, মহত্ত্বেই সুখ, নাল্পে সুখমন্তি, অল্প-কিছুতেই সুখ নেই।

 মানুষের পক্ষে তাই সকলের চেয়ে দুর্গতি যখন আপনার জীবনে সে আপন অন্তর্নিহিত ভূমাকে প্রকাশ করতে পারলে না—বাধাগুলাে শক্ত হয়ে রইল। এই তার পক্ষে মৃত্যুর চেয়ে বড়াে মৃত্যু। আহারে বিহারে তােগে বিলাসে সে পরিপুষ্ট হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের দীপ্তিতে, ত্যাগের শক্তিতে, প্রেমের বিস্তারে, কর্মচেষ্টার সাহসে সে যদি আপনার প্রবুদ্ধ মুক্তস্বরূপ কিছু পরিমাণেও প্রকাশ করতে না পারে তবে তাকেই বলে মহতী বিনষ্টিঃ —সে বিনষ্টি জীবের মৃত্যুতে নয়, আত্মার অপ্রকাশে।

 সভ্যতা যাকে বলি তার এক প্রতিশব্দ হচ্ছে ভূমাকে প্রকাশ। মানুষের ভিতরকার যে নিহিতার্থ, যা তার গভীর সত্য, সভ্যতায় তারই আবিষ্কার চলছে। সভ্য মানুষের শিক্ষাবিধি এত ব্যাপক, এত দুরূহ, এইজন্যেই। তার সীমা কেবলই অগ্রসর হয়ে চলেছে, সভ্য মানুষের চেষ্টা প্রতিনির্দিষ্ট কোনাে গণ্ডীকে চরম বলতে চাচ্ছে না।

 মানুষের মধ্যে নিত্যপ্রসার্যমান সম্পূর্ণতার যে আকাঙ্ক্ষা তার দুটো দিক, কিন্তু সরা পরস্পরযুক্ত। একটা ব্যক্তিগত পূর্ণতা আর একটা সামাজিক, এদের মাঝখানে ভেদ নেই। ব্যক্তিগত উৎকর্ষের ঐকান্তিকতা অসম্ভব। মানবলােকে যাঁরা শ্রেষ্ঠ পদবী পেয়েছেন তাঁদের শক্তি সকলের শক্তির ভিতর দিয়েই ব্যক্ত, তা পরিচ্ছিন্ন নয়। মানুষ যেখানে ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন, পরস্পরের সহযােগিতা যেখানে নিবিড় নয়, সেইখানেই বর্বরতা। বর্বর একা একা শিকার করে, খণ্ড খণ্ড ভাবে জীবিকার উপযুক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, সেই জীবিকার ভােগ অত্যন্ত ছোটো সীমার মধ্যে। বহুজনের চিত্তবৃত্তির উৎকর্ষসহযােগে নিজের চিত্তের উৎকর্ষ, বহুজনের শক্তিকে সংযুক্ত করে নিজের শক্তি, বহুজনের সম্পদকে সম্মিলিত করার দ্বারা নিজের সম্পদ প্রতিষ্ঠিত করাই সভ্য মানবের লক্ষ্য।

 উপনিষৎ বলেন, আমরা যখন আপনার মধ্যে অন্যকে ও অন্যের মধ্যে আপনাকে পাই তখনই সত্যকে পাই—ন ততাে বিজুগুপ্সতে—তখন আর গােপনে থাকতে পারি নে, তখনই আমাদের প্রকাশ। সভ্যতায় মানুষ প্রকাশমান, বর্বরতায় মানুষ অপ্রকাশিত। পরস্পরের মধ্যে পরস্পরের আত্মােপলব্ধি যতই সত্য হতে থাকে ততই সভ্যতার যথার্থ স্বরূপ পরিস্ফুট হয়। ধর্মের নামে, কর্মের নামে, বৈষয়িকতার নামে, স্বাদেশিকতার নামে, যেখানেই মানুষ মানবলােকে ভেদ সৃষ্টি করেছে সেইখানেই দুর্গতির কারণ গােচরে অগােচরে বল পেতে থাকে। সেখানে মানব আপন মানবধর্মকে আঘাত করে, সেই হচ্ছে আত্মঘাতের প্রকৃষ্ট পন্থা। ইতিহাসে যুগে যুগে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

 সভ্যতা-বিনাশের কারণ সন্ধান করলে একটিমাত্র কারণ পাওয়া যায়, সে হচ্ছে মানবসম্বন্ধের বিকৃতি বা ব্যাঘাত। যারা ক্ষমতাশালী ও যারা অক্ষম, তাদের মধ্যেকার ব্যবধান প্রশস্ত হয়ে সেখানে সামাজিক সামঞ্জস্য নষ্ট হয়েছে। সেখানে প্রভুর দলে, দাসের দলে, ভাগীর দলে, অভূক্তের দলে সমাজকে দ্বিখণ্ডিত করে সমাজদেহে প্রাণপ্রবাহের সঞ্চরণকে অবরুদ্ধ করেছে; তাতে এক অঙ্গের অতিপুষ্টি এবং অন্য অঙ্গের অতিশীর্ণতায় রােগের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই এই ছিদ্র দিয়ে আজ যমের চর আনাগােনা করছে। আমাদের দেশে তার প্রবেশপথ অন্য দেশের চেয়ে আরও যেন অবারিত। এই দুর্ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে।

 একদিন আমাদের দেশে পল্লীসমাজ সজীব ছিল। এই সমাজের ভিতর দিয়েই ছিল সমস্ত দেশের যােগবন্ধন, আমাদের সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা ধর্মকর্মের প্রবাহ পল্লীতে পল্লীতে ছিল সঞ্চারিত। দেশের বিরাট চিত্ত পীতে পল্লীতে প্রসারিত হয়ে আশ্রয় পেয়েছে, প্রাণ পেয়েছে। এ-কথা সত্য যে, আধুনিক অনেক জ্ঞানবিজ্ঞান সুযােগসুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলুম। তখন আমাদের চেষ্টার পরিধি ছিল সংকীর্ণ, বৈচিত্র্য ছিল স্বল্প, জীবনযাত্রার আয়ােজনে উপকরণে অভাব ছিল বিস্তর। কিন্তু সামাজিক প্রাণক্রিয়ার যােগ ছিল অবিচ্ছিন্ন। এখন তা নেই। নদীতে স্রোত যখন বহমান থাকে তখন সেই স্রোতের দ্বারাই এপারে ওপারে এদেশে ওদেশে অনাগােনা-দেনাপাওনার যােগ রক্ষা হয়। জল যখন শুকিয়ে যায় তখন এই নদীরই খাতু বিষম বিন্ন হয়ে ওঠে। তখন এক কালের পথটাই হয় অন্য কালের অপথ। বর্তমানে তাই ঘটেছে।

 যাদের আমরা ভদ্রসাধারণ নাম দিয়ে থাকি তারা যে বিদ্যালাভ করে, তাদের যা আকাঙ্ক্ষা ও সাধনা, তারা যে-সব সুযােগসুবিধা ভােগ করে থাকে সে-সব হল মরা নদীর শুষ্ক গহ্বরের এক পাড়িতে তার অপর পাড়ির সঙ্গে জ্ঞানবিশ্বাস আচার-অভ্যাস দৈনিক জীবনযাত্রায় দুস্তর দূরত্ব। গ্রামের লােকের না আছে বিদ্যা, না আছে আরােগ্য, না আছে সম্পদ, না আছে অন্নবস্ত্র। ওদিকে যারা কলেজে পড়ে, ওকালতি করে, ডাক্তারি করে, ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেয়, তারা রয়েছে দ্বীপের মধ্যে; চারিদিকে অতলস্পর্শ বিচ্ছেদ।

 যে-স্নায়ুজালের যােগে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বেদনা দেহের মর্মস্থানে পৌছয়, সমস্ত দেহের আত্মবােধ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বােধের সম্মিলনে সম্পূর্ণ হয়, তার মধ্যে যদি বিচ্ছিন্নতা ঘটে তবে তাে মরণদশা। সেই দশা আমাদের সমাজে। দেশকে মুক্তিদান করবার জন্যে আজ যারা উৎকট অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত এমন-সব লােকের মধ্যেও দেখা যায়, সমাজের মধ্যে গুরুতর ভেদ যেখানে, যেখানে পক্ষাঘাতের লক্ষণ, সেখানে তাদের দৃষ্টিই পড়ে না। থেকে থেকে বলে ওঠেন, কিছু করা চাই; কিন্তু কণ্ঠের সঙ্গে সঙ্গে হাত এগােয় না। দেশ সম্বন্ধে আমাদের যে উদ্যোগ তার থেকে দেশের লােক বাদ পড়ে। এটা আমাদের এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, এর বিপুল বিড়ম্বনা সম্বন্ধে আমাদের বােধ নেই। একটা তার দৃষ্টান্ত দিই।

 আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষাবিধি বলে একটা পদার্থের আবির্ভাব হয়েছে। তারই নামে স্কুলকলেজ ব্যাঙের ছাতার মতো ইতস্তত মাথা তুলে উঠেছে। এমন ভাবে এটা তৈরি যে, এর আলাে কলেজি মণ্ডলের বাইরে অতি অল্পই পৌছয়—সূর্যের আলাে চাঁদের আলােয় পরিণত হয়ে যতটুকু বিকীর্ণ হয় তার চেয়েও কম। বিদেশী ভাষার স্থূল বেড়া তার চারদিকে। মাতৃভাষার যােগে শিক্ষাবিস্তার সম্বন্ধে যখন চিন্তা করি সে-চিন্তার সাহস অতি অল্প। সে যেন অন্তঃপুরিকা বধূর মতােই ভীরু। আঙিনা পর্যন্তই তার অধিকার, তার বাইরে চিবুক পেরিয়ে তার ঘােমটা নেমে পড়ে। মাতৃভাষার আমল প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যেই, অর্থাৎ সে কেবল শিশুশিক্ষারই যােগ্য— অর্থাৎ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনাে ভাষা শেখবার সুযােগ নেই, সেই বিরাট জনসংঘকে বিদ্যার অধিকার সম্বন্ধে চিরশিশুর মতােই গণ্য করা হয়েছে। তারা কোনােমতেই পুরাে মানুষ হয়ে উঠবে না অথচ স্বরাজ সম্বন্ধে তারা পুরাে মানুষের অধিকার লাভ করবে, চোখ বুজে এইটে আমরা কল্পনা করি।

 জ্ঞানলাভের ভাগ নিয়ে দেশের অধিকাংশ জনমণ্ডলী সম্বন্ধে এতবড়ো অনশনের ব্যবস্থা আর কোনাে নবজাগ্রত দেশে নেই—জাপানে নেই, পারস্যে নেই, তুরস্কে নেই, ইজিপ্টে নেই। যেন মাতৃভাষা একটা অপরাধ, যাকে খ্রীস্টান ধর্মশাস্ত্রে বলে আদিম পাপ। দেশের লােকের পক্ষে মাতৃভাষাগত শিক্ষার ভিতর দিয়ে জ্ঞানের সর্বাঙ্গসম্পূর্ণতা ভামরা কল্পনার বাইরে ফেলে রেখেছি। ইংরেজি হােটেলওয়ালার দোকান ছাড়া আর কোথাও দেশের লোকের পুষ্টিকর অন্ন মিলবেই না এমন কথা বলাও যা আর ইংরেজি ভাষা ছাড়া মাতৃভাষার যােগে জ্ঞানের সম্যক সাধনা হতেই পারবে না এও বলা তাই।

 এই উপলক্ষ্যে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, আধুনিক সমস্ত বিদ্যাকে জাপানী ভাষার সম্পূর্ণ আয়ত্তগম্য করে তবে জাপানী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সত্য ও সম্পূর্ণ করে তুলেছে। তার কারণ, শিক্ষা বলতে জাপান সমস্ত দেশের শিক্ষা বুঝেছে—ভদ্রলােক বলে এক সংকীর্ণ শ্রেণীর শিক্ষা বােঝে নি। মুখে আমরা যাই বলি, দেশ বলতে আমরা যা বুঝি সে হচ্ছে ভদ্রলােকের দেশ। জনসাধারণকে আমরা বলি, ছােটোলোক; এই সংজ্ঞাটা বহুকাল থেকে আমাদের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করেছে। ছোটোলােকদের পক্ষে সকল প্রকার মাপাঠিই ছােটো। তারা নিজেও সেটা স্বীকার করে নিয়েছে। বড় মাপের কিছুই দাবি করবার ভরসা তাদের নেই। তারা ভদ্রলােকের ছায়াচর, তাদের প্রকাশ অনুজ্জ্বল, অথচ দেশের অধিকাংশই তারা, সুতরাং দেশের অন্তত বারাে আনা অনালােকিত। ভদ্রসমাজ তাদের স্পষ্ট করে দেখতেই পায় না, বিশ্বসমাজের তো কথাই নেই।

 রাষ্ট্রীয় আলােচনার মত্ত অবস্থায় আমরা মুখে যাই কিছু বলি-না কেন, দেশাভিমান যত তারস্বরে প্রকাশ করি না কেন—আমাদের দেশ প্রকাশহীন হয়ে আছে বলেই কর্মের পথ দিয়ে দেশের সেবায় আমাদের এত ঔাসী। যাদের আমরা ছােটো করে রেখেছি মানবস্বভাবের কৃপণতাবশত, তাদের আমরা অবিচার করেই থাকি। তাদের দোহাই দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে অর্থসংগ্রহ করি—কিন্তু তাদের ভাগে পড়ে বাক্য, অর্থটা অবশেষে আমাদের দলের লােকের ভাগ্যেই এসে জোটে। মােট কথাটা হচ্ছে, দেশের যে অতিক্ষুদ্র অংশে বুদ্ধি বিদ্যা ধন মান সেই শতকরা পাঁচ পরিমাণ লােকের সঙ্গে পঁচানব্বই পরিমাণ লােকের ব্যবধান মহাসমুদ্রের ব্যবধানের চেয়ে বেশি। আমরা এক দেশে আছি অথচ আমাদের এক দেশ নয়।

 শিশুকালে আমাদের ঘরে যে সেজের দীপ জ্বলত তার এক অংশে অল্প তেল অপর অংশে অনেকখানি জল ছিল। জলের অংশ ছিল নিচে, তেলের অংশ ছিল উপরে। আলো মিটমিট করে জ্বলত, অনেকখানি ছড়াত ধোঁয়া। এটা কতকটা আমাদের সাবেক কালের অবস্থা। ভদ্রসাধারণ এবং ইতরসাধারণের সম্বন্ধটা এইরকমই ছিল। তাদের মর্যাদা সমান নয় কিন্তু তবুও তারা উভয়ে একত্র মিলে একই আলাে জ্বালিয়ে রেখেছিল। তাদের ছিল একটা অখণ্ড আধার। আজকের দিনে তেল গিয়েছে একদিকে, জল গিয়েছে আর-একদিকে; তেলের দিকে আলাের উপাদান অতি সামান্য, জলের দিকে একে-বারেই নেই।

 বয়স যখন হল ঘরে এল কেরােসিনের ল্যাম্প বিদেশ থেকে; তাতে সবটাতেই এক তেল, সেই তেলের সমস্তটার মধ্যেই উদ্দীপনার শক্তি। আলাের উজ্জ্বলতাও বেশি। এর সঙ্গে য়ুরােপীয় সভ্যসমাজের তুলনা করা যেতে পারে। সেখানে এক জাতেরই বিদ্যা ও শক্তি দেশের সকল লােকের মধ্যেই ব্যাপ্ত। সেখানে উপরিতল নিম্নতল আছে, সেই উপরি তলের কাছেই বাতি দীপ্ত হয়ে জলে, নিচের তল অদীপ্ত। কিন্তু সেই ভেদ অনেকটা আকস্মিক; সমস্ত তেলের মধ্যেই দীপ্তির শক্তি আছে। সে হিসাবে জ্যোতির জাতিভেদ নেই; নিচের তেল যদি উপরে ওঠে তাহলে উজ্জ্বলতার তারতম্য ঘটে না। সেখানে নিচের দলের পক্ষে উপরের দলে উত্তীর্ণ হওয়া অসাধ্য নয়; সেই চেষ্টা নিয়তই চলছে।

 আর-এক শ্রেণীর বাতি আছে; তাকে বলি বিজলি বাতি। তার মধ্যে তারের কুণ্ডলী আলাে দেয়, তার আগাগােড়াই সমান প্রদীপ্ত। তাঁর মধ্যে দীপ্ত-অদীপ্তের ভেদ নেই। এই আলো, দিবালােকের প্রায় সমান। য়ুরােপীয় সমাজে এই বাতি জ্বালাবার উদ্যোগ সব দেশে এখন চলছে না; কিন্তু কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে—এর যন্ত্রটাকে পাকা করে তুলতে হয়তাে এখনো অনেক ভাঙচুর করতে হবে, যন্ত্রের মহাজন কেউ কেউ হয়তাে দেউলে হয়ে যেতেও পারে, কিন্তু পশ্চিম মহাদেশে এইদিকে একটা ঝােঁক পড়েছে সে-কথা আর গােপন করে রাখবার জো নেই। এইটে হচ্ছে প্রকাশের চেষ্টা, মানুষের অন্তর্নিহিত ধর্ম; এই ধর্মসাধনায় সকল মানুষই অবাহত অধিকার লাভ করবে, এই রকমের একটা প্রয়াস ক্রমশই যেন ছড়িয়ে পড়ছে।

 কেবল আমাদের হতভাগ্য দেশে দেখি, মাটির প্রদীপে যে-আলো একদিন এখানে জ্বলেছিল তাতেও অজি বাধা পড়ল। আজ আমাদের দেশের ডিগ্রিধারীরা পল্লীর কথা যখন ভাবেন তখন তাদের জন্যে অতি সামান্য ওজনে কিছু করাকেই যথেষ্ট বলে মনে করেন। যতক্ষণ আমাদের এইরকমের মনোভাব ততক্ষণ পল্লীর লোকেরা আমাদের পক্ষে বিদেশী। এমন কি, তার চেয়েও তারা বেশি পর, তার কারণ এই —আমরা স্কুলে কলেজে যেটুকু বিদ্যা পাই সে-বিদ্যা য়ুরোপীয়। সেই বিদ্যার সাহায্যে য়ুরোপীয়কে বোঝা ও য়ুরোপীয়ের কাছে নিজেকে বোঝানে আমাদের পক্ষে সহজ। ইংলও ফ্রান্স জার্মানির চিত্তবৃত্তি আমার কাছে সহজে প্রকাশমান; তাদের কাব্য গল্প নাটক যা আমরা পড়ি সে আমাদের কাছে হেঁয়ালি নয়; এমন কি, যে-কামনা যে-তপস্যা তাদের, আমাদের কামনা-সাধনাও অনেক পরিমাণে তারই পথ নিয়েছে। কিন্তু যারা মা-ষষ্ঠী মনসা ওলাবিবি শীতল ঘেঁটু রাহু শনি ভূত প্রেত ব্রহ্মদৈত্য গুপ্তপ্রেসপঞ্জিকা পাণ্ডা পুরুতের আওতায় মানুষ হয়েছে তাদের থেকে আমরা খুব বেশি উপরে উঠেছি তা নয়; কিন্তু দুরে সরে গিয়েছি, পরস্পরের মধ্যে ঠিকমতো সাড়া চলে না। তাদের ঠিকমতো পরিচয় নেবার উপযুক্ত কৌতুহল পর্যন্ত আমাদের নেই।

 আমাদের কলেজে যারা ইকনমিক্স, এথনোলজি পড়ে তারা অপেক্ষা করে থাকে য়ুরোপীয় পণ্ডিতের— পাশের গ্রামের লোকের আচার-বিচার বিধিব্যবস্থা জানবার জন্যে। ওরা ছোটোলোক, আমাদের মনে মানুষের প্রতি যেটুকু দরদ আছে তাছে করে ওরা আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। পশ্চিম-মহাদেশের নানাপ্রকার ‘মুভমেণ্ট'এর পূর্বাপর ইতিহাস এঁরা পড়েছেন— আমাদের জনসাধারণদের মধ্যেও নানা মুভমেণ্ট্, চলে আসছে, কিন্তু সে আমাদের শিক্ষিত-সাধারণের অগোচরে। জানবার জন্যে কোনো ঔৎসুক্য নেই—কেননা তাতে পরীক্ষাপসের মার্কা মেলে না। দেশের সাধারণের মধ্যে আউল বাউল কত সম্প্রদায় আছে, সেটা একেবারে অবজ্ঞার বিষয় নয়; ভদ্রসমাজের মধ্যে নূতন নূতন ধর্মপ্রচেষ্টার চেয়ে তার মধ্যে অনেক বিষয়ে গভীরতা আছে; সে-সব সম্প্রদায়ের যে সাহিত্য তাও শ্রদ্ধা করে রক্ষা করবার যােগ্য— কিন্তু ওরা ছােটোলােক।

 সকল দেশেই নৃত্য কলাবিদ্যার অন্তর্গত, ভাব প্রকাশের উপায়রূপে শ্রদ্ধা পেয়ে থাকে। আমাদের দেশে ভদ্রসমাজে তা লােপ পেয়ি গেছে বলে আমরা ধরে রেখেছি, সেটা আমাদের নেই। অথচ জনসাধারণের নৃত্যকলা নানা আকারে এখনাে আছে— কিন্তু ওরা ছোটোলােক। অতএব ওদের যা আছে সেটা আমাদের নয়। এমন কি, সুন্দর সুনিপুণ হলেও সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয়। ক্রমে হয়তো এ-সমস্তই লােপ হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সেটাকে আমরা দেশের স্মৃতি বলেই গণ্য করি নে, কেননা বস্তুতই ওরা আমাদের দেশে নেই।

 কবি বলেছেন, “নিজ বাসভূমে পরবাসী হলে।” তিনি এইভাবেই বলেছিলেন যে, আমরা বিদেশীয় শাসনে আছি। তার চেয়ে সত্যতর গভীরতর ভাবে বলা চলে যে, আমাদের দেশে আমরা পরবাসী—অর্থাৎ আমাদের জাতের অধিকাংশের দেশ আমাদের নয়। সে-দেশ আমাদের অদৃশ্য অস্পৃশ্য। যখন দেশকে মা ব’লে আমরা গলা ছেড়ে ডাকি তখনমুখে যাই বলি মনে মনে জানি, সে মা গুটিকয়েক আদুরে ছেলের মা এই করেই কি আমরা বাঁচব। শুধু ভােট দেবার অধিকার পেয়েই আমাদের চরম পরিত্রাণ?

 এই দুঃখেই দেশের লােকের গভীর ঔদাসীন্যের মাঝখানে, সকল লােকের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে, এখানে এই গ্রাম-কয়টির মধ্যে আমরা প্রাণ-উদ্বোধনের যজ্ঞ করেছি। যারা কোনাে কাজই করেন না তাঁরা অবজ্ঞার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এতে কতটুকু কাজই বা হবে। স্বীকার করতেই হবে তেত্রিশ কোটির ভার নেবার যােগ্যতা আমাদের নেই। কিন্তু তাই বলে লজ্জা করব না। কর্মক্ষেত্রের পরিধি নিয়ে গৌরব করতে পারব এ কল্পনাও আমাদের মনে নেই, কিন্তু তার সত্য মিয়ে যেন গৌরব করতে পারি। কখনো আমাদের সাধনায় যেন এ দৈন্য থাকে যে, পল্লীর লোকের পক্ষে অতি অল্পটুকুই যথেষ্ট। ওদের জন্য উচ্ছিষ্টের ব্যবস্থা করে যেন ওদের অশ্রদ্ধা না করি। শ্রদ্ধয়া দেয়ম— পল্লীর কাছে আমাদের আত্মোৎসর্গের যে নৈবেদ্য তার মধ্যে শ্রদ্ধার যেন কোনো অভাব না থাকে।

১৩৩৭