রূপসী বোম্বেটে/পূর্ব্ব কথা

উইকিসংকলন থেকে

রূপসী বোম্বেটে



পূর্ব্ব কথা

(১)

অষ্ট্রেলিয়ায় যত স্বর্ণখনি আছে, পৃথিবীর আর কোনও দেশে তত সোনার খনি নাই। ‘জিগ্‌স’ স্বর্ণ-খনি এক সময় সমগ্র অষ্ট্রেলিয়ায় অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল; এই খনির ‘ষ্টেসন’ অর্থাৎ কারখানাটিও অতি বৃহৎ। বহু-সংখ্যক শ্রমজীবি এই কারখানায় কাজ করিত। কর্ম্মচারীগণের সংখ্যাও অল্প ছিল না॥

 শরৎ কালের এক দিন অপরাহে শ্রান্ত তপন বৈচিত্র্যময়ী প্রকৃতি দেবীকে সুলোহিত রশ্মিজালে রঞ্জিত করিয়া সুদূরবর্ত্তী গিরিঅন্তরালে অস্ত-গমননান্মুখ; শ্রমজীবীরা তখন দৈনন্দিন কাজ বন্ধ করিয়া। গৃহে প্রস্থান করিয়াছিল; ‘জিগ্‌স’ ষ্টেসেনের চতুর্দিক নিস্তব্ধ, কেবল সমীরণ-প্রবাহে প্রান্তর প্রান্তবর্ত্তী বৃক্ষের হরিৎ পত্ররাশি শর শর শব্দে কম্পিত হইতেছিল। এই সময় জিগ্‌স খনির একটি কারখানা-ঘরে দুইজন লোক, নিম্ন স্বরে কি পরামর্শ করিতেছিল। তাহাদের এক জনের নাম জেমস্‌ পিয়ারসন, অন্যের নাম করলক্স মর্টন; পিয়ারসন খনির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, মর্টন খনির ম্যানেজার।

 মর্টন বলিল, “দেখ পিয়ারসন, আমাদের সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করিতে আর বিলম্ব করা হইবে না। আমাদের দলস্থ সকলেরই ইচ্ছা, যত শীঘ্র সম্ভব কাজ শেষ করা হউক।”

 পিয়ারসন বলিল, “তোমাদের সকলেরই যদি ইহাতে মত থাকে, তবে আমার আর অমত কি? তবে আমার বিবেচনায় আরও মাস তিনেক বিলম্ব করিলে ভাল হইত। খনির যে স্তরটায় এখন কাজ চলিতেছে তাহাতে যথেষ্ট সোনা উঠিতেছে; সেই স্তরটা শেষ করিতে পারিলে পরবর্ত্তী স্তরে সোনা অপেক্ষাকৃত দুপ্রাপ্য হইবে, তখন আমাদের ফন্দী খাটিবে ভাল। এখন খনিতে স্বর্ণাভাবের, কথা প্রকাশ করিলে কী হয় ত সে কথা বিশ্বাস করিবেন না; বিশেষতঃ, যদি কোনও ইনস্পেক্টার খনি পরীক্ষা করিতে আসে, তাহা হইলে আমাদের প্রস্তাবের অসারতা প্রতিপন্ন হইতে বিলম্ব হইবে না।”

 মর্টন বলিল, “সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাক, মিসেস্‌ কার্টার কোনও ইস্পেক্টারকে খনি পরীক্ষা করিতে পাঠাইবেন না। তিনি খনির কাজ কিছুই বুঝেন না, আমাদের মুখেই খান; আর তাঁর মেয়ে আমেলিয়া ত নিতান্ত বালিকা, আমাদের কোনও কথায় তাহার অবিশ্বাস হইবে না। এমন সুযোগ কি সর্ব্বদা পাওয়া যায়? খনিটা যদি আমাদের হাতে আসে, আমরা ছয় জনে যদি তাহার মালেকান স্বত্ত্ব আত্মসাৎ করিতে পারি, তাহা হইলে আমরা সকলেই বড় মানুষ হইতে পারি। আমি আলেস্কা হইতে চিলি পর্য্যন্ত সকল দেশের অনেক সোনার খনি দেখিয়াছি, কিন্তু এমন লাভজন খনি কোথাও আর একটিও দেখি নাই, এত সোনা অন্য কোনও খনিতে নাই। এ খনি স্বর্ণস্তরে পরিপূর্ণ।”

 পিয়ারসন বলিল, “তুমি বাহিরের কোনও লোককে খনির মধ্যে নামিতে দিও না। খনির ভিতরের অবস্থা যেন কেহ জানিতে না পারে।”

 মর্টন বলিল, “সেজন্য তোমার চিন্তা নাই। খনির অবস্থা জানাইয়া আমি কর্ত্রীকে টেলিগ্রাম করিব?

 পিয়ারসন বলিল, “আমি কালই রাষ্ট করিব, এ খনিতে আর সোনা নাই; খনির কাজে খরচ বিস্তর, কিন্তু যে পরিমাণ সোনা উঠিতেছে তাহাতে খরচা পোযাইতেছে না। তুমি মিসেস্‌ কার্টারকে তাঁহার সদর ষ্টেসন হইতে এখানে আসিবার জন্য টেলিগ্রাম কর। তবে যদি তিনি ভাগ্য-পরীক্ষার জন্য কারও কাছে টাকা কর্জ্জ করেন, আর সেই টাকায় নূতন উৎসাহে খনির কাজ চালাইতে চাহেন, তাহা হইলে কিরূপ দাঁড়াইবে বলিতে পারি না।”

 মর্টন বলিল,“তাহাতেই বা ভয় কি? আমি জানি মিঃ কার্টার মৃত্যুর পূর্ব্বে তাঁহার স্ত্রীকে বলিয়াছিলেন, জিগ্‌স খনির মত খনি এ অঞ্চলে দ্বিতীয় নাই; সুতরাং তিনি সহজে ইহা হাতছাড়া করিতে চাহিবেন না। আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া দিব কোন উপায়ে টাকা কর্জ করিয়াও নূতন নূতন যন্ত্রের সাহায্যে ইহার কাজ চালানো উচিত। কারণ কোন। গভীরতর স্তরে প্রচুর স্বর্ণ থাকাই সম্ভব, তাহা খনন করা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। আমার কথা তিনি অবিশ্বাস করিবেন না। খনির কাজে আমি কিরূপ অভিজ্ঞ, তাহা তিনি জানেন। তিনি অর্থাভাবে ‘জিগ্‌স’ বন্ধক রাখিয়া টাকা কর্জ্জ লইবেন; নূতন নূতন যন্ত্র আসিবে, খনির কাজও আরম্ভ হইবে, কিন্তু ঐ পর্যন্ত! কেবল তাহাকে সর্বস্বান্ত হইতে হইবে, হাতেরও যাইবে, পাতেরও যাইবে। আমি তাঁহাকে যে ভাবে চালাইব, তিনি সেই ভাবেই চলিবেন।”

 পিয়ারসন বলিল, “যে কাজে হাত দিয়াছি, তাহা নির্ব্বিঘ্নে সুসস্পন্ন হইলেই মঙ্গল। বিধবার সর্ব্বনাশ না করিয়া আমরা নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেছি না।”

 কথা শেষ হইলে উভয়ে স্ব স্ব আবাসে প্রস্থান করিল।

 পর দিন সন্ধ্যাকালে জিগ্‌স খনির স্বত্ত্বাধিকারিণী মিসেস্ কার্টার ট্রেণ হইতে জিগ্‌স ষ্টেসনে নামিলেন।

 খনির ম্যানেজার মর্টন ষ্টেসনে তাঁহার অভ্যর্থনা করিতে আসিয়াছিল; সে মিসেস কার্টারকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “আপনি আসিয়াছেন! আশা করি পথে আপনার কোনও কষ্ট হয় নাই।”

 মিসেস কার্টার বলিলেন, “না, আমার কোনও কষ্ট হয় নাই; কিন্তু তোমার টেলিগ্রাম, পাইয়া আমার বড়ই দুশ্চিন্তা হইয়াছে। মিঃ মর্টন, যে জনবর শুনিতেছি তাহা কি সত্য? জিগ্‌স খনিতে আর সোনা নাই?”

 মর্টন বলিল, “দুঃখের সহিত বলিতে হইতেছে—এ জনরব সত্য। অধিক আর বলিল কি, এই ব্যাপারে আমাদের সকলেরই মস্তকে। যেন বিনামেঘে বজ্রাঘাত হইয়াছে! আজ আপনার স্বামী জীবিত থাকিলে এ সঙ্কটে একটা কিছু উপায় করিতে পারিতেন। জিগ্‌স। খনির উপর তাঁহার অগাধ বিশ্বাস ছিল।”

 মিসেস্ কার্টার বলিলেন, “কি উপায় করিতেন? আমি ত কোনও উপায়ই দেখিতেছি না। আমার স্বামীর বিশ্বাস ছিল, এই খনিতে যে পরিমাণ স্বর্ণ আছে এত স্বর্ণ অন্য কোনও খনিতে নাই। এখন এই বিপদ হইতে মুক্তিলাভের কোনও উপায় আছে কি না শীঘ্র আমাকে বল। আমি জানি আমার স্বামী এই খনির কাজ কোন ক্রমেই বন্ধ হইতে দিতেন না। যেমন করিয়া হউক, ইহার কাজ চালাইতেন।”  মর্টন বলিল; “কিন্তু সে ত কম টাকার কাজ নয়। জিগ্‌স খনির সুনাম নষ্ট হইয়াছে, উহার বদনাম ডাকিয়াছে। তবে এখন যদি নূতন নূতন কল আমদানী করিয়া খন্তির ভিতর দীর্ঘকাল কাজ চালানো যায়, তাহা হইলে ভবিষ্যতে সুফল লাভ হইতেও পারে। কিন্তু সে যে বহুৎ টাকার কাজ! মিঃ কার্টার জীবিত থাকিলে যেমন করিয়া হউক উপযুক্ত টাকার সংস্থান করিতেন।” -মর্টন এমন ভাবে দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিল—যেন দুঃখে কষ্টে তাহার বুক। ফাটিয়া যাইতেছিল।

 মিসেস্‌ কার্টার ব্যস্ত ভাবে বলিলেন, “আমি স্ত্রীলোক, কাজকর্ম্ম বুঝি না; এ সঙ্কটে আমার কর্তব্য কি বল, তোমার পরামর্শটা শুনি।”

 এই সকল বিষয়ের আলোচনা করিতে করিতে উভয়ে হোটেলের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। মর্টন বারান্দার নীচে আসিয়া বলিল, “পরামর্শ আপনাকে দিতে পারি, কিন্তু আপনি কি তদরে কাজ করিতে পারিবেন? সম্পত্তি বন্ধক না রাখিলে তত টাকা কে কর্জ্জ দিবে?”

 মিসেস কার্টার সোৎসুক দৃষ্টিতে মর্টনের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন সম্পত্তি বন্ধকের কথা বলিতেছ?”

 মর্টন একবার চতুর্দ্দিকে চাহিয়া ইতস্তুত করিয়া বলিল, “আপনার স্বামী জীবিত থাকিলে জিগ্‌স খনিই কিছু দিনের জন্য বন্ধক দিয়া টাকা কর্জ্জ করিতেন, এবং সেই টাকায় এই দায় হইতে উদ্ধার লাভের চেষ্টা করিতেন,; সম্ভবতঃ তাহার চেষ্টা সফল হইত।”

 মিসেস্‌ কার্টার হতাশ ভাবে বলিলেন, “কিন্তু আমার ত আর কোনও মূল্যবান সম্পত্তি নাই; জিগ্‌সই আমার প্রধান সম্বল। এই শেষ সম্বল হাত-ছাড়া করিব?”  মর্টন বলিল, “অন্য উপায় আর কি আছে?”

 মিসেস্‌ কার্টার হোটেলের বারান্দায় উঠিতে উঠিতে বলিলেন, “আজ রাত্রে আমি ভাবিয়া দেখিব। কাল তোমার সঙ্গে সকল কথা হইবে।”

 মর্টন—“নমস্কার” বলিয়া হোটেলের বারান্দা হইতে হিসেস কার্টারের নিকট বিদায় গ্রহণ করিল।

 পথে আসিয়া মর্টনের মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল। সে মনে মনে বলিল, “মেলবোর্ণে পুস্তক-প্রকাশকের কাজ করিয়া বিশ বৎসর কাল কত গ্রন্থকারের সর্ব্বনাশ করিয়াছি, পঁচিশ হাজারের চুক্তি করিয়া লক্ষ বহি ছাপাইয়া বিত'র করিয়াছি; কত গরীব লেখককে দিয়া কেতাব লিখাইয়া লইয়া তাহাদিগকে এক পেনিও দিই নাই; এমন বুদ্ধিমান হইয়া একটা নির্বোধ বিধবাকে ঠকাইতে পারিব না?”

(২)

 উক্ত ঘটনার ছয় মাস পরে এক দিন জিগ্‌স খনির ডাইরেক্টর পিয়ারসন ম্যানেজার মিঃ মর্টনকে সঙ্গে লইয়া মিসেস কার্টারের সহিত তাঁহার বাঙ্গালায় দেখা করিতে চলিল। মিসেস্‌ কার্টার মর্টনের পরামর্শে জিগ্‌স ষ্টেশন একজন উত্তমর্ণেয় নিকট বন্ধক দিয়: ছিলেন; বলা বাহুল্য উত্তমর্ণ টা উপলক্ষ্য মাত্র, প্রকৃত উত্তমর্ণ। পিয়ারসন, মর্টন, মর্গান প্রভৃতি—মিসেস্‌ কার্টারের বেতনভোগী কর্ম্মচারীগণ। মিসেস্‌ কার্টার তাহার এই একমাত্র খনি বন্ধক দিয়া ‘বিনাগঙ্গ’ নামক একটি পশুপালন-ক্ষেত্রে এই বাঙ্গালায় কন্যার সহিত বাস করিতেছিলেন।—এই বাঙ্গালা ও তাহার চতুষ্পর্শস্থ ভূসম্পত্তি ভিন্ন তাহার জীবিকানির্বাহের অন্য কোনও অবলম্বন ছিল না।  পিয়ারসন মিসেস্‌ কার্টারের বাঙ্গালায় প্রবেশ করিয়া দেখিল: তিনি তাঁহার কন্যা আমেলিয়ার সহিত গল্প করিতেছেন।

 পিয়ারসন মিসেস্‌ কার্টারকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “আপনার সঙ্গে গোপনে দুই একটি কথা আছে।”

 আমেলিয়া এই কথা শুনিয়া উঠিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, তাহা লক্ষ্য করিয়া মিসেস্‌ কার্টার বলিলেন, “তুমি এখানে থাকিলে ক্ষতি নাই মা! মিঃ পিয়ারসন, কি বলিতে আসিয়াছ—বল। বোধ হয় জিগ্‌স খনি সম্বন্ধে কোনও কথা বলিবে!”

 পিয়ারসন বলিল, “হাঁ, কিন্তু একটি ঝড় দুঃসংবাদ শুনিবার জন্য আপনি প্রস্তুত হউন।”

 মিসেস্‌ কার্টার বলিলেন, “আবার দুঃসংবাদ! মর্টন একবার দুঃসংবাদ দিয়া আমাকে প্রায় পথে বসাইয়াছে, তুমি এবার কি দুঃসংবাদ আনিয়াছ পিয়ারসন? টাকাগুলি সব জল ফেলিয়াছ বুঝি?”

 পিয়ারসন বলিল, “আপনার অনুমান সত্য। আপনি আপনার যথাসর্বস্ব বন্ধক দিয়া যে টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা সমস্তইবৃথা ব্যয় করিলাম! কিছুতেই কিছু হইল না, জিগ্‌স খনি খুঁড়িয়া এত চেষ্টাতেও এক তোলা সোনা পাওয়া যাইতেছে না।—এই খনিতেই আপনাকে সর্বস্বান্ত হইতে হইল।”

 মিসেস্‌ কার্টার এই দুঃসংবাদে ক্ষণকাল স্তম্ভিত ভাবে চেয়ারে বসিয়া রহিলেন, তাহার পর হতাশ ভাবে অস্ফুট স্বরে বলিলেন, “এখন উপায়?”

 পিয়ারসন, বলিল, “সে টাকাতে হয় নাই, আরও কিছু টাকা। দেনা হইয়াছে। পাওনাদারেরা তাহাদের প্রাপ্য টাকার জন্য বড়ই পীড়াপীড়ি করিতেছে, শীঘ্র তাহাদের টাকাগুলি পরিশোধ না করিলেই নয়।”

 মিসেস কার্টার বলিলেন, “তোমার কথা বুঝিয়াছি। আমার শেষ সম্বল ‘বিনাগঙ্গ’ ষ্টেসনটিও ছাড়িয়া দিতে হইবে! শেষে তোমরা আমাকে গাছের তলায় বসাইলে!”

 মিশেস্‌ কার্টার আর আত্মসংবরণ করিতে পারিলেন না। নিজের জন্য তাঁহার কোন চিন্তা ছিল না; কিন্তু তাঁহার যুবতী কন্যা আমেলিয়ার কি গতি হইবে? আমেলিয়ার বয়স তখন উনিশ বৎসর; যুবতী সুন্দরী, অসাধারণ বুদ্ধিমতী, কিন্তু সংসারে তাঁহার আপনার বলিবার আর কেহ ছিল না। আমেলিয়া কোথায় আশ্রয় পাইবেন? মিসেস কার্টারের মাথা ঘুরিয়া উঠিল, তিনি মুর্চ্ছিত হইয়া চেয়ার হইতে নীচে পড়িলেন।

 পিয়ারসন ও তাহার সহকারী মর্টন মিসেস্‌ কার্টারকে তুলিবার জন্য তাড়াতাড়ী তাঁহার নিকট অগ্রসর হইল; কিন্তু আমেলিয়া বিদ্যুৎবেগে উঠয়া তাহাদিগকে সরিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিলেন, তাহার পর তাঁহার জননীর সংজ্ঞাহীন দেহ ক্রোড়ে তুলিয়া লইয়া কক্ষান্তরে প্রস্থান করিলেন। সেখানে তাঁহাকে একটি শয্যায় শয়ন করাইয়া তাঁহার মস্তকে ও ললাটে জলসিঞ্চন করিতে লাগিলেন।

 মর্টন অস্ফুট স্বরে বলিল, “জীবনে অনেক অপকর্ম্ম করিয়াছি, কিন্তু এবার এই বিধবার সর্ব্বনাশ করিয়া আমার বড়ই অনুতাপ হইতেছে।”

 পিয়ারসন চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া সরোষে বলিল, “চুপ করিয়া থাক। আমরা যে কাজে হাত দিয়াছি, তাহা শেষ করিতেই হইবে; এখন অনুতাপ করিয়া কোনও ফল নাই। তোমার ধর্ম্মজ্ঞান এত প্রবল হইয়া থাকিলে পূর্ব্বে সে কথা বলা উচিত ছিল; তখন আমাদের। ষড়যন্ত্রে যোগ না দিলেই পারিতে!”

 কন্যার প্রাণপণ শুশ্রুষায় মিসেস্‌ কার্টারের মূচ্ছা ভঙ্গ হইল, তিনি নয়ন উন্মিলিত করিয়া কন্যার মুখের দিকে চাহিলেন।

 আমেলিয়া করুণ স্বরে বলিলেন, “মা, মা, তুমি এত হতাশ হইও না; পরমেশ্বর আমাদের ভাগ্যে যাহা লিখিয়াছেন তাহাই হইবে। চল আমরা ইংলণ্ডে চলিয়া যাই, সেখানে আমাদের কোনও একটা উপায় হইবে।”

 কন্যার কথা মিসেস কার্টারের কর্ণে প্রবেশ করিল না, তাঁহার বিস্ফারিত নেত্রে স্বপ্ন-বিজড়িত ভাব, সে দৃষ্টি, স্বাভাবিক নহে। সেই অস্বাভাবিক দৃষ্টি লক্ষ্য করিয়া আমেলিয়া, অভ্যন্ত ভীত হইলেন। মিসেস্‌ কার্টার অস্ফুট স্বরে বলিলেন, “জন, প্রিয়তম, আমাকে ক্ষমা কর। অনেক দিন তুমি আমাকে ছাড়িয়া একাকী রহিয়াছ, আর। তোমাকে একাকী থাকিতে হইবে না আমি আসিতেছি। তোমার বড় সাধের সম্পত্তি জিগ্‌স আমি বন্ধক দিয়াছি;তুমি আমাকে বলিয়াছিলে জিগ্‌স যেন কখন হস্তান্তর না করি—কিন্তু আমি বিপদে পড়িয়া বুদ্ধি হারাইয়াছিলাম, তোমার উপদেশ গ্রাহ্য করি নাই; তুমি আমার অপরাধ মার্জ্জনা কর, আমাকে তোমার কাছে টানিয়া লও।”

 মিসেস্ কার্টার হঠাৎ নীরব হইলেন, তাঁহার মোহ অপসারিত হইল; তিনি কন্যার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমেলিয়া, মা আমার, তোমার পিতা মৃত্যুর পূর্ব্বে বুঝিতে পারিয়াছিলেন তাঁহার কর্ম্মচারীরা ঘোর বিশ্বাসঘাতক, তাহারা তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব লুঠ করিতেছে; কিন্তু হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় এই সকল তস্করকে তিনি যথাযোগ্য দণ্ড দিতে পারেন নাই। পিয়ারসন ও মর্টন কয়েক জন সহকারীর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া আমাকে সর্বস্বান্ত করিয়াছে, তোমাকে পথে বসাইয়াছে। আমার দিন ত ফুরাইয়া আসিয়াছে, কিন্তু তুমি কোথায় আশ্রয় গাইবে, তোমার কি উপায় হইবে, এই চিন্তাতে মরণেও শান্তি পাইব না।”

 মিসেস্‌ কার্টার আবার নীরব হইলেন; অন্তিম হিক্কায় তাঁহার দেহ কম্পিত হইল। তাহার পর সব নিস্তব্ধ। প্রাণ-বিহঙ্গ তাঁহার দেহ পিঞ্জর ত্যাগ করিল।

 জননী কথা কহিতে কহিতে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন আমেলিয়া ইহা বুঝিতে পারিলেন না। তিনি তাড়াতাড়ী উঠিয়া তাঁহার মস্তকে হাত দিলেন, এবং মায়ের মূর্চ্ছা। হইয়াছে ভাবিয়া তাঁহার চেতনা সম্পাদনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু বৃথা চেষ্টা! তাঁহার বক্ষঃস্থলে হাত দিয়া দেখিলেন, বক্ষের স্পন্দন থামিয়া গিয়াছে!—তখন আমেলিয়া বুঝিতে পারিলেন, মা জন্মের মত তাঁহাকে ছাড়িয়া গিয়াছেন।

 আমেলিয়া মাতার মৃত দেহের নিকট হইতে উঠিয়া স্খলিত পদে সেই কক্ষ পরিত্যাগ করিলেন, এবং পিয়ারসন ও মর্টন যে কক্ষে বসিয়াছিল, সেই কক্ষে উপস্থিত হইলেন। আমেলিয়ার নয়নে অশ্রু ছিল না, আকর্ণবিশ্রান্ত বিস্ফারিত নেত্র হইতে অগ্নি-ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছিল, ঘৃণা ও ক্রোধে তাঁহার সুন্দর মুখ লোহিতাভ হইয়াছিল, তাঁহার ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বহিতেছিল, এবং সুগঠিত সমুন্নত দেহ থর থর করিয়া কাঁপিতেছিল। পিয়ারসন ও মর্টন আমেলিয়ার রণচণ্ডীর ন্যায় মূর্ত্তি দেখিয়া সবিস্ময়ে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহাদের মুখে কথা ফুটিল না।

 আমেলিয়া প্রায় এক মিনিটকাল নীরবে দণ্ডায়মান থাকিয়া সুস্পষ্ট ঘৃণার সহিত উত্তেজিত স্বরে বলিলেন, “তোমরা কি ভাবে আমাদের সর্বস্ব অপহরণ করিয়াছ, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি। আমার মা খনির কাজকর্ম্ম বুঝিতেন না, তিনি তোমাদের কুপরামর্শে ভুলিয়া জিগ্‌স খনি বন্ধক দিতে সম্মত হইয়াছিলেন, তোমরা সেই খনি বন্ধক দিয়া যে টাকা পাইয়াছ তাহা আত্মসাৎ করিয়াছ। আমার বাবার যে কিছু বিষয় সম্পত্তি ছিল, তাহা গ্রাস করিয়াও তোমাদের ক্ষুধা মেটে নাই, শেষে এই ভাবে আমার মায়েরও সর্ব্বনাশ করিলে! তোমাদের দুষ্কর্ম্মের প্রতিফল দানের পূর্ব্বেই বাবার মৃত্যু হইয়াছিল। তোমাদের শয়তানীতেই আজ আমি পথের কাঙ্গাল। যদি আইনের সাহায্যে তোমাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রবঞ্চনার উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করা সম্ভব হয়, তবে আমি সে চেষ্টার ত্রুটী করিব না; কিন্তু তোমরা বড় ধূর্ত্ত, বোধ হয় আইন বাঁচাইয়া কাজ করিয়াছ, রাজদ্বারে অভিযোগ করিয়া হয় ত তোমাদিগকে শাস্তি দিতে পারিব না। না পারি ক্ষতি নাই, রাজদণ্ড যে কার্য্যে অক্ষম, আমার শক্তি সে কার্যে অসমর্থ হইবে না।

 “তোমরা আমার টাকা চুরি করিয়াছ, আমার তালুক মুলুক, খনি, জমী-জমা আত্মসাৎ করিয়াছ সেজন্য আমি কাতর নহি; কিন্তু আবার স্নেহময়ী জননী তোমাদের অত্যাচারে-তোমাদের পৈশাচিক ব্যবহারে ভগ্ন-হৃদয়ে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন; তোমরা নারীহত্যা করিয়াছ; তোমরা আমার মাতৃহন্তা! তোমাদের এ অপরাধ আমি ক্ষমা করিব না। আমি আমার জননীর মৃত দেহ স্পর্শ করিয়া সপথ করিয়াছি—যে পর্য্যন্ত তোমাদের দলের প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতক শয়তানকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত—মৃত্যু-যন্ত্রণা তুল্য যন্ত্রণা-গ্রস্ত না। করি, যে পর্য্যন্ত তোমরা, সর্বস্বান্ত হইয়া আমার মত পথে না বস, সে পর্য্যন্ত আমি প্রতিহিংসা সাধনে নিবৃত্ত হইব না। তোমাদের সর্ব্বনাশ সাধনই আমার জীবনের একমাত্র ব্রত হইল। মনে করিও না—ইহা শোকাতুরা অসহায় যুবতীর নিস্ফল দম্ভ, ক্ষুব্ধা নারীর প্রলাপ মাত্র। আমি যাহা বলিলাম, শীঘ্র হউক বিলম্বে হউক, তাহা কার্য্যে পরিণত করিবই। এখন তোমরা আমার সম্মুখ হইতে দূর হও, আর মুহুর্ত্ত কাল এখানে বিলম্ব করিলে আমি তোমাদিগকে কুকুর লেলাইয়া দিব। তোমরা এক সপ্তাহ মধ্যে আমাদের বাড়ী ঘর দখল করিতে পার; দুই চারি দিনের মধ্যে আমি আমার এই শেষ আশ্রয় ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইব।”

 পিয়ারসন ও মর্টন নত মস্তকে এই তীব্র তিরস্কার শ্রবণ করিল, আমেলিয়ার কথা যে হইলে তাহারা উঠিয়া ধীরে ধীরে লগুড়াহত কুকুরের মত সেই স্থান ত্যাগ করিল।

 কর্ম্মচাকীরা প্রস্থান করিলে আমেলিয়া মাতার মৃত দেহের পাশে বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কাঁদিলেন।

 যথা সময়ে জননীর মৃত দেহ সমাহিত করিয়া আমেলিয়া তাঁহার বৈষয়িক কাগজ-পত্র পরীক্ষা করিলেন, হিসাব-পত্র দেখিয়া তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীরা তাঁহার মাতার সর্ব্বস্ব নানা কৌশলে আত্মসাৎ করিয়াছে।

 আমেলিয়া কয়েক দিন পরে মেলবোর্ণ নগরে উপস্থিত হইয়া। একজন এটর্ণিকে সেই সকল হিসাবপত্র দেখাইলেন। এটর্ণি তাহা পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “মিস্‌ কার্টার আপনার বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীরাই যে আপনাদের সর্ব্বস্বান্ত করিয়াছে, এ বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহারা আইন বাঁচাইয়া কাজ করিয়াছে। তাহাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করিয়া কোনও ফল হইবে না।”  আমেলিয়া আবেগ ভরে বলিলেন, “আইনে অন্যায়ের প্রতিকার নাই? প্রবঞ্চনার দণ্ড নাই? না থাক্‌, আমি স্বয়ং ইহার প্রতিকার করিব।”

 ক্রুদ্ধা যুবতী এটর্ণির বাড়ী হইতে বাহির হইয়া রাজপথের বিপুল জনস্রোতে কোথায় অদৃশ্য হইলেন, কেহ তাহা দেখিল না, কেহ তাহার সন্ধানও লইল না। সংসারে যাহার আপনার বলিতে কেহ নাই, যাহার মাথা রাখিবারও স্থান নাই, সে জীবিত আছে কি মরিয়াছে, কে তাহার অনুসন্ধান করিবে?

(৩)

 পূর্ব্বোক্ত ঘটনার পর ছয় বৎসর চলিয়া গিয়াছে।

 ছয় বৎসর পরে গ্রীষ্মকালের এক দিন মধ্যাহ্নে দক্ষিণ মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ-সন্নিকটে একখানি প্রকাণ্ড জাহাজ নঙ্গর করিয়া সমুদ্র-তরঙ্গে ঈষৎ আন্দোলিত হইতেছিল। জাহাজখানির বর্ণ বকপক্ষের ন্যায় শুভ্র; শুভ্র বেশধারী নাবিকেরা জাহাজের ডেকের উপর স্ব স্ব কার্য্যে রত ছিল। সমুদ্রবক্ষঃ-প্রবাহিত মুক্ত সমীরণ ডেকের উপর হিল্লোলিত হইতেছিল।

 ডেকের এক প্রান্তে সুশীতল ছায়ায় একখানি বেতের চেয়ারে একটি যুবতী বসিয়াছিলেন; যুবতী সৌন্দর্য্যের সজীব প্রতিমা, এমন রূপসী রমণী লক্ষ জনের মধ্যে একজনও দেখা যায় কি না সন্দেহ। যুবতীর পাশে একটি বেত্র নির্ম্মিত ক্ষুদ্র টেবিলের উপর এক গ্লাস লেবুর সরবৎ, তাহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ খণ্ড ভাসিতেছিল। যুবতীর ক্রোড়ে একখানি পুস্তক, তিনি অবনত মস্তকে পুস্তক খানি পাঠ করিতেছিলেন।  শুভ্র ফ্ল্যানেলের পরিচ্ছদে সজ্জিত একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক যুবতীর অদূরস্থিত আর একখানি চেয়ারে আসিয়া বসিলে যুবতী তাহার সহিত কথোপকথন আরম্ভ করিলেন।

 দুই চারিটি,কথার পর যুবতী সেই প্রৌঢ় ভদ্র লোকটিকে বলিলেন, “হাঁ মামা, এখন আমার সমাজে মিশিবার সময় হইয়াছে। আমার মা যখন তাঁহার বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীদের ষড়যন্ত্রে সর্ব্বস্বান্ত হইয়া ভগ্ন-হৃদয়ে প্রাণত্যাগ করেন—সেই সময় আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, আমি তাহাদের সকলেরই সর্ব্বনাশ করিব। সে আজ ছয় বৎসরের কথা; এই ছয় বৎসরের এক দিনও আমি সেই প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হই নাই। রাজদ্বারে অভিযোগ করিয়া আইনের সাহায্যে এই প্রবঞ্চনার প্রতিকার হইবে না জানিয়া আমি স্বহস্তে তাহাদের প্রতিফল দানের জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। তাহার পর বোম্বেটে-গিরি আরম্ভ করিয়া এই দীর্ঘকালে আমি প্রচুর অর্থ-সম্পদ লাভ করিয়াছি। আমার প্রচণ্ড প্রতাপে আটলাণ্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে সকল দেশের জাহাজ কম্পমান! সমুদ্রপথে আমার অব্যাহত গতি, সুবিস্তীর্ণ সমুদ্রে আমি যাহা ইচ্ছা করিয়া আসিয়াছি; কিন্তু যাহাদের সর্বনাশের জন্য এই জঘন্য বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছি, সমুদ্রে বাস করিয়া তাহাদিগকে শাস্তি দান করা অসম্ভব; সুতরাং আমাকে স্বলে অবতরণ করিতে হইবে।”

 পাঠক বুঝিয়াছেন এই যুবতী আমাদের পূর্ব্ব পরিচিত আমেলিয়া কার্টার; তিনি যাহার সহিত আলাপ করিতেছিলেন তাহার নাম জ্যাক গ্রেভিস্। জ্যাক সম্বন্ধে আমেলিয়ার মাতুল। জ্যাক পূর্ব্বে চুরী বাটপাড়ী করিয়া জীবিকানির্বাহ করিত, শেষে সে তাহার ভাগিনেয়ীর দলভূক্ত হয়। এখন জ্যাক আমেলিয়ার দক্ষিণ হস্ত, সে-ই এই। বোম্বেটে জাহাজের অধ্যক্ষ। কিন্তু জ্যাক ভাগিনেয়ীর অসাধারণ শক্তি ও প্রতিভার পরিচয় পাইয়াছিল; সে ভৃত্যের ন্যায় তাঁহার অনুগত হইয়া থাকিত; আমেলিয়া কার্টারের কোনও কথার প্রতিবাদ করিবারও তাহার শক্তি ছিল না।

 আমেলিয়ার কথা শুনিয়া জ্যাক বলিল, “আমরা সমুদ্রে আছি, নিশ্চিন্ত আছি, এথানে সকলেই আমাদের ভয়ে কম্পমান; কিন্তু তীরে নামিলে কি আমাদের ভয়ের যথেষ্ট কারণ নাই? সমগ্র সভ্য রাজ্যের পুলিশ আমাদের উপর খড়গহস্ত, এ কথা ত তোমার অজ্ঞাত নহে।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “তোমার ভয় অনর্থক মামা, আমার জাহাজের কর্মচারীরা বিশ্বাসঘাতকতা না করিলে আমরা নিরাপদ। কিন্তু জাহাজে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা নাই। মনুষ্য-চরিত্রে আমি অনভিজ্ঞা” নহি, আমি বাছিয়া বাছিয়া লোক লইয়াছি। আমার জাহাজের কাপ্তেন ভগহান, বহুদর্শী কাপ্তেন; বিনা দোষে সে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিল, তাই সে পলাইয়া আসিয়া আমার আশ্রয় লইয়াছে। যে সমাজ অকারণে তাহাকে উৎপীড়িত করিয়াছে—আমাকে ছাড়িয়া সে কখনও সেই অকৃতজ্ঞ সমাজের আশ্রয় গ্রহণ করিবে না; সমাজকে সে শত্রু মনে করে, সে প্রাণপণে আমাকে সাহায্য করিবে। আমার জাহাজের প্রত্যৈক কর্ম্মচারী, জানে আমি তাহাদের রাজ্ঞী, তাহারা আমার আদেশ বিনা-প্রতিবাদে নতশিরে পালন করে। তথাপি তুমি জাহাজের সকল কর্ম্মচারীকে জানাইবে, আমি যখন যে আদেশ করিব, তাহা যতই অসঙ্গত হউক, তাহাদিগকে তাহা পালন করিতে হইবে; কি উদ্দেশ্যে আমি কোন্ কর্মে প্রবৃত্ত হইব, তাহা যেন কেহ জানিতে চাহে। তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিবে—আমার আদেশই তাহাদের আইন, আমার আদেশের উপর কোনও আপীল নাই। যদি কেহ আমার আদেশ লঙ্ঘন করে—তাহা হইলে আমি তাহাকে অতি কঠোর শাস্তি, দিব।”

 আমেলিয়ার মাতুল গ্রেভিস্‌ ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল; আমেলিয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই স্থানে বসিয়া রহিলেন। স্যার পর তিনি জাহাজের একটি সুসজ্জিত কেবিনে প্রবেশ করিয়া বৈদ্যুতিক গোলকে অঙ্গুলী স্পর্শ করিলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই কক্ষটি উজ্জ্বল বিদ্যুতালোকে উদ্ভাসিত হইল।

 এই সেলুনের সুবিস্তীর্ণ মেঝে কারুকার্যখচিত স্থূল গালিচায় আবৃত; সেলুনের কাষ্ঠ নির্ম্মিত প্রাচীর গাত্রে শ্রেণীবদ্ধ আলমারি, প্রত্যক্ষ আলমারি নানা প্রকার গ্রন্থে পূর্ণ। অন্য দিকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রাগার; তাহাতে লৌহ, পিত্তল ও কাচ নির্ম্মিত নানা প্রকার যন্ত্র সন্নিবিষ্ট ছিল; এতদ্ভিন্ন নানা আকারের শিশি ও বোতলে নানা প্রকার ঔষধ। মস্তকের উপর অসংখ্য তারের জাল, কোনও তার অঙ্গুলীর ন্যায় স্থূল, কোনও তার কেশের ন্যায় সূক্ষ্ম। এই কক্ষের সাজসজ্জা দেখিলে বুঝিতে পারা যাইত, আমেলিয়া বোম্বেটে-গিরিতেই এত কাল অতিবাহিত করেন নাই।

 আমেলিয়া তাঁহার-সেলুনের দ্বার রুদ্ধ করিয়া চেয়ারে উপবেশন, করিলেন, তাহার পর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়ো বলিলেন, “গত ছয় বৎসর কাল অক্লান্ত চেষ্টার পর আমি প্রতিহিংসা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হইয়াছি।—সর্ব্বাগ্রে পিয়ারসনের সর্বনাশ করিব, তাহার পর মর্টন। ছয় জনের একজনকেও ছাড়িব না।—আমার এই বৈরনির্যাতন কার্য্যে হে স্বর্গের দেবতা, তুমি যদি সহায় না হও, তবে শয়তান, তুমি আমার সহায় হও।”

(৪)

 সাল্‌ভেরিটা আমেরিকার একটি ক্ষুদ্র রাজ্য, স্পেনের উপনিবেশ। মার্কিন যুক্তরাজ্যের ন্যায় এই রাজ্যেও সাধারণতন্ত্র, শাসন-প্রথা প্রচলিত ছিল। অনেক দিন ধরিয়া অশান্তি ও প্রজা-বিপ্লবের পর এখানে সাধারণ-তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।—আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি সেই সময় এই শিশু সাধারণ-তন্ত্রের বয়স পাঁচ বৎসর মাত্র।

 জেমস্‌ পিয়ারসন নামক একজন বৈদেশিক পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে এই রাজ্যে উপস্থিত হইয়া ব্যবসায়-বাণিজে প্রবৃত্ত হন। জেমস্‌ পিয়ারসন বহু অর্থ লইয়া এদেশে আসিয়াছিলেন, তাহার অর্থ-বল ও বুদ্ধি-বল অসাধারণ ছিল; অর্থ-বলে অল্পদিনেই তিনি ব্যবসায় বাণিজ্যের যথেষ্ট উন্নতি করিয়াছিলেন, বুদ্ধিবলে তিনি প্রজা সভায় অখণ্ড প্রভুত্ব। ও প্রতিপত্তি লাভে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি যখন এই রাজ্যে পদার্পণ করেন,তখন অশান্তি ও প্রজাবিপ্লবে অধিবাসীগণের ধন-প্রাণ বিপন্ন হইয়া উঠিয়াছিল; প্রজা সাধারণের সহিত ভূস্বামীগণের নিত্য বিবাদবিসম্বাদ চলিতেছিল। বুদ্ধিমান পিয়ারসন রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের জন্য ভুস্বামীগণের দলে যোগদান করিলেন, এবং ছয় মাসের অবিশ্রান্ত। চেষ্টার রাজ্যে শান্তি স্থাপন পূর্ব্বক ভূস্বামীগণের মুখপাত্র হইয়া উঠিলেন। বিদেশী পিয়ারসনের খ্যাত-প্রতিপত্তিতে এই ক্ষুদ্র রাজ্য পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। অবশেষে তিনি সালভেরিটা সাধারণ-তন্ত্রের মুকুটহীন রাজা হইয়া উঠিলেন। জনসাধারণ ও ভূস্বামীগণ সকলেই নতশিরে তাহার নেতৃত্ব স্বীকার করিলেন।

 জেমস্ পিয়ারসন কোন্ দেশ হইতে সাল্‌ভেরিটা রাজ্যে পদার্পণ করিয়াছিলেনতাহা কেহ জানিত না; এবং যখন তিনি উক্ত সাধা। রণ-তন্ত্রের সভাপতি নির্ব্বাচিত হইলেন,—তখন তাঁহার অতীত জীবনের ইতিহাস সম্বন্ধে কেহ অনুসন্ধানও কারল না। তাঁহার উদারতা, মহত্ব, সমদর্শিতা ও শাসন শক্তির নিকট সকলেই মস্তক অবনত করিল। রাজনীতি ক্ষেত্রে যাঁহাদের সহিত তাঁহার প্রতিদ্বন্দিতা ছিল,—তাঁহারাও তাঁহার প্রাধান্য স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন।

 সভাপতি পিয়ারসন যে দিন সভাপতি নির্ব্বাচিত হন—সেই দিনের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য প্রতিবৎসর সেই তারিখে সালভেরিটা-রাজধানীতে একটি রাজনৈতিক উৎসবের আয়োজন হইত। এরূপ মহোৎসব সে রাজ্যে আর দ্বিতীয় ছিল না। সম্ভ্রান্ত নরনারীগণ মহা উৎসাহে এই উৎসবে যোগদান করিতেন। উৎসবারম্ভের তিন মাস পূর্ব্ব হইতে উৎকৃষ্ট গাউন ও পরিচ্ছদাদির জন্য প্যারিসে ও লণ্ডনে ‘অর্ডার’ প্রেরিত হইত। নাচের মজলিসে সর্ব্বোকৃষ্ট বসনভূষণে সজ্জিত হইবার আশায় সম্রান্ত সমাজ জলের মত অর্থ ব্যয় করিতেন।

 ডাক্তার হক্সটন রাইমার নামক একজুন ভবঘুরে এই উৎসবের অব্যবহিত পূর্ব্বে সালভেরিটা রাজধানীতে উপস্থিত হয়। সুচিকিৎসক হইলেও সে ডাক্তারী ছাড়িয়া জুয়াচুরী বাটপাড়ী দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। সম্রান্ত সমাজে মিশিবার তাহার অদ্ভুত শক্তি ছিল এবং সে এমন কৌশলে চুরী করিত যে, কেহ তাহা ধরিতে পারিত না। সালভেরিটার রাষ্ট্রীয় উৎসবে একটা বড়রকম দাঁও মারিবার আশাতেই সে সেখানে উপস্থিত হইয়াছিল। সে কোনও কৌশলে একখানি নিমন্ত্রণ পত্র সংগৃহীত করিয়া উৎসবের দিন সায়ংকালে রাজপ্রাসাদে নাচের মজলিসে প্রবেশ করিল।

 নাচের মজলিস লতা-পত্রে ও নানাপ্রকার সুগন্ধি কুসুমে সুসজ্জিত হইয়াছিল; প্রত্যেক বাতায়ন জাতীয় পতাকায় ও পুষ্পমাল্যে শোভিত, পতাকার পার্শ্বে সর্ব্বজন-সমাদৃত প্রেসিডেণ্টের চারুচিত্র সন্নিবিষ্ট। যে শিল্পী মজলিস সাজাইয়া ছিল, তাহার রুচি-নৈপুণ্যের প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। নিমন্ত্রিত নরনারীগণের বিশ্রামের জন্য বহু অর্থব্যয়ে চিরহরিৎ গুল্ম ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃক্ষ দ্বারা কুঞ্জ রচিত হইয়াছিল। যেন প্রকৃতি দেবী স্বহস্তে এই সকল কুঞ্জ নির্মাণ করিয়াছেন—এমনই সুন্দর নির্মাণ-কৌশল! এই সকল কুঞ্জের মধ্যে বিভিন্ন গুল্মের অন্তরালে সুদৃশ্য কাষ্ঠাসন সংরক্ষিত ছিল; শ্রান্ত প্রেমিকযুগল নৃত্যের অবসানে সেখানে বসিয়া যাহাতে মনের দ্বার উদঘাটিত করিয়া নিভৃতে গল্প করিতে পারে—তাহার যথাযাগ্য ব্যবস্থা করা হইয়াছিল।

 নৃত্যের দিন সন্ধ্যার পর রাইমার অন্যের অলক্ষ্যে ‘বলরুমে’ প্রবেশ করিল। স্পেনীয় ভাষায় তাহার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল, এবং সে স্পেন দেশীয় লোকের ন্যায় ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া আসিয়াছিল। তাহাকে সেই বেশে দেখিলে কেহই বলিতে পারিত না যে, সে স্পেন দেশের লোক নহে।

 বলরুমে প্রবেশ করিয়া রাইমার একটি স্তস্তের পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া নিমন্ত্রিত নরনারীগণকে দেখিতে লাগিল।

 রাইমার প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে দাঁড়াইয়া রহিল, কেহ তাহাকে চিনিত না, সুতরাং কেহই তাহাকে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিল না; সে-ও কাহারও সহিত আলাপ করিল না। এই ভাবে দণ্ডায়মান থাকিয়া শ্রান্তিবোধ করিলে রাইমার বলরুমের অভ্যন্তরস্থ দ্বার অতিক্রম পূর্ব্বক পূর্ব্ব-বর্ণিত বিরাম-কুঞ্জে প্রবেশ করিল, এবং একটি গুল্মের অন্তরালে একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িল।

 সেই স্থানে বসিয়া চারিদিকে চাহিতে চাহিতে, হঠাৎ দ্বারপ্রান্তে একটি সুন্দরী যুবতীকে দেখিয়া সে মোহিত হইয়া আর দৃষ্টি ফিরাইতে পারিল না। সে মুগ্ধ নেত্রে যুবতীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

 যুবতী সেখানে একাকিনী দাঁড়াইয়া ছিলেন, রাইমার যে গুল্মের অন্তরালে বসিয়া তাঁহাকে দেখিতেছে, তাহা তিনি দেখিতে পান নাই। যুবতী চারিদিকে চাহিয়া অষ্ট্রীচ্‌ পাখীর পালকের একখানি পাখা খুলিয়া বায়ু সেবন করিতে লাগিলেন। পাখাখানি অতি সুন্দর, তাহার শিল্পনৈপুণ্যও অতি বিচিত্র। পাখার ম্যাণ্ডেলটি গজদন্ত নির্ম্মিত; গজদন্তের হণ্ডেল হীরামুক্তা খচিত।

 রাইমার দেখিল যুবতী, পাখাখানি নাড়িতে নাড়িতে তাহার হাণ্ডেলের নিম্নপ্রান্তে সন্নিবিষ্ট একটি স্প্রিং টিপিলেন, আর হ্যাণ্ডেলটির প্রান্তস্থিত একখানি ক্ষুদ্র গোলাকার ডালা খুলিয়া গেল! তখন যুবতী এক ছড়া বহুমূল্য হীরক হার তাহার মধ্যে নিক্ষেপ করিলেন। অনন্তর অন্য একটি স্প্রিং টিপিবামাত্র সেই হ্যাণ্ডেলের ডালা বন্ধ হইয়া গেল। তখন যুবতী পাখাখানি পূর্ব্ববৎ নাড়িতে নাড়তে বলরুমের অভিমুখে। প্রস্থান করিলেন।

 গুন্মান্তরালে বসিয়া এই ব্যাপার দেখিয়া রাইমারের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে মনে মনে বলিল, “সুন্দরী, তুমি বড় বুদ্ধিমতী, কিন্তু আমার চোখে ধূলা দিতে পার নাই। তোমার ঐ পাখাখানার উপর আমাকে নজর রাখিতে হইবে। এই গজদন্তের হণ্ডেলের মধ্যে লক্ষমুদ্রা মূল্যের হীরক-হার লুকানো আছে, কে ইহা অনুমান করিবে? বোধ হয় যুবতী হার ছড়াটি হারাইবার ভয়ে ওখানে লুকাইয়া। রাখিয়াছে। হা, হা, বেচারা জানে না—উহার উপর ‘রাইমারের। নজর পড়িয়াছে।কিন্তু কে এ যুবতী? সন্ধান লইতে হইতেছে।”

 রাইমার উঠিয়া ধীরে ধীরে বলরুমের দিকে অগ্রসর হইল॥  বলরুমে প্রবেশ করিয়া রাইমার পুনর্ব্বার সেই স্তম্ভের পাশে দণ্ডায়মান হইল, কিন্তু তাহার দৃষ্টি সেই যুবতীর দিকে; রাইমার বুঝিতে পারিল, যুবতী কোনও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কন্যা বা ভগিনী হইবে; সাধারণ গৃহস্থের গৃহে এমন রূপ দেখা যায় না, এমন বেশভূষাও সম্ভব নহে। নিমন্ত্রিত সম্রান্ত যুবকগণ দলে দলে যুবতীর চারি পাশে লুব্ধ মধুপের ন্যায় গুঞ্জন করিতে লাগিল। প্রত্যেকের আশ-যুবতী তাহাকে লইয়া নাচিবেন, তাহার জীবন ধন্য হইবে।

 নাচ চলিতে লাগিল, যুবতী কোনও যুবকের সহিত নাচিতে সম্মত হইলেন না, একপাশে দাঁড়াইয়া নাচ দেখিতে লাগিলেন। ক্রমে একদফা নাচ হইয়া গেল; জলযোগের ঘণ্টা পড়িল। পরিশ্রান্ত নর্ত্তক-নর্ত্তকীগণ পানাহারের জন্য কক্ষান্তরে প্রবেশ করিলেন।

 পানাহারের পর আবার ঘণ্টা পড়িল। পানাহারের পর সকলে বলরুমে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু হঠাৎ একটা গণ্ডগোল বাধিল, পুনর্ব্বার নৃত্য আরম্ভ হইবার পূর্ব্বে একজন উচ্চপদস্থ প্রৌঢ় রাজকর্মচারী বলরুমে প্রবেশ করিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “ভদ্র মহোদয়া ও মহোদয়গণ! আমাকে দুঃখের সহিত প্রকাশ করিতে হইতেছে, আমাদের মহাসম্মানিত ষ্টেট্‌ সেক্রেটারী মহাশয়ের পত্নী সিনোরা এল্‌ফ্রেডা হঠাৎ তাঁহার মহামূল্য হীরকহার হারাইয়া ফেলিয়াছেন। আপনারা সকলেই অবগত আছেন, পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় সিনোরা এই রাজ্যের আহত সৈনিকগণের শুশ্রুষা করায় এই রাজ্যের অধিবাসীগণ বহু সহস্র মুদ্রা চাঁদা তুলিয়া সিনোরার গুণের পুরস্কার স্বরূপ তাঁহাকে এই হীরক-হার উপহার প্রদান করিয়াছিলেন।”

 নৃত্য অরম্ভ হইবে কি,এই সংবাদে নিমন্ত্রিত নরুনারীগণ সকলেই সবিস্ময়ে পরস্পরের মুখ চাহিতে লাগিলেন, কেহ কোনও কথা বলিতে পারিলেন না। এই সম্ভ্রান্ত মজলিশে খানাতল্লাসীর প্রস্তাব করিতে কাহারও সাহস হইল না, শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ সে কথা মুখেও আনিলেন না।”

 পূর্বোক্ত বক্তা ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন, “যদি কেহ এই হার পড়িয়া পাইয়া থাকেন, তিনি নিশ্চয়ই তাহা সিনোরাকে প্রত্যর্পণ পূর্ব্বক তাঁহার ও জনসাধারণের কৃতজ্ঞতাভাজন হইবেন; কিন্তু যদি কেহ লোভে পড়িয়া এই হার চুরী করিয়া থাকে, তাহা হইলে সুদক্ষ পুলিশের তাহা জানিতে বাকি থাকিবে না।—সেই ইতর তস্কর তাহার লোভের উপযুক্ত দণ্ড লাভ করিবে।”

 সকলেই নির্ব্বাক্, নিস্তব্ধ, বিস্ময়ে স্তম্ভিত!

 অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে পুনর্ব্বার নৃত্য আরম্ভ হইল; ডাক্তার হক্সটন রাইমারব্যাপার কি তাহা বুঝিতে পারিল। চোরের উপর এসে সতর্ক দৃষ্টি রাখিল; সে স্থির করিল-যেমন করিয়া হউক সেই অপরিচিতা যুবতীর নিকট হইতে গজদণ্ড নির্মিত হণ্ডেল-বিশিষ্ট অঅস্ট্রিচ্‌ পক্ষের পাখাখানি হস্তগত করিতে হইবে।

 ডাক্তার রাইমারের চক্ষু উৎসাহে জ্বলিয়া উঠিল; সে দেখিতে পাইল, পূর্ব্বোক্তা যুবতী পাখাখানি আন্দোলিত করিতে করিতে একজন সন্ত্রান্ত বেশধারী সামরিক কর্মচারীর সহিত হাসিয়া হাসিয়া গল্প করিতেছেন।

 রাইমার মনে মনে বলিল, “কি আশ্চর্য! এমন দুঃসাহসের কাজ করিয়াও যুবতীর কিছুমাত্র সঙ্কোচ নাই, কুণ্ঠা নাই; যেন সে এই হারচুরী সম্বন্ধে কিছুই জানে না! চোরের এমন নিঃসঙ্কোচ সপ্রতিভ ভাব আর কখনও দেখি নাই। যুবতী অসাধারণ বুদ্ধিমতী। কিন্তু তোমার ঘটে যতই বুদ্ধি থাক, মেয়ে মানুষ চোর! আমার হাত ছাড়াইবার শক্তি তোমার নাই, সে হার আমার হস্তগত হইবেই। শুভক্ষণে আজ এই মজলিশে প্রবেশ করিয়াছিলাম।—না, এই যুবতীর সহিত পরিচয় না করিলে চলিতেছে না। চুরীর ব্যবসায়ে যদি আমি উহাকে আমার দলে টানিয়া আনিতে পারি, তাহা হইলে পৃথিবীতে আমি অজেয় হইব সন্দেহ নাই, কিন্তু হার ছড়াটি অগ্রে চাই।”

 অনন্তর রাইমার ভোজনের টেবিলে উপবেশন পূর্ব্বক প্রফুল্ল চিত্তে আহার করিল, উৎকৃষ্ট সুরাপানে তাহার স্ফুর্ত্তি বর্ধিত হইল। কিন্তু যদি সেই যুবতীর পরিচয় তাহার জানা থাকিত, তাহা হইলে সে বুঝিতে পারিত, তাহার এরূপ হর্ষোন্মত্ত হইবার কারণ নাই। সে জানিত না—এই যুবতী তাহাকে একহাটে কিনিয়া আর এক হাটে বিক্রয় করিতে পারে!

 পাঠক বোধ হয় বুঝিয়াছেন, এই যুবতী আমাদের পূর্ব্বপরিচিতা বোম্বটে সর্দারণী আমেলিয়া কার্টার। জিগ্‌স খনির ডিরেক্টর জেমস্ পিয়ারসনের সর্বনাশ সাধনের জন্য আমেলিয়া, কার্টার পিয়ারসনের কোনও সম্ভ্রান্ত বন্ধুর জাল পরিচয়-পত্র আনিয়া সাল্‌ভেরিটা রাজ্যে পদার্পণ করিয়াছিলেন।

(৫)

 আহারান্তে ডাক্তার রাইমার আমেলিয়ার সহিত আলাপ করিবার সুযোগ অন্বেষণ করিতেছি; কিন্তু আমেলিয়ার নিকট তখন অনেক লোক ছিল বলিয়া সে তাঁহার নিকট অগ্রসর হয় নাই। অনেকক্ষণ পরে আমেলিয়াকে একাকিনী একখানি চেয়ারে উপবিষ্টা দেখিয়া রাইমার উঠিয়া তাঁহার নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং কোমল সুরে বলিল, “সিনোরিটা (কুমারী সাহেবা) কে বড় ক্লান্ত বোধ হইতেছে, বিরাম-কুঞ্জে কিছুকাল বিশ্রাম করিলে ক্লান্তি দূর হইতে পারে।”  আমেলিরা সবিস্ময়ে মুখ তুলিয়া রাইমারের মুখের দিকে চাহিলেন; তাহার পর গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “আপনার বোধ হয় ভুল। হইয়াছে, কাহাকে আপনি একথা বলিতেছেন?”

 রাইমার বলিল, “না, আমার ভুল হয় নাই আপনাকেই আমি। এ কথা বলিতেছি। অবশ্য আমি স্বীকার কলিতেছি—আপনার নামটি আমার স্মরণ হইতেছে না, কিন্তু আপনি দয়া করিলেই তাহা স্মরণ হইতে পারে।”

 আমেলিয়া ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আপনার ব্যবহার শিষ্টাচার-বিরুদ্ধ, কোনও অপরিচিত লোকের নিকট আমি এরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করি না। আপনি পুনর্ব্বার আমাকে বিরক্ত করিলে আমি অন্যের সাহায্যে আপনাকে এখান হইতে উঠাইয়া দিব।”

 রাইমার ক্রোধ গোপন করিয়া মৃদু স্বরে বলিল, “আমাকে এখানে ভয় প্রদর্শন করিবার আবশ্যক নাই; আমার ধৃষ্টতা মার্জ্জনা করিবেন। আপনার ঐ পাখাখানি দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছি। এমন সুন্দর পাখা পূর্ব্বে কোথাও দেখি নাই; তাই আপনার সঙ্গে আলাপ করিতে আসিয়াছি।”

 রাইমার তৎক্ষণাৎ আমেলিয়ার পাশে ঝুঁকিয়া পড়িয়া টেবিলের উপর হইতে পাখাখানি তুলিয়া লইল। ইহা দেখিয়া আমেলিয়ার চোখ মুখ ক্রোধে লাল হইয়া উঠিল; কিন্তু তিনি কোনও কথা বলিবার পূর্ব্বেই রাইমার পাখাখানি আন্দোলিত করিয়া বলিল, “ইহার শিল্প-নৈপুণ্য কি চমৎকার! পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভিনিস নগরে এই প্রকার পাখা প্রস্তুত হইত, তাঁহাদের দুই একখানি আমি ইতিপূর্ব্বে দেখিয়াছি; সেই সকল পাখার শিল্প-নৈপুণ্য দেখিযাই যে বিস্মিত হইতে হয়, এরূপ নহে, তাহা নিম্মণে শিল্পীর অন্য প্রকার বাহাদুরীরও পরিচয় পাওয়া যায়। এই প্রকার পাখার হাণ্ডেলের নিম্মপ্রান্তে একটি গুপ্ত স্প্রিং থাকে, সেই প্রিং টিপিলে একটি ক্ষুদ্র ডালা খুলিয়া যায়; ডলার নীচে যে গুপ্ত গহ্বর থাকে তাহাতে গোপনীয় চিঠি-পত্র, প্রণয়ীর লকেট প্রভৃতি অনায়াসে লুকাইয়া রাখা চলে। এমন কি, কারুকার্যখচিত বহুমূল্য হীরক হার পর্যন্ত সেই গুপ্ত গুহায় লুকাইয়া রাখিলে কেহ তাহার সন্ধান পায় না। আপনার এই পাখা খানিও ভিনিসের পাখা বলিয়া বোধ হইতেছে; যদি সত্যই তাহা হয়, তাহা হইলে ইহার হাণ্ডেলের মধ্যেও গুপ্ত গহ্বর আছে।—আছে কি না আপনি কি কোনও দিন তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখেন নাই?”

 আমেলিয়া বিস্ফারিত নেত্রে রাইমারের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি?”

 রাইমার বলিল, “সে কথা আপনাকে বলিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই; কিন্তু আমি ত পূর্ব্বেই বলিয়াছি আপনাকে বড়ই পরিশ্রান্ত দেখাইতেছে, বিরাম-কুঞ্জে কিছুকাল বিশ্রাম করিলেই আপনি সুস্থ হইবেন।”

 রাইমারের স্বরে কিঞ্চিৎ বিদ্রুপের আভাস ছিল, বিশেষতঃ পাখাখানি তখন, পর্য্যন্ত তাহার হাতেই ছিল। আমেলিয়া ভয় কাহাকে বলে তাহা জানিতেন না, কিন্তু এই অপরিচিত ভদ্রলোকের ব্যবহার তাঁহার নিকট কেমন রহস্যপূর্ণ বোধ হইল। তাঁহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল; তিনি ভাবিলেন “লোকটা কি হার-চুরীর। সন্ধান পাইয়াছে?—এ পুলিসের গোয়েন্দা না কি! না কোনও ছদ্মবেশী তস্কর, চুরীর উপর বাটপাড়ী করিতে আসিয়াছে?—লোকটা যে-ই হউক, উহার সহিত এখন অশিষ্ট ব্যবহার করা হইবে না, তাহাতে গুপ্ত কথা প্রকাশ হইয়া পড়িতে পারে। দেখি উহার উদ্দেশ্য কি?”

 এই সকল কথা চিন্তা করিয়া আমেলিয়া মৃদু হাস্যে ওষ্ঠ সুরঞ্জিত করিয়া কোমল স্বরে বলিলেন, “হাঁ, সত্যই আমি ক্লান্ত হইয়াছি, আপনার অনুরোধ রক্ষায় আমার বিশেষ আপত্তি নাই, কিন্তু অগ্রে আমার পাখাখানি দিন।”

 রাইমার বলিল, “আপনার পাখা আপনি লইবেন এ আর অধিক কথা কি? কি এ বড় সুন্দর পাখা, আমার হাতে খানিক ক্ষণ থাকিলে ক্ষতি কি? চলুন, আমি ইহা লইয়াই আপনার সঙ্গে যাইতেছি।”

 আমেলিয়া নিফল ক্রোধে ওষ্ঠ দংশন করিলেন, তাহার পর নেপথ্যবর্তী নির্জ্জন বিরাম-কুঞ্জের দিকে অগ্রসর হইলেন, রাইমার পাখাখানি হাতে লইয়া তাঁহার পাশে পাশে চলিল।

 আমেলিয়া বিরাম-কুঞ্জে প্রবেশ পূর্ব্বক তাল-জাতীয় গুল্মের অন্তরালস্থিত একখানি চেয়ারে উপবেশন করিলে, রাইমার তাঁহার অদূরে আরি একখানি চেয়ারে বসিল; তাহার পর আমেলিয়াকে নিম্ম স্বরে বলিল, “এখন আমরা নিশ্চিন্ত মনে আলাপ করিতে পারি। পাখা সম্বন্ধে আমি যে আলোচনা করিতেছিলাম, প্রথমে কি সেই কথাই তুলিব?”

 আমেলিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “এ আলোচনা বন্ধ রাখিলে কোনও ক্ষতি নাই, বিষয়টা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। আপনি নিশ্চয় কোনও গুপ্ত অভিসন্ধিতে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন; আপনার কি অভিপ্রায়, অগ্রে তাহাই জানিতে ইচ্ছা করি।”  রাইমার বলিল, “উত্তম তাহাই হউক, কিন্তু আমি এখন পর্য্যন্ত আপনার নাম জানিতে পারি নাই।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আমার নাম জানিবার জন্য আপনি এত ব্যস্ত কেন? আমার নাম জানিয়া আপনার কোনও লাভ নাই, দরকার মনে হইলে পরে আপনাকে আমার নাম বলিব; অগ্রে বলুন, আপনি কোন্ কথা বলিবার জন্য আমাকে এখানে ডাকিয়া আনিলেন।”

 রাইমার বলিল, “সর্ব্বাগ্রে আপনাকে একটি ছোট গল্প বলিব, দয়া করিয়া আমার গল্পটা শুনুন, আহাতে আপনার অধিক সময় নষ্ট হইবে না।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আমি এখানে অধিক বিলম্ব করিতে পারিব না। আপনার উদ্দেশ্য কি তাহাই বলুন, আমার গল্প শুনিবার আগ্রহ নাই।”

 রাইমার বলিল, “আমার গল্পেই আমার উদ্দেশ পরিস্ফুট হইবে।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আপনার কথাগুলি হেঁয়ালীর মত; ভাল, আপনি সঙ্ক্ষেপে আপনার গল্পটা শেষ করুন।”

 রাইমার আমেলিয়ার মুখের দিকে চঞ্চল দৃষ্টিতে চাহিয়া নিম্ন স্বরে বলিতে লাগিল, “আমার গল্পের নায়ক এক সময় বড় দরিদ্র ছিল, দরিদ্র হইলেও তাহার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমা ছিল না; কিন্তু দরিদ্রের উচ্চাভিলাষ জীবনে পূর্ণ হইবার সম্ভাবনা নাই, তাহারও সে-অশাছিল না। লোকটি অসাধারণ চতুর; প্রকৃত পক্ষে তেমন চতুর লোক পৃথিবীতে একজনের অধিক আছে বলিয়া বোধ হয় না, কেবল একজন মাত্র তাহাকে চাতুর্যে পরাজিত করিতে পারিত। সেই ব্যক্তি ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিটেটিভ;—যাহা হউক, আমার বিশ্বাস এমন একদিন আসিবে যে দিন সেই চতুর দরিদ্র সেই চতুর ডিটেটিভকেও। রীতিমত শিক্ষা দিতে পারিবে।”

 আমেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই বিখ্যাত ডিটেটিভের নাম আপনি জানেন কি?”

 রাইমার বলিল, “তাহায় নাম রবার্ট ব্লেক, আপনি বোধ হয় তাহার নাম শুনেন নাই?”

 আমেলিয়া হঠাৎ মুখ ফিরাইলেন। একখানি বৃটীশ সদাগরী জাহাজ লুণ্ঠনের অভিযোগে মিঃ ব্লেক আমেলিয়াকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য কিরূপ চেষ্টা করিতেছিলেন, আমেলিয়া তাহা জানিতেন; মিঃ ব্লেকের সহিত তাঁহার পরিচয়ও ছিল। কিন্তু তিনি রাইমারের নিকট সে সম্বন্ধে কোনও কথা বলিলেন না।

 রাইমার তাঁহার বিচলিত ভাব লক্ষ্য না করিয়া বলিতে লাগিল, “বলিয়াছি আমার গল্পের নামক দরিদ্র হইলেও বড়ই চতুর, সে কৌশলে অনেকের বহু সম্পত্তি আত্মসাৎ করিয়াছিল; কিন্তু রবার্ট ব্লেকের তাড়ায় বিব্রত হইয়া স্বদেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক বিদেশে গমন করিল, এবং সুযোগের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল; কিন্তু সেখানে শীঘ্র অর্থাগমের কোনও সুযোগ ঘটিল না। যাহা হউক, তাহার সৌভাগ্যক্রমে এক দিন সে কোনও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির গৃহে নাচের মজলিশে। কৌশলে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইল। সেখানে সে এইরূপ একটি বিরাম-কুঞ্জে একটি চিরহরিৎ গুল্মের অন্তরালে বসিয়া বিশ্রাম করিতে করিতে কিছু দূরে একটি পরমাসুন্দরী যুৱতীকে দণ্ডায়মান দেখি। পাইল। সেই যুবতীর হাতে এইরূপ অস্ট্রিচ্‌ -পালকের একখানি পাখা ছিল; তাহার হাণ্ডেলটিও এইরূপ কারুকার্য খচিত, গজদন্তে নিম্মিত। যুবতী এদিকে ওদিকে চাহিয়া পাখার হ্যাণ্ডেলের প্রান্তস্থিত একটি স্প্রিং টিপিলেন, আর তৎক্ষণাৎ হ্যাণ্ডেল-মধ্যস্থিত গুপ্ত আধারের ডালা খুলিয়া গেল; তখন যুবতী সেই গুপ্ত আধারে একছড়া মহামুল্য হীরক হার লুকাইয়া রাখিয়া তাহার ডালা বদ্ধ করিলেন। এ কাণ্ড চক্ষুর নিমিষে ঘটিল। যুবতী তাহার পর পাখা ঘুরাইতে ঘুরাইতে নাচের মজলিশে প্রবেশ করিলেন। যুবক যে লুকাইয়া এই কাণ্ড দেখিয়াছে,—তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না।

 “যুবকটি প্রথমে মনে করিয়াছিল, এই হীরক-হার যুবতীর নিজস্ব সম্পত্তি, লোকের ভীড়ে খোয়া যাইবার ভয়ে তিনি তাহা পাখার মধ্যে লুকাইয়া রাখিলেন। যুবক, আর্থিক অসচ্ছলতায় এতই কষ্ট পাইতেছিল যে, সেই হীরক-হারটি কোনও কৌশলে আত্মসাৎ করিবার জন্য বড়ই ব্যাকুল হইয়া উঠিল, এবং কি কৌশলে তাহা হস্তগত করিবে, তাহাই ভাবিতে লাগিল; সে যুবতীর গতিবিধির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখি,—ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিল।

 “সেই নাচের মজলিসে যাঁহারা নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে কোনও সম্রান্ত রাজ-কর্মচারীর পত্নীও ছিলেন, তাঁহার মহামূল্য হীরক-হার গোলমালে হারাইয়া গিয়াছে, এইরূপ একটা কথা যুবকের কর্ণে প্রবেশ করিল। যুবক তখন বুঝিতে পারি, উক্ত যুবতীই সেই হার চুরী করিয়া এই ভাবে লুকাইয়া রাখিয়াছেন। যাহা হউক, বিস্তর অনুসন্ধানেও সেই হার পাওয়া গেল না, অগত্যা পুলিশে সংবাদ দেওয়া হইল। কিন্তু পুলিশ যে সেই যুবতীকে সন্দেহ করিবে, বা হারের সন্ধান পাইবে, যুবক মুহূর্ত্তের জন্যও ইহা বিশ্বাস—করিতে পারিল না।

 “যুবতীর অদ্ভুত কৌশল ও বুদ্ধির প্রাখর্য্যের পরিচয় পাইয়া সেই যুবক অতঃপর চোরের উপর বাটপাড়ী করিবার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিল। সে মনে করিল যদি সে অর্থোপার্জ্জনে এই বুদ্ধিমতী যুবতীর সহায়তা লাভ করিতে পারে, যুবতী যদি তাহার সহিত যোগ দান করিয়া, এই লাভজনক ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হন,—তাহা হইলে অতি অল্প দিনের মধ্যেই বহু অর্থ উভয়ের হস্তগত হইতে পারে; “পুলিশের সাধ্য নাই তাহাদিগকে ধরে। যুবক এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া যুবতীকে এ সম্বন্ধে তাঁহার অভিপ্রায় জিজ্ঞাসা করিবার জন্য গোপনে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিল।—এখন আপনি বলুন দেখি যুবতী তাহাকে কি উত্তর দিয়াছিলেন?”

 আমেলিয়া নিস্তব্ধ ভাবে রাইমারের এই সুকৌশলপূর্ণ কাহিনী শ্রবণ করিয়া বলিলেন, “আপনার গল্পটি বেশ চিত্তাকর্ষক, কিন্তু আপনি কি উদ্দেশ্যে আমার কাছে এই অবান্তর কথা উত্থাপিত করিলেন—তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না।”

 রাইমার তৎক্ষণাৎ পাখাখানির হ্যাণ্ডেলের স্প্রিং টিপিল, তাহার ডালা খুল্কিমাত্র অপহৃতহীরক-হারের কিয়দংশ বাহির হইয়া পড়িল। তখন রাইমার মৃদু হাসিয়া বলিল, “আপনি বুঝিতে পারিতেছেন যুবতী কৌশলে সেই হার আত্মসাৎ করিরা অন্যের অলক্ষ্যে অতি সাবধানে। অসম্ভব স্থানে লুকাইয়া রাখিলেও, পাখাসমেত হারগাছটি সেই চতুর যুবকের হস্তগত হইয়াছিল। যুবতী কোন উপায়ে যে সেই চতুর যুবকের কবল হইতে হারগাছটী উদ্ধার করিবেন, তাহার সম্ভাবনা ছিল না; এ সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করিলেই তাঁহার বিপদ,—তাহা তিনি জানিতেন। কিন্তু যুবক হারছড়াটী তাঁহাকে ফেরত দিতে সম্মত ছিল, সে প্রার্থনা করিয়াছিল, এইরূপ লাভজনক ব্যবসায়ে যুবতী তাহার সহায়তায় প্রবৃত্ত হউন। সম্রান্ত সমাজে যুবতী সুপরিচিতা, সর্ব্বত্রই তাঁহার অব্যাহত গতি; সুতরাং তিনি যেমন উপার্জ্জনের সুযোগ পাইবেন, অন্যে সেরূপ পাইবে না।”

 আমেলিয়া অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে রাইমারের দিকে চাহিয়া দৃঢ় স্বরে বলিলেন,“যুবতী যদি সাধারণ রমণী হইত,তাহা হইলে সে, এই যুবকের হাতে ধরা পড়িয়া বিহ্বল হইত, কিংকর্ত্তব্য-বিমূঢ় হইয়া হারছড়াটির আশা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইত, কিন্তু যুবতী সেই যুবকের মত শত শত চতুর যুবককে অঙ্গুলি সঙ্কেতে ইচ্ছামত পরিচালিত করিত, এখনও করিয়া থাকে। শীঘ্র আমার পাখা দাও,নতুবা এখনই তোমার মৃত দেহ ভূমিতলে লুটাইবে, জানিও।”—আমেলিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহার পকেট হইতে টোটাভরা একটি ক্ষুদ্র পিস্তল রাহির করিয়া রাইমারের ললাটে তাহা উদ্যত করিলেন।

 রাইমার মুহূর্ত্তকাল কিংকর্তব্য-বিমূঢ় ভাবে বসিয়া রহিল, তাহার মুখ শুকাইয়া গেল। কিন্তু মুহূর্ত্ত মধ্যে সে আত্মসংবরণে সমর্থ হইল, হাসিয়া বলিল, “সুন্দরী, আমাকে ভয় প্রদর্শন বৃথা! আপনি আমাকে গুলি করিতে সাহস করিবেন না, আপনার পিস্তলেয় শব্দ হইলেই নাচ-ঘর হইতে অনেকে এখানে ছুটিয়া আসিবে। নরহত্যা করিয়া সম্রান্তবংশীয়া সুন্দরীরও কঠোর রাজদণ্ড হইতে মুক্তি লাভের আশা নাই। হারের মূল্য অপেক্ষা আপনার জীবনের মূল্য অনেক অধিক।”

 আমেলিয়া, বলিলেন, “মিথ্যা আশায় প্রলুব্ধ হইও না, আমি তোমাকে বৃথা ভয় প্রদর্শন করি নাই। আমার এই পিস্তলের টোটা আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে নির্ন্মিত। এই টোটায় যে বারুদ আছে তাহা নির্ধ্বূম; পিস্তল আওয়াজ করিলে যে শব্দ হইবে, তাহা দুই হাত দূরের লোকেরও কর্ণে প্রবেশ করিবে না।—শীঘ্র আমার পাখা দাও।”  রাইমার বলিল, “সিনোরিটা, আপনি বড়ই “চতুরা, আমি পূর্ব্বে আপনার বুদ্ধির পরিমাণ করিতে পারি নাই। আমি আপনার নিকট পরাজয় স্বীকার করিলাম, আপনার পাখা আপনি লউন।”

 আমেলিয়া পিস্তলটি পকেটে ঘুরিয়া পাখাখানি তুলিয়া লইলেন, তাহার পর মৃদু স্বরে বলিলেন,“আমিও তোমাকে একটি গল্প বলিতেছি, আশা করি গল্পের তাৎপর্য বুঝিতে তোমার কষ্ট হইবে না। আমার গল্পের নায়িকা কেবল সুন্দরী নহেন, অসাধারণ বুদ্ধিমতী, সম্ভ্রান্ত সমজের সর্বত্র তাহার অব্যাহত গতি। তিনি একটি নূতন দেশে গিয়া একটি বলের মজলিসে উপস্থিত হন; কিন্তু সে দেশে তিনি বাস করেন; সেই রাজ্যের রাজধানীর বন্দরে তাহার নিজের যে জাহাজ আছে সেই জাহাজে তিনি বাস করেন। বলের মজলিসে এক চতুর যুবক গোপনে থাকিয়া যুবতীর কেনিও একটি কাজ দেখিতে পায়। যুবক মনে করিয়াছিল—সে সহজেই যুবতীকে বশীভূত করিতে পারিবে, তাহার অভিষ্ট সাধনে বিলম্ব হইবে না,—কিন্তু ইহা যুবকের ভ্রম মাত্র; সে পূর্ব্বে যুবতীর শক্তি সামর্থ্যের পরিচয় পায় নাই বলিয়াই তাহার এরূপ বিশ্বাস হইয়াছিল। যাহা হউক, যুবতী সেই চতুর যুবককে বুদ্ধি-কৌশলে পরাজিত করিয়া তাহাকে হতভম্ব করেন। কিন্তু যুবকটিকে তিনি তাঁহার নিজের দলভুক্ত করিয়া লইতে সম্মত আছেন; অর্থোপার্জ্জনে সে লাভের যথাযোগ্য অংশ পাইবে, কিন্তু তাহাকে কয়েকটি অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইতে হইবে যুবতীর প্রস্তাবে সম্মত না হইলে যুবক কোনও বিষয়ে তাঁহার সাহায্য পাইবে না।”

 রাইমার বলিল, “গল্পটি বড়ই মনোরম, সুতরাং যুবতী সেই হতভম্ভ যুবকের নিকট কি প্রস্তাব করিলেন, তাহা আমার জানিবার আগ্রহ হইয়াছে।”  আমেলিয়া বলিলেন, “যুবতীর প্রস্তাব এই যে, সেই যুবককে সর্ব্ব বিষয়ে তাঁহার কর্তৃত্ব স্বীকার করিতে হইবে। তাঁহার একজন সুচতুর কর্ম্মঠ সহকারীর প্রয়োজন আছে; কি বুদ্ধিমত্তায়, কি সাহসে ও কার্য্য-নৈপুণ্যে, কি নূতন নূতন উদ্ভাবনী শক্তিতে—সকল বিষয়েই সে তাঁহার সমকক্ষ হইলেও তাঁহার কর্তৃত্ব তাহাকে নতশিরে মানিয়া চলিতে হইবে। তোমার গল্পে রবার্ট ব্লেক নামক এক বিখ্যাত ডিটেটিভের প্রসঙ্গ আছে, আমার গল্পের নায়িকাও এই ডিটেক্‌টিভকে শত্রু মনে করেন। রবার্ট ব্লেক একাধিক বার তাঁহাকে বিপদে ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কেবল তাঁহার অসাধারণ বুদ্ধিকৌশলেই সে তাঁহাকে শৃঙ্খলিত করিতে পারে নাই। এই গোয়েন্দাপ্রবরের সহিত আমার গল্পের নায়িকার একবার সাক্ষাৎ-ও হইয়াছিল; আমার গল্পের নায়িকা তাহার বুদ্ধিকৌশলে, ছদ্মবেশ ধারণের নিপুণতায় ও কার্য্যপটুতায় এতই মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে,তাহাকে গোয়েন্দাগিরি ছাড়িয়া তাঁহার দলভুক্ত হইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন;কিন্তু রবার্ট ব্লেক অবজ্ঞার সহিত এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়াছিল, বলিয়াছিল—গোয়েন্দাগিরিই তাহার জীবনের একমাত্র। লক্ষ্য; বিপন্নের বিপন্নিবারণই তাহার জীবনের ব্রত। অণর আমার গল্পের নায়িকার ব্রত দুষ্টের দমন, দাম্ভিকের দম্ভ চূর্ণ, প্রবলের শক্তির বিলোপ-সাধন, অত্যাচারীর নিগ্রহ।—আমার গল্পের নায়িকার প্রস্তাব শুনিয়া তাঁহার সহায়তাপ্রার্থী যুবক কি উত্তর দিয়াছিল, অনুমান করিতে পার?”

 রাইমার বলিল, “সে, নিশ্চয়ই তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছিল, তাঁহার, প্রত্যেক আদেশ নতশিরে পালন করিতে স্বীকৃত হইয়াছিল।”  আমেলিয়া হাসিয়া বলিলেন, “সে ভালই করিয়াছিল; কিন্তু আমার গল্পটা ক্রমে লম্বা হইয়া উঠিতেছে, এখন উহা শেষ করিলে ক্ষতি নাই।

 রাইমার বলিল, “হাঁ, শেষ করতে পারেন।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “উত্তম।—যুবক আমার গল্পের নায়িকার প্রস্তাবে সম্মত হইলে তিনি তাহাকে তাঁহার জাহাজে যাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন; স্থির হইল, সে পর দিন বেলা দশটার সময় তাঁহার জাহাজে উপস্থিত হইবে। আমার গল্পের নায়িকা একটি গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ কার্য্যে হস্তক্ষেপণের সঙ্কল্প করিয়াছিলেন; তাহার সাফল্যে সমগ্র আমেরিকায় ভীষণ আন্দোলন উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা;— ইউরোপের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ডিটেক্‌টিভগণ সেই রহস্যভেদের চেষ্টায় আহারনিদ্রা ত্যাগ করিবে। কিন্তু সেই বিপুল রহস্য ভেদ করা গোয়েন্দা নামক জীবের সাধ্যাতীত। যুবক এই গুরুতর কার্যে কি ভাবে আত্মনিয়োগ করিবে—জাহাজে সে সম্বন্ধে আলোচনা হইবে, এইরূপ কথা ছিল।

 রাইমার বলিল, “আমার বিশ্বাস যুবক হৃষ্টচিত্তে এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু আপনার গল্পের নায়িকা যে কোনও দুরভিসন্ধিতে তাহাকে তাঁহার জাহাজে নিমন্ত্রণ করেন নাই, ইহা সে কিরূপে বুঝিল?”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আমার গল্পের নায়িকার উপর তাহার এতটুকু বিশ্বাস না থাকিলে সেই যুবক কিরূপে তাঁহার কর্তৃত্ব নতশিরে মানিয়া চলিবে? যাঁহার প্রভুত্ব স্বীকার করিতে হইবে, তাঁহার উপর নির্ভর করিতেই হইবে।—যাহা হউক, আমার গল্পের নায়িকা তাহাকে ‘বলিয়াছিল—তাঁহার কথা অবিশ্বাস হইলে সে অনায়াসে রবার্ট ব্লেককে এ কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারে। রবার্ট ব্লেক এই যুবতীকে মহাশত্রু মনে করেন বটে, কিন্তু তাঁহাকে মিথ্যাবাদিনী মনে করেন না। যুবতী দুর্ব্বলের নিগ্রহপরায়ণ অত্যাচারী সম্রান্ত সমাজের শক্র হইতে পারেন, কিন্তু তিনি মিথ্যাকথা বলেন না, ব্লেক এ কথা জানেন, এবং সম্ভবতঃ একথা অস্বীকার করেন না।”

 রাইমার বলিল, “সেই যুবক বোধ হয় রবার্ট ব্লেকের পরামর্শ গ্রহণ না করিয়াই আপনার নায়িকার প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছিল। যুবতীর কথা শুনিয়াই সকল সন্দেহ দূর হয়।”

 আমেলিয়া সহাস্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন বল তোমার নাম কি?”

 রাইমার বলিল, “এ অধীনের নাম ডাক্তার হক্‌স্টন রাইমার।”

 আমেলিয়া সবিস্ময়ে বলিলেন, “তোমারই নাম ডাক্তার রাইমার? ও—তুমি বিখ্যাত লোক, আমি শুনিয়াছি তুমি একাধিকবার লণ্ডনের জেল ভাঙ্গিয়া পলায়ন করিয়াছিলে, কত বার রবার্ট ব্লেকের বিপুল চেষ্টা ব্যর্থ করিয়াছ! তুমি অসাধারণ ব্যক্তি।”

 রাইমার বলিল, “আমার নাম আপনার অপরিচিত নহে, ইহা আমি গৌরবের বিষয় মনে করিতেছি।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আশা করি তুমি ভবিষ্যতেও তোমার নামের গৌরব অক্ষুন্ন রাখিতে পারিবে। এখন আর কোনও কথা নয়, আমি বড় শান্ত হইয়াছি। তুমি কাল সকালে বন্দরে গিয়া যে সাদা জাহাজখানি দেখিবে, তাহাতে উঠিয়া মিস্‌ আমেলিয়া কার্টারের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিবে, তাহা হইলেই আমার দেখা পাইবে।”

 রাইমার, এ কথা শুনিয়া মুহূর্ত্ত কাল বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া রহিল, তাহার পর বলিল, “আপলিই বিখ্যাত রূপসী বোম্বেটে আমেলিয়া কার্টার? আমি আপনার সঙ্গে চালাকি করিতে গিয়াছিলাম। অধমের গোস্তাকি মাফ্‌ করুন।—আজ সত্যই মণি-কাঞ্চন যোগ!”

 রাইমার মজলিস পরিত্যাগ করিয়া পথে আসিয়া ভাবিল, “এবার, আর আমার সৌভাগ্যের পথ কে রোধ করে? আজ আমার এক দিন!,

 পর দিন প্রভাতে ডাক্তার রাইমার অনেক টাকা ব্যয় করিয়া একটি উৎকৃষ্ট পরিচ্ছদ কিনিয়া আনিল। সেই পরিচ্ছদে সজ্জিত হইয়া সে বেলা দশটার কিছু পূর্ব্বেই বন্দরে আসিল। সেখানে সে একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া আমেলিয়ার জাহাজের দিকে চলিল।

 রাইমারের পরিচ্ছদ আগা-গোড়া সাদা। ক্যাম্বিসের জুতা হইতে মাথার হ্যাট পর্যন্ত সমস্তই সাদা। তাহার পকেটে সোনার ঘড়ি চেন, অঙ্গুলীতে মূল্যবান হীরাঙ্গুরীয়, সার্টের বোতামগুলি হীরকখচিত;—সমস্তই চোরা মাল!

 রাইমারের নৌকা আমেলিয়ার জাহাজে ভিড়িলে সে নিগ্রো মাঝিকে সহর্ষে দ্বিগুণ ভাড়া ফেলিয়া দিয়া জাহাজে উঠিল। আমেলিয়া তাঁহার কর্মচারীদের পূর্ব্বেই বলিয়া রাখিয়াছিলেন; রাইমার অবিলম্বে আমেলিয়ার সম্মুখে নীত হইল।

 আমেলিয়া তখন ডেকের উপর, একখানি বেতের চেয়ারে বসিয়া ছিলেন; তাঁহার পরিচ্ছদ শুভ্র। উৎসাহ ও স্ফুর্ত্তি সমুদ্রবক্ষঃ-প্রবাহিত মুক্ত সমীরণ-হিল্লোলের মত তাঁহার সর্ব্বাঙ্গে হিল্লোলিত হইতেছিল।

 আমেলিয়া রাইমারের করস্পর্শ করিয়া সহাস্যে বলিলেন, “তুমি ঠিক সময়ে আসিয়াছ। ঐ চেয়ারখান টানিয়া লইয়া বসিয়া পড়। তোমার নৌকা বিদায় করিয়া দিয়াছ কি?

 রাইমার বলিল, “হাঁ, কর্ত্রী।”— মে প্রথমেই তাহাকে কর্ত্রী বলিয়া সম্বোধন করিল। সে বুঝিয়াছিল এখন তাহার জীবনের শুভাশুভ আমেলিয়ার অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিতেছে।

 আমেলিয়া বলিলেন, “তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গ কর নাই দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলাম। আমার যে সকল কথা আছে তাহা এখানেই বলি শোন; “আমার কথা শেষ হইলে আমার মামা ও দলের অন্যান্য লোকের সহিত তোমার পরিচয় করাইয়া দিব।”।

 রাইমার বলিল, “আপনার অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। আপনার কি বলিবার আছে বলুন, আমি শুনি। আশা করি আমার ধূমপানে আপনার আপত্তি নাই।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আপত্তি কি?—তুমি আমার সিগারেট পরীক্ষা করিতে পার।”

 আমেরিয়া তাঁহার কারুকার্যখচিত সুন্দর ‘সিগারেট কেশ’টি সহাস্যে রাইমারের দিকে প্রসারিত করিলেন। রাইমার একটি সিগারেট বাহির করিয়া মুখে গুঁজিল।

 তখন নাবিকেরা জাহাজের অন্য দিকে কাজ করিতেছিল, নিকটে অন্য কেহ ছিল না। আকাশ সুনীল, রবিকর-প্রদীপ্ত সমুদ্র-জল যেন হিরণ-কিরণে অনুরঞ্জিত, অব্যাহত সমীরণ-প্রবাহ শুভ্র ক্যাম্বিসের পর্দ্দা কম্পিত করিতেছিল। দূরে দূরে ছোট ছোট নৌকাগুলি পাল তুলিয়া লীলাভঙ্গে সমুদ্রের তুরঙ্গের উপর নাচিতেছিল। জাহাজের চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া রাইমার আমেলিয়ার বিপুল বিভবের পরিচয় পাইল। সে দরিদ্রের সন্তান, ঐশ্বর্য্যের জন্য তাহার হৃদয় চিরদিন লালায়িত, আমেলিয়ার সাহায্যে এক দিন সে এইরূপ ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হইতে পারিবে,—এই উদ্দাম কল্পনায় তাহার হৃদয়ও সমুদ্রতরঙ্গান্দোলিত তরণীগুলির ন্যায়উদ্বেলিত আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল। সে ভাবিল, রবার্ট ব্লেক কতবার তাহার মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়াছে; এই অসীম শক্তিশালিনী মহিমময়ী নারীর আশ্রয়ে থাকিতে আর তাহার ভয় কি?—রবার্ট ব্লেক আর তাহার ছায়াও স্পর্শ করিতে পারিবে না॥

 তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া তাহার ভাগ্য-দেবতা অদৃশ্য থাকিয়া হাসিতেছিলেন। অতীতের ন্যায্য অদূর ভবিষ্যতেও যদি তাহার দৃষ্টি প্রসারিত করিবার শক্তি থাকিত, তাহা হইলে সে আমেলিয়ার সহযোগিতায় সম্মত হইত কি না সন্দেহ।

 দস্যু যদি চিরসুখী হইত, তাহা হইলে ভগবানের সৃষ্টি ব্যর্থ হইত।

 আমেলিয়া সিগারেট টানিয়া বলিলেন, “মিঃ রাইমার, এই সালভেরিটা রাজ্য-সম্বন্ধে তোমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে কি?”

 রাইমার বলিল, “না, আমি এখানে কয়েক দিন মাত্র আসিয়াছি, এ দেশ সম্বন্ধে আমার কোন অভিজ্ঞতা নাই; কিন্তু পোর্টো কষ্টা বন্দর আমার সুপরিচিত। সেখানকার অলি-গলি সমস্তই আমি চিনিয়া ফেলিয়াছি। এখানে আমার আত্মীয় বন্ধু কেহ নাই, কৌশলে এখানকার নাচের মজলিশে প্রবেশ করিয়াছিলাম।”।

 আমেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,“প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন সম্বন্ধে কোনও কথা জান?”

 রাইমার বলিল, “এখানে আসিয়া তাহার সম্বন্ধ যে দুই চারিটী কথা, শুনিয়াছি—তাহার অধিক কিছুই জানি না।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “এখানকার গবর্মেণ্টের ভিতরের খবর কিছু রাখ?”

 রাইমার বলিল, “হাঁ, কিছু কিছু রাখি বৈ কি?” এ

 আমেলিয়া বলিলেন, “গবর্মেণ্টের ভিতরের কি খবর জানিতে পারিয়াছ? তাহা বলিতে আপত্তি আছে কি?”  রাইমার বলিল, “না, কোনও আপত্তি নাই। ছোট-খাট খবর বলিয়া কোনও লাভ নাই, তবে একটা বড় খবর আছে বটে। এই রাজ্যের আর্থিক অবস্থা বড় শোচনীয়। সেইজন্য লণ্ডনে দুই কোটী টাকা কর্জ্জ লইবার প্রস্তাব চলিতেছে। শুনিয়াছি পঞ্চাশ বৎসরে শুল্ক বিভাগে কে আয় হইতে, তাহাই দিয়া এই ঋণ পরিশোধ করা হইবে। যাহারা ঋণ দিবে তাহারা প্রস্তাব করিয়াছে—শুল্ক বিভাগের কার্য্য তাহাদের নিজের লোক দ্বারা পরিচালিত করিতে হইবে।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “এই দুই কোটী টাকার একটা মোটা বখ্‌রা পাইতে তোমার আপত্তি আছে কি?”

 রাইমার হর্ষ-বিগলিত স্বরে বলিল, “আপত্তি? যদি এই টাকাগুলা মারিতে পারা যায়—তবে সে জন্য আমি মাথা দিতেও রাজী আছি।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “কাজটা কঠিন বটে, কিন্তু চেষ্টা করিতে ক্ষতি কি? মাথা না দিয়াও কার্যোদ্ধার হইতে পারে।”

 রাইমার বলিল, “আপনি কি সত্যই এজন্য চেষ্টা করিবেন?”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আমি কি তোমার সঙ্গে পরিহাস করিতেছি?”

 রাইমার বলিল, “এ সকল কাজে আমার খুব উৎসাহ, মাথাও এক রকম খেলে। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন।”

 আমেলিয়া বলিলেন,“তুমি বোধ হয় জান না আগামী মাসের প্রথম দিনে এই টাকা লণ্ডন হইতে এখানে প্রেরিত হইবে।”

 রাইমার বলিল, “না, আমি তাহা জানিতাম না।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “হাঁ, ঐ দিন টাকা প্রেরিত হইবে বটে, কিন্তু এখানকার গবমেণ্টের ধনাগারের নির্ন্মাণ-কার্য এখনও শেষ, হয় নাই, সুতরাং এ টাকা ধনাগারের রাখা হইবে না ইহা নিশ্চয়।”  রাইমার বলিল, “কোথায় রাখা হইবে কে জানে?”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানিতে পারিয়াছি, এই দুই কোটী টাকার স্বর্ণমুদ্রা একখানি স্বতন্ত্র ষ্টীমারে এখানে আসিতেছে; আগামী মাসের ১৫ই, কি ১৬ই তারিখে সেই ষ্টীমার এখানকার বন্দরে, পৌঁছিবে; ১৭ই তারিখের মধ্যে নিশ্চয়ই আসিবে। আমি সন্ধান লইয়া ইহাও জানিতে পারিয়াছি যে, যত দিন গবর্মেণ্টের ধনাগারের নির্ন্মাণকার্য্যে শেষ না হয়, তত দিন স্বর্ণমুদ্রাগুলি প্রাসাদেই থাকিবে। প্রাসাদের অন্য কোনও কক্ষে রাখিলে প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন সকল সময় তাহার উপর দৃষ্টি রাখিতে পারিবে না ভাবিয়া সে আদেশ করিয়াছে— তাহার শয়ন কক্ষের পার্শ্বের কক্ষে সুদৃঢ় লোহার সিন্দুকে স্বর্ণ মুদ্রাগুলি রাখিতে হইবে। আর দশ জন অস্ত্রধারী প্রহরী দিবারাত্রি এই টাকার পাহারায় থাকিবে।

 “এখন কথা এই যে, সালভেরিটার গবর্মেণ্ট এই অর্থ যেভাবে খরচ করিবে, ‘আমাদের হস্তে তাহার অধিকতর সদ্ব্যবহার হইতে পারে! সুতরাং যেমন করিয়া হউক, উহা আমাদিগকে হস্তগত করিতেই হইবে।”

 রাইমার বলিল, “কম টাকা ত নয়; দুই কোটী টাকা! এত টাকা যে সামাল দেওয়াই কঠিন হইবে। আর এ বিপুল অর্থ। সরাইবারই বা উপায় কি?”

 আমেলিয়া হাসিয়া বলিলেন, “তুমি প্রথমেই যে ভড়কাইয়া যাইতেছ? আমার সকল কথা শুনিলে কাজটা অসম্ভব মনে হইবে না। এই বিপুল অর্থ অপহরণ করিবার শক্তি আমার নাই এরূপ মনে করিও না, এরূপ কঠিন কার্য্যেও আমি এই নুতন হস্তক্ষেপণ করিতেছি; এমন দুষ্কর কর্ম্মে ইতিপূর্ব্বেও আমি কৃতকার্য হইয়াছি। আমি এমন কৌশলে টাকাগুলি সরাইতে চাই, যেন কেহই আমাদের কার্য্যের কোনও প্রমাণ না পায়। আমাকে ত সন্দেহ করিতে পারিবেই না; তোমার উপরেও পুলিশের সন্দেহ হইবে না।”

 রাইমার হাসিয়া বলিল, “পুলিশ সন্দেহ করিতে পারিলে আর বাহাদুরী কি?”

 আমেলিয়া বলিলেন, “এখন কি করিতে হইবে শোন। আমি কেবল টাকাগুলি সরাইয়াই ক্ষান্ত হইব না; টাকার সঙ্গে সঙ্গে। প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকেও আমি ধরিয়া লইয়া যাইতে চাই। টাকার সঙ্গে যদি প্রেসিডেণ্টকে পর্যন্ত সরাইতে পারা যায়,—তাহা হইলে সকলেই মনে করিবে প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন টাকাগুলি চুরি করিয়া ফেরার হইয়াছে। তখন গবর্মেণ্ট প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের সন্ধানেই ব্যস্ত হইবে, আমাদের দিকে তাহাদের লক্ষ্য থাকিবে না। কিন্তু কেবল এইজন্যই যে আমি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে চুরী করিতে উদ্যত হইয়াছি, এরূপ মনে করিও না; টাকাগুলিতে আমার যেমন দরকার, তাহাকেও ঠিক সেই রকম দরকার। প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের উপর আমার ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে; তাহাকে কীটের ন্যায় পদদলিত করিতে না পারিলে আমার মন স্থির হইবে না।”

 রাইমার বলিল, “আশ্চর্য্য, অতিআশ্চর্য্য! আমি যতই আপনার সাহস ও বুদ্ধি-নৈপুণ্যের পরিচয় পাইতেছি, ততই আমার বিস্ময় উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইতেছে। যাহা হউক, প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের উপর আপনার স্বাক্রোশের কারণ জানিতে পারি কি?”

 আমেলিয়া বলিলেন, “এ কথা তোমার জানিবার কোনও আবশ্যক নাই। আগামী কল্য আ্মরা এই বন্দর পরিত্যাগ করিব, এবং টাকাগুলি যত দিন এখানে না আসে, তত দিন কিছু দূরে থাকিব। আমার মামা আমার ধনাধ্যক্ষ; তোমার যখন যত টাকার আবশ্যক, তাঁহার নিকট চাহিলেই তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা দিবেন। আজ বৈকালে আমার অধীনস্থ কর্ম্মচারীদের লইয়া এক বৈঠক করিব; তুমি আমাদের ‘বোম্বেটে সমিতি’র সহকারী সভাপতি নির্ব্বাচিত হইবে। আশা করি, তোমা দ্বারা কোনও দিন এই পদের গৌরব ক্ষুন্ন হইবে না, বা কোনও দিন কোনও কারণে তুমি আমার কর্তৃত্ব অস্বীকার করিবে না।”

 রাইমার বলিল, “আপনার আদেশ শিরোধার্য্য, আমি সপথ করিয়া বলিতেছি বিপদে সম্পদে চিরদিন আপনার অনুগত হইয়া থাকিব; কখনও কোনও কারণে আপনার ন্যস্ত বিশ্বাসের অপব্যবহার করিব না।”

 আমেলিয়া বলিলেন, “আমার কথা শেষ হইয়াছে; তুমি জাহাজেই থাক, আমি তোমার বাসের কক্ষ নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিব।—অপরাহ্নে আবার তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে, এখন বিদায়।”

 আমেলিয়া উঠিয়া তাঁহার সেলুনে প্রবেশ করিলেন।—রাইমারও গাত্রোখান করিল।

 আমেলিয়ায় জাহাজ পরদিন প্রত্যুষে পোর্টো কষ্টার বন্দর পরিত্যাগ পূর্ব্বক শুভ্রপক্ষ বিহঙ্গের ন্যায় আটলাণ্টিক মহাসমুদ্রের সুনীল ভাসিয়া চলিল।