রূপসী বোম্বেটে/প্রথম খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ


সিনর মেন্‌ডোজা প্রস্থান করিলে স্মিথ প্রভুর নিকট আসিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি স্থির করিয়াছেন?

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “এখন পর্যন্ত আমি কিছুই স্থির করিতে পারি নাই; তবে এইমাত্র বুঝিতে পারিয়াছি যে, প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন স্বেচ্ছায় অদৃশ্য হন নাই; কিন্তু তাঁহার নিরুদ্দেশের কারণ অনুমান করা সহজ নহে। ব্যাপার যেরূপ জটিল, তাহাতে আমি যে সহজে কৃতকার্য্য হইব, তাহার সম্ভাবনা অতি অল্প।”

 মিঃ ব্লেক কথা কহিতে কহিতে বাতায়ন-পাশ্বে দণ্ডায়মান হইলেন, কিন্তু বাহিরের দিকে চাহিয়াই মাথা টানিয়া লইলেন। তিনি দেখিলেন, একটি লোক পথে দাঁড়াইয়া লুব্ধ মার্জ্জারের মত তাঁহার জানালার দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। তিনি আড়ালে দাঁড়াইয়া সাবধানে পুনর্ব্বার পথের দিকে চাইলেন। তাহারপর হঠাৎ মুখ ফিরাইয়া স্মিথকে বলিলেন, “স্মিথ,একজন লোক পথের অন্য পাশে দাঁড়াইয়া এই দিকে চাহিয়াছিল, আমাকে দেখিবামাত্র সে মুখ ফিরাইয়া লইল; আমার অনুমান, এই ব্যক্তি সিনর মেন্‌ডোজার অনুসরণে এখানে আসিয়াছে। বিনা উদ্দেশ্যে সে যে তাঁহার অনুসরণ করিয়াছিল, এরূপ বোধ হয় না। আমি এখনই বাহিরে যাইব; অন্য দিকে না গিয়া অক্সফোর্ড স্ট্রীটের দিকে চলিব। তুমি দুই চারি মিনিট বিলম্ব করিয়া অক্সফোর্ড স্ট্রীটের দিকে যাইবে; যদি দেখিতে পাও কেহ আমার অনুসরণ করিতেছে, তবে তাহার গতি-বিধির দিকে লক্ষ্য রাখিবে। সে যে দিকে যাইবে, তুমিও সেই দিকে যাইবে।”  মিঃ ব্লেক অতঃপর তাঁহার অট্টালিকা হইতে বাহির হইয়া সদর দরজায় দাঁড়াইয়া একটি চুরুট ধরাইলেন, তাহার পর পথে আসিয়া এক খানি ভাড়াটে গাড়ীতে উঠিলেন; গাড়ী অক্সফোর্ড স্ট্রীটের দিকে চলিল।

 মিঃ ব্লেকের অনুসরণকারী মুহূর্ত্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া আর এক খানি গাড়ীতে উঠিয়া তাঁহার অনুসরণ করিল।

 মিঃ ব্লেকের গাড়ী অক্সফোর্ড স্ট্রীটের ভিতর দিয়া একটা বাজারে উপস্থিত হইলে তিনি গাড়ী থামাইলেন, এবং গাড়ী হইতে নামিয়া কোচম্যানকে নির্দিষ্ট ভাড়া দিলেন; তাহাকে বলিলেন, “তুমি এখন তাড়াতাড়ী গাড়ী লইয়া চলিয়া যাইও না; দশ মিনিট এখানে অপেক্ষা কর—তাহার পর যেখানে খুসী যাইও।”।

 কোচম্যান তাঁহার প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করিল; সেই সময় তিনি পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলেন, তাঁহার অনুসরণকারীর গাড়ীও তাঁহার গাড়ীর পশ্চাতে আসিয়া থামিল।

 মিঃ ব্লেক একটি দোকান-ঘরের ভিতর দিয়া তাহার পশ্চাদ্বর্ত্তী দ্বারে উপস্থিত হইলেন; সম্মুখেই পথ, তিনি সেই পথে নামিয়া আর একথানি গাড়ীতে উঠিয়া পড়িলেন; গাড়ী তাঁহাকে লইয়া কক্সপুর স্ট্রীটের দিকে চলিল। তিনি গাড়ী হইতে, মুখ বাড়াইয়া অন্য কোনও গাড়ী দেখিতে পাইলেন না, বুঝিলেন তাহার অনুসরণকারী তাহার ফন্দী বুঝিতে না পারিয়া ধাঁধায় পড়িয়াছে।

 মিঃ ব্লেক সিয়া বলিলেন, “স্মিথ নিশ্চয়ই লোকটার উপর নজর রাখিবে। তবে লোকটা চালাক হইলে সে যে স্মিথের মতলব ঠাহর করিতে পারিবে না এমন বোধ হয় না।”

 মিঃ ব্লেক কিছু দূর গমন করিয়া গাড়ী হইতে নামিলেন, নিকটেই একটি ষ্টীমার কোম্পানীর আফিস ছিল, তিনি সেই আফিসে প্রবেশ করিলেন। তিনি সন্ধানে জানিলেন, একখানি জাহাজ পর দিনই সাল্‌ভেরিটা রাজ্যে যাত্রা করিবে। তিনি সাল্‌ভেরিটার একখানি, টিকিট কিনিয়া বাড়ী ফিরিলেন।

 স্মিথের তখনও দেখা নাই! এতক্ষণ সে কোথায় কি করিতেছে বুঝিতে না পারিয়া মিঃ ব্লেক উৎকণ্ঠিত হইলেন।—স্মিথ অনেকক্ষণ পরে বেলা কাটাইয়া গৃহে ফিরিল।

 মিঃ ব্লেক জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু সন্ধান করিতে পারিয়াছ কি?”

 স্মিথ বলিল, “না মহাশয়, লোকটা ভারি চালাক; সে আমার মতলব টের পাইয়া একখানি গাড়ীতে উঠিয়া চম্পট দিল! আমি তাহার অনুসরণ করিয়াছিলাম বটে, কিন্তু গ্রাণ্ডরোডে একটা ভিড়ের সম্মুখে আসিয়া সে হঠাৎ গাড়ী হইতে নামিয়া কোথায় যে সরিয়া পড়িল, ভিড় ঠেলিয়া আমি আর তাহার অনুসরণ করিতে পারিলাম না।

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “সেজন্য তোমার দুঃখিত হইবার কারণ নাই, আমি তাহার চোখে ধূলা দিয়াছি, সে-ও তোমার চোখে ধূলি দিয়াছে।—এখন কথা শোন, আমি তোমার উপর একটি বড় গুরুতর কার্যের ভার দিব। আমার নিজের যাহা করা উচিত ছিল, তোমাকেই তাহা করিতে হইবে।”

 স্মিথ কুষ্টিত ভাবে বলিল, “আমাকে কি করিতে হইবে।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “তোমাকে অবিলম্বে সাল্‌ভেরিটায় যাত্রা করিতে হইবে। তুমি সেখানে একাকী যাইবে।”

 স্মিথ বলিল, “আপনি আমাকে এত অধিক কাজের লোক ভাবিতেছেন—ইহা আমার পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয়। আপনার কথা শুনিয়া আমার বড় আনন্দ হইল। আপনি আমাকে যে আদেশ করিবেন, প্রাণপণে তাহা পান করিব।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “আমি তাহা জানি; জানি ঘলিয়াই তোমাকে সেখানে পাঠাইতেছি। তুমি জাহাজে উঠিয়া বিশেষ সাবধানে থাকিবে, মুহূর্তের জন্যও অসতর্ক হইবে না; কেহ তোমার উপর নজর রাখিয়াছে কি না লক্ষ্য করিবে। আজ যে লোকটা আমার অনুসরণ করিয়াছিল, আমার বিশ্বাস, সে সিনর মেন্‌ডোজার উপর দৃষ্টি রাখিয়াছে। বোধ হয় তাহার সন্দেহ হইয়াছে, সিনর মেন্‌ডোজা এই ব্যাপারের তদন্তভার আমাকে দিবার জন্যই এখানে আসিয়া। ছিলেন। সে নিশ্চয়ই প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের শত্রুপক্ষের লোক। ব্যাপার দেখিয়া মনে হইতেছে ইংলণ্ডেও তাহাদের দল আছে; তাহারা সিনর মেডোজার গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছে, তিনি কি করিতেছেন না করিতেছেন তাহার সন্ধান লুইতেছে। আমরা যাহাই করি, তাহারা যে কোনও উপায়ে তাহার সন্ধান লইরেও সেই জন্যই আমাদিগকে যথাসাধ্য সাবধান হইয়া চলিতে হইবে।”

 স্মিথ বলিল, “আপনার উপদেশ আমার স্মরণ থাকিবে, আপনি আমাকে কবে সাল্‌ভেরিটায় যাইতে বলেন?”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “কালই; কাল প্রভাতে তোমাকে এখান। হতে রওনা হইতে হইবে। আমি তোমার জন্য জাহাজের টিকিট কিনিয়া আনিয়াছি। তোমাকে যে জাহাজে যাইতে হইবে, তাহার “ন “ওরিনকো"। ‘অরিনকো’ কাল বেলা দশটার সময় বন্দর ত্যাগ করিবে। আমার মনে হইতেছে কাল সকালে না গিয়া যদি আজ রাত্রেই তুমি জাহাজে উঠ, তাহা হইলে বাহিরের কোনও লোক তোমার সন্ধান পাইবে না; আজ রাত্রেই যাওয়া ভাল। এখন তোমাকে কি করিতে হইবে মন দিয়া শোন।”

 মিঃ ব্লেক কয়েক বার চুরুট টানিয়া বলিলেন, “তুমি সাল্‌ভেরিটায় উপস্থিত হইয়া সিনর মার্টিনার সহিত সাক্ষাৎ করিবে, এবং তাঁহার নামে আমি যে পত্র দিব, তাহা তাঁহাকে দিবে। সিনর মার্টিনা এহন অস্থায়ীভাবে সেখানকার প্রেসিডেণ্টের পদে নিযুক্ত আছেন। তিনি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের বিরুদ্ধ দলের লোেক, কিন্তু সেজন্য তোমার। কোন অসুবিধা হইবে না; কারণ, তুমি কি উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়াছ, তাহা তিনি জানিতে পারিবেন না। কেবল তাঁহাকে কেন, সেখানে কোনও লোককে তোমার প্রকৃত উদ্দেশ্য জানিতে দিবে না। কিছু দিন পূর্ব্বে আমি যখন পোর্টো কষ্টায় গিয়াছিলাম, সেই সময় সিনর মার্টিনার কোনও উপকার করিয়াছিলাম, সে কথা তিনি এত শীঘ্র ভুলিয়া যান নাই; সূতরাং তিনি আমার পত্র পাইলে নিশ্চয়ই সাধ্যানুসারে তোমাকে সাহায্য করিবেন। তাঁহার ন্যায় ক্ষমতাশালী পদস্থ লোকের সাহায্যে তোমার অনেক কাজে র সুবিধা হইবে; অনেক কাজ সহজ হইবে। তুমি যাহাতে কোনও অসুবিধায় না পড়, এইজন্যই চিঠি দিতেছি।

 সাল্‌ভেরিটার রাজধানী পোর্টো কষ্টায় এখন খুব গণ্ডগোেল চলিতেছে, তাহা সেখানে উপস্থিত হইলেই দেখিতে পাইবে। সেখানে এখন ইচ্ছামত সকল স্থানে যাইতে পারিবে না, পদে পদে বাধা পাইবে; এ অবস্থায় সিনর মার্টিনা যদি তোমার সায় থাকেন, তাহা হইলে হঠাৎ কেহ তোমার কোনও কাজে বাধা দিতে সাহস করিবে না।

 “সিনর মেন্‌ডোজা বিশ্বাস—সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের আদিম অধিবাসীরা টাকাগুলা লুঠ করিয়া মিঃ পিয়ারসনকে বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছে, এবং সাল্‌ভেরিটার পাহাড়ে কোথাও বন্দী করিয়া রাখিয়াছে। হয় ত ইহা সত্য, কিন্তু মিঃ পিয়ারসনের কোনও শত্রুদল যে এই কার্য্য করে নাই, তাহাই বা কে বলিবে? এই দুইটি অনুমানের কোনও একটি সত্য হইতে পারে।

 “যদি শেষোক্ত অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে স্থানীয় জেলেটা পোর্টো কষ্টার ১৫ মাইল দূরে সমুদ্র-বক্ষে যে জাহাজখানা দেখিয়াছিল, সেই জাহাজখানি কোন্ দেশের জাহাজ, কোন্‌ দিকে তাহা গিয়াছে, তাহার সন্ধান লওয়ার আবশ্যক। সংবাদপত্রে জাহাজ সমুহের অবস্থানের যে তালিকা প্রকাশিত হয়, আমি সেই তালিকা খুঁজিয়া দেখিয়াছি; জানিতে পারিয়াছি, সেই সময় পাঁচ দিনের মধ্যে কোনও জাহাজ সাল্‌ভেরিটার কোনও বন্দর ত্যাগ করে নাই।

 “এই উভয় প্রকার অনুমান ভিন্ন আরও একটি অনুমান অসঙ্গত মনে হয় না, হয় ত প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনই অপরাধী; টাকাগুলি, লইয়া তিনি কৌশলে চম্পট দিয়াছেন। এই অনুমান সত্য হইলে অন্য দুইটি অনুমান মিথ্যা, সন্দেহ নাই। কিন্তু অবস্থা বিবেচনায় প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে আমি অপরাধী মনে করিতে পারিতেছি না।

 “সাল্‌ভেরিটায় উপস্থিত হইয়া তোমাকে যাহা যাহা করিতে হইবে সক্ষেপে তাহা বলিলাম;—সমুদ্রতীরে গিয়া জেলে যে জাহাজখানি ঘটনার দিন শেষ-রাত্রে দেখিতে পাইয়াছিল, তাহার সন্ধান লইবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিবে।

 স্মিথ বলিল, “আপনার আদেশ সাধ্যানুসারে পালন করিব, কিন্তু আপনি এখন কি করবেন? আপনি কি এই তদন্তে হস্তক্ষেপ করিবেন না?”  মিঃ ব্লেক বলিলেন, “তুমি কত দূর কি করিতে পার তাহাই তা দেখি, তাহার পর প্রয়োজন হইলে আমি কাজে হাত দিব। এত বড় গুরুতর কার্য্যে তোমাকে একাকী পাঠাইতে আমার মন সরিতেছে।; কিন্তু উপায় নাই, আপাততঃ আমাকে লণ্ডনে থাকিতেই হইবে।”

 স্মিথ বলিল, “আমার জন্য আপনি চিন্তা করিবেন না, আমি খুব সতর্ক থাকিব। আমাকে বোধ হয় ছদ্মবেশে যাইতে হইবে; আমি কোন্ ছদ্মবেশ গ্রহণ করিব?”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “তুমি দেশ-ভ্রমণকারীর ছদ্মবেশে যাইবে। সকলের যেন ধারণ হয় তুমি কোনও ধনাঢ্যের সন্তান, দেশ ভ্রমণে বাহির হইয়াছ! এজন্য তোমার হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকা আবশ্যক; যত টাকার প্রয়োজন, তুমি আমার নিকট পাইবে। তুমি এখানেই। তোমার সংবাদাদি পাঠাইবে; কিন্তু ইতিমধ্যে যদি আমাকে দেশান্তরে যাইতে হয়, তাহা হইলে সিনর মেন্‌ডোজার নিকট আমি একখানি গালামোহর-করা পত্র রাখিয়া যাইব; তুমি দেশে ফিরিয়া তাঁহার নিকট হইতে সেইপত্র লইবে। সেই পত্রে আমার অন্যান্য উপদেশ জানিতে পারিবে। এখন আমার হাতে অনেক কাজ আছে; তুমি যাত্রা করিবার পূর্ব্বে, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। সে সময় তোমাকে আরও দুই চারিটি কথা বলিয়া দিব।”

 স্মিথ প্রভুর নিকট বিদায় লইয়া যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত হইল।

   *   *   *   *   *

 'ওরিনকো’ টিল্‌বারির বন্দরে নঙ্গর করিয়াছিল। স্মিথ উৎকৃষ্ট পরিচ্ছদে সজ্জিত হইয়া রাত্রি দশটার সময় জাহাজ উঠিল; বেকার ষ্ট্রীটে বাড়ী হইতে যাইবার সময় সে চারিদিকে লক্ষ্য করিয়াছিল, কিন্তু কেহ তাহার অনুসরণ করিয়াছে বলিয়া বোধ হইল না।—সে কতকটা নিশ্চিন্ত হইল।

 জাহাজে উঠিয়া স্মিথ তাহার কেবিনে প্রবেশ করিল। সে স্থির করিল, জাহাজ না ছাড়িলে, আর সে কেবিন হইতে বাহির হইবে।—যথাসময়ে জাহাজ ছাড়িয়া দিল।

 জাহাজ সাগরে পড়িলে স্মিথ কেবিন হইতে বাহির হইল। “ওরিনকে। তেমন বড় জাহাজ নহে, তাহাতে আরোহীর সংখ্যাও অধিক ছিল না; বিশেষতঃ সময়টি দেশ-ভ্রমণেরও তেমন উপযোগী নহে বলিয়া অধিক লোক তখন বিদেশ-ভ্রমণে যাত্রা করে নাই, আর সাল্‌ভেরিটা দেশ ভ্রমণের তেমন উপযোগীনও নহে।

 এই জাহাজে একজন কাফি কর সপরিবারে তাঁহার কৃষিক্ষেত্রে যাইতেছিলেন; তাঁহার দুইটি পুত্র সঙ্গে ছিল, তাহারা স্মিথের প্রায় সমবয়স্ক। এতভিন্ন জাহাজে একটি প্রৌঢ়া ধর্ম্ম-প্রচারিকা ও এক জন প্রৌঢ় পাদরী ছিলেন; তাহারা বিদেশে ধর্ম্মপ্রচার করিতে যাইতেছিলেন। এই কয়েক জন ভিন্ন ‘ওরিনকো’ জাহাজে উল্লেখ যোগ্য যাত্রী আর কেহ ছিল না।—জাহাজে সদাগরী পণ্য দ্রব্যই অধিক ছিল।

 স্মিথ অল্প সময়ের মধ্যেই কাফি-করের পুভ্রদ্বজের সহিত ভাব করিয়া লইল। জাহাজের কাপ্তেন ও অন্যান্য কর্ম্মচারীরা বেশ ভদ্রলোক। স্মিথের সহিত তাঁহাদের সকলেরই বন্ধুত্ব হইল। স্মিথ ভাবিল, সমুদ্রপথে তাহার দিন বেশ আমোদই কাটিবে।

 দ্বিতীয় দিন কাফি-করের পুত্রদ্বয় জাহাজের উপর খেলার আয়োজন করিয়া লইল; স্মিথ সানন্দে তাহাদের খেলায় যোগদান করিল। ক্ষুদ্র জাহাজখানি সেই সীমাহীন সমুদ্রবক্ষে গগনবিহারী শুভ্রপক্ষ বিহঙ্গের ন্যায় দ্রুত বেগে লক্ষ্য পথে অগ্রসর হইতেছিল; অকুল সমুদ্রের কোনও দিকে কূল দেখা যাইতেছিল না।

 সন্ধ্যার পূর্ব্বে অল্প মেঘ করিয়া বৃষ্টি অসিল। ঝড় ছিল না, কেবল। বৃষ্টি। অত্যন্ত শীত বোধ হওয়ার আরোহীরা ডেক পরিত্যাগ পূর্ব্বক কেবিনে আশ্রয় লইলেন।

 স্মিথ কিছু কাল কেবিনে ছিল, কিন্তু সেখানে অত্যন্ত গরম বোধ হওয়ায় সে ‘ম্যাকিন্‌টোসে’ সর্বাঙ্গ আবৃত করিয়া টুপিটা মাথায় দিয়া ডেকের দিকে চলিল।

 ডেকের পশ্চাদ্ভাগে আসিয়া স্মিথ রেলিংএর ধারে গিয়া দাঁড়াইল; তখন সেখানে ঝুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল। বৃষ্টিতে ভিজিয়া সে বড় আরাম বোধ করিল। স্থূল ‘ম্যাকিন্‌টোসে’ তাহার সর্ব্বাঙ্গ আবৃত ছিল, বৃষ্টিধারা তাহার অঙ্গ স্পর্শ করিতে পারিল না; কিন্তু ম্যাকিন্‌টোসের উপর বৃষ্টির বর্ষণ তাহার বড় প্রীতিকর বোধ হইতে লাগিল।

 সে সময় ডেকে অন্য লোক ছিল না; স্মিথ রেলিংএর ধারে দাঁড়াইয়া মেঘাবৃত অন্ধকার আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। অন্ধকারে আকাশ ও সমুদ্র পরস্পরের আলিঙ্গন-পাশে আবদ্ধ। কেবল জলের ঝুপ্‌ ঝপ্‌ শব্দ, আর ফেনোর্ম্মিমুখর মহাসমুদ্রে সেই ক্ষুদ্র জাহাজের অশ্রান্ত গতি। স্মিথ হঠাৎ মাথা তুলিয়া পশ্চাতে ফিরিয় চাহিল; তাহার মনে হইল, কেহ নিঃশব্দ পদসঞ্চারে তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে।

 ডেকের অপরিস্ফুট আলোকে স্মিথ আগন্তুককে চিনিতে পারিল। আগন্তুক পূর্বোক্ত পাদরীপুঙ্গব। পাদরীকে দেখিয়া স্মিথ কয়েক পদ সরিয়া গিয়া হাস্য মুখে তাহাকে অভিবাদন করিল।

 পাদবী স্মিথকে প্রত্যাভিবাদন করিয়া বলিল, “আঃ, আজ কি দুর্যোগের রাত্রি! কিন্তু এমন রাত্রিই আমার বড় ভাল লাগে। এরূপ ঝড় বৃষ্টি অন্ধকার, উর্দ্ধে ঐ অনন্ত আকাশে দিগন্তব্যাপী মেঘের সঞ্চালন, আর নিয়ে এই অনন্ত সমুদ্রে ঝটিকাতাড়িত পর্ব্বতপ্রমাণ উচ্চ বিরাট তরঙ্গরাশির ভীষণ তাণ্ডব;—প্রকৃতই উপভোগ্য। ইহা প্রভুর বিচিত্র লীলাই স্মরণ করাইয়া দেয়। লীলাময়ের ইচ্ছায় কি না হয়?—এমন। স্থির শান্ত সমুদ্র, এমন তপন কিরণানুরঞ্জিত নির্ম্মল নীল আকাশ—ঘণ্টা দুইএর মধ্যেই কি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করিয়াছে! কিন্তু আমি ইহাতে ভয় পাই না, প্রভুর প্রকট লীলাই দেখিতে পাই। তুমিও কি এই দৃশ্য ভালবাস?”

 স্মিথ সহাস্যে বলিল,” প্রভুর প্রকট লীলা যে কেবল ধর্ম্মপ্রচারকদের ভাল লাগিবে, আর আমার মত পাষণ্ডের ভাল লাগিবে না, প্রভুর বোধ হয় এরূপ অভিপ্রায় নহে। সত্যই সমুদ্রবক্ষে এই প্রকার ঝড় জল, মেঘ বিদ্যুৎ আমার বড়ই ভাল লাগে; জাহাজে দাঁড়াইয়া মনে হয় আমি যেন মায়ের কোলে দুলিতেছি।”।

 উভয়ে কথা কহিতে কহিতে জাহাজের একেবারে কিনারায় রেলিংএর ধারে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। পাদরীপুঙ্গব হঠাৎ দুই হাত প্রসারিত করিয়া স্মিথের কণ্ঠনালী সবেগে চাপিয়া ধরিল!-ধর্ম্মধ্বজী ভণ্ড পাদরীর কাজ দেখিয়া স্মিথ স্তম্ভিত হইল; কিন্তু তাহার আর্ত্তনাদ কারবার শক্তি রহিল না, পাদরী, তাহার কণ্ঠরোধ করিয়াছিল। তাহার শ্বাসরুদ্ধ হইল, চক্ষু দু’টি যেন অক্ষিকোটর হইতে ঠেলিয়া বাহির হইবার উপক্রম করিল! তাহার মাথার ভিতর ঝিম্ ঝিম্‌ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল, তাহাতে বৃষ্টির ঝম ঝম্ শব্দ, ঝটিকার অশ্রান্ত গর্জ্জন ও সমুদ্র-তরঙ্গের অবিরাম কল্লোল-ধ্বনি ডুবিয়া গেল।

 সেই সকল মিশ্র ধ্বনি ডুবাইয়া পাদরী হুঙ্কারধ্বনি করিল, “তুই এই রকম সমুদ্র, এই রকম ঝড় বৃষ্টি ভালবাসি? মনে হয় তুই মায়ের কোলে শুইয়া দুলিতেছিস্‌!—তোর মায়ের কোলে শুইয়া দুলিবার সুবিধা করিয়া দিতেছি।”—পাদরী স্মিথকে জড়াইয়া ধরিয়া শূন্যে তুলিল, তাহার পর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার চারি দ্দিকে চাহিয়া রেলিং ডিঙ্গাইয়া তাহাকে ঝু্‌প্‌ করিয়া সমুদ্রবক্ষে নিক্ষেপ করিল! স্মিথ সমুদ্রে, নিক্ষিপ্ত হইবার পূর্ব্বে পাদরীর অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া তাহার কবল হইতে মুক্তি লাভের চেষ্টা করিয়াছিল; কিন্তু ব্যাঘ্র-কবলিত ছাগশিশুর চেষ্টার ন্যায় তাহার চেষ্টা বিফল হইয়াছিল।—সে জলে পড়িবার সময় উভয় হস্ত প্রসারিত করিয়াছিল, রেলিংএর পার্শ্বে লৌহদণ্ডে একটি ‘লাইফ বেল্ট’ ঝুলিতেছিল, স্মিথ তাহা সবলে আঁকড়াইয়া ধরিলে, প্রবল আকর্ষণে লাইফ বেল্টটা স্মিথের হাতে খুলিয়া আসিল।

 স্মিথ উদ্দাম তরুঙ্গসঙ্কুল অন্ধকারপূর্ণ সমুদ্রে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতে লাগিল; সমুদ্রের লবণাক্ত শীতল জল তাহার নাকে-মুখে প্রবেশ করিল। চক্ষু ভয়ানক জ্বালা করিতে লাগিল। নিশ্বাস ফেলিতে কষ্ট হইল। ক্রমে তাহার সকল চিন্তার অবসান হইল। সঘন মেঘগর্জ্জনে ও সমুদ্রের কল কল্লোলে সে মৃত্যুর অট্টহাস্য শুনিতে পাইল।

 জাহাজের অন্য কোন লোক এই লোমহর্ষণ কাণ্ডের কথা জানিতে পারিল না। জাহাজ ঝটিকান্দোলিত সমুদ্র-বক্ষ ভেদ করিয়া সবেগে গন্তব্য পথে অগ্রসর হইল।