রূপসী বোম্বেটে/প্রথম খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ


পূর্ব্বোক্ত ঘটনার দিন ভিন্ন অন্য কোনও দিন জাহাজের উপর মিঃ ব্লেকের শান্তির ব্যাঘাত হয় নাই, দিন গুলি বেশ আমোদেই অতিবাহিত হইয়াছিল। জাহাজের কাপ্তেন ও তাহার সহযোগী কর্ম্মচারীগণের সৌজন্যে ও শিষ্টাচারে তিনি অত্যন্ত প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন। জাহাজের কাপ্তেন হইতে বাবুর্চ্চিখানার খানসামা পর্যন্ত তাঁহার এমন অনুগত হইয়া উঠিয়াছিল, তাঁহার সন্তোষ সাধনের জন্য তাহারা সকলই করিতে প্রস্তুত ছিল। দীর্ঘকাল জাহাজে বাস করায় মিঃ ব্লেকের স্বাস্থ্যের যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। এমন বিশ্রামসুখ তিনি দীর্ঘকাল লাভ করিতে পারেন নাই।

 মিঃ ব্লেকের জাহাজ সাল্‌ভেরিটার সন্নিকটবর্ত্তী হইলে তিনি কাপ্তেন পেণ্টল্যাণ্ডকে অনুরোধ করিলেন, জাহাজখানি যেন দিবাভাগে সাল্‌ভেরিটার বন্দরে লইয়া যাওয়া না হয়, সন্ধ্যা-সমাগমের পূর্ব্ব পর্যন্ত তাহা দূরে—সমুদ্রবক্ষে বিচরণ করিবে। অধিক রাত্রে জাহাজখানি সমুদ্রতটে কোনও নির্জ্জনে স্থানে নঙ্গর করিবে। মিঃ ব্লেক সেখান হইতে একখানি নৌকা লইয়া তীরে উঠিবেন; তিনি তীরে উঠিবামাত্র জাহাজ পুনর্ব্বার দূরে লইয়া যাইতে হইবে। এক সপ্তাহ পর্য্যন্ত দূরে দূরে অবস্থিতি করিয়া সপ্তাহান্তে জাহাজধানি পুনর্ব্বার অন্যের অলক্ষ্যে সমুদ্রতটে আনীত হইবে; এবং তিনি যেখানে অবতরণ করিবেন, জাহাজের নৌকা সেই স্থানে তাঁহাকে লইতে যাইবে। যদি তিনি সেখানে প্রত্যাগমন করেন, তাহা হইলে নৌকায় উঠিয়া জাহাজে যাইবেন; যদি নৌকার মাঝি তাঁহাকে দেখিতে না পায়, তাহা হইলে নৌকা লইয়া চলিয়া যাইবে,এবং জাহাজখানিকে তিন দিনর জন্য পুনর্ব্বার দূরে লইয়া যাইতে হইবে। —এই তিন দিন পরে তিনি নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট স্থলে জাহাজের প্রতীক্ষা করিবেন।

 এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া মিঃ ব্লেক যথাসময়ে জাহাজ হইতে তীরে অবতরণ করিলেন; জাহাজ হইতে নামিবার সময় তিনি নূতন ছদ্মবেশ ধারণ করিলেন।

 নাবিকের জরাজীর্ণ ছদ্মবেশে তিনি যে স্থানে অবতরণ করিলেন, সেই স্থানটি সাল্‌ভেরিটার রাজধানী পোর্টো কষ্টা হইতে সাত মাইল দূরে অবস্থিত। মিঃ ব্লেক নৈশ অন্ধকারে দ্রুত রাজধানীর দিকে অগ্রসর হইলেন।

 এইরূপ সাবধানতা অবলম্বন করিয়া মিঃ ব্লেক মনে করিয়াছিলেন করিয়াছিলেন জাহাজের গতিবিধির প্রতি কেহ লক্ষ্য করিবে না, তিনি যে জাহাজ হইতে নামিয়াছেন, তাহাও কেহ বুঝিতে পারিবে না; কিন্তু ইহা তাঁহার ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, কর্সেয়ার জাহাজ গোপনে সমুদ্রতটের নিকটে অল্পক্ষণের জন্য নঙ্গর করিলেও তাহা একজনের দৃষ্টি অতিক্রম করিতে পারে নাই। সেই ব্যক্তি নিঃশব্দে তাঁহার অনুসরণ করিতেছিল।

 মিঃ ব্লেক জাহাজ হইতে নামিবার সময় টাইগারকে সঙ্গে লইয়া যান নাই; যদি যাইতেন, তাহা হইলে তাঁহার অনুসরণকারী, টাইগারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অতিক্রম করিতে পারিত না। টাইগার সঙ্গে না থাকায় মিঃ ব্লেক তাঁহার অনুসরণকারীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রহিলেন।  রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া মিঃ ব্লেক একটি দরিদ্র পল্লীতে প্রবেশ করিলেন। সেই পল্লীর অধিবাসীগণ সাধারণতঃ দুশ্চরিত্র; তাহারা অসৎ উপায়ে অর্থোপার্জ্জন করিত। এই পল্লীতে তিনি সর্ব্বপ্রথমে একজন স্থানীয় অধিবাসীর সহিত কয়েক মিনিটের জন্য সাক্ষাৎ করিয়া পুনর্ব্বার পথে বাহির হইলেন।

 তখন সাল্‌ভেরিটার অবস্থা কিরূপ, মিঃ ব্লেক তাহা জানিতে পারেন নাই। সাল্‌ভেরিটায় তখনও ঘোর অরাজকতা বর্তমান। পথে চলিতে চলিতে তিনি নিম্ন শ্রেণীর অনেক লোক দেখিতে পাইলেন; কেহ পথে দাঁড়াইয়া মাতলামি করিতেছিল, কেহ বা কাহারও গলায় ছুরী দিয়া কিরূপে তাহার সর্ব্বস্ব অপহরণকরিবে, সেই চেষ্টায় ঘুরিতেছিল।—কোনও দিকে শান্তি বা সুশৃঙ্খলার চিহ্নমাত্র ছিল না।

 সঙ্কীর্ণ গলির দুই পাশে নোংরা জীর্ণ কুটীর;—নাবিকেরা মদ্যপানে উন্মত্তপ্রায় হইয়া দলে দলে সেই পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল;তাহারা পরস্পরকে কুৎসিৎ ভাষায় গালি দিতেছিল, কোলাহল করিতে করিতে এক গৃহ হইতে গৃহান্তরে প্রবেশ করিতেছিল। রাত্রিকালে এমন জঘন্য স্থানে ভ্রমণ করিতে অত্যন্ত সাহসী লোকেরও সাহস হয় না। স্থানীয় কোনও ভদ্রলোক দায়ে পড়িয়াও সেখানে যাইতেন না; অপরিচিত বিদেশী ত দুরৈর কথা?

 মিঃ ব্লেক অত্যন্ত সতর্ক ভাবে চলিয়া অবশেষে একটি সুড়ঙ্গ-পথে প্রবেশ করিলেন। পোর্টো কষ্টায় এরূপ সুড়ঙ্গ-পথ অনেক আছে। মিঃ ব্লেক পূর্বে একাধিক বার পোর্টো কষ্টায় আসিয়াছিলেন, এবং এই সকল সুড়ঙ্গ-পথ তাঁহার কতকটা পরিচিত ছিল।

 মিঃ ব্লেক-দীর্ঘপথ অতিক্রম করিয়া অবশেষে একটি জীর্ণ অট্টালিকার দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। বাড়ীটি দেখিয়া বোধ হয় না যে, সেখানে কেহ বাস করে। অট্টালিকার বহিঃদ্বার রুদ্ধ ছিল; মিঃ ব্লেক সেই দ্বারে মৃদু করাঘাত করিলেন।

 তিন বার আঘাতের পর একজন লোক ভিতর হইতে জিজ্ঞাসা করিল, “দরজায় কে ঘা দিতেছে?”

 মিঃ ব্লেক নিম্নস্বরে বলিলেন, “যাহার ভিতরে যাইবার আবশ্যক?”

 প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি জানেন না সাঙ্কেতিক শব্দ বলিতে না পারিলে এখানে প্রবেশ করিতে দেওয়া হয় না?”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “জানি।”

 প্রশ্নকারী বলিল, “কি শব্দ বলুন।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “টোডোস্‌।”

 প্রশ্নকারী সন্তর্পণে দ্বার খুলিয়া বলিল, “ভিতরে আসুন।”

 মিঃ ব্লেক এই সাঙ্কেতিক শব্দটি কিরূপে জানিতে পারিলেন, তাহা জানিবার জন্য পাঠকের কৌতুহল হইতে পারে।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মিঃ ব্লেক কার্যোপলক্ষে কয়েকবার সাল্‌ভেরিটা-রাজধানী পোর্টো কষ্টায় গমন করিয়াছিলেন; এই জন্য এই স্থানের পথ ঘাট সমস্তই তাঁহার সুপরিজ্ঞাত ছিল। সেই সময় সিনর মার্টিনা (এখন যিনি অস্থায়ী ভাবে এই রাজ্যের কর্তৃত্ব লাভ করিয়াছেন) বিপ্লববাদীগণের অধিনায়ক ছিলেন; সিনর মার্টিনার জীবন এক সময় বিপন্ন হইয়া উঠিলে মিঃ ব্লেকের সাহায্যেই তাঁহার প্রাণরক্ষা হয়। এই জন্য সিনর মার্টিনা মিঃ ব্লেকের নিকট কৃতজ্ঞ ছিলেন।

 কিন্তু মিঃ ব্লেককেও সে সময় অল্প বিপদে পড়তে হয় নাই; তিনি সাল্‌ভেরিটার রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া কার্যসিদ্ধির জন্য ছদ্মবেশে বিদ্রোহী দলে যোগদান করিয়াছিলেন। ভূগর্ভে বিদ্রোহীগণের একটি প্রকাণ্ড আড্ডা ছিল; রাজ-সৈন্যগণ সহসা সেই আড্ডা আক্রমণ করিয়ী বিদ্রোহীদের উপর গুলি বর্ষণ করিতে থাকে। একজন দলপতি মিঃ ব্লেকের সম্মুখে থাকিয়া সৈন্যগুণের আক্রমণ প্রতিহত করিবার চেষ্টা করিতেছিল; একজন রাজ-সৈন্য তাহাকে গুলি করিতে উদ্যত হইলে, মিঃ ব্লেক সেই সৈন্যের প্রাণবধ করিয়া দলপতির প্রাণ রক্ষা করেন। কৃতজ্ঞ দলপতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তাঁহাকে একখানি মূল্যবান হীরক উপহার প্রদান করিয়াছিল। অনন্তর সে মিঃ ব্লেককে সঙ্গে লইয়া সুড়ঙ্গ-পথে আর একটি আড্ডায় পলায়ন করিয়াছিল। এটি সেই আড্ডা। মিঃ ব্লেক, জাহাজ হইতে নামিয়া যাহার সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করছিলেন, সেই ব্যক্তিই সেই দলপতি;—তাহারই নিকট তিনি এই আড্ডায় প্রবেশের সাঙ্কেতিক শব্দটি জানিতে পারেন।

 এই অট্টালিকার বাহ্যিক অবস্থা অতি শোচনীয় হইলেও ভিতরের সাজ-সজ্জা অতি মনোহর। ভিতরের কক্ষ সুন্দর রূপে সজ্জিত, উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত! মিঃ ব্লেক কার্যানুরোধে পূর্ব্বে বিপ্লববাদীগণের গুপ্ত সমিতির সদস্য নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন; সুতরাং এই অট্টালিকায় প্রবেশ করিতে তাঁহার আশঙ্কার কোনও কারণ ছিল না।

 মিঃ ব্লেক কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, কক্ষ-প্রাচীর মূল্যবান চীনাংশুকে আবৃত; মেঝের উপর একখানি স্থূল ও কারুকার্যখচিত পারস্যদেশীয় গালিচা প্রসারিত। মধ্যস্থলে একখানি সুবৃহৎ গোলাকার টেবিল; টেবিলের উপর লোহিত মখমলের আস্তরণ, তাহাতে সোণালী জরির কারুকার্য্য। টেবিলের চারিদিকে গদি-আঁটা সুন্দর সুন্দর চেয়ার; কয়েকটি তাম্রনির্ম্মিত সুবৃহৎ ল্যাম্প দপ্‌ দপ্‌ করিয়া জ্বলিতেছিল, তাহাতে বোধ হইতেছিল কক্ষটি বিদ্যুলোকে উদ্ভাসিত। সেই আলোক প্রাচীর-গাত্রস্থ চাকচিক্যময় চীনাংশুকে প্রতিফলিত হইয়া তাঁহার নয়নের বিভ্রম উৎপাদন করিতে লাগিল।

 সেই কক্ষে একখানি চেয়ারে একটি বৃদ্ধ বসিয়াছিল, তাহায় বর্ণ পীতাভ; তাহাকে দেখিলে দক্ষিণ আমেরিকার লোক বলিয়া মনে হয় না, মনে হয় সে চীন দেশের লোক,—কোনও চীনাম্যানের বংশধর। তাহার পরিধানে পীতবর্ণের জমকালো পরিচ্ছদ। লোকটি একটি সুবৃহৎ গড়গড়ায় ধূমপান করিতেছিল; তাহার চক্ষু দু’টি গোলাকার, ক্ষুদ্র তাহা অক্ষিকোটরে প্রবিষ্ট। মুখ দেখিয়া লোকটিকে সুপণ্ডিত ও তত্ত্বজ্ঞ বলিয়াই বোধ হয়; মুখের ভাব সম্পূর্ণ নির্ব্বিকার।

 মিঃ ব্লেক তাহার সম্মুখে আসিয়া তাহাকে সসম্ভ্রমে অভিবাদন কবিলেন; লোকটি গড়গড়ার নল মুখ হইতে নামাইয়া মিঃ ব্লেককে একখানি চেয়ারে বসিবার জন্য ইঙ্গিত করিল; তাহার পর কাশির মত খন্‌খনে আওয়াজে বলিল, “অনেক কাল পরে তুমি এদেশে আসিয়াছ।”

 মিঃ ব্লেক সবিনয়ে বলিলেন,“হাঁ, সর্ব্বজ্ঞ, আমি পাঁচ বৎসর পরে এদেশে আসিয়াছি।”

 বৃদ্ধ বলিল, “তোমার এখন সময় ভাল, তুমি কাজে হাত দিতেছ তাহাতেই কৃতকার্য্য হইতেছ। শুভগ্রহ তোমার” সকল অকল্যাণ নষ্ট করিতেছে।—তোমার মঙ্গল হউক।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “আমার ক্ষমতা অক্ষমতা আপনার ত অবিদিত নহে।”  বৃদ্ধ বলিল, “এ আর বেশী কথা কি? তুমি বিদেশী ও আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত হইলেও আমি বুঝিয়াছিলাম তোমার গুণ আছে, তুমি নিতান্ত সাধারণ লোক নও; সেই জন্যই আমি তোমাকে আমার শিষ্য-সমাজে প্রবেশের অধিকার দান করিয়াছিলাম। এ পর্য্যন্ত অন্য কোনও বিদেশীকে এরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শন করি নাই। তুমি আমার অনুগ্রহ লাভের অযোগ্য পাত্র নই। তুমি জীবনের প্রত্যেক কার্য্যে যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়াছ, তাহাতে আমি তোমার প্রতি বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি। কিন্তু এবার তুমি বড়ই কঠিন কার্য্যের ভার লইয়া। এদেশে আসিয়াছ।

 মিঃ ব্লেক বিস্ময় দমন করিয়া বলিলেন, “আপনি সর্ব্বজ্ঞ, আমি কি জন্য এদেশে আসিয়াছি, তাহা আপনার অজ্ঞাত নহে।”

 বৃদ্ধ বলিল, “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন নিরুদেশ হইয়াছে, তুমি তাহার সন্ধানে বাহির হইয়াছ।”

 মিঃ ব্লেক সহাস্যে বলিলেন, “আপনার নিকট কোনও কথা গোপন করিয়া ফল নাই, আপনার অনুমান সত্য।”

 বৃদ্ধ বলিল, “তোমার বিনয় প্রশংসনীয়; কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন আসিয়াছ?”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “সর্ব্বজ্ঞকে সে কথাও আবার বলিতে হইবে? আমি জানিতে চাই—”

 বৃদ্ধ বলিল, “প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন সাল্‌ভেরিটায় আছে কি না? তোমার কিরূপ অনুমান?”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “আমার অনুমান তিনি সাল্‌ভেরিটায় নাই। আমার এ অনুমান কি সত্য?”

 বৃদ্ধ বলিল, “হ তুমি যথার্থই অনুমান করিয়াছ; এ রাজ্যে-প্রেসি-, ডেণ্ট পিয়ারসনের সন্ধান পাইবে না। তবে তোমার ভাগ্য প্রসন্ন, তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে, কিন্তু বিলম্বে।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “প্রসিডেণ্ট পিয়ারসন সম্বন্ধে কোনও কথা কি আপনার নিকট জানিতে পারিব না?’

 বৃদ্ধ বলিল, “না বৎস, আমি তাহার সম্বন্ধে তোমাকে কোনও কথা বলিতে পারিব না। সে এখন তাহার পাপের ফলভোগ করিতেছে; সমস্ত গ্রহই এখন তাহার প্রতিকূল। দৈব-নির্ব্বন্ধের প্রতিকূলে কোনও কাজ করি, এরূপ আমার ইচ্ছা নহে। তবে এই মাত্র বলিতে পারি, সেই দূরাচার আমাদের এই সুপবিত্র গুপ্ত মণ্ডলীর বিরুদ্ধাচারী, তাহার ভণ্ডামী প্রকাশিত হইয়া পড়ুক, ইহাই মণ্ডলীর ইচ্ছা; মণ্ডলীর ইচ্ছা পূর্ণ হইবে। যাহা হউক, তুমি যখন আমার অনুগৃহীত, তখন আমি তোমার সঙ্কল্প-সাধনে বাধা দিব না। কিন্তু তোমাকে কোন রূপ সাহায্য করিতে আমি অসমর্থ, তুমি পুরুষকারের সহায়তায় কার্যোদ্ধারের চেষ্টা কর। তবে তোমার মঙ্গলের জন্য ইহাও বলিতেছি পথে অগ্রসর হইলে তোমাকে পদে পদে বিপন্ন হইতে হইবে। আমি তোমার সম্মুখে সাংঘাতিক বিপদ দেখিতেছি; অতএব ক্ষান্ত হও, বৎস, ক্ষান্ত হও। তোমার সম্মুখে পর্ব্বত-প্রমাণ বাধা বর্ত্তমান।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “আপনিই ত বলিলেন, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে, কিন্তু বিলম্বে।”

 “বৃদ্ধ” গম্ভীর ভাবে বলিল, “হাঁ, সে কথা সত্য; কিন্তু বৎস, আমি তোমাকে স্নেহ করি, আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। তুমি কিরূপ ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হইয়াছ—তাহা অনুভব করিয়াই আমি তোমাকে সাবধান করিতেছি। অনর্থক কেন বিপদ-জালে জড়িত হইবে?—দেশে তোমার অনেক কাজ পড়িয়া আছে, তাহাতে প্রবৃত্ত হইলে তোমার স্বদেশের মঙ্গল হইবে; এ বিদেশে কেন অনর্থক খুন হইতে আসিয়াছ?”

 মিঃ ব্লেক উঠিয়া বলিলেন, “আমার দুর্ভাগ্য, এই কঠিন কার্য্যে আমি আপনার সাহায্যে বঞ্চিত হইলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আপনার আশীর্ব্বাদে আমার চেষ্টা বিফল হইবে না। আপনি বলিয়াছেন, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে; ইহাই আমার যথেষ্ট সান্ত্বনা। হয় ত এই চেষ্টায় আমি বিপন্ন হইতে পারি—কিন্তু বিপদকে আমি ভয় করি না। ইচ্ছা করিয়াই ত আমি বিপদসমুদ্রে ঝাঁপ দিয়াছি। কার্য্যোদ্ধার না করিয়া আমি ফিরিব না, ইহাই আমার সঙ্কল্প। এখন আমাকে বিদায় দান করুন।”

 “তোমার মঙ্গল হউক”,—বলিয়া বৃদ্ধ পুনর্ব্বার ধূমপানে মনঃসংযোগ করিল। মিঃ ব্লেক বৃদ্ধকে অভিবাদন করিয়া ক্ষুন্ন মনে অট্টালিকা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

 মিঃ ব্লেক আশা করিয়াছিলেন, বৃদ্ধের নিকট তিনি প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের অন্তর্ধান সম্বন্ধে কোন-না-কোন সংবাদ জানিতে পারিবেন; কিন্তু সে আশা পূর্ণ না হওয়ায় তিনি বড়ই নিরুৎসাহ হইলেন। তিনি সেই স্থান হইতে বাহির হইয়া একটি নির্জ্জন অন্ধকারপূর্ণ সঙ্কীর্ণ গলি দিয়া চলিতে লাগিলেন। পূর্ব্বে যে লোকটি তাঁহার অনুসরণ করিতেছিল, সে কিছু দূরে তাঁহার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়াছিল। মিঃ ব্লেককে ফিরিতে দেখিয়া সে পুনর্ব্বার তাঁহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হই।

 মিঃ ব্লেকের পকেটে একটি পিস্তল ছিল; হঠাৎ তাঁহার বোধ হইল পশ্চাতে তিনি কাহারও পদশব্দ শুনিতে পাইলেন, তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পশ্চাতে চাহিলেন; কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখিতে পাইলেন না। তখন পিস্তলটি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া সাবধানে গন্তব্য পথে অগ্রসর হইলেন।

 মিঃ ব্লেক কিছু দূর অগ্রসর হইতে না হইতে তাঁহার অনুসরণকারী লঘু পদক্ষেপে তাঁহার পশ্চাতে আসিয়া পড়িল, তাহার পদশব্দে মিঃ ব্লেক ফিরিয়া চাহিলেন;—সম্মুখে এক দীর্ঘ মূর্ত্তি দেখিয়া তিনি পকেট হইতে তাড়াতাড়ী পিস্তলটি বাহির করিলেন। ঠিক সেই মুহূর্ত্তে তাঁহার অনুসরণকারী একখানি তীক্ষ্ণধার দীর্ঘ ছুরিকা তাহার স্কন্ধদেশে প্রোথিত করিল!

 মিঃ ব্লেক আর হাত তুলিতে পারিলেন না, তিনি অস্ফুট আর্তনাদ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চেতনা বিলুপ্ত হইল। তাঁহার শোণিতে সেই স্থানের মৃর্ত্তিকা কর্দ্দমিত হইল।

 তাঁহার আততায়ী আর সেখানে দাঁড়াইল না; সে উৎফুল্ল মনে নগরের টেলিগ্রাফ অফিসে উপস্থিত হইল, এবং লণ্ডনে এই টেলিগ্রাম করিল,

 “ওরিনকোর কাজ শেষ। আজ রাত্রে বি-ও ফরসা। সকল বাধা বিঘ্নের অবসান। মালিককে সংবাদ দাও; আর কি করিতে হইবে জানাও।”