রোকেয়া রচনাবলী/মতিচূর (প্রথম খণ্ড)/গৃহ

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

গৃহ

গৃহ বলিলে একটা আরাম বিরামের শান্তিনিকেতন বুঝায় যেখানে দিবাশেষে গৃহী কর্ম্মক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়া বিশ্রাম করিতে পারে। গৃহ গৃহীকে রৌদ্র বৃষ্টি হিম হইতে রক্ষা করে। পশু পক্ষীদেরও গৃহ আছে। তাহারাও স্ব স্ব গৃহে আপনাকে নিরাপদ মনে করে। ইংরাজ কবি মনের আবেগে গাহিয়াছেন:

"Home, sweet home;
There is no place like home.
Sweet sweet home."

 পিপাসা না থাকিলে জল যেমন উপাদেয় বোধ হয় না, সম্ভবতঃ সেইরূপ গৃহ ছাড়িয়া কতকদিন বিদেশে না থাকিলে গৃহসুখ মিষ্ট বোধ হয় না। বিরহ না হইলে মিলনে সুখ নাই। পুরুষেরা যদিও সর্বদা বিদেশে যায় না, তবু সমস্ত দিন বাহিরে সংসারক্ষেত্রে থাকিয়া অপরাহুে গৃহে ফিরিয়া আসিবার জন্য উৎসুক হয়—বাড়ী আসিলে যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাচে।

 আবাস বিশ্লেষণ করিলে দুই অংশ দেখা যায়—এক অংশ আশ্রয়স্থান, অপরাংশ পারিবারিক জীবন (অর্থাৎ Home}। গৃহরচনা স্বাভাবিক; বিহগ বিহগী পরস্পরে মিলিয়া নীড় নির্ম্মাণ করে, শৃগালেও বাসযোগ্য গর্ত্ত প্রস্তুত হয়। ঐ নিলয় ও গর্ত্তকে আলয় বলা যাইতে পারে, কিন্তু তাহা প্রকৃত “গৃহ” নয়। সে যাহা হউক,—পশুদের “গৃহ” আছে কি না এস্থলে তাহা আলোচ্য নয়।  এখন আমাদের গৃহ সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে চাই। আমাদের সামাজিক অবস্থার ৩ দষ্টিপাত করিলে দেখি, অধিকাংশ ভারত নারী গৃহসুখে বঞ্চিত। যাহারা অপরের অধীনে থাকে, অভিভাবকের বাটীকে আপন ভবন মনে করিতে যাহাদের অধিকার নাই, গৃহহাদের নিকট কারাগার তুল্য বোধ হয়। পারিবারিক জীবনে যে সুখী নহে, যে নিজেকে শনিবারের একজন গণ্য (member) বলিয়া মনে করিতে সাহসী নহে, তাহার নিকট গৃহ শান্তিনিকেতন বোধ হইতে পারে না। কুমারী, সধবা, বিধবা—সকল শ্রেণীর অবলার অবস্থাই শোচনীয়। প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি অন্তঃপুরের একটু একটু নমুনা দিতেছি। এরূপে অস্তঃপুরের পর্দা উঠাইয়া ভিতরের দৃশ্য দেখাইলে আমার ভ্রাতৃগণ অত্যন্ত ব্যথিত হইবেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু কি করি—নালীঘায় অস্ত্র চিকিৎসার একান্ত প্রয়োজন! ইহাতে রোগীর অতীব যন্ত্রণা হইলেও তাহা রোগীর সহ্য করা উচিত। উপরের চশ্মাবরণ খানিকটা না কাটিলে ভিতরের ক্ষত দেখাইব কিরূপে? তাই ভ্রাতাদের নিকট অন্তঃপুরের কোন কোন অংশের পর্দা তুলিবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করি।

 আমি ইহা বলি না, যে আমাদের সমাজের গুণ মোটেই নাই। গুণ অনেক আছে, দোষও বিস্তর আছে। মনে করুন, একজনের এক হাত ভাল আছে, অন্য হাতে নালীঘা হইয়াছে। এক হাত ভাল আছে বলিয়া কি অন্য হাতের চিকিৎসা করা উচিত নহে? চিকিৎসা করিতে ইলে রোগের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করা আবশ্যক।

 অদ্য আমরা সমাজ-অঙ্গের ক্ষত স্থলের আলোচনা করিব সমাজের সুস্থ অংশ নিশ্চিন্তু থাকুক। আমাদের সমাজে অনেক সুখী পরিবার আছেন, তাহাদের বিষয় আমাদের আলোচ্য নহে—তাহারা সুখে শান্তিতে ঘুমাইতে থাকুন। আসুন পাঠিকা! আমরা লৌহপ্রাচীরবেষ্টিত অন্তঃপুরের নিভৃত কক্ষগুলি পরিদর্শন করি।

 ১। বলিয়াছি ত কখন বিদেশে না গেলে গৃহ-আগমন সুখ অনুভব করা যায় না। আমরা একবার (বেহারে) জামালপুরের নিকটবর্তী কোন সহরে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। সেখানে আমাদের জনৈক বন্ধুর বাড়ী আছে। সে বাটীর পুরুষের সহিত আমাদের আত্মীয় পুরুষদের বন্ধুত্ব আছে বলিয়া শরাফত[১] উকিলের বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগকে দেখিতে আমাদের আগ্রহ হয়। দেখিলাম, মহিলাকয়টি অতিশয় শান্ত শিষ্ট মিষ্টভাষিণী, যদিও কূপমণ্ডুক! তাহারা আমাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন। সেখানে শরাফতের পত্নী হসিনা, ভগ্নী জমিলা, জমিলার কন্যা ও পুত্রবধূ প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর জমিলাকে যখন আমাদের বাসায় যাইতে অনুরোধ করিলাম, তখন তিনি বলিলেন যে তাহারা কোন কালে বাড়ীর বাহির হন না, ইহাই তাহাদের বংশগৌরব! কখনও ঘোড়ার গাড়ী বা অন্য কোন যানবাহনে আরোহণ করেন শাই। শিবিকা-আরোহণের কথায় “হ” কি “না” বলিয়াছিলেন, তাহা আমার ঠিক মনে নাই। আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, “তবে আপনারা বিবাহ করিয়া শ্বশুরবাড়ী যান কিরূপে? আপনার ভাতৃবধূ আসিলেন কি করিয়া?” জমিলা উত্তর দিলেন, “ইনি আমাদের আত্মীয় কন্যা—এ পাড়ায় কেবল আমাদেরই গোষ্ঠীর বাড়ী পাশাপাশি দেখিবে।” এই বলিয়া তিনি আমাকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গিয়া বলিলেন, “এই আমার কন্যার বাড়ী; এখন আমার বাড়ী চল।” তিনি আমাকে একটা অপ্রশস্তু গলির (ইহার একদিকে ঘরবাড়ী, অন্যদিকে উচ্চ প্রাচীর) ভিতর দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া লইয়া গেলেন। তাঁহার সকলগুলি কক্ষ দেখাইলেন। কক্ষগুলি ‘অসুর্যম্পশ” বলিয়া বোধ হইল। অতঃপর একটি দ্বার খুলিলে দেখিলাম অপরদিকে হসিনার পুত্রবধূ আছে?—জমিলা বলিলেন, “দেখিলে, এই দ্বারের ওপার্শ্বে আমার ভাইএর বাড়ী, এপার্শ্বে আমার বাড়ী। ও কক্ষে বধূ থাকেন বলিয়া এ দ্বারটি বন্ধ রাখি। আমাদের সওয়ারীর দরকার হয় না কেন, তাহা এখন বুঝিলে?” ঐরূপে সকল বাড়ীই প্রদক্ষিণ করা যায়। সমস্ত মহাল্লাটা পর্যটন করা আমার অভিপ্রেত না থাকায় আমরা গৃহতুল্য বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। জমিলা বলিয়াছেন, তিনি শীঘ্রই মক্কা শরীফ যাইবেন,—এ পাপদেশে তাহার আর থাকিবার ইচ্ছা নাই। আমরা আশা করি, তিনি মক্কা শরীফ হইতে ফিরিয়া আসিলে গৃহ—আগমন সুখটা অনুভব করিবেন।

 পাঠিকা কি মনে করেন যে হসিনা বা জমিলা গুহে আছেন? অবশ্য না; কেবল চারি প্রাচীরের ভিতর থাকিলেই গৃহে থাকা হয় না। এদেশে বাসরঘরকে “কোহবর” বলে, কিন্তু “কবর” বলা উচিত!! বাড়ীখানা ত শরাফতের, সেখানে যেমন এক পাল ছাগল আছে, হংস কুকুট আছে, সেইরূপ একদল স্ত্রীলােকও আছেন! অথবা স্ত্রীলােকদের বন্দিনী” বলা যাইতে পারে। যেহেতু তাঁহাদের পারিবারিক জীবন নাই! আপনার নিজের বাড়ীর কথা মনে করুন। তাহা হইলে হসিনার অবস্থা বুঝিবেন॥

 ২। অনেক পরিবারের গৃহিণীদের সম্বন্ধে এরূপ বলা যাইতে পারে—“বাহার মিয়া হত হাজারী, ঘরর্মে বিবি কাহাৎ কি মারী।” অর্থাৎ, বাহিরে ত যথেষ্ট জাকজমক—যেন স্বামী সাতহাজার সেনার অধিনায়ক; আর অন্তঃপুরে গৃহিণী দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িতা!! বাহিরে বৈঠকখানা আছে, আস্তাবল আছে—অনেক কিছু আছে, আর ভিতরে গৃহিণীর নমাজের উপযুক্ত স্থান নাই!

 ৩। এখন আমরা অন্তঃপুরের ক্ষতস্থল দেখাইব। সাধারণতঃ পরিবারের প্রধান পুরুষটি মনে করেন গৃহখানা কেবল “আমার বাটী”—পরিবারস্থ অন্যান্য লােকেরা তাহার আশ্রিত।[২] মালদহে কয়েকবার আমরা একজনের বাটীতে যাতায়াত করিয়াছি। গৃহস্বামী কলিমের স্ত্রীকে আমরা কখনও প্রফুল্লমুখী দেখি নাই। তাঁহার ম্লান মুখখানি নীরবে আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি আকর্ষণ করিত। ইহার কারণ এই—কয় বৎসর অতীত হইল, কলিম স্বীয় ভায়রাভাইয়ের সহিত বিবাদ করিয়াছেন; তাহার ফলে কলিমের পত্নী স্বীয় ভগ্নীর সহিত দেখা করিতে পানি না! তিনি এতটুকু ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারেন না, “আমার ভগ্নী আমার নিকট অবশ্য আসিবেন।” হায়! বাটী যে কলিমের! তিনি যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন, যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন না! আবার ওদিকে ও বাটীখানা সলিমের! সেখানে কলিমের পত্নীর প্রবেশ নিষেধ।

 বলা বাহুল্য কলিমের স্ত্রীর অন্ন, বস্ত্র বা অলঙ্কারের অভাব নাই। বলি, অলঙ্কার কি পিতৃমাতৃহীনা অবলার একমাত্র ভগ্নীর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা জুলাইতে পারে? শুনিলাম, তিনি সপত্নী-কণ্টক হইতেও বিমুক্ত নহেন! এরূপ অবস্থায় তাহার নিকট গৃহ কি শান্তিনিকেতন (sweet home) বলিয়া বোধ হয়? তিনি কি নিভৃতে নীরবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভাবেন না, “আমার মত হতভাগী নিরাশ্রয়া আর নাই।”

 ৪। একস্থলে দুই ভ্রাতায় কলহ হইল—মনে করুন, বড় ভাইটির নাম “হাম”, ছোট ভাইটির নাম “সাম”। ভ্রাতার সহিত বিবাদ করিয়া হাম স্বীয় কন্যাকে বলিলেন, “হামিদা! তুমি যতদিন আমার বাটীতে আছ, ততদিন জোবেদাকে (সামের কন্যা) পত্র লিখিতে পাইবে।” পিতৃ-আদেশ অবশ্যই শিরোধার্য। কিন্তু হামিদা আশৈশব যে পিতৃব্যতনয়াকে ভালবাসিয়াছে, তাহাকে হঠাৎ ভুলিয়া যাওয়া তাহার পক্ষে সহজ নহে। যন্ত্রণায় তাহার হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল।—যে দুইটি বালিকার শৈশবের ধূলাখেলার স্মৃতি উভয়ের জীবনে বিজড়িত রহিয়াছে—দুরে থাকিয়াও যাহারা পত্রসূত্রে একত্র গ্রথিত ছিল, আজ সেই একবৃন্তের কুসুম দুইটিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া হাম গৃহস্বামিত্বের পরিচয় দিলেন! দুইটি অসহায় অক্ষমা বালিকার কোমল হৃদয় দলিত ও চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া গৃহস্বামী স্বীয় ক্ষমতা প্রকাশ করিলেন!! বলা বাহুল্য, জোবেদাও হামিদাকে পত্র লিখিত অক্ষম! যদি তাহারা কোন প্রকারে পরম্পরকে চিঠি পাঠায়—তবে হামিদার পত্র সাম আটক (intercept) করেন, জোবেদার পত্র হামের কবলে পড়িয়া মারা যায়!! বালিকাদ্বয়ের রুদ্ধ-অশু, হৃদয়বিদারী দীর্ঘনিশ্বাস যবনিকার অন্তরালেই বিলীন হয়! শুনা যায়, আইন অনুসারে ১৮ (কি ২২) বর্ষীয়া কন্যার চিঠিপত্র আটক (intercept) করিতে পিতা অধিকারী নহেন। সে আইন কিন্তু অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে পায় না! কবি বেশ বলিয়াছেন:

“তোমরা বসিয়া থাক ধরা প্রান্তভাগে,
শুধু ভালবাসা জান না বাহিরে বিশ্বে
গরজে সংসার”—

তাইত; আইন আছে, থাকুক, তাহাতে হামিদা বা জোবেদার লাভ কি? ঐরূপ কত পত্র দেবর ভাসুর প্রভৃতি কর্তৃক অবরুদ্ধ (intercepted) হয়, কে তাহার সংখ্যা করে? বিধবা ভ্রাতৃবধূটি স্বীয় ভ্রাতা ভগিনীর চিঠিপত্র লইয়া কোনমতে কালক্ষেপ করেন—যদি আশ্রয়দাতা দেবরটি বিরক্ত হন, তবে আর তাঁহার ভ্রাতা ভগ্নীর পত্র পাইবার উপায় নাই! অসহায় অন্তঃপুরিকাদিগকে ঈশ্বর ব্যতীত আর কে সাহায্য করিবে?

 ৫। আমরা রমাসুন্দরীকে অনেকদিন হইতে জানি। তিনি বিধবা; সন্তান সন্ততিও নাই। তাহার স্বামীর প্রভূত সম্পত্তি আছে, দুই চারিটি পাকা বাড়ীও আছে। তাঁহার দেবর এখন সে সকল সম্পত্তির অধীশ্বর। দেবরটি কিন্তু রমাকে একমুঠা অন্ন এবং আশ্রয়দানেও কুণ্ঠিত। আমরা বলিলাম, “ইনি হয়ত দেবর-পত্নীর সহিত কোদল করেন।” এ কথার উত্তরে একজন (যিনি রমাকে ১৪/১৫ বৎসর হইতে জানেন) বলিলেন, “রমা সব করিতে জানে, কেবল কোঁদল জানে না। রমা বেশ জানে, কি করিয়া পরকে আপন করিতে হয়; কেবল আপনাকে পর করিতে জানে না।”

 “এতগুণ সত্ত্বেও দেবরের বাড়ী থাকিতে পান না কেন?”

 “কপালের দোষ!” হায় অসহায়া অবলা! তোমরা নিজের দোষকে “কপালের” দোষ বল বটে, কিন্তু ভুগিবার বেলা তোমরাই স্বকীয় কর্ম্মফল ভুগিতে থাক! তোমাদের দোষ মূর্খতা, অক্ষমতা, দুর্বলতা ইত্যাদি। রমাসুন্দরী বলিলেন, “বেঁচে থাকতে বাধ্য বলে বেঁচে আছি; খেতে হয় বলে খাই—আমাদের সেই সহমরণপ্রথাই বেশ ছিল! গবর্ণমেট সহমরণ প্রথা তুলে দিয়ে বিধার যন্ত্রণা বৃদ্ধি করেছেন।” ঈশ্বর কি রমার কথাগুলি শুনিতে পান না? তিনি কেমন দয়াময়?

 ৬। আমরা একটি রাজবাটী দেখিতে গিয়াছিলাম। অবশ্য রাজার অনুপস্থিতি সময় যাওয়া হইয়াছিল। তিনি উপাধিপ্রাপ্ত রাজা-রাজ্যের বার্ষিক আয় প্রায় ৫০০০০০ টাকা।

 বাড়ীখানি কবি-বণিত অমরাবতীর ন্যায় মনোেহর। বৈঠকখানা বিবিধ মূল্যবান সাজসজ্জায় ঝলমল করিতেছে; এদিকে সেদিকে ৫/৭ খানা রজত-আসন শূন্য হৃদয়ে রাজাকে আহ্বান করিতেছে! এক কোণ হইতে রবির একটু ক্ষীণরশি একটি দর্পণ পড়িয়াছিল; তাহার প্রতিরশ্মি চারিদিকে বেলুরের ঝাড়ে প্রতিভাত হইয়া এক অভিনব আলোকরাজ্য রচনা করিয়া ফেলিয়াছে! এক কক্ষে রাজার রৌপ্যনির্মিত পর্যঙ্কখানা মশারী ও শয্যায় পরিশোভিত হইয়া প্রবাসী রাজার অপেক্ষা করিতেছে। পাঠিকা হয়ত বলিবেন, “খাটখানা রাণী ব্যবহার করেন না কেন?” তাহা হইলে সমাগত লোকেরাও লক্ষ টাকার পর্যঙ্কখানা দেখিতে পাইত না যে! বহির্বাটী পরিদর্শন করিয়া আমরা রাণীর মহলে গেলাম।

 রাণীর ঘর কয়খানাতেও টেবিল, টিপাই, চেয়ার ইত্যাদি সাজসজ্জা আছে। কিন্তু তাহার উপর ধূলার স্তর পড়িয়াছে। রাজা কোন কালে এসব কক্ষে পদার্পণ করেন বলিয়া বোধ হইল। রাণীর শয্যাপার্শ্বে কয়েকখানা বাঙ্গালা পুস্তক এলোমেলোভাবে চুড়ান রহিয়াছে।

 রাণীকে দেখিয়া আমি হতাশ হইলাম। কারণ বৈঠকখানা দেখিয়া আমি রাণীর যেরূপ মূর্ত্তি কল্পনা করিয়াছিলাম, এ মূর্ত্তি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি পরমা সুন্দরী (১৬/১৭ বৎসরের বালিকা—পরিধানে সামান্য লালপেড়ে বিলাতি ধুতি; অলঙ্কার বলিতে হাতে তিন তিন গাছি বেঙ্কুরের চুড়ি, মাথায় রুক্ষ কেশের জটা—অনুমান পনের দিন হইতে তৈলের সহিত চুলগুলির সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখখানি এমনই করুণ ভাবে পূর্ণ যে বাণীকে মূর্তিমতী “বিষাদ” বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে চক্ষু মনের দর্পণ স্বরূপ। রাণীর নয়ন দুটিতে কি কি হৃদয়বিদারক ভাব ছিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অক্ষম।

 রাজা সর্বদা বিদেশে, বেশীর ভাগে কলিকাতায় থাকেন। সেখানে তাহার অপ্সরা, বিদ্যাধরীর অভাব হয় না, এখানে রাণী বেচারী চিরবিরহিণী!! বাড়ীতে দাস দাসী, ঠাকুর দেবতা, পুরোহিত ইত্যাদি সবই আছে; আনন্দ কোলাহলও যথেষ্ট আছে, কেবল রাণীর হৃদয়ে আনন্দ নাই! গৃহখানা তঁহার নিকট কারাগার স্বরূপ বোধ হইতেছে। রাণী যেন একদল দাসীসহ নিন কারাবাসদণ্ডভোগ করিতেছেন!! আমাদের সঙ্গী একটি মহিলা জনান্তিকে বলিলেন, “এমন চমৎকার বাড়ী, আর ঘরে এমন পরী যার, তিনি কি সুখে বিদেশে থাকেন!”

 রাণী বাঙ্গালা বেশ জানেন; তিনি কেবল বই পড়িয়া দুর্বহ সময় কাটান। তিনিমিতভাষিণী, বেশী কিছু বলিলেন না, কিন্তু যে দুই একটি কথা বলিলেন, তাহা অতি চমৎকার। আমাদের একটি বর্ষীয়সী সঙ্গিনী বলিলেন, “তুমি রাজার রাণী, তোমার এ বেশ কেন? এস আমি চুল বেঁধে দিই।” রাণী উত্তর দিলেন, “জানি না কি পাপে রাণী হয়েছি।” ঠিক কথা! অথচ লোকে এই রাণীর পদ কেমন বাঞ্ছনীয় বোধ করে! অন্তঃপুরের ঐ সকল ক্ষতকে নালীঘা না বলিয়া আর কি বলিব? এ রােগের কি ঔষধ ই? বিধবা ত সহমরণ-আকাক্ষা করে; সধবা কি করিবে?

 ৭। “মহম্মদীয় আইন অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্ত্বির উত্তরাধিকারিণী হই “আমাদের বাড়ী”ও হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়, বাড়ীর প্রকৃত কর্ত্তা স্বামী, পুত্র, জামাত, দেবর ইত্যাদি হন। তাহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ীর মালিক। হকত্রীটি ঐ নায়েবের ক্রীড়াপুতুল মাত্র। নায়েব কত্রীকে যাহা বুঝায়, অবােধ নিরক্ষর কত্রী তাহাই বুঝেন।

 গৃহকত্রী মােহসেনা স্বীয় জামাতার সহিত কলহ করিয়া দুই এক দিনের জন্য কোন দূর সম্পর্কীয় দেবর কাসেমের বাড়ী যান। এ বাড়ীখানা মােহসেনার পৈতৃক সম্পত্তি সুতরাং ইহা তাহার একান্ত আপন” বস্তু। কীর একমাত্র দুহিতাও মারা গিয়াছেন; তবু তিনি জামাতাকে (দুই চারিজন দৌহিত্রী ইত্যাদি সহ) বাড়ীতে রাখিয়াছেন। এরূপ স্থলে জামাতা জামালকে। শাশুড়ীর আশ্রিত বলা যাইতে পারে। কিন্তু তামাশা দেখুন, মােহসেনা গৃহে ফিরিয়া আসিলে, দ্বারবান তাঁহাকে জানাইল, এ বাড়ীতে তাহার প্রবেশ নিষেধ। তিনি অত্যন্ত ক্রদ্ধা হইয়া বলিলেন—“কি? আমার বাড়ীতে আমারই প্রবেশ নিষেধ? পর্দা কর, আমি (শিবিকা হইতে নাবি।”

 দ্বারবানপর্দা করিতে পারি না, মালিকের হুকুম নাই।

 কত্রী—কে তাের মালিক? একমাত্র মালিক ত আমি!

 দ্বারবান—বেআদবী মাফ হউক; হুজুর কি আমাকে তাঁহার পয়জার হইতে রক্ষা করিতে পারেন? হুজুর ত পর্দায় থাকেন, আমরা জামাল মিয়াকেই জানি। আপনি মালিক, তাহা ত দুনিয়া জানে; কিন্তু আমার প্রতি দয়া করিয়া আপনি ফিরিয়া যান। আপনি এখানে নামিলে গােলামের উপর জুলুম হবে। হুজুরেরও অপমান হওয়ার সম্ভাবনা।

 যাহা হউক, হুজুর ফিরিয়া গেলেন!! তিনি কাসেমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন কি কোন আইন নাই, যাহার দ্বারা আমার বাড়ী আমি দখল করিতে পারি?” কাসেম বলিলেন, “আছে। আপনি নালিশ করুন, আমরা সাহায্য করিব।” ওদিকে জামাল এই নালিশের বিষয় জানিতে পারিয়া কাসেমের নিকট আসিলেন। সবিনয়ে মিষ্ট ভাষায় কাসেমকে বুঝাইলেন, “আজ আপনি যদি আমার শাশুড়ীর সাহায্য করেন, তবে ত অন্তঃপুরিকাদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। যদি কখন আপনার এরূপ বিপদ ঘটে তবে কেহ আপনার পরিবারের স্ত্রীলােকদের সাহায্য করিবে, আপনি কি তাহা পসন্দ করিবেন? ভাবিয়া দেখুন, এরূপ হওয়া কি ভাল? মিছামিছি শত্রুতা পাতাইবেন কেন?”

 কাসেম অন্তঃপুরে আসিয়া মােহসেনাকে বুঝাইলেন যে, মামলা মােকদ্দমায় অনেক হেঙ্গাম; ওসব গােলমাল না করাই ভাল। অভাগিনী ক্রোধে, অভিমানে নীরবে দগ্ধ হইতে থাকিলেন!! ঐরূপ আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। খদিজা প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, তাহার স্বামী হাশেম দরিদ্র কিন্তু কুলীন বিদ্বান। হাশেম ছলে কৌশলে সমস্ত জমিজমা আত্মসাৎ করিয়া লইলেন; খদিজার হাতে এক পয়সা নাই। খদিজার পৈত্রিক বাড়ীতে বসিয়াই হাশেম আর দুই তিনটা বিবাহ (?) করিয়া তাহাকে সতিনী জ্বালায় দগ্ধ করিতে লাগিলেন! এরূপ না করিলে আর ক্ষমতাশালী পুরুষের বাহাদুরী কি? ইহাতে যদি খদিজা সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করেন, তবে প্রবীণ মহিলাগণ তঁহার হৃদয়ে স্বামীভক্তির অভাব দেখিয়া নিন্দা করেন, কেহ দুই একটা জীর্ণ পুঁথি (মসলামসায়েলের বঙ্গানুবাদ) দেখাইয়া বলেন, “স্বামী মাথা কাটিলে “আহ বলিতে নাই!” কেহ সুরযােগে আবৃত্তি করিলেন:

“নারীর মাের্শেদ[৩] স্বামী সের্তাজ[৪] জানিবে।
মাের্সেদের সম নারী পতিকে ভজিবে!”

 যাহা হউক খদিজার দুঃখে সহানুভূতি করিবে, এমন লােকটি পর্যন্ত নাই! ইহাকে নরকযন্ত্রণা ভিন্ন আর কি বলিব? কোন মৌলভী বক্তৃতা (ওয়াজ) করিতে যাইয়া বলিয়াছেন, “স্ত্রীলােকে বেশী গুণা (দোষ) করে; হযরত মেয়ারাজ গিয়া দেখিয়াছেন নরকে বেশীর ভাগে স্ত্রীলােক শাস্তি পাইতেছে।” আমরা কিন্তু এই পৃথিবীতেই দেখিতেছি-কুলকামিনীরা অসহ্য নরকযন্ত্রণা ভােগ করিতেছেন!

 ৮। পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ হইতে কন্যাকে বঞ্চিত করিবার নিমিত্ত কি কি জঘন্য উপায় অবলম্বন করা হইয়া থাকে, তাহা কে না জানে? কোন ভ্রাতা তাহা মুখ ফুটিয়া বলেন নাবলিলে অবলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হইবে যে![৫] সুতরাং সে শােচনীয় কথা আমাদিগকেই বলিতে হইতেছে। কোন স্থলে আফিংখাের, গাজাখাের, নিরক্ষর, চিররােগী বৃদ্ধ-যে মােকদ্দমা করিয়া জমিদারীর অংশ বাহির করিতে অক্ষম এইরূপ লােককে কন্যাদান করা হয়! অথবা ভগ্নীর দ্বারা বিবাহের পূৰ্বেই লা-দাবী লিখাইয়া লওয়া হয় কিম্বা ভগ্নীদিগকে চিরকুমারী রাখা হয়; এবং ভ্রাতৃবধূ ননদদিগকে দাসীর মত ভাবেন! আর যদি কোন পরিবারে পুত্র মােটেই না থাকে, কেবল ডজন, অর্ধ ডজন কন্যাই থাকে,তবে জ্যেষ্ঠা ভগ্নীর ভাগ্যবান স্বামীটি অবশিষ্ট শ্যালিকা কয়টিকে চিরকমারী রাখিতে চেষ্টা করেন! ইহাই সমাজের নালীঘা!! হায় পিতা মােহাম্মদ (দঃ)! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্ত পিতৃসম্পত্তিতে অধিকারিণী করিয়াছ, কিন্তু তােমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্ব্বনাশ করিতেছে!! আহা! “মহম্মদীয় আইন" পুস্তকের মসি-রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তাহারই। আইন আমাদের ন্যায় নিরক্ষর অবলাদের নহে।

 ৯। নববিধবা সৌদামিনী দুই পুত্র ও এক কন্যাসহ ভ্রাতার আলয়ে আশ্রয় লইয়াছেন। ৯/১০ মাস পরে তাহার (১৫ ও ১২ বৎসরের) পুত্র দুইটি দশ দিনের ভিতর মারা যায়। সৌদামিনীর নিকট ১০০০০ টাকার কোম্পানীর কাগজ ছিল।

 যে সময় বিধবা সৌদামিনী পুত্রশােকে পাগলপ্রায় ছিলেন, সেই সুযােগে (অর্থাৎ বালকদ্বয়ের মৃত্যুর একমাস পরেই) ভ্রাতা নগেন্দ্র ঐ টাকাগুলি র্তাহারই নামে গচ্ছিত রাখিতে ভগ্নীকে অনুরােধ করিলেন। বলিলেন, “স্ত্রীলােকের নামে টাকা জমা থাকলে গােলমাল হ'তে পারে। আমি ত আর তোমার পর নই।” ভগীর মাথা ঠিক ছিল না, নগেন্দ্র যাহা লিখাইলেন তিনি তাহাই লিখিলেন। ভাবিলেন, “অমন চাদ যদি গিয়াছে, তবে আর পোড়ার টাকা থেকে কি হবে? প্রতিভার বিয়ে ত নগেন্দ্র দিবেই। আমি এখন মলে বাচি।” নগেন্দ্র ক্রমে দুই তিনটা কন্যাদায় হইতে মুক্ত হইলেন। কিন্তু প্রতিভার বিবাহের জন্য মোটেই ভাবেন না। তাহার বয়স ১২ বৎসর হইলে সৌদামিনী তাহার বিবাহের জন্য ব্যস্ত হইলেন। তিনি যত তাড়া করেন, নগেন্দ্র ততই বলেন, “বর পাওয়া যায় না!”

 প্রতিভা ১৫ বৎসরের হইল—বিবাহ হইল না। ১০০০০ টাকা দিয়া বর পাওয়া যায় না, একথা কি পাঠিকা বিশ্বাস করেন? প্রতিবেশিনীরা নিন্দা করে, অভিশাপ দেয়, “ছি ছি কেমন মামা!” বলে, হাতে নগেন্দ্রের কি ক্ষতি হয়। পল্লীগ্রামের নিন্দা অপবাদ চপার্শ্বস্থিত শস্যক্ষেত্রেই বিলীন হয়। প্রকাণ্ড পাটক্ষেত্রে বড় বড় শূকর লুক্কায়িত থাকিতে পারে, আর ঐ নিন্দাটুকু লুকাইতে পারিবে না?

 এখন সৌদামিনী দেখিলেন তাঁহার স্বামীর কষ্ট উপার্জিত টাকা দ্বারা নগেন্দ্রের অবস্থা ভাল হইল, কন্যাদের বিবাহ হইল—কেবল তাহারই একমাত্র প্রতিভা কুমারী রহিল!!

 ভগ্নী মানকুমারী বলিয়াছেন:

“কাঁদ তোরা অভাগিনী। আমিও কাদিব,
আর কিছু নাহি পারি, ক’ ফোটা নয়ন বারি
ভগিনী! তোদেরি তরে বিজনে ঢালিব;
যখন দেখিব চেয়ে  অনুঢ়া “প্রাচীনা মেয়ে”
কপালে যোটেনি বিয়ে—তখনি কাঁদিব,
যখন দেখিব বালা   সহিছে সতিনি জ্বালা
তখনি নয়ন জলে বুক ভাসাইব;
সধবা বিধবা প্রায়   পরান্ন মাগিয়া খায়—
দেখিলে কাদিয়া তার যমেরে ডাকিব,
এ তুচ্ছ এ হীন প্রাণ   দিতে পারি বলিদান
তোদেরি কল্যাণে বোন্! কিন্তু কি করিব?
কঁদিতে শকতি আছে, কাঁদিয়া মরিব।”

 আমি কিন্তু তাহার সহিত একমত হইয়া কঁদিবার সুরে সুর মিলাইতে পারিতেছি না। আমার ভগ্নীটি অবশেষে সবখানি শক্তি কেবল “কাঁদিয়া মরিতে ব্যয় করিলেন! বাস! ঐরূপ বিজনে অশ্রু ঢালিয়া ঢালিয়াই ত আমরা এমন অবলা হইয়া পড়িয়াছি।

 আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া ভ্রাতা ভগ্নীগণ হয়ত মনে করিবেন যে আমি কেবল ভ্রাতৃবৃন্দকে নরাকারে পিশাচরূপে অঙ্কিত করিবার জন্যই কলম ধরিয়াছি। তাত্ম নয়। আমি ত কোথাও ভ্রাতাদের প্রতি কটু শব্দ ব্যবহার করি নাই—কাহাকেও পাপিষ্ঠ, পিশাচ, নিষ্ঠুর বলিয়াছি কি? কেবল রমণীহৃদয়ের ক্ষত দেখাইয়াছি। ঐ যে কথায় বলে, “বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়, এক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে-ভগ্নীর দুঃখ বর্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিন্দা হইয়া পড়িয়াছে।

 সুখের বিষয় আমাদের অনেক ভ্রাতা এরূপ আছেন, যাঁহারা স্ত্রীলােকদিগকে যথেষ্ট শাস্তিতে গৃহসুখে রাখেন। কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা ইহাও বলিতে বাধ্য যে অনেক ভ্রাত আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীত্বের পরিচয় দিয়া থাকেন।

 এখন বােধ হয় সুযােগ্য ভ্রাতৃগণ বুঝিবেন যে “এত বড় সংসারে আমরা নিরাশ্রয়া বুলিয়া আমি ভুল করি নাই—ঐ কথার প্রতিবর্ণ সত্য। আমরা যে কোন অবস্থায় থাকি না কেন, অভিভাবকের বাটীতে থাকি। প্রভুদের বাটী যে আমাদিগকে সর্ব্বদাই রৌদ্র, বৃষ্টি, হিম হইতে রক্ষা করে, তাহা নহে। তবু:

 যখন আমাদের চালের উপর খড় থাকে না, দরিদ্রের জীর্ণতম কুটীরের শেষ চালনা ঝানিলে উড়িয়া যায়, টুপটাপ বৃষ্টিধারায় আমরা সমস্ত রাত্রি ভিজিতে থাকি,—চপলাচমকে নয়নে ধাধা লাগে,বনাদে মেদিনী কঁপে, এবং আমাদের বুক কঁপে, প্রতি মুহূর্তে ভাবি, বুঝি বজ্রপাতে মারা যাই-তখনও আমরা অভিভাবকের বাটীতেই থাকি।

 যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধুরূপে প্রাসাদে থাকি, তখনও প্রতুগৃহে থাকি। আবার যখন ঐ প্রাসাদতুল্য ত্রিতল অট্টালিকা ভূমিকম্পে চূর্ণ হয়,—সােপান অতিক্রম করিয়া অবতরণ কালে আমাদের মাথা ভাঙ্গে, হাত পা ভাঙ্গে-রক্তাক্ত কলেবরে হতজ্ঞান প্রায় অবস্থায় গােশালায় গিয়া আশ্রয় লই,—তখনও অভিভাবকের বাটীতে থাকি!!

 অথবা গৃহস্থের বৌ ঋী রূপে প্রকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি; আর যখন চৈত্র মাসে ঘাের অমানিশীথে প্রভুর বাটীতে দুষ্টলােক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয় হয়,—সব জিনিষপত্রসহ ঘরগুলি দাউদাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে,—আমরা একসনে প্রাণটি হাতে করিয়া কোনমতে দৌড়াইয়া গিয়া দূরস্থিত একটা কুলগাছতলে পাঁড়াইয়া কাপিতে থাকি,—তখনও অভিভাবকের বাটীতে থাকি!!! (জানি না, কবরের ভিতরও অভিভাবকের বাটীতে থাকা হয় কি না!!)

 ইংরাজিতে Home বলিলে যাহা বুঝায়, “গৃহ” শব্দ দ্বারা আমি তাহাই বুঝাইতে চাই। উপরে যে রাণী, রমা, হামিদা, জোবেদা প্রভৃতির অবস্থা বলা হইয়াছে, তাহারা কি গৃহসুখ ভােগ করিতেছেন? শারীরিক আরাম ও মানসিক শান্তিনিকেতন যাহা, তাহাই গহ। বিধবা হইলে স্বামীগৃহ একরূপ বাসের অযােগ্য হয়; হতভাগিনী তখন পিতা, ভ্রার শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তাহাতে তাহার যে দশা হয়, সৌদামিনী-চিত্রে বর্ণিত হইয়াছে। একটা হিন্দি প্রবাদ আছে:

“ঘর কি জ্বলি বনমে গেয়ী—বনমে লাগি আগ '
বন বেচারা কেয়া করে,কমর্মে লাগি আগ !”

 অর্থাৎ “গৃহে দগ্ধ হইয়া বনে গেলাম, বনে লাগিল আগুন; বন বেচারা কি করিবে, (আমার কপালেই লাগিয়াছে আগুন!”

 তাই বলি, গৃহ বলিতে আমাদেরই একটি পর্ণকুটীর নাই। প্রাণ-জগতে কোন জন্তুই আমাদের মত নিরাশ্রয়া নহে। সকলেরই গৃহ আছেনাই কেবল আমাদের।[৬]

  1. এ প্রবন্ধে উল্লিখিত ব্যক্তিদের নামগুলি কম্পিত্ন। বর্ণনার সুবিধার নিমিত্ত এরূপ নাম দেওয়া হইল।
  2. কোন বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ কোন ঘটনা আমাদের লক্ষ্য নহে। এদিক ওদিককার সত্য ঘটনাসমূহ হইতে উপকরণ সংগ্রহ করিয়া একটা সাধারুণ চিত্র অঙ্কিত হইল মাত্র। ইহাতে কোন নদীর একধারে নবমুকুলিত আম্রকানন, অন্য তীরে (আমেরিকার নায়েগারা তটস্থিত নীহারাবৃত পত্রহীন তরুরাজি দেখিয়া কেহ চিত্রকরকে আনাড়ী মনে করিবেন না,—যেহেতু নদী, আম্রকানন, তুষারাবত তরু—এ সবই সত্য।
  3. মাের্শেদ-গুরু।
  4. সের্তাজ-সের—তাজ) মাথার মুকুট, অর্থাৎ মুকুটকুল্য শ্রদ্ধাস্পদ।
  5. স্ত্রীলােকদের দুঃখকাহিনীপূর্ণ একটি প্রবন্ধ কোন উর্দু সংবাদপত্রে প্রকাশের নিমিত্ত দেওয়া হইয়াছিল। সম্পাদক তাহা প্রকাশ করিতে সাহসী হন নাই লিখিলেন যে, এরূপ প্রবন্ধ প্রকাশ করিলে সাধারণ পুরুষসমাজ চটিবেন! সুখের বিষয়, বাঙ্গালা কাগজগুলির যথেষ্ট সৎসাহস আছে, তাই রক্ষা! নচেৎ আমাদের দুঃখের কান্না কাঁদিবার উপায়ও থাকিত না!
  6. আমাদের যে সকল ভগ্নী গৃহসুখভােগ করেন,এ সন্দর্ভটি তাহাদের জন্য লিখা হয় নাই- ইহা গৃহহীনাদের জন্য।