রোকেয়া রচনাবলী/মতিচূর (প্রথম খণ্ড)/পিপাসা (মহরম)

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

পিপাসা
(মহরম।)


কাল বলেছিলে প্রিয়। আমারে বিদায়
দিবে, কিন্তু নিলে আজ আপনি বিদায়!

*

দুঃখ শুধু এই ছেড়ে গেলে অভাগায়
ডুবাইয়া চির তরে চির পিপাসায়।
যখন যেদিকে চাই,
কেবলি দেখিতে পাই,
“পিপাসা, পিপাসা” লেখা জ্বলস্তু ভাষায়।
শ্রবণে কে যেন ঐ “পিপাসা” বাজায়।

 প্রাণটা সত্যই নিদারুণ তৃষানলে জ্বলিতেছে। এ জ্বালার শেষ নাই, বিরাম নাই, এ জ্বালা অনন্ত। এ তাপদগ্ধ প্রাণ যে দিকে দৃষ্টিপাত করে, সেই দিকে নিজের হৃদয়ের প্রতিবিম্ব দেখিতে পায় পােড়া চক্ষে আর কিছুই দেখি না। পুষ্পময়ী শস্যশ্যামলা ধরণীর আনন্দময়ী মূর্ত্তি আমি দেখি না। বিশ্ব জগতের মনােরম সৌন্দর্য আমি দেখি না। আমি কি দেখি, শুনিবে? যদি হৃদয়ের ফটোগ্রাফ তােলা যাইত, যদি চিত্রকরের তুলিতে হৃদয়ের প্রতিকৃতি অঙ্কিত করিবার শক্তি থাকিত,—তবে দেখাইতে পারিতাম, এ হৃদয় কেমন! কিন্তু সে উপায় নাই।

 ঐ যে মহরমের নিশান, তাজিয়া প্রভৃতি দেখা যায়,—ঢাকঢোল বাজে, লােকে ছুটাছুটি করে, ইহাই কি মহরম? ইহত কেবল খেলা, চর্ম্মচক্ষে দেখিবার তামাসা। ইহাকে কে বলে মহরম? মহরম তবে কি? কি জানি, ঠিক উত্তর দিতে পারিলাম না। কথাটা ভাবিতেই পারি,ওকথা মনে উদয় হইলেই আমি কেমন হইয়া যাই,—চক্ষে অন্ধকার দেখি, মাথা ঘুরিতে থাকে। সুতরাং বলিতে পারি না—মহরম কি?

 আচ্ছা তাহাই হউক, ঐ নিশান তাজিয়া লইয়া খেলাই হউক; কিন্তু ঐ দৃশ্য কি একটা পুরাতন শােকস্মৃতি জাগাইয়া দেয় না? বায়ু-হিল্লোলে নিশানের কাপড় আন্দোলিত হইলে, তাহাতে কি স্পষ্ট লেখা দেখা যায় না—“পিপাসা, পিপাসা”? উহাতে কি একটা হৃদয়বিদারক শোকস্মৃতি জাগিয়া উঠে না? সকল মানুষই মরে বটে কিন্তু এমন মরণ কাহার হয়?[১]

 একদিন স্বপ্নে দেখিলাম—স্বপ্নে মাত্র যেন সেই কারবালায় গিয়াছি। ভীষণ মরুভূমি তপ্ত বালুকা; চারিদিক ধূ ধূ করিতেছে; সমীরণ হায় হায় বলিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন কাহাকে খুঁজিতেছে! আমি কেবল শুনিতে পাইলাম—“পিপাসা, পিপাসা”! বালুকা কণায় অঙ্কিত যেন “পিপাসা, পিপাসা”! চতুর্দিক চাহিয়া দেখিলাম, সব শূন্য, তাহার ভিতর ‘পিপাসা” মূর্তিমতী হইয়া ভাসিতেছে।

 সে দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর—তথা হইতে দূরে চলিলাম। এখানে যাহা দেখিলাম, তাহা আরও ভীষণ, আরও হৃদয়বিদারক! দেখিলাম মরুভূমি শোণিত-রঞ্জিত![২] রক্তপ্রবাহ বহিতে পারে নাই—যেমন রক্তপাত হইয়াছে, অমনি পিপাসু মরুভূমি তাহা শুযিয়া লইয়াছে। সেই সব রেখায় লেখা—“পিপাসা, পিপাসা”।

 নবীন যুবক আলী আকবর হােসেনের পুত্র যুদ্ধে ক্লান্ত হইয়া পিতার নিকট পিপাসা নাইতে আসিয়া কাতর কণ্ঠে বলিতেছেন “আল-আৎশ! আল-আংশ!!” (পিপাসা, পিপাসা! ঐ দেখ, মহাত্মা হােসেন স্বীয় রসনা পুত্রকে চুষিতে দিলেন, যদি ইহাতে তাহার কিছুমাত্র তৃপ্তি হয়! কিন্তু তৃপ্তি হইবে কি,—সে রসনা যে শুদ্ধ—নিতান্ত শুষ্ক! যেন দিক দিগন্তর হইতে শব্দ আসিল,—“পিপাসা পিপাসা”।

 মহাত্মা হােসেন শিশুপুত্র আলী আসগরকে কোলে লইয়া জল প্রার্থনা করিতেছেন। ৩াহার কথা কে শুনে? তিনি দীন নয়নে আকাশপানে চাহিলেন, “আকাশ মেঘশূন্য লি, নিতান্তই নির্ম্মল! তিনি নিজের কষ্ট,জল পিপাসা অম্লান বদনে সহিতেছেন। পরিজনকে সান্ত্বনা বাক্যে প্রবােধ দিয়াছেন। সকিনা প্রভৃতি বালিকারা জল চাহে না—তাহারা বুঝে, জল দুপ্রাপ্য। কিন্তু আঙ্গর বুঝে না-সে দুগ্ধপোষ্য শিশু, নিতান্ত অজ্ঞান। অনাহারে জলাভাবে মাতার স্তন্য শুকাইয়া গিয়াছে— শিশু পিপাসায় কাতর।

 শহরবানু (হোসেনের স্ত্রী) অনেক যন্ত্রণা নীরবে সহিয়াছেন, আজ আসগরের যাতনা তাহার অসহ্য! তিনি অনেক বিনয় করিয়া হোসেনের কোলে শিশুকে দিয়া জল প্রার্থনা করিতে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন, “আর কেহ জল চাহে না; কেবল এই শিশুকে একটু জল পান করাইয়া আন। শত্রু যেন ইহাকে নিজ হাতে জল পান করায়,জলপাত্রটা যেন তোমার হাতে নাই দেয়!!”

 মহাত্মা হোসেন স্ত্রীর কাতরতা এবং শিশুর দুরবস্থা দেখিয়া জল প্রার্থনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন | কাতরস্বরে বলিলেন, “আমি বিদেশী পথিক, তোমাদের অতিথি, আমার প্রতি যত ইচ্ছা অত্যাচার কর, সহিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু এ শিশু তোমাদের নিকট কোন দোষে দোষী নহে। পিপাসায় ইহার প্রাণ ওষ্ঠাগত একবিন্দু জল দাও! ইহাতে তোমাদের দয়াধর্ম্মের কিছুমাত্র অপব্যয় হইবে না!” শত্রুগণ কহিল, “বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে, শীঘ্র কিছু দিয়া বিদায় কর।”

 বিপক্ষ হইতে শিশুর প্রতি জলের পরিবর্তে তীর বৃষ্টি হইল!!

“পিয়াস লাগিয়া জলদে সাধিনু
বজর পড়িয়া গেল।”

 উপযুক্ত অতিথি-অভ্যর্থনা বটে! হোসেন শরবিদ্ধ আঙ্গরকে তাহার জননীর কোলে দিয়া বলিলেন, “আসগর চিরদিনের জন্য তপ্ত হইয়াছে! আর জ্বল জ্বল বলিয়া দিয়া কাঁদাইবে না! আর বলিবে না ‘পিপাসা, পিপাসা’! এই শেষ!”

 শহরবান কি দেখিতেছেন? কোলে পিপাসু শরবিদ্ধ আসগর, সম্মুখে রুধিরাক্ত কলেবর “শহীদ” (সমরশায়ী) আকবর! অমন চাঁদ কোলে লইয়া ধরণী গরবিণী হইয়াছিল— যে আকবর ক্ষতবিক্ষত হইয়া, পিপাসায় কাতর হইয়া মৃত্যুকালে এক বিন্দু জল পায় নাই। শোণিতধারায় যেন লেখা আছে “পিপাসা, পিপাসা”! শহীদের মুদ্রিত নয়ন দুটি নীরবেই বলে যেন “পিপাসা, পিপাসা!! দৃশ্য ত এইরূপ মর্ম্মভেদী তাহাতে আবার দর্শক জননী:আহা!!

যে ফুল ফুটিত প্রাতে,—নিশীথেই ছিন্ন হল,
শিশিরের পরিবর্তে রুধিরে আপুত হ'ল!

 আরও দেখিলাম,—মহাত্মা হোসেন সমরশায়ী। সমরক্ষেত্রে কেবলই পিপাসী শহীদগণ পড়িয়া আছেন। তাহাদের শুষ্ক কণ্ঠ যেন অস্ফুট ভাষায় বলিতেছে “পিপাসা, পিপাসা”। জয়নব (হোসেনের ভগিনী) মুক্ত কেশে পাগলিনী প্রায় ভ্রাতার নিকট বিদায় চাহিতেছেন। ডাকিয়া, উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিতেছেন,— “ভাই! তোমাকে মরুভূমে ফেলিয়া যাইতেছি! আসিয়াছিলাম তোমার সঙ্গে,—যাইতেছি তোমাকে ছাড়িয়া! আসিয়াছিলাম অনেক রত্নে বিভূষিত হইয়া—যাইতেছি শুন্য হৃদয়ে। তবে এখন শেষ বিদায় দাও! একটি কথা কও, তবে যাই! একটিবার চক্ষু মেলিয়া দেখ—আমাদের দুরবস্থা দেখ, তবে যাই!” জয়নবের দুঃখে সমীরণ হায় হায় বলিল,—দুর দুরান্তরে ঐ হায় হায় শব্দ প্রতিধ্বনিত হইল।

 এখন আর স্বপ্ন নাই—আমি জাগিয়া উঠিয়াছি। দূরে শৃগালের কর্কশ শব্দে শুনিলাম “পিপাসা, পিপাসা”! একি, আমি পাগল হইলাম নাকি? কেবল “পিপাসা দেখি কেন। কেবল “পিপাসা” শুনি কেন?

 আমার প্রিয়তমের সমাধিস্থানে যাইলাম। বনপথ দিয়া যাইতে শুনিলাম, তরুলতা বলে “পিপাসা, পিপাসা”! পত্রের মর্ম্মর শব্দে শুনিলাম “পিপাসা, পিপাসা”। প্রিয়তমের গাের হইতে শব্দ আসিতেছিল—“পিপাসা, পিপাসা”! ইহা অতি অসহ্য! প্রিয়তম মৃত্যুকালে জল পায় নাই—চিকিৎসকের নিষেধ ছিল। সুতরাং পিপাসী মরিয়াছে।

 আহা! এমন ডাক্তারী কে রচনা করিয়াছেন? রােগীর প্রতি (রােগ বিশেষে) জল-নিষেধ ব্যবস্থা কোন হৃদয়হীন পাষাণের বিধান? যখন রােগীকে বাচাইতে না পার, তখন প্রাণ ভরিয়া পিপাসা মিটাইয়া স্ক্রল পান করতে দিও। সে সময় ডাক্তারের উপদেশ শুনিও না। নচেৎ আমারই মত আজীবন পিপাসায় দগ্ধ হইবে।

 কোন রােগী মৃত্যুর পূর্বদিন বলিয়াছিল, “বাবাড্রান! তোমারই সােব্রাহির জল দাও। রােগী জানে, তাহার পিতার সােরাহির জল অবশ্যই শীতল হইবে পিতা তাহার আসন্নকাল জানিয়া স্বহস্তে সােরাহি আনিয়া দিলেন। অন্যান্য মিত্ররূপী শত্রুগণ তাহাকে প্রচুর জল সাধ মিটাইয়া পান করিতে দেয় নাই। ঐ রােগীর আত্ম কি আজ পর্যন্ত কারবালার শহীদদের মত “পিপাসা, পিপাসা” বলিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় না? না; স্বর্গসুখে পিপাসা নাই। পিপাসা—যে বাচিয়া থাকে,তাহারই! অনন্তু শান্তি নিদ্রায় যে নিদ্রিত হইয়াছে, পিপাসা তাহার নহে! পিপাসা—যে পােড়া স্মৃতি লইয়া জাগিয়া থাকে,—তাহারই!!

 কিন্তু কি বলিতে কি বলিতেছি,~~-আমার হৃদয়ানন্দ মৃত্যুর পূর্বদিন গােপনে জননীর নিকট জল চাহিয়াছিল। ডাক্তারের নিষেধ ছিল বলিয়া কেহ তাহাকে জল দিত না। জননী ভয়ে ভয়ে অল্প জল দিয়াছিলেন। মৃত্যুকালে সে তৃষ্ণায় অত্যন্ত কাতর ও অধীর হইয়াছিলহায়! না জানি সে কেমন পিপাসা!

 হৃদয়ানন্দ জানিত, আমি তাহাকে জল দিব না। আমি চিকিৎসকের অন্ধ আজ্ঞাবহ দাস, তাহাকে জল দিব না। তাই সে আমার উপস্থিত থাকা সময় জল চাহিতে সাহস করে নাই! কি মহতী সহিষ্ণুতা! জলের পরিবর্তে চা চাহিল। শীতল জলের পিপাসায় গরম চা!! চা তখনই প্রস্তুত হইয়া আসিল। যে ব্যক্তি চা পান করাইতেছিল, সে চা’র পেয়ালার কড়া ধরিতে পারিতেছিল না—পেয়ালা এত তপ্ত ছিল। আর সেই পিপাসী সে পেয়ালাটি দুই হস্তে (যেন কত আদরের সহিত জড়াইয়া ধরিয়া চা পান করিতে লাগিল!! আহা! না জানি সে কেমন পিপাসা!! অনলরচিত পিপাসা!! কিম্বা গরলরচিত পিপাসা!!! সে সময় হয় ত তাহার শরীরে অনুভব শক্তি ছিল না, নচেৎ অত গরম পেয়ালা ও কোমল হাস্তে সহিবে কেন? আট বৎসরের শিশু—শনীর পুতুল, তাহার হাতে গরম পেয়ালা!—আর সেই তপ্ত চা-স্বাস্থ্য ভাল থাকিলে নিশ্চয় গলায় ফোস্কা হইত। আর ঐ মাখন-গঠিত কচি হাত দুটি জ্বলিয়া গলিয়া যাইত!! সেই চা তাহার শেষ পথ্য—আর কিছু খায় নাই।

 আক্ষেপ এই যে, জল কেন দিলাম না। রোগ সারিবার আশায় জল দিতাম না।—রোগ যদি না সারিল, তবে জল কেন দিলাম না? এই জন্যই ত রাত্রি দিন শুনি,—“পিপাসা, পিপাসা”! ঐ জন্যই ত এ নরকযন্ত্রণা ভোগ করি! আর সেই গরম চা’র পেয়ালা চক্ষের সম্মুখ ঘুরিয়া বেড়ায়, হৃদয়ে আঘাত করে, প্রাণ দগ্ধ করে! চক্ষু মুদ্রিত করিলে দেখি— অন্ধকারে জ্যোতির্ময় অক্ষরে লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”।

 নিশীথ সময়ে গৃহছাদে উঠিলাম। আকাশমণ্ডল পরিষ্কার ছিল কোটী কোটী তারকা ও চন্দ্র হীরক প্রভায় জ্বলিতেছিল। আমার পোড়া চক্ষে দেখিলাম—ঐ তারকা—অক্ষরে লেখা “পিপাসা, পিপাসা”। আমি নিজের পিপাসা লইয়া ব্যস্ত, তাহাতে আবার বিশ্বচরাচর পিপাসা দেখায়—পিপাসা শুনায়। বোধ হয় নিজের পিপাসার প্রতিবিম্ব দেখিতে পাই মাত্র, আর কেহ পিপাসী নহে। অথবা এ বিশ্বজগৎ সত্যই পিপাসু!

 কুসুমকাননে আমি কি দেখিতে পাই? কুসুম হেলিয়া দুলিয়া বলে “পিপাসা, পিপাসা” লতায় পাতায় লেখা “পিপাসা, পিপাসা”! কুসুমের মনোমোহিনী মৃদু হাসি আমি দেখি না। আমি দেখি, কুমুদের সুধাংশু-পিপাসা॥

 বিহগ কুজনে আমি কি শুনিতে পাই? ঐ “পিপাসা, পিপাসা”। ঐ একই শব্দ নানাসুরে নানাৱাগে শুনি,—প্রভাতে ভৈরবী, নিশীথে বেহাগ—কিন্তু কথা একই। চাতক পিপাসায় কাতর হইয়া ডাকে—“ফটিক জল”। কোকিল ডাকিয়া উঠে “কুহু” ঐ কুহুস্বরে শত প্রাণের বেদনা ও হৃদয়ের পিপাসা ঝরে! এ কি, সকলে আমাকে পিপাসার ভাষা শুনায় কেন? আহা! আমি কোথায় যাই? কোথায় যাইলে “পিপাসা” শুনিব না?

 চল হৃদয়, তৃর নদী তীরে যাই,—সেইখানে হয় ত “পিপাসা” নাই। কিন্তু ঐ শুন! স্নিগ্ধসলিলা গঙ্গা কুলকুল স্বরে গাহিতেছে। “পিপাসা, পিপাসা” আপন মনে গাহিয়া বহিয়া যাইতেছে! একি স্বয়ং জল, তোমার আবার পিপাসা কেমন? উত্তর পাইলাম, “সাগরপিপাসা”। আহা! তাই ত, সংসারে তবে সকলেই পিপাসু? হইতে পারে, সাগরের—যাহার চরণে, জাহ্নবি! তুমি আপনার প্রাণ ঢালিতে যাইতেছে, তাহার পিপাসা নাই। তবে দেখা যাউক।

 একদিন সিন্ধুতটে সিক্ত বালুকার উপর বসিয়া সাগরের তরঙ্গ গণনা করিতেছিলাম। ঊর্মিমালা কি যেন যাতনায়, কি যেন বেদনায় ছটফট করিয়া গড়াইয়া গড়াইয়া আছাড়িয়া। পড়িতেছিল। এ অস্থিরতা, এ আকুলতা কিসের জন্য? সবিস্ময়ে সাগরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:

তব ওই সচঞ্চল লহরীমালায়
কিসের বেদনা লেখা?—পিপাসা জানায়।

পিপাসা নিবৃত্ত হয় সলিল—কৃপায়,
বল হে জলধি ! তব পিপাসা কোথায়?

 আবার তাহার গভীর গর্জনে শুনিলাম, “পিপাসা, পিপাসা”! হায়! এই পােড়া পিপাসার জ্বালায় আমি দেশান্তরে পলাইয়া আসিলাম, এখানেও ঐ নিষ্ঠুর কথাই শুনিতে পাই। চক্ষ মুদ্রিত করিলাম—ঐ তরঙ্গে তরঙ্গে আর পিপাসা দেখিতে ইচ্ছা ছিল না। সমুদ্র আবার গম্ভীর গর্জন করিল। এবারও তাহার ভাষা বুঝিলাম,—স্পষ্ট শুনিলাম,—“পিপাসা, পিপাসা”।

 “পিপাসা পিপাসা'—মুখ মানব! জান না এ কিসের পিপাসা? কোথায় শুনিয়াছ সাগরের পিপাসা নাই? এ হৃদয়ের দুর্দান্ত পিপাসা কেমন করিয়া দেখাইব? আমার হৃদয় যত গভীর, পিপাসাও তত প্রবল! এ সংসারে কাহার পিপাসা নাই? পিপাসা পিপাসা—এইটুকু বুঝিতে পার না? ধনীর ধন-পিপাসা, মানীর মান-পিপাসা, সংসারীর সংসার-পিপাসা। নলিনীর তপন-পিপাসা, চকোরীর চন্দ্রিকা-পিপাসা! অনলেরও তীব্র পিপাসা আছে! আহা! এই মােটা কথা বুঝ না? পিপাসা না থাকিলে ব্রহ্মাণ্ড ঘুরিত কি লক্ষ্য করিয়া? আমার হৃদয়ে অনন্ত প্রণয়-পিপাসা,—যতদিন আছি, পিপাসাও থাকিবে! প্রেমিকের প্রেম-পিপাসা, প্রকৃতির ঈশ্বর-পিপাসা! এইটুকু কি বুঝিতে পার না? * * *”

 তাই বটে, এত দিনে বুঝিলাম, আমার হৃদয় কেন সদা হু হু করে, কেন সদা কাতর হয়। এ হৃদয়ের পিপাসা তুচ্ছ বারি পিপাসা নহে। ইহা অনন্ত প্রেম-পিপাসা। ঈশ্বর একমাত্র বাঞ্ছনীয়, আর সকলে পিপাসী-ঐ বাঞ্ছনীয় প্রেমময়ের প্রেম-পিপাসী!!

 আমি তবে বাতুল নহি। আমি যে পিপাসা দেখি, তাহা সত্য— কল্পিত নহে! আমি যে পিপাসা শুনি, তাহাও সত্য-কল্পনা নহে। ঈশ্বর প্রেম, এ বিশ্বজগৎ প্রেম-পিপাসু।

  1. একদা জয়নাল আবদীন (হোসেনের পুত্র) জনৈক কসাইকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছাগল জবেহ করিতে আনিয়াছ, উহাকে কিছু খাওয়াইয়াছ? কসাই উত্তর করিল, “হ্যাঁ, ইহাকে এখনই প্রচুর জলপান করাইয়া আনিলাম!” ইহা শুনিয়া তিনি বলিলেন, “তুমি ছালটাকে প্রচুর জ্বলপানে তৃপ্ত করিয়া জবেহ করিতে আনিয়াছ; আর শিমর আমার পিত্রাকে তিন দিন পর্যন্ত লাভাবে পিপাসায় দগ্ধ করিয়া জবেহ করিয়াছে!!
    কারবালার যুদ্ধের সময় জয়নাল রাগে ভুগিতেছিলেন বলিয়া শহীদ (সমরশায়ী) হন নাই।
  2. ধর্ম্মগুরু মহাত্মা মোহাম্মদের (দঃ} মৃত্যুর পর, ক্রমান্বয়ে আবুবকর সিদ্দিক, ওমর খেতাব ও ওসমান গনি “খলিফা” হইলেন। চতুর্থবারে আলী খলিফা হইবেন, কি মোয়াবীয়া খলিফা হইবেন, এই বিষয়ে মতভেদ হয়। একদল বলিল, “মোয়াবীয়া হইবেন,” একদল বলে, “আলী মোহাম্মদের (দঃ) জামাতা, তিনি সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী”। এইরূপে বিবাদের সূত্রপাত হয়।
    অতঃপর মোয়াবীয়ার পুত্র এজিদ, আলীর পুত্র হাসান ও হোসেনের সর্বনাশ করিতে বদ্ধপরিকর হইল। এজিদ মহাত্মা হাসানকে কৌশলে বিষ পান করাইয়া হত্যা করে। ইহার এক বৎসর পরে মহাত্মা হোসেনকে ডাকিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া কারবালায় লইয়া গিয়া যুদ্ধে বধ করে। কেবল যুদ্ধ নহে—এজিদের দলবল ইউফ্রেীজ নদী ঘিরিয়া রহিল; হোসেনের পক্ষের কোন লোককে নদীর জল লইতে দেয় নাই। পানীয় জলের অভাবেই তাহারা আধমরা হইয়াছিলেন। পরে যুদ্ধের নামে একই দিন হোসেন আত্মীয়স্বজনসহ নিহত হইলেন। এ কথায় মতভেদ আছে; কেহ বলেন, তিন দিন যুদ্ধ হয়, কেহ বলেন একই দিন যুদ্ধ করিয়া সকলে সমশায়ী হইয়াছেন। নদীর জল হইতে হোসেনকে বঞ্চিত করিয়া এজিদ আঁশেষ নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করিয়াছে।
    অষ্টাদশ বর্ষীয় নবীন যুবক কাসেম (হাসানের পুত্র) মৃত্যুর পূর্ব রাত্রে হোসেনের কন্যা সকিনাকে বিবাহ করেন! কারবালা যখন সকিনাকে নববধূ বেশে দেখিল, তাহার কয় ঘণ্টা পরেই তাহাকে নববিধবা বেশে দেখিয়াছিল। যেদিন বিবাহ, সেই দিনই বৈধব্য! হায় কারবাল! এ দৃশ্য দেখার চেয়ে অন্ধ কেন হও নাই? পুরুষণ ত যুদ্ধ করিতেছিলেন, আর ললনাগণ কি করিতেছিলেন?—একজনের জন্য শোক করিতেছিলেন, আর একটির সমরশায়ী হওয়া সংবাদ পাইলন!—কাসেমের জনা কঁদিতেছিলেন, আলী আকবরের মৃতদেহ পাইলেন! শোকোজ্জ্বাস কাসেমকে ছাড়িয়া আকবরের দিকে ধাবিত হইল, আকবরের মাথা কোলে লইয়া কাঁদিতেছিলেন, শিশু আসগরকে শরবিদ্ধ অবস্থায় প্রাপ্ত হইলেন! এক মাতৃ-হৃদয়—আকবরকে কোল হইতে নামাইয়া আসারকে কোলে লইল—ক সহ্য হয়? পুত্রশোকে আকুলা আছেন, কিছুক্ষণ পরে সর্বস্বধন হোসেনের ছিন্ন মস্তক (শত্রু উপহার পাঠাইল পাইলেন, তাই দেখিতেছেন, ইতোমধ্যে (হোসেনের কন্যা) বালিকা ফাতেমা পিতার মাথা দেখিয়া কাঁদিয়া আকুল হইল, শহরবানু তাহার জন্য সান্ত্বনার উপায় খুঁজিতেই ছিলেন—ফাতেমার শ্বাসরোধ হইল! ক্ষুধায় পিপাসায় কাতর বালিকা কত সহিবে? হঠাৎ প্রাণত্যাগ করিল! শহরবানু এখন সকিনার অশ্রু মুছাইবেন, না ফাতেমাকে কোলে লইবেন?
    আহা! এত যে কেহই সহিতে পারিবে না! আমার শােকসন্তপ্ত পূত্র-শাকাতুর ভগিনীমণি তােমরা একবার শহরবানু ও জয়নবের শােকরাশির দিকে দৃষ্টিপাত কর। তােমরা একজনের শােকেই বিহ্বল হও —দশদিক অন্ধকার দেখ! আর এ যে শােকসমূহ আঘাতের উপর আঘাত। তোমরা এক সময় এক ক্রনের বিরহে প্রাণ ভরিয়া দিতে পার, তাহাদের সে অবসর ছিল না! এক জয়ন কি করিবেন বল, নিজের পুত্রের জন্য কাদিবেন, না প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্রদের দিকে চাহিবেন, না সব ছাড়িয়া ভ্রাতা হােসেনের ক্ষত ললাটখানি অশ্রুধারায় ধুইবেন? সেখানে অশ্রু ব্যতীত আর জল ত ছিল না।
    ধীরহৃদয়! একবার হােসেনের বীরতা সহিষ্ণুতা দেখ! ঐ দেখ, তিনি নদীবক্ষে দাড়াইয়া আর কোন যােদ্ধা নাই, সকলে সমরশায়ী, এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা। তিনি কোন মতে পথ পরিষ্কার করিয়া নদী পর্যন্ত গিয়াছেন। ঐ দেখ অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিলেন, বুঝি পান করেন; না, পান ত করিলেন না!—য জলের জন্য আর তাঁহারই কোলে প্রাণ হারাইয়াছে, আকবর তাঁহার রসনা পর্যন্ত চুষিয়াছেন—সেই জল তিনি পান করিবেন? না,—তিনি জ্বল তুলিয়া দেখিলেন, ইচ্ছা করিলে পান করিতে পারেন। কিন্তু তাহা না করিয়া নদীর জল নদীতেই নিক্ষেপ করিলেন। বীরের উপযুক্ত কাজ!!
    মহরমের সময় সুন্নি-সম্প্রদায় শিয়ালে আমাদের জন্য যােগ দেয় না। একথা যে বলে, তাহার ভুল, -শােচনীয় ভুল। আলী ও তদীয় বংশধরগণ উভয় সম্প্রদায়েরই মান্য ও আদরণীয়। র্তাদের শােচনীয় মৃত্যু স্মরণ সময়ে কোন্ প্রাণে সুন্নিগণ আমােদ করিবে? আমােদে করে লকদল, সহৃদয় সূন্নিদল মহরমকে উৎসব বলে না।
    শিয়াদের বাহ্য আড়ম্বর সুন্নিগণ ভাল মনে করেন না। বক্ষে করাঘাত করিলে বা শেক-বস্ত্র পরিধান করিলেই যে শােক করা হইল, সুন্নিদের এরূপ বিশ্বাস নহে। মতভেদের কথা এই যে, শিয়াণ হজরতা আয়ষা—ফাতেমার বিমাতা সিংহাসন আলীকে না দিয়া মােয়াবীয়াকে দিয়াছেন বলিয়া আয়ষাকে নিন্দা করে। আমরা আয়ষার (আলীর সংশাশুড়ী হওয়া ব্যতীত আর কোন দোষ দেখি না। চতুর্থ খলিফা কে হইবেন, ধর্ম্মগুরু মােহাম্মদ (দঃ) তাহার নাম স্পষ্ট না বলিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়াছেন। সে নির্দিষ্ট ব্যক্তি মােয়াবীয়া কিম্বা আলী তাহারা উভয়ে একই স্থানে দণ্ডায়মান ছিলেন। এই মতভেদ হইল। কেহ বলিল “চতুর্থ খলিফা মােয়াবীয়া, কেহ বলিল “আলী"।
    আয়ষা হিংসা করিয়া বলেন নাই, সিংহাসন মােয়াবীয়া পাইবেন। তিনি ঐ অনুমানের কথাই বলিয়াছিলেন মাত্র। সুন্নিগণ মাননীয়া আয়ষার নিন্দা সহ্য করিতে পারেন না। শিয়া সুন্নিতে এইটুকু কথার মতভেদ। এই বিষয় লইয়াই দলাদলি।