রোকেয়া রচনাবলী/মতিচূর (প্রথম খণ্ড)/বোরকা

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

বােরকা

আমি অনেক বার শুনিয়াছি যে আমাদের “জঘন্য অবরােধ প্রথা”ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাহারা প্রায়ই আমাকে “বােরকা” ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিষটা কি? তাহ কি কেবল বােরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে কি বুঝিব যে জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলােকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে?

 আমাদের ত বিশ্বাস যে অবরােধের সহিত উন্নতির বেশী বিরােধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। কেহ কেহ বলেন যে ঐ উচ্চশিক্ষা লাভ করিতে হইলে এফ,এ, বি,এ, পরীক্ষার জন্য পর্দা কাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (University Hall-এ) উপস্থিত হইতে হইবে | এ যুক্তি মন্দ নহে! কেন? আমাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় (University) হওয়া এবং পরীক্ষক স্ত্রীলােক হওয়া কি অসম্ভব? যতদিন এইরূপ বন্দোবস্ত হয়, ততদিন আমাদের পাশকরা বিদ্যা না হইলেও চলিবে।

 অবরােধ প্রথা স্বাভাবিক নহে—নৈতিক। কেননা পশুদের মধ্যে এ নিয়ম নাই। মনুষ্য মে সভ্য হইয়া অনেক অস্বাভাবিক কাজ করিতে শিখিয়াছে। যথা—পদব্রজে ভ্রমণ করা

স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষে সুবিধার জন্য গাড়ী, পাল্কী প্রভৃতি নানাপ্রকার যানবাহন প্রস্তুত করিয়াছে। সঁতার দিয়া জলাশয় পার হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষে নানাবিধ জলযান প্রস্তুত করিয়াছে। তাহার সাহায্যে সঁতার না জানিলেও অনায়াসে সমুদ্র পার হওয়া যায়। ঐরূপ মানুষের অস্বাভাবিক” সভ্যতার ফলেই অন্তঃপুরের সৃষ্টি।

 পৃথিবীর অসভ্য জাতীরা অৰ্দ্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। ইতিহাসে জানা যায়, পূর্বে অসভ্য ব্রিটনেরা অর্ধনগ্ন থাকিত। ঐ অর্ধনগ্ন অবস্থার পূর্বে গায় রঙ মাখিত! ক্রমে সভ্য হইয়া তাহারা পােষাক ব্যবহার করিতে শিখিয়াছে।

 এখন সভ্যতাভিমানিনী (Civilized) ইউরােপীয় এবং ব্রাহ্মসমাজের ভগ্নীগণ মুখ ব্যতীত সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া হাটে মাঠে বাহির হন। আর অন্যান্য দেশের মুসলমানেরা (ঘরের বাহির হইবার সময় মহিলাদের মুখের উপর আরও একখণ্ড বাবরণ (বােরকা) দিয়া ঐ অঙ্গাবরণকে সম্পূর্ণ উন্নত (perfect) করিয়াছেন। যাহারা বােরকা ব্যবহার করেন না, তাহারা অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকেন। কেহ কেহ বােরকা ভারী বলিয়া আপত্তি করেন। কিন্তু তুলনায় দেখা গিয়াছে ইংরাজ মহিলাদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বােরকা অধিক ভারী নহে।

 পর্দা অর্থে ত আমরা বুঝি গােপন করা বা হওয়া, শরীর ঢাকা ইত্যাদি—কেবল অন্তঃপুরের চারি-প্রাচীরের ভিতর থাকা নহে। এবং ভালমতে শরীর আবৃত না করাকেই “বে-পর্দা” বলি। যাহারা ঘরের ভিতর চাকরদের সম্মুখে অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় থাকেন, তাহাদের অপেক্ষা যাহারা ভালমতে পােষাক পরিয়া মাঠে বাজারে বাহির হন, তাহাদের পর্দা বেশী রক্ষা পায়।

 বর্ত্তমান যুগে ইউরােপীয়া ভগ্নীগণ সভ্যতার চরম সীমায় উঠিয়াছেন; তাঁহাদের পর্দা নাই কে বলে? তাহাদের শয়নকক্ষ, এমনকি বসিবার ঘরেও কেহু বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেন। এ প্রথা কি দোষণীয়? অবশ্য নহে। কিন্তু এদেশের যে ভগ্নীরা বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহাদের না আছে ইউরােপীয়াদের মত শয়নকক্ষের স্বাত (bedroom privacy) না আছে আমাদের মত বােরকা!

 কেহ বলিয়াছেন যে “সুন্দর দেহকে বােরকা জাতীয় এক কদর্য ঘােমটা দিয়া আপাদমস্তক ঢাকিয়া এক কিম্ভুত কিমাকার জীব সাজা যে কি হাস্যকর ব্যাপার যাহারা দেখিয়াছেন, তঁহারাই বুঝিতে পারিয়াছেন” ইত্যাদি। তাহা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যে রেলওয়ে প্লটফরমে দাড়াইয়া কোন সম্রান্তু মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে তাহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। বরং কুলকামিনীগণ মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য দেখাইয়া সাধারণ দর্শকমণ্ডলীকে আকর্ষণ করাই দোষণীয় মনে করিবেন।

 ইংরাজী আদব কায়দা (etiquette)ও আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে ভদ্রমহিলাগণ আড়ম্বররহিত (simple) পােষাক ব্যবহার করিবেন—বিশেষতঃ পদব্রজে ভ্রমণ কালে চাকচিক্যময় বা আঁকজমক-বিশিষ্ট কিছু ব্যবহার করা তাহাদের উচিত নহে।[১]

 নিমন্ত্রণ ইত্যাদি রক্ষা করিতে যাইলে মহিলাগণ সচরাচর উৎকৃষ্ট পরিচ্ছদ ও বহুমূল্য অলঙ্কার ব্যবহার করিয়া থাকেন। গাড়ী হইতে নামিবার সময় ঐ পরিচ্ছদ রূপ আভরণ কোচম্যান দ্বারবান প্রভৃতির দৃষ্টি হইতে গােপন করিবার জন্য একটা সাদাসিধা (simple) বােরকার আবশ্যক হয়। রেলওয়ে ভ্রমণ কালে সাধারণের দৃষ্টি (public gaze) হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ঘােমটা কিম্বা বােরকার দরকার হয়।

 সময় সময় ইউরােপীয় ভগ্নীগণও বলিয়া থাকেন, “আপনি কেন পর্দা ছাড়েন না (Why don't you break off purdah)?” কি জ্বালা! মানুষে নাকি পর্দা ছাড়িতে পারে? ইহাদের মতে পর্দা অর্থে কেবল অন্তঃপুরে থাকা বুঝায়। নচেৎ তাহারা যদি বুঝিতেন যে তাহারা নিজেও পর্দার (অর্থাৎ privacyর) হাত এড়াইতে পারেন না, তবে ওরূপ বলিতেন না। যদিও তাঁহাদের পােষাকেও সম্পূর্ণ পর্দা রক্ষা হয় না, বিশেষতঃ সান্ধ্য-পরিধেয় (evening dress) ত নিতান্তই আপত্তিজনক। তবু তাহা বহু কামিনীর একহারা মিহি সাড়ী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

 তারপর অন্তঃপুর ত্যাগের কথা—অন্তঃপুর ছাড়িলে যে কি উন্নতি হয়, তাহা আমরা ত বুঝি না। প্রকারান্তরে উক্ত স্বাধীনা রমণীদেরও ত শয়নকক্ষরূপ অন্তঃপুর আছে।

 মােটের উপর আমরা দেখিতে পাই সকল সভ্যজাতিদেরই কোন না কোন রূপ অবরােধ প্রথা আছে। এই অবরােধ-প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে? এমন পবিত্র অবরােধ-প্রথাকে যিনি “জঘন্য” বলেন, তাঁহার কথার ভাব আমরা বুঝিতে অক্ষম।

 সভ্যতা (civilization)-ই জগতে পদা বৃদ্ধি করিতেছে। যেমন পূর্বে লােকে চিঠিপত্র কেবল ভাঁজ করিয়া পাঠাইত, এখন সভ্য (civilized) লােকে চিঠির উপর লেফাফার আবরণ দেন। চাষারা ভাতের থালা ঢাকে না; অপেক্ষাকৃত সভ্য লােকে খাদ্য সামগ্রীর তিন চারি পাত্র একখানা বড় থালায় (tray-তে রাখিয়া উপরে একটা “খানপােষ” বা “সরপােষ” 15াকা দেন; যাহারা আরও বেশী সভ্য তাহাদের খাদ্য বস্তুর প্রত্যেক পাত্রের স্বতন্ত্র আবরণ থাকে। এইরূপ আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে, যেমন টেবিলের আবরণ, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়-ইত্যাদি।

 আজিকালি যে সকল ভগ্নী নগ্নপদে বেড়াইয়া থাকেন, তাহাদেরই আত্মীয়া সুশিক্ষিত {enligthtened) ভগ্নীগণ আবার সভ্যতার পরিচায়ক মােজা জুতার ভিতর পদযুগল আবৃত করেন। ক্রমে হাত ঢাকিবার জন্য দস্তানার সৃষ্টি হইয়াছে। তবেই দেখা যায়—সভ্যতার (civilization-এর) সহিত অবরােধ প্রথার বিরােধ নাই।

 তবে সকল নিয়মেরই একটা সীমা আছে। এদেশে আমাদের অবরােধ-প্রথাটা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। যেমন অবিবাহিতা বালিকাগণ স্ত্রীলােকের সহিতও পর্দা করিতে বাধ্য থাকেন! কখন কোন প্রতিবেশিনী আসিয়া উপস্থিত হইবে, এই ভয়ে নবম বর্ষীয়া বালিকা প্রাঙ্গণে বাহির হয় না। এই ভাবে সর্বদা গৃহকোণে বন্দিনী থাকায় তাহাদের স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয়। দ্বিতীয়তঃ তাহাদের সুশিক্ষার ব্যাঘাত হয়। যেহেতু খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কীয়া আত্মীয়া ব্যতীত তাহারা অন্য কাহাকেও দেখতে পায় না, তবে শিখিবে কাহার নিকট? নববধূদের অন্যায় পর্দাও উল্লেখযোগ্য। তাহারা বিবাহের পর প্রথম দুই চারি মাস কেবল “জড় পুত্তলিকা” সাজিয়া থাকিতে বাধ্য হন। ঐরূপ কৃত্রিম অন্ধ ও বোকা হইয়া থাকায় কেমন অসুবিধা ভোগ করিতে হয়, তাহা যে সশরীরে ভোগ করে, সেই জানে!! কথিত আছে, কোন সময় একটি সভ্রান্ত পরিবারের নববধূর পৃষ্ঠে ঘটনাক্রমে বৃশ্চিক দংশন করে—তিনি সে যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করিয়াছিলেন। তৃতীয় দিবস “চৌথীর স্নানের সময় অন্য স্ত্রীলোকেরা তাহার পৃষ্ঠের ক্ষত দেখিয়া দুঃখিত হইয়াছিল! আজি কালি বৃদ্ধাগণ খুব প্রশংসার সহিত ঐ বধূটির উপমা দিয়া থাকেন! বোধ হয় বৃশ্চিকটা খুব বিষাক্ত ছিল না!

 যাহা হউক ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম (moderate) করিতে হইবে। অনেক পরিবারে মহিলাগণ ঘনিষ্ট কুটুম্ব ব্যতীত অপর কাহারও বাটী যাতায়াত করেন না। ইহাতে পাচ রকমের স্ত্রীলোকের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইতে পারে না বলিয়া তাঁহারা একেবারে কুপমণ্ডুক হইয়া থাকেন। অন্তঃপুরিকাদের পরস্পর দেখা শুনা বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুরুষেরা যেমন সকল শ্রেণীর লোকের সহিত আলাপ করিয়া থাকেন, আমাদেরও অজ্রপ করা উচিত। অবশ্য আঁহাদিগকে আমরা ভদ্র-শিষ্ট বলিয়া জানি, কেবল তহ্যদের সঙ্গে মিশির,—তাঁহারা যে কোন ধর্মাবলম্বিনী (য়িহুদী, নাসারা, বুৎপুরস্ত বা যাই হউন, ক্ষতি নাই। এই যে “গয়ের মজহব” বিশিষ্ট স্ত্রীলোকের সহিত পর্দা করা হয়, ইহা ছাড়িতে হইবে। আমাদের ধর্ম ত ভঙ্গপ্রবণ নহে, তবে অন্য ধর্মাবলম্বিনী স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা হইলে ধর্ম্ম নষ্ট হইবে, এরূপ আশঙ্কার কারণ কি?

 আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয়। তবে সে জন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস (practice) চাই; বিনা অভ্যাসে কোন কাজটা হয়?

 সচরাচর বোরকার আকৃতি অত্যন্ত মোটা (course) হইয়া থাকে। ইহাকে কিছু সুদর্শন (fine) করিতে হইবে। জুতা কাপড় প্রভৃতি যেমন ক্রমশঃ উন্নতি প্রাপ্ত হইয়াছে, সেইরূপ বোরকারও উন্নতি প্রার্থনীয়। যে বেচারা বোরকা সুদূর আরব হইতে এদেশে আসিয়াছে, তাহাকে হঠাৎ নির্বাসিত করিলেই কি আমরা উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠিব?

 সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই—শিক্ষার অভাবে হইয়াছে। সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তিগুলি এমন সঙ্কুচিত হইয়াছে। ললনাকুলের ভীরুতা ক্রমে বালকদের হৃদয়ে সংক্রামিত হইতেছে। পঞ্চম বর্ষীয় বালক যখন দেখে যে তাহার মাতা পতঙ্গ দর্শনে মূর্ছিত্র হন, তখন কি সে ভাবে না যে পতঙ্গ বাস্তবিকই কোন ভয়ানক বস্তু?

 এইখানে বলিয়া রাখি যে কীট পতঙ্গ দেখিয়া মূর্ছা যাওয়ার দোষে কেবল আমরা দোষী নহি। সুসভ্যা ইংরাজ রমণীও এ অপবাদ হইতে মুক্তি পান না। “গালিভরের ভ্রমণ” নামক পুস্তকে ("Gullivers' Travels”-এ দেখা যায়, যখন ডাক্তার গালিভর “ব্রবডিঙ্গন্যাগ” (Brobdingnag)-দের দেশে গিয়া শস্যক্ষেত্রে সভয়ে বিচরণ করিতেছিলেন, তখন একজন ব্রডিন্যায় তাঁহাকে হাতে তুলিয়া লইয়া আপন স্ত্রীকে দেখাইতে গেল! ইংরাজ-ললনা যেমন কীট পতঙ্গ বা মাকড়সা দেখিয়া ভীত হন, বুবডিঙ্গনাগ রমণীও তদ্রপ ডাক্তার গালিভরকে দেখিয়া ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল!! কারণ দীর্ঘকায়া ব্রবডিঙ্গনব্যাগ রমণী ডাক্তারকে একটি ক্ষুদ্র কীট-বিশেষ মন করিয়াছিল!! তাই বলি পর্দা ছাড়িলেও পতঙ্গ ভীতি দূর হয় না! “

 পতঙ্গ-ভীতি দূর করিবার জন্য প্রকৃত সুশিক্ষা চাই—যাহাতে মস্তিষ্ক ও মন উন্নত (brain ও mind cultured) হয়। আমরা উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না। যতদিন আমরা আধ্যাত্মিক জগতে পুরুষদের সমকক্ষ না হই, ততদিন পর্যন্ত উন্নতির আশা দুরাশা মাত্র। আমাদিগকে সকলপ্রকার জ্ঞানচর্চা করিতে হইবে।

 শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দুরদশী ভাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে ইহাতে তাহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাহারা জাগিয়া উঠিতে ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন। আমি ইতঃপূর্বেও বলিয়াছি যে “নর ও নারী উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না। এখনও তাহাই বলি। এবং আবশ্যক হইলে ঐ কথা শতবার বলিব।

 এখন ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই—তাহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কতা করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনির্ব্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর-শোভন অলঙ্কার ছাড়িয়া জ্ঞান-ভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ অমূল্য অলঙ্কার:

“চোরে নাহি নিতে পারে করিয়া হরণ,
 জ্ঞাতি নাহি নিতে পারে করিয়া বণ্টন,
দান কৈলে ক্ষয় নাহি হয় কদাচন,
এ কারণে বলে লোকে বিদ্যা মহাধন।”

 আমি আরো দুই চারি পংক্তি বাড়াইয়া বলি:

অনলে না পারে ইহা করিতে দহন,
সলিলে না পারে ইহা করিতে মগন,
অনন্ত অক্ষয় ইহা অমূল্য রতন,
এই ভূষা সঙ্গে থাকে যাবত জীবন!

 তাই বলি অলঙ্কারের টাকা দ্বারা “জেনানা স্কুলের আয়োজন করা হউক। কিন্তু ভগ্নীগণ যে স্কুল লাভের জন্য সহজে গহনা ত্যাগ করিবেন, এরূপ ভরসা হয় না। দুঃখের কথা কি বলিব, আমার ভগ্নীদিগকে বোধ হয় এক প্রকার গৃহসামগ্রীর মধ্যে গণনা করা হয়! তাই টেবিলুটা যেমন ফুল পাতা দিয়া সাজ্জান হয়; জানালার পর্দাটা যেমন ফুলের মালা, পুঁতির মালা বা ড্রপ অন্য কিছু দ্বারা সাজান হয়, সেইরূপ গৃহিণী আপন পুত্রবধূটিকেও একরাশি অলঙ্কার দ্বারা সাজান আবশ্যক বোধ করিয়া থাকেন! সময় সময় ভ্রাতাগণ আমাদিগকে “সোণা-রূপা রাখিবার স্তম্ভ (stand) বিশেষ” বলিয়া বিদ্রুপ করিতেও ছাড়েন না! কিন্তু “চোরা না শুনে ধরম কাহিনী”!

 যাহা হউক, পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাটা হইয়া পাঁড়ায় নাই। এখন আমাদের শিক্ষয়িত্রীর অভাব আছে। এই অভাবটি পূরণ হইলে এবং স্বতন্ত্র স্কুল কলেজ হইলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করিয়াও উচ্চশিক্ষা লাভ হইতে পারে। প্রয়োজনীয় পর্দা কম করিয়া কোন মুসলমানই বোধ হয় শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হইবেন না।[২]

 আশা করি, এখন আমাদের উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তা ভগ্নীগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে বোরকা জিনিষটা মোটের উপর মন্দ নহে।

  1. ঐ উপদেশে আমরা কোরাণ শরীফের অষ্টাদশ “পারার “সুরা নূরের একটি উক্তির প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই। যথা-“বিশ্বাসী স্ত্রীলােকদিগকে বল, তাহারা যেন দৃষ্টি সতত নীচের দিকে রাখে (অর্থাৎ চঞ্চল নয়নে ইতস্ততঃ না দেখে!) এবং তাহারা যেন আভরণ (বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ব্যতীত) অর্য লােককে না দেখায়।”
  2. এই সন্দর্ভটি লিখিত হইবার পর বর্ত্তমান ছোটলাট sir Andrew Fraserএর “The purdah of ignorance” শীর্ষক বক্তৃতার অংশবিশেষ দৃষ্টিগোচর হইল। তিনি বলিয়াছেন—“Let the efforts of educationists be first directed to the instruction of our girls within the purdah, and let woman begin to exercise her chastening influence on society in spite of the system of seclusion, which only time can modify and violent efforts to shake which can only arouse opposition to female education, instead of doing any immediate practical good in the direction, of emancipation of women.” (গত ৮ই মাষ্টের “Telegraph” সংবাদপত্র হইতে উদ্ধৃত হইল।)
    আমাদের মতের সহিত ছোটলাট বাহাদুরের মতের কি আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখা যায়।